রিহান একবার নিশানের দিকে আরেকবার মিলির দিকে তাকায়।তারপর কোনো প্রকার মন্তব্য না করে মাথা নিচু করে বসে থাকে।নিশান গিয়ে রিহানের পাশে বসে।নিশান রিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,”মেয়েটার নাম কি?”
রিহান কোনোপ্রকার উত্তর দেয় না।কিন্তু নিশানও নাছোড়বান্দা।সে পুনরায় আবার জিজ্ঞাসা করে।এবার জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে রিহান খানিকটা রাগি গলায় বলে,
“আপনাকে কেন বলবো?”
নিশান এবার উঠে গিয়ে মিলির পার্শে দাঁড়ায়।মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“তুই গাড়িতে ওঠ।আমি ওনাকে গাড়িতে তোলার ব্যবস্তা করছি।” এইকথা বলার সাথে সাথে মিলি গাড়িতে উঠে বসে।নিশান ড্রাইভারের সাথে কিছু কথা বলে।ড্রাইবার গাড়ি থেকে নেমে নিশানের সাথে আস্তে আস্তে করে এগোতে থাকে।নিশান আস্তে আস্তে রিহানের পিছন দিক দিয়ে আগাতে থাকে।তার পিছন পিছন চলতে থাকে ড্রাইবার।মিলি তাদের আগানো দেখে মুখ লুকিয়ে হাসতেছে।রিহান মাথা নিচু করে বসে আছে।
হঠাৎ রিহানের মনে হয় তাকে পিছন থেকে তুলে ধরে দৌড়ানো হচ্ছে।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।এদিকে ড্রাইভার আর নিশান রিহানকে পিছন থেকে তুলে ধরে গাড়িকে লক্ষ্য করে দৌড়াচ্ছে।একপর্যায়ে তারা গাড়ির সামনে আসতেই ঝট করে দরজা খুলে দেয় মিলি।নিশান রিহানকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে টপাটপ গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয়।ড্রাইভার আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে বিন্দুমাত্র সময় দেরি না করে গাড়ি চালাতে শুরু করে।রিহান গাড়িতে উপস্তিত সবার দিকে থ মেরে তাকিয়ে আছে।নিশান এবার সামনের সিট থেকে পিছনে ঘুরে বসে।রিহান আর তার মধ্যে চোখাচোখি হয়ে যায়।মিলি এবার নিশানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভাইয়া তোর ইমপর্টেন্ট কাজটা কখন?”
নিশান কিছু না বলে রিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভাই এবার আপনি বলুন আপনার জীবন কাহিনীটা।আমরাও শুনি।প্লিজ বলুন না।প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ।”
নিশানের এরকম অনুরোধ করা দেখে মিলিও রিহানকে অনুরোধ করে।শেষ পর্যন্তু রাজি হয়ে যায় রিহান।তবে শর্ত দেয় সে মেয়েটার নাম বলতে পারবে না।তার এই শর্ত চিরধার্য বলে মেনে নেয় উপস্তিত সবাই।রিহান এবার বলতে শুরু করে,
“২০১৫ সালের শেষের দিকে বিদেশ থেকে ১৫দিনের ছুটিতে বাসায় আসি।বাসায় এসে এমন এক কথা শুনতে পাই যা জীবনেও কল্পনা করতে পারিনি।আমার সৎ বাবা-মা একজন বাবার কাছ থেকে ১০লক্ষ টাকা নিয়েছে।তারা বলেছে আমি দেশে ফিরলেই আমার সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিবে।এই শর্ত দেয়ায় রাজি হয়ে যান তিনি।অপেক্ষা করতে থাকেন আমি আসার।যেদিন আমি আসি সেদিনই তিনি বিয়ের আয়োজন শুরু করেন।বিয়েতে আমার একবিন্দুও মত ছিল না।কিন্তু মা-বাবা মারা যাওয়ার পর যারা আমাকে এতদিন লালন-পালন করেছেন তাদের কথায় না করতে পারিনি।সেদিন মেয়ে দেখে আসি।মেয়েটাকে পছন্দ হয় আমার।তারপর বিয়েতে আর কোনো অমত থাকে না।”
এতদুর বলে একটু থামে রিহান।সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।ড্রাইভার চোখটা সামনে রাখলেও কানটা রেখেছে রিহানের কথায়।রিহান আবার বলতে শুরু করে,
“পরেরদিন কিছুটা ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা সম্পুর্ন হয়ে যায়।সেদিনই বুঝেছিলাম আমার সৎ বাবা-মা শুধু মাত্র টাকার জন্য মেয়েটাকে এ বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছে।তবুও কিছু না বলে চুপচাপ ছিলাম।বিয়ের পরের কয়েকদিন এপাশ-ওপাশ দাওয়াত খেতে খেতে কেটে যায়।ঘনিয়ে আসে আমার ছুটির অন্তিম মুহুর্ত।আজ বাদে কালকে বিদেশে চলে যাব।যাওয়ার সময় তাকে বলেছিলাম,খুব শিঘ্রই আমি ফিরে আসবো।”
এই বলে কিছুক্ষন থেমে থাকে আবার বলতে শুরু করে রিহান,
“সেখানে পৌছে প্রথমে তাকে ফোন দিলে ফোনটা ওয়েটিং দেখাচ্ছিল।মনে করলাম বাসার কারো সাথে কথা বলছিল মনে হয়।তারপর ফোন ধরে সে।তাকে জানাই আমি চলে এসেছি।সেদিন থেকে আবার আগের মতো কাজ শুরু করি।দিনে একবার করে বাসায় কথা বলতাম।তবে তখন অবশ্য খুব ভালোভাবে আমার সাথে কথা বলতো।কিন্তু তার মনে মনে যে এত খারাপ মতলব ছিল তা ভাবতেও পারিনি।আমার রুমের পাশের রুমের ছেলে গুলো খুব বাজে কাজ করতো।কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসতাম বলে এসব থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসেনি।সে পরকিয়ায় মেতে উঠেছিল।অবশেষে প্রেগন্যান্টও হয়েছিল।আমার সৎ বাবা-মা তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।আমি দেশে ফিরলে আমাকেও বাসা থেকে বের করে দিল।”
নিশান এবার রিহানকে বলে,”আপনার তার সাথে দেখা করার ইচ্ছে আছে!”
রিহান নিশানের দিকে তাকিয়ে বলে,”তার সাথে দেখা করে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞাসা করবো,কেন সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো?”
মিলি এতক্ষন সব শুনছিল।গাড়ি এসে তাদের বাসার সামনে থামে।মিলি সর্বপ্রথম গাড়ি থেকে নামে।তারপর নিশান,পরিশেষে গাড়ি থেকে নামে রিহান।নিশান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে গাড়ি ওয়ালার ভাড়া পরিশোধ করে দেয়।গাড়ি ওয়ালা সেখান থেকে চলে গেলে নিশান আর মিলি সেখান থেকে রিহানকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।মিলি অবাক হয়ে বাড়িটাকে দেখছে।দীর্ঘ ৪বছর ধরে এ বাড়ি ছেড়ে বাহিরে রয়েছে সে।
ভিতরে প্রবেশ করে নিশান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রায় চমকে ওঠে।ও মাই গড ২ঘন্টা পার হয়েছে।নিশান আর একমুহুর্ত দেরি না করে মিলিকে বলে রিহানকে দেখে রাখতে।এই বলে সে রাস্তায় বের হয়ে পড়ে।বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে।অনেক দেরি হয়ে গেছে।কোনদিক দিয়ে এত সময় চলে গেল বুঝতে পারছে না নিশান।শেষ পর্যন্ত একটা রিকসা আসে।নিশান রিকসা ওয়ালাকে থামিয়ে চট করে উঠে পড়ে।রিকসা চলতে শুরু করে।
প্রায় ২০মিনিট সময় লাগে মেডিকেলে পৌছাতে।নিশান তারাতারি ভিতরে প্রবেশ করে।কিছুটা দৌড়ে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে।প্রবেশ করে থমকে যায় নিশান।ডাক্তার বসে আছে আর রিমি বেডটাতে শুয়ে আছে।নিশান তারাতারি করে ডাক্তারের অনুমতি না নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে।তারপর ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ডাক্তার আজকেই কি নিয়ে যাওয়া যাবে?”
ডাক্তার না বললে নিশান জোর করে।শেষ পর্যন্ত ডাক্তার রাজি হয়।চালাক প্রকৃতির ছেলে নিশান বুঝতে পেরেছে রিহানের বউ এই রিমিই।তাই সে চাচ্ছে দুজনের দেখা করাতে।সব রেডি করে সে রিমিকে নিয়ে আস্তে আস্তে বাহিরে বের হয়।রিমি কোনো কথা বলছে না।নিশান বাহিরে বের হয়ে একটা রিকসা থামায়।তারপর রিমিকে বসিয়ে নিজে বসে।রিকসা চলতে শুরু করে।আজকে রিহান আর রিমির দেখা হবে সেটা শুধু নিশান জানে।
হঠাৎ একটা ট্রাক পাগলের মতো ছুটে আসতে শুরু করে তাদের দিকে।মনে হয় ট্রাকের চালকটার কিছু হয়েছে।রিকসাওয়ালার পা চলছেই না।রিমি চোখ বন্ধ করে নিশানকে জড়িয়ে ধরেছে।আর নিশান….
অবশেষে সেই বাচাল মহিলার হাত থেকে মুক্তি মেলে রিমির।তাকে এই অবস্তান থেকে মুক্ত করে নিশান।সে এসে রিমিকে সেখান থেকে নিয়ে যায়।সব শেষে তারা সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বের হয়ে যায় মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।লক্ষ্য অপারেশন।
রাস্তায় প্রায় ১০মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কোনো রিকসার দেখা মিলছে না।রিমি নীল রংয়ের একটা জামা পড়েছে।জামাটা নিশানের বোনের।অবশেষে একটা রিকসা আসে তাদের সামনে।নিশান সব ঠিক করে প্রথমে রিমিকে রিকসায় উঠিয়ে দেয়।তারপর নিজে উঠে রিকসাওয়ালাকে অনুমতি দেয় রিকসা চালানোর।রিকসা ওয়ালা অনুমতি পেয়ে চলতে শুরু করে।নিশান তাকিয়ে আছে তার ডানদিকে।সে চলন্ত রিকসায় বসে রাস্তা দেখছে।একপর্যায়ে রিমি হুট করে জিজ্ঞাসা করে,
“আপনার বোনের নাম কি?”
নিশান খানিকটা সময় পড়ে উত্তর দেয়,
“মিলি”
রিমি আর কোনো কথা না বলে চুপ হয়ে যায়।তার মনে একরকম বাজে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।তার মনের চিন্তাটা হলো নিশানের বোন রিমিকে নিয়ে।রিমি যে তার ঘরে থাকছে এটা তার পছন্দ নাও হতে পারে,আবার হতেও পারে।আরো ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবনা ভাবছে।একপর্যায়ে তারা এসে পৌছায় মেডিকেলের সামনে।নিশান রিকসাওয়ালার ভাড়া পরিশোধ করে রিমিকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।নিশান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৮:৫৮ বাজে।তারমানে ঠিক সময়ে এসেছে।নিশান রিমিকে একটা জায়গায় বসতে বলে নিজে যায় ডাক্তারের খোঁজে।কিছুক্ষন পরে সে ফিরে আসে।ধপ করে বসে পড়ে রিমির পাশের চেয়ার টায়।রিমি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কি হলো?ডাক্তার নেই?”
নিশান দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে রিমি কথার প্রতিউত্তরে বলে,
“আছে,রেডি হন আপনি।কিছুক্ষন পরই আপনাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হবে।”
কথাটা শুনে রিমির মনে একপ্রকার ভয় সৃষ্টি হয়।পেটটা আগের মতোই আছে।যদি একটু কমতো থাহলে রিমি অপারেশন করতো না।কিন্তু পেটের ফুলো তো কমছেই না বরং বাড়ছে।তাই বাধ্য হয়ে সে অপারেশন করছে।দুজনেই বসে আছে কখন তাদের ডাক পড়বে।নিশান রিমিকে নানা ভাবে নানা কথা বলছে।যেন রিমি ভয় না পায়।নিশান রিমিকে আরো একটা কথা বলে যে,
“অপারেশনের পর রিমি বাড়িতে যেতে পারবে।”
এই কথাটা শুনে রিমির মুখটা আরো কালো হয়ে যায়।সে কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে থাকে।রিমির এ অবস্তা দেখে নিশানও চুপ হয়ে যায়।
কিছুক্ষন পর রিমির ডাক পড়ে ডাক্তারের চেম্বারে।নিশান রিমির সঙ্গে চলে তাকে এগিয়ে দিতে। দুজনে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে। ডাক্তার এবার তাদের উদ্দেশ্যে করে বলে,
“নিশান সাহেব আপনি এখানে থাকুন। আমি উনাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যাচ্ছি আল্লাহ হাফেজ”
এবার তিনি রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,”চলুন আমার সঙ্গে তুমি।”
রিমি চুপ করে থেকে একবার নিশানের দিকে তাকায়। তারপর ডাক্তারের পিছন পিছন চলতে শুরু করে।নিশান ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে বাহিরে এসে মোবাইলটা নিয়ে বসে আগের জায়গাটাতে।এদিকে রিমিকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হয়েছে।কিছুক্ষণ পরেই তার অপারেশন শুরু হবে।নিসান বাহিরে বসে আছে এই মুহূর্তে তার ফোনে একটা কল আসে।সে স্কিনে তাকিয়ে দেখে তার বোনের নাম্বার।নিশান ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে বলা হয়,”ভাইয়া তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্ট একটা গাড়ি নিয়ে আসো। বাই পরে কথা হবে।”
নিজের বোনের ভাবগতি কিছুই বুঝতে পারেনা নিশান।সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এখনো রিমির অপারেশনের শেষ হতে 2 ঘন্টার মত লাগবে।এর মধ্যে সে গাড়ি নিয়ে তার বোনকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আবার এখানে আসতে পারবে।নিসান উঠে দাঁড়িয়ে বাহিরে বের হয় খুঁজতে শুরু করে একটা গাড়ি।
এদিকে অজ্ঞান অবস্থায় এখনো পড়ে আছে রিহান। হঠাৎ তার মুখে পানির ছিটা পড়ে।সে চোখ খুলে চারদিকে তাকায়।মনে করতে পারতেছেনা কিছুই। হঠাৎ করেই মনে হয় সে তো এয়ারপোর্টে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।সে ধপ করে উঠে বসে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখে পানির ছিটা দেয়া মেয়েটি। রিহান কোন বলার আগেই মেয়েটা রিহান কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আপনি এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন কেন?”
রিহান তার মাথায় হাত দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকায়। তারপর আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে বেঞ্চটাতে বসে। মেয়েটাও তার পাশে বসে।মেয়েটা রিহানকেকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আপনার নাম কি জানতে পারি!”
রিহান মাথা নাড়িয়ে বলে অবশ্যই।”আমার নাম রিহান”
আবার মেয়েটা রিহানকেকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আপনি এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন কেন?” রিহান একবার মেয়েটার দিকে তাকায় তারপর মাথা টা নিচু করে নেয়।এই মুহূর্তে তার রিমির কথা মনে হচ্ছে। সে কত বড় ভুল করেছে।রিমিকে সে ভালোবেসেছে আর রিমি তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে।
রিহান মেয়েটার সাথে কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়ায়।মেয়েটাও সাথে সাথে রিয়ানের সাথে উঠে দাঁড়ায়।রিয়ান চলতে শুরু করলে মেয়েটাও তার পেছনে পেছনে চলতে শুরু করে।একপর্যায়ে রিহান বিরক্ত হয়ে আবার বেঞ্চটাতে বসে।মেয়েটা তার পাশে বসে। মেয়েটা রিহানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমি আপনাকে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরালাম অথচ আপনি আমার উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছেন। এটা কেমন ধরনের অভদ্রতা?”
রিহান এবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে,”থ্যাংকু! আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন আর করতে হবে না।এ মুহুর্তে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করতেছে না।মাথাটা খুব ঘুরতেছে। বাড়ি যেতে হবে। ও বাড়ি কোথায় যাব আমার তো বাড়ি নেই। এখানে থাকতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত।তারপর চলে যাব।”
মেয়েটা রিহানের কোন কথা বুঝতে পারতেছেনা।তাই মেয়েটা রিয়ান কে উদ্দেশ্য করে বলে,”কি আবোল তাবোল বলছেন,একটু খুলে বলুন না।”
রিহান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে এতক্ষণ সময় হবে।মেয়েটা ঘরির দিকে তাকিয়ে বলে,”বলতে পারেন!”
মুহুর্তের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে রিহান। তার সব কথা বলা উচিত হবে কিনা এ ব্যাপারে নিয়ে ভাবতে শুরু করে।অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় বলে দেবে। আজকেই শেষ দিন তারপর আর কারো সঙ্গে দেখা হবে না।তো সে আমার জীবনের কথা জানলে সমস্যা কি?বলেই দেই!
“এই ভেবে রিয়ান বলতে শুরু করে আমি বিদেশে থাকি। কয়েক বছর আগে মানে দুই বছর আগে আমার বাবা-মা একজনের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন।আমি তাকে আমার মন প্রান উজার করে ভালোবাসি কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে নি। আমি বিদেশে থাকলে সে পরকীয়া মেতে উঠেছিল। তাই তো পেটে বাচ্চা হয়েছিল কিন্তু সেই বিষয়টিকে অস্বীকার করে।আমার সৎ বাবা মা তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।এমনিতেই আমার বাবা-মা আমাকে দেখতে পেত না,আমার টাকায় চলত দেখে আমার বউকে এতদিন রেখেছিল।কিন্তু এখন সে এত বড় অপরাধ করায় তাকে আর রাখেনি।বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।সাথে আমাকেও বের করে দিয়েছে বাসা থেকে। রিহান আর কিছু বলার আগেই তার সামনে একটা গাড়ী এসে থামে।গাড়ি থেকে উঁকি দেয় নিশান। তার মানে কি মেয়েটা নিশানের বোন?তাহলে রিহান আর রিমির দেখা হচ্ছেই?নাকি কেউ একজন চলে যাবে উপরে?
চলবে..
বুঝতে পারতেছিনা নিশান নাকি রিহান হিরো হবে।
আল্লাহ হাফেজ।
রিমি বাসাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নিশান আস্তে করে রিক্সা থেকে নেমে রিমিকে রিকশা থেকে নামতে সাহায্য করে। তারপর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে রিক্সাওয়ালার ভাড়া পরিশোধ করে।ভাড়া পরিশোধ হওয়া মাত্র রিকশাওয়ালা সেই স্থান ত্যাগ করে।রিমি নিশানকে নিয়ে একটা দরজার সামনে আসে।নিশান দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল বাজাতে শুরু করে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,কে?নিশান বাহির থেকে চিল্লিয়ে বলে,”মা!আমি”
সাথে দরজা খুলে যায়।এক বৃদ্ধ মহিলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।রিমি তাকে সালাম দেয়,তিনি সালামের জবাব দিয়ে নিশানের দিকে তাকান।তিনি নিশানকে উদ্দেশ্য করে বলেন,”কেরে”
নিশান তার মায়ের কানে কানে কি জানি বলে?তার মা রিমির দিকে তাকিয়ে বলে,”আসো ভেতরে আসো।”
নিশানের মায়ের সাথে ভিতরে প্রবেশ করে রিমি।তার পেছনে পেছনে নিশান ভিতরে প্রবেশ করে।নিশান প্রবেশ করার পর দরজাটা লাগিয়ে দেয় সে নিজেই।রিমি ভিতরে প্রবেশ করে দেখে সেখানে সোফায় বসে আছে একজন বৃদ্ধ পুরুষ।বয়স 60 কি 70 হবে।বৃদ্ধ লোকটা যে নিশানের বাবা সেটা বুঝতে কষ্ট হয়না রিমির।সে নিশানের বাবাকে সালাম দেয়।তিনি কিছুটা গম্ভীর হয়ে সালামের উত্তর দেন।
এবার নিশানের মা রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“বসো সোফায়”
রিমি আস্তে করে সোফায় বসে পড়ে।নিশান গিয়ে তার বাবার সাথে বসে পড়ে।রিমির সামনের সোফাটাতে বসেন নিশানের মা।নিশানের মায়ের কড়া দৃষ্টি রিমির দিক থেকে নড়ছে না।এবার নিশানের মা রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“তোমার নাম কি?”
রিমি মাথা নিচু করে বলে,”মাইয়া জামান রিমি।”
এবার নিশানের বাবা রিমির দিকে তার কড়া দৃষ্টি ফেলেন।তিনি তার চশমাটা ডেক্সের উপরে রাখতে রাখতে বলেন,
“আমরা তোমার ব্যাপারে সব জানি।নিশান আমাদের সব বলেছে।” রিমি খানিকটা অবাক চোখে তাকায় নিশানের দিকে।কখন নিশান এত কিছু বললো তার বাবা-মাকে।সব সময়ই তো নিশানের সাথে ছিল সে।তাহলে কখন বললো?নিশান তার চশমাটা খুলে তার বাবার চশমার পাশে রাখতে রাখতে বলে,
“বাবা কালকে ওনার অপারেশন হবে।আমি ডাক্তারকে দেখিয়েছি।”
নিশানের কথাটা শুনে তার বাবা সাথে সাথে বলে,”খুব ভালো করেছো।অপারেশনটা করেই ফেল রিমি।বেষ্ট অফ লাক।”এই কথা বলে তিনি সোফা থেকে উঠে দাড়ান।হাটতে শুরু করেন তার রুমের দিকে।কিছুদুর যাওয়ার পর আবার ফিরে আসেন।টেবিলের উপর থেকে চশমাটা নিয়ে ঝাম্মাকঝালো এক প্রকার হাসি দিয়ে চলে যান তিনি।
নীরব দর্শকের মতো সবকিছু দেখছিল নিশানের মা।শেষ মুহুর্তে তিনি উপলব্ধি করলেন যে তারও কিছু বলা উচিত।তাইতো বলার জন্য মুখ খুলতে ধরলেন।কিন্তু এই মুহুর্তে চিলের মতো তার মুখের কথা কেড়ে নেয় নিশান।সে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“মা,ওনি কোথায় থাকবেন।সারাটা দিন ধকল গেছে,এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।কালকে আবার অপারেশন।”
মুখটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ান নিশানের মা।মুখে কোনো কথা না বলে রিমিকে ইশারায় তার পিছন পিছন আসতে বলেন।রিমি নিশানের দিকে তাকালে নিশান ইশারায় তাকে বলে যেতে।রিমি উঠে দাঁড়িয়ে নিশানের মায়ের পিছন পিছন চলতে শুরু করে।নিশানের মা রিমিকে নিয়ে আসে একটা রুমে।রুমটা অনেক সুন্দর করে গোছানো।দেখে মনে হয় দীর্ঘ ২-৩ বছর ধরে কেউ এখানে থাকে না।অনেক জায়গায় ময়লা জমেছে।মাকড়সা জাল বুনেছে।
এবার রিমির মা টপ করে দরজাটা লাগিয়ে দেন।দরজা লাগিয়ে দিয়ে তিনি এমন এক হাসি দেন যেন সবেমাত্র বিট্রিশরা ইন্ডিয়া ত্যাগ করলো এবং এর পিছনে তার জোরালো অবদান রয়েছে।তিনি কিছুটা দৌড়েই রিমির সামনে এসে দাঁড়ান।ঝট করে রিমির হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দেন।প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া সব কিছু আবাল দর্শকের মতো দেখছে রিমি।তার মনে অনেক প্রশ্ন আসলেও মুখ ফুটছে না।
নিশানের মা রিমিকে উদ্দেশ্য করে এক নিশ্বাসে বলে,
“তোমার বাসা কই?তোমার কি হয়েছে?তুমি কিভাবে নিশানের সাথে দেখা করলে?তোমার শশুর বাড়ি কই?তোমার শশুরের নাম কি?তোমার স্বামী কোথায় থাকে?কি চাকরি করে?কোন দেশে থাকে?তোমার শাশুড়ি কি তোমাকে জ্বালায়?তোমার ননদ আছে?কি নাম?বিয়ে হয়েছে নাকি হয়নি?কত বছর বয়স?নিশ্চয় তোমার সাথে মিল নেই?তোমার বাবা-মা কি করে?তোমার বাবার বয়স কত?তোমার মা কি চাকরি করে নাকি গৃহিনী?”
আর কিছু বলার আগেই দরজায় আওয়াজ পড়ে।তার কথার মাঝখানে দরজায় আওয়াজ পড়ায় বেশ বিরক্ত হন মহিলা।কিছুটা অনিশ্চাসত্বে উঠে দাঁড়িয়ে দরজাটা খুলে দেন।দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে নিশানের বাবা।নিশানের বাবা খানিকটা রেগে বলে,
“কালকে মেয়েটার অপারেশন,রেষ্ট দরকার এখন।আর তুমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার সাথে প্যাকপ্যাক করছো?যাও”
গালি খেয়ে মুখ বেকিয়ে সেখান থেকে চলে যায় নিশানের মা।নিশানের বাবা রিমির দিকে তাকিয়ে একটা স্নান হাসি দিয়ে চলে যান।এতক্ষনে রিমি হাফ ছেড়ে বাঁচে।বৃদ্ধ মহিলা যে অতিরিক্ত বাচাল সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়না তাকে।কিন্তু এতটা পরিমাণে কথা বলতে পারে কোনো বাচাল সেটা রিমির জানা ছিল না।রিমি চেষ্টা করে তার মতো এক নিশ্বাসে বলতে কিন্তু পারেনা।মহিলা স্বামী ছেলেকে ভয় পায় সেটাও বুঝতে পারে রিমি।তাইতো তখন কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিল।
রিমি অতশত না ভেবে বিছানায় হেলান দেয়।মুহুর্তেই তার চোখ ঘিরাও করে নেয় ঘুমরাজ।হারিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।
————–__________
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে রিমির স্বামী রিহান।চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার।টিকিট কাটা হয়ে গেছে।কালকে সন্ধ্যায় সে চলে যাবে এখান থেকে।কবে ফিরে আসবে জানা নেই তার?তার চোখের পানি বাধ সাধছে না।তার দিকে তাকিয়ে আছে অনেকে।সে গিয়ে বসে পড়ে একটা বেঞ্চে।চোখ বন্ধ করে ভাবতে শুরু করে আগের দিন গুলোর কথা।সে রিমিকে কতটা পরিমানে ভালোবাসতো।এখনো বাসে সমানতালে।কিন্তু রিমি তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করলো,সে ভাবতেই পারছে না।তার সহপাঠী প্রবাসিরা নানা অশ্লীল কাজ করে।কিন্তু সে এসব থেকে বহু কষ্টে নিজেকে বিরত রেখেছে শুধু রিমিকে ভালোবাসে বলে।কিন্তু রিমি তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করলো।রিহান আর কিছু ভাবতে পারছে না।মাথা বনবন করে ঘুরছে তার।মুহুর্তের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রিহান।বেঞ্চ থেকে ধপকরে মাটিতে পড়ে যায় সে।
সকাল হয়েছে।নিশানদের বাড়িতে এক অন্যরকম আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করছে।দীর্ঘ ৪বছর পর বিদেশ থেকে ফিরে আসছে নিশানের ছোট বোন।সেই উপলক্ষে আনন্দের শেষ নেই।এদিকে আটটা বাজতেই নিশান এসে রিমিকে তাড়া দেয় রেডি হওয়ার জন্য।কিন্তু নিশানের বাচাল মা তাকে ছাড়ছেই না।তিনিকে রিমিকে বসিয়ে রেখে নিজের মেয়ের গুনগান গাইছেন।তার মেয়ে অমুকে ভালো,অমুকে খারাপ,ইত্যাদি ইত্যাদি।এসব শুনতে শুনতে প্রায় বিরক্ত রিমি।কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বলতে পারছে না যে,আপনি যান তো।না জানি কখন মুক্তি মেলে রিমির এই মহিলার হাত থেকে।
চলবে..
{নিশান নাকি রিহান?কে হবে হিরো,নায়ক?}
নামাজ কায়েম করুন।আল্লাহ হাফেজ।
দীর্ঘ 2 ঘন্টা হাসপাতলে অপেক্ষা করার পর অবশেষে কাঙ্খিত সময়টি সামনে এসে দাঁড়ায়।লোকটা আর রিমির ডাক পরে ডাক্তারের চেম্বারে।লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে রিমিকে বলে,চলুন আমার সাথে।
তারপর দুজনে ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করে।
যতই ডাক্তারের চেম্বারে দিকে আগাচ্ছে ততোই বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে রিমির। না জানি কি হয়?অবশেষে মনকে শক্ত করে ভিতরে প্রবেশ করে রিমি।
প
চেম্বারে প্রবেশ করতেই ডাক্তার তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,’বসুন’
লোকটা ডাক্তারের সামনের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ে।পাশের চেয়ারটায় বসতে বলে রিমিকে।রিমি পাশের চেয়ারটাতে বসে তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের দিকে।ডাক্তার তার ভারী লেন্সের চশমা টা খুলে ডেস্কের উপর রাখতে রাখতে লোকটাকে বলে,”ইনি আপনার ওয়াইফ নাকি!”
লোকটা চটপট করে উত্তর দেয়,না।ডাক্তার খানিকটা চিন্তিত হয়ে বলে,”ওহ,আপনার নাম কি যেন?”
লোকটা তার চশমা টা খুলে ডেস্কের উপর রাখতে রাখতে বলে, “নিশান”
এবার ডাক্তার চশমাটা আবার নিজের চোখে পড়তে পড়তে রিমিকে বলে,”আপনার নাম রিমি তাই না!”
রিমি নীরবে মাথা নাড়িয়ে হা বোধক উত্তর দেয়।ডাক্তার এবার রিমি আর নিশানকে কে উদ্দেশ্য করে বলে,”রিপোর্ট তো খুবই ভয়ঙ্কর এসেছে”
ভয়ংকর কথাটা শুনে রিমি আর নিশান দুজনের মনেই এক প্রকার ভয় সৃষ্টি হয়।বিশেষ করে রিমির মনে ভয় ঢুকেছে,না জানি কী হয়? যদি তার শ্বশুর শাশুড়ির কথা ঠিক হয় তাহলে তার মাথা লজ্জায় কাটা যাবে।আর যদি ঠিক না হয়,তাহলে রিমি তাদের কথার উত্তর দেওয়ার যোগ্যতা রাখবে।দুজনের এমন ভয়-ভীতি যুক্ত চেহারা দেখে ডাক্তার বলে,
“ঘাবড়ানোর কিছু নেই।বেশি ভয়ঙ্কর কিছু না।”
ডাক্তারের ঠোঁটের কোণে মুচকি এক ধরনের হাসি রয়েছে।এবার তিনি রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আপনার শশুর-শাশুড়ি কোন প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই আপনাকে বাসা থেকে বের করে দিল।এটা তাদের কি ঠিক হয়েছে?নিশান সাথে সাথে উত্তর দেয,”না একদমই ঠিক হয়নি”
ডাক্তার আবার রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আপনি বললেন, আপনার স্বামী আপনাকে ভুল বলে বুঝে চলে গেছে।এটাও তো ঠিক না।অন্তত তার উচিত ছিল আপনার কথা শোনা,তাইনা।রিমি উত্তর দেয়ার আগেই নিশান বলে,
“অবশ্যই,আমি হলে তো আগে তার কথা শুনতাম।তার সমস্যা কি? সেটা জানতে চাইতাম।দরকার হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতাম।কিন্তু তিনি পরীক্ষা করার আগেই তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন।এটা অবশ্যই ভুল সিদ্ধান্ত তার।
ডাক্তার এবার রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”রিপোর্টে একটা অদ্ভুত জিনিস এসেছে”
নিশান সাথে সাথে বলে,”কি সেই অদ্ভুত জিনিস?”
রিমিও বলে,”কি সেই অদ্ভুত জিনিস?”
ডাক্তারটা ডেস্ক এর উপরে রাখা থেকে একটা রিপোর্ট বের করে। আর একবার দেখে নিশান আর রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”অদ্ভুত জিনিসটি বড়ই বিচিত্র।আপনার পেটটা ফুলে গিয়েছে এরকম আরো তিন চার জন রোগী আমার কাছে এসেছিল।তাদের রোগ আর আপনার রোগ প্রায় সেম সেম।রিমি ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কি সেই রোগ?যার কারণে আমার পেটটা এত বড় হলো।”
ডাক্তার এবার চশমাটা ডেস্কের উপর রেখে বলে,
“আপনার পেটের ভিতর একটা টিউমার হয়েছে।আপনার অপারেশন প্রয়োজন।তবে ইচ্ছা হলে ঔষধ দিয়ে এটি নিরাময় করা যায়।”
রিমি আর নিশান দুজন দুজনের দিকে তাকায়।ডাক্তার আবার বলতে শুরু করে,
“আপনার যদি ইচ্ছে হয় অপারেশন করতে পারেন।আবার যদি ইচ্ছে না হয়,আমি ওষুধ দিচ্ছি।ওষুধ দিয়ে এটি নিরাময় করতে পারেন। তবে অপারেশনই বেস্ট।নাহ,ওষুধ দিয়ে এটি নিরাময় করা যায়,সেটাও ভালো হবে।আপনাদের যেটা ইচ্ছা হয়।”
রিমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখে এই মুহুর্তে তার অপারেশন করা ঠিক হবে না।কারণ এ সময়ে তাকে দেখার মত কেউ নেই।সে ডাক্তার কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমাকে ঔষধই দিন।”
কিন্তু নিশান সাথে সাথে উত্তর দেয়,”না আপনার এখন তাড়াতাড়ি এই পেট ফোলা কমানো দরকার।আপনি বরং অপারেশনই করুন।”
এই নিয়ে দুজনের মধ্যে খানিকটা ঝগড়া লেগে যায়।রিমি বলে, ঔষধ দিয়ে তা নিরাময় করবে।আর নিশান বলে,অপারেশন করতে হবে।মাঝখান থেকে ডাক্তার বলে
“ঔষধ দিলে কমপক্ষে হলেও চার-পাঁচ মাস লাগবে।আর অপারেশনে মাত্র 20-25 দিনের মধ্যেই সেরে যাবে।”
রিমি আর নিশানের এরকম ঝগড়া দেখে ডাক্তার আবার বলে, “আপনারা বাহিরে গিয়ে ঝগড়া করুন। আমি নেক্সট পেশেন্টকে দেখি।আর কি সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা এসে আমাকে জানাবেন।”
নিশান সাথে সাথে ডাক্তার কে উদ্দেশ্য করে বলে,”ডাক্তার আপনার কাছে কোনটা বেস্ট?অপারেশন নাকি ওষুধ?”
ডাক্তার খানিকটা চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।তিনি একবার রিমির দিকে একবার নিশানের দিকে তাকান।শেষে তিনি মুখ ফুটে উত্তর দেন,
“আমার কাছে অপারেশনই বেস্ট।কোন প্রকার রিক্স নেই।”
নিশান সাথে সাথে একগাল হাসি নিয়ে রিমির দিকে তাকায়।রিমি গভীর ভাবে চিন্তা করছে।অপারেশন করা ঠিক হবে কিনা?অবশ্য অপারেশন করলে সে তাড়াতাড়ি নিজের বাসায় ফিরে যেতে পারবে।আর ঔষুধ হলে কমপক্ষে ছয় মাস লাগবে।এতদিন সে কোথায় থাকবে?অপারেশন হলেই বা কোথায় থাকবে?তার তো যত্নের প্রয়োজন হবে তখন।কোন কাজ করতে পারবে না এতদূর হাঁটতেও পারবে না।অবশেষে রিমি আর নিশান দুজনে বাইরে বের হয়ে আসে।উদ্দেশ্য একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া।কোনটা করা ঠিক হবে?
রিমির জন্য অপারেশন নাকি ঔষধ দিয়ে রোগটা নিরাময় করা ভালো হবে।কিন্তু শুরু থেকেই নিজের সিদ্ধান্তে অটল নিশান।সে রিমিকে বারবার বলছে,অপারেশনের জন্য রেডী হতে।রিমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখছে আসলে কোনটা করা ঠিক হবে?
শেষ পর্যায়ে রিমি ভেবে দেখে ঔষধ দিয়ে নিরাময় করলে কমপক্ষে ছয় মাস তাকে বাহিরে থাকতে হবে।এতদিন সে কোথায় থাকবে? আর যদি অপারেশন করে নিরাময় করে তাহলে মাত্র 25 টা দিন থাকতে হবে। এ-কয়দিন না হয় নিশানের হাত-পা ধরে তার কাছে থেকেই ভালো হবে।রিমি নিশানের সিদ্ধান্তে রাজী হয়,কিন্তু নিশানকে উদ্দেশ্য করে বলে,”শোনেন,অপারেশন করলে আমার যত্নের প্রয়োজন হবে।কমপক্ষে হলেও 20 থেকে 30 দিন।এ কয়েক দিন আমি কোথায় থাকবো?নিশান ঝটপট রিমিকে উত্তর দেয়,
“আমি এখনো বিয়ে করিনি,আমি আর আমার বাবা-মা একসাথে থাকি।আমার সঙ্গে থাকতে পারেন।রিমি চিন্তামুক্ত হয়।শেষ পর্যন্ত সে নিশান কে বলে সে অপারেশনের রাজি।তবে মনের ভিতর এক প্রকার ভয় কাজ করছে তার।নিশানসহ দুজনই ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে।ডাক্তার তাদের দেখে সাথে সাথে বলে,”কি সিদ্ধান্ত হল?” নিশান সাথে উত্তর বলে,”আমরা কালকে অপারেশন করাবো।”
ডাক্তারের সাথে সাথে বলে,”তাহলে তো ভালই হয় তাহলে।আপনারা কাল সকাল 9টায় চলে আসবেন।একেবারে অপারেশনের জন্য রেডি হয়ে।কালকেই অপারেশন হবে।ভয়ের কিছু নেই,এটা খুব কঠিন কোনো অপারেশন নয়।নিশান আর রিমি দুজনে ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসে হসপিটাল থেকে।
বাহিরে এসে নিশান একটা রিকশাকে ডাক দেয়।রিক্সা সামনে আসতেই নিশান উঠে বসে এবং রিমিকে উঠে বসতে সাহায্য করে। রাস্তায় দু’জনে কোন প্রকার কথা-বাত্রা ছাড়াই চলে।নিশান রিকশাওয়ালাকে নিজের বাসার ঠিকানা দেয় এবং বলে এই ঠিকানায় যেতে।রিকশাওয়ালা সেই ঠিকানা অনুযায়ী চলতে শুরু করে।প্রায় 20 থেকে 30 মিনিট চলার পর রিক্সাওয়ালা এসে থামে একটা সুন্দর বাসার সামনে।রিমি অবাক হয়ে বাসাটাকে দেখছে।
লোকটা রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”বলুন এবার আপনার সমস্যা গুলো।আপনি কেন এভাবে শুয়ে আছেন?আপনার তো এখন এভাবে থাকা যাবেনা।আপনার শশুর বাড়ির লোকজন কি তা জানে না?”
প্রায় এক নিশ্বাশে কথা গুলো বলে ফেলে লোকটা।রিকসা চলছে।রিমি খানিকক্ষন লোকটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে,
“অনেক কথা,শুনতে শুনতে বিরক্ত হবেন।”
লোকটা অবাক নয়নে রিমির দিকে তাকিয়ে খানিকটা মুচকি হেসে বলে,”ওকে”
রিক্সা নিজ গতিতে চলছে।লোকটা কোন কথা বলছে না,সাথে রিমিও কোন কথা বলছে না।দুজনে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। একপর্যায়ে রিস্কা এসে থামে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে।লোকটা একলাফে রিক্সা থেকে নেমে পকেট থেকে টাকা বের করে রিকশাওয়ালাকে দেয়।রিমিকে রিকশা থেকে নামতে বলে।রিমি রিকশা থেকে নামলে,রিক্সাওয়ালা মুহূর্ত দেরি না করে সেখান থেকে চলে যায়।লোকটা একবার ভালো করে রিমির সম্পূর্ণ শরীরের দিকে তাকায়।তারপর মন্তব্য করে,
“আপনার আগে শপিংমলে যাওয়া উচিত ছিল।এ অবস্থায় এখানে আসা ঠিক হয়নি।ওকে এসেই যখন পড়েছি,ওড়নাটা ভালো করে বেঁধে নিন নিচের দিকটায়।যাতে রক্তগুলো দেখা না যায়।খাওয়া-দাওয়া করে শপিং মলে গিয়ে কাপড় কিনব।চলুন আমার সাথে ভিতরে যাই।এবার রিমি ভালো করে ওড়নাটা বেঁধে নিয়ে লোকটার সাথে চলতে শুরু করে।রেষ্টুয়েন্টে প্রবেশ করতেই কয়েকজন লোকটাকে সালাম দেয়।লোকটা তাদের কিছু কথা বলে,রিমিকে নিয়ে একটা কোণে টেবিলে বসে।রিমি মাথা নিচু করে বসে আছে। লোকটা এক নয়নে রিমির দিকে তাকিয়ে আছে।একটা ছেলে বিভিন্ন রকমের খাবার এনে টেবিলে রাখে।লোকটা চশমা খুলে রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“নিন খাওয়া শুরু করুন! আমিও খাচ্ছি আপনার সঙ্গে।”
এতটা পরিমাণে ক্ষুধা ছিল যে রিমি খপখপ করে খেতে শুরু করে।লোকটা অবাক হয়ে রিমির খাওয়া দেখছে।ক্ষুধার জ্বালায় একপর্যায়ে রিমি সব খাবারই খেয়ে ফেলে।তার এতটা পরিমাণে ক্ষুধা লেগেছিল যা বলে বোঝানোর নয়।লোকটা রিমি কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“বলুন এবার,খুব শুনতে ইচ্ছে করছে আপনার কাহিনীটা।”
রিমি আর কোন কথা না বলে ডাইরেক্ট বলতে শুরু করে,
“এই যে আমার পেটটা দেখছেন না এত ফুলে গেছে,আসলে আমি প্রেগনেন্ট নই।”
লোকটা খানিকটা তাজ্জব হয়ে বলে,”কি বললেন?”
রিমি মাথা নীচু করে বলে,”হ্যাঁ,একদিন আগেও ঠিক ছিলাম।হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখি আমার পেটটা অনেক দূর ফুলে আছে।প্রথমদিন গায়ে না লাগালেও পরের দিন সকালে উঠে দেখে পেটটা আরো ফুলে গেছে।সেদিনই সম্পূর্ণ গ্রামের রটে যায় আমি পরকীয়ায় মেতে আছি।তার উপর আবার আমার স্বামী বিদেশে থাকে। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সেটা বিশ্বাস করে নেয়।আমাকে বের করে দেয় বাসা থেকে।সেদিন ভেবেছিলাম আমার স্বামী যদি থাকতো তাহলে হয়তো আমাকে ভুল বুঝতো না।কিন্তু পরে বুঝলাম সেটাও ভুল।আমার স্বামী ও আমাকে ভুল বুঝল।সে আমার কোন কথা না শুনে আমাকে অবিশ্বাস করে চলে গেল।অন্তত তার উচিত ছিল আমার কথাটা শোনা।তাই না?”
লোকটা শুধু নীরবে মাথা নাড়ায়।আর বলে,
“আপনার স্বামী বিদেশ থেকে কবে আসছে এটা জানেন?আর কখনই বা আপনার সঙ্গে দেখা হলো?আপনি তো অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিলেন।তার পরেই তো আমি তুলে আনলাম।তার আগে কি দেখা হয়েছিল?”
রিমি মাথা নাড়িয়ে বলে হ্যা।সাথে মুখ ফুটিয়ে বলে,
“অজ্ঞান হওয়ার আগে আমি সেখানে বসেছিলাম।হঠাৎ পিছন থেকে কেউ আমার মাথায় পানি ছুড়ে মারে।আমি অবাক হয়ে পেছনে তাকালে দেখি আমার পিছনে দাড়িয়ে আছে আমার স্বামী।আমার মনটা খুশিতে নেচে ওঠে।তাড়াতাড়ি অনেক কষ্ট করে হলেও তার কাছে যেতে চেষ্টা করি।কিন্তু তার কাছে যেতেই সে খানিকটা ঘৃণিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমার মত কলঙ্কিত মেয়ে আমার কাছে আসবে না।দূরে থাকো। তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম,মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসে ছিলাম।তাও কেন আমার সাথে ঠকবাজি করলে?”
সে আর আমার কোন কথা না শুনে সেখান থেকে চলে যায়।তারপর পরেই তো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
এই কথা বলে রিমি কান্না করতে শুরু করে।রেষ্টুয়েন্টের সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।লোকটা তার হাতটা রিমির মাথার উপর রেখে বলে,”বুঝেছি,চলুন।এখন আপনাকে শপিংমলে নিয়ে যাই।তারপর ডাক্তার দেখাবো।”
রিমি নিজের চোখের পানি মুছে বলে,
“আমার জন্য কেন এত কিছু করছেন?”
লোকটা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
“মানুষ তো মানুষের জন্যই।আমি না হয় আপনার জন্য এটুকুই করছি,আপনি হয়ত আমার একদিন অনেক বড় উপকারে আসবেন।”
লোকটা উঠে দাঁড়ায়।রিমিও তার সাথে উঠে দাঁড়ায়।লোকটা চলতে শুরু করে।রিমি লোকটার পিছন পিছন হাটতে শুরু করে।লোকটা রেস্টুরেন্ট হতে বের হয়ে একটা রিকশা কে ডাক দেয়।রিক্সা তাদের সামনে থামলেই দুজনে উঠে বসে।লোকটা রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”শপিংমলে আগে চলুন।”
তারপর সম্পূর্ণ রাস্তায় তারা দুজনে কোন কথা বলে না।রিক্সাওয়ালা এসে থামে একটা শপিং মলের সামনে।আগেরবারের মতো লোকটা আবার রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে রিকশা ভাড়া পরিশোধ করে। রিমিকে নামতে বলে।রিমি আস্তে করে নেমে আসে।রিমি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় সব ঠিক আছে কিনা।লোকটা আর রিমি ভিতরে যায়।লোকটা রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আপনার কি কি প্রয়োজন বলেন?”
রিমি খানিকটা মুচকি হেসে বলে,
“এমনিতেই আপনি দয়া করে আমাকে কিনে দিচ্ছেন।তার ওপর আমি আবার আবদার করবো।না আপনার যেটা পছন্দ হয় সেটাই দিন।লোকটা খানিকক্ষণ রিমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “ওকে,আমার সাথে আমার সাথে আসেন”
তারপর লোকটা গিয়ে দাঁড়ায় একটা দোকানের সামনে।দোকানদার কে উদ্দেশ্য করে বলে,”ভাইয়া ভালো একটা শাড়ি দেখান তো অবশ্যই শাড়িটা খয়রি রঙের হতে হবে।”লোকটার কথা অনুযায়ী দোকানদার একটা শাড়ি নিয়ে আসে।শাড়িটা খুব পছন্দ হয় রিমির। সাথে লোকটারও পছন্দ হয়।সেই শাড়িটা কিনে নেয় লোকটা। রিমির হাতে দিয়ে বলে,
“যান ট্রায়াল রুম থেকে চেঞ্জ করে আসুন।”
রিমি ট্রায়াল রুমে গিয়ে কাপড় টা চেঞ্জ করে বাইরে আসে।লোকটা তার জন্য অপেক্ষা করছে।লোকটার কাছে যেতেই লোকটা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এবার চলুন ডাক্তারের কাছে।সব পরীক্ষা করে দেখা দরকার, আমারও আপনার বিষয়ে খুব কৌতুহল।”
তারা বাহির হয়ে আসে। লোকটা একটা রিক্সা ডাক দেয়।দুজনে রিক্সায় উঠে বসে। রিক্সা চলতে শুরু করে,গিয়ে থামে একটা মেডিকেলের সামনে।লোকটা রিকশা থেকে নেমে রিমিকে নামতে বলে।লোকটা ভাড়া পরিশোধ করে রিমিকে নিয়ে ভিতরে যায়। ডাক্তারকে দেখিয়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্টের অপেক্ষায় বসে থাকে।কি রিপোর্টে আসবে ভেবে পাচ্ছেনা তারা।আসলে কি তার পেটে বাচ্চার আছে নাকি অন্য কিছু?
মাঠের মাঝখানে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে রিমি। সবাই পাগল বলে চলে যাচ্ছে,কিন্তু কেউ তার দিকে আসতেছে না।এক পর্যায়ে রিমি লজ্জায় পড়ে যায়।সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না? তার এখন কি করা উচিত পরামর্শ দেয়ার মানুষ নেই। এদিকে পেটের ক্ষুধায় উঠে দাঁড়াতেও পারছে না। তারপরেও দাঁতের উপর দাঁত রেখে অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায় সে।হাঁটতে শুরু করে আবার সেই অজানা উদ্দেশ্যে।সব ছেলেরাই তার কোমরের নিচের দিকে তাকাচ্ছে,যে স্থানেটাকে সে তার ওড়না দিয়ে বেঁধে রেখেছে।ক্ষুধায় নড়াচড়া করতে পারছেনা তবুও সে হেঁটে চলেছে।পেট আগের তুলনায় আরো বেশি ফুলে গেছে।এখন তার ডাক্তার দেখানো উচিত কিন্তু খাবারের টাকা নেই যার,ডাক্তার কিভাবে দেখাবে?
একটা কুকুরেরও খাবার জোটে কিন্তু এখন তার খাবার জুটছে না।বাসায় থাকলে এতক্ষণ হয়তো কোরমা,পোলাও খেতে পারত।কিন্তু এখন তো একটা রুটি খেতে পারছে না। কষ্টে হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছে তার।কিন্তু কিছু করার নেই।চোখ দিয়ে অঝোর-ধারায় পানি পড়ছে।তার বুকটা খুব ব্যাথা করছে।বাধ্য হয়ে রাস্তাতেই শুয়ে পড়ে সে।কিছুক্ষণ পরেই অজ্ঞান হয়ে যায়।তারপর কি হয়েছে কিছু জানা নেই তার?
৩.
চোখ খুলে দেখে সে পড়ে আছে একটা মাঠের মধ্যে।মনে করার চেষ্টা করে কি হয়েছিল? একপর্যায়ে মনে পড়ে সে তো মাঠ থেকে উঠে অনেকদূর হেটে গিয়েছিল,তাহলে আবার এখানে কিভাবে আসলো?মাথাটা খুব ব্যাথা করছে।নড়তে পারছে না,সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। হঠাৎ কেউ তার মাথায় পানি ছুড়ে মারে।সে অবাক হয়ে পিছনে তাকায়।
পিছনে এমন এক ব্যক্তিকে দেখতে পায় যাকে এখানে আশা করিনি সে।তার স্বামী স্বয়ং তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে থাকা বোতলের পানি ছুড়ে মেরেছে তার দিকে। সে বিশ্বাস করতে পারতেছেনা তার স্বামী তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। যার এখন থাকার কথা কাতারে,সে কিভাবে তার পেছনে থাকতে পারে এটা সত্ত্যিই অবিশ্বাস জনক। তবুও তো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেই হবে।
অজান্তেই এক হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার মুখে। দাঁতের উপর দাঁত চেপে কষ্ট করে উঠে দাড়ায় সে। তার স্বামীর দিকে এগোতে থাকে। তার স্বামী ও তার দিকে তাকিয়ে আছে তবে মুখের মধ্যে ফুটে উঠেছে তার প্রতি ঘৃণা।তার স্বামী মূলত তাকে দেখছে না,তার পেট টাকে দেখছে।সে কাছে যেতেই তার স্বামী তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কি ভাবে করতে পারলে এরকম? আমি সত্যিই এখনো বিশ্বাস করতে পারতেছিনা।নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।কিন্তু আজ তুমি এই কাজ করলে,তোমার মুখে থু।”
রিমি কিছু বলার আগেই তার স্বামী সেখান থেকে চলে যায়।রিমি খুব ভেঙ্গে পড়ে।তার মনে একটা আশা ছিল যে তার স্বামী তাকে ভুল বুঝবে না। কিন্তু এখন তার স্বামীও তাকে ভুল বুঝল।রিমির বুক ফেটে কান্না আসে। চোখের পানি বাদ সাধছে না।খিদায় পেটটা ফেটে যাচ্ছে। রিমি কান্না করতে করতে সেখানেই বসে পরে।তার স্বামীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে সে।মনে করেছিল তার স্বামী তার পক্ষে থাকবে কিন্তু এখন তার স্বামী ও তার বিপক্ষে চলে গিয়েছে।এখন রিমি সম্পুর্ন একা। তার এখন ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।সবকিছু পরীক্ষা করে রিপোর্ট টা প্রয়োজন।যা দিয়ে সে তার শ্বশুর বাড়ির লোকের কথা প্রত্যেকটা কথার উচিত জবাব দিতে পারবে।কিন্তু খাবার টাকা নেই যার সে কিভাবে ডাক্তার কে দেখাবে?এতগুলো পরীক্ষা করবে।
চিন্তায় মাথা ভার হয়ে যাচ্ছে তার।বুঝতে পারছে কিছুক্ষণ পর আবার সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত তার কথাটাই ঠিক হয়। সে আবার অজ্ঞান হয়ে যায়।সেখানেই পড়ে থাকে।যে ওড়না দিয়ে কোমর বেঁধেছিল,রক্ত ঢেকেছিল সেই ওড়নাটা উপরে উঠে যায়।রাস্তা দিয়ে যাতায়াতরত প্রত্যেকটা পুরুষই তার দিকে তাকিয়ে ছিল।সে অজ্ঞান হয় সেখানে পড়ে আছে কিন্তু কেউ তার তার দিকে এগোচ্ছে না।
দেখতে দেখতে চার পাঁচ ঘন্টা চলে যায়।কিন্তু এখনো জ্ঞান ফিরল না রিমির।বিকেল হয়ে যায়, খেলার জন্য সেখানে ছুটে ছুটে আসতে শুরু করে বালকেরা।সবাই এসে ভিড় করে তার চারদিকে, দূর থেকে এসব দেখে সেখানে আসে একজন পুরুষ।বয়স ত্রিশের কাছাকাছি ,চোখের লেন্সের চশমা,চুলগুলো কালোও নয় সাদাও নয়।দুই রং এর মধ্যবর্তী।সে সবাইকে ছাড়িয়ে দিয়ে এসে রিমির পাশে দাঁড়ায়।পকেট থেকে একটা পানির বোতল বের করে আস্তে করে রিমির মুখে দেয়। প্রথমবারের চেষ্টায় জ্ঞান ফেরাতে পারে না সে, দ্বিতীয়বারের চেষ্টাও বিফল হয়। কিন্তু তৃতীয় বারের চেষ্টায় রিমি চোখ খোলে।
চোখ খুলে চারদিকে তাকাতে থাকে সে।মনে করতে পারছেনা কিছু।হঠাৎ কি মনে করে কোমরের দিকে হাত দেয়। হাত তুলে চোখের সামনে এনে দেখে ভিজে গেছে।মুহূর্তে সে উঠে আসা ওড়নাটা দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে ফেলে।অবাক হয়ে তাকায় পাশে থাকা মানুষটার দিকে।মানুষটা এক নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মানুষটার এরকম তাকানো দেখে রিমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়। মানুষটা সবাইকে সড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।মানুষটা রিমিকে সুন্দর করে জিজ্ঞাসা করে,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
রিমি অবাক হয়ে তাকায় লোকটার দিকে।লোকটা এমন ভাবে তার সাথে কথা বলছে যেন চেনা পরিচিত কেউ।কিন্তু আজ অব্দি লোকটাকে দেখেনি সে। রিমি লজ্জা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
ততক্ষণে সব ছেলেরাই সেখান থেকে চলে গিয়েছে। লোকটা আবার থেকে প্রশ্ন করে,
“আপনার এই সময় এখানে থাকা ঠিক নয়। আপনি এখন প্রেগন্যান্ট আর আপনি এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।চলুন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।রিমি তার কথার কোন জবাব দেয় না।লোকটা আবার একই প্রশ্ন করে তাকে।রিমি মাথা তুলে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার না খুব খিদে লেগেছে একটু খাবার কোথায় পাবো?”
লোকটা সাথে সাথে উত্তর দেয়,
“আমার সঙ্গে চলুন।আমার একটা রেস্টুরেন্ট আছে,সেখানে আপনাকে খাওয়াবো।”
রিমি লজ্জা পেয়ে বলে,থাক দরকার নেই।মানুষটা সাথে সাথে উত্তর করে,”থাক বলতে হবে না চলুন” রিমি লজ্জা নিয়ে তার সাথে হাটতে শুরু করে
৪.
লোকটার সাথে হেটেই চলেছে রিমি।কথা হচ্ছে না বিষয় নিয়ে।এতক্ষনের জার্নিতে রিমি বুঝতে পারে লোকটা খানিকটা গম্ভীরই।প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে পছন্দ করেননা।প্রচুর কষ্ট হলেও মুখে হাসি রেখে তার সাথে হেটে চলেছে রিমি।একপর্যায়ে লোকটা একটা রিকশা ডাক দেয়।তারপর দুজনে রিকসায় চড়ে বসে।লোকটা রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
রিমি পিরিয়ডের ব্যাথায় কাতড়াচ্ছে।তার দিকে যে এগোচ্ছে ৩জন যুবক সেদিকে তার খেয়াল নেই।সে ব্যাথার কারণে চারদিকের কিছুই শুনতে পারছে না।রক্তে পাজামা ভিজে গেছে তার।পেটটা অতিরিক্ত ফোলা থাকার কারণে বেশি নড়াচড়া করতেও পারছে না।ছেলেগুলো তার সামনে এসে দাঁড়ায়।রিমির চোখ দিয়ে পানির ফোয়াড়া নামছে।রিমি চোখ খুলে সামনে তাকিয়েই চমকে ওঠে।মনের ভিতরে প্রবেশ করেছে ভয় নামক জিনিসটা।ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলে ওঠে,
“তোরা হাতদুটো ধর,আমি আগে কাজটা সেরে নেই।রক্ত গোলাপ।কতদিন থেকে এরকম ফুল দেখিনা।আহ!”
ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে আরো অশ্লীল ভাষায় কথা বলছিল।দুজন ছেলে গিয়ে রিমির দুহাত চেপে ধরে।রিমি যে প্রতিরোধ করবে তারও উপায় নেই।কুকুর গুলো দাঁড়িয়ে দেখছে।রিমির কান্নার পরিমাণ মুহুর্তে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।আজ হয়তো নিজের সবটুকুই বিসর্জন দিতে হবে তাকে।একদিকে ব্যাথা অন্যদিকে সতিত্ব।
ছেলেদুটো রিমির হাত দুটো চেপে ধরে।আর একজন ছেলে তার নিজের প্যান্টের বেল্টে খুলতে শুরু করে।রিমি কান্না করতে করতে চোখ বন্ধ করে ফেলে।চোখ বন্ধ করলেও পানি ঠিকই গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে।সে কল্পনায় দেখতে পারছে ছেলেটা তার কাছে আসছে।
৩.
হঠাৎ করে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়।রিমির হাতদুটো ছেড়ে দেয়া হয়েছে।সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলে রিমি।দেখে অবাক করা এক কান্ড।দুটো ছেলে প্রাণপণে ছুটছে।আর যে ছেলেটা প্যান্টের বেল্ট খুলে উলঙ্গ হয়েছিল তাকে কয়েকটা কুকুর ধরেছে।তার অবস্তা হয়েছে দেখার মতো।রিমি তার চোখ বন্ধ করে সেখানে বসে আছে।কুকুর গুলো ছেলেটাকে কামড়ে শেষ করছে।একপর্যায়ে ছেলেটা খুব জোড়ে চিল্লিয়ে ওঠে।রিমি কি মনে করে নিজের চোখটা খুলে ফেলে।চোখ খুলে বুঝতে পারে ভুল করেছে।লজ্জায় চোখদুটো আবার বন্ধ করে নেয়।একটা কুকুর ছেলেটার গোপনাঙ্গে কামড় দিয়েছে।ছেলেটা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেছে।কুকুর গুলো এবার তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজ নিজ আবাসনে যায়।
ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়ে থাকে।কিছুক্ষন আগে রিমির যে পরিমাণ ব্যাথা ছিল তা এখন নেই।এর কারন কি হতে পারে তা রিমির অজানা।রিমি বুঝতে পারে এখানে থাকাটা আর নিরাপদ নয়।তার ঐ দুই বন্ধু পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রস্তুতি নিয়ে আবার আসতে পারে।একবার না হয় ভাগ্যের জোড়ে বেঁচেছে।কিন্তু পরেরবার তো নাও বাঁচতে পারে।কিন্তু এতরাতে বাহিরে একটা মেয়ে।সেটা কি নিরাপদ?সে ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে?শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় এখানে নয় বাহিরে গিয়ে একটা জায়গা খুঁজে আজকে রাতটা কাটিয়ে দেবে।
রিমি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু ব্যার্থ হয়।দিত্বীয়বার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়।আবার মনে পড়ে স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুসের কথা।এই লোকটা কথা বারবার মনে পড়ায় নিজের মনে উপর খানিকটা বিরক্ত হয় রিমি।সে নিজের মনকে বলে,স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস নয়,এই রিমিই সেরা।এই কথা মনে করে সে উঠতে চেষ্টা করে।এবার সফল হয় সে।সে উঠে দাঁড়াতেই আবার পড়ে যেতে ধরে।এক্সিডেন্টের ধকল এখনো সাড়িয়ে উঠতে পারেনি।সেই ব্যাথা গুলো এখনো আছে।না জানি কতদিন থাকবে?ঔষুধ যে খাবে তারও পয়সা নেই।সব কিছুর বাধা পেড়িয়ে রিমি হাটতে শুরু করে।সে বুঝতে পারছেনা এটা তার সঠিক সিদ্ধান্ত নাকি ভুল সিদ্ধান্ত।সে আর অতসত না ভেবে সেখান থেকে বের হয়ে হাটতে শুরু করে।পেটটা কালকের তুলোনায় আজকে একটু কমেছে।এই পেট ফুলোর জন্যই আজ তার এই অবস্তা।এসব কথা ভেবে সে মনে মনে পেটটাকে ইচ্ছে মত গালি দেয়।
হাটতে হাটতে রিমি এসে দাঁড়ায় একটা শহীদ মিনারের সামনে।শহীদ মিনারের উপরে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ৩টা বাজে।রিমি আবার হাটতে শুরু করে।সম্পুর্ন রাস্তায় মানুষ নামক কোনো প্রাণীর ছায়া নেই।মাঝে মাঝে দু-চারটা কুকুর আছে।রিমি হাটতে হাটতে এসে দাঁড়ায় একটা স্কুলের সামনে।সামনে বিশাল একটা মাঠ।স্কুলের গেটের সামনে একটা লাইট আলো দিচ্ছে।রিমি স্কুলের নামটা পড়তে শুরু করে।স্কুলের নাম হলো,’গংগাচড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।’
রিমি স্কুলের গেটের সামনেই বসে পড়ে।স্কুলের গেটে তালা দেওয়া রয়েছে।না হলে ভিতরে ঢুকতো।রিমি সেখানে আস্তে করে সুয়ে পড়ে।ভাবতে থাকে আগের কথা গুলো।এইসময় তার থাকার কথা ছিল কোথায় আর সে কোথায়।তার বাবা-মা যার সাথে বিয়ে দিয়েছে সে একজন প্রবাসী রিমি সেটা জানেনা।জানলে হয়তো বিয়েই করতো না।আজকে তার স্বামী তার পাশে থাকলে না হোক কিছু করতো।একপর্যায়ে রিমি সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।একঘুমে রাত পার।রাতে আর কোনো রকম সমস্যা হয় না।
সকাল বেলা স্কুলের দারোয়ান এসে জাগিয়ে দেয় তাকে।রিমি তারাতারি উঠে পড়ে।দারোয়ানটা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।এতে বিন্দু পরিমান লজ্জা পায় রিমি।সে তারাতারি উঠে হাটতে শুরু করে।পিছন থেকে দারোয়ানটা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আর কোনোদিন যদি এখানে দেখি মেরে ভুত বানিয়ে দেব।যত্তসব পাগলের দল।”
রিমি তার কথায় কান না দিয়ে হাটতে শুরু করে।রাস্তার সবাই রিমির দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।প্রথম প্রথম রিমি এর কারন বুঝতে না পারলেও পড়ে বুঝতে পারে।সবাই তার দিকে তাকানোর কারন হচ্ছে তার রক্তে মাখা পাজামাটা।কালকে পিরিয়ডের সময় যেটা রক্তে একাকার হয়ে গিয়েছিল।রিমি নিজে খুব লজ্জায় পড়ে যায়।বুকের ওরনাটা দিয়ে কমোড়টা ঢেকে ফেলে।এবার তার দিকে তাকাচ্ছে সব ছেলেরা।রিমি বুঝতে পারে এভাবে হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব নয়।কিন্তু সে বসবে এমন কোনো জায়গায়ও নেই।আসার পথে কিছু ভাঙ্গা বাড়ি দেখেছিল।কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই বমি বমি ভাব শুরু হয় রিমির।সাথে সাথে বাহিরে বের হয়ে আসে সে।ভিতরের পরিবেশ প্রচন্ড বাজে।মানব সন্তানেরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।
রিমি পুনরায় হাটতে থাকে।আর সম্ভব হচ্ছে না আর এই হাটা।সে ধপকরে একটা মাঠে বসে পড়ে।মাথাটা নিচের দিকে করে থাকে।কালকের ব্যাথাটা আজকে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।পেটটা অসহ্য রকমের ব্যাথা করছে।রিমি সেখানেই শুয়ে পড়ে।উদিত সুর্যের আলো এসে পড়ে তার চোখে মুখে।সে মাঠের মাঝেই শুয়ে পড়ে।সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে আর চলে যাচ্ছে।কেউ থামছে না দেখার জন্য।সবাই চলে যাওয়ার সময় বলে যাচ্ছে,’পাগলিটা শুয়ে আছে’
চলবে..
•গল্পের মধ্যে বলা হয়েছে,{মানব সন্তানেরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।}এখানে এটা বলতে বোঝানো হয়েছে টয়লেটকে।সো মানুষ টয়লেটে যা করে এখানে তাই করেছে।
১.
যেদিন রিমির স্বামীর বিদেশ যাওয়ার ২বছর পূর্ণ হয় সেদিন থেকে হঠাৎই রিমির পেট ফুলতে শুরু করে।গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে স্বামী বিদেশ থাকায় পরকিয়ায় মেতে উঠেছে রিমি,নাহলে ২বছর ধরে যার স্বামী বাহিরে সে কিভাবে গর্ভবতী হয়?রিমির শশুড় বাড়ির সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিমিকে তারা বাসা থেকে বের করে দিবে।এরকম একজন কলঙ্কিনিকে বাসায় রাখলে বাসায় ফেরেশতাও আসবে না।কিন্তু রিমি বুঝতে পারছে না তার পেটটা হঠাৎ ফুলে উঠলো কেন?এত পরিমাণে ফুলে উঠেছে যে,অন্য কেউ কেন সে নিজেই দেখলে মনে হবে পেটের মধ্যে বাচ্চা রয়েছে।
এদিকে রিমিকে বাসা থেকে বের করার প্রস্তুতি চলছে।সারা গ্রামের মানুষ এসে ভীড় জমিয়েছে তাদের বাড়ির সামনে। রিমি চুপ করে নিজের ঘরে বসে আছে।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অঝোর ধারায়।বিয়ের ২বছর হতে না হতেই শশুর বাড়ি থেকে চলে যেতে হচ্ছে তাকে।এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে রিমির শাশুড়ি।তিনি রিমির সামনে এসে দাঁড়িয়ে সপটে থাপ্তর চালিয়ে দেন রিমির গালে।রিমি বিন্দুমাত্র অবাক হয় না।তার শাশুড়ি বলতে শুরু করে,
“তোকে এখনো এ বাড়িতে রেখেছি এটা তোর চানকপাল।ছি.আমার ছেলেটা তোকে বিশ্বাস করে বাসায় রেখে গিয়েছে আর তুই ব্যবসা খুলে বসেছিস।নিজের মামাতো,খালাতো,চাচাতো সব ভাইকে ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করিস।আমরা কি কিছুই বুঝিনা।তখন কিছু বলিনি,আজকে প্রমাণ পেয়ে বললাম।তুই আর এক মুহুর্ত আমার বাসায় থাকবি না।আমার ছেলে তোর মতো মেয়ের মুখ দেখতে চায় না।”
তার শাশুড়ি যে তাকে অপমান করলো তাতে তার কষ্ট নেই কিন্তু তার মামাতো,খালাতো,চাচাতো ভাইদের অপমান করার কারনে তার খুব রাগ উঠে যায়।বহু কষ্টে রাগটাকে দমন করে চিল্লিয়ে কান্না করতে করতে বলে,
“আজকে বের করে দিলেন আমার কথা না শুনে।তবে যেদিন প্রমাণ করতে পারবো এই অপবাদটা আপনারা ভুল মানুষকে দিয়েছেন সেদিন আমি আর এই বাড়িতে থাকবো না।মনে রাখবেন”
এই কথা বলে কান্না করতে করতে বাসা থেকে বের হয়ে আসে রিমি।ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে।বাড়ির আঙ্গিনায় সব মানুষের ভীড় ঠেলে কান্না করতে করতে বের হয়ে আসে রিমি।হাটতে শুরু করে অজানা উদ্দেশ্য।তার পিছন পিছন হাটছে কৌতুহলি বালকের দল।তারা রিমির দিকে তাকাচ্ছে আর পিছন পিছন হাটছে।একপর্যায়ে তারা রিমির পিছন পিছন চলা বাদ দিয়ে দেয়।রিমি হাটতেই থাকে।নিজের বাসায় যে যাবে তার ভাড়াটাও নেই।বাসায় যেয়েই বা কি করবে?বাবা-মায়ের বোঝা হতে চায় না সে।রিমি কান্না করছে আর হাটছে।সে যে ডাক্তারের কাছে যাবে তারও টাকা নেই।অথচ তার এখন ডাক্তারকে দেখা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
পেট জানান দিচ্ছে যে,বিপুল পরিমাণে ক্ষিধা লেগেছে।হাত-পা জানান দিচ্ছে আমরা খুব ক্লান্ত।রিমি তবুও হাটতেই থাকে।সন্ধ্যে নামছে পশ্চিম দিগন্তে।রাত নামার আগে তাকে নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে রাত্রীযাপনের জন্য।রিমি হাটতে হাটতে সামনে দেখতে পায় একটা বাসা।আর চারদিকে কোনো বাসা নেই।একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বাসাটা।অযত্নে-অবহেলায় জসে পড়ার মতো অবস্তা।রিমির মনে বিরাজ করছে আরেকটা বিরাট বড় চিন্তা।কালকে তার পিরিয়ডের ডেট রয়েছে।কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না?আপাতত পেটটাকে শান্ত করতে হবে।কিন্তু তার কাছে কোনো টাকা নেই।কিভাবে পেটকে শান্ত করবে?সে আস্তে আস্তে বাসাটার দিকে এগোতে থাকে।একপর্যায়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে।ভিতরে ঢুকে সে আজব কিছু জিনিস দেখতে পায়।অনেকগুলো কুকুর বাসা বেধেছে বাসাটায়।রিমি সেখানে একটা জায়গা খুঁজে পায় থাকার মতো।সিদ্ধান্ত নেয় সেখানেই রাত কাটাবে।এখন সমস্যা হলো কি খাবে?খাবারের জন্য ক্লান্ত শরির নিয়ে বের হয় রিমি।মেইনরোড দিয়ে হাটতে শুরু করে।হঠাৎ পিছন থেকে তাকে ফেলে দেয় একটা গাড়ি।রিমি চটকে পড়ে যায় একদিকে।প্রচন্ড ব্যাথা পায় সে।শরিরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্ত বের হতে শুরু করে।গাড়িটা চলে গেছে সেখান থেকে।এমনিতেই রিমি দুর্বল হয়ে আছে তার উপর আবার এক্সিডেন্ট।প্রভু কি একদিনেই তাকে সব বিপদ দিচ্ছে।রিমি যে উঠে দাঁড়াবে তার শক্তিটাও নেই।বাধ্য হয়ে সেখানেই শুয়ে চোখের পানি ফেলতে শুরু করে।হঠাৎ সে তলপেটে ব্যাথা অনুভব করে।বুঝতে পারছে পিরিয়ড শুরু হবে কিছুক্ষন পরই।
রিমি রাস্তায় শুয়েই চোখের পানি ফেলছে।কেউ তাকে তোলার মতো নেই।তার নিজেরও উঠার শক্তি নেই।কিছুক্ষন শুয়ে থাকার পর তার সমস্ত শরির চিনচিন করতে শুরু করে।মনে হয় সব রক্ত শেষ।রিমি বহুকষ্টে উঠে বসে।কিন্তু দাঁড়ানোর শক্তি নেই তার।রিমি উঠে বসে তাকিয়ে দেখে সমস্ত রাস্তায় তার রক্ত।হাতের কনুই ছিলে গেছে।ব্যাথায় হাতটাও নড়াতে পাড়ছে না সে।
রিমি নিরবে চোখের পানি ফেলতে শুরু করে।হঠাৎ চোখ খুলে পাশে একটা লাঠি দেখতে পায়।সেটাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলে প্রথমবার ব্যার্থ হয়।দ্বিতীয় বারও ব্যার্থ হয়ে।মনে পড়ে ছোটবেলার পড়া।রাজা রবার্ট ব্রুস সাতবারের বার যুদ্ধ করে সফল হয়েছে।রিমি আবার চেষ্টা করে।এবার সফল হয় সে।সে মনে মনে বুঝতে পারে যে,রবার্ট ব্রুসের চেয়ে সে এগিয়ে আছে।
আস্তে আস্তে হাটতে শুরু করে সে।তাকে যেতে হবে রাত্রীযাপনের জন্য যে জায়গাটা দেখে রেখে এসেছে সেখানে।এত ব্যাথা করছে যে,ব্যাথার কারণে ক্ষিধার কথা ভুলেই গেছে।এখনো রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি।একপর্যায়ে রিমি পৌঁছে যায় কাঙ্খিত সেই জায়গায়।আস্তে আস্তে বসে পড়ে সেখানে।বাসাটা ভালো থাকা অবস্তায় এই জায়গাটা যে চিলেকোঠা ছিল সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার।
রক্ত জমাট বেধেছে সমস্ত গায়ে।পরিষ্কার করারও ইচ্ছা জাগছে না তার মনে।একদিকে প্রচন্ড ব্যাথা অন্যদিকে প্রচন্ড ক্ষিধা।অনুপস্তিত রয়েছে শুধু ঘুমটাই।তাই সে মনে মনে ঘুম ডাকতে শুরু করে।এই মুহুর্তে তার ঘুম দরকার।পেটটা আস্তে আস্তে আরো ফুলতে।রক্ত জমাট বাঁধা জায়গা গুলোয় ব্যাথা আরো বাড়ছে।তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বেরে চলেছে ক্ষিধা।আচমকা ঘুম এসে থামিয়ে দেয় সবকিছুকে।শান্ত করে দেয় সমস্ত শরিরটাকে।রিমিকে নিয়ে রওনা হয় তার দেশে।
২.
রাত ২টার কাছকাছি সময়।আচমকা ভুক ভুক করে ডাকতে শুরু করে কুকুর নামক প্রাণী গুলো।কিছুক্ষন ডেকে শান্ত হয় তারা।রিমি জাগনা পায়নি এখনো।এত ব্যাথা যে ঘুম থেকে উঠছেই না।কেটে যায় কিছু সময়।
আচমকা চিল্লিয়ে উঠে বসে পড়ে রিমি।তলপেটটা অসহনীয় ব্যাথা করছে।আপনা-আপনি চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে।ঠোঁট দুটো জাপটে ধরেছে নিজেদেরকে।হাত গুলো খামছে ধরেছে নিচে থাকা মাটিগুলোকে।রক্তে ভিজে যাচ্ছে পাজামা।রিমি শুধু কান্না করছে আর মনে প্রাণে আল্লাহকে ডাকছে।সব ব্যাথা=পিরিয়ডের ব্যাথা+এক্সিডেন্টের ব্যাথা+শাশুড়ির থাপ্তরের ব্যাথা যুক্ত হয়ে সমস্ত শরিরে হুলস্তুুল কান্ড শুরু করেছে।একপর্যায়ে রিমি চিল্লিয়ে কান্না করতে থাকে।আর সহ্য করতে পারছে না ব্যাথা।সৃষ্টিকর্তা কেন মেয়েদেরকে এতোটা কষ্ট দেয় এই সময়গুলোতে।কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না সে।চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কাঁদছে।কুকুর গুলো সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে রিমির কান্ড-কারখানা।এমন সময় সেখানে প্রবেশ করে কয়েকটা ছেলে।একজন রিমিকে এই অবস্তায় দেখার সাথে সাথে বলে,
“ওহ,আজকে কার মুখ দেখে সকালে উঠছিরে।সামনে টগবগ করছে রক্তগোলাপ।আজকে খুব মজা পাবো।”
তার কথায় তাল মিলায় উপস্তিত সবাই।রিমির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।সে ব্যাথার চোটে তাদের কোনো কথাই শুনতে পারছে না।ছেলেগুলো এগোতে শুরু করে তার দিকে…
সাদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে সেই এক পশলা বৃষ্টিতে পথের ধুলোর সাথে মিশেই। শোভা যখন জানতে পারলো তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মানুষটা আর নেই পৃথিবীতে। নবিজি (সাঃ) বলেছেন, যদি তুমি তোমার চরিত্র হারিয়ে ফেলো, তাহলে তুমি সবকিছুই হারিয়ে ফেললে। সাদও তার সাক্ষী।
শোভা প্রথমে বুঝতে বা মানতেই পারলোনা সাদের মৃত্যুর ব্যাপারটা। কিন্তু মানতে হলো। চিৎকার করে কাঁদলো, কেন কাঁদলো নিজেই জানেনা। তবে কী ওর মনের কোথাও সাদের জন্য অনুভূতির কোনো টুকরো রয়ে গিয়েছিল? ভালোবাসা কখনো মরে যায়না, হয়তো চাপা পড়ে যায় কোনোকিছুতে। সাদের লাশ নিয়ে আসা হলো শোভাদের বাড়িতে। শোভা দেখলো না সাদকে। ঘরে বসে রইলো। রাফু-তুতুল মাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আমাদের বাবা কী আর নেই আম্মু?’
কী বলবে শোভা? এটাই ওর কপালে লিখা ছিলো? মানুষটার মৃত্যু তো সে কামনা করেনি? তবু কেন এমন হলো!
‘ না নেই।’
‘ মরে গেছে?’
শোভা কান্না চেপে বললো,
‘ হুম মরে গেছে।’
‘ আম্মু তোমার কান্না পাচ্ছে! তাহলে কাঁদছো না কেন?’
‘ কাঁদতে নেই বাবা।’
‘ তাহলে দাদুমা কাঁদছে কেন?’
‘ তুমি কষ্ট পেলে যেমন আমি কাঁদি, তেমনই তোমার বাবাও তো ওনার ছেলে তাই কাঁদছে।’
‘ আমাদের বাবা কী আর ফিরে আসবেনা?’
‘ জানিনা বাবা। তুমি চুপ করো। নানাভাইয়ের কাছে যাও।’
‘ আম্মু তুতুল কাঁদছে।’
‘ কোথায় ও?’
‘ বারান্দায় একা বসে আছে। এলো না আমার সাথে।’
‘ আচ্ছা।’
‘ আম্মু আমরা অনেক বড় হবো, তোমার দুঃখ ঘুচিয়ে দেবো।’
রাফুর এই কথাটাই শান্তির বার্তার মতো ছড়ালো চারদিকে। শোভা আর কিছু বললো না। সন্তানদের বাবা ছাড়া কী শোভা নিজেই করলো? ও-ই কী দায়ী ছেলেমেয়ের কান্নার জন্য? এসব কেন ওর ভাগ্যে লিখা ছিলো? কেন? শোভা কী জীবনে কষ্ট পেতে আর কাঁদতেই এসেছে!
রাফুকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তোমরা কী মনে মনে আমাকে খারাপ ভাবছো? চাইলে যেতে পারতে বাবার সাথে!’
‘ চাইছিলাম না। ওনি যদি ভালো হতো তাহলে তোমাকে নিয়েই ফিরতাম আম্মু।’
‘ রাফু তুমি আমাকে একা থাকতে দাও।’
‘ আমার ওসব রক্ত দেখতে ভালো লাগেনা, কিন্তু ওনার জন্য মায়া হচ্ছে। আচ্ছা আম্মু একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
‘ হুম।’
‘ মরে যাওয়ার সময় কী ওনার খুব কষ্ট হয়েছে তাইনা?’
‘ হুম।’
‘ তখন কী আমাদের কথা ওনার মনে হয়নি?’
শোভার মনটা খচখচ করতে লাগলো। সত্যিই কী ওই কঠিন সময়টাতে শোভাদের কথা সাদের মানসপটে ভেসে উঠেছিলো? ঠিক কী চাইছিলো ওই খারাপ মানুষটা? ওদেরকে কী তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ভাবছে? নাকি অনুতপ্ততার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো সাদ? এক পশলা বৃষ্টি কী ওর জীবনটাতে শান্তি এনে দিয়েছে! আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে তো কোনো ক্ষতি হতোনা। তবে কেন এই একটা জীবন অতি স্বল্প সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে গেলো আর শোভার জন্য রেখে গেলো কষ্টের পাহাড়। এতোদিন তো শোভা নিজেকে মানিয়েই নিয়েছিল জীবনের সাথে, লোকটা আবার উলটপালট করে দিয়ে গেলো। কী শান্তি পায় ওকে এমন কষ্ট দিয়ে সেটা ওই সাদ নামক ব্যক্তিটিই জানে। রিডিকিউলাস!
রাফু ঘর থেকে চলে গেলে কয়েকজন প্রতিবেশী, আত্মীয় এসে শোভাকে নিয়ে বিলাপ শুরু করলো। কীভাবে থাকবে, বাচ্চা নিয়ে চলবে কীভাবে, আরেকটা বিয়ে করবে কিনা এইসব। তারা জানতো না শোভার সাথে কাগজে কলমে ওই ব্যক্তিটির ছাড়াছাড়ি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। অথচ এই মানুষগুলোই এতোদিন শোভাকে বাঁকা নজরে দেখতো, রাস্তায় বেরুলে আড়চোখে দেখতো, কানাঘুষা করতো। বিকেলবেলা মহিলাদের আড্ডার প্রধান বিষয়বস্তু ছিলো রমজান সাহেবের মেয়ে শোভার বর কই? বাচ্চাগুলো কী অবৈধ নাকি। এগুলো শুনতে শুনতে এতকাল কেটেছে শোভার। আর আজ এসেছে সিমপ্যাথি দেখাতে। ওসব মনমানসিকতার মানুষগুলোর জন্যই সমাজে আজও মেয়েরা নর্দমার কীটের মর্যাদা পায়। এর শেষ কোথায় জানেনা শোভা। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থা খুব দ্রুতই পাল্টানো প্রয়োজন, পরিবর্তন প্রয়োজন।
ডিভোর্সি নারী মানেই খারাপ নয়। হতে পারে সে অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার। তাই সবসময় নারীদেরকে বাঁকা চোখে না দেখে বিষয়টা তলিয়ে দেখুন৷ দেখবেন বিপরীত পক্ষ থেকে মেয়েটি কতোটা কষ্ট, অপমান, নির্যাতন সহ্য করে এসেছে। পরকীয়া, শারীরিক চাহিদা, যৌতুক এসবই আজকাল সমাজকে দূষিত করে ফেলছে। অথচ সবাই বাঁকা চোখে তাকিয়ে আঙ্গুল তুলে দেখাবে, “মেয়েটা ডিভোর্সি, চরিত্রহীন, বেলেল্লাপনা করে বেড়ায় তাইতো ওর সংসার ভাঙলো!”
মহিলাদের এসব বিলাপ শুনে শোভার ভেতর খারাপলাগা কাজ করলো। কেঁদেই দিলো। একসময় ভালোবাসতো সাদকে। কষ্ট যতোই দিক, ভালোবাসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ওদের কখনো মিল হওয়ার সম্ভাবনা ছিলোনা। ভাগ্যটাই হয়তো এমন ছিলো। ইচ্ছে করলেই পাল্টানো যেতো জীবন। মিলি এলো, ওর ও ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু মহিলাদের এসব দেখে ও সবাইকে একপ্রকার রেগেমেগে কিছু কড়া কথা বলে ঘর থেকে বের করে দিলো। বিরক্ত হয়ে ওরা চলে গেলো।
মিলি শোভাকে বললো,
‘ যাবি শুভি?’
‘ কোথায়?’
‘ সাদ ভাইকে দেখতে?’
‘ তোর মুখে অনেক বছর পর শুনলাম সাদ ভাই!’
‘ সবসময়ই ডাকতাম। কিন্তু মেজাজ খারাপ হলে ভুলে যেতাম।’
‘ বুঝি আমি।’
‘ যাবি?’
‘ না।’
‘ আর কখনো দেখতে পারবিনা, শেষবেলা দেখে নে।’
‘ আমি দেখতে চাইনা।’
‘ অন্তত ওনার মায়ের জন্য?’
‘ কেন?’
‘ ওনি নইলে কষ্ট পাবে শুভি। মহিলাটা বড্ড ভালো। কেউই নেই আর ওনার। স্বামী-সন্তান সবাই তো ছেড়ে গেলো। তোকে তো মেয়ে মেনেছে, যা না একটু।’
‘ তুই বলছিস?’
‘ হুম। সময়ে কঠিন, সময়ে নরম। যখন যা হওয়া দরকার তখন তাই-ই হতে হয়!’
সাদের মা রোমেলা খবরটা শুনে অনেক শকড হলো। ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সবাইকে একনজর দেখানো হলো। মিলি নিয়ে এলো শোভাকে। দেখলো খারাপ মানুষটাকে একবার। তারপর চলে গেলো। কাফন-দাফন করানো হলো চট্টগ্রামেই।
রোমেলা একপর্যায়ে স্ট্রোক করে ফেললো। ওনাকে হসপিটালাইজড করা হলো। অবস্থা শোচনীয়, কিন্তু সাইফের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেবার ওনি বিপদমুক্ত হলেন। ছেলের কথা ভেবে ওনি কান্না করলেন। কিন্তু তখন পৃথিবী নামক গ্রহটিতে ওনি একটা বিন্দুর মতোই একা। পাশে আর কেউই রইলোনা। সেই সময় ওনার পাশে দাঁড়ালেন শোভা। শ্বাশুড়িকে নিয়ে শুরু করলো নিজের পথচলা। যে পথচলাতে প্রতিটা ধাপে ধাপে অপমানিত হয়েছে শোভা। কারণ ওর স্বামী নেই, সংসার নেই। সমাজে এমন নারীর কোনো দামই নেই। সিঙ্গেল মাদার, বিধবা নারীরা যে কতোটা অবহেলিত সেটা বলে বোঝানোর ক্ষমতা কারোর নেই।
মিলির নিজের সংসার হলেও ওর সব ভাবনা আজও শোভার জন্য বরাদ্দ। ছোট্ট একটা মেয়ে ওর। নাম মিশু। রাফু তুতুল ওকে নিজের বোন ভাবে। মা-বাবা, শ্বাশুড়ি, নিজের সন্তানদের নিয়ে শোভার জীবনটা এগুতে লাগলো। খুবই কষ্টের সেই যাত্রা ছিলো। কিন্তু কষ্টের পরেই আসে সুখ।
বছর কয়েকের মাঝেই রোমেলা মারা গেলো। শোভার মা-বাবাও পর পর কয়েক বছরের ব্যবধানে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলো। সবচেয়ে বড় আশ্রয়, ছায়া হারালো শোভা। শাফিন দেশে এলো বউ নিয়ে। এখনো সে নিঃসন্তান। কয়েকমাস থেকে আবারও পাড়ি জমালো বিদেশে। এবার কানাডাতে স্যাটেল হলো ও। এর মধ্যে শোভার অতি পরিচিত, সবচেয়ে বড় বন্ধু মিলির আশ্রয়টাই ছিলো। শোভাদের পাশের ফ্ল্যাটটাতেই উঠে এলো সাইফের ফ্যামিলি। মিলি নিজের স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলো। যেহেতু শোভা চাকরি করে তাই রাফু-তুতুলকে পালন করার দায়িত্ব ও নিজের কাঁধে নিলো অনেকাংশেই। মাঝে মাঝে শোভা ভেবে পায়না এমনও মানুষ হয়, এতো ভালো বান্ধবী ও কীভাবে পেলো। কখনো এই ঋণ শোধ হবে কিনা! কিন্তু এটা শোধ হওয়ার নয়, কারণ পুরোটাই ভালোবাসা। ভালোবাসার কোনো ঋণ হয়না, শোধও হয়না। শোভার মাথায় হাত রাখার মতো মিলিটা সবসময় শুভির মিলিই রয়ে গেলো।
দিন, মাস, বছরগুলো এভাবেই কাটতে লাগলো। নরম, নমনীয় শোভাকে এই সমাজের জন্য হতে হলো কঠোর। মানুষের ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলতে লাগলো। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলো, একটা ব্যাংকের ম্যানেজারের পদে ওর চাকরি হলো। শোভার রুপ, গুণ দেখে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতোন কর্মকর্তা, যিনি বিবাহিত এবং যার দুটো মেয়ে সন্তান আছে সেই মাহফুজুর রহমান শোভাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। এছাড়া কিছু চরিত্রহীন কলিগরা ওকে কুপ্রস্তাব দিলো। শোভা লজ্জ্বায় বা ভয়ে গুটিয়ে রইলো না। আগের শোভা সে নেই। লিখিত অভিযোগ জমা দিলো বড় বড় কর্মকর্তাদের কাছে, কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে তাদেরকে বরখাস্ত করা হলো। মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
শোভা ওদেরকে বুঝিয়ে দিলো, মেয়েরা দুর্বল নয়। কিন্তু এর ফল হলো ভয়ানক। একদিন অফিস শেষে ফিরতে গিয়ে রাত হয়ে গেলো। এসময় চট্টগ্রামের এই এলাকাটাও খুব বেশি নীরব হয়ে পড়ে। সাইফ ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলো সাহায্য লাগবে কিনা বা একা আসতে পারবে কিনা। কিন্তু শোভা সাহায্য নিলোনা। মাহফুজুর রহমান প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেয় সেদিন শোভাকে ফলো করছিলো এবং সুযোগ বুঝে ওনার ভাড়া করা দুজন গুন্ডা ওর পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিলো। শোভার ওপর যখন ওরা এ্যাটাক করলো তখন ফাঁকা রাস্তায় একা শুভি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। মুহূর্তের জন্য হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বুঝতে পারছিলো না কী করবে। তারপর হঠাৎই ভাবলো মরবেই যখন তখন লড়াই করে মরাই ভালো। অন্তত নিজের কাছে নিজের জিত হবে। শোভা প্রাণপণে একটা লোকের পেটে লাথি মারলো, ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে লোকটা মাটিতে বসে পড়লো। অপর লোকটা শোভার এই ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলো। এই সুযোগে শোভা দৌড় শুরু করলো। দ্বিগবিদিক হারিয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান দেখতে পেলো। ওদিকে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই কিছু একটা এসে পড়লো ওর গায়ে। হতভম্ব শোভা পেছনে তাকিয়ে দেখলো সেই গুন্ডা লোক দুটোর হাতে একটা বোতল, ধোঁয়া বেরুচ্ছে। শোভার গলা, হাত, পায়ের কিছু অংশ জ্বলছে। বুঝতে পারলো ওকে এসিড মারা হয়েছে।
তখন শোভার হুশ এলো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই তাই। বিশ্বাসই করতে পারছিলো না শোভা। গলা, হাত, পা যখন জ্বলেপুড়ে যেতে লাগলো তখনই চিৎকার করে উঠলো। মাটিতে বসে পড়লো। পেটের কাছে মাংস উঠে গিয়েছে। প্রচন্ড ব্যথা আর জ্বলুনিতে শোভার মনে হচ্ছে ওর জীবনের সমাপ্তি এখানেই। চিৎকার করে কান্না করছে কিন্তু কেউ নেই সাহায্য করার। জ্ঞান হারানোর আগে দোকানদারের
উদ্দেশ্যে শোভা বলতে পারলো,
‘ আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি চাচা।’
দোকানদার কাশেম মিয়া তাঁর মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে এভাবে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। কোনোমতে দুজন লোক জোগাড় করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ব্যাগপত্র ঘেটে ফোন নম্বর জোগাড় করে কাশেম মিয়া
সবকিছু জানালো মিলিকে। খবর শুনেই একটা চিৎকার করে মিলি অজ্ঞান হয়ে গেলো। তার শুভির একি অবস্থা হলো!
সাইফ মিলিকে বাবা-মা’য়ের কাছে রেখে দ্রুত হসপিটালে চলে এলো। শোভার এমন অবস্থা দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলোনা। বোনের মতো ভালোবাসে শোভাকে। ওর সব কষ্ট অনুভব করতে পারে সাইফ। কিন্তু মেয়েটা আর কত সহ্য করবে? কে করলো এই কাজ?
অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা হলো শোভার। কণ্ঠনালী, গণ্ডদেশ মারাত্নক ক্ষতির সম্মুখীন হলো। খাবার খেতে পারতোনা। পোড়া মাংসগুলোতে পচন ধরায় সার্জারি করা হলো শোভার। পোড়া মাংসগুলো তুলে সেখানে প্লাস্টিক সার্জারি করা হলো। মুখে এসিড পড়েনি সেটাই বাঁচোয়া। পুরোটা সময় সাইফ-মিলি শোভার পাশে ছিলো। দীর্ঘ দুইমাস হসপিটালে একপ্রকার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে জয়ী হয়ে শোভা ফিরে এলো।
শাফিনকে এই ঘটনার কিছুই জানানো হলোনা। শোভা বারণ করেছে। একবার যদি শাফিন শোনে শোভার এই অবস্থা তাহলে দুনিয়া উলটপালট করে ফেলবে। এমনিতে চলে আসতে চায়, কিন্তু শোভা মানা করে দিয়েছে। এতো সিকিউর একটা ভবিষ্যত ফেলে কেন শোভার জন্য চলে আসবে। কিন্তু মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা ঠিকই পাঠায়, শোভার মানা স্বত্তেও। বোনপাগল ভাই যে। শোভা পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পরে শাফিনকে এই ঘটনা শোভা নিজেই জানালো এবং শাফিন ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ দেশে ফিরতে চাইলো কিন্তু শোভা আসতে দিলোনা। ব্ল্যাকমেইল করলো একপ্রকার। ফলে শাফিন আর কিছুই করতে পারলোনা।
এই ঘটনা এখানেই শেষ নয়। শোভা অভিযোগ দায়ের করলো থানায়। সন্দেহভাজন হিসেবে অফিসের কলিগদের দায়ী করলো। পুলিশরা তদন্ত করলো জোরালোভাবে, কারণ শাফিন ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করেছে। যার ফলাফলসরুপ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট অত্যন্ত জোর দিয়ে এই কেসটা হ্যান্ডেল করছে। তদন্ত চালানো হলো এবং ওই দুজন গুন্ডা ধরা পড়লো। সাক্ষী ছিলো চায়ের দোকানদার কাশেম আলী। ফলে মূল আসামি মাহফুজুর রহমানকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। কেস কোর্টে উঠলো এবং মাহফুজুর রহমানের দশ বছরের জেল হলো। চারদিকে শোভার মতো নারীর জয়-জয়কার। কারণ এই লোকের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ আরো ছিলো। প্রমাণের অভাবে ক্ষমতাশালী এই লোকটার কিছুই করা যায়নি। শোভার সাহসের জন্য খুব প্রশংসা করলো মানুষ ওর!
পুড়ন্ত গলা, হাত-পা শোভার। তবুও মায়ের মিষ্টি চেহারাটা রাফুর জীবন। ছোট থেকে মায়ের সাথে ঘটা অন্যায় দেখে রাফুর এই সমাজের প্রতি খুবই ঘৃণা এসে পড়ে। মাকে কোনোদিন কষ্ট পেতে দেয়নি ওরা দুজন। বুঝতে শিখেছে আঘাত মানুষকে শক্ত হতে শেখায়। মায়ের মতো ভুল যাতে আর কেউ না করে, সেজন্য রাফু নিজেও মেয়েদের থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। তবে বন্ধুত্ব ছিলো ছেলেমেয়েদের সাথে, সেই বন্ধুত্বটাকে সম্মান করেছে। প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ করেছে মেয়েদের সাথে হওয়া অন্যায়গুলোর জন্য। শোভা সবসময় সন্তানদের সাথে ছিলো। একুশটা বছর পার হয়ে গেলো এভাবেই।
তুতুল ডাক্তারি পাস করলো, রাফু কানাডা চলে গেলো পড়াশোনা করতে। কিন্তু তবুও ওরা মায়ের শিক্ষা ভুলেনি। নারীদের কীভাবে সম্মান করতে হয় বা মানুষ হিসেবে কীভাবে বাঁচতে হয় সেটা ওরা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু দিনশেষে শোভা একা। মিলি আছে আজও, থাকবে সবসময়।
প্রকৃতিতে বসন্ত। সাজবে সবুজ, বাসন্তী সাজে। তুতুল মিলি আর মিশু কে নিয়ে শহর ঘুরতে বেরিয়েছে। শোভা ওদেরকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। শোভা ঘরে একা। বিগত একুশ বসন্তের কথা ভাবছে ও। কোনোদিন পালন করা হয়নি জাঁকজমকভাবে। কিন্তু আজ তার মেয়ে তুতুল সেটা করেছে। পুরাতন সব ভুলে নতুন বসন্তকে সাজিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। কিন্তু চাইলেই কী সব সাজিয়ে নেওয়া যায়? শোভা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে রইলো। সমুদ্র দেখা যায় এখান থেকে। রাফুটা থাকলে ভালো হতো, কিন্তু ছেলেটা আসতে পারছেনা। বড্ড ভালোবাসতো সমুদ্র। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে শোভাকে। স্থির থাকতে পারলোনা শোভা, বেরিয়ে এলো। একা একা যখন বালিয়াড়িতে হাঁটতে লাগলো তখন ঝুপ করে নেমে এলো বৃষ্টিধারা। একুশ বছর আগের সেই শুভিটাই আজও রয়ে গিয়েছে, পাল্টায়নি একটুও। বৃষ্টিতে ভেজা সেই দুর্দান্ত মানবীটিকে দূর থেকে দেখে রাফু ওর মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।
‘ বৃষ্টিতো আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপভোগ করার জন্যই পাঠায় তাইনা? বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। আমার বয়সও হয়েছে বৃষ্টিতে ভিজার।’
শোভা মুচকি হাসলো। বাবার মতো কথা শিখেছে ছেলেটা।
রাফু বলল,
‘ তোমার সাথে সমুদ্রের পাড়ে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজার জন্যই আমি চাই, আরো হাজারবার আমার জন্ম হোক।’
শোভা ছেলের দিকে তাকালো। চমকে লক্ষ্য করলো, সাদের অবয়ব। সেই নাক, চোখমুখ, কথা বলার সুন্দর ভঙ্গি। এই ক’টা বছরে এতো পরিবর্তন! আজ সাদের কথা মনে পড়ছে খুব। মানুষটা বেঁচে থাকলে এতোদিনে হয়তো আরও কষ্ট সহ্য করতে হতো। ভালোই হয়েছে মরে গিয়ে। শোভার খুব ইচ্ছে ছিলো সমুদ্রের পাড়ে সাদকে নিয়ে হাঁটবে, বৃষ্টিতে ভিজবে। ভিজছে, তবে সাদের একটা অংশের সাথে, যেটা আজ তাঁর পুত্র রাফু। মাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাফু হেসে বললো,
‘ বাবার মতো হয়ে গিয়েছি তাইনা?’
‘ আংশিক!’
‘ কিন্তু ওনার মতো হলেও, চিন্তাধারা ওমন নয়। তোমার মতোই স্বচ্ছ!’
শোভা হাসলো শুধু।
‘ আচ্ছা, তুমি বুঝলে কীভাবে আমি এসেছি?’
‘ মায়েরা সব বুঝতে পারে। আমার মন বলছিলো তুমি আসবে।’
‘ তাইতো সুদূর কানাডা থেকে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম।’
‘ ভালো করেছো।’
‘ আম্মু চলো সমুদ্রে নামি!’
‘ নাহ।’
‘ কেন?’
‘ এমনিতে বৃষ্টিতে ভিজছি, সমুদ্রে নামতে হবেনা।’
‘ তোমাকে কিন্তু পঁচিশ বছরের যুবতীই লাগছে, মোটেও পঁয়তাল্লিশ বছরের মহিলা লাগছেনা।’
‘ তোমাকে পাঁচ বছরের সেই রাফুই দেখাচ্ছে।’
রাফু হেসে গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ আজ বৃষ্টিটা অন্যরকম, হাজার বছর পরপর
মনে হয় এমন বৃষ্টি হয়। তাইনা?’
‘ হতে পারে।’
তারপর রাফু কিছুক্ষণ চিন্তা করার ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ এই বৃষ্টিটার কী নাম দেওয়া যায় বলোতো!’
শোভা দূরে, সমুদ্রের গভীরে দৃষ্টি রেখে টুপটাপ করে ঝরে পড়া বৃষ্টিরাজির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এক পশলা বৃষ্টি!’
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। সাদের হয়তো আরও শাস্তি পাওয়া উচিৎ ছিলো, তাড়াহুড়ায় বিশ্লেষণ দিতে পারিনি। আর এখানেই অগোছালো গল্পটার ইতি টানলাম। ভুল-ত্রুটি মাফ করবেন। হয়তো আপনাদের আশানুরূপ হয়নি।
পরদিন সকালে সাদ এলো। একা এলো না, ওর মা রোমেলাও এলো। শোভা যা ভাবার ভেবে নিয়েছে। ওনাদের খুব আপায়্যন করলো। সাইফদের মেহমানরা সবাই ব্রেকফাস্টের পরে চলে গিয়েছিল। শুধু সাইফের মা-বাবা, সাইফ-মিলি রয়ে গেলো। মূলত সাদের জন্যই। আর সাইফদের বাসাও বেশি দূর নয়। পাশের এলাকা। যাইহোক, চা-নাস্তা সহ অন্যান্য খাবার ওদেরকে দেওয়া হলো। সাদ মনে মনে বেজায় খুশি। পরিস্থিতি ঠিকই আছে।
রোমেলা শোভার কাছে গেলেন। শোভা খুব ইতস্তত বোধ করলো। ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। স্বামী-সন্তানের করা অন্যায় ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলো।
‘ শোভা মা, তুমি ওনাকে মাফ করে দিও। তুমি মাফ না করলে আল্লাহ ওনাকে মাফ করবেনা।’
‘ আমি ওনাকে মাফ করে দিয়েছি আন্টি।’
‘ আন্টি বলো না, আমাকে একবার মা বলে ডেকো তুমি। পুত্রবধূর সুখ তো কপালে জুটেনি, তোমার মতো ভালো একটা মেয়েকে হারাতে চাইনা।’
শোভা চুপ করে রইলো। রোমেলা ইতস্তত করে বলল,
‘ ইয়ে আমি আমার নাতি-নাতনিদের দেখতে পারি?’
‘ কেন নয়! আপনি তো কোনোকিছু করেননি।’
‘ বিশ্বাস করো মা, সংসারে আমি শুধু একটা কাঠের পুতুল। যার কোনো দাম নেই। আমি কখনোই এই অন্যায়টা মেনে নিতাম না। ছেলেকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন বুনেছিলাম, ভাবিনি এমন হবে।’
রাফু আর তুতুলকে শোভা নিয়ে আসলো। রোমেলা শিশু দুটির দিকে তাকিয়ে চোখ মুছলো। জড়িয়ে নিলো বুকের মধ্যে। তাঁর নাতি-নাতনি। তাঁর বংশের প্রদীপ। রাফু মাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ওনি কে আম্মু?’
‘ তোমার দাদুমা।’
‘ আমাদেরও দাদুমা আছে?’
‘ হুম, ওনিই তোমাদের দাদুমা। সালাম দাও!’
দুই ভাইবোন রোমেলাকে সালাম দিলো। ওনি মিষ্টি হেসে উত্তর দিলেন। তারপর ওদের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। শোভা অবাক হয়ে বলল,
‘ কীসের কাগজ ওটা?’
‘ একটা চেক মা।’
‘ চেক? কীসের চেক?’
‘ আসলে আমার কিছু টাকা আছে ব্যাংকে, সেগুলো আমি আমার নাতি-নাতনিদের দিতে চাই।’
‘ ওসব লাগবেনা। আপনি এটা ফিরিয়ে নিন।’
‘ এরকম বলোনা। আমিতো তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিন, তাই এটা তোমায় রাখতেই হবে।’
‘ আমি টাকা নিতে চাচ্ছিনা।’
‘ জানি কেন নিতে চাচ্ছোনা।’
শোভা চকিতে তাকালো। রোমেলা মৃদু হেসে বললো,
‘ ওটা সাদ বা ওর বাবার টাকার অংশ নয়। এটা আমার বাপের বাড়ির টাকা, অঙ্কটা মোটামুটিই। আমার আর ক’দিন। টাকাগুলো এমনিতেই পড়ে থাকবে ব্যাংকে।’
‘ কিন্তু..!’
‘ কোনো কিন্তু করোনা মা। কেউ না জানলেও আমি জানি তুমি আমার ছেলের কাছে কখনোই ফিরে যাবেনা। যদিও ছেলেটা আশা নিয়ে এসেছে। এখন তুমি যদি আমার মতামত জানতে চাও, তাহলে আমিও বলবো ওর কাছে ফিরে না যাওয়াটাই ভালো।’
শোভা রোমেলার কথায় অবাক হলো। মহিলাটা ভালো। শ্বাশুড়ি হিসেবে মন্দ ছিলোনা। কিন্তু ভাগ্য তাদের এক হতে দেয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শোভা। রোমেলা রাফু আর তুতুলের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছেন। এই কষ্ট কাউকে দেখানোর নয়, বোঝানোর নয়।
সাদ বসার ঘরেই। ওর মনটা বড্ড উসখুস করছে। শোভা রোমেলার জন্য চা নিয়ে এলো। ঘরে এসে রোমেলার হাতে চায়ের কাপ দিলো। রোমেলা হাসলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
‘ আমার ছেলেটা খুব খারাপ তাইনা?’
‘ হয়তো!’
‘ ওর কিন্তু এমন হবার কথা ছিলোনা। মূলত পূর্ব শত্রুতার জন্যই সাদের বাবার মনে একটা বিদ্বেষ তৈরি হয়েছিলো। জানিনা কী থেকে কী হয়ে গেলো।’
‘ এসব কথা থাক।’
‘ শোভা! তুমি কী আবার বিয়ে করবে?’
ও চমকে উঠে বলল,
‘ কখনোই না।’
‘ জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দিতে পারবেনা?’
‘ কখনোই না। যে সুযোগটা দিয়েছে সেটাই অনেক। এর বেশিকিছু চাইনা।’
‘ তোমার তো একটা কাঁধের খুব প্রয়োজন!’
‘ স্বামী ছাড়া নারীরা দুর্বল নয়। দ্বিতীয় পুরুষ কখনোই আসবেনা আমার জীবনে।’
এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো দুজনের মধ্যে। এমন ভালো মহিলাটাকে সাদ কীভাবে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চাইতে পারে, স্বার্থপর একটা! এভাবেই দুপুর হয়ে গেলো। শোভা শান্ত মেজাজে সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিলো। অতঃপর যখন সেই সময়টা এলো তখন সাদ জিজ্ঞেস করলো,
‘ জানিনা। তবে এখন নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন আমি আপনার কাছে ফিরে না গেলে কী হবে?’
‘ বুঝতে পারছিনা।’
‘ ওয়েল! বুঝার দরকার নেই, কারণ আপনার সেই বোধ এখনো হয়নি।’
‘ তুমি কিন্তু হেয়ালি করছো!’
‘ হেয়ালি আমি করছিনা। আপনি পুতুল খেলা খেলছেন।’
‘ কী করেছি আমি?’
‘ ডিভোর্স হয়ে যাওয়া স্বত্ত্বেও আপনি কী করে ভাবলেন আমি আপনার কাছে ফিরে যাবো? মানে বুদ্ধি লোপ পেয়েছে আপনার?’
‘ শোভা!’
‘ শুনুন। মানছি আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু ডিভোর্স মানে বুঝেন তো? আমাদের আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়।’
‘ তুমি আমাকে ভালোবাসো না?’
‘ না। যে ছেলে নিজের গর্ভধারিণী মাকে একটু সুখের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চায়, সেই কাপুরুরকে আমি চাইনা।’
সাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
‘ ইসলামি শরীয়ত মতে, আমি যদি আপনার কাছে ফিরে যাই তাহলে আমাকে আরেকটা লোকের সাথে বিয়ে করে ঘর করতে হবে, সেই লোকের সাথে যদি আমার ডিভোর্স হয়ে যায়। তাহলে আপনাকে আমি বিয়ে করতে পারবো। তো আপনি কী এটা চান?’
শোভার মুখে রহস্য খেলা করছে। অসম্ভব শীতল গলায় দারুণ একটা ডিসিশন।
‘ এটা বাদ দিন। আমি যদি আপনার কাছে ফিরে যাই, তাহলে আমার আত্মসম্মান খর্ব হবে। সারাজীবন আপনার কাছে ছোট হয়ে থাকতে আমি পারবোনা। আপনিই বলুন, মেয়েদের আত্মসম্মান কী এতোই ঠুনকো?’
‘ তাতে কী আসে যায়?’
‘ আমাকে দেওয়া শাস্তিগুলোর কথা মনে করুন আপনি। কী কী করেছিলেন?’
সাদ প্রথম থেকে করা সব অন্যায়ের কথা মনে করার চেষ্টা করলো। যেদিন অফিসে ফোন করে শোভা ওকে বাবা হওয়ার খবরটা দিয়েছিলো, তারপর ও কী বলেছিলো। একবাক্যে সন্তানদের বাবার পরিচয় অস্বীকার করেছিলো। টিনার মতো সুন্দরী মেয়ের লোভে পড়ে ওকে বিয়ে করেছিলো। এমনকি মৃতপ্রায় শোভাকে হসপিটালে দেখতে পর্যন্ত আসেনি। পথেঘাটে কতশত লোক শোভাকে নিয়ে ঠাট্টা করতো। রমজান সাহেব, শাফিন ওর পায়ে পর্যন্ত ধরতে রাজি ছিলো কিন্তু ও ফেরেনি। সমাজে ওদের অবস্থান এতোটাই নেমে গিয়েছিল যাতে করে কেউ ওদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। একদিন ফোন করে খবর নেয়নি। টিনাকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড হানিমুনে গিয়েছিল। বাচ্চার হওয়ার কথা শুনে জেদের বশে ওদের কেড়ে নিতে চাইছিলো, মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো ওই মাসুম দুটো বাচ্চাকে। ওর জন্য শোভারা ঢাকা থেকে গোপনে এসে চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছলো। এতোবছর কত কষ্ট করেই না চলেছে ওরা। আর ওর জন্য ওর বাবা-মা বৌমার সুখ পায়নি। টিনার জন্য ওর বাবা মারা গিয়েছে, মা বিধবা হয়েছে। তারপর যখন সবকিছু ঠিক হওয়ার একটা আভাস দেখা দিলো তখনই রাফুকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জঘন্যতম ষড়যন্ত্র করে বসলো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কতকিছুই না ঘটে গেলো। এরপর কী করে ও ভেবেছিলো শোভা ওর সাথে সংসার করবে? যেখানে পাঁচ বছর আগেই ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে!
আজ এতোদিন পর সাদ নিজের অন্যায়গুলোর কথা মনে করে অনুতপ্ত হতে লাগলো। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। শোভা হেসে বলল,
‘ কিছু মনে পড়েছে কী?’
এই কোণের ঘরটাতে সবাই ওদেরকে একা কথা বলার জন্য ছেড়ে দিলো। এমন সময় মিলি এলো। বলল,
‘ এখন আপনিই বলুন আপনার মতো দুমুখো সাপের কাছে ফিরে যাওয়া উচিৎ?’
সাদ বলল,
‘ আমাকে ক্ষমা করা যায়না?’
শোভার অট্টহাসিতে পুরো ঘর কেঁপে উঠলো। বলল,
‘ শোভা এতোটাও দয়াহীন নয়। ও সবাইকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে।’
‘ তাহলে কেন আমরা এক হতে পারবোনা?’
‘ কারণ আমার আত্মসম্মানবোধ আছে। আমি আপনার মতো দুর্বল মানুষ নই।’
‘ তাহলে কী আমার বাচ্চাদেরও তুমি দিবেনা?’
‘ আমি দেওয়া না দেওয়ার কে?’
‘ তাহলে আমি ওদের নিয়ে যাবো।’
শোভা কেঁপে উঠলেও কিছু বললোনা। চোখেমুখে স্বকীয়তা বজায় রেখে বলল,
‘ ওরা যদি আপনার সাথে যেতে চায় তাহলে নিয়ে যাবেন!’
সাদ মনে মনে স্বস্তি পেলো। কিন্তু রাফু আর তুতুলকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, ওরা ওর সাথে যেতে চায় কিনা তখন ওরা চুপ করে রইলো।
কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভাবলো। রাফু আড়ালে তুতুলকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ বাবার সাথে যেতে চাস বোন?’
‘ আম্মু যাবে?’
‘ না!’
‘ তুমি যাবে?’
‘ তুই আগে বল।’
‘ আমরা গেলে তো আম্মু কষ্ট পাবে। তুমি শোনোনি কাল রাতে আম্মু আমাদের একটা গল্প বলেছে। আচ্ছা গল্পের ঘটনাগুলো কী আম্মুর সাথে ঘটেছে?’
‘ হুম, ছোটআম্মুও বলেছিলো আমাকে একবার।’
‘ বাবাটা ভালো না। আমি যাবোনা।’
‘ ঠিক বলেছিস। আম্মু জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে, আমিও যাবোনা।’
‘ আমরা আম্মুকে ভালোবাসি।’
‘ হুম।’
তারপর সাদের দিকে তাকিয়ে রাফু বলল,
‘ আমরা আপনার সাথে যাবোনা। মায়ের সাথে থাকবো।’
সাদ রেগে গেলো। চিৎকার করে বলল,
‘ সব তোমাদের মা আর ওই মিলি শিখিয়ে দিয়েছে যাতে আমার সাথে না যাও!’
‘ না। আমি আর বোনই তো ঠিক করেছি আংকেল।’
রাফু যখন সাদকে আংকেল ডাকলো তখন ওর বুকে কাঁটা বিঁধলো যেন। নিজের ছেলে বাবাকে আংকেল ডাকছে এটা কতোটা কষ্টের শুধু সে-ই জানে।
‘ আংকেল আপনি আমাদের আম্মুকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। ভালো হলে কখনোই দিতেন না। আপনি ভালো লোক হলে আমরা আপনার সাথে যেতাম, কিন্তু আপনি খারাপ।’
সাদ খুব কষ্ট পেলো। কোনোমতে বলল,
‘ আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবেনা? বাবা বলে ডাকবেনা তোমরা?’
রাফুর মনটা শোভার মতোই নরম। বোনকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুই ডাকবি?’
‘ তুমি বললে।’
রাফু সাদকে বলল,
‘ আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি বাবা।’
তুতুলও স্বগোতক্তি করলো। বলল,
‘ কিন্তু আপনার সাথে যাবোনা আমরা।’
শোভা ছেলেমেয়েদের মুখে এরকম একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। ভেবেছিলো ওরা বুঝি ওকে সত্যিই ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু ওরা ছেড়ে যায়নি। শোভা আরকিছুই না বলে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদেই দিলো।
সাদের চোখ বেয়ে এবার পানি পড়তে লাগলো। বাবা হলে নাকি ছেলেদের জীবন পাল্টে যায়। কিন্তু সাদ পাল্টালো। অনেক পরে, যখন সময় হারিয়ে গিয়েছে। যখন ওর নিজের সন্তানরাই আর ওকে চায়না। কতোটা পাপ করলে কারো এমন শাস্তি হতে পারে। খুব সহজেই যে জীবনটা কাটাতে পারতো সুখে শান্তিতে, সেই জীবনটাই নরকের মতো হয়ে গেলো সাদের।
সাদ আর কথা বাড়ালোনা। মাকে ছাড়াই বেরিয়ে এলো শোভার বাসা থেকে। টলমল পায়ে হাইওয়ে ধরে হাঁটতে লাগলো। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পথঘাট চুপচাপ। ঝরঝর করে নামতে লাগলো বৃষ্টিধারা। ভিজে চুপসে গেলো ও। সাদ ভাবতে লাগলো ওর আর কী আছে এই জগতে? ও কী করছে এখানে! বেঁচে থাকার অধিকারটাও নেই ওর। জীবনে এতগুলো ভুল কীভাবে কীভাবে করে ফেললো ও? কোন মোহের টানে ছুটছিলো যে এত পাপ করে ফেলেছে? অথচ কলেজ জীবনে ও কত মানুষেরই না সাহায্য করতো। ওই শোভাটাই ওর জীবনে একটা বাদলধারার মতো নেমেছিলো। আবার হঠাৎই চলে গেলো সাদের একটা ভুলের জন্য। এক পশলা বৃষ্টির মতোন। প্রথম দেখাও হয়েছিলো এক পশলা বৃষ্টির মধ্যে। আচ্ছা, এখন যদি পথের ধুলোর সাথে মিশে যায় তাহলেও কী ওর পাপের পাহাড় ঘুচবে? জীবন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ওর আর ভালো লাগছেনা কিছু ভাবতে। জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চায় ও! কিন্তু কীভাবে পালাবে? মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই কী ওর শান্তি মিলবে?
ভাবনার মাঝেই একটা গাড়ি ওর ওপর দিয়ে চলে গেলো। ছিঁটকে একটা পাথরে বারি খেলো সাদের মাথাটা। কিছু বলার চেষ্টা করে শুধু বলতে পারলো, “ভালো থেকো আমার শুভি!” নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো, বুকটা কয়েকবার উঠানামা করে একসময় স্থির হয়ে গেলো। বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যেতো লাগলো কালচে-লাল রক্ত। পিষে গেলো নিথর দেহটা পথের ধুলোর সাথে। এক পশলা বৃষ্টিতে ওর জীবনটা নিঃশেষ হয়ে গেলো।