Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 126



প্রিয়তোষ পর্ব-১৬

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_১৬
লিখা: Sidratul muntaz

নোরা চলন্ত গাড়ির জানালায় এক হাত বের করে হাতের উপর মাথা ঠেঁকিয়ে আনমনে বলল,” জানেন,আজকে অন্তরা আর আলভীর বাসররাত।”

অনিক ড্রাইভ করতে করতে বলল,” জানি।”তারপর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” আমাদেরটা যে কবে হবে!”

নোরা অনিকের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,” বিয়ে হওয়ারই কোনো চান্স নেই আর উনি এলেন বাসর নিয়ে। স্বপ্ন দেখারও লিমিট লাগে।”

” বিয়ে হওয়ার চান্স নেই মানে? কি বলছো?”

” আন্টি তো আমাকে পছন্দই করেন না। দেখলেন না, খাবার টেবিলে কিভাবে এড়িয়ে গেলেন!”

” আরে ধুর, তুমি ওইটা নিয়ে চিন্তা করছো? পাগল! মা হয়তো তোমাকে চিনতে পারেনি। চিনলে এমন করতো না।”

” আপনি যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, চিনতে না পারার তো কথা না। আমার মনে হয় উনি নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন।”

অনিক এ কথার জবাব দিতে পারল না। কি করে দেবে? তার কাছে তো জবাব নেই। নোরাও আর প্রশ্ন করল না এ বিষয়ে। অনিক নিজেও খুব ভালো করে জানে তার মা এই সম্পর্কে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু সেটা নোরাকে বুঝতে দিতে চাইছে না সে। আর অনিক যেটা বুঝাতে চায়না, নোরা সেটা আগ বাড়িয়ে বুঝতেও চায়না। অনিক বলল,” ফুচকা খাবে নোরা?”

” এতোরাতে ফুচকা কোথায় পাবেন?”

” তুমি খাবে কিনা বলো।”

” হ্যাঁ খাবো।”

” ঠিকাছে তাহলে দশমিনিট ওয়েট করো।”

দশমিনিট পর অনিক গাড়ি থামিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। নোরা একাই গাড়িতে বসে রইল। একটু পর নোরা দেখল অনিক সত্যি সত্যি ফুচকার গাড়ি নিয়ে আসছে। গাড়িটা সে নিজেই ঠেলছে। আর ফুচকাওয়ালা ওর পেছন পেছন আসছে। নোরা অবাক হয়ে গাড়ি থেকে নামল। অনিককে জিজ্ঞেস করল,” আপনি এতোরাতে উনাকে কোথায় পেলেন?”

অনিক হাসিমুখে বলল,” তোমাকে নিয়ে লংড্রাইভে আসব এই প্ল্যান অনেক আগে থেকেই ছিল। তখনি মামার সাথে এপোয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলাম। কারণ আমি তো জানি, আমার বউয়ের ফুচকা হলে আর কিছু লাগেনা। আমাকেও লাগেনা। আজকে আলভী অন্তরার বাসররাত, আর আমাদের ফুচকারাত।”

একথা বলেই নোরার দিকে এক প্লেট ফুচকা এগিয়ে দিল অনিক। নোরা হেসে ফেলল। ফুচকার প্লেট নিতে নিতে বলল,” আপনি আসলেই একটা পাগল।”

অনিক ফুচকাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল,” মামা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি বানাও। জলদি জলদি বানাও। ও কিন্তু খাওয়াতে খুব ফাস্ট। তুমি একটা বানাতে বানাতে ওর দশটা খাওয়া হয়ে যাবে।”

নোরা ফুচকা মুখে পুরে বলল,” মামা কি আপনার পরিচিত?”

অনিক বলল,” পরিচিত মানে? আরে আমাদের এলাকার মামা! তোমার কাছে তো অনেকবার উনার গল্প করেছি ভুলে গেছো?”

” ভুলিনি, মনে আছে। মামা আপনি এতো তাড়াহুড়া করবেন না তো। আস্তে আস্তে বানান। আমি এতো বেশি খাবো না।”

ফুচকাওয়ালা হেসে বলল,” আরে খান আম্মাজান। বাপজান তো খালি আপনার লাইগাই আমারে বাসার থেকা উঠায় আনসে। আর বিল নিয়া চিন্তা কইরেন না। আপনাদের লাইগা আজকে ফ্রী অফার।”

নোরা অনিকের দিকে তাকিয়ে হাসল। অনিক ফুচকাওয়ালার কাঁধে হাত রেখে বলল,” আরে কি বলো মামা? কথায় কথায় এতো ফ্রী অফার দিলে চলবো? ব্যবসায় কি লালবাত্তি ধরাইবা নাকি?”

” বাপজান, আপনারে ফ্রী দিমু না তো কারে ফ্রী দিমু? আর আপনারে ফ্রী দিলে আমার ব্যবসায় লালবাত্তি জ্বলবো না। উলডা সবুজবাত্তি জ্বলবো।”

” দেখেছো নোরা। এই না হলে মামু। কিন্তু মামা, তুমি আমার মামা হয়ে ফ্রী ট্রিট দিতেই পারো। কিন্তু আমি ভাগ্নি হয়ে তোমারে কিছু দিমু না তাই কি হয়? তাই আজকের জন্য কিন্তু তোমার বাসার ডিনারের দায়িত্ব আমি নিলাম। এইডায় না করলে চলবো না।”

ফুচকাওয়ালা হাসতে হাসতে বলল,” আইচ্ছা আইচ্ছা।”

নোরা ফুচকা খাচ্ছে আর ওদের আলাপ শুনে হাসছে। ফুচকাওয়ালা নোরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,” বুঝলেন আম্মাজান, বাপজানের লাইগা তো দোকানে আমার বাড়তি লোকই রাখা লাগেনা। বাপজান সময় পাইলেই দোকানে আইসা কাস্টমারগো অর্ডার সাপ্লাই দেয়। উনার লাইগা আমার ব্যবসায় কেমনে লাল বাত্তি জ্বলবো কন দেহি? ”

নোরা চোখ বড় করে বলল,” ও, তাহলে এই কাহিনি? আপনি ফুচকার দোকানেও কাজ করেন? তাইতো বলি, ফুচকা সম্পর্কে আপনার এতো জ্ঞান কিভাবে হলো!”

অনিক মাথা চুলকে বলল,” আরে মামার দোকান থাকলে ভাগ্নিরা তো একটু আকটু শিখেই যায়। বাই দ্যা ওয়ে নোরা, তোমার আর আমার কিন্তু ফুচকা খাওয়ার একটা কম্পিটিশন হওয়ার কথা ছিল। কম্পিটিশনটা কি হবে?”

” একদম না। আমি অলরেডি তিনপ্লেট খেয়ে ফেলেছি। এখন কম্পিটিশন হলে আমি নিশ্চিত হারবো। আপনি আগে বলেন নি কেন? চালাকি না?”

অনিক হো হো করে হেসে দিল। নোরা অনিকের মুখে একটা ফুচকা তুলে দিয়ে বলল,” নিন, খান।”

অনিক বড় করে হা করল। নোরা পুরোটা ফুচকা অনিকের মুখে পুরে দিল। তারপর হাসতে লাগল। অনিক বুঝল না নোরা হাসছে কেন। তারপর টের পেল, ফুচকাটা এত্তো ঝাল! ঝালে ওর মুখ জ্বলে যাচ্ছে। অনিক প্রতিশোধী গলায় বলল,” দাঁড়াও। এখন আমিও রিভেঞ্জ নিবো। উইথ এক্সট্রা মাসালা।”

ফুচকাওয়ালা ওদের খুনশুটি দেখে হাসছেন। অনিক ফুচকাওয়ালাকে বলল,” মামা তুমিও আমাদের সাথে খাও।”

ফুচকাওয়ালা বলল,” আরে আরে বাপজান আমি কেন খামু? আপনে আম্মাজানরে নিয়া খান, মজা করেন।”

অনিক বলল,” ধুর! আমরা একলাই খাবো আর তুমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখবে তা হয় নাকি? হা করো তো।”

অনিক ফুচকাওয়ালাকেও ফুচকা খাইয়ে দিল। নোরা অবাক হয়ে দেখছে। অনিকের এই রুপ তার অজানা ছিল। তার কেন জানি অসম্ভব ভালো লাগছে অনিককে দেখে। ছেলেটা এতো মিশুক, আগে তো জানতো না সে! কিছুদিন আগেও নোরা ভাবতো অনিক এক্সট্রা ভাবওয়ালা অহংকারী লোক। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, ওর মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র নেই। ও একজন বিশুদ্ধ মনের মানুষ।

যাওয়ার সময় অনিক ফুচকাওয়ালার বাসার সবার জন্য কাচ্চি কিনে দিল। উনি সেগুলো নিয়ে চলে গেলেন উনার গন্তব্যে। আর অনিক-নোরা উঠে গেল ওদের গাড়িতে। গাড়ি চলছে, নোরা বলল,” আচ্ছা, এই গাড়ি আপনি আদনান স্যারের কাছ থেকে কি বলে এনেছেন?”

” যা সত্যি তাই বলে এনেছি।”

” আমার কথা বলেছেন?”

” হুম।”

” উনি কি তাহলে আমাদের সম্পর্কে খুশি?”

” উনার খুশি-অখুশিতে কি আসে যায়? আমরা তো খুশি।”

অনিক হাসল। নোরা বলল,” না মানে.. প্রথম প্রথম উনি আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে যেভাবে রিয়েক্ট করেছেন আমি তো ভয়ই পেয়েছিলাম৷ আচ্ছা উনি তখন এতো রাফ বিহেভ কেন করেছিলেন?”

” দ্যাখো নোরা, কোচিংটা তো আদনান ভাইয়ের ছিল। আর সেই কোচিং এ আমাদের সম্পর্ক ছিল টিচার আর স্টুডেন্টের। উনি ভয় পাচ্ছিলেন আমরা কোচিং এর নাম খারাপ করবো। তার উপর তন্নীকে তো চেনোই। সেও কিন্তু তোমার মতোই ছিল। অবশ্য তোমার মতো এতো পাগলামি করতো না, কিন্তু এমন অনেক কিছুই করতো যা আদনান ভাইয়ের চোখ এড়ায়নি। উনি তো তোমাদের ক্লাস থেকে আমাকে বাদ দেওয়ার ডিসিশন নিয়েছিলেন।”

” এইটা করলে আমি কোচিং এই পড়তাম না।”

” আর আমিও কি চাকরি করতাম? তোমার জন্যই তো কোচিং এ ঢোকা। তোমাদের ক্লাস নিতে না পারলে আমিও রিজাইন করে দিতাম।”

” সব হয়েছে ওই তন্নী শাকচুন্নিটার জন্য। আদনান স্যার হয়তো ভাবতেন আপনি ক্লাস নেওয়ার নাম করে স্টুডেন্টদের সাথে ফ্লার্ট করে বেড়ান তাইনা?”

” এক্সেক্টলি। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানো? তন্নী যা করতো, সব কিন্তু তোমাকে জ্বালানোর জন্য। তুমি কি সেটা বুঝতে?”

” বুঝতাম না আবার! একশোভাগ বুঝতাম। কিন্তু আপনি তো ওকে পাত্তা দিতেন না। এতেই আমার শান্তি লাগতো। হিহি!”

অনিক হেসে বলল,” আমার মনে হয় এর পেছনেও তিথির হাত আছে।”

” মানে? এখানে তিথিআপুর হাত কোথ থেকে এলো?”

” বাহ, হঠাৎ তিথিআপু বলছো যে? আগে তো শুধু তিথি বলতে।”

” না, আজকে বিয়ের অনুষ্ঠাবে উনাকে দেখে মন হল উনি আমার অনেক বড়। বয়সেও বড় আর হাইটেও বড়। তাই ভাবলাম উনাকে আমার আপুই ডাকা উচিৎ। ”

” নোরা, তিথির বিশাল হাইট দেখে কি তোমার মনখারাপ হয়েছে?”

নোরা মাথা নিচু করে বলল,” হুম। আমি যদি তিথি আপুর মতো হতাম তাহলে খুব ভালো হতো। আপনার সাথে দাড়ালে আমাকে একদমই মানায় না। মনে হয় বিশাল তালগাছের সাথে ছোট্ট বোনসাই।”

অনিক হো হো করে হেসে দিল। বলল,” বোনসাইয়ের দাম সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে? সেদিক থেকে চিন্তা করলে তুমি সবচেয়ে দামী। আর তুমি জানো তোমাকে আমার কত কিউট লাগে? ”

” হয়েছে বাদ দিন। এবার বলুন তন্নীর ওসব কারসাজির পেছনে তিথিআপুর কিভাবে হাত আছে?”

” তিথি তন্নীর কাজিন না? হাত থাকতেই পারে। আর তিথি তো তোমার ব্যাপারে সব জানে। হয়তো ইচ্ছে করেই তন্নীকে দিয়ে এসব করাতো। তোমার উপর হিংসা থেকে!”

” কি? তন্নী তিথিআপুর কাজিন?”

” কেন তুমি আগে জানতে না?”

” কিভাবে জানবো? আমি কি তন্নীর সাথে এতো ক্লোজ নাকি? যদিও ওকে আমি চারবছর ধরে চিনি। কিন্তু কখনো এইটা জানিনি যে ওর কাজিনের নাম তিথি।”

” ওহ। হয়তো ইচ্ছে করেই জানায়নি। তিথিই হয়তো নিষেধ করেছে। কারণ চারবছর ধরেই কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করি।”

” আর এজন্যই সেদিন রেশমি আমাকে ইচ্ছে করে আপনার বার্থডে তে সিগারেট গিফট করার আইডিয়া দিয়েছিল! রেশমি তো তন্নীর ক্লোজ ফ্রেন্ড। এইটা হয়তো ওদের প্ল্যানেরই অংশ ছিল যেন আপনি আমার উপর রেগে যান।”

” তুমি একথা আমাকে আগে বলোনি কেন?”

” সরি।”

” বোকা নোরা, তুমি খুব বোকা।”

নোরা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,” আসলে রেশমির কথা শুনে ইন্সপায়ারড হয়ে না, আমি ইচ্ছে করেই আপনাকে সিগারেট গিফট করেছিলাম। আমি জানতাম আপনি রেগে যাবেন, তবুও।”

অনিক অবাক হয়ে বলল, ” কেন?”

” কারণ আমি বুঝতে চেয়েছিলাম, আমার উপর আপনার ইন্টারেস্ট আছে কি নেই। সেটা আপনার রাগের মাত্রা দেখেই বোঝা যেতো।”

” তাহলে যখন ধমকাচ্ছিলাম তখন ফ্যাচফ্যাচ করে ওভাবে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলে কেন?”

” সেটাও আপনাকে পরীক্ষা করার জন্যই। আমার খারাপ লাগায় আপনার কতটা খারাপ লাগে সেটা দেখতে চেয়েছিলাম।”

” নোরা! তোমাকে আমি সহজ-সরল ভেবেছিলাম। এখন তো দেখছি তুমি শয়তানের হাড্ডি।”

নোরা খিলখিল করে হেসে উঠল। অনিক কিছুক্ষণ দেখল সেই মাদকমাখা হাসিমুখ। তারপর হঠাৎ শান্তগলায় বলল, ” নোরা, তুমি নেশা হও আমার।”

নোরা হাসি থামিয়ে অবাক চোখে তাকাল। অনিক গাড়ির ব্রেক কষল। তারপর আচমকাই নোরাকে একটানে কাছে এনে বলল, ” এসো বোঝাচ্ছি।”

আহসানুল্লাহ আলভীকে এক চড় দিলেন। আলভী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই। আফিয়া কাদতে কাদতে আহসানুল্লাহকে বললেন, ” কি করছো? এই দিনে নতুন বউয়ের সামনে তুমি ছেলেটার গায়ে হাত তুলছো?”

আহসানুল্লাহ রাগী গলায় বললেন,” আর তোমার হারামজাদা কি করসে সেইডা দেখো না? আজকের মতো একটা রাইতে ছাইপাশ গিল্লা হেলতে-দুলতে ঘরে ঢুকে! হের কত্তবড় সাহস! আমার বাড়িতে এমন বেলেল্লাপনা আমি সহ্য করমু না। ওই বাইর হো তুই ঘরথেকা। এখনি বাইর হো।”

আহসানুল্লাহ আলভীকে কলার ধরে টেনে তুললেন। শিপন আর আরিফ সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল। শিপন বলল,” আঙ্কেল ছাইড়া দেন।ওর ভুল হয়ে গেসে।”

আহসানুল্লাহ বিস্ফারিত চোখে বললেন,” তোমরা চুপ থাকো। এই তোমাদের সাথে চলতে চলতে ওর আরো এই অবস্থা। ওই, হারামজাদা এমনে ঝিমায় ক্যান? কয় পেগ গিলসে অয়? সত্যি কইরা বলো কয় পেগ গিলসে?”

আরিফ মাথা নিচু করে বলল,” বারো পেগ।”

আহসানুল্লাহ আবার আলভির গালে চড় দিলেন। আলভী পিছিয়ে গেল। আহসানুল্লাহ ছেলের পশ্চাৎদেশ বরাবর লাথি মেরে ঘর থেকে বের করলেন। তারপর ফটাস করে দরজা আটকে দিলেন। তারপর আফিয়ার দিকে ঘুরে বললেন,” আজকে থেকা ওর বাসায় ঢোকা বন্ধ।”

বলেই নিজের রুমে চলে গেলেন। অন্তরা সোফায় বসে কান্না আরম্ভ করল। আফিয়াও অন্তরার সাথে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। এদিকে শিপন আর আরিফ সমানে দরজা ধাক্কাচ্ছে। আলভী ওদের ডেকে বলল,” ওই থাম তোরা। ল যাই। এই বাসায় আমিও আর থাকতে চাইনা। একদিক দিয়া ভালোই হইসে। ওই মাইয়ার চেহারা দেখতে হইবো না। এর চেয়ে রাস্তায় থাকা ভালো।”

আলভী একথা বলে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগল। শিপন আর আরিফও বাধ্য হয়ে ওকে অনুসরণ করা শুরু করল।

অন্ধকার রাত। শীতল পরিবেশ। চারদিকে নিস্তব্ধতা। অনিক নোরার কোমল ঠোঁট আর্দ্র স্পর্শে ভরিয়ে দিচ্ছে। গলায় মুখ ডুবিয়ে অজস্র চুম্বন ক্রমাগত ঢেলে যাচ্ছে। নোরার সম্পুর্ণ শরীর প্রতি মুহুর্তে কেপে উঠছে। অজানা এক ভালোলাগায় শিহরীত হচ্ছে নোরা। যেন সুখের স্রোতে ভাসছে। শ্বাস আটকে আটকে আসছে।

অনিকের মাথার চুলগুলো হাতের মুষ্টিতে নিয়ে ক্রমাগত ছটফট করছে সে। এ যন্ত্রণা ভয়ংকর, তীব্র এক অসহনীয় অনুভূতি। যা ক্রমান্বয়ে মাতাল করে তুলছে তাকে। তাদের এই সুখকালীন পর্যায়ে চিড় ধরল ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় নোরার বুক ধুকপুক করে উঠল। মনে হচ্ছে এতোক্ষণ সে স্বপ্ন সায়রে ডুবে ছিল। মাত্র জাগ্রত হয়েছে। অনিক বিরক্তগলায় বলল,” ফোনটা কি সাইলেন্ট রাখা যায়না?”

নোরা স্বাভাবিক হয়ে হাসার চেষ্টা করল,” সাইলেন্ট কিভাবে রাখবো? কত জরুরী ফোন আসতে পারে।”

নোরা ফোন হাতে নিয়ে দেখল বাবার ফোন। বাবা ছোটখাটো কারণে কখনও ফোন করেন না। নিশ্চয়ই জরুরী কোনো দরকার। নোরা ফোনের স্ক্রিনে দেখল রাত দেড়টা বাজে। অথচ এখনো সে বাইরে। এজন্যই তো বাবা ফোন করছেন! নোরা ফোন রিসিভ করলল,” হ্যালো আব্বু।”

” মা! কোথায় তুমি? বাসায় আসবে কখন?”

” এইতো আব্বু রিকশায় আছি। আসলে এতোক্ষণ সেজুতি, তন্নীদের সাথে গল্প করছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেছে। তুমি টেনশন করো আমি চলে আসবো।”

” চলে এসো মা, খুব রাত হয়েছে। গেইটের সামনে এসে আমাকে মিসডকল দিও। আমি চাবি নিয়ে নিচে নামবো।”

” আচ্ছা আব্বু।”

ফোন রেখে নোরা বলল,” দেখলেন কত দেরি হয়ে গেছে? বাসায় যেতে হবে। চলুন তো আমাকে গলির মোড়ে নামিয়ে দিবেন।”

” গলির মোড়ে কেন? সরাসরি গেইটের সামনেই নামিয়ে দিবো!”

” পাগল? আব্বু বারান্দা থেকে দেখে ফেললে? আমি তো বলেছি আমি রিকশায়।”

” ও আচ্ছা। কিন্তু এতোরাতে একা হেঁটে যেতে পারবে?”

” কতদূর আর? পাঁচমিনিটেরই তো রাস্তা। কিচ্ছু হবে না আপনি চলুন।”

” ওকে।”

অনিক নোরাকে গলির মোড়ে একটা চায়ের দোকানের পাশে নামিয়ে দিল। নোরা গাড়ি থেকে নেমে অনিককে হাসিমুখে বাই দিল। অনিকও বলল,” বাই।”

নোরাকে যতক্ষণ দেখা গেল, অনিক ততক্ষণ তাকিয়ে রইল। মেয়েটা আস্তে আস্তে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। অনিকের বুক হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল। তার ইচ্ছে করল গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে নোরাকে ধরতে।

খালি রাস্তায় একা একা হাঁটার সময় নোরার ফোন বেজে উঠল। অন্তরার নম্বর। হালকা চিন্তিত হল নোরা। আলভী আবার কোনো কাহিনি ঘটায়নি তো? দ্রুত ফোন রিসিভ করল সে,” হ্যালো।”

” দোস্ত, তুই কি বাসায় চলে গেছিস?”

” না। যাচ্ছি৷ কি হয়েছে তোর কাঁদছিস নাকি?”

অন্তরা পাঁচ সেকেন্ডে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” আলভীকে আঙ্কেল মেরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন।”

” ওমা কেন?”

” ছাদে বসে বন্ধুদের সাথে মতো মদ খাচ্ছিল। আঙ্কেল সেটা জানতে পেরে প্রচুর রেগে গেছেন। তারপর ওকে পিটিয়ে বের করে দিয়েছেন। ও কোনোদিনও শোধরাবে নারে। এখন মনে হচ্ছে ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিল। কুকুরের লেজ হাজার টেনেও সোজা করা যায়না। ও হলো সেই কুকুর।”

অন্তরা এসব বলতে বলতে কেঁদেই চলেছে। নোরা বলল,” আচ্ছা তুই কান্না থামা। এতো কাঁদিস না। কেঁদেই বা কি হবে? আর ও যে শোধরাবে না সেটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝলাম না আন্টি-আঙ্কেলের মতো এতো ভালো মা-বাবা পেয়েও আলভী এমন কি করে হল? আঙ্কেল যেই মানুষ, ওকে তো পিটিয়েই সোজা বানিয়ে ফেলার কথা। ”

” পেটালেও কিছু হয়না রে। গন্ডারের চামড়া।”

” তুই চিন্তা করিস না। আমি কাল সকালে অনিককে তোদের বাসায় পাঠাবো। অনিক আঙ্কেলকে বুঝিয়ে বললে আঙ্কেল আবার আলভীকে বাসায় ফিরিয়ে আনবে।”

” সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। আঙ্কেল আলভীকে বাসায় আনতে চাইলেও সে নিজে আসবে তো? ও তো আমার মুখও দেখতে চায়না।”

” তুই এজন্য কষ্ট পাচ্ছিস? কাঁদিস না। আসলে খুব ঝামেলার মধ্যে বিয়েটা হয়েছে তো, ওর এখন মাথাটা গরম। কয়েকদিন যাক, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। টেনশন নিস না..”

নোরা কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। সে বাসার সামনে চলে এসেছে। আর এসেই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখল। আলভী আর তার সাথে দুইজন ছেলে নোরাদের বাসার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে। নোরার বারান্দা বরাবর আলভী ইট,পাটকেল ছুড়ে মারছে। আর অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করছে। নোরার গা ভ’য়ে শিউরে উঠল। আলভীকে দেখে মনে হচ্ছে পুরোপুরি আউট অফ মাইন্ড। বারবার খালি বলছে,” নোরা দ্যা বিচ! সাহস থাকে তো সামনে আয়। একবার খালি বাসা থেকে বের হো। তারপর তোরে আমি বুঝামু। আমার সাথে পাঙ্গা নেওয়া?তোর খুব চুলকানি উঠসে নারে? তোর চুলকানির মলম আমার কাছে আছে। আজকে তোরে আমি মলম লাগামু তুই বের হো খালি।”

নোরা পিছিয়ে গেল। এ অবস্থায় কিছুতেই আলভীর সামনে যাওয়া যাবেনা। ওর বুক দুরুদুরু করছে। ওরা তিনজন আর ও একজন। কি করে পারবে? ওইদিকে অন্তরা ননস্টপ হ্যালো হ্যালো করছে। নোরা ভীত গলায় বলল,” অন্তু রে! অসভ্যটা এখন আমার বাসার সামনে।”

” কি বলিস? ও তোর বাসার এ্যাড্রেস পেল কই?”

” সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। আর ও একা না। দু’টো ছেলেও আছে ওর সাথে।”

” তুই বাসায় ঢুকতে পেরেছিস?”

” না, কি করে ঢুকবো? ওরা তো গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

” তোর সাথে আর কেউ নেই?”

” না। অনিক তো আমাকে মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে৷ রাস্তা পুরা খালি একটা মানুষও নেই। আমার ভীষণ ভয় করছে দোস্ত..”

হঠাৎ নোরার ফোন কেটে গেল। অন্তরা হ্যালো হ্যালো করছে কিন্তু ওইপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই। অন্তরার বুক ধক করে উঠল। সে বুদ্ধি করে অনিককে ফোন লাগাল।

এদিকে আলভী,শিপন,আরিফ নোরাকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। নোরা ওদের হঠাৎ সামনে দেখে এতো ভয় পেল যে ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। আলভী হিংস্র নেকড়ের মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওই চোখে এতো হিংস্রতা,এতো ক্রোধ যে ওই চোখে তাকাতেই নোরার হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। শিপন আলভীকে বলল,” কি করবি?”

আরিফ বলল,” উঠায় নিমু?”

এ কথা শুনে নোরা পিছিয়ে গেল। ওর নিঃশ্বাস থেমে গেছে। পেছনে কয়েক ইঞ্চি দূরেই দেয়াল। আলভী কোনো কথা না বলেই হুট করে নোরাকে একটা রামচড় দিল। সেই চড়ের ধাক্কা এতো বেশি ছিল যে নোরা সামলাতে না পেরে উল্টোদিকে ঘুরে দেয়ালের সাথে জোরেসোরে একটা বারি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

তার চোখ-মুখ ঝাপসা হয়ে আসছে। নোরার প্রতি যে ক্ষোভ,ক্রোধ তা যেন এক চড়েই ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে আলভী। নোরা চোখে কিছু দেখছে না, শুধু কানে শুনল,” এই তোরা তোল ওরে, জলদি তোল। আজকে ওর জীবনের শেষদিন হইবো।”

নোরা মাথায় হাত দিয়ে বহুকষ্টে উঠে দাঁড়াল। সবকিছু আবছা অন্ধকার লাগছে। মাথা থেকে গড়গড় রক্ত পড়ছে। ঠোঁটের একপাশ কেটে গেছে। তবুও এই অবস্থাতে শিপন আর আরিফ ওকে ধরতে এলে নোরা দুজনকেই ধাক্কা মেরে উল্টা পথে দৌড়ানো শুরু করল। আলভী, শিপন, আরিফও ওর পেছনে ছুটছে।

নোরা দৌড়ানোর বল পাচ্ছেনা, হাঁপিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু থামারও উপায় নেই। হঠাৎ সামনে তাকিয়েই দেখল অনিক পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এদিকেই আসছে। নোরা অনিককে দেখে থেমে গেল এবং মাটিতে বসে পড়ল। অনিক নোরাকে এই অবস্থায় দেখে আৎকে উঠল। নোরার সাথে সেও মাটিতে হাটু গেঁড়ে বসে পড়ল। নোরার রক্তাক্ত মুখ স্পর্শ করে কাঁপা কণ্ঠে বলল,” কি হয়েছে নোরা? ওরা কি করেছে বলো! সবকয়টাকে কবর দিয়ে ফেলবো।”

নোরা কিছু বলার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। অনিক নোরাকে কোলে তুলে সামনে এগিয়ে আসতে নিলে আলভীরা উল্টোপথে হাটা ধরল। কিন্তু উল্টোপথে পুলিশ। আর একপাশে নোরার বাবা আনিস দাঁড়িয়ে আছেন। আলভীরা যখন নোরার বারান্দায় ইট,পাটকেল ছুড়ছিল তখনি আনিস পুলিশকে ফোন করেছিলেন। পুলিশ আলভীদের এ্যারেস্ট করে নিল, আর আনিস তাকিয়ে রইল অনিকের দিকে। যে তার অজ্ঞান হওয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাড়িয়ে আছে।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১৫

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৫
লিখা Sidratul Muntaz

অন্তরা আলভীদের বাসার দরজায় নক করেছে। দরজা খুললেন আলভীর মা আফিয়া খানম। অন্তরার চোখ-মুখে কান্নার ছাপ৷ চোখ-নাক ফুলে লাল হয়ে দেখাচ্ছে। হাতে লাগেজ ব্যাগ।ওরনা দিয়ে ক্রমাগত চোখ-মুখ মুছছে আর কাঁদছে মেয়েটা। বিধ্বস্ত অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে আফিয়া খানিক ঘাবড়ালেন। হকচকিয়ে বললেন,” কে তুমি? কাকে চাও?”

অন্তরা ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল,” আলভী বাসায় আছে?”

” না, আলভী তো বাসায় নাই। তুমি আলভীর কে হও?”

” আপনি কি আন্টি? মানে আলভীর মা?”

” হ্যাঁ।কিন্তু তুমি কে? আর কাঁদছো কেন এভাবে?”

অন্তরা শুরু করল চূড়ান্ত নাটক। কাঁদতে কাঁদতে দরজার সামনে বসে পড়ল। আফিয়া আরো অবাক হলেন। হুট করে একটা অচেনা মেয়ে এসে তার বাড়ির দরজার সামনে বসে এইভাবে কাঁদছে কেন? মনে তো হচ্ছে প্রেমঘটিত ব্যাপার। আফিয়া কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন। অন্তরাকে বসা থেকে উঠিয়ে বললেন,” আচ্ছা তুমি আগে ভেতরে এসো। তারপর শুনছি কি হয়েছে।”

অন্তরা এক কথায় ভেতরে ঢুকে গেল। মনে হচ্ছে ভেতরে আসতে বলায় মেয়েটা খুশিই হয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখল জুতা পড়েই চলে এসেছে। তাই আবার বাইরে গিয়ে জুতা গুলো খুলল। লাগেজটা নিয়ে ভেতরে ঢুকেই সোফায় বসে গেল। আফিয়া দরজা লাগিয়ে অন্তরার পাশে বসলেন। অবাক হয়ে তিনি দেখছে মেয়েটিকে।

অন্তরা নাক মুছতে মুছতে বলল,” আমি অন্তরা।”

” আচ্ছা অন্তরা। এবার বলো কি হয়েছে তোমার? আমার ছেলে কি তোমার সাথে কোনো অন্যায় করেছে?”

অন্তরা নিজেকে স্বাভাবিক করে দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বলতে লাগল,” আন্টি, ওর সাথে আমার পুরো তিনবছরের সম্পর্ক। মাঝে একবার ব্রেকআপও হয়েছিল। তাও কার জন্য জানেন? আপনার প্রবাসী বড় ছেলের গার্লফ্রেন্ডের জন্য। ”

” আমার বড় ছেলে? মানে আবির?”

” হ্যাঁ। ওই আবির ভাইয়ার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল। কি যেন নাম, আদ্রিতা না পাদ্রিতা জানি?”

” আদ্রিতা।”

” হ্যাঁ। ওই মেয়ে আমাকে এত্তো অপমান করেছে আন্টি আমি আপনাকে কি বলবো? আপনি আমার মায়ের মতো। মায়ের কাছে এসব কিভাবে বলি?”

” আচ্ছা আমি বুঝতে পেরেছি। ওই মেয়ের মুখ তো মুখ নয় পঁচা নর্দমা। চরিত্রও ভীষণ বাজে। ওর সাথে আবিরের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বিয়েটা ভেঙে গেছে। আমরাই ভেঙে দিয়েছিলাম৷ সে আরো দুইবছর আগের ঘটনা।”

” হ্যাঁ আমি তখনকার কথাই বলছি আন্টি। এর আগে আলভীর সাথে আমার রিলেশন ছিল। ওই আপুটার জন্য সেই রিলেশন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। তারপর আবার আমাদের প্যাচআপ কিভাবে হয়েছিল জানেন? ছাব্বিশে অক্টোবর আলভীরা পাহাড় ট্রেকিং এ গেল না? সীতাকুন্ডে?”

” হ্যাঁ।”

” ওইখানে আমিও গিয়েছিলাম আমার ফ্রেন্ডদের সাথে। আপনার ছেলে খাদে পড়ে যাচ্ছিল। ওই খাদ থেকে আমি ওকে টেনে তুলেছি। কিন্তু ‘উপকারীকে বাঘে খায়’ একটা প্রবাদ আছে না? আপনার ছেলে হলো সেই বাঘ। আমি ওকে খাদ থেকে টেনে তুললাম, ওর জীবন বাচালাম, আর ও এখন আমাকেই ছেড়ে চলে যেতে চাইছে।”

অন্তরা আবার কাঁদতে শুরু করল। চোখে হাত দিয়ে কান্না। আফিয়া পড়ে গেলেন মহা মুশকিলে। এই মেয়ে কথা বলে কম, কাঁদে বেশি। একে কিভাবে সামলাবেন? উনি অন্তরার মাথায় হাত রেখে বললেন,” আহারে! কি করেছে কুলাঙ্গারটা তোমার সাথে?”

” প্রথমে আমার সাথে নাটক করেছে, বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন আমি.. আমি..”

অন্তরা আবার কাঁদতে লাগল। আফিয়া ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন,” মা তুমি নির্দ্বিধায় বলো। কি হয়েছে?”

” কিভাবে আপনাকে বলি কথাটা আন্টি? আপনি আমার মায়ের বয়সী।”

” আহা বলোই না। কি কথা?”

” আমি দুইমাসের প্র্যাগনেন্ট..”

তারপর আবার কান্না শুরু। আফিয়া মুখে হাত রেখে চোখ বড় করে বললেন,” কি বলো? হারামজাদা এতোবড় ঘটনা ঘটায় ফেলছে?”
অন্তরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ” শুধু তাই না আন্টি। এখন আমার সাথে ব্রেকআপ করতে চায় ও। আর.. দাঁড়ান.. দেখাই আপনাকে।”

অন্তরা হ্যান্ডব্যাগ থেকে একপাতা ট্যাবলেট বের করল। বলল,” এইযে দেখেন আন্টি, এগুলো আমাকে কিনে দিয়ে বলে কিনা অ্যাবর্শন করে ফেলতে।”

অন্তরা কাঁদছে। জোরে জোরে কাঁদছে। আফিয়া বিস্ফারিত চোখে অন্তরার হাত থেকে ট্যাবলেটের পাতাটা নিলেন। তার এসব দেখে মাথা ঘুরছে। চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে।

অন্তরা কান্না বজায় রেখে বলল,” আপনিই বলুন আন্টি, একটা বাচ্চা নষ্ট করা কতবড় অন্যায়! আমি ওকে জন্ম দিতে পারবো না, কিন্তু তাই বলে মেরে ফেলব? আমি কি এতোই পাষাণ! আপনিও তো মা। আপনিই বলেন কোনো মা কি পারে তার সন্তানকে মেরে ফেলতে?”

আফিয়া জবাব দিলেন না। তিনি রীতিমতো বাকরুদ্ধ। অন্তরা বলতে লাগল,” আমার বাসায় এ কথা জানলে এই বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলবে। এদিকে আপনার ছেলে আমার ফোনও ধরছে না। আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলনা। তাই বাধ্য হয়ে আপনার কাছে এসেছি। এখন আপনি এর একটা বিহিত করুন আন্টি। আপনিই আমার শেষ ভরসা। নাহলে আমি ভারী কলসি গলায় বেঁধে পানিতে ডুবে মরব। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার কাছে।”

আফিয়া অনেকক্ষণ পর মৃদু স্বরে বললেন,” ছি, ছি, এসব কথা বলে না মা। ”

অন্তরা কাঁদছে। আফিয়া বিস্ময় সামলে উঠতেই বললেন,” তুমি একদম ঠিক করেছো আমাকে এসব জানিয়ে। এবার শুধু দেখো আমি কি করি। তুমি ওঠো মা, অনেক কান্নাকাটি করেছো আর না। চোখ মোছো।”

” আন্টি বাসায় আমার বিয়ের কথা চলছে। কিন্তু আমি অন্যকাউকে কিভাবে বিয়ে করি বলেন? তাই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে একেবারে চলে এসেছি। আপনি যদি আমাকে আশ্রয় না দেন তাহলে আমি আ’ত্মহ’ত্যা করবো।”

” আমার ছেলে তোমার সাথে যেটা করেছে তার মাশুল ওকে দিতেই হবে। ও খালি আজ বাসায় আসুক।”

অন্তরা মাথা তুলে বলল,” আন্টি, আমি কিন্তু একেবারে বাসা থেকে চলে এসেছি। এই মুখ নিয়ে বাড়ি ফেরা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। যদি আপনারা এখান থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেন তাহলে আমি সোজা রেললাইনে গিয়ে মাথা দেবো।”

আফিয়া ভ’য়ে তটস্থ হয়ে বললেন,” আরে কি আবোল-তাবোল কথা! তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে কে? যাও আলভীর ঘরে গিয়ে বসো। হাত মুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হও। খেয়েছো কিছু?”

” না।” দুইপাশে মাথা নাড়ল অন্তরা।

আফিয়া বললেন,” আচ্ছা ঠিকাছে, আমি তোমাকে খাবার দিচ্ছি। যাও মা যাও, আর কান্নাকাটি করো না।”

অন্তরা কাঁদতে কাঁদতে আলভীর ঘরে গেল। আফিয়া মুখে হাত চেপে সোফায় বসে রইলেন। তার এখনও হাত-পা কাঁপছে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। তার কুলাঙ্গার ছেলেটা তলে তলে এতো কাহিনি ঘটিয়ে ফেলল আর উনি কিচ্ছু টের পেলেন না?

আলভী বাসায় এসে দেখল অন্তরা তারই ঘরের তারই বিছানায় আরাম করে শুয়ে মোবাইল টিপছে। অন্তরাকে বাসায় দেখে আলভীর মাথায় বাজ পড়ল যেন। বিস্ময়ে ঘাবড়ে গিয়ে বলল,” তুমি? তুমি এখানে কি করছো?”

অন্তরা মুচকি হেসে বলল,” এইতো, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম জান।”

” মানে? তুমি আমার বাসার এ্যাড্রেস কোথায় পেলে?” আলভী আ’তঙ্কে অস্থির। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে নাকি। মা-বাবা জিজ্ঞেস করলে সে কি উত্তর দেবে?

অন্তরা উঠে বসতে বসতে চোখ টিপে বলল,” পেয়েছি! মন দিয়ে খুঁজলে সব পাওয়া যায়।”

” এখনি আমার বাসা থেকে বের হও।”

” সরি, সেটা সম্ভব না।”

” মানে?”

” ওইযে দেখো আমার লাগেজ, সব গুছিয়ে একেবারে চলে এসেছি। তোমার কাছে।”

আলভীর মাথা কাজ করছে না। অন্তরা এসব কি বলছে? সে তীব্র মেজাজ দেখিয়ে বলল,” তুমি কি ফাজলামো করছো আমার সাথে? দেখো এসব করে কোনো লাভ নেই। আমি একবার বলে দিয়েছি রিলেশন রাখবনা মানে রাখবোই না। নাউ গো টু হেল।”

” রিলেশন তোমাকে রাখতে হবে না। আর আমি কেন হেলে যাবো? হেলে তো এবার তোমাকে পাঠাবো বেবি।”

আলভী রাগে ফুসতে ফুসতে অন্তরার লাগেজটা তুলে ওর হাতে দিয়ে বলল,” এক্ষুনি বের হও।”

এমন সময় আফিয়া ঘরে ঢুকলেন। পাথর কঠিন মুখে বললেন,” ও কোথাও যাবেনা। ওকে আমি থাকতে দিয়েছি, ও এখানেই থাকবে।”

আলভী অবাক হয়ে বলল,” ও। এবার বুঝতে পেরেছি। মেয়েটা তোমার ব্রেইনওয়াশ করে এই বাসায় ঢুকেছে তাইনা মা? এই বাসায় ওকে আমি এক মিনিটও টিকতে দিবো না। এই বের হও।”

আফিয়া ঠাস করে আলভীর গালে চড় মা’রলেন। মায়ের আক্রোশী আচরণে ভ্যাবাচেকা খেল। আফিয়া ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন,” এতোবড় একটা কান্ড করার পরেও লজ্জা করে না তোর? তুই আবার ওকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলছিস? বাসা থেকে তো তুই নিজে বের হবি। আজকে তোর বাবা আসুক! তারপর তোর বিচার হবে। অন্তরা তুমি চলে এসো, আমার ঘরে থাকবে।”

আফিয়া অন্তরাকে নিয়ে চলে গেল। আলভী বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ক্রমশ তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। নিজের চুল নিজ হাতে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অকারণেই টেবিলে কয়েক বার লাথি দিল সে। দেয়ালে কয়েকবার ঘুঁষি মারল৷ তবুও রাগ কমছে না।

আলভীর বাবা আহসানুল্লাহ বাসায় এসে সব শুনলেন। তবে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কেবল বিরাট একটা লাঠি নিয়ে আলভীকে বেরধক পেটানো শুরু করলেন। আফিয়া ঘাবড়ে গেলেন এ অবস্থা দেখে। পেটাতে পেটাতে ছেলেকে না মেরেই ফেলেন। উনি কাঁপা হাতে অনিকের মা ইলোরাকে ফোন করলেন। অনিকরা ওদের এলাকাতেই থাকে। যে কোনো সমস্যায় সাহায্যকারী প্রতিবেশীর মতো ছুটে আসেন ইলোরা।

আফিয়া ইলোরাকে ফোন করে বাড়ির পরিস্থিতি জানালানে। অনুরোধ করলেন অনিককে যেন এখানে পাঠানো হয়। ইলোরা শুনে হা হুতাশ করতে লাগলেন। আলভী ছেলেটাকে কত ভালো ভেবেছিলেন তিনি! অথচ সে এসব কি করল?

অনিক এসে আলভীদের বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা করল। আহসানুল্লাহ আর আফিয়াকে নিয়ে বৈঠকে বসল। অনিক মাঝখানে, দুইপাশে আহসানুল্লাহ আর আফিয়া। সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আলভী। মার খেয়ে ওর চেহারাই বদলে গেছে। আহসানুল্লাহ এখনও শান্ত হোন নি। একটু পর পরই মেজাজ গরম করে ছেলেকে মা’রতে যাচ্ছেন। অন্তরা আফিয়ার ঘরে চুপচাপ বসে আছে। বসার ঘরে কি আলোচনা হচ্ছে সেটাও কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে।

অনিক অন্তরা আর নোরার প্ল্যানের ব্যাপারে সব জানতো। সে আহসানুল্লাহকে ঠান্ডা করার উদ্দেশ্যে বলল,” আঙ্কেল, এভাবে রাগারাগি করে লাভ নেই। ঘটনা যেহেতু ঘটেই গেছে, আমাদের এখন উচিৎ একটা সমাধানে আসা।।”

আহসানুল্লাহ রাগান্বিত গলায় বললেন,” সমাধান পরে। আগে এই কুলাঙ্গারকে আমি পুলিশে দিবো। কত্তবড় জানোয়ার একটা মেয়ের গোটা জীবন নষ্ট করে দিল। এমন আরো কত জায়গায় কত কাহিনি করছে ও জানে আর ওর আল্লাহ জানে। ওই কু*ত্তা**রবাচ্চা, ওই হারামজাদা। তুই এখনি বের হো। আমার বাসা থেকা বের হো তুই।”

অনিক আহসানুল্লাহর হাত ধরে বলল,” আঙ্কেল থামেন। মাথা ঠান্ডা করে ভাবেন, ওকে পুলিশে দিলে মান-সম্মান আপনারই যাবে। আর মেয়েটারও বাসায় জানাজানি হবে। বদনাম ছড়াবে। তার চেয়ে ভালো আমি একটা কথা বলি, অন্তরাদের বাসায় আপনারা বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। বিয়ে ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

আহসানুল্লাহ আরও চটে গেলেন। উচ্চগলায় বললেন,” কোন মেয়ের বাবা মা রাজি হবে এই অধমের কাছে মেয়ে দিতে? ও তো এলাকার ভাদাইম্মা। না আছে কোনো চাকরি না আছে কোনো যোগ্যতা। এই গাধাকে আমি কেমনে বিয়া করাই? কিসের ভরসায়?”

” আঙ্কেল এতো কথা চিন্তা করার সময় এখন না। এতোবড় দুর্ঘটনা যেহেতু ঘটে গেছে, বিয়ে ছাড়া আমি আর কোনো উপায় দেখছি না। তাছাড়া বিয়ে না দিলে মেয়েটা যদি উল্টা-পাল্টা কিছু করে তখন কিন্তু দোষ আবার আপনাদের ঘাড়েই এসে পড়বে। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যাবে। এমনিতে তো হ্যারসমেন্টের কেইস হতো, পরে কিন্তু হয়ে যাবে মার্ডার কেইস।”

আফিয়া মাথা নেড়ে বললেন,” হ্যাঁ বাবা ঠিক বলেছো। আমিও সেটা ভেবেই মেয়েটাকে ঘরে রেখেছি।”

আহসানুল্লাহ খানিকটা আতঙ্ক নিয়ে বললেন,” এখন কি হবে বাবা? কিছু একটা করো তুমি।”

অনিক বলল,” শোনেন আঙ্কেল, আমি যেটা বলছি সেটা একবার ভেবে দেখেন। আপনি অন্তরাদের বাসায় প্রস্তাবটা দেন।”

” বাবা তুমি যতটা সহজ ভাবছো বিষয়টা কিন্তু অত সহজ না। ওরা কেমনে রাজি হবে? আর এই গাধার বাচ্চার কাছে তো অন্ধ-খোড়া মেয়েও বিয়ে দিবে না কেউ।”

” আঙ্কেল অন্তরা আমার স্টুডেন্ট। আমি না হয় টিচার হিসেবে ওর মা-বাবার সাথে কথা বলবো। ওদেরকে রাজি করানোর চেষ্টা করবো। আপনি খালি প্রস্তাব দেন। বাকিটা ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”

আহসানুল্লাহ মাথা নেড়ে বললেন,” ঠিকাছে, দেখি।”

ওমনি আলভী চেচিয়ে উঠল,” না আব্বু। আমি বিয়ে করবো না।”

আহসানুল্লাহ বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,” হারামজাদা! তুই আবার কথাও কস?”

বলতে বলতে পায়ের জুতা খুলে ছুড়ে মারলেন আলভীর গায়ে। আলভী ক্যাচ ধরে ফেলল। নিয়মিত ক্রিকেট খেলার এই এক সুবিধা। কেউ কিছু ছুড়ে মারলে সহজেই ক্যাচ ধরে ফেলা যায়।

অনিকের কথা অনুযায়ী আলভীর বাবা-মা অন্তরাদের বাসায় গেলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। নোরা ওইদিকে অন্তরার বাবা-মাকে বুঝিয়ে রেখেছিল। অন্তরা দুইবছর ধরে যে ছেলের জন্য ডিপ্রেশনে ছিল, ওই ছেলেটাই আলভী। অন্তরা ছেলেটাকে খুব ভালোবাসে। তাছাড়া পারিবারিক অবস্থাও খারাপ না আলভীদের। বড়ভাই বিদেশ থাকে। যে-কোনো সময় আলভীও চলে যাবে। এসব জেনে অন্তরার মা-বাবাও রাজি হলেন। অন্তরা-আলভীর বিয়ে ঠিক করা হলো।

বাড়ির পাশেই একটা খোলা মাঠে স্টেজ সাজানো হয়েছে। আজ অন্তরা আর আলভীর বিয়ে।প্যান্ডেল টানিয়ে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব বেশি আয়োজন না, ছোটখাটো অনুষ্ঠান। এলাকার কয়েকজন, অন্তরা-আলভীদের নিজস্ব আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়েই বিয়ের অনুষ্ঠান। আর অনিক-নোরা তো আছেই।

সেজুতি,তন্নী, রেশমি, জবা, এক কথায় কোচিং-এর সব বন্ধুরা এসেছে। এই অনুষ্ঠানে নোরা তিথি মেয়েটিকে সরাসরি দেখল। মেয়েটি অসম্ভব সুন্দর। আর বেশ লম্বাও। নোরার থেকে তো কমপক্ষে একহাত লম্বা। অনিকের পাশে দাঁড়ালে একদম পারফেক্ট লাগে। মনে হয় যেন মেইড ফর ইচ আদার জুটি। তিথিকে দেখে নোরার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এজন্যই কি অনিকের মা তিথিকে এতো পছন্দ করেন?

অনিক ম্যানেজমেন্টের কাজে ব্যস্ত। টেবিলে খাবার দেওয়া, আনা-নেওয়া,সবাইকে বেড়ে খাওয়ানো, সবকিছু অনিক আর ওর গ্রুপ মেম্বাররা করছে। অনিক আজকে লেমন কালার শেরয়ানি পরেছে। ওকে যে কি সুন্দর লাগছে! নোরার বারবার চোখ আটকে যাচ্ছে। এদিকে অনিকেরও একই অবস্থা। নোরা পিঠ অবধি লালচে চুলগুলো দুলিয়ে তার চোখের সামনে এপাশ-ওপাশ ছুটোছুটি করছে। অনিক যতবার তাকাচ্ছে ততবার ছোটখাটো ধাক্কা খাচ্ছে। তার উপর নোরা পড়েছে রাণী গোলাপী রঙের লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গার উপর সোনালী সুতোর কাজ। মুখে হালকা-পাতলা মেকাপও করেছে।

আজকে একদম অন্যরকম লাগছে নোরাকে। ওর চুলের রঙ আর গায়ের রঙের সাথে লেহেঙ্গার রংটা ভালোভাবে ফুটে আছে। যেন বিধাতার এক অনন্য সৃষ্টি! অনিক মুগ্ধচোখে নোরাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। অন্তরাকেও আজ ভীষণ মিষ্টি লাগছে। ওর বিয়ের শাড়িটাও মিষ্টি কালার। সেই শাড়িতে অন্তরাকে অপরুপ লাগছে। বধুবেশে কি সব মেয়েকেই এতো মানায়?

আলভীটা মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। আলভীর মুখ দেখে নোরার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এই বিয়েতে তার মত নেই, সেটা কি সবাইকে বোঝাতেই হবে? ওকে দেখে মনে হচ্ছে চেয়ারে স্কচটেপ লাগিয়ে ওকে জোর করে বেধে রাখা হয়েছে। উঠতে পারছে না বলে বাধ্য হয়ে বসে আছে। এই বিয়ে ভাঙার জন্য কত কান্ড যে সে করেছে! শেষমেষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

পরে আহসানুল্লাহ হু*মকি দিলেন অন্তরাকে বিয়ে না করলে ওকে ত্যায্য পুত্র করবেন। বাবার সম্পত্তির কানা-কড়িও সে পাবেনা। সেই ভয়েই বেচারা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আলভীর অসহায় মুখ দেখে নোরা মনে মনে পৈশাচিক আনন্দও পাচ্ছে।

নোরা খেতে বসার সময় সময় ইচ্ছে করেই অনিকের মা ইলোরার পাশে বসল। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যদি হবু শাশুড়ীকে একটু পটানো যায় সেই আশায়! কিন্তু লাভ হলো কই? ইলোরা একটিবারের জন্য নোরার সাথে কথাও বললেন না। এমনকি নোরার দিকে তাকালেন পর্যন্ত না। নোরা বামসাইডে বসেছিল। ডানসাইডে ইলোরা তিথির জন্য জায়গা রেখেছিলেন। তিথি এসে ওখানে বসল।অনিক টেবিলে খাবার দিতে আসার সময় হাসিমুখে একবার বলেছিল,” মা, ও নোরা। আমার স্টুডেন্ট।”

তখন উনি নোরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছেন। সেই হাসিতেও কপটতা, কৃপণতা। নোরার মনটা একেবারে খারাপ হয়ে গেল। তবে অনিকের বাবা ইসহাক সাহেব নোরার সাথে হাসিমুখে গল্প করছিলেন। ইসহাক পান খেতে খুব ভালোবাসেন। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর অনিক নোরার হাতে একটা পান দিয়ে বলল বাবার কাছে নিয়ে যেতে। নোরা ইসহাককে পান দিতে গেল। সেই উসিলাতেই হল গল্প।

অনিক ইসহাককে নোরার পরিচয় বলল। পরিচয় বলতে শুধু নাম। ইসহাক বাকিটা নিজে থেকেই বুঝে নিলেন। হবু শশুরমশাইকে নোরার বেশ পছন্দই হল। হাসি-খুশি ধরণের মানুষ। অথচ অনিকের মাকে দেখলে মনে হয় মুখের মধ্যে সারাক্ষণ ভারী কিছু পুরে রেখেছেন। হাসতে যেন ভীষণ কষ্ট হয় উনার। আর গালগুলো সারাক্ষণ ফুলে থাকে। যেন খুব রাগী মানুষ!

অনুষ্ঠান যখন প্রায় শেষের দিকে, কনে বিদায় হচ্ছে, অন্তরা মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে, সেই মুহুর্তে অনিক নোরাকে টেনে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে এলো। নোরা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

” লং ড্রাইভে।”

” মানে?”

অনিক যখন দেখল আশেপাশে কেউ নেই, তখন নোরাকে কোলে তুলে নিল। নোরার ভালো লাগলেও সে বিরক্তির ভাণ করে বলল,” ধুর! কি করছেন? কেউ দেখে ফেললে?”

অনিক জবাব দিল না। নোরাকে গাড়ির ভেতরে এনে বসাল। তারপর নিজে বসল ড্রাইভিং সিটে৷ নোরা বলল,” আমরা এখানে কেন আসলাম? কার গাড়ি এটা?”

” আদনান ভাইয়ের। একঘণ্টার জন্য ম্যানেজ করেছি। তোমাকে নিয়ে লংড্রাইভে যাবো।”

” এতোরাতে হঠাৎ লংড্রাইভে কেন?”

” তুমি এতো সুন্দর করে সেজেছো কেন? এ অবস্থায় একটু আদর করতে না পারলে তো আফসোসে মরেই যেতাম।”

অনিক নোরার কোমর ধরে ওকে নিজের কোলের উপর বসাল। নোরা লজ্জায় লুটিয়ে পড়ছে। বলল,” আপনার উদ্দেশ্যটা কি বলুন তো? এভাবে আমাকে অনুষ্ঠানের মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে আসলেন? সবাই তো পরে আমাদের খুঁজবে।”

” খুঁজুক। সবাইকে খুঁজতে দাও। আজরাতের জন্য নিখোঁজ হবো আমরা।”

নোরা আর কিছু বলার আগেই অনিক ওকে গ্রাস করে নিল।

আলভী ছাদের রেইলিং এর উপর বসে সিগারেট টানছে। ওর দুইপাশে শিপন আর আরিফ। আলভীর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর সকল কুকর্মের সঙ্গী। তিনজনের হাতেই মদের বোতল। আলভী মদও খাচ্ছে। আর বেহুশের মতো খালি টলছে। শিপন আলভীকে উদ্দেশ্য করে বলল,” কিরে মামা! আর কত খাবি? আজকা না তোর বাসররাত! আজকা এতো খাইস না। অসুবিধা আছে।”

আলভী চেচিয়ে উঠল,” রাখ তোর বাসররাত! এইডা বালের রাত। এই বিয়াই আমি মানি না আবার বাসর! ওই মাইয়ার লগে বাসর অনেক আগেই হইয়া গেসে। অয় এহন আমার কাছে মাল। ওইডাও মাল, এইডাও মাল। ওই মালের থেকা এই মালই ভালা। এইডাই খাই।”

আলভী মদের গ্লাসে চুমুক দিল। আরিফ বলল,” তুই বিয়াডা করলি ক্যা তাইলে?”

আলভী তাচ্ছিল্যের হাসি দিল,” চাপ মামা চাপ! চাপে পইড়া করসি। ওই মাইয়ারে বিয়া না করলে আমার বাপে আমারে ত্যায্য করতো। কপাল কইরা একটা বাপও পাইসি বটে। শালার জীবনডাই ত্যানা বানায় দিল।”

আলভী হাতের গ্লাসটা জোরে ছুড়ে মারল। ঝনঝন শব্দে গ্লাসটা ভেঙে পড়ল।শিপন বলল,” আরে কি শুরু করলি?”

আরিফ বলল,” ওর মাথা ঠিক নাই। নেশা হইয়া গেসে মনে হয়। ধর ওরে, নিচে নিয়া যাই।”

আলভী বলল,” ওই থাম! আমি কোনোখানে যামু না। ওই মাইয়ার কাছে তো জিন্দেগীতেও না। ওরে আমি মানি না, মানমু না। সব হইসে ওই কালনাগিনী নোরার লাইগা। মাইয়াটা মিচকা শয়তান বুঝলি? ওই মাইয়ারে যতদিন শিক্ষা দিতে না পারমু, আমার শান্তি নাই। আমার জীবনডা দোযখ বানায় ছাড়সে অয়। ওরে আমি ছাড়মু না।”

আরিফ রসিকতাপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল,” কি করবি? অয় তো শুনলাম অনিক ভাইয়ের জানের জান। ওরে কিছু করার সাধ্য কি তোর আছে? মুখেই খালি তোমার ফটরফটর মিয়া!”

শিপন আরিফের কথায় হাসল।আলভী আগুন গরমচোখে তাকাল। আচমকা আরিফের গালে চড় বসিয়ে দিল সে। আরিফ হকচকিয়ে গেল। আলভী কাপা কাপা কণ্ঠে বলল,” তুই এই কথা কইয়া আমার রাগ আরো একশো গুণ বাড়ায় দিসোস। বুকের মধ্যে দাউদাউ কইরা আগুন জ্বলতাসে আমার। এই আগুন এতো সহজে নিভবো না। ওই মাইয়ারে তো আমি দেইখা লমুই। তোরেও দেইখা লমু।”

শিপন বলল,” কি করবি দোস্ত? মুখে এসিড মারবি?”

আলভী বাঁকা হেসে বলল,” অয় যা করসে, ওইডার লাইগা এই শাস্তিও খুব কম হইয়া যায়। আমার পুরা জীবনডা নষ্ট করসে ওই মাইয়া। ওর জীবনও আমি তেজপাতা বানামু। ওরে এমন শিক্ষা দিমু, যেন সারাজীবন মনে রাখে। আমার নাম বুকের মধ্যে গাইথা রাখে। চাইলেও যেন কোনোদিন ভুলতে না পারে।”

আলভী শয়তানি হাসিতে মত্ত হল। ওর চোখেমুখে তীব্র ক্রোধ উপচে পড়ছে। শিপন আর আরিফও সেই হাসি দেখে ভয়ে শিউরে উঠল। এই হাসি যেন হাসি নয়, সর্বনাশের ইঙ্গিত!

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১৪

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_১৪
লিখা: Sidratul muntaz

প্রায় একঘণ্টার মতো নৌকাভ্রমণ শেষে ওরা পাড়ে উঠে এলো। নোরা চাইছিল আরো কিছুক্ষণ ঘুরতে। কিন্তু মাঝি বেশি গভীরে যেতে চাইল না। রাতেরবেলায় বন্যপ্রাণীর উপদ্রব থাকতে পারে। অনিক নৌকা থেকে নেমে মাঝিকে বলল,” থ্যাঙ্কিউ ভাই।”

মাঝি আবার সেই দাঁত বের করা হাসিটা দিল। নোরা ভয়ে অনিকের হাত জড়িয়ে ধরল। নৌকায় থাকাকালীন পুরোটা সময় এই মাঝি বেটাকে কেন জানি সন্দেহ হচ্ছিল নোরার। মনে হচ্ছিল এই বেটা ইচ্ছে করে নৌকা উল্টে অনিককে ফেলে দিবে৷ তারপর তাকে নিয়ে চলে যাবে। সীতাকুন্ডের দূর্ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে।

গাড়িতে বসেও রাতারগুলের দৃশ্য স্মৃতিতে ভাসছে নোরার। ঘোর এখনও কাটেনি। অনিকের কাঁধে মাথা ঠেঁকিয়ে সুন্দর মুহুর্তগুলো কল্পনা করছে সে। অনিক বলল,” কেমন লাগল নৌকাভ্রমণ?”

নোরার কোনো উত্তর নেই। অনিক আবার ডাকল,” নোরা!”

এবারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর খেয়াল করে দেখল মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। অনিক মৃদু হাসল। নোরাকে আর ডাকল না। বরং সে খানিকটা সিটের সাথে হেলে নিচু হয়ে বসল। যেন নোরা আরাম করে ঘুমাতে পারে। অনিক সুবিধাজনকভাবে বসতেই নোরা একটু নড়েচড়ে আরো ভালো করে কাঁধে মাথাটা রাখতে পারল।

সে অনিককে জড়িয়ে ধরে এক পা অনিকের উপর তুলে দিয়েছে। অনিকের ভালোও লাগছে। আবার নোরার নরম কোমল স্পর্শে তার শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে।রিসোর্টে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেছে। গ্রুপ মেম্বাররা সব ঘুমে কাবু। নোরার ঘুম ভাঙেনি। তাই এবারও নোরাকে কোলে নিয়ে রিসোর্টে ঢুকল অনিক। তারপর বিছানায় শুয়িয়ে দিল। অন্তরা এখানে নেই। হয়তো ফেরেনি এখনও৷ এদিকে নোরা অনিকের একহাত ধরে আছে। হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। নোরা আরো ভালো করে জড়িয়ে ধরেছে।

অনিক নোরাকে ছেড়ে উঠল না। হাত ছাড়াতে গেলে নোরা বিছানা থেকেই পড়ে যাবে৷ এখন উপায় হল নোরাকে ঘুম থেকে জাগানো নাহলে এভাবেই বসে থাকা। নোরাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। একদম বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। কি যে মিষ্টি লাগছে! অনিক ওকে এমনি এমনি মিষ্টিপরী ডাকেনা।

সারারাত কেটে গেল। অনিক একইভাবে বসেছিল। অন্তরা রাতে রিসোর্টে ফেরেনি। যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল, অনিক চমকে উঠল। এতো দ্রুত সকাল হয়ে গেছে? নোরা একসময় নিজে থেকেই অনিকের হাত ছেড়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল। অনিক তারপর উঠে বিছানায় বসল। তারপর নোরার পাশে শুয়ে পড়ল। নোরার হাতের সাথে অনিকের শরীর লাগতেই সে শক্ত করে অনিককে জড়িয়ে ধরল। অনিকের শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে কি তাকে আজকে ঘুমাতেই দিবেনা?

অনিক ঘুমালনা। জেগেই থাকল। সারাটাসময় নোরার কোমল শরীরের উষ্ণতা অনুভব করে জেগে থাকা।

সকালে ঘুম ভাঙতেই নোরা আবিষ্কার করল সে একদম কোলবালিশের মতো অনিককে ব্যবহার করে শুয়ে আছে৷ চ’মকে উঠে অনিককে ছেড়ে দিল। ওরা রাতারগুল থেকে রিসোর্টে কখন এলো? তার তো কিছুই মনে পড়ছে না। অন্তরা কোথায়?

একটা হাই তুলে অনিকের দিকে তাকাল নোরা। ছেলেটা কি সুন্দর করে যে ঘুমায়! কি নিষ্পাপ মুখ। নোরা কিছুক্ষণ অনিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কপালে একটা চুমুও দিল৷ এই পর্যন্ত যতবার অনিকের ঘুমন্ত মুখ ও দেখেছে, কপালে চুমু না দিয়ে থাকতে পারেনি। এতো কিউট ফেসটা দেখে চুমু না দিয়ে কি থাকা যায়?

আচ্ছা অনিককে এভাবে ঘুমাতে তিথি কি কোনোদিন দেখেছে? যদি দেখে থাকে তাহলে সেও নিশ্চিত অনিককে চুমু দিয়েছে। ওই মেয়ে তো জাগ্রত অবস্থাতেই নির্লজ্জের মতো অনিককে লিপকিস করে বসে। কি সাহস! তাহলে ঘুমন্ত অবস্থায় কি করবে আল্লাহ মালুম। অনিককে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। সে ঘুমন্ত অবস্থায় তিথি কখনও তার রুমে এসেছিল কিনা। নোরা এইকথা ভেবে নিজের মাথাতেই গাড্ডা মারল। অনিক ঘুমন্ত অবস্থায় থাকলে কিভাবে বুঝবে তার রুমে কে এসেছে আর কে আসেনি! তবে এইটা জিজ্ঞেস করা যায়, অনিক ঘুমানোর সময় দরজা খুলে ঘুমায় নাকি বন্ধ করে। তাহলেই বুঝা যাবে।

নোরা ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। অনিক চোখ খুলে তাকাল। তারপর নিজে নিজেই হাসল।ওরা আজকেও সারাদিন ঘুরে কাটিয়েছে। তবে আজ সবাই একসাথে। প্রথমে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, জাফলং,ঝর্ণা আরো বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরের দিন ঠিক করা হয় বিছানাকান্দি যাবে। কিন্তু নোরা রাজি হলো না৷ তাকে কালকেই ঢাকায় ফিরতে হবে। সন্ধ্যায় তারা দু’জন ক্লান্ত শরীরে রিসোর্টে ফিরে এলো। বাকিরা তখনও ঘুরাঘুরি আর শপিং-এ ব্যস্ত। জাফলং এর স্বচ্ছ পানিতে প্রায় আধঘন্টার মতো শুয়েছিল নোরা। ওর এখন ঠান্ডা লেগে, গলা ভেঙে যা-তা অবস্থা।

অনিকেরও তাই। রিসোর্টে ফিরে অনিক ভেজা জামা-কাপড় চেঞ্জ করল। আর নোরা ঢুকল গোসলে। বিশ পঁচিশ মিনিটের গোসল শেষে চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখল অনিক সোফাতে গা এলিয়ে টিভি দেখছে। নোরা অনিকের কাছে গিয়ে বসল। আহ্লাদী গলায় বলল,” এই! কি করছেন?”

অনিক মুচকি হেসে নোরার গাল টিপে দিয়ে বলল,” টিভি দেখি।”

,” দেখবেন না টিভি। টিভি পঁচা।”

” তাহলে কি করবো?”

” আমাকে দেখবেন।”

” তুমি দেখালেই না দেখবো।”

অনিকের কথার অর্থ ধরতে পেরেই নোরা চোখ বড় করে তাকাল। তারপর তার হাতে জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিল। অনিক কঁকিয়ে উঠল,” আহ!”

” আর বলবেন এসব কথা? হুহ।”

নোরা নিজ দায়িত্বে টিভি বন্ধ করল। রিমোর্টটা একসাইডে ফেলে কঠিনগলায় বলল,” নিন, এবার গল্প করুন।”

” কি গল্প শুনবে?”

নোরা আগ্রহ নিয়ে বলল,” তিথির গল্প।”

অনিক বিরক্ত হয়ে বলল,” ওর আবার কি গল্প?”

” বলুন না শুনি?”

” কি বলবো? তুমি প্রশ্ন করো আমি উত্তর দেই।”

” আচ্ছা তিথির সাথে যে ঘটনাটা আপনি ফোনে লিখে রেখেছেন ওইরকম ঘটনা কি আর কখনো ঘটেছে?”

অনিক গম্ভীরমুখে বলল,” না। ভুলেও না।আর কখনো ঘটলে ওই মেয়েকে শুন্যে তুলে আছাড় মারতাম আমি।”

নোরা হেসে উঠল। অনিক রাগী গলায় বলল,” টপিক চেঞ্জ করো। ওর বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না।”

” তাহলে আমার বিষয়ে বলুন।”

” তোমার বিষয়ে কি?”

” আমাকে আপনি কবে থেকে ভালোবাসেন?”
” ডায়েরীতে লেখা ছিল, ১৬ই জানুয়ারি, ২০২০।”

” আচ্ছা এত্তোদিন ওয়েট করে কিভাবে থাকলেন? তার উপর আমাকে কিছু বুঝতে পর্যন্ত দেন নি। দিনের পর দিন আমাকে ফলো করে গেছেন অথচ আমি জানতেও পারিনি। ক্ষুণাক্ষরেও কিছু টের পাইনি। কিভাবে সম্ভব বলুন না।”

অনিক হালকা হাসল,” আসলে ইচ্ছে করেই কোনোদিন তোমার সামনে আসিনি। ভয় লাগতো।”

নোরা অবাক হয়ে বলল,” কিসের ভয়?”

” শুনেছিলাম তুমি নাকি ছেলেদের সাথে প্রেম করো আর ছ্যাকা দাও। এটা নাকি তোমার প্যাশন? এমনকি তোমার ফেসবুক প্রোফাইলের বায়োতেও ছিল,’ ফ্লার্টিং ইজ মাই প্যাশন। ফ্লার্টিং ইন মাই ভেইন। সো বয়েস,থিংক টোয়াইজ।’ এসব দেখে আমার ভয় লাগতো। যদি আমার সাথেও এমনকিছু করো? আর রিজেক্ট হওয়ার ভয় তো ছিলই। তুমি আমাকে রিজেক্ট করলে আমি মরেই যেতাম।”

” আপনি কি পাগল? আপনি কি করে ভাবলেন আপনার মতো ছেলেকে আমি রিজেক্ট করবো? সেই যোগ্যতা আছে আমার? শুধু একবার প্রপোজ করেই দেখতেন! নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যেতাম।”

” এইখানেই তো ভয়। আমি তোমাকে প্রপোজ করলে তুমি হয়তো আমার হাইট,ওয়েট,ফিগার,এসব দিয়ে আমাকে বিচার করতে। তখন কিন্তু সেটাকে বলা হতো মোহ। যা সাময়িক। খুব অল্প সময়ের জন্য। তার উপর তোমার বয়সটাও ছিল সেরকম। চোখের দেখায় ভালোলাগাকেই তখন ভালোবাসা মনে হয়। আমি তোমাকে প্রপোজ করলে তুমি ভাবতে, ছেলেটা তো সুন্দর! একটু বাজিয়ে দেখি,এক্সেপ্ট করে ফেলি! কিন্তু আমার ভালোবাসার গভীরতাটা বোঝার সাধ্য তোমার হতোনা। তারপর একটা সময় আমার থেকেও বেটার কাউকে পেলে তোমার মনে হতো সে আরো পারফেক্ট। তুমি কারো গুরুত্বটা বুঝতে না। কিন্তু যখন আমি তোমার টিচার হলাম, তুমি আমাকে দেখলে, জানলে,পরিচিত হলে, বুঝতে পারলে আমি কেমন মানুষ। কিন্তু সত্যি করে বলোতো, অনিকস্যার মানে আমার মধ্যে তুমি যেমন এ্যাটিটিউড দেখেছো তা কি সত্যিই তোমার পছন্দনীয়? তুমি কি এমন ছেলে আগে পছন্দ করতে?”

নোরা ঠোঁট উল্টে বলল,” উহুম!”

” তাহলে আমাকে তোমার কেন ভালো লাগলো? আমার কোনোকিছুই তো তোমার পছন্দ ছিলনা। আমি তো এক্সট্রা ভাবওয়ালা ছিলাম তাইনা?”

নোরা লজ্জা পেয়ে হাসল। অনিক বলল,” এইযে সবসময় এতো রুড বিহেভ করতাম তোমার সাথে, আজাইরা লেকচার দিতাম, ধমকাতাম, বোরিং বোরিং কথা বলতাম, তবুও তুমি আমার সবকথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে। আমি যেটাই করতাম সেটাই তোমার পছন্দ হতো এমনকি যেটা তোমার সবথেকে অপছন্দ সেটাও যদি আমি করতাম তাও তোমার ভালো লাগতো। ”

নোরা মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ লাগতো।”

অনিক বলল ” আর আমার কাছে একটু কম এ্যাটেনশন পেলেই তোমার মনখারাপ হয়ে যেত।”

” হুম, হতো। খুব মনখারাপ হতো।”

” আমি অন্যকারো প্রশংসা করলে, অন্যকারো সাথে হেসে কথা বললেও তোমার রাগ হতো, হিংসা হতো।”

” অবশ্যই হতো। বিশেষ করে তন্নী।”

অনিক হো হো করে হেসে দিল। বলল,” জানি তো। এসব কেন হতো জানো নোরা? কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসতে। এটা তুমি নিজে রিয়েলাইজ করেছো। আমি তোমার কাছে কতটা ইম্পোর্টেন্ট সেটা এখন তুমি নিজেই বুঝো। কিন্তু যদি আমি তোমাকে সরাসরি প্রপোজ করতাম, তাহলে হয়তো আমার জন্য এসব ফিলিংস তোমার কখনোই আসতো না। তুমি আমাকেও আর পাচঁটা সাধারণ ছেলের মতো ট্রিট করতে। কিন্তু এখন আমি তোমার কাছে সাধারণ কেউ নই। খুব স্পেশাল আমি তোমার কাছে। তোমার বেস্ট চয়েস। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম, তোমার বেস্ট চয়েস হতে।”

নোরা হঠাৎ অনিকের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” আপনিও এমনিতেও আমার বেস্ট চয়েস। শুধু আমার কেন? আপনি যে কারো জন্য বেস্ট। বেস্ট বেস্ট বেস্ট! আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী যে আমি আপনাকে পেয়েছি। আল্লাহর দেওয়া সবথেকে দামী উপহার হলেন আপনি। আমি আপনাকে কক্ষনো হারাতে চাইনা।”

” ডট ডট ডট।”

” মানে?”

” মানে আমার ক্ষেত্রেও তাই। আমিও তোমাকে কক্ষনো হারাতে চাই না। সারাজীবনের জন্য চাই।”

নোরা হেসে অনিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ ফোনের শব্দে দু’জন আলাদা হল। নোরার ফোনটা বাজছে। অনিক ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল ‘বাবা’ লিখা। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” শ্বশুরমশাইয়ের ফোন।”

” ওহ। বাসার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানে আসার পর বাবার সাথে বেশি কথা হয়নি।”

নোরা তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো আব্বু, আসসালামু আলাইকুম। ”

” কেমন আছো মা?”

” আমি ভালো আছি৷ তুমি কেমন আছো আব্বু?”

” এইতো আল্লাহ রাখছে! তুমি কি করো?”

” অন্তুর সাথে বসে টিভি দেখছি আব্বু। তুমি কি করো?”

” আমি তো অফিস থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম। রিকশায় উঠে ভাবলাম তোমার সাথে একবার দেখা করে যাই। একবার বারান্দায় আসতে পারবে মা? আমি অন্তরাদের বাসার সামনে দিয়েই যাচ্ছি।”

নোরার গলায় শব্দ আটকে গেল। এখন কি জবাব দেবে?আমতা- আমতা করে বলল,” বারান্দায়? ওদের বারান্দার দরজায় তো তালা দেওয়া থাকে আব্বু। দরজা খোলা নিষেধ। আসতে পারবো না। আর তুমি এই কিছুক্ষণের জন্য আবার রিকশা থেকে কেন নামবে? চলে যাও না থাক।”

” রিকশা থেকে নামতাম না। রিকশায় বসেই দেখতাম একনজর। আচ্ছা আসতে না পারলে থাক। অন্তরার মায়ের কি অবস্থা এখন?”

” আন্টি তো এখনও হসপিটালেই আছে। অবস্থা ভালোই। আউট অফ ডেঞ্জার। তুমি টেনশন করো না আব্বু। দুই-একদিনের মধ্যেই আন্টিকে রিলিজ দিয়ে দিবে। তারপর আমিও বাসায় চলে আসবো।”

” ও তাই? আচ্ছা সাবধানে থেকো মা, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো, আর কিছু দরকার লাগলে বাবাকে অবশ্যই ফোন করবে।”

” আচ্ছা আব্বু, তুমি টেনশন করোনা। আমি একদম ঠিকাছি। আর তুমিও ভালো থেকে, মাকে টেনশন করতে নিষেধ করো।”

” আচ্ছা মা রাখছি।”

” আচ্ছা বাবা।”

নোরা ফোন কেটে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল। অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,” খুব জোর বেঁচে গেছি। বাবা আমাকে দেখার জন্য অন্তরাদের বারান্দায় যেতে বলছিল। কি একটা বিপদে পড়তাম বলেনতো?”

অনিক নোরাকে কাছে টেনে বলল,” শ্বশুরমশাই দেখছি নিজের মেয়ের জন্য একটু বেশিই চিন্তা করে। কিন্তু উনি তো এইটা জানেন না উনার একমাত্র আদরের মেয়ে জামাইয়ের কাছে খুব আদরেই আছে। জানলে আর টেনশনই করতেন না।”

নোরা হেসে বলল,” ধ্যাত!”

অনিক নোরাকে কিস করতে যাচ্ছিল এমন সময় আবারও ফোন বেজে উঠল। অনিক ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল,” শালির ঘরে শালি।”

নোরা অবাক হয়ে বলল,”মানে?”

বলতে বলতেই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অন্তরার ফোন। অনিক কেন একথা বলেছে সেটা এবার বুঝল। একটু হেসে নোরা ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো অন্তু! বল, কি খবর? কোথায় তোরা?”

ওই পাশ থেকে ভেসে এলো অন্তরার আতঙ্কিত কণ্ঠ,” দোস্ত! ঘটনা হ্যাজ ঘটেক্টেড বাই দুর্ঘটনা।”

” মানে?”

” মানে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।”

” কি ঘটছে? তালবাহানা না করে সোজাসুজি বল।”

” আরে আজকে আমার মা’র সাথে আঙ্কেলের আরএকে টাওয়ারে দেখা হইছিল।”

” আঙ্কেল মানে? আমার বাপ?”

” তো কি আমার বাপ? আমার বাপকে কি আমি আঙ্কেল ডাকি? তোর বাপকে তো ডাকি।”

” হায় হায় কি বলিস? আব্বু তো তাইলে সব বুঝে গেছে।”

” শুধু কি তোর বাপই বুঝছে? আমার মা বুঝে নাই? ”

” হ্যাঁ তাইতো।”

” তুই যে আমার সুস্থ স্বাভাবিক মাকে আইসিউতে ভর্তি করিয়ে সিলেট ঘুরতে এসেছিস আর আমিও যে তোর বাপকে নিয়ে মিথ্যে বলছি এটা এখন তারা বুঝে গেছে। কিন্তু ভাগ্যিস, দু’জন যে একজন-অন্যজনকে সুস্থ দেখে হার্ট এটাক করেনি এটাই বড় বিষয়। নাহলে আমরা যেই প্যাঁচ লাগিয়ে আসছি… এতোক্ষণে তাদের হার্ট ফেইল করে আসলেই আইসিউ তে থাকার কথা ছিল।”

নোরা ঘামছে। ভীত কণ্ঠে বলল, ” তোর মাকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখে আব্বু যে হার্ট ফেইল করেনাই এটাই ভাগ্য। ”

অন্তরা হেসে বলল,” সেটাই তো বলছি আমি।”

” তোর হাসি পাচ্ছে? এদিকে আমার কান্না আসছে।”

” এতো ভ’য়ের কিছু নাই। আমি আম্মুকে ম্যানেজ করে ফেলছি।বলছি আমি কক্সবাজার ট্যুরে আসছি সব ফেন্ডদের নিয়ে। আম্মু হয়তো একটু গ্যাজাবে… পরে মাফ করে দিবো। তুইও এখন আঙ্কেলকে ফোন দিয়ে এটা বল আর মাফ চা৷ আঙ্কেল তো ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। মাফ করে দিবে।”

নোরা হতাশ গলায় বলল,”খুব সওয়াবের কথা বলেছিস বোন। কিন্তু আমার বাবা এতো সহজ-সরল না। উনি আমাকে একটু আগেই ফোন দিছিল। বলছিল তোদের বাসার বারান্দায় আসতে। আমাকে নাকি দেখবে। এবার বুঝতে পারছি কেন বলছে।”

” ওরে, আঙ্কেলের তো ব্যাপক বুদ্ধি। ওইদিকে আম্মুর কাছে আমার খবর জেনে নিল আর এদিকে তোকেও বাজিয়ে দেখল। ”

” কিন্তু আমি তো ফেঁসে গেছি। একটু আগেই আব্বুকে বানিয়ে বানিয়ে কত মিথ্যা বললাম,এবার আমার কি হবে রে দোস্ত?”

” আরে প্যারা নাই। নাকে তেল দিয়ে ঘুমা। আঙ্কেলকে আমি বুঝিয়ে বলবোনে।”

” কিন্তু কাহিনি তো সেই একই। আমি আব্বুকে মিথ্যে বলেছি।”

” তো সেটা তো তুই আসলেই বলেছিস। অন্তত অনিকস্যারের বিষয়টা ধামাচাপা পড়বে এটা নিয়েই শুকরিয়া আদায় কর।”

” হ্যাঁ সেটাই। আর আমার কি কপাল দেখ, জীবনে প্রথমবার মাত্র আব্বুর সাথে মিথ্যে বললাম, আর প্রথমেই হাতে নাতে ধরা। ধুর! এখন আব্বু আর কোনো কথাই আমার বিশ্বাস করবে না।”

” থাক বাদ দে। কি আর করার। আর আমরা কিন্তু সকালে উঠেই রওনা দিবো। তারপর দু’জন একসাথে গিয়ে আঙ্কেলের কাছে মাফ চেয়ে আসবো। আঙ্কেল মাফ করে দিবে চিন্তা করিস না।”

” তুই কখন ফিরবি অন্তু?”

অন্তরা ফিসফিস করে বলল,” আজরাতে আমি ফিরবো নারে। আলভীর সাথে একটা জায়গায় এসেছি। রাতটা এখানেই কাটাবো৷ তুই অনিকস্যারের সাথে ইঞ্জয় কর না? রাখছি বায়৷ সকালে দেখা হবে।”

অন্তরা লাইন কেটে দিল। নোরা হতভম্ব। চিন্তাগ্রস্ত মুখে অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,” অন্তরা রাতে ফিরবে না।”

অনিক এতোক্ষণ গালে হাত রেখে সব শুনছিল। এবার বলল,” এটা আমি আগেই বুঝেছিলাম৷ এখন বলো কি হয়েছে?”

নোরা অসহায় মুখে অনিককে সব বুঝিয়ে বলল। অনিক রাগান্বিত স্বরে বলল,” আমি আগেই তোমাকে সাবধান করেছিলাম নোরা। এখন ঝামেলা হলো তো?”

অনিকের ধমকে নোরা হালকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মাথা নত করে বলল,” স্যরি।”

অনিক কিছু একটা ভেবে বলল,” থাক বাদ দাও। এখন সলিউশন কি বলো? আমাদের কাল সকালেই ফিরে যেতে হবে?”

” আপনারা যেতে না চাইলে থাকুন। আমি আর অন্তরা চলে যেতে পারব।”

” পাগল? আমি তোমাদের একা ছাড়ব?এতো রিস্ক নেওয়ার দরকার নেই।”

নোরা হঠাৎ হেসে বলল,” এখানে না এলে তো আমার জীবনের বেস্ট মুহুর্তগুলোই মিস করে যেতাম। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। কিন্তু এখন আমার মনখারাপ।”

” কেন?”

” কাল এখান থেকে চলে যাচ্ছি যে, তাই। ”

অনিক সামান্য হাসল। নোরা বিষণ্ণ স্বরে বলল,” কাল থেকে তো আবার সব আগেরমতো হয়ে যাবে। যখন তখন আপনাকে আর দেখতে পারবো না। আবার আগেরমতো দিনে মাত্র একবার দেখা। তাও লুকিয়ে লুকিয়ে। এই সময়গুলোকে খুব মিস করবো। আপনাকে খুব মিস করবো।”

এসব বলতে বলতে অনিকের বুকে মাথা রাখল নোরা। অনিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” এজন্যই বলেছিলাম, চলো বিয়েটা করে ফেলি। তারপর এখানেই সেটেল হয়ে যাই। ঢাকা ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু তুমি তো রাজি হওনা।”

” ধ্যাত! ইয়ার্কি করবেন না তো।”

অনিক হেসে বলল,” তোমাকে আমিও খুব মিস করবো নোরা। এখন শুয়ে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে৷ আমি পাশের রুমে সাব্বির ভাইদের সাথে যাচ্ছি।”

” না, ওই একরুমে এতো মানুষ কি করে থাকবেন? দরকার নেই। আপনি এখানেই সোফায় শুয়ে পড়ুন না! কতবড় সোফা।”

” আমাকে রুমে রেখে তুমি ঘুমাতে পারবে তো? ভ*য় লাগবে না?”

নোরা আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,” না৷ লাগবে না।” পর পর আবার বলল,” আচ্ছা,কি দরকার আজরাতটা ঘুমানোর? চলুন না আমরা বসে গল্প করি।”

নোরার ভেজা চুল থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। মায়াবী মুখটা কি স্নিগ্ধ। ক্রমশ ঘোর আকর্ষণের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। যতক্ষণ কাছে থাকবে ততক্ষণই বিপদ। অনিক তাকে দূর করার জন্যই বলল,” না। ঘুমাতে হবে। নাহলে সকালে উঠে জার্নি করতে পারবে না। এখন যাও ঘুমাও গিয়ে। আমাকেও ঘুমাতে দাও।”

অনিক উল্টোদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ল। নোরা কিছুক্ষণ বসে থেকে সেও চলে গেল ঘুমাতে।

সকালে সবাই সিলেট থেকে বাস ধরে রওনা দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পৌঁছানোর পর নোরা আর অন্তরা দু’জন মিলেই আনিস সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইল। অন্তরা বলল,” স্যরি আঙ্কে, নোরার কোনো দোষ নেই। আমি ওকে জোর করে নিয়ে গেছিলাম।”

আনিস বললেন,” তোমাদের মিথ্যে বলাটা উচিৎ হয়নি। ট্যুরে যাওয়ার বিষয়টা আমাকে জানালেই হতো। আমি কি অনুমতি দিতাম না? এতোবড় একটা মিথ্যে সাজানোর কি দরকার ছিল? ”

নোরা মাথা নিচু করে বলল,” সরি আব্বু।”

আনিস বললেন,” এবারের মতো মাফ করলাম। আর কখনও যেন এমন না হয়।”

তারপর অন্তরার বাড়িতে গিয়েও একই কাজ। নোরা বলল,” স্যরি আন্টি, অন্তরার দোষ নেই। আমি ওকে জোর করে নিয়ে গেছিলাম।”

অন্তরার মা দু’জনকেই ক্ষ’মা করলেন। তবে তিনিও সাবধান করলেন, আর কখনও যাতে এমন না হয়। দুই বান্ধবী নিজেদের পরিকল্পনা সফল করতে পেরে গর্বিত। একসাথে বসল গল্প করতে। তিনদিন দুইরাতের ট্যুরে কে কি মজা করল, কেমন করে কাটাল সেই গল্প। নোরা অন্তরাকে ওদের ঘুরাঘুরির সব ঘটনা বলল। অন্তরা বলল,” ওয়াও! তোরা এতো মজা করেছিস?”

” হুম। এই দুইদিন আমার লাইফের বেস্ট দুইদিন ছিল। আমি কক্ষনো ভুলব না।তোরা কি করেছিস? কোথায় কোথায় ঘুরেছিস?”

” আমরা তো তেমন ঘুরাঘুরিই করিনি। আলভী আমাকে অন্য আরেকটা রিসোর্টে নিয়ে গেছিল।”

অন্তরা চোখ বড় করে শুধাল,” কি বলছিস? তোরা আলাদা আরেকটা রিসোর্টে ছিলি?”

” হুম, খুব নিরিবিলি আর এক্সপেন্সিভ সেই রিসোর্ট। তাই মাত্র একরাতই এফোর্ট করতে পেরেছে আলভী। কিন্তু সেই রাতটা আমার লাইফের বেস্ট রাত ছিল।”

নোরা দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলল,” সারারাত কি করেছিস শুনি?”

অন্তরা ঢঙ করে চিকনগলায় বলল,” বলা যাবে না।”

নোরাও আর ঘাটাল না ব্যাপারটা। সে যা আশঙ্কা করছে তা যেন না হয়। সবকিছু ভালোই চলছিল। অনিক-নোরার প্রেমকাহিনীও আগের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে নোরার এডমিশন টেস্টের সময় চলে এলো। কিন্তু নোরা পড়া-শুনা নিয়ে মোটেও সিরিয়াস হচ্ছে না। মেডিকেলের এডমিশন টেস্ট তার একদম ভালো হয়নি। এখন সামনে ঢাবি আর বুয়েটের এক্সাম৷ দিন-রাত এক করে পড়াশুনা করছে নোরা।

অনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নোরাকে বাসায় এসে পড়াবে। বুয়েটে চান্স পেয়ে গেলে নোরা হবে তার জুনিয়র। তাই সে খুব ডেডিকেশন এর সাথে নোরাকে পড়াতে চাইছে। লীরা আর আনিস সাহেবের সাথে এই বিষয়ে কথা বলল নোরা। আনিস সাহেব মেয়ের পড়াশুনার প্রতি এতো আগ্রহ দেখে খুশি হলেন। তাছাড়া বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের ছাত্র এতো অল্প বেতনে বাসায় এসে পড়াতে চাইছে, এটাই তো বিস্ময়কর ব্যাপার! যে শোনে সে অবাক হয়। আনিস সাহেব মত দিয়ে দিলেন। অনিক এখন নিয়মিত নোরাদের বাসায় যাতায়াত করে। দুই-তিন ঘণ্টা সময় তার নোরার সাথেই কেটে যায়।

দিনগুলো স্বপ্নের মতো অতিবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু জীবন কখনও স্বপ্নের মতো সুন্দর হয় না৷ শান্তভাবে বয়ে চলা নদীর পানিতেও দমকা বাতাস এসে ছন্দপতন ঘটায়।

হঠাৎ একদিন একটা ঘটনা ঘটল। রাত তখন প্রায় বারোটা বাজছে। নোরা বিছানায় মাত্র শুয়েছে। ওমনি অন্তরার ফোন।

” হ্যালো নোরা।”

“বল।”

” দোস্ত, কই তুই?”

” রমনা পার্কের গাছতলায় বসে বাদামভাজা খাই। তুই কই?”

” ইয়ার্কি মারিস না।”

নোরা হেসে বলল,” রাত বারোটা বাজে ফোন দিয়ে এই ধরণের প্রশ্ন করলে এর চেয়ে ভালো উত্তর হয়না। যাইহোক, কি কারণে ফোন দিয়েছিস সেইটা বল।”

” দোস্ত সর্বনাশ হয়েছে।”

” এইবার কিন্তু চড় খাবি। সরাসরি ঘটনা বল। আর তুই কি কাঁদছিস নাকি?”

অন্তরা এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”

” মানে কি? আলভীর সাথে?”

” হুম।”

” কবে? কখন?কিভাবে? আর ব্রেকআপের কারণ কি?”

” জানিনা। ও ইদানীং খুব ইগনোর করতো বুঝছিস। কথায় কথায় খারাপ বিহেভিয়ার করতো। ব্যাড ল্যাঙ্গুয়েজ ইউস করতো। এমন কি বাংলা ভাষায় গালিও দিতো। আর কত সহ্য করা যায় বল? পরে রাগের মাথায় আমিও একটা গালি দিয়ে ফেলছি, তারপরই বলে ব্রেকআপ। আমার নম্বর ব্ল্যাকলিস্ট করে দিছে, সব জায়গা থেকে আমাকে ব্লক করে দিসে, অন্য নম্বর দিয়ে ফোন করলেও ধরেনা। আমার ভয়েস শুনলেই কেটে দেয়। এখন কি হবে আমার দোস্ত?”

” শোন অন্তু, আলভীকে আমার থেকে ভালো তুই চিনিস। ও যে এমন একটা কাজ করবে সেটা তুই ভালোভাবেই জানতিস। সো এই সিচুয়েশনটার জন্য তোর প্রস্তুত থাকা উচিৎ ছিল। এখন ন্যাকা কান্না কেদে তো লাভ নেই।”

” হ্যাঁ আমি জানতাম, কিন্তু এবার যে ও ব্রেকআপ করবে আমি সত্যিই ভাবিনি। আমরা তো অনেক বেশি ক্লোজ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন ও কিভাবে ব্রেকআপ করতে পারে বল? আমি ওকে ছাড়া জীবনেও থাকতে পারবো না। পাগলই হয়ে যাব।”

অন্তরা আবার কাঁদতে বসেছে। নোরা অবাক হয়ে বলল,” অনেক ক্লোজ হয়ে গিয়েছিস বলতে? ফিজিক্যাল কিছু করিস নি তো?”

অন্তরার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। নোরার যা বুঝার বুঝে গেছে৷ সে বলল,” কবে হয়েছে এসব? আমাকে বলিসনি কেন?”

” তোকে বললে তুই আমাকে আস্তো রাখতি?”

” হয়েছে তো। এবার মর। আমাকে ফোন করেছিস কেন?”

” প্লিজ এমন বলিস না। আমি কি করতাম বল? ও আমার কাছে চাইলে আমি না করতে পারতাম না।”

অন্তরা এবার হিঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। নোরা বলল,” থাম, থাম। আমার কাছে কেঁদে কি হবে? ঘটনা যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেলেছিস। আগে থেকেই আমাকে সব জানালে এমনকিছুই হতে দিতাম না আমি। আর তুই কি বোকা অন্তু? কি করে পারলি এতোবড় রিস্ক নিতে? আলভী যে তোকে ছেড়ে চলে যাবে এটা তুই জানতি না?”

” জানতাম তো। আবার ভয়ও লাগতো। যদি ওর কথা না শুনলে আমাকে ছেড়ে চলে যায়?”

” তখন চলে গেলেই ভালো হতো।কিন্তু এখন যে তোর জীবনটা মরুভূমি বানিয়ে চলে গেল? এখন কি করবি তুই?”

” মানুষের বেলাতেই শুধু ভাষণ দেওয়া যায়। আমার জায়গায় তুই থাকলে কি করতি? অনিকস্যার যদি তোর কাছে তোকে চাইতো তুই না করতে পারতি? সত্যি করে বল তো? ”

নোরা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” উনি এরকম কখনোই চাইতেন না। আর যদি চাইতেন, তাহলে তখনি আমি উনার উপর থেকে বিশ্বাস হারাতাম। তোর মতো বোকামী কোনোদিন করতাম না।”

অন্তরা আর কিছু বললনা। শুধু কাঁদছে। নোরা বলল,” আচ্ছা শোন, টেনশন করিস না। আমি দেখছি কিছু করা যায় কিনা। ওই আলভীকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব দেখিস। আচ্ছা তোদের ব্রেকআপ কবে হয়েছে?”

” ইগনোর তো অনেকদিন করেই করছিল।আজকে সন্ধ্যায় একদম ক্লিয়ারলি ব্রেকআপ করল।”

” আচ্ছা, তাহলে শোন তোকে একটা আইডিয়া দেই। তুই ওদের বাড়ির ঠিকানা জানিস?”

” না, জানিনা তো।”

” আচ্ছা অনিকস্যারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমি তোকে ম্যাসেজ করে দিবোনে। সেটা সমস্যা নেই। তুই খালি শোন তুই কি করবি।”

নোরা অন্তরাকে সব প্ল্যান বুঝিয়ে দিল। অন্তরা বলল,” যদি এতেও কাজ না হয়?”

” নাহলে আর কি করার? কোর্ট-কাছারি করতে হবে, পুলিশের ঝামেলায় জড়াতে হবে। ডিরেক্ট মামলা করে দিবি। কোনো ছাড় নেই।”

” দোস্ত এটা আমার বাসায় জানাজানি হলে কিন্তু আমি শেষ।”

” তুই আগেই কেন ভয় পাচ্ছিস? এইটা বোঝ তুই নিজে অলরেডি ফেসে গেছিস। এখন আলভীকে ফাসাতে হবে। যেভাবেই হোক ফাসাতে হবে।”

অন্তরা চোখ মুছে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল, ” হুম।”

” ঠিকাছে, এখন তাহলে নিশ্চিন্তে ঘুমা। আর মাথায় ছকটা সাজিয়ে ফেল। কিভাবে কি করবি। আমি অনিকস্যারের কাছ থেকে এ্যাড্রেস নিয়ে তোকে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছি।”

” ওকে। গুডনাইট।”

” গুডনাইট।”

অন্তরা এরপরেরদিন বাক্স-পেটরা গুছিয়ে আলভীদের বাড়ি চলে গেল।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১৩

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৩
লিখা Sidratul Muntaz

শ্রীমঙ্গলে আগেই অনলাইনে রিসোর্ট বুক করা ছিল। অনিককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়ার পর ওরা সরাসরি গিয়ে রিসোর্টে উঠল। দুইরুমের একটা ঘর। ড্রয়িংরুমে বড় বিয়াল্লিশ ইঞ্চির একটা টিভি। বেডরুম, ড্রয়িংরুম দুই জায়গাতেই এসি। বেডরুমে বিছানা, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি আর ড্রয়িংরুমে বিলাশবহুল সোফা। দৃষ্টিনন্দন শোপিস। বাথরুমে বাথটাব শাওয়ারের অসাধারণ ব্যবস্থা আছে। নোরা আর অন্তরার জন্য একটা রুম ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

নরম গদির বিছানা পেয়েই আরামে আগে একটা ঘুম দিল নোরা। তার চোখে রাজ্যের ঘুম কারণ সে হাসপাতালে একফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি। অন্তরা গতরাতে এখানেই ছিল। তবে তারও ঠিকমতো ঘুম হয়নি। রাতে আলভীর সাথে ঘুরতে বের হয়েছিল। কিন্তু সেটা নোরাকে বুঝতে দিল না সে। দুপুরের লাঞ্চ তাদের রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে নোরা কিছুই খায়নি। অনিক তাকে ফোন করেছিল। সেই ফোন ধরল অন্তরা।

” হ্যালো, অনিকস্যার?”

” নোরা কোথায়?”

” ও তো ঘুমাচ্ছে। ডাকবো?”

” হ্যাঁ ডাকো। সকাল থেকে কিছু খায়নি মেয়েটা। উঠে লাঞ্চ করতে বলো।”

” অনেক ট্রাই করেছি স্যার। কিন্তু ও উঠছে না। একেবারে ম’রার মতো ঘুমায়।”

অনিক মৃদু হেসে বলল,”কাতুকুতু দাও। উঠে যাবে।”

অন্তরা চোখ বড় করে তাকাল। এই বুদ্ধি তার আগে মাথায় আসেনি কেন? সঙ্গে সঙ্গে নোরার কোমরের দুই সাইড ধরে কাতুকুতু দিতে শুরু করল অন্তরা। মেয়েটা প্রায়। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। রেগেমেগে বলল,” তোর সমস্যা কি?”

অন্তরা হাসতে হাসতে বলল,” আমার কোনো সমস্যা নেই। অনিকস্যার বলেছে তোকে এইভাবে ওঠাতে। এইতো নে কথা বল।”

নোরার কানে ফোনটা চাপিয়ে অন্তরা উঠে গেল। ওই পাশ থেকে অনিকের অট্টহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নোরা বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” আপনি শিখিয়ে দিয়েছেন তাই না?”

” হুম।”

” আপনি তো আচ্ছা শয়তান!”

” হাত-মুখ ধুঁয়ে খেতে বসো। নাহলে আরো শয়তানি দেখাবো। আর তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

” হুহ! লাগবে না আপনার সারপ্রাইজ।”

নোরা ফোন রেখে বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। অন্তরা ততক্ষণে বের হয়ে গেছে আলভীর সাথে। তারা একাকী ঘুরবে। নোরা গোসল সেরে আবারও একই পোশাক পরল। আর জামা-কাপড় সাথে আনেনি সে। চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখল অন্তরা কোথাও নেই। বিছানায় কিছু জিনিস পড়ে আছে। একটা লাল শাড়ি, কালো ব্লাউজ, লাল কাচের চুড়ি আর পুতির মালা। পাশে ছোট একটা প্যাকেটে আরো কিছু জিনিস আর একটা চিরকুট। নোরা চিরকুটটা আগে খুলল। অনিকের সুন্দর হাতের লিখা,” আজকে ইচ্ছে হল তোমাকে মনের মতো সাজাবো। তুমি শাড়ি পরতে পারো কিনা জানিনা। কোনোদিন তো দেখিনি। তবে আজ কি পরবে আমার জন্য? প্লিজ! যদি না পারো, তাহলে আমি পরিয়ে দিতেও রাজি। তখন আবার এটা জিজ্ঞেস করো না যে আমি শাড়ি পরানো কোথা থেকে শিখলাম। মুভি দেখে শাড়ি পরানো শেখা যায়না ঠিক। তবে সেটা শেখার আরও অনেক উপায় আছে। আর এটা সত্যি যে তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেখবো বলেই আমি শাড়ি পরানোটা বিশেষ যত্নে শিখেছিলাম। তোমার জন্য লালশাড়ি কেন আনলাম জানো? কারণ এই সবুজ শহরে কৃষ্ণচূড়ার মতো সুন্দর লাল তুমিটাকে দেখার আমার বড্ড শখ। সিলেটের চা বাগানে লালশাড়ি পরে তুমি প্রজাপতির মতো উড়বে। মিষ্টিপরী থেকে হয়ে যাবে লালপরী। আমার লালপরী। সবুজের কোলে লালপরীর চঞ্চলতা এনে দিবে আলাদা মাধুর্য্য। সেই পরিপূর্ণতাকে মুগ্ধচোখে দেখার সুযোগ কি আমার হবে মিষ্টিপরী?পরবে লালশাড়িটা আমার জন্য? ”

নোরা চিরকুটটা পরার সময় মুচকি হাসছিল। তার হাত দু’টো কাঁপছিল। সে মনে মনে বলল,” হুম পরবো। নিশ্চয়ই পরবো।”

তারপর প্যাকেটটা খুলে বাকি জিনিসগুলো দেখল। একটা কালো টিপের পাতা, কাজল, আর লাল লিপস্টিক। নোরা কখনও গাঢ় রঙের লিপস্টিক লাগায় না। তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। একবার শুধু অন্তরার জোরাজুরিতে লাগিয়েছিল, অনিকের বার্থডে’র দিন। কিন্তু তখন তো অনিক তার বয়ফ্রেন্ড ছিলনা, শুধু স্যার ছিল। তাই এতোটা লজ্জা লাগেনি। কিন্তু আজকে কিভাবে এই লাল লিপস্টিক ঠোঁটে লাগাবে ও? তাও আবার অনিকের সামনে! লজ্জাতেই তো মরে যাবে।

শাড়িটা পরে সম্পুর্ণ তৈরি হওয়ার পর আয়নাতে নিজেকে দেখে নোরা নিজেই হতবাক। বাঙালি সাজেও তাকে বাঙালি লাগছে না। মনে হচ্ছে লাল চুল আর সাদা চামড়ার কোনো বিদেশিনীর বাঙালি মেয়ে সাজার ব্যর্থ চেষ্টা। তবে নিজের রুপ দেখে আজ সে নিজেই মুগ্ধ। তার সারা শরীর কাঁপছে। এই রুপ, এই সৌন্দর্য্য কোথায় ছিল এতোদিন? নাকি নিজেকে কখনো ভালো করে দেখাই হয়নি। আয়নার দিকে তাকিয়ে নোরা অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল, ” এই মেয়ে,কে তুমি? তুমি কি সত্যিই আমি?”
তারপর নিজে নিজেই হেসে উঠল।এর আগে কখনও কারো জন্য এভাবে সাজেনি ও। আজকেই প্রথম। ভয়,ভালোলাগা,লজ্জা সবমিলিয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি। জীবনের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিগুলো বুঝি এমনই হয়!

হঠাৎ দরজায় খট করে শব্দ হলো। নোরা চ’মকে উঠতেই দেখল পেছনে অনিক দাঁড়িয়ে আছে৷ গ্রুপের সবাই ঘুরতে বের হয়ে গেছে। শুধু অনিক অপেক্ষায় ছিল নোরার জন্য। নোরা লাজুকমুখে তাকাল। মাথা নত করে রইল। নোরার সৌন্দর্য্য দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হতে হল অনিককে। মেয়েটাকে সত্যিই লালপরী লাগছে। যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা কোনো রাজকন্যা। এতো সুন্দর! অনিকের চোখের পলক অজান্তেই স্থির হয়ে গেল। অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় অনেকক্ষণ যাবৎ চেয়ে রইল সে নোরার দিকে।

নোরা লাজুকহাসি বজায় রেখেই মাথা নিচু করে বলল,” শুধু কি দেখবেনই? কিছু বলবেন না?”

অনিকের যেন হুশ ফিরল। মৃদু হেসে নোরার কাছে এসে ওকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে ওর কাঁধে মুখ ঠেঁকিয়ে বলল,” তোমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে জানো?”

” কি?”

” মনে হচ্ছে আল্লাহ তোমার এই ফুটফুটে শরীরটা প্রথমে মুলতানি মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন, তারপর চন্দনের প্রলেপ মিশিয়ে দিয়েছেন। তাই তো তুমি এতো সুন্দর, পবিত্র,পরিচ্ছন্ন। ”

নোরার লজ্জা আরো বেড়ে গেল। অনিকের দিকে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরল। অনিক হঠাৎ ঠান্ডা গলায় বলল,” এই নোরা!”

নোরা অনিকের বুকে মাথা রেখেই জবাব দিল,” হুম?”

” চলো বিয়ে করে ফেলি।”

নোরা হেসে বলল, ” মানে?”

” মানে অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না। আমার তো একদমই তর সইছেনা। চলো এখানেই বিয়ে করে সংসার পেতে ফেলি। আর ঢাকা ফিরে যাওয়ার দরকার নেই।”

” পাগল হয়েছেন?”

” উহুম। সত্যি বলছি। বিয়ে করবে নোরা?”

” বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি চাই না এভাবে আমাদের বিয়ে হোক। আমাদের বিয়ে তো এলাহী আয়োজন করে হবে। সাতদিনব্যাপী রাস্তা সাজানো হবে, গায়ে হলুদ,বৌভাত,বিয়ে প্রত্যেক অনুষ্ঠানে স্টেজ সাজানো থাকবে। আমার কাজিনরা নাচবে, গেইট ধরবে, আপনার জুতো চুরি করে টাকা নিবে, হৈ-হুল্লোড় হবে। আর আমার অনেক শখ জানেন? পালকিতে চড়ে শশুরবাড়ি যাওয়ার। পালকির ব্যবস্থা থাকবে, আর বিয়ের প্রথম একমাস আমি একদম নতুন বউয়ের মতো সেজে থাকবো। উৎসবের আমেজ অনেকদিন ধরে থাকবে। তবেই না বিয়ের আসল মজা!”

” বাহ! বিয়ে নিয়ে তোমার এতো স্বপ্ন?”

” কেন? আপনার স্বপ্ন নেই?”

” আছে। তবে আমার স্বপ্ন তোমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে।”

” তাই? সেটা কিরকম?”

” মানে হচ্ছে.. আমার সব স্বপ্ন শুধু বাসর নিয়ে।” কথাটা বলেই ফিচেল হাসল অনিক।

নোরা চোখ কুটি করে বলল,” ধুর, আপনিও না! তবে বাসর নিয়ে আমারও স্বপ্ন আছে।”

” তাই? কি স্বপ্ন শুনি!”

” আমাদের বাসর হবে খোলা আকাশের নিচে।”

” খোলা আকাশের নিচে কেন?”

” চাঁদ, তারা, মেঘ সবাইকে সাক্ষী রেখে এক কথায় প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া। আর যদি সেটা নৌকায় হয় তাহলে তো কথাই নেই। মাঝ নদীতে খোলা আকাশের নিচে চারিপাশে শুধু ঢেউয়ের খেলা। আর উপরে তাকালেই ভাসমান সাদা মেঘের ভেলা। কতটা সুন্দর পরিবেশ একবার ভেবে দেখুন!”

” সেক্সও কি আমরা নৌকাতেই করবো? নৌকা ডুবে যাবেনা? ”

অনিকের উত্তর শুনে নোরার সব অনুভূতি উধাও হয়ে গেল। মুখটা গম্ভীর করে আচমকাই অনিকের বুকে,পিঠে কিল দিতে শুরু করল সে। আর বলল,” ছি। আপনি এত্তো খারাপ কেন?”

অনিক হাসতে হাসতে বলল, ” আচ্ছা, আচ্ছা, সরি। আমি তো শুধু বাস্তবতার কথা বললাম।”

” এতো বাস্তবতার কথা বলতে কে বলেছে আপনাকে?”

নোরার নাকের ডগা রাগে গোলাপী হয়ে গেছে। অনিক পেছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
” আচ্ছা স্যরি মিষ্টিপরী। তারপর বলো। আর বাসর নিয়ে তোমার আর কি কি স্বপ্ন?”

” এখন আর বলতে ইচ্ছে করছেনা। মুড নষ্ট হয়ে গেছে। আচ্ছা আমরা ঘুরতে কখন বের হবো? সবাই তো চলে গেছে।”

” ভেবেছিলাম তো আমরাও বের হবো। কিন্তু সেটা এখন আর ইচ্ছে করছে না। ঘর পুরো ফাঁকা। এখন শুধু মকা…”

” উফ, ফাজলামি করবেন না। আমি শ্রীমঙ্গল কখনও আসিনি। প্লিজ ঘুরতে যেতে চাই।”

” তোমাকে এই অবস্থায় বাইরে নিয়ে গেলে মানুষ আর চা বাগান দেখবে না। সবাই শুধু তোমাকেই দেখবে। সেটা কি আমার সহ্য হবে? তার চেয়ে ভালো ঘরে বসে আমি একাই দেখি।”

নোরা লজ্জায় লাল হয়ে বলল,” ধ্যাত! আমি ঘুরতে যেতে চাই। প্লিজ চলুন না।”

” যাবো তো মিষ্টিপরী। সেজন্যই তো সাইকেল ভাড়া করে এনেছি। রাতের মতো সাইকেলে করে আমরা পুরো শ্রীমঙ্গল ঘুরে বেড়াবো আজ। তুমি সামনে বসবে আর আমি পেছনে।”

নোরা চোখ বড় করে বলল,” সত্যি? ”

” সত্যি। ”

” তাহলে দ্রুত চলুন না প্লিজ প্লিজ! আমি সাইকেলে চড়বো।”

” চলো। ”

সাইকেল নিয়ে ওরা সর্বপ্রথম ঘুরতে গেল বিটিয়ারআই। যেখানে স্বচক্ষে চায়ের প্রস্তুত প্রণালী দেখা যায় এবং সেই সম্পর্কে জানা যায়। নোরার ওখানে গিয়ে মনে হল এসব শিখে তার কি লাভ? সে চা খেতে ভালোবাসে। বানানো টানানো তার সাধ্যি না। তবে জায়গাটা নোরার ভালোই পছন্দ হল। সুন্দর কিছু জায়গায় ওরা ছবি তুলল।

তারপর ওরা চলে গেল নীলকণ্ঠ টি কেবিনে। সেখানের ফেমাস সাতরঙ এর চা খেতে। এক কাপ চায়ের মূল্য পঁচাশি টাকা। দাম শুনেই নোরার ইচ্ছে হল একবার খেয়ে দেখার। তবে পঁচাশি টাকার সেই সাতরঙ চায়ের থেকে দশটাকার দুধচাটাই নোরার বেশি পছন্দ হল। ওরা ওখানকার ফুচকাও খেল। নোরার মনে হচ্ছিল এতো দারুণ ফুচকা সে জীবনে খায়নি। এই দুই জায়গা ঘুরতে ঘুরতেই বিকাল হয়ে গেছে।

অনিক তারপর ওকে নিয়ে গেল নূরজাহান টি গার্ডেনে। যাওয়ার পথে অনিক বলছিল এইটা নাকি সিলেটের সেরা উঁচুনিচু পাহাড়ী চা বাগান। জায়গাটায় গিয়ে নোরা এই কথার অর্থ বুঝল। এক কথায় চোখ ধাঁধানো সুন্দর জায়গা। চাবাগান যে এতো সুন্দর হতে পারে এইখানে না এলে নোরা ধারণা পেতো না। গ্রুপের অন্য সদস্যরা নিজেদের মতো ঘুরছে। নোরা আর অনিক ঘুরছে আলাদা। একসময় অনিক বলল,” এসেছিলাম গ্রুপ ট্যুরে অথচ হয়ে যাচ্ছে মিনি হানিমুন। ব্যাপারটা দারুণ না? থ্যাঙ্কিউ নোরা, এতো সুন্দর সময় উপহার দেওয়ার জন্য।”

নোরা জবাব না দিয়ে শুধু হাসল। আকাশটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস, একটু পর পর মেঘের গর্জন, বৃষ্টির পূর্বাভাস সম্পুর্ণ পরিবেশটা মাতিয়ে রেখেছিল। অনিক-নোরা সাইকেলটা পার্ক করে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসল। নোরা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসল আর অনিক ওর কোলে মাথা রেখে একদম শুয়ে পড়ল।

ওদের চতুর্দিকে উঁচুনিচু পাহাড়, চাপাতার তরতাজা সুগন্ধ, নীল আকাশে জমাট মেঘ আর মন-মাতানো বাতাস এক কথায় মনের মতো পরিবেশ। নোরা অনিকের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে গান গাইছিল। তার গানের কণ্ঠ খুব একটা সুন্দর না। তবে অনিকের কাছে সেই কণ্ঠ অতুলনীয় মনে হচ্ছিল। আর নোরা এতো সুন্দর করে ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল,অতিরিক্ত আরাম পেয়ে অনিক কখন ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও টের পেলনা। ওর ঘুম ভাঙল বৃষ্টির পানিতে।

হুট করেই শুরু হল তুমুল বর্ষণ। অনিক উঠে বসতেই নোরা একেবারে দাঁড়িয়ে লাফানো শুরু করল। চা বাগানে বৃষ্টির সৌন্দর্য্য দেখে তার ভীষণ ভালো লাগছে। বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ নোরাকে দেখতে অনিকেরও চমৎকার লাগছিল। নোরা উপভোগ করছে বৃষ্টি, আর অনিক উপভোগ করছে নোরা। লাল টুকটুকে দুষ্ট-মিষ্টি চঞ্চলাবতী নোরা।

হঠাৎ কোথ থেকে যেন বিরাট একটা কচুপাতা জোগাড় করে আনল অনিক। সেই কচুপাতার ছায়ায় নোরাকে টেনে নিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়াল। নোরা মনখারাপ করে বলল,” এখানে কেন আনলেন? ”

” ভিজে যাচ্ছিলে তো।”

” ভিজতেই তো ভালো লাগছিল।”

” বুঝেছি ভালো লাগছিল। কিন্তু এখন ভেজা উচিৎ হবে না। রাতের বেলা ভিজবে।”

” রাতের বেলা কেন? এখন ভিজলে কি হয়েছে?”

” নিজের দিকে ভালো করে তাকাও, তাহলেই বুঝতে পারবে।”

অনিক কথাগুলো অন্যদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল।নোরা নিজের দিকে ভালো করে দেখল একবার। তার ভেজা শরীরে লাল শাড়িটা লেপ্টে আছে। দেখতে দৃষ্টিকটু লাগছে। নোরা লজ্জা পেয়ে বলল,” সরি।”

অনিক বলল,” ইটস ওকে। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন আমিই তোমাকে নিয়ে ভিজবো। ততক্ষণ তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।”

” ঠিকাছে। কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলে?”

“এই বৃষ্টি এতো জলদি থামবে বলে মনে হয়না। আর তারপরেও যদি থেমে যায় তাহলে বেডলাক।”

নোরা মনে মনে দোয়া করতে লাগল বৃষ্টি যেন কিছুতেই না থামে। বৃষ্টিতে ভিজতে না পারলেও কোনো আফসোস নেই। কিন্তু এভাবে কচুপাতার নিচে অনিককে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে থাকতে নোরার দারুণ লাগছে। অনিক দুজনের মাথার উপরই কচুপাতাটা ধরে রেখেছে। একটু পর পর অন্যহাত দিয়ে নিজের ভেজা চোখ-মুখ আর চুল মুছছে। কি যে সুন্দর দৃশ্য! নোরার ইচ্ছে করছে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে অনিকের মাথা মুছে দিতে। কিন্তু তার শাড়ির আঁচলটা তো আরো ভেজা।

একটু পর পর দমকা বাতাসে দুজনের শরীররই কেঁপে উঠছে। অনিক একহাত দিয়ে নোরার কোমর ধরে ওকে কাছে নিয়ে আসল। নোরা আরও কাছে এসে অনিকের বুকে মাথা রাখল। বৃষ্টির ঝুমঝাম শব্দের সাথে অনিকের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ। এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে?

সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর চারদিকে যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার বৃষ্টি তখনও থামেনি। অনিক-নোরা চা বাগানের এবড়োখেবড়ো মেঠোপথ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। বৃষ্টির বেগ তখন আরো বেড়ে গেছে। দুজন পাগলের মতো বৃষ্টিখেলায় মেতে উঠেছে। এই বৃষ্টি যেন বৃষ্টি নয়, সুখের বর্ষণ। অনিক নোরার কোমর ধরে ওকে উপরে তোলে ঘুরাতে শুরু করল। আর নোরা ভুবন কাঁপানো হাসির স্রোতে মত্ত হল। চা বাগানে তখন তেমন কেউ ছিল না। অনিকের গায়ে লাল টি-শার্ট আর কালো জিন্স। নোরার গায়ে লাল শাড়ির সাথে কালো ব্লাউজ। ওরা প্রকৃতির সাথে পুরো মিশে যাচ্ছিল। বৃষ্টি যতক্ষণ চলল ওরা ততক্ষণই ভিজল। অতল সুখের গভীর সাগরে মাতাল হয়ে সাতার কাটছিল দু’জনেই।

সাইকেলে উঠে কাকভেজা শরীর নিয়ে রিসোর্টে ফিরে দুজনই ক্লান্ত। গ্রুপের অন্যরা তখনও ফেরেনি। হয়তো বৃষ্টির কারণে কোথাও আটকা পড়েছে। অনিক নোরাকে কোলে নিয়ে রিসোর্টের রুম পর্যন্ত এসেছে। নোরা হাসতে হাসতে বলল,” আজকের দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। আমি আজকের কথা কক্ষনো ভুলবো না।”

তারপর অনিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” আপনাকে ধন্যবাদ। ”

অনিক ঘোর নিয়ে নোরার দিকে তাকিয়ে ছিল। নোরার ভেজা চোখে গাঢ় কাজলের ছাপ, আধরঙা লাল লিপস্টিক, ভেজা এলোমেলো চুল, পাগল হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। সে মাতাল দৃষ্টিতে বলল,” তোমাকে আই লভ ইউ।”

অনিকের কথায় নোরা খিলখিল শব্দে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে আরও নেশা পেয়ে বসল অনিকের। রুম সম্পুর্ণ রুম অন্ধকার। আবছা আলোয় তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনিক আলো জ্বালালো না। দরজা আটকে নোরাকে কোলে নিয়েই বেডরুমে চলে এলো। বিছানায় পিঠ ঠেঁকতেই নোরা অনিকের গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,” এই, কি হয়েছে আপনার?”

অনিক মাতাল কণ্ঠে বলল,” জানি না।”

তারপর এলোপাথাড়ি চুমু দিতে শুরু করল নোরার গলায়, ঠোঁটে। নোরা ভ্যাবাচেকা খেল। বাঁধা দেওয়ার সুযোগটুকুও হলো না৷ এর আগেই অনিক তাকে ঘায়েল করে ফেলেছে। নোরা কেবল টি-শার্ট খামচে ধরল অনিকের। নোরার বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরাতেই মৃদু শব্দে চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা,” না প্লিজ।”

অনিকের হুশ ফিরল, সে কি করছে এসব নোরার সাথে? নিজের কাজে লজ্জিত হয়ে খুব দ্রুত উঠে বসল। নোরা দুইহাতে নিজেকে ঢেকে গুটিয়ে আছে। তার চোখে অশ্রু। অনিক কোনমতে নিজেকে সামলে বলল,” আ’ম স্যরি নোরা।”

নোরা কোনো জবাব দিল না। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। সে এমন আচরণ আশা করেনি অনিকের কাছে। তার এই প্রথম ভ*য় হচ্ছে মানুষটার সঙ্গে একা ঘরে অবস্থান করতে।অনিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কয়েক বার ঢোক গিলল। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,”বেশিক্ষণ ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লাগবে। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ডিনারের ব্যবস্থা করছি।”

অনিক এ কথা বলেই উঠে দাঁড়াল। তারপর তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নোরা কিছু সময় শুয়ে থেকে উঠে বসল। তারপর সময় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হলো। শাড়ি পাল্টে আগের পোশাক পরে নিল। অনিক ততক্ষণে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে গেছে। বাকিটা সময় নোরা একাই কাটাল। রাত নয়টার মধ্যে সবাই রিসোর্টে ফিরে এলো। অন্তরাকে খুব হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। সারাদিন তারা কত মজা করেছে সেই বিষয়ে গল্প জুড়ে দিল এসেই।

নোরা কিছুই বলছিল না। সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছে। অন্তরা তার কাঁধে হাত রেখে বলল,” কি সমস্যা তোর? ভূতে ধরেছে? এমন থম মেরে আছিস কেন?”

” ভালো লাগছে না।” বিষণ্ণ মুখে কথাটা বলেই বারান্দায় চলে গেল নোরা।

কিছুক্ষণ পর অন্তরাও বারান্দায় ঢুকল। সন্দেহী চোখে বলল,” সত্যি করে বলতো, কি হয়েছে? অনিকস্যারের সাথে ঝগড়া করেছিস?”

নোরা আ’চমকা কেঁদে উঠল। তার কান্না দেখে হতভম্ব অন্তরা। নোরা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে বলতে লাগল,” আমার নিজেকে খুব বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে অন্তু। আমি বাবার সাথে মিথ্যা বলেছি। তার বিশ্বাস ভেঙেছি। আর… ”

নোরা কথা শেষ করল না। অন্তরা বলল,” কি হয়েছে তোর?”

নোরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” জানি না। খুব খারাপ লাগছে কেন যেন।”

” অনিক স্যারের সাথে কিছু হয়েছে?”

” না। উনার দোষ নেই। দোষ আমার। এভাবে হুট করে এখানে চলে আসা ঠিক হয়নি। আমরা কাল সকালেই চলে যাবো অন্ত।”

” কি বলছিস? কালই? কত সুন্দর জায়গা! আমার তো আরও ঘুরতে মন চাইছে। প্লিজ আর একটা দিন থাকি নোরা।”

নোরা কঠিন মুখে বলল,” আমি থাকব না। এটা ফাইনাল। এবার তোর ইচ্ছে হলে তুই থাক। তোর ব্যাপার।”

এটুকু বলেই বারান্দা থেকে চলে গেল নোরা। রুমে ঢুকতেই দেখল অনিক দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে সযত্নে। নোরা কি করবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসল। অন্তরাও বারান্দা থেকে ছুটে এলো,” স্যার আপনি এখানে?”

” নোরার জন্য ডিনার নিয়ে এসেছিলাম।”

” শুধু নোরার জন্য? আমার জন্য আনেননি?”

“তোমার জন্য আলভী বাইরে ওয়েট করছে। তোমাকে জানাতে বলেছিল।”

” ওহ, আচ্ছা, আচ্ছা। আমি যাচ্ছি।”

ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় চুলটা একটু ঠিক করেই অন্তরা বের হয়ে যাচ্ছিল। তারপর আবার ফিরে এসে বলল,” স্যার একটা কথা, ওকে না ভূতে ধরেছে। কাল সকালেই চলে যেতে চাইছে। অথচ আমাদের তো আরও একটাদিন থাকার কথা ছিল। প্লিজ ওকে আপনি বোঝান৷ আমি যাচ্ছি বাই।”

নোরা অন্তরার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে অন্তরা বের হয়ে গেল।অনিক নোরার প্লেট টেনে নিয়ে বিরিয়ানি সার্ভ করছে শান্ত ভঙ্গিতে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল মৃদু গলায়,” রাগের কারণটা জানতে পারি?”

নোরা অপ্রস্তুত হলো। সংকোচিত গলায় বলল,” আমি কি একবারও বলেছি আমি রাগ করেছি?”

” তুমি তো বলবে না। কিন্তু বুঝে নেওয়ার দায়িত্বটা তো আমার।”

” এতোই যখন দায়িত্ব বুঝেন, তাহলে রাগের কারণটাও নিজ দায়িত্বে খুঁজে বের করুন। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

” তোমার সবসময় উত্তর রেডি থাকে তাই না?”

একথা বলে অনিক নোরার পাশাপাশি বসল। চুপচাপ খাচ্ছে নোরা। অনিকও খাওয়া শুরু করল। খাবার শেষে নোরা প্লেট রেখে উঠে যাওয়ার সময় অনিক তার হাত ধরল। তারপর বলল,” চলো।”

” কোথায়?”

” একটা জায়গায়।”

” আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি ঘুমাবো।”

” মাত্র রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এখন কি ঘুমাবে নোরা? সিলেটে কি ঘুমাতে এসেছো?”

নোরা জবাব দিল না। অনিক ওর হাত টেনে বলল,”চলো প্লিজ।”

” বললাম তো যাবো না। আমার ভালো লাগছে না।”

অনিক কোনো কথা না বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। নোরা ভাবল অনিক রাগ করে চলে গেছে। এখন ওর নিজের কাছেই আফসোস হতে লাগল। এতোটা রুড বিহেভ না করলেও হতো। অনিক হঠাৎ আবার ফিরে এলো। নিজের ব্যাগ থেকে একটা বড় শাল এনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিল। নোরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি করছেন?”

” চুপ।”

এটুকু বলেই নোরাকে কোলে নিয়ে ফেলল অনিক। নোরা আর কিছু বলার আগেই ওকে নিয়ে রিসোর্টের বাইরে চলে এলো। নোরা বুঝে গেল বাঁধা দিয়ে লাভ নেই। তাই চুপ করে রইল। অনিক জীপ ভাড়া করে এনেছে। ওইটাতেই নোরাকে ওঠাল। তারপর ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। অনিক-নোরা পাশাপাশি বসে আছে। একটু পর নোরা বলল,” আচ্ছা আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?”

অনিক রহস্যময় হাসি দিয়ে শুধু বলল,” সারপ্রাইজ। ”

নোরা তারপর আর কোনো প্রশ্নই করলনা। জীপ থামল চৌঙ্গাইঘাটে। ওখানে নেমেই অনিক নোরাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। গ্রাম গ্রাম পরিবেশ,আশেপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নোরা ভয়ে অনিকের একহাত জড়িয়ে ধরে আছে। অনিক ওকে নিয়ে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে চলে এসেছে। আরো কিছুটা সামনে যেতেই নোরা দেখল ঘাটে একজন মাঝি নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছে। অনিক মাঝিকে বলল,” মাঝিভাই! সব রেডি?”

মাঝি দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে বলল,” হো ভাই, আয়া পড়েন।”

এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও মাঝির ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল নোরা। তার সবকিছুতেই কেমন ভয় ভয় লাগছে। হঠাৎ সারা নৌকা আলোকিত হয়ে উঠল। সোনালী রঙের ছোট ছোট লাইট পেঁচিয়ে নৌকাটা সাজানো হয়েছে। নদীর পানিতে লাইটগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশের তারাগুলো মুক্তভাবে পানিতে ঝরে পড়ছে। কি যে অমায়িক! কি যে মোহনীয়!

অনিক নোরাকে নিয়ে নৌকাতে উঠল। আর মাঝি বৈঠা বাইতে শুরু করল। নোরা প্রথম কয়েক মিনিট কিছু বলতেই পারলনা। মুগ্ধচোখে শুধু আশেপাশের সৌন্দর্য্য দেখছে। প্রকৃতির এই রুপ আর অনিকের হঠাৎ সারপ্রাইজ তাকে কিছুসময়ের জন্য বাকরুদ্ধ করতে পুরোপুরি সক্ষম। নোরা নিজ থেকেই বলে উঠল,” এতো সুন্দর কেন? সব কিছু কেন এতো ভালো লাগছে? আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

অনিক হেসে বলল,” তোমার এই পাগল হওয়া রুপটাই তো দেখতে চেয়েছিলাম। আর এই পাগল করা হাসি।”

নোরা তাকিয়ে বলল,” আপনি এতোকিছু কখন করলেন? কিভাবে করলেন?”

” তুমিই না বলেছিলে, তোমার নৌকায় উঠে খোলা আকাশ দেখার শখ। দেখো খোলা আকাশ!”

অনিক উপরে তাকাল, নোরাও তাকাল। কিন্তু আকাশ দেখা যাচ্ছে না, বড় বড় সবুজ গাছ নীল আকাশটা ঢেকে রেখেছে। তবুও সুন্দর লাগছে। অতুলনীয় সুন্দর। অনিক বলল,” ওহ! সরি, এখন আকাশ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু পরেই যাবে, যখন আমরা মাঝনদীতে চলে আসবো।”

” খোলা আকাশ দরকার নেই। এভাবেই ভালো লাগছে। উফফ এই জায়গাটা এতো সুন্দর কেন?”

” শুয়ে শুয়ে দেখো, আরো বেশি সুন্দর লাগবে।”

দুজন একসাথে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। অনিক নোরার একহাত ধরে রইল। নোরার দুইচোখ ঝলমল করছে। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি! নৌকা ধীরগতিতে বয়ে চলেছে, টলটলে পানিতে ঢেউ খেলা করছে,একটুু পর পর নদীতে ভাসমান বিশাল গাছগুলো সামনে চলে আসছে। মনে হচ্ছে ওরা এখনি গহীন জঙ্গলে হারিয়ে যাবে। কিন্তু মুহুর্তেই আবার উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে সব। একটু পরেই সবুজ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো বিশাল আকাশ। খন্ড খন্ড মেঘের দৃশ্য। নোরা মাথা উঠিয়ে নদীর পানির দিকে তাকাল। অনিক বলল,” কি করছো নোরা? পড়ে যাবে তো।”

নোরা হেসে বলল,” পড়ে গেলে কি হবে? মরে যাবো?”

অনিক অবাক হয়ে তাকাল। নোরা আবার হাসল। বলল,” এখানে মরতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। এতো সুন্দর দৃশ্যের স্মৃতি নিয়ে মরে গেলেও শান্তি। খুব শান্তি।”

অনিক কিছু বললনা। শক্ত করে নোরার হাতটা ধরে রাখল। নোরা নদীর পানিতে দেখল নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য। একটু পর পর নদীতে ঢেউ উঠছে, মনে হচ্ছে যেন আকাশেই ঢেউ খেলা করছে। আকাশ-নদীর একরুপ। আহা! নোরা চোখ বন্ধ করল। নীরব পরিবেশে নদীর কুলকুল ধ্বনি শোনার অব্যর্থ চেষ্টা। একটু পর নোরা জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা আমরা এখানে কতক্ষণ থাকবো?”

” এইতো দেড়-দুইঘণ্টা। তুমি চাইলে আরো বেশিক্ষণও থাকা যাবে।”

” নৌকাটা সারাজীবনের জন্য ভাড়া করে নেওয়া যায়না? আমরা না হয় সারাজীবন ভেসে বেড়াবো!”

অনিক হেসে ফেলল। নোরাকে এতো খুশি দেখে নিজের উপর ভীষণ গর্ব হচ্ছে তার। নোরার এই আনন্দের জন্য সে দায়ী। একথা ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে উঠছে। অনিক একজীবনে আর তেমন কিছু চায়না। শুধু সারাজীবন নোরাকে এভাবেই খুশি রাখতে চায়।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১২

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১২
লিখা Sidratul Muntaz

” নোরা জানো, মা আমার বিয়ের কথা ভাবছে।”

হঠাৎ অনিকের এই মেসেজ দেখে নোরা ভড়কে গেল। পড়তে বসেছিল কিছু সময়ের জন্য। আগামীকাল কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। তবে আপাতত বই রেখে লাফিয়ে ফোন হাতে নিল।নোরা অবাক হয়ে লিখল,” আপনার বিয়ে মানে? এতো জলদি?”

” জলদি কোথায়? বয়স তো কম হয়নি। ছাব্বিশবছর বিয়ের জন্য যথেষ্ট।”

” ওহ।” নোরা ভাবছে কি বলবে। তার বিয়ের পরিকল্পনা তো এখনও বহুদূরে। আগে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। গ্র্যাজুয়েশন করবে, তারপর।

অনিক আবার লিখল,” কি করি বলোতো? তোমার ফ্যামিলি তো তোমাকে এতো দ্রুত বিয়েও দেবে না, তাইনা?”

” হুম.. কমপক্ষে পাঁচবছর অপেক্ষা করতে হবে।”

” এতোদিন অপেক্ষা কিভাবে সম্ভব? মা তো এখনি উঠে-পরে লেগেছে। পাঁচবছরের কথা শুনলে হার্টফেইল করবে নিশ্চয়ই।”

” আন্টির কি পছন্দের কোনো মেয়ে আছে?”

” আছে। কিন্তু মায়ের যাকে পছন্দ আমার তাকে খুবই অপছন্দ। জীবনেও ওই মেয়েকে বিয়ে করবো না আমি।”

” তাহলে ওই মেয়েটা ছাড়া অন্যমেয়েকে করবেন?”

” অন্যকাউকে বিয়ে করার হলে অনেক আগেই করে ফেলতাম। তোমার জন্য চারবছর অপেক্ষা করতাম না। বুঝেছো মিষ্টিপরী?”

নোরা মৃদু হেসে লিখল,” হুম বুঝলাম। আচ্ছা ওই মেয়েটির নাম কি তিথি?”

” তুমি এটাও আমার ডায়েরী থেকে পড়ে ফেলেছো?”

” হ্যাঁ। আসলে লেখাগুলো সামনে এসে গিয়েছিল তাই..সরি।”

” সরি’র কিছু নেই। আমার সবকিছুই তোমার জানা দরকার। মেয়েটি ছয়বছর ধরে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। মায়ের মাথাটা আগেই খেয়েছে এখন আমাদের সবার মাথা খাওয়ার জন্য হাত ধুঁয়ে পেছনে পড়ে আছে। অসহ্য! ”

” আচ্ছা আমি কি তিথির একটা ছবি দেখতে পারি?”

” তুমি ওর ছবি দেখে কি করবে?”

” কিছু করবো না, শুধু দেখবো।”

” আমার কাছে তো ওর কোনো ছবি নেই।”

” ফেসবুক থেকে সেইভ করে দেন।”

” সেটাও সম্ভব না। ও আমার ব্লকলিস্টে। আচ্ছা নোরা এখন রাখছি। পরে কথা হবে।”

অনিক অফলাইন হয়ে গেল। নোরার আর পড়ায় মন বসছে না। কেমন যেন অস্থির লাগছে। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমও আসছিল না। অনিক ফোন ধরেনি সারারাত। খুব ব্যস্ত মনে হয়। ভোরে নোরার ঘুম আপনা-আপনি ভেঙে গেল। তখন আবার অনিকের নাম্বারে ডায়াল করল। কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। সকালে নোরা একটা দুঃসংবাদ পেল। গতরাতে গ্রুপ ট্যুরে সিলেট যাওয়ার পথে অনিক এক্সিডেন্ট করেছে!

কলিংবেল বাজছে। অন্তরা ব্রেকফাস্ট করছিল। তার মা আর বাবা দু’জনেই অফিসের জন্য খুব সকালে বের হয়ে যান। সারাদিন অন্তরা একা বাসাতেই থাকে। আধখাওয়া ব্রেডটা রেখে দরজা খুলতেই নোরার কান্নারত অবস্থা দেখে অন্তরা হকচকিয়ে গেল।

হিঁচকি তুলে কাঁদছে মেয়েটা। এলোমেলো চুল। নাকের ডগায় জমে আছে ঘাম। বিধ্বস্ত অবস্থা একেবারে! অন্তরা আলতো করে ধরল তার কাঁধ। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে দোস্ত? তোর এই অবস্থা কেন?”

” অনিক স্যার এক্সিডেন্ট করেছে… কথাটা বলতে বলতে নোরা প্রায় লুটিয়ে পড়তে নিচ্ছিল। তাকে শক্তহাতে সামলে নিল অন্তরা। কোনমতে ধরে এনে সোফায় বসালো।

” শান্ত হ। আমি আলভীর কাছে শুনেছি সব। তোকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু গাঁধাটা বলেই দিল।”

” আমি এক্ষুণি ওর কাছে যাব। এক্ষুণি যাব।” অপ্রকৃতস্থের মতো কথা বলছে নোরা। অন্তরা ওর এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল।

” আরে, সিরিয়াস কিছু হয়নি পাগল। খুবই মাইনর ইনজ্যুরি হয়েছে। অনিক স্যার জানালার কাছে ছিল বলে মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়েছে। এর বেশি কিছু না।”

” তোর কাছে এটা বেশি কিছু মনে হচ্ছে না? কি ফালতু কথা বলছিস!”

রাগে সেন্টার টেবিলের টিস্যুবক্স আর ফুলের টব আছড়ে ফেলে দিল সে। সিরামিকের টবটা কার্পেটের উপর পিছলে পড়ার কারণে ভেঙে গেল না। অন্তরা ভীত কণ্ঠে বলল,” মাথা ঠান্ডা কর নোরা। সত্যি অনিকস্যারের কিছু হয়নি।”

” তাহলে ও আমার ফোন ধরছে না কেন? আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই। রাইট নাউ!”

” আচ্ছা, আচ্ছা, আমি আলভীকে ফোন করছি।”

” আমি সিরিয়াস অন্তু। আমি সিলেট যাবো।”

” মানে? পাগল হয়েছিস?”

” তুই আমার সাথে যেতে চাইলে আয়। নয়তো আমি একা একাই চলে যাবো।”

” চুপ কর, থাপ্পড় খাবি একটা। তুই কিভাবে যাবি?”

নোরা সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। শুধু বলতে লাগল,” আমি অবশ্যই যাবো।”

দুপুরে অনিকের সাথে নোরার কথা বলার ব্যবস্থা করা গেল। অনিক নিজের অবস্থা নোরাকে বুঝতেই দিল না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মাথা ব্যান্ডেজ আর হাতে গুরুতর ইনজুরি নিয়ে সে খুব হৃষ্টচিত্তে জানাল, ” আমি একদম ঠিকাছি নোরা। কিছুই হয়নি আমার। শুধু সামান্য একটু ইনজ্যুরড হয়েছি। হসপিটালে তো জাস্ট ফার্স্ট এইড ট্রিটমেন্টের জন্য এসেছিলাম। এখন আমি রিসোর্টে আছি।”

নোরার তখন কান্নাই থামছে না। সে ভালো করেই জানে অনিক হসপিটালে। একটু আগেই আলভীর সাথে অন্তরা কথা বলেছে। নোরা তাদের কথোপকথন শুনেছে মন দিয়ে৷ তাই অনিক নিখুঁত অভিনয় দিয়েও তাকে ভোলাতে পারল না। সে বলল,” আমি এখুনি আপনাকে দেখতে চাই। এই মুহূর্তে। ”

অনিক বিপাকে পড়ে গেল। হাসপাতালে বসে সে ভিডিওকলের কথা বলতে পারবে না। তাই বাহানা বানাল,” আচ্ছা আমি তো এখন বের হচ্ছিলাম। বাসায় এসে তোমাকে ভিডিওকল দিবো।”

” আর একটাও মিথ্যা বলবেন না। আমি ভালো করেই জানি আপনি কোথায়। আর শুনুন, আমি এখনি সিলেট আসছি।”

” পাগল নাকি তুমি? খবরদার এসব পাগলামি করবে না।”

নোরা অবিরাম কাঁদছে। অনিক নরম গলায় বলল,” তেমন কিছুই হয়নি বিশ্বাস করো। শুধু পেছন থেকে একটা ছোট গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগেছিল। আলভী তোমাকে না জানি কি উল্টা-পাল্টা বুঝিয়েছে। টেনশনের কিচ্ছু নেই।”

” আমি দুইঘণ্টার মধ্যে সিলেট পৌঁছে যাবো। আপনারা যেখানে আছেন ঠিক সেখানেই। আমি বাসে আছি।”

” হোয়াট?”

নোরা কথা শেষ করেই লাইন কেটে দিল।অনিক ভেবেছিল নোরা হয়তো ফাজলামো করছে। কিন্তু কে জানতো মেয়েটা সন্ধ্যার মধ্যে সত্যি সত্যি চলে আসবে!

অনিক হাসপাতালের গ্রাউন্ডফ্লোরে বসে চা খাচ্ছিল। একটু পর হঠাৎ দেখল নোরা দূর থেকে হেঁটে আসছে। তার কাঁধে হালকা গোলাপী রঙের একটা ব্যাগপ্যাক। থ্রি কোয়ার্টার কালো জিন্সের সাথে সাদা টি-শার্ট। টি-শার্টের উপর আকাশী রঙের জ্যাকেট। খোলা চুল। দেখতে একদম অন্যরকম লাগছে নোরাকে। অনিক প্রথমে ভেবেছিল এটা বুঝি তার ভ্রম! নোরাকে দেখতে দেখতে আনমনে চায়ে চুমুক দিতে নিয়ে তার ঠোঁট অবধি পুড়ে গেল!

নোরা অনিককে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। পেছনেই অন্তরা ছিল। বিনয়ী কণ্ঠে বলল,” স্যার আসসালামু আলাইকুম।”

অনিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। নোরা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে কাঁদছে। অনিক তাকে সামলাবে নাকি নিজেকে এখনও বুঝে উঠতে পারল না। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে!

থমথমে নীরবতা ঘর জুড়ে। বিশাল জানালা থেকে ফুরফুর করে বাতাস আসছে। মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে নোরা। অনিক তারই সামনে বসে আছে সোফাতে। ধা’ক্কাটা এখনও সামলাতে পারছে না সে। দু’টো মেয়ে মানুষ ঢাকা থেকে সিলেট চলে এসেছে। বিষয়টা হজম করার মতো না। অনিক গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল,” কাজটা কেন করলে নোরা?”

” তার আগে বলো তুমি এটা কেন করলে?”

অনিক হতভম্ব হয়ে উচ্চারণ করল,” মানে? আমি কি করেছি?”

” তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল মাঝরাতে। অথচ সেটা আমাকে জানতে হলো সকালে। তাও তুমি কিছু জানালে না। আমাকে জানতে হলো আলভীর কাছ থেকে। আর এই…”

বিছানা ছেড়ে উঠে এলো নোরা। সোফায় অবস্থানরত অনিকের মুখোমুখি এসে তার শার্টের কলার খামচে ধরল। শাসনের ভঙ্গিতে শুধাল,” কোনোকিছু প্ল্যান না করে আলভীর সাথে তুমি এখানে কিভাবে এলে? সীতাকুন্ডে ও তোমার এতোবড় ক্ষতি করেছিল তবুও? জানো না ওর সঙ্গে থাকলেই তোমার বিপদ হয়। এখন এই এক্সিডেন্টটাও যে পূর্ব পরিকল্পিত না তার কি গ্যারান্টি আছে? বলো?”

নোরার চোখ থেকে আগুনের হু’লকি বের হচ্ছে। ক্রোধে কাঁপছে ঠোঁট দু’টো। অনিকের মাত্র খেয়াল হল নোরা তাকে তুমি করে বলছে। এজন্যই কি সবকিছু এতোটা এলোমেলো লাগছে? নোরা যতবার কথা বলছে অনিক বুকে একটা ধাক্কার মতো খাচ্ছে। তবে বিষয়টা তার ভালোই লাগছে। নোরা আবার জিজ্ঞেস করল,” কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন? বলো?”

অনিক কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,” তুমি বাসায় ম্যানেজ করলে কিভাবে? এখানে আসার সময় আন্টি-আঙ্কেল কিছু বলেনি।”

নোরা ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” সেটা বড় কথা না। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

” কি উত্তর দিবো? আলভী তার কাজের জন্য অনেক আগেই ক্ষ’মা চেয়েছে। আর আজকের ঘটনাটা শুধুই একটা দূর্ঘটনা। এখানে আলভীর দোষ নেই কারণ গাড়িতে সেও ছিল। তাছাড়া আলভী আমাদের গ্রুপ মেম্বার। ওকে ছাড়া কোনো ট্যুর প্ল্যান হয় না।”

” উফ, তোমাকে কে বলেছিল ট্যুরে আসতে? তাও আবার আমাকে না জানিয়ে? যদি ভ*য়ংকর কিছু হয়ে যেতো আমি কি করতাম বলো?”

অনিক পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে নোরার দিকে। ইশশ! লাল চুলের বাচ্চা মেয়েটার মুখে ‘তুমি’ ডাকটা শুনতে কি দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা তার বউ। অনিক মনের অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিল। নোরার নরম গালে হাত রেখে কোমল গলায় বলল,”আ’ম স্যরি। এরপর থেকে আর কখনও তোমাকে না জানিয়ে কিছু করব না।”

কথাটা বলেই নোরাকে টেনে সোফার দেয়ালে মিশিয়ে দিল অনিক। তারপর ঠোঁটে দিল গাঢ় চুমু। সারাদিনের ক্লান্তি, দূর্বলতা, সব এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল। প্রশান্তিতে চোখ বুজে আসতে লাগল। বেশ অনেকক্ষণ পর অনিক ছাড়ল নোরাকে। মেয়েটা তখন বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। অনিক জিজ্ঞেস করল আলতো গলায়,” এখন বলো, বাসায় কি বলে এসেছো?”

নোরা জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
” শোনো, প্রথমে আমি ফোন করলাম বাবাকে। বললাম অন্তুর মা ভীষণ অসুস্থ। তাই আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে হসপিটালে গেছেন। অন্তু বাসায় একা থাকবে। আন্টিকে এক কয়েকদিনের জন্য হসপিটালে এডমিট করার প্রয়োজন হয়েছে। এই ক’দিন আমি অন্তুর সাথে ওর বাসায় থাকবো। তারপর অন্তুকে বাবার সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছি। অন্তু একটু গলা ভেঙে কান্নাকাটির চেষ্টা করেছে, ব্যাস! ”

” এতোবড় মিথ্যে? আর অন্তরা? ও কিভাবে ম্যানেজ করেছে ওর বাসায়?”

” ও একই কাজ করেছে। ওর মাকে বলেছে আমার বাবা হাসপাতালে। কিছুদিন ও আমার বাসায় থাকবে।”

অনিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। কণ্ঠে অসন্তোষ ঢেলে বলল,” কি দরকার ছিল এতো রিস্ক নেওয়ার?”

” তোমার জন্য আমি এর থেকেও বড় রিস্ক নিতে পারি।”

” তাই?”

” হুম। তাই।”

” তাহলে প্রমাণ দাও। চলো বিয়ে করে ফেলি। আর ঢাকায় ফিরে যাবো না। সংসার পাতবো এখানেই। রাজি?”

নোরা হেসে ফেলল। অনিক হঠাৎ চিন্তিত গলায় বলল,” ওহ শিট!”

” কি হয়েছে?”

” আলভী তো তোমাকে দেখেছে নিশ্চয়ই? যদি বাড়িতে ফোন করে বলে দেয়? ও তো একটা কিনিকবাজ নেটওয়ার্ক।”

নোরা হেসে জিজ্ঞেস করল,” কিনিকবাজ নেটওয়ার্ক? সেটা আবার কি?”

অনিক আশঙ্কাগ্রস্ত গলায় বলল,” আচ্ছা তোমার বাবা মানে আঙ্কেল যদি তোমাকে খুঁজতে অন্তরাদের বাসায় চলে যায় তখন?”

” আরে ধুর! বাবার এতো টাইম নেই। আর কেনোই না যাবে? বাবা কি আমাকে সন্দেহ করেছে? সন্দেহ করলে তো আসতেই দিতো না।”

” পরে যদি সন্দেহ করে?”

” কেন করবে? কোনো কারণ আছে সন্দেহ করার? দেখেন আপনি শুধু শুধু টেনশন করবেন না। আর আমারও টেনশন বাড়াবেন না।”

” ‘তুমি’টাই তো ঠিক ছিল। এখন আবার ‘আপনি’ কেন?”

” ‘তুমি’ তো আমি রাগের মাথায় বলছিলাম।”

” রাগটাই তো ভালো লাগছিল। বউ বউ লাগছিল।”

“ইশ!” নোরা লজ্জা পেয়ে হাসল। তখনি দরজা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করল নার্স। নোরা দ্রুত সোফা থেকে উঠে বিছানায় এসে বসল। অল্পবয়সী নার্স আঁড়চোখে একবার নোরাকে দেখেই অনিকের দিকে তাকাল। তারপর প্রশ্ন করল,” পেশেন্ট কে?”

অনিক জবাব দিল,” আমি পেশেন্ট।”

” তাহলে আপনি ওখানে বসে আছেন কেন? শুয়ে থাকতে বলা হয়েছিল আপনাকে।”

তারপর নোরার দিকে চেয়ে কিছুটা রুক্ষ স্বরে বলল,” দয়া করে পেশেন্টের বেড থেকে উঠুন।”

নোরা সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল। নার্সটি শাসনের সুরে অনিককে বলছে,” সন্ধ্যা থেকেই নিচে গিয়ে পায়চারী করছেন আপনি। একবারও আপনাকে বেডে দেখি না আমি। প্রবলেম কি? এভাবে চললে সুস্থ হবেন? বসুন এদিকে। ঔষধটা খান। আর জ্বর আছে নাকি আপনার গায়ে? দেখি তো!”

নার্স অনিকের কপালে হাত রাখল জ্বর দেখার উদ্দেশ্যে। নোরার যেন গা-পিত্তি জ্বলে গেল। নার্স ঔষধ বের করে অনিকের মুখের সামনে ধরতেই সে বলে উঠল,” আমাকে দিন। আমি খাওয়াচ্ছি।”

বলেই নার্সের হাত থেকে ট্যাবলেট কেঁড়ে নিল নোরা। ইতস্তত মুখে বলল,” আপনি যান। আর প্রেসক্রিপশনটা রেখে যান। আমিই ওকে সময়মতো ঔষধ খাইয়ে দিবো। আপনাকে প্রেশার নিতে হবে না।”

হঠাৎ নোরার এমন আচরণে নার্সের চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল। অস্বস্তি মাখা কণ্ঠে বলল,” ঠিকাছে। কিছু লাগলে বলবেন।”

” লাগবে না কিছু। আপনি যেতে পারেন।” বেশ স্পষ্ট কণ্ঠে বলল নোরা।

নার্স চলে যেতেই অনিক হাসিতে ভেঙে পড়ল। নোরা অবাক হয়ে বলল,” হাসছেন কেন?”

” জেলাসিতে তোমাকে দারুণ দেখায় নোরা।”

নোরা থতমত খেয়ে বললাম,” আমি জেলাসি কোথায় করলাম? আর এই নার্সকে জেলাস করার কি আছে? আমার কি খেয়ে কাজ নেই?”

বলেই মুখ গোজ করে সোফায় বসল নোরা। অনিক হাসি হাসি মুখে তখনও তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বলল,” মা যে কাল তোমার সাথে এতো রুড বিহেভ করেছে সেটা তুমি আমাকে জানাওনি কেন নোরা?”

নোরা চ’মকে উঠল। আ’চমকাই মুখটা মলিন হয়ে গেল তার। অনিক বলল,” কি ভেবেছিলে? বললে আমি বিশ্বাস করতাম না?”

নোরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” আসলে আমি কিভাবে কথাটা বলবো বুঝতে পারছিলাম না,সরি। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন? আন্টি কি নিজেই আপনাকে বলেছে?”

অনিক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “হুহ! মা বলবে আমাকে? ফোনের রেকোর্ডিং চেক করেছিলাম৷ মা তোমাকে যা যা বলেছে সব শুনেছি।”

নোরা অস্বস্তি মাখা গলায় বলল,” আপনি আবার উনার সাথে রুড হোননি তো? দেখুন উনি হয়তো বিষয়টা বোঝেননি তাই…”

নোরাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অনিক কাছে এসে ওর ঠোঁট চেপে ধরল। তারপর বলল,” তুমি এতো মিষ্টি কেন নোরা?”

তারপর নোরার ডানহাতটা নিয়ে হাতের উল্টোপিঠে একটা গাঢ় চুমু দিল। হাতটা ধরে থেকেই বলল,” এইযে হাতটা ধরলাম, কোনোদিনও ছাড়ব না। মরে গেলেও না। প্রমিস।”

নোরা চোখে অশ্রুমেলা। নাক টেনে বলল,” আর আপনার ফ্যামিলি যদি আমাকে কোনোদিন না মানে?”

” অবশ্যই মানবে। আমি মানিয়েই ছাড়ব।”

নোরা অনিকের বুকে মাথা রাখল। অনিক ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে নিয়ে এলো। সারারাত অনিকের কেবিনেই ছিল নোরা। আর অনিকের গ্রুপ মেম্বাররা রিসোর্ট বুক করে সেখানে। অন্তরাও চলে গেছে আলভীদের সাথে। কিছুসময়ের জন্য অনিক ঘুমিয়েছে। নোরা তার মাথার কাছে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিল। হঠাৎ মাঝরাতে অনিকের ঘুম ভেঙে যায়। সে ফিসফিসিয়ে নোরাকে ডাকল,”এই নোরা।”

” হুম? কিছু লাগবে আপনার? ওয়াশরুমে যাবেন?”

” না। বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

” এতোরাতে?”

অনিক উঠে বসতে বসতে বলল,” বাইরে অনেক বাতাস৷ এমন আবহাওয়ায় রাতের শহর ঘুরতে দারুণ লাগবে। নিচে সাব্বির ভাই তার সাইকেলটা রেখে গেছে। আমিই বলেছিলাম। চলো ঘুরে আসি।”

” কিন্তু, ডাক্তার আপনাকে বলেছে রেস্ট নিতে।”

” কিছু হবে না। মাত্র একঘণ্টার জন্য।”

নোরা মৃদু শ্বাস ফেলে বলল,” ঠিকাছে। কিন্তু শুধু একঘণ্টা।”

হাসপাতালের বেয়ারাকে পাঁচশো টাকা দিয়ে অনিক নোরা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। নোরাকে সামনে বসাল অনিক। নোরা বসলও।

” আচ্ছা আপনি কিভাব জানলেন আমার সাইকেলে এভাবে বসতে ভালো লাগে?”

” জানি না। আমি তো বসিয়েছি আমার স্বার্থে।”

নোরা অবাক হয়ে বলল, “আপনার স্বার্থে?”

” হুম। এইযে দেখো, তোমার চুলগুলো আমার চোখেমুখে এসে বারি খাচ্ছে। আমি চুলের মিষ্টি গন্ধ নিতে পারছি। আর ইচ্ছে করলেই তোমার ঘাড়ে,পিঠে, মুখ ঘষতে পারছি। তুমি পেছনে বসলে তো এই সুযোগগুলো পেতাম না। মিস হয়ে যেতো।”

নোরা লজ্জায় গুটিয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার। শীতল পরিবেশ। কেমন একটা নেশা জাগানো রোমাঞ্চকর অনুভূতি। নোরা আজকের এই রাত কোনোদিন ভুলবে না! অনিক একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে সাইকেল থামাল। চারদিকে ঝড়ো হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টিও হতে পারে। অনিক সাইকেল থামিয়েই নোরাকে জড়িয়ে ধরে একদম কোলে নিয়ে ফেলল।

নোরা হাসতে হাসতে বলল,” আরে কি করছেন? আপনার হাতে তো ব্যথা!”

” ব্যথা সেরে গেছে।”

নোরা বলল,” তাই বলে এভাবে আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হবে?”

” হ্যাঁ হবে। আমার ভালো লাগছে। তোমার লাগছে না?”

নোরা অনিকের শার্টের বোতাম খুঁটতে খুঁটতে লাজুক মুখে জবাব দিল,” হুম লাগছে তো।”

“আর কি কি ভালো লাগে বলো?”

নোরা অনিকের বুকে মুখ ঢেকে বলল,” আপনি যা করবেন তাই ভালো লাগবে।”

” তুমি নিশ্চিত? ”

“হুম।”

” এইটা ভুল নোরা, আমার সবকাজই তো তোমার ভালো লাগবে না।”

” কেন? ”

অনিক দুষ্ট হেসে বলল,”যদি অন্যমেয়ের সাথে প্রেম করি সেটাও ভালো লাগবে? যদি তোমার জায়গায়…”

অনিক আর কিছু বলার আগেই নোরা ওর মুখ চেপে ধরে বলল,” একদম খু’ন করে ফেলব।”

অনিক উচ্চশব্দে হেসে উঠল। হঠাৎ খেয়াল করল নোরার চোখ ছলছল করছে। মেয়েটাকে সে যত অবুঝ ভেবেছিল এই মেয়ে তার চেয়েও অবুঝ। অনিক হেসে বলল,” আরে পাগলি, আমি তো দুষ্টুমী করছি এতে কাঁদার কি হল?”

” এ ধরণের বাজে দুষ্টুমীও আর করবেন না। ”

” আচ্ছা করবো না সরি।”

অনিক নোরাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছে। নোরা হঠাৎ বলল,” প্লিজ এবার আমাকে নামান, আমি হাঁটতে চাই।”

অনিক নামিয়ে দিল। নোরা বলল,” জায়গাটা খুব ঠান্ডা তাইনা? বাতাস আসছে। বৃষ্টি হলে ভালো হতো।”

“বৃষ্টি হবে মনে হয়।”

” আমরা ভিজবো?”

” তুমি চাইলে ভিজবো।”

” না থাক, আপনার জ্বর এলে?”

নোরা লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে লাগল। অনিক পকেটে হাত রেখে স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটছে। নোরা অনেকটা দূরে চলে গেছে। হঠাৎ বজ্রপাতের বিকট শব্দে নোরা চিৎকার দিয়ে সামনের একটা বটগাছ জড়িয়ে ধরল। অনিক কাছে এসে বলল,” বাহ! সবসময় দেখি বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেলে মেয়েরা ছেলেদের জড়িয়ে ধরে। আর তুমি কিনা একটা বটগাছ জড়িয়ে ধরলে? তুমি তো ইতিহাসই বদলে দিলে।”

নোরা ভয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,” আপনি তো কাছে ছিলেন না। নাহলে আপনাকেই জড়িয়ে ধরতাম।”

” এইতো এখন কাছে আছি। জড়িয়ে ধরো।”

” আগে বাজ পড়ুক!”

অনিক এক হাত দিয়ে নোরার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে এনে বলল,” বাজ পড়াটা কি জরুরী?”

নোরা সরে যেতে চাইল কিন্তু পারল না। বলল,” অবশ্যই জরুরী এবার ছাড়ুন।”

” উহুম!”

” কামড় দিবো কিন্তু।”

” দাও। আমিও দিবো।”

” কি? আপনি আমাকে কামড় দিবেন?”

” হ্যাঁ। ”

“আচ্ছা আমার আগে কি আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিল?”

” হ্যা ছিল তো।”

নোরার চোখ বড় বড় হয়ে গেল,” কি? ছিল? আমাকে কোনোদিন বলেন নি তো!”

” তুমি জিজ্ঞেসই করোনি। কিভাবে বলবো? আমি তো আর তোমার মতো না। রাস্তাঘাটের অচেনা মানুষদেরও বলে বেড়াই বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ হওয়ার ঘটনা।”

অনিক একথা বলেই অন্যদিকে তাকাল। নোরার মনে পড়ে গেল, তাদের যখন প্রথম দেখা হয়েছিল তখন সে রিকশায় বসে অনিককে তার এক্স বয়ফ্রেন্ড ফারহানের গল্প শুনিয়েছিল। অনিক সেটা এখনো মনে রেখেছে। আবার সুযোগ পেয়ে তাকে খোঁচাও দিচ্ছে। কি বদের হাড্ডি রে বাবা! নোরা মুখ হাঁ করে সরু চোখে তাকাল। তারপর অনিকের বাহুতে কয়েকটা কিল দিয়ে বলল,” মজা নিচ্ছেন তাইনা?”

অনিক হাসতে হাসতে বলল,” যদিও ফারহানের বিষয়টা আমি জানতাম, তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে মজা লাগছিল। আর তোমার ইনোসেন্সনেস দেখেও ভালো লাগছিল।”

” হুহ! আপনি আসলেই বদের হাড্ডি। আচ্ছা এখন বলুন তো আপনার কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল?”

অনিক কড় গুণতে লাগল,” এক..দুই..তিন..চার..

নোরা অবাক হয়ে বলল,” এতোগুলো গার্লফ্রেন্ড ছিল?”

” খুব বেশি না। সাড়ে আটটা।”

” মানে? গার্লফ্রেন্ড আবার সাড়ে আটটা হয় কিভাবে?”

” মানে একজনের সাথে রিলেশন হওয়ার আগেই ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তাই সে আমার হাফ গার্লফ্রেন্ড, হাফ এক্স।”

নোরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। অনিকের কথার আগা-গোড়া তার মাথায় ঢুকছে না। নোরাকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে অনিক হেসে দিল। বলল,” কি?”

নোরা কথা না বলে আবার অনিককে মারতে শুরু করল। আর অনিক তো হেসেই খু’ন। হাসতে হাসতে বলল,” আরে মারছো কেন?”

” সত্যি করে বলুন কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল আপনার। আর তাদের সাথে কি কি করেছেন। সবাইকেই কি কিস করেছেন? এজন্যই তো বলি, এতো ভালো কিসিং কোথ থেকে শিখলেন!”

” তাহলে স্বীকার করছো আমি গুড কিসার?” সামান্য ঝুঁকে এলো অনিক।

নোরা হকচকিয়ে গেল।রাগী কণ্ঠে বলল,” আপনি বলবেন?”

” আচ্ছা বলছি। মজা করেছি। আমার কখনো কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিল না। তুমিই আমার প্রথম, তুমিই আমার শেষ। ”

নোরা সন্দেহী দৃষ্টিতে বলল,” সত্যি? ”

” সত্যি রে বাবা! এখন কি প্রমাণ লাগবে?”

” না। প্রমাণ লাগবে না। কিন্তু এটা বলুন, তাহলে আপনি কিস করা কিভাবে শিখলেন?”

” বোকা মেয়ে! এসব শিখতে গার্লফ্রেন্ড থাকা লাগে? মুভি দেখেও তো শেখা যায়।”

” মুভি? মুভি তো আমিও দেখি। কই আমি তো শিখিনি।”

” তুমি তো তামিল, হিন্দি, বাংলা এসব দেখো। ইংলিশ মুভি কখনো দেখেছো?”

নোরা মাথা নেড়ে বলল,” উহুম। ওদের ইংরেজি আমি বুঝিনা। আর সাবটাইটেলও পড়তে পারিনা। সব মিলিয়ে দেখা হয়না।”

” আচ্ছা এসব বাদ দাও। অন্তত টাইটানিক তো দেখেছো?”

” ওটাও দেখিনি। হিন্দি ডাবিং অনেক খুজেছি কিন্তু পাইনি। তাই দেখাও হয়নি।”

অনিক মৃদু হেসে নোরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” আহারে! আমার বউটা কত্ত ইনোসেন্ট। থাক তোমাকে এসব দেখতেও হবে না জানতেও হবেনা। তুমি এমনই থাকো।”

হঠাৎ কিসের একটা শব্দে দু’জনই চমকে উঠল তারা। অনিক সরে গেল নোরার কাছ থেকে। নোরাও আশেপাশে খুঁজতে লাগল। কারো কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হাসির আওয়াজও আসছে। নোরার হালকা ভয় লাগল। অনিকের হাত ধরে বলল,” এখানে মনে হয় কেউ আছে। চলুন চলে যাই।”

“সামনে তাকাও।”

নোরা অনিকের ইশারা বরাবর সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। আলভী আর অন্তরা একসাথে খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায়। নোরার দেখেই ভীষণ লজ্জা লাগল। অনিক বলল,” আলভীর রুমে সাব্বির ভাই ছিল। তাই হয়তো ওরা এখানে এসেছে।”

নোরা অনিকের চোখ ধরে বলল,” আপনি কেন দেখছেন? তাকাবেন না।”

অনিকের হাসি পেল৷ বলল,” আচ্ছা তাকাবো না। চলো এখান থেকে।”

” না দাঁড়ান। ওদেরকে একটু ডিস্টার্ব করি।”

” ডিস্টার্ব করবে মানে? কোনো দরকার নেই। শুধু শুধু লজ্জা পাবে।”

” উহুম। আমি এভাবে ছেড়ে দিবোনা। রাত-বিরাতে ফষ্টিনষ্টি বের করছি ওদের।”

“নোরা, আমরাও কিন্তু একই কাজ করছিলাম। যদি ওরা আমাদের আগে দেখতো তখন আমরাও অস্বস্তিতে পড়তাম। তাই ছেড়ে দাও। আমরা দেখেছি এটা ওদের জানানোর কোনো দরকার নেই।”

” আমরা কি ওদের মতো এসব করছিলাম? ”

” তবুও বাদ দাও না ভাই।”

” না। আমি বাদ দিবো না। এতোবড় একটা জিনিস দেখে ফেলেছি। আর অন্তুকে একটু জ্বালাবো না?তাই কি হয়?”

” অন্তরা তোমার বেস্টফ্রেন্ড। কিন্তু আমার তো ছোটভাই আর ছাত্রী। আমি কিভাবে..”

” এতো সাধু সেজেন না তো। অন্তু এখন আর আপনার ছাত্রী না। আপনার শালিকা। তাই আপনি সব করতে পারেন। এইযে নিন পাথর।”

” পাথর দিয়ে কি হবে?”

” একটা পাথর আমি নিবো আরেকটা আপনি। তারপর একসঙ্গে ঢিল মারবো।”

” এই না একদম না। পাগল নাকি?”

” পাগল না পাগলী। আপনিই তো বলেন। এবার ধরেন।”

নোরা এ কথা বলেই অনিকের হাতে পাথরটা দিয়ে সামনে তাকাল। তারপর নিজের হাতেরটা ঢিল মারতে মারতে অনিককে বলল,” আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মারেন,মারেন!”

অনিক মারবে না তাই বাধ্য হয়ে নোরাই ওর হাত থেকে নিয়ে ঢিল মারল। পরে নিজেরটাও মারল। তারপর সাথে সাথে নিচে বসে গেল। অনিককেও টেনে বসাল। তারপর হেসে হেসে বলল,” এবার শুধু মজা দেখুন।”

আলভী আর অন্তরা ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল। আশেপাশে ঢিলের উৎস খুঁজতে খুঁজতে নিজেদের অবস্থা ঠিক করল। তারপর কিছুক্ষণ গুজুরগুজুর করে চলে যেতে লাগল। ওরা চলে যেতেই নোরা হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অনিকও হাসছে। নোরা বলল,
” আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর ওরা ভূতের ভয় পেয়েছে। এখন এই ঘটনা তো কাউকে জানাতেও পারবে না। ভীষণ মজা হবে।”

অনিক বলল,” তুমি এতো দুষ্টু কেন নোরা?”

নোরা কিছু বলছে না শুধু হেসেই যাচ্ছে।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১১

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১১
লিখা Sidratul Muntaz

সময় কেটে যায়, নোরার কান্না থামে না। খুশির অশ্রু বাঁধ মানে না। অপ্রত্যাশিত ভাবে পেয়ে যাওয়া এই তুমুল সুখের স্রোত সামলাতে হিমশিম খেতে হয় তার কিশোরী মনকে। অনিকও বহুদিনের তৃষ্ণার্ত ছিল। প্রেয়সীকে এতো কাছে পেয়ে বেচাল হয়ে উঠেছে তার মন। দুই হাতে আঁকড়ে ধরেই রেখেছে তারা একে-অন্যকে। হঠাৎ পেছন থেকে কাশির শব্দ কানে আসতেই দু’দিকে ছিটকে সরে গেল দু’জন। আনিকার মুখে প্রশস্ত হাসি। সে হৃষ্টচিত্তে ফোড়ন কাটল,” ভাগ্যিস, বাবা-মা কেউ বাসায় নেই!”

অনিক লাজুক মুখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাথরুমে ঢুকে গেল। বড় আপুর সামনে কোনো কথাই বলতে পারল না সে। নোরা সংকোচে কাঁপছে। চোখের অশ্রুধারা তখনিও থামেনি। বাঁধ ভাঙা আনন্দ হচ্ছে শরীর জুড়ে। আনিকা নোরার কাছে এসে তার চিবুকে হাত রেখে বলল,” ভাইয়ের কাছে অনেক আগেই শুনেছিলাম তোমার কথা। কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনও। সেদিন যে বাড়ি এসেছিলে ভাইয়ের অসুস্থতার সময়, তখনি অনিক বলেছিল তোমার কথা। তুমিই সেই মিষ্টি মেয়েটা। আমার ভাইয়ের হৃদয় হরণকারীনি।”

নোরা চ’মকে তাকাল। তিরতির করে কাঁপছে তার চোখের পাতা। এ কোনো স্বপ্ন নয়তো? আনিকা নোরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” সত্যি খুব মিষ্টি তুমি। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে।”

রীতিমতো মাথা ঝিমঝিম করছে নোরার। খুশির একটা তীব্র স্রোত প্রবাহিত হলো সারা শরীর জুড়ে। এতো লজ্জা আর বাঁধন ছাড়া অনুভূতি তার কখনও হয়নি।

ঈদের ছুটির পর কোচিং খুলে গেল। অনিক-নোরার মধ্যে তখন চলছিল ভয়াবহ রকমের প্রেম। দিন-রাত ফেসবুকে চ্যাটিং,ভিডিও কল, দিনে একবার করে দেখা করা, কোচিং এই প্রতিদিন দেখা হতো ওদের। কিন্তু এতেও অনিকের মন ভরতো না। ছুটির পর অনিক ওকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে যেতো। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘোরা যেতো না। নোরার বাসায় ফেরার তাড়া থাকতো।

একদিন রাত বারোটার দিকে নোরা ল্যাপটপ কোলে নিয়ে মুভি দেখছিল। আর ম্যাসেজে অনিকের সাথে কথা বলছিল। অনিক জিজ্ঞেস করল,” কি করো?”

” এইতো মুভি দেখছি।”

” কি মুভি?”

” তামিল।”

” তুমি তামিল বোঝো?”

” সরাসরি তামিল না তো। হিন্দি ডাবিং।”

” ও আচ্ছা।”

” হুম। আপনি কি করেন?”

” কিছুক্ষণ আগে বাসায় আসলাম।”

” এতো দেরি? রাতে খেয়েছেন?”

” খাচ্ছি।”

” খেতে খেতে ম্যাসেজ করছেন? কষ্ট হয়না?”

” না। কোনো কষ্ট নেই। বরং আরাম।”

” কিভাবে?”

” বলা যাবেনা।”

” এই প্লিজ বলুন না। বামহাত দিয়ে আপনার ম্যাসেজ লিখতে আরাম কিভাবে লাগে? আপনাকে দেখে তো মনে হয়না আপনি বামহাতী।”

অনিক অনেকগুলো হাসির ইমোজি দিল। নোরা বলল,
” প্লিজ বলুন না বামহাত দিয়ে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে ম্যাসেজ লিখছেন?”

“আমি তো একবারও বলিনি আমি বামহাত দিয়ে ম্যাসেজ লিখছি।”

” তাহলে কোনহাত দিয়ে লিখছেন?”

“ডানহাত দিয়ে।”

” তাহলে কি বামহাত দিয়ে খাচ্ছেন?”

” উহুম। কোনো হাত দিয়েই খাচ্ছি না।”

” মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না বুঝিয়ে বলুন না প্লিজ।”

” বুঝিয়ে বলা যাবেনা। তোমার না বোঝাই ভালো। পরে এইটা নিয়ে কথা শোনাবে।”

” ও হ্যালো! আমি আপনার মতো না যে মানুষের দুর্বলতা নিয়ে কথা শোনাবো।”

” আমি কারো দুর্বলতা নিয়ে কখন কখন কথা শোনালাম?”

” আমাকে তো সবসময় বলেন কমন সেন্স নেই। এটা কি কথা শোনানো না?”

” ও এই ব্যাপার? ওইটা তো তোমার সাথে মজা করি। তোমাকে খেপানোর জন্য। ”

” নিজে খেপানোর জন্য মজা করলে দোষ নেই আর আমি করলেই দোষ?”

” আচ্ছা বাবা বলছি। আমি নিজের হাতে খাচ্ছি না, মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। তাই আমি আরামে ম্যাসেজ টাইপ করতে পারছি। এবার বুঝেছো?”

” ও আল্লাহ! এত্তোবড় ছেলে এখনো মায়ের হাতে খায়?”

” জানতাম এভাবেই বলবে। এজন্যই বলতে চাইনি।”

” তো বলার মতো কথা হলে বলবো না? আমার তো এবার আপনাকে হিংসা হচ্ছে। আপনি এতোবড় হয়ে যাওয়ার পরেও আপনার মা আপনাকে খাইয়ে দেয়। আর আমার মা?”

“বড়-ছোট ফ্যাক্ট না। মা-বাবার কাছে সন্তানেরা সবসময় ছোট।”

” আপনার মাথা। আমার মায়ের কাছে তো আমি সেই কবেই বুড়ো হয়ে গেছি। আমার কি মনে হয় জানেন? মায়েদের কাছে শুধু ছেলেরাই ছোট থাকে, আর মেয়েরা বুড়ো হয়ে যায়।”

” আমি ছেলে-মেয়ের কথা বলিনি। আমি শুধু বলেছি সন্তান।”

” ভুল বলেছেন। সঠিকটা আমি বলছি, আপনি শুধু ছেলে বলেই মায়ের কাছে আপনি এখনো ছোট। মেয়ে হলে এতোদিনে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগতো।”

“তাই? তোমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগেনি তো?”

” এখনও লাগেনি। কিন্তু সেই সময় খুব জলদি আসবে। যখন মা-বাবা দুজনেই আমার বিয়ের জন্য উঠে-পড়ে লাগবে।”

” আমিও চাই জলদি আসুক। ”

” কেন?”

” তোমার বিয়ে মানেই তো আমার বিয়ে। বিয়ের বয়সও আমার হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার তো হচ্ছে না। আর অপেক্ষা ভালো লাগেনা।”

” এই, আপনার না একটা আনম্যারিড বড়বোন আছে? তাকে বিয়ে না দিয়েই নিজের বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন?”

” তোমাকে কে বলল আনিকা আপু আনম্যারিড?”

“মানে? আনিকা আপু আনম্যারিড না?”

” আপুর আরও দু’বছর আগে বিয়ে হয়েছে। মিসক্যারেজ না হলে এতোদিনে কোলে একটা বাচ্চাও থাকতো। আর আমি মামা হয়ে যেতাম।”

এ কথা শুনে নোরার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আনিকা আপু কত হাসি-খুশি মানুষ। অথচ তার কি-না মিসক্যারেজ হয়েছিল!

” আচ্ছা নোরা তুমি ঘুমাবে কখন?” অনিক আবার মেসেজ করেছে।

নোরা লিখল,” এইতো মুভিটা শেষ হলেই ঘুমিয়ে যাবো। প্রতিরাতে মুভি দেখা নেশা হয়ে গেছে বুঝেছেন? সাথে চিপস বা চকলেট থাকলে জমে যেতো।”

অনিক মেসেজটা সিন করেও কিছু রিপ্লাই দিল না। প্রায় আধঘণ্টা পর সে আবার মেসেজ করল,” নোরা একবার বারান্দায় আসবে?”

” বারান্দায় কেন? আপনি কি বাসার নিচে?”

” বাইকের আওয়াজ পাচ্ছো না?”

” না! কিভাবে পাবো? আমার কানে তো ইয়ারফোন।”

নোরা ইয়ারফোনটা কান থেকে খুলল। ভিডিও পজ করে বারান্দায় গেল। অনিক বাইকের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নোরাকে দেখেই হাত নাড়ল। নোরাও হাত নাড়ল। অনিক মাত্র কিছুদিন আগে বাইক কিনেছে। আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে হুটহাট বাসার নিচে চলে আসা। নোরার অবশ্য বিষয়টা মজাই লাগে। অনিক পকেট থেকে মোবাইল বের করল। নোরা বুঝে গেল ওকেই ফোন করছে। তাই এক দৌড়ে বিছানা থেকে ফোন নিয়ে আবার বারান্দায় এলো। অনিক এতোক্ষণে ফোন দিয়ে ফেলেছে। নোরা বলল,” হ্যালো, আচ্ছা আপনি এতোরাতে এলেন কেন? কি দরকার ছিল?”

” একবার নিচে আসবে?”

“অসম্ভব। কেউ দেখে ফেললে খবর আছে।”

” ওহ। ঠিকাছে তাহলে আমি চলে যাই।”

” আরে দাঁড়ান! এতোদূর এসে আবার চলে যাবেন কেন? থাকুন আমি আসছি।”

নোরা এ কথা বলে ফোন কেটে দিল। অনিক হেসে ফেলল। সে জানতো নোরা আসবেই। নোরা মেইন গেইট দিয়ে বের হতেই অনিক ওকে একটানে একটা সরু গলিতে নিয়ে আসল। অন্ধকার রাস্তা, আশেপাশে কেউ নেই। নোরা চোখ বড় করে বলল,” এখানে কেন নিয়ে আসলেন?”

” যেন কেউ দেখে না ফেলে।”

একথা বলে অনিক নোরার এক গাল টিপে দিল। নোরা আরেকগাল এগিয়ে দিয়ে বলল,” এ গালেও দিন।”

” কি দিবো?”

অনিকের কণ্ঠে দুষ্টুমী। নোরা রেগেমেগে বলল,” টাচ করতে বলেছি।”

” কেন?”

” একগালে টাচ করা ভালোনা। স্বামী মরে যায়।”

” ধুর! ভুয়া কথাবার্তা এসব।”

” ভুয়া হলেও আমি বিশ্বাস করি। এখন দিন তো।”

অনিক টাচ করলনা। চুমু দিল। নোরা চোখ বড় করে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,” এএটা ক-কি হল?”

অনিক অকপটে বলল,” তুমি বলেছো টাচ করতে। হাত দিয়েই টাচ করতে হবে এমন তো বলোনি। আমি ঠোঁট দিয়ে টাচ করলাম, টাচ তো হয়েছে”

দুষ্টুমি করে চোখ মারল অনিক। নোরা লজ্জায় মাথা নিচু করে গালে হাত ঘঁষতে লাগল। অনিক তার চিবুকে হাত রেখে মুখটা উপরে তুলল। নোরা আইটাঁই করে বলল,” আচ্ছা এখন আমি যাই? অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।”

“অনেকক্ষণ কই হল? পাঁচমিনিটও তো হয়নি।”

নোরা মাথা নিচু করে ছটফট করছে। তার পা কাঁপছে সামান্য। অনিক বুঝতে পারছে মেয়েটা ভ*য় পাচ্ছে। তবুও ইচ্ছে করেই ছাড়ছে না৷ দুইপাশে হাত দিয়ে বেরিকেডের মতো আটকে রেখেছে। তার কম্পন রত মুখটা দেখতে অনিকের খুব মজা লাগছে।

নোরা অনুরোধ করে বলল,” যাই প্লিজ?”

“কেন?”

” বাবা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার রুমে দেখতে আসে। তখন আমাকে না পেলে?”

অনিক অভিমানী কণ্ঠে বলল,” আধঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে এতোদূর এসেছি। অথচ তোমাকে মাত্র দশমিনিটের জন্যও পাবো না?”

” আমি কি আপনাকে আসতে বলেছিলাম?”

অনিক গম্ভীর গলায় বলল,” ওকে! আর আসবো না। চলে যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই নোরাকে ছেড়ে সামনে এগোলো অনিক। নোরা তার হাত টেনে ধরল,” আরে, আরে, রাগ করলেন নাকি?”

” না রাগ করবো কেন? ভুল আমারই। তুমি তো আসতে বলোনি, তবুও কেন এসেছি?”

” সরি, আর বলবো না।”

নোরার মুখ কাঁদো কাঁদো। সে অনিককে জড়িয়ে ধরল। তার হাত গিয়ে ঠেঁকল অনিকের কোমরে। তখন নোরা খেয়াল করল অনিকের পকেটে কিছু একটা আছে। বড় প্যাকেটজাতীয় কিছু। নোরা ওখানে হাত দিয়ে বলল,” এটা কি?”

“তোমার জন্য চকলেট এনেছিলাম। ”

অনিক পকেট থেকে চকলেটের প্যাকেট বের করে নোরার হাতে ধরিয়ে দিল। নোরা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল,” আপনি কিভাবে জানলেন এটা আমার পছন্দ?”

” আমি জানবো না তো কে জানবে? চারবছর ধরে ফলো করছি। তোমার সবকিছুই জানি।”

নোরা লাজুক হাসল। অনিক হঠাৎ নোরাকে কোলে তুলে ফেলল। নোরা ভয় পেয়ে বলল,” আরে আরে, রাস্তাঘাটে এ কি করছেন? নামান প্লিজ।”

” উহুম। নামানো যাবেনা। তোমাকে এভাবে নিয়েই গেইট পর্যন্ত যাবো। তারপর ওইখানে নামাবো।”

“প্লিজ এটা করবেন না। কেউ দেখে ফেললে অনেক বড় সমস্যা হয়ে যাবে।”

” দেখলে দেখবে।”

” দেখলে দেখবে মানে? আপনি কি আমাকে ফাঁসাতে চান?”

অনিক উত্তর না দিয়ে সত্যি সত্যি নোরাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। আর নোরা ছটফট করতে লাগল। গলির মোড়ে এসে অনিক ওকে নামিয়ে দিল। গেইট পর্যন্ত গেলনা। নোরা হাঁফ ছেড়ে বাচল৷ তারপর কিছু একটা মনে পড়ায় বলল,” আচ্ছা আপনি না তখন বলছিলেন আনিকা আপুর বিয়ে হয়ে গেছে? তাহলে উনার হাসব্যান্ড কোথায়?”

” বিদেশ থাকে। ইতালির রোমে।”

” তাহলে আনিকাআপুর শ্বশুরবাড়ি?”

” গ্রামের বাড়িতে। আপুর ওখানে কষ্ট হয় বলে মা নিয়ে এসেছে। এখন আমাদের সাথেই থাকে।”

” ভাইয়া দেশে আসেনা?”

” আসে..ছয়মাসে একবার।”

” ইশ, আপুর কি কষ্ট।”

অনিক মৃদু হাসল। নোরার মাথায় শয়তানি চাপল। আচমকা অনিকের গালে চুমু দিয়ে দৌড়ে চলে গেল গেইটের ভেতরে। অনিক বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল শুধু। সে কিছু বলার আগেই নোরা ফুড়ুৎ।

পরদিন ছিল শুক্রবার। আলাদা কোনো পরীক্ষা না থাকায় কোচিং সেদিন বন্ধ ছিল। নোরার সারাদিনে একবারও অনিকের সাথে দেখা হয়নি। ফোনে কথা হয়েছে মাত্র একবার। এরপর যতবার কল দিয়েছে ফোন বন্ধ। অনলাইনেও আসেনি সারাদিন। নোরা অপেক্ষায় ছিল কখন অনিক অনলাইনে আসবে। ওর সাথে একবার কথা হবে। এই নিয়ে চিন্তাতেও ছিল প্রচুর।

এদিকে অনিক গিয়েছিল তার এক বন্ধুর বাসায়। জায়গাটা গ্রামাঞ্চল হওয়ায় নেটওয়ার্কের ঝামেলা ছিল। অনিক তাই নোরার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। আর নোরাকে সেটা জানাতেও পারেনি। নোরা সারাদিন টেনশনে ছিল। রাতে বাসায় আসার পর অনিক গোসলে ঢুকল। গরমকালে সে দিনে দুইবার গোসল করে। একবার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আরেকবার বাসায় ঢোকার সময়। অনিক বাথরুমে ঢোকার পরেই ফোনটা এলো। নোরা ফোন করছিল। হঠাৎ অনিকের ফোন খোলা পেয়ে নোরা পরপর কয়েকবার ফোন দিয়ে দিল। দিতেই থাকল। অনিকের মা ইলোরা খাতুন তখন অনিকের ঘরেই ছিলেন। বারবার ফোনটা বাজছে দেখে ধরে ফেললেন,” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে অল্পবয়সী মেয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো” আসসালামু আলাইকুম। ”

ইলোরা মেয়ের কণ্ঠ শুনে প্রথমেই একটু অবাক হলেন। অনিক ইদানীং ফোনে একটু বেশিই সময় কাটাচ্ছে। রাতে খেতে বসলেও ফোন আসলে খাওয়া রেখে বারান্দায় চলে যায়। মাঝরাতে ছেলের ঘর থেকে কথার আওয়াজও শোনা যায়। এসবের কারণ এখন ইলোরার কাছে পরিষ্কার। তার একমাত্র গুণোধর ছেলে তাহলে প্রেম করছে! ইলোরা বললেন,” কে বলছো?”

নোরা কোমলভাবে বলল,” আমি নোরা। অনিকস্যারের স্টুডেন্ট। স্যারকে কি আছেন?”

” কি দরকার ওকে?”

” কালকে আমাদের ম্যাথ ক্লাস তো। সে বিষয়েই একটু দরকার ছিল।”

“তুমি কি ওর কোচিং এর স্টুডেন্ট? ”

” জ্বী।”

মহিলার ভারী কণ্ঠ শুনে নোরার গলা হালকা কাঁপছে।

ইলোরা বললেন,” কোচিং এর স্টুডেন্ট হলে বাসায় কেন ফোন দিচ্ছো? কোচিং এর ঝামেলা কোচিং পর্যন্ত মিটিয়ে নিবে। বাসায় কেন ফোন করা লাগবে? দিন নেই রাত নেই শুধু ফোন আর ফোন। স্যারের সাথে ছাত্রীর এতো কিসের কথা? আর কখনও ফোন দিবে না। আমাকে যেন আর বলতে না হয়। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো না। বুঝেছো মেয়ে? বি কেয়ারফুল। যত দরকার সব কোচিং এ। বাসায় এতো ফোন দেওয়াদেওয়ি চলবে না।”

নোরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ইলোরা খট করে লাইন কেটে দিলেন। নোরা চমকে উঠল। তার চোখে অজান্তেই পানি এসে গেছে। এতোটা ঝাঁঝালো ব্যবহার এর আগে কেউ তার সাথে করেনি।

অনিক গোসল সেরে এসে যখন ফোনটা হাতে নিল, দেখল নোরার অনেকগুলো মিসডকল। সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক করল। কিন্তু নোরার ফোন বন্ধ। অনিক চিন্তায় পরে গেল। অনলাইনেও নেই মেয়েটা। নোরার সাথে তার ফোন থেকে লাস্ট কথা হয়েছিল দশমিনিট আগে। প্রায় দু’মিনিটের কনভারসেশন। অনিক বুঝল সে বাথরুমে থাকাকালীন কেউ এই ঘরে এসেছিল আর নোরার সাথে কথা বলেছিল। তখন কিছু হয়নি তো?

আনিকা এইসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ওর এই ঘরে আসার কথা না। বাবা ঘরে আসলেও ফোন ধরবে না। অনিক তার মাকে ডাকল। ইলোরা ঘরে এসে বললেন,” ডাকছিলি?”

” মা, তুমি কি আমার ফোন রিসিভ করেছো?”
” হ্যাঁ করেছিলাম। তুই গোসলে ছিলি, ফোনটা বারবার করে বাজছিল তাই ভাবলাম জরুরী হতে পারে।”

“ফোন ধরে কি বলেছো?”

” কিছুই তো বলিনি। আমি হ্যালো হ্যালো করছিলাম কিন্তু ওইপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসছিল না। পরে আমি কেটে দিয়েছি।”

” শুধু এইটুকুই?”

” হ্যাঁ, কেন কি হয়েছে?”

” কিছুনা। আচ্ছা আমি একটু বের হচ্ছি।”

” এতোরাতে কই যাবি?”

” দরকার আছে।”

” টেবিলে ভাত বেড়েছি খাবি না?”

” এসে খাব।”

” আরে, কি এমন জরুরী দরকার?”

অনিক আর কোনো কথার জবাব দিলনা। তোয়ালে দিয়ে ভালো করে চুল মুছে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরা অবস্থাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইক নিয়ে সোজা চলে গেল নোরাদের বাসার সামনে।

নোরা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। অনিক বাইকে বসেই নোরার বারান্দার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। ঘরের লাইট বন্ধ ছিল। অনিক নিজের মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিল না। নোরা তার সাথে কথা না বলে ঘুমাতে চলে কেন?অনিক কয়েকবার নোরার বারান্দা বরাবর ঢিল ছুঁড়ল। কিন্তু কোনো রেসপন্স পাওয়া গেলনা।

অনিক নোরাদের বাসার দাড়োয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা ভাই, চারতলার দক্ষিণ সাইডের ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে থাকে। নাম নৌরিন জাহান। ওকে চেনেন?”

” হ্যা চিনছি। বলেন কি দরকার?”

” কোনো দরকার না। আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম সব ঠিক আছে কিনা। মানে ও কি বাসায় আছে?”

” বাসায়ই তো থাকবো। এতোরাতে তো বিল্লিং থেকা বাইর হওয়া নিষেধ। মেইন গেইট তালা দেওয়া থাকে। ”

” ওহ। আচ্ছা আপনি কি সিউর ও বাসাতেই আছে? মানে আপনি দেখেছেন?”

” দেখি নাই। এখন আপনি কি বাসায় যাইবেন?আপনি কি হন ওগো?”

অনিক পড়ে গেল বিপাকে। সে নোরাদের কি হয় এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। অনিক চুপ করে থাকায় দাড়োয়ান আবার জিজ্ঞেস করল,” যাইবেন উপরে? ফোন লাগামু?”

” না না। দরকার নেই থাক।”

অনিক এ কথা বলে আবার বাইকে গিয়ে বসল। দাড়োয়ানের সাথে কথা বলেও টেনশন একটুও কমল না তার। যতক্ষণ না নোরার সাথে কথা বলতে পারছে তার মন শান্ত হবে না। সারারাত বাইকে বসেই কাটিয়ে দিল অনিক।

সকালে ঘুম ভেঙেই নোরার বাবা শাহআলম আনিস এক কাপ চা খেতে বারান্দায় আসলেন। তখন তিনি দেখলেন খালি রাস্তার মাঝখানে বাইক নিয়ে এক যুবক বসে আছে। তখন কিছু মনে না করলেও পরে যখন বুঝতে পারলেন ছেলেটির নজর উনার মেয়ের বারান্দার দিকে তখন আনিসের মনে হালকা খোটকা লাগল।

তিনি চা খেয়ে গোসলে গেলেন। গোসল সেরে এসে দেখলেন ছেলেটা এতোক্ষণ বসেছিল এখন দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় বসে আনিস কিছুক্ষণ পেপার পড়লেন। বেশি না শুধু হেডলাইনগুলো পড়লেন। কারণ আজ পত্রিকায় উনার মনোযোগ নেই। মনোযোগ বাইকওয়ালা অচেনা যুবকটির দিকে। প্রায় এক থেকে দেড়ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন ছেলেটা গেল না আনিস দাড়োয়ানকে ফোন করলেন।

দাড়োয়ান এসে অনিককে বলল,” আনিস সাহেব আপনাকে ডাকসেন।”

অনিক প্রথমে কিছু বুঝল না। তারপর ওপরে তাকাতেই সরাসরি চোখাচোখি হল। আনিস অনিককে হাতের ইশারায় বললেন উপরে আসতে। অনিক উপরে গেল। দরজা আগে থেকেই খোলা ছিল। একটা অল্পবয়সী কালোমেয়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রুটি বেলছে। খোলা দরজায় দাড়ালে রান্নাঘরটা সরাসরি দেখা যায়। মেয়েটি আঁড়চোখে অনিকের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। বেশ কৌতুহল নিয়েই তাকাচ্ছে।

আনিস রুম থেকে বের হতেই দেখলেন অনিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উনি দরজাটা লাগিয়ে অনিককে ভেতরে এসে বসতে বলে চলে গেলেন। ভদ্রলোকের কথামতো সোফায় এসে বসল অনিক। এরকম পরিস্থিতিতেও তার ভয় লাগছে না। সে শুধু আশেপাশে নোরাকে খুঁজছে।

আনিস ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই অনিক উঠে দাঁড়াল। আনিস হাত ইশারা করে বসতে বললেন এবং মুখেও বললেন,” বসেন বসেন।”

তারপর নিজেও বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,” আপনার নাম?”

অনিক কোমলচিত্তে বলল,” অনিক আবেদিন। আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট। আমাকে তুমি করে বলুন প্লিজ।”

আনিস ছেলেটার মতিগতি বুঝতে পারছেন না।এতোক্ষণ ধরে বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। যেই উপরে আসতে বলল ওমনি সুরসুর করে চলে এলো৷ এখন আবার অতি ভদ্রতা সহিত কথাও বলছে। বিষয়গুলো একটাও স্বাভাবিক লাগছে না আনিসের কাছে। উনি মৃদু হেসে অনিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশ্যাকের উদ্দেশ্যে। অনিক উঠে দাড়িয়ে হ্যান্ডশ্যাক করল। তারপর সেই হাতটা বুকে ছোয়ালো। এটাও ভদ্রতার একটা অংশ। ছেলেটা কি সত্যিই খুব ভদ্র? নাকি ভদ্র সাজার ভাণ করছে? এতো ভদ্র হলে রাস্তার মাঝখানে বাইক নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? আবার মানুষের বাসার বারান্দার দিকে নজরই বা রাখবে কেন?

আনিস উচ্চস্বরে ডাকলেন,”কল্পনা!”
সেই কালো মেয়েটি দৌড়ে আসল,” জি খালু? বলেন।”

” দেখছো না মেহমান এসেছে। চা নাস্তা কই?”

মেয়েটি দাঁত কেলিয়ে বলল,” ওক্ষণি আনতাসি খালু।”

অনিক বাঁধা দিল,”আমি এখন কিছু খাবো না। আঙ্কেল আপনি আমাকে যে কারণে ডেকেছেন সেই কারণটা শুধু বলুন। আমার একটু তাড়া আছে।”

” তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না তোমার তাড়া আছে।”

অনিক হকচকিয়ে বলল,” জ্বী?”

” অনেকক্ষণ ধরে দেখছি বাইক নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে আছো। দক্ষিণ দিকের বারান্দাটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলে। কি আছে ওইখানে? কাউকে খুঁজছো?”

অনিক সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে মনে যে উত্তর প্রস্তুত করে রেখেছিল সেটাই বলল,” জ্বী। আসলে একটা বাসা খুঁজছি।”

” কার বাসা?”

” নিজামুদ্দিন স্যারের বাসা?”

” কে নিজামুদ্দিন? ”

” আমার শিক্ষক। কলেজের শিক্ষক।” খুব অকপটে মিথ্যা বলল অনিক।

আনিস গম্ভীর মুখে জানতে চাইলেন” উনার বাসা কই?”

” এখানেই। আশেপাশে কোথাও।”

” সেটা তো বুঝেছি। কিন্তু কোন লেনে? বাড়ির নম্বর কত?”

” বাড়ির নম্বরটাই তো মনে পড়ছে না। তাই খুঁজে বের করতেও পারছিনা। নাহলে কখন পেয়ে যেতাম।”

অনিক হাসল। আনিস সেই হাসিতে তাল মেলালেন না। গম্ভীরমুখে বললেন,” ঠিকমতো ঠিকানা না জেনেই বাসা খুঁজতে চলে এসেছো?”

অনিক অপ্রস্তুত ভাবে বলল,” ঠিকানা আসলে জানতাম কিন্তু ভুলে গেছি। মাথায়ই আসছে না মানে মনেই পড়ছে না।”

” সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু বাইক নিয়ে আমার বাসার সামনে দাড়িয়েছিলে কেন?”

” আসলে হঠাৎ করে বাইকটা স্টার্ট হচ্ছিল না। আশেপাশে পার্কিং এর জায়গাও পাচ্ছিলাম না। তাই ওভাবেই বসে থাকতে হল কিছুক্ষণ। ”

” আর বারান্দার দিকে তাকিয়ে কি খুঁজছিলে?”

অনিক হাসি মুখে বলল,”আসলে বারান্দাটায় সূর্যমুখী ফুলের গাছটা দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। তাই তাকিয়েছিলাম। কিছু খুঁজছিলাম না।”

আনিস এখনও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।কথাগুলো উনার বিশ্বাসযোগ্য হল কি-না বোঝা গেলনা। ওদের কথার মাঝখানেই নোরা ঘরে ঢুকল। হঠাৎ অনিককে দেখে খুব চমকে গিয়ে কোনোকিছু না ভেবেই বলে ফেলল,” আরে স্যার, আপনি এখানে? আসসালামু আলাইকুম। ”

অনিক নোরার দিকে তাকাল। এতোক্ষণে নোরাকে দেখে মনে স্বস্তি আসল অনিকের। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। চোখগুলো হালকা লাল তবে ফুলে আছে। গালে গোলাপী আভা, তৈলাক্ত মুখ, এলোমেলো চুল। অনিক লোভাতুর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হাসিমুখে বলল,” নোরা,কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো স্যার। আপনি ভালো আছেন?”

আনিস এবার বললেন,” নোরা, উনি তোমার স্যার নাকি?”

নোরা বলল,” জ্বী আব্বু। কোচিং এর ম্যাথ স্যার। অনিকস্যার।”

আনিসের মুখে এতোক্ষণে হাসি ফুটল। অনিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,” আপনি এতোক্ষণ এ কথা বলেন নি কেন?”

অনিক বলল,” আসলে আমি তো নিজেও জানতাম না, যে এটা আমার ছাত্রী মানে নোরার বাসা।”

” ও আচ্ছা। তা ভালোই হলো স্যারকে খুঁজতে এসে ছাত্রীকে পেয়ে গেলেন।”

আনিস এ কথা বলে হাহা করে হাসলেন। নোরা আর অনিকও সেই হাসিতে তাল মেলালো। অনিক বলল,” আপনি কিন্তু আবার আমাকে ‘আপনি’ করে বলে লজ্জা দিচ্ছেন। প্লিজ ‘তুমি’ করে বলবেন।”

” আচ্ছা আচ্ছা সে না হয় বললাম তবে তোমাকে কিন্তু আজকে আমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করে যেতে হবে।”

” না না আঙ্কেল সেটা সম্ভব না। আমি বরং আজ উঠি।”
অনিক উঠে দাঁড়াল।নোরা বলল,” প্লিজ স্যার, ব্রেকফাস্ট করে যান না। আমাদের ভালো লাগবে।”

আনিস বললেন,” বসো বসো। ব্রেকফাস্ট করে যাও। খুব বেশি সময় লাগবে না।”

আনিস একথা বলে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেলেন। গলা উঁচিয়ে লীরাকে ডাকছেন। অনিক বিড়বিড় করে নোরাকে জিজ্ঞেস করল,” লীরা কে?”

নোরাও বিড়বিড় করে উত্তর দিল,” মা।”

“ও আচ্ছা, মানে আমার শাশুড়ী!”

” উফ!” লজ্জায় নোরার মুখ লালচে হয়ে গেল। ততক্ষণে নোরার মা লীরা-ও চলে এসেছেন। অনিককে দেখেই হাসিমুখে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। তারপর সবাই একসঙ্গে টেবিলে খেতে বসল। আনিস অনিককে নিজের সাথেই বসালেন। নোরা অনেকটা দূরে তবে অনিকের বরাবর বসল। লীরা খেতে বসলেন না। শুধু অনিককে এটা সেটা বেড়ে দিলেন।

যেখানে হয়তো ঝাটার বারি খেয়ে বিদায় হওয়ার কথা ছিল সেখানে টিচার হিসেবে বাড়তি সম্মান অনিকের মন্দ লাগল না। বরং বেশ ভালোই লাগল। অনিক চলে যাওয়ার সময় নোরা বাবাকে বলল,” বাবা, আমি স্যারকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দেই?”

আনিস বললেন,” আচ্ছা যাও, চাবি নিয়ে যেও।”

নোরাদের মেইন গেইট চব্বিশঘণ্টা তালা দেওয়া থাকে। তাই আনিস নোরাকে নিঃসন্দেহে যেতে দিলেন। নোরা না গেলে উনি নিজেই যেতেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একটা খালি জায়গা বুঝে অনিক- নোরাকে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে জড়িয়ে ধরল। তারপর সারামুখে অনেকগুলো চুমু দিতে লাগল।

নোরা ভয়ে শিটিয়ে বলল,” কি করছেন, ছাড়ুন তো।”

অনিক ছাড়ল না। আরো শক্ত করে ধরে বলল,” আগে বলো সারারাত ফোন ধরছিলে না কেন?”

নোরা একটু অপ্রস্তুতবোধ করল। খুব মনখারাপ লাগায় ফোন সাইলেন্ট রেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছিল সে। কালরাতের ঘটনাটা কি অনিককে বলবে? ছেলের কাছে মায়ের বদনাম করাটা কি ঠিক হবে? নোরা আমতা আমতা করে বলল,”ফোনে চার্জ ছিলনা। দূরে চার্জে দিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম তাই হয়তো টের পাইনি।”

” তো সেটা আমাকে জানাবে না? আমি সারারাত কত টেনশনে ছিলাম কোনো ধারণা আছে তোমার? রাতে যখন গোসল সেরে এসে দেখলাম তোমার এতোগুলো মিসডকল অথচ ফোন ধরছো না, টেনশনে মাথার মগজ লাফাচ্ছিল আমার। ওই অবস্থাতেই বাসা থেকে বের হয়ে এখানে চলে এসেছি। সারারাত এভাবেই বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ট্রাউজার আর টি-শার্ট পড়ে তোমার বাবার সাথে দেখা করেছি। উনি নিশ্চয়ই ভাবছেন স্যারের মাথায় সমস্যা আছে।”

” সমস্যা তো আছেই। আপনি আসলেই একটা পাগল। এমন কেউ করে? সারারাত বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকার কি দরকার ছিল? ঘুমাননি নিশ্চয়ই? ”

” ঘুম আসতো না নোরা। কিভাবে ঘুমাতাম?”

” সরি, আপনাকে এতো কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

নোরা মাথা নিচু করে ফেলল। তার চোখ টলমল হয়ে এসেছে। অনিক ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,” আরে পাগলী, এতে কাঁদার কি হলো? রাত জাগার অভ্যাস আছে আমার। একরাত না ঘুমালে তেমন কিচ্ছু হয়না। তাছাড়া আমি না আসলে কি তোমাদের সাথে ব্রেকফাস্টের সুযোগটা পেতাম বলো? একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। হবু শ্বশুরমশাই আর শ্বাশুরিমায়ের সাথে পরিচয়টা হয়ে গেল।”

নোরা হাসল। অনিক বলল,” শুধু হাসলে হবেনা। এখন একটা জিনিস চাই। সারারাত আমাকে টেনশনে রাখার পানিশমেন্ট।”

অনিক কি চাইছে সেটা বুঝতে পেরে নোরা শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে বলল,” প্লিজ এখানে না। কেউ চলে আসবে।”

” আসুক। পায়ের আওয়াজ পেলেই ছেড়ে দিব, প্রমিস।”

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১০

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১০
লিখা- Sidratul Muntaz

সঙ্গত কারণেই সেজুতির মেজাজ ভীষণ খারাপ। নোরা, অন্তরা দু’জনই সেলফিশ। এই দুই কাপলের নিষ্পেষণে নিজেকে লাগছে কাবাব মে হাড্ডি কিংবা বিরিয়ানির এলাচি। অন্তরা আর আলভী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। পেছনে সেজুতি নিজের ব্যাগ আর অন্তরার ব্যাগ দু’টোই কাঁধে নিয়ে হাটছে। আর নোরা একটা কোথায় হাওয়া হয়েছে তার তো কোনো খোঁজই নেই।

অন্তরা হঠাৎ পেছন ফিরে বলল,” নোরার আর কোনো খোঁজ পেলি?”

সেজুতি বলল,” একটু আগে ফোন দিয়েছিলাম, ধরেনি।”

” ধরবে কিভাবে? ও তো এখন ভীষণ ব্যস্ত। সেলফিশ একটা। বয়ফ্রেন্ড পেয়ে আমাদের ভুলেই গেছে।”

সেজুতি মনে মনে বলল,” আর তুই নিজে কি?”

আলভী এই জায়গাটা বেশ ভালো করে চেনে। তারা মেইনরাস্তা দিয়ে না এগিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছিল। অন্তরা বলল,” আমাদের আগে নোরাকে খুঁজতে হবে। সে অনিক স্যারের সাথে আছে।”

অন্তরার কথায় অবাক হলো আলভী,” অনিক স্যার?”

” হ্যাঁ। আমাদের কোচিং-এর স্যার। তুমি চেনো নিশ্চয়ই।”

” হু। এখান থেকে মিরসরাই বেশ দূরে। তার চেয়ে চন্দ্রনাথ মন্দির কাছে। আগে ওখানে যাই। অনিক ভাইয়ের সাথে হলে নোরাও নিশ্চয়ই ওখানেই গেছে।”

” তুমি মনে হয় জায়গাটা খুব ভালো করে চেনো? আগে কখনও এখানে এসেছিলে নাকি?”

আলভী বাঁকা হেসে বলল,” আসিনি। তবে যথেষ্ট রিসার্চ করেছি এই জায়গা নিয়ে।”

” রিসার্চ করেছো? কেন?”

” একজনকে প্রতিযোগিতায় হারানোর জন্য।”

” সেই একজনটা কে? অনিক স্যার?”

আলভী অবাক হয়ে তাকাল,” তুমি বুঝলে কিভাবে?”

অন্তরা হেসে বলল,” তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি আলভী।”

আলভী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে জানতে চাইল,” নোরা আর অনিক ভাইয়ের মধ্যে কিছু চলছে নাকি? তুমি আবার ওকে বলে দিও না।”

” বলবো না। কিন্তু তুমি উনাকে প্রতিযোগিতায় হা’রাতে চাইলে কেন?”

” সে অনেক কাহিনী। কাজটা করতে গিয়েই দুর্ঘটনাবশত খাদে পড়ে গেছিলাম। তোমরা না এলে হয়তো এখনও ওখানেই আটকে থাকতে হতো। যাহোক, বাদ দাও। নোরার কথা বলছিলাম। কি চলছে অনিক ভাইয়ের সাথে ওর?”

” আরে, নোরা তো মূলত উনার জন্যই…”

সেজুতি থামাল অন্তরাকে। চোখ পাকিয়ে বলল,” থাম অন্তু, নোরার পারসোনাল ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা কি খুব জরুরী?”

অন্তরা থেমে গেল। প্রসঙ্গ কা’টাতে বলল,” ঠিকাছে বাদ দাও। ওসব তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি শুধু বলো চন্দ্রনাথ মন্দির আমরা কিভাবে যাবো?”

আলভী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নোরার ব্যাপারটা তাকে বুঝতেই হবে। কি চলছে ওদের মধ্যে সেটা না জানা অবধি শান্তি নেই। হঠাৎ তিনজনই শুনতে পায় ঝামেলার শব্দ। আলভী পিছিয়ে এসে বলল,” ওদিকে যাওয়া যাবে না। ফিরে চলো।”

অনিক নোরাকে নিয়ে ছুটে আসছিল। পুলিশ তখনও তাদের ধাওয়া করছে। এরা নাকি জনগণের বন্ধু। অথচ একা কাপল দেখে সুযোগ নিতে ছাড়েনি।নোরার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে অনিক। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে সে। নোরা পুরোপুরি একটা ঘোরের মধ্যে আছে। হঠাৎ তাদের পায়ের শব্দ শুনে সেজুতি বলল,” কেউ মনে হয় এদিকে আসছে ”

আলভী বলল,” আমরা ওদিকে যাবো না। জায়গাটা ভীষণ বিপজ্জনক। যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। চলো আমরা পালাই।”

সেজুতি বলল,” কেউ মনে হয় বিপদে পড়েছে। আমাদের কি উচিৎ না তাদের হেল্প করা?”

আলভী বলল,” আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হল নিজেদের হেল্প করা। মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে তো নিজের বিপদ ডেকে আনা যায়না।”

দৌড়াতে নিয়ে নোরা পা পিছলে পড়ে গেল। তারপর হঠাৎই ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। অনিক নিচু হয়ে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,” কিচ্ছু হয়নি নোরা৷ আমি আছি তো!”

সেজুতি অন্তরাকে বলল,” দোস্ত, আমি কারো কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি।”

অন্তরা বিরক্ত হয়ে বলল,” কি আবোল-তাবোল বলছিস?”

“দোস্ত সত্যি। কেউ একজন কাঁদছে। মনে হয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ”

সেজুতি কথাটা বলেই সেদিকে পা বাড়াল। আলভী ধমকে উঠল,” সেজুতি তুমি কি আমাদের ফাঁসাবে নাকি? প্লিজ স্টপ।”

অন্তরা হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল,” ওইটা নোরা না? নোরা!”

অনিক-নোরা থেমে দাঁড়াল। সেজুতি আর অন্তরা দৌড়ে গিয়ে নোরাকে জড়িয়ে ধরল। আলভী অনিককে দেখে অবাক হয়ে বলল,” ভাই, তুমি এখানে?”

অনিক বলল,” তুই এখানে কি করছিস?”

” রাস্তা হারায় ফেলছিলাম ভাই। তোমাদের কি হইছে?”

অনিক বলল,” বলিস না, আমিও রাস্তা হারায় ফেলছি। পুলিশরা আমাদের একা পেয়ে পেছনে লেগেছে।”

আলভী বলল,” পেছনে লাগল কেন?”

অনিক বলল,” অনেক ঘটনা। এখন বলার সময় নেই। আচ্ছা তোর ফোনে নেটওয়ার্ক আছে? চন্দ্রনাথ ফোন লাগা দ্রুত। সাব্বির ভাইকে ফোন দে। জানা আমরা কই আছি।”

” অনেকক্ষণ আগেই ফোন লাগাইছি ভাই।”

” ওরা আসছে?”

” শান্তভাই বাইক নিয়া আসতেছে।”

“থ্যাংক গড। তাহলে অপেক্ষা করি। ”

“কিন্তু ভাই ততক্ষণে ধরা পড়লে?”

” ধরা পড়লেও বিপদ নেই। আমরা এখানে পাঁচজন আছি। সাহস হবে না কারো কিছু করার।”

ওরা ধরা পড়ার আগেই শান্ত আর সাব্বির বাইক নিয়ে পৌঁছে গেল। পুলিশরা এতোজেন ছেলে মানুষ একসঙ্গে দেখে আর কিছু বললনা। বাইক নিয়ে চন্দ্রনাথ পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল।

অনিক বলল,” নেহাৎ সাথে তিনজন মেয়ে আছে আর বিপদে পড়েছি। নাহলে ওদের দেখে নিতাম।”

আলভী বলল,” বাদ দাও ভাই। বিপদ কেটে গেছে। এটাই শান্তি।”

“তবুও ওরা চরম অন্যায় করেছে। মানুষের বিপদের সুযোগ নেওয়া খুব নিকৃষ্ট কাজ।”

বাইকে ওঠার সময় আরেকটা সমস্যা তৈরী হলো। দুই বাইকে ছয়জন ওঠা যায়। কিন্তু সাতজন কিভাবে? শান্ত আর সাব্বির এক বাইকে বসেছে। ওদের পেছনে আলভী উঠে গেল।

অনিক বাধ্য হয়ে অন্তরা, সেজুতি আর নোরাকে নিয়ে অন্য বাইকে উঠল। যেহেতু তিনজন মেয়েই খুব রোগা- পাতলা তাই তেমন একটা অসুবিধা হলো না। অনিক বাইকে ওঠার পর সেজুতি আর অন্তরা পেছনে বসল৷ পেছনে আর জায়গা ছিলনা তাই অনিক সাইকেলের মতো করে নোরাকে সামনে বসাল।নোরা এতোটা সময় কোনো কথা বলেনি। সে নিজস্ব চিন্তাজগতে বুদ হয়ে আছে।

অন্তরা বলল,” আমরা কি এখন মিরসরাই যাচ্ছি?”

অনিক বলল,” না, ওতোদূর বাইক নিয়ে যাওয়াটা রিস্কি। আপাতত চন্দ্রনাথ যাবো।”

বাইক চালিয়ে ওরা যখন চন্দ্রনাথ পৌঁছে গেল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খোলা মাঠের চারপাশে তাবু টানানো হয়েছে। মাঝখানে ক্যাম্পফায়ার করা হয়েছে। অন্তরা বাইক থেকে নেমেই বলল,” ওয়াও কি সুন্দর! ”

অনিকদের টিমের আরো অনেক সদস্য সেখানে ছিল। কিন্তু সবাই ছেলে। শুধু নোরারা তিনজনই মেয়ে। তাদের একটা আলাদা তাবুতে বসতে দেওয়া হলো। সেজুতি আর অন্তরা ক্ষুধার্ত ছিল তাই ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নোরা তাবুতে ঢুকেই অন্তরাকে জিজ্ঞেস করল,” অন্তু, তোর আর আলভীর মধ্যে কি সব ঠিক হয়ে গেছে?”

সেজুতি বলল,” তা আর বলতে? দেখছিস না দুইজন কেমন কাঁঠালের আঠার মতো চিপকে ছিল।”

সেজুতি একথা বলে হাসতে লাগল। নোরা হাসল না। তার মুখ উদাসীন। অন্তরা লজ্জা পেয়ে বলল, ” ধ্যাত! আমরা কিছুই করিনি। শুধু গল্প করেছি।”

সেজুতি বলল,” আমি কিছু করার কথা কখন বললাম? নোরা দেখেছিস, চোরের মন পুলিশ পুলিশ।”

অন্তরা এবার সেজুতিকে কিল মারতে শুরু করল। নোরা বলল, ” আচ্ছা তোরা খালামণিকে কিছু জানিয়েছিস?”

সেজুতি বলল,” কি জানাতাম বল? তুই অনিকস্যারকে নিয়ে বিজি,অন্তরা আলভিকে নিয়ে বিজি আর আমি সিঙ্গেল মানুষ মশা তারাই এটা বলতাম?”

সেজুতির কথা শুনে অন্তরা হেসে উঠল। নোরা তখনও নিশ্চুপ। অন্তরা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,” কি হয়েছে তোর? এমন ভূতের মতো মুখ গোমরা বানিয়ে রেখেছিস কেন? অনিক স্যার কি কিছু বলেছে তোকে? বকা দিয়েছে?”

সাথে সাথেই নোরার মস্তিষ্কে বেজে উঠল সেই কণ্ঠস্বর,” নোরা আই লভ ইউ। অনেক আগে থেকে। প্রায় চারবছর আগে থেকে…”

সারা গা কাটা দিয়ে উঠল নোরার। চারবছর আগে থেকে কিভাবে সম্ভব? সে তো তখন অনিক স্যারকে চিনতোই না। সেজুতি নোরার মুখের কাছে চুটকি বাজিয়ে বলল,” এই নোরা, প্রবলেমটা কি বলতো?”

অন্তরা হঠাৎ বলল,” উফ, তোদের তো একটা কথা বলাই হয়নি। জানিস আলভী কি করেছে? অনিক স্যার যে দল থেকে আলাদা হয়ে গেল আর এতো এতো বিপদে পড়ল সেসব কিছু আলভীর জন্যই হয়েছে। ও অনিকস্যারকে দিকভ্রষ্ট করে প্রতিযোগিতায় জিততে চেয়েছিল। তুই আবার কথাটা অনিক স্যারকে বলে দিস না নোরা। তোকে এই ব্যাপারে না জানালে আমার হাসফাস লাগছিল। তাই জানালাম। বুঝেছিস? ”

অনিক নোরার খোঁজ নিতে মাত্র তাবুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখনই অন্তরার কথাগুলো তার কানে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে সে ওই মুহূর্তে ছুটে যায় আলভীর তাবুতে। ওকে কলার ধরে হিরহির করে টেনে তাবু থেকে বের করে মাঠে নিয়ে আসে। তারপর কোনো কথা না বলে শুধু মা’রতে থাকে। আলভীর বিকট চিৎকার শুনে সবাই তাবু থেকে বের হয়ে এসেছে ততক্ষণে।

নোরা,অন্তরা, সেজুতি অবাক বিস্ময়ে দেখছে, অনিক শুধু আলভীকে মে’রেই যাচ্ছে। আলভীর নাক-মুখ ফেটে র’ক্ত বের হচ্ছে। অন্তরা এসব দেখে কেঁদেই ফেলল। সবাই অনিককে কারণ জিজ্ঞেস করছে, কেন অনিক আলভীকে এভাবে মা’রছে সে। আলভী হয়তো কারণটা আপনা-আপনিই বুঝে গেছিল। তাই অনিকের পা ধরে মাফ চাইতে লাগল।

অনিক আলভীর কলার ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে বলল,” তোকে আমি ছোটভাই ভাবতাম৷ আর তুই আমার সাথে এটা কি করলি? আমি নোরাকে নিয়ে কতবড় বিপদে পড়েছিলাম কোনো ধারণা আছে তোর? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তোর জন্য মেয়েটার কতবড় ক্ষতি হতে পারতো সেটা কল্পনাও করতে পারবি না তুই। মাত্র দশহাজার টাকার জন্য এতো নিচে নামলি? শালা তুই পি’শাচের থেকেও অধম।”

অনিক তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আলভীকে আঘাত করছে। তার অবস্থা খারাপের দিকে যেতেই সবাই এসে অনিককে থামাল। অনিকের এই রুপ দেখে নোরা বাকরুদ্ধ। তার হাত-পা রীতিমতো কাঁপছিল।

তিনটি মেয়ের ফোনই আউট অফ রিচ। লীনা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। মেয়েগুলোর কিছু হলে দায়ভার কে নেবে? আগে জানলে সে নোরাদের বের হতেই দিতো না। লিনার স্বামী অফিসের কাজে শহরে গেছে। সন্ধ্যার দিকে আকাশের কাছে ফোন আসে অনিকের নাম্বার থেকে।

নোরা তাবুতে বসে আছে চুপচাপ। তার পাশে সেজুতি। অন্তরা আলভীর তাবুতে গেছিল। সে হঠাৎ ছুটে এসে বলল,” নোরা, বাইরে আকাশ ভাই। আমাদের নিতে এসেছে।”

আকাশের নাম শুনে নোরা চ’মকে উঠল। সেজুতি বলল,” উনি কিভাবে জানে যে আমরা চন্দ্রনাথ মন্দির এসেছি? তুই বলেছিস?”

অন্তরা দুই পাশে মাথা নাড়ল,” আমি কিছু বলিনি। নোরা জানিয়েছে হয়তো।”

” আমার ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। আমি কিভাবে ফোন করব?”

নোরার উত্তর শুনে সেজুতি আর অন্তরা বিস্মিত হয়ে চোখাচোখি করল। সেজুতি বলল,” তাহলে কে জানাল উনাকে? চলতো বাইরে গিয়ে দেখি।”

তিনজন বেরিয়ে দেখল আকাশ আর অনিক কোলাকুলি করছে। সবাইকে সুরক্ষিত দেখে আকাশের চেহারায় স্বস্তির হাসি। অথচ নোরার চোখে-মুখে বিস্ময়। তাদের মধ্যে যে পূর্ব পরিচয় আছে সেই কথা নোরা জানতো না!

আকাশ বলল,” অনিক ভাই সময় মতো ফোন করেছিল বলে তোদের খুঁজে পেলাম৷ লীনা আন্টি খুব দুশ্চিন্তা করছে। বাড়ি চল নোরা।”

নোরা বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল,” তুমি উনাকে চেনো?”

আকাশ ইতস্তত দৃষ্টিতে অনিকের দিকে চাইল। অনিক ইশারা দিতেই সে বলল,” আমার ইউনিভার্সিটির সিনিয়র অনিক ভাই। গত পাঁচবছর ধরে চিনি। ”

নোরা তাকাল অনিকের দিকে, বিস্মিত চোখজোড়ায় প্রশ্ন ঘুরছে হাজারও। একটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। মেইন রাস্তার কাছাকাছি অনিক দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ তার সাথে করমর্দন করে গাড়িতে উঠল। সেজুতি আর অন্তরাও উঠল৷ নোরা উঠতে নিয়েও থামল। ভেতরে তাকিয়ে বলল,” অপেক্ষা কর, আমি একটু আসছি।”

অন্তরার মনখারাপ। শেষবার একটু আলভীর সাথে দেখা করা গেল না। আলভী কি তার উপর রেগে আছে? নোরা ধীরপায়ে অনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনিক প্রশ্ন করল,” কিছু বলবে?”

” আপনি তখন… ওইসময় কি বলেছিলেন?”

অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল নোরা। অনিক না বোঝার ভাণ করল,” কখন?”

” আপনি ভালো করেই জানেন আমি কখনের কথা বলছি।”

“আমার মনে পড়ছে না।”

নোরা চোখ তুলে তাকাল। অনিকের দৃষ্টিতে এলোমেলো ভাব। নোরার অস্থির লাগছে। কাতর গলায় উচ্চারণ করল,” মিথ্যা বলছেন আপনি৷ আপনার সব মনে আছে, আমি জানি।”

অনিক নিজেকে সামলালো। শান্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলল,” নোরা, বাড়ি যাও৷ আকাশ বলছিল তোমার খালামণি খুব টেনশন করছে তোমাদের নিয়ে।”

” কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেন না। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

” জেদ করো না নোরা। যাও এখন।”

ধ’মকে উঠল অনিক। নোরা ভ*য় পেল না একটুও। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি যাব না। যতক্ষণ আপনি সত্যিটা না বলবেন, আমি কোথাও যাবো না।”

তারপর কয়েক কদম এগিয়ে এসে আবার বলল,”আপনি আমাকে চারবছর ধরে কিভাবে চেনেন? কোথায় দেখেছিলেন?”

পেছন থেকে আকাশ ডাকল,” নোরা, দ্রুত আয়। লীনা আন্টি ফোন দিচ্ছে। ”

নোরা তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে। উত্তরের অপেক্ষায় সে। অনিক বলল,” সাবধানে যেও।”

নোরা আর কিছু বলতে পারল না। আকাশ আবার তাড়া দিতেই তাকে গাড়িতে উঠে বসতে হলো। পরদিন নোরাদের ঢাকায় চলে যেতে হলো। সবকিছু চলতে লাগল আগের নিয়মে। শুধু নোরা থেমে গেল। সেই একই জায়গায়, একই মায়ায়, একই বাক্যতে।

কোরবানির ঈদ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু কোচিং-এর ছুটি শেষ হতে এখনও এক সপ্তাহ বাকি৷ নোরা সারাদিন বাসায় থাকে। অনিকের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। ফেসবুক থেকে ব্লক তখনও খোলেনি সে। নোরার হাসফাস লাগে সবসময়। একদিন সে একটা পাগলামি করে বসল। এমনি বিকালে স্কুটি নিয়ে বের হয়েছিল অন্তরাদের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যাওয়া হলো না। ফার্মগেট পেরিয়ে সে চলে গেল পান্থপথ, অনিকদের বাসার সামনে। বিল্ডিং এর কাছে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে শ্বাস ফেলল নোরা। অনিক স্যারের বারান্দা দেখা যাচ্ছে। জবা ফুলের গাছ ঝুলে আছে জানালার গ্রিলে। তিনটি রঙিন জবাফুল কি সুন্দর দুলছে জানালার গ্রিলে!

নোরা চোখের পলক ফেলল না৷ একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকার পর হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে চলে যাওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু বিবেকের কথা মন শুনল না। নোরা নিজের অজান্তেই ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। লিফটের থার্ড ফ্লোরে ক্লিক করে সরাসরি দরজায় গিয়ে বেল বাজাল। দরজা খুলল আনিকা। তখন বিকাল সাড়ে চারটা বাজে।

নোরাকে মাথায় হেলমেট পরা অবস্থায় দাঁড়ানো দেখে আনিকা একটু চ’মকাল। পরমুহূর্তেই হেসে বলল,” নোরা, তুমি এখানে? এসো ভেতরে এসো।”

নোরার খুব লজ্জা করছে। ইতস্তত মুখে সে জানতে চাইল,” আপু, অনিক স্যার কি বাড়িতে আছে?”

” না। ভাই তো নেই। তুমি বসো। ও চলে আসবে।”

” না থাক, আমি বরং চলেই যাই।”

নোরা বাইরে পা বাড়াতে নিলেই আনিকা ওর হাত চেপে ধরল। রাগী কণ্ঠে বলল,” দরজার সামনে থেকে ফিরে যাবে নাকি? অসম্ভব! ভেতরে এসো। আমি পায়েস রান্না করছি। খেয়ে যেতে হবে।”

জোর করে নোরাকে ভেতরে এনে বসালো আনিকা। নোরার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তার কি এখানে আসা ঠিক হয়েছে? অনিক স্যার তাকে দেখলে রেগে যাবে না তো? একা ড্রয়িংরুমে বসে অনেক কিছুই ভাবছিল নোরা।

অনিকের রুমটা সামনেই। আনিকা রান্নাঘরে ছিল। নোরা দেখল আশেপাশে কেউ নেই। সে ধীরপায়ে অনিকের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পরিচিত সুগন্ধে ভরে আছে ঘরটা। ছিমছাম, গোছালো,পড়ার টেবিলটা খুব শৌখিন ভাবে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে বড় করে একটা ঘড়ির পেইন্টিং আঁকা। বেডসাইডে আচ্ছন্ন হওয়ার মতো সুন্দর প্রকৃতির ছবি। নোরা সবকিছু খুঁটিয়ে দেখছিল। আর নাম না জানা এক মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা কালো রঙের ডায়েরীতে নজর পড়ল তার। কৌতুহলী হয়েই ডায়েরীটা হাতে তুলে নেয়। সাদা পৃষ্ঠা জুড়ে এলোমেলো অনেক কিছু লেখা। নোরা যে-কোনো একটা পেইজ থেকে পড়তে শুরু করল,

মা যে আমাকে এভাবে অবিশ্বাস করবে ভাবিনি কখনও। আজকের দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি। কিছু কিছু কষ্ট মনে খুব গাঢ়ভাবে দাগ কাটে। সেই দাগ হাজার চেষ্টা করলেও মুছে ফেলা যায়না। আমার আজকের কষ্টটাও তেমনি।

আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার পর ওয়াশরুমে ঢুকেছিলাম ফ্রেশ হতে। খালি গায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম তিথি আমার বিছানায় শুয়ে আছে। অস্বস্তি লাগতে শুরু হল আমার। এর আগে কখনও কোনো মেয়ের সামনে অর্ধোলঙ্গ অবস্থায় উপস্থিত হতে হয়নি। প্রথমেই ধমক দিলাম৷ কিন্তু আমার রাগকে বিস্ময়ে পরিণত করে তিথি হঠাৎই আমার ঠোঁট আকড়ে ধরল নিজের ঠোঁট দিয়ে।

আমি এতোটাই অবাক হলাম যে রিয়েক্ট করতেও ভুলে গেলাম। মেয়েটাকে আমি কোনোকালেই পছন্দ করতাম না। কিন্তু অসম্মান করিনি কখনও। ছোটবোনের চোখে দেখতাম ওকে। কিন্তু সে আমার সাথে এটা কি করল? আমি ক্রোধে ফেটে পড়ছিলাম। সেই ক্রোধ দমন করতে না পেরে অচিরেই তিথির গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।

তিথি কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বের হল। বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন মা। আমার হাতের পাঁচটি আঙুলের ছাপ তিথির ফরসা গালে খুব সুন্দরভানে বিছিয়ে ছিল। মা এটুকু বুঝলেন আমি তিথির গায়ে হাত তুলেছি। সেই কৈফিয়তও চাইলেন। তবে আমার কাছে না। তিথির কাছে। অবাক তো তখনি হলাম। কষ্টও পেলাম ভীষণ।

নিজের ছেলের থেকে একটা বাহিরের মেয়ের প্রতি মায়ের অগাধ বিশ্বাস আমার বুকের ভিতরটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল। তিথি আমার সামনে দাঁড়িয়েই মাকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে গেল। আর মা সেটাই বিশ্বাস করলেন। অভিমানে আমার চোখ ফেটে কান্না আসছিল। তখন মায়ের সামনে আমি কাঁদতে পারিনি ঠিকই। তবে যতবার এই ঘটনা মনে পড়ছে, কান্নাটা আপনা-আপনিই চলে আসছে। মা তিথির সামনেই আমার গালে চড় বসিয়ে বললেন,”তিথির গালের চড়টা আমি তোকে ফিরিয়ে দিলাম। তোর মতো কুলাঙ্গার ছেলে আমার পেটে জন্মেছে! এই লজ্জা নিয়ে আমি বাচবো কিভাবে?ছি! ধিক তোকে।”

হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই বলেছো। আমি তোমার কুলাঙ্গার সন্তান। তাইতো এতোবছরেও তোমার বিশ্বাসটুকু অর্জন করতে পারলাম না। তোমার কোমল হৃদয়ে যত্ন করে রাখা বিশ্বাসের জায়গাটা দখল করে আছে বাহিরের একটা অপরিচিত মেয়ে। যার প্রাধান্য তোমার কাছে আমার থেকেও বেশি। তাইনা মা? আজ তুমি আমাকে একটু বিশ্বাস করতে পারলে না? কেন মা? আমি কি তোমার এতোই খারাপ ছেলে? এই আঘাত আমি কোনোদিন ভুলবো না মা। কোনোদিন না!

লেখাটা পড়ার পর নোরার মনে প্রশ্ন ঘুরছে। তিথি কে? অনিকের গার্লফ্রেন্ড? না সেটা সম্ভব না। তাহলে অনিক তার সম্পর্কে এভাবে লিখতো না। পৃষ্ঠা বদলাতেই নোরা আরেকটা অধ্যায় পেয়ে গেল। প্রথমেই খুব যত্ন করে লেখা ,” প্রিয়তোষ।” নোরার পড়তে ভয় লাগছে। অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে অনিকের প্রেমবাক্য সে মেনে নিতে পারবে না। তবুও সাহস করে পড়তে শুরু করল,

তাকে আমি দেখেছিলাম ১৬ই জানুয়ারি,২০২০। আজ থেকে প্রায় চারবছর আগে। কিছু কিছু অনুভূতি এমনও হয়, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেওয়ার মতো। সেদিনের পর থেকে গোটা চার বছর ধরেই জ্বলছি আমি। ওই রুপের আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাঁক হচ্ছি। বেশিরভাগ মানুষই হয়তো প্রেয়সীর দীঘল কালো চুলের মায়ায় আকৃষ্ট হয়। প্রেমে পড়ে কাজল কালোচোখের নজরকাঁড়া দৃষ্টিতে। কিন্তু আমার ব্যাপারটা অন্য। আমি প্রেমে পড়েছিলাম তার লালচে চুলের। মোটা মোটা কোকড়ানো লাল চুলগুলোর উথাল-পাথাল দৃশ্য আমার হৃদয় কাঁপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট।তার ফোলা ফোলা চোখের অবাক করা চাহনি আমার মনে অজস্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। সেদিন এক মুহুর্তের জন্য আমিসহ আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। আমি মাতাল হয়েছিলাম সেই অদ্ভুত মাদকময় সৌন্দর্য্যের নেশায়। জীবনে প্রথমবারের মতো ভালোবাসা নামক উপলব্ধিটার সাথে পরিচিত হয়ে নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমি শেষ। আমি আর আমিতে নেই। আমার হৃদয়জুড়ে তখন অচেনা এক নারীর রাজত্ব।

সেই অপরিচিতার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল হসপিটালের করিডোরে। দিনটি ছিল শুক্রবার। আমি কেবল তখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র। হাসান ভাইয়ের কেবিনে ঢোকার সময় একটা মেয়ে আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে হাতের ফাইলটা ফেলে দিল। ফাইল থেকে কাগজগুলো এলোমেলো হয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।বাচ্চা মেয়েটি সম্ভবত আগে থেকেই কাঁদছিল। ফাইলগুলো অগোছালোভাবে পড়ে যাওয়ায় তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। খুব অস্বস্তিকর অবস্থা।আমি তাড়াহুড়ায় ছিলাম। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই কাগজগুলো কুড়িয়ে নিতে লাগল। আর আমি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম।

কেবিন থেকে বের হওয়ার পরে দেখি সেই একই মেয়ে করিডোরের সামনে দাঁড়িয়ে কাচের দেয়ালে ভর দিয়ে আকাশ দেখছে। দমকা বাতাসে তার গলা পর্যন্ত ছোট ছোট লালচে চুলগুলো উড়ছে। মুখের মধ্যে কান্নার ছাপ তখনও স্পষ্ট। ছোট্ট চিকন নাকের উপর হালকা একটা কালো তিল। ঠিক নাকের গোড়া বরাবর। সেই তিলটাতেও আলাদা ঘোর। আমি যে তাকে নেশাগ্রস্তের মতো দেখছিলাম মেয়েটি হয়তো তা টেরও পায়নি। সে তখন পাতলা পাতলা গোলাপী ঠোঁটগুলো বারে বারে উল্টে আনমনে কাঁদায় ব্যস্ত। মায়াভরা মিষ্টি চেহারার মেয়েটির ওই কান্না আমার হৃদয়ে আলোড়ন তুলে দিল। কেন কাঁদছে সে? জানতে মরিয়া হয়ে উঠল মন।

ইচ্ছে করল এক নিমেষে তার সকল দুঃখ ঘুচিয়ে দিতে।তার গায়ে তখন সাদার উপর কালো ব্লকের সেলোয়ার কামিজ। ওই মুহুর্তে ওই রঙটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রং মনে হচ্ছিল আমার। আর সেই মেয়েটিকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী রমনী। ভালোবাসা জিনিসটাই কি এমন অদ্ভুত? সেই অদ্ভুত সৌন্দর্য্যের কাছে দুনিয়ার অন্যসব সৌন্দর্য্যই ফিকে মনে হয়। লভ এট ফার্স্ট সাইটে আমি কোনোকালেই বিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু সেই লভ এট ফার্স্ট সাইটই যে আমাকে এমনভাবে ফাঁসিয়ে দিবে কে জানতো?

মেয়েটির কান্নারত মায়াবী চেহারা আমার মনে যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা ভোলার মতো না। কবে যে মেয়েটিকে পাওয়ার আশায় পাগলামি শুরু করতে লাগলাম নিজেও টের পাইনি। ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলাম,মায়াভরা মিষ্টিমুখের এক মিষ্টিপরীকে দেখে। মনে হচ্ছিল কাঁদার জন্যই তার জন্ম হয়েছে। সে কাঁদুক, আর আমি দু’চোখ ভরে দেখি সেই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য।

একদিন জানতে পারলাম আমার ভার্সিটির জুনিয়র আকাশের কাজিন হচ্ছে আমার সেই মিষ্টিপরী। আকাশ বরাবরই আমার ভক্ত ছিল। তাই তেমন কোনো অসুবিধা পোহাতে হয়নি। সেদিন থেকেই শুরু করলাম ওর কাছ থেকে মিষ্টিপরীর সব আপডেট নেওয়া। তখন মাত্র ক্লাস নাইনে পড়তো আমার মিষ্টিপরী। ওই অবস্থায় ওর বাচ্চা মস্তিষ্কে প্রেম নামক ভারী শব্দটা ঢুকিয়ে তার নরম মনে আঘাত করতে চাইনি। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাচ্চা মেয়েটির বড় হয়ে উঠার অপেক্ষা।

পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম মিষ্টিপরীর হসপিটালে কান্নার রহস্য। সেদিন হসপিটালে মিষ্টিপরীর মা এডমিট ছিল। দিনের পর দিন অনুভূতি গাঢ় হচ্ছিল আমার মিষ্টিপরীর জন্য। ইচ্ছে করতো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে। তারপর একদিন জানতে পারলাম মিষ্টিপরী সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারেনা। সাথে সিগারেটখোরদেরও না। অথচ আমার তখন সিগারেটের প্রতি ডেঞ্জারাস অ্যাডিকশন। তবুও ছেড়ে দিলাম।

মিষ্টিপরীর উপর আমার নজরদারি ছিল। কোথায় যায়, কি করে সবসময় ফলো করতাম। এক কথায় ওর পেছনে ঘুরেই আমার দিনের অর্ধেক কেটে যেতো। আর বাকি অর্ধেক সময় কাটতো ওর কথা ভেবে। আস্তে আস্তে সময় গড়াতে লাগল। মিষ্টিপরী ততদিনে এসএসসি পাশ করে ফেলেছে। তখনি ভেবেছিলাম ওর সামনে যাবো। ওকে মনের কথা জানাবো। ওর কাছে ধরা দিবো। কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলাম ওর একটা রিলেশন চলছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার অপেক্ষা শুরু করলাম।

মনের মধ্যে কোথায় জানি একটা আশার প্রদীপ জ্বলছিল। সেই আশায় দিন গুণছিলাম। মিষ্টিপরী এইচএসসি পাশ করল। এডমিশন কোচিং এর জন্য আদনান ভাইয়ের ভর্তি হবে এটা জানতাম। তাই আমিও এপ্লাই করে রাখি। আর চাকরিটাও হয়ে গেল। কোচিং-এ ম্যাথ টিচার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে মিষ্টিপরীর সামনে আমি প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম তখন আগস্ট মাসের দুই তারিখ। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল ও। বেখেয়ালিভাবে ওর ব্যাগ থেকে ওয়ালেট পড়ে গেল। সেই ওয়ালেট তুলে দেওয়ার বাহানাতেই ওর সাথে কথা বলা। কিন্তু সত্যিটা তখনও জানাতে পারিনি ওকে। কারণ তখন আমি ওর কোচিং এর স্যার আর ও আমার ছাত্রী।

স্যার হয়ে ছাত্রীর সাথে প্রেম, বিষয়টা ভালো দেখায়না। ভেবে রেখেছিলাম ও ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার পরই প্রপোজটা করবো। ইদানীং মনে হচ্ছে মিষ্টিপরীও আমার প্রতি দুর্বল। কিন্তু ওর এই দুর্বলতাটা হয়তো শুধুই ভালোলাগা কিংবা সাময়িক মোহ। তাই প্রশ্রয় দিচ্ছিনা। ওকে ইচ্ছে করেই ধমকের উপর রাখি। ওর ভয় পাওয়া নিষ্পাপ মুখটা দেখতে দারুন লাগে।ওদের ব্যাচের সাথে আমার ক্লাস সপ্তাহে মাত্র একদিন হয়। তাই প্রতিদিন ওদের ক্লাসে ইচ্ছে করেই আমার লাঠি রেখে দিতাম। যেন লাঠি নিতে যাওয়ার বাহানায় ওকে এক নজর দেখতে পারি।

আমার জন্মদিনে খুব সুন্দর করে সেজে এসেছিল মেয়েটা। টকটকে লাল গোলাপের মতো লাগছিল দেখতে। ওর ওই রুপ দেখে নিজের চোখ সামলাতে খুব হিমশিম খাচ্ছিলাম। বারবার নজর ওর দিকেই আটকে যাচ্ছিল।আর সেটা খুব সাবধানে সরিয়েও নিচ্ছিলাম। তবে জন্মদিনে নোরার দেওয়া উপহারটা দেখে খুব বিস্মিত হলাম আমি। যার জন্য চারবছর আগে সিগারেটের নেশা ছাড়লাম সে-ই জন্মদিনে সিগারেট উপহার দিচ্ছে!

কি করবো বুঝতে না পেরে হালকা মিসবিহেভ করে ফেললাম। মিষ্টিপরী কাঁদতে কাঁদতে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। মায়া লাগল আমার। তার চোখের অশ্রু আমার বুকে আঁচড় তুলে দিল।আমারও যে ভেতরটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। তাই থাকতে না পেরে চলে গেলাম ওর কাছে। ক্ষমা চাইলাম। আমার মুখে সরি শুনে পাগলিটার সে কি খুশি! আস্তে আস্তে আমিও ওর পাগলামিতে রেসপন্স করা শুরু করলাম। কিন্তু নিয়তির হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি।

হঠাৎ আদনান ভাই আমাদের সন্দেহ করতে শুরু করলেন। নোরাকে একদিকে যেমন লেখাপড়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল আমাকেও চাকরি নিয়ে থ্রেট দেওয়া হচ্ছিল। এই চাকরিটা আমার প্রয়োজন। নোরার সাথে প্রতিদিন দেখার করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এই চাকরি। তাই চাকরি ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

আদনান ভাই বললেন নোরাকে ফেসবুকে ব্লক করে রাখতে। চাকরি টেকানোর জন্য আমাকে মেনে নিতেই হলো। এই কয়েকমাস হয়তো একটু কষ্ট হবে। অপেক্ষায় আছি নোরার ভার্সিটির এডমিশন টেস্টের। তারপর ওকে সব জানাতে আর কোনো বাধা থাকবে না। জানিনা কবে এই অপেক্ষার অবসান হবে। কবে আমি আমার মিষ্টিপরীকে বোঝাতে পারব, আমি ওকে কতটা ভালোবাসি।”

লেখাগুলো পড়তে পড়তে নোরার চোখ দিয়ে যে কয়হাজার ফোঁটা পানি বেরিয়েছে তার হিসেব নেই। কাঁদতে কাঁদতে প্রায় হিচকি উঠে যাওয়ার উপক্রম। সে কি সত্যিই এতোটা সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে? নাকি পুরোটাই স্বপ্ন। যদি স্বপ্নই হয়, তাহলে সেই স্বপ্ন থেকে নোরা কোনোদিন জাগতে চায়না।

খট করে দরজায় শব্দ হলো। অনিক ভেতরে প্রবেশ করেছে। ভ্রু কুঁচকে সে দেখছে নোরাকে আর নোরার হাতের ডায়েরীটাকে। আবেগে তখন কাঁপছিল নোরা। ডায়েরীটা টেবিলে রেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল অনিকের গলা।

অনিক স্তব্ধীভূত৷ বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম দামামা বাজছে।অনুভূতি লুকানোর চেষ্টা করেও আর লাভ নেই। সে ধরা পড়ে গেছে! নোরার সমস্ত শরীরে তখন বাঁধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ছে। সে খুশির সাগরে ভাসতে ভাসতে কান্না মাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” আপনি আমাকে চারবছর ধরে ভালোবাসেন?”

অনিক ঠান্ডা গলায় বলল,” হ্যাঁ। কিন্তু তখন জানতাম না তুমি যে এতো অবুঝ আর পাগলী।”

” জানলে কি করতেন?”

অনিক নোরার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” আরো বেশি করে ভালোবাসতাম।”

নোরা চোখে পানি নিয়েই হাসতে লাগল। উল্লাসী হাসি। বেঁচে থাকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তার আর কিচ্ছু চাইনা।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০৯

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ৯
লিখা Sidratul Muntaz

অনেক সময় কেটে গেছে। অন্তরা আর সেজুতি অপেক্ষা করতে করতে অস্থির। নোরার এখনও ফেরার নাম নেই। সেজুতি ব্যাগ থেকে ফলের বক্স বের করে ফল খাচ্ছে। অন্তরাকেও সেধেছিল, সে খায়নি। সেজুতি একাই খেতে খেতে বলল,”দোস্ত, অনেক রেস্ট হয়েছে। এবার চল উঠি।”

” উঠি মানে? নোরা আসবে না?”

” তুই কি নোরার জন্য অপেক্ষা করছিস?”

“তো করবো না? ওকে না নিয়েই চলে যাবো নাকি?”

সেজুতি উপহাসের সুরে হেসে বলল,” সখী, তুমি বোকার স্বর্গে বাস করিতেছো।”

“মানে?”

“মানে ও আর এখানে ভুলেও আসবে না।”

” কেন আসবে না?”

” আরে অনিকস্যারকে পেয়ে গেছে না? আমাদের কথা এখন মনে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। চল দেরি না করে আমরা বাসায় চলে যাই। ওর যখন সময় হবে ও চলে আসবে।”

” কিন্তু এভাবে ওকে একা রেখে আমরা চলে যাবো?”

” নোরা একা না। ওর সাথে অনিকস্যার আছে। একা হলাম আমরা। আমাদের সাথে কেউ নেই।”

” তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।”

” নে এবার ওঠ। দেখি সামনে কোনো গাড়ি পাওয়া যায় নাকি।”

” হ্যাঁ চল।”

অন্তরা সেজুতির সাথে হাঁটতে শুরু করল। একটু পর অন্তরা বলল,” আচ্ছা সেজু, আন্টি যদি নোরার কথা জিজ্ঞেস করে তখন আমরা কি বলবো?”

” বলবো কিছু একটা।”

” কিছু একটা কি?”

” যেতে যেতে ভাবি কিছু একটা কি।”

অনিক বড় বড় পা ফেলে হাঁটছে। পেছনে নোরা পা টিপিয়ে টিপিয়ে আসছে। অনিক পেছনে তাকাতেই সে ফট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। অনিক রুক্ষ গলায় বলল,” নোরা আমি জানি তুমি আমার পেছনেই আসছো। লুকিয়ে লাভ নেই। গাছের পেছন থেকে বের হয়ে আসো।”

নোরা মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসল। মুখ মলিন করে বলল,” সরি।”

“সরি কেন?”
” আপনাকে মিথ্যে বলেছি তাই। আর এমন হবে না। এই আমি কান ধরে উঠবস করছি। এক,দুই,তিন, চার..”

“থামো!”
গমগমে ধ’মকে কেঁপে উঠল নোরা। থামল, কিন্তু কান ছাড়ল না। অনিক বলল,” কান থেকে হাত নামাও।”

নোরা কান থেকে হাত নামিয়ে নিল। অনিক কোমরে হাত রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,” আচ্ছা আমি তোমাকে নিয়ে যাবোটা কোথায় বলোতো? আমার গন্তব্য এক জায়গায় তোমার গন্তব্য অন্য জায়গায়। তাহলে তুমি আমার সাথে কেন আসছো?”

“কারণ আমি এ জায়গার কিচ্ছু চিনি না।”

অনিক তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিল,” হোয়াট আ জোক! তুমি আবার চেনো না? না চিনেই আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এতোদূর চলে এসেছো?”

” যতদূর এসেছি ততদূর চিনি। কিন্তু এই জায়গা তো চিনিনা।”

অনিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চারদিকে গহীন জঙ্গল, অচেনা-অজানা পথে এই মেয়েটিকে নিয়ে যাবে কোথায় সে? অনিক সামনে হাঁটতে লাগল। নোরার এবার ভ*য় লাগছে। সে বিরাট ভুল করেছে এখানে এসে। এখন মনে হচ্ছে সত্যিটা বলে দিলেই ভালো হতো। ধ্যাত! ওরা হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গল পেরিয়ে মেইনরাস্তায় চলে এসেছে। কিন্তু রাস্তা সম্পুর্ণ পরিষ্কার। একটা সাইকেল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

অনিক বলল,”কারফিউয়ের জন্য একটা বাস পর্যন্ত নেই। এবার কি হবে? চন্দ্রনাথ মন্দির এখান থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। এতোদূর যাব কিভাবে? হেঁটে যাওয়া তো সম্ভব নয়।”

নোরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” সেটা পরে দেখা যাবে। আগে চলুন পেটগরম করে আসি।”

অনিক মুখ কুঁচকে বলল,” কি?”

” পেটগরম! মানে ক্ষিদে পেয়েছে। ব্রেকফাস্টের কথা বলছি।”

” তো সেটা ঠিক করে বলো। ‘পেটগরম করে আসি’ এটা আবার কেমন ভাষা?”

নোরা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ” আরে ওই হলো আর কি! চলুন তো!”

নোরা অনিকের এক হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু অনিক আসছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নোরার দিকে তাকিয়ে আছে কঠিন দৃষ্টিতে। নোরা বলল,” কি হলো আসুন! আমি কি আপনাকে টেনে টেনে নিয়ে যাবো?”

অনিক হাতের দিকে ইশারা করে বলল,” স্কিউজ মি!”

নোরা হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,” ওহ সরি।”

তারপর একটু থেমে আবার বলল,”আপনি সবসময় এমন ভাণ করেন যেন আমার ছোয়া লাগলে আপনার চর্মরোগ বা স্কিন ক্যানসার হয়ে যাবে। ”

অনিক জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে হাঁটতে শুরু করল।কোনো এক লোকাল ধাবায় ওরা ব্রেকফাস্টের জন্য গেল। অনিক-নোরা যখন খাচ্ছিল ধাবার ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে হাসি হাসি মুখে অনিককে বললেন,” স্যার, খাবারটা কেমন?”

নোরা লোকটার মুখে স্যার শুনে হিহি করে হেসে দিল। তারপর অনিকের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে বলল,” স্যার! আপনি কি জনগণের স্যার?”

অনিক নোরার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল,” খাবার ভালো। কিন্তু ঝালের পরিমাণটা একটু বেশি। এটা খেয়াল রাখবেন।”

” ওকে স্যার। থ্যাঙ্কিউ।”

অনিক হেসে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। নোরা নিজের খাওয়া রেখে অনিকের খাওয়া দেখছে। একটা মানুষ এতো পারফেক্ট ভাবে কি করে খাবার খেতে পারে? খাওয়ার সময় পুরো মুখ বন্ধ রেখে কুটকুট করে চিবায়। কোনো শব্দ হয়না। আবার টিস্যু দিয়ে মাঝে মাঝে মুখটা হালকাভাবে মুছে। সেই দৃশ্য দেখেই নোরা দিশেহারা হয়ে যায়। লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আগ্রহ নিয়ে দেখছে তাদের। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,” হানিমুন নাকি?”

নোরা বিষম খেল। কাশি থামিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনিক বলল,” কি আজে-বাজে কথা বলছেন? আমার ছোটবোন হয় ও।”

” ও আচ্ছা, আচ্ছা, মাফ করবেন।”

অনিকের উত্তর শুনে নোরার কাশি থেমে গেছে। আহত দৃষ্টিতে থম মেরে তাকিয়ে আছে সে। শেষমেষ ছোটবোন? এও শুনতে হলো? লোকটি লজ্জিত হেসে চলে যেতেই নোরা কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বলে উঠল,” হে আল্লাহ, এই কথা শোনার আগে তুমি আমার মরণ কেন দিলে না?”

ড্রামা কুইনের ড্রামা দেখে অনিকের হাসি পেলেও হাসল না সে। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,” খাও চুপ করে। নয়তো আবার বিষম উঠবে।”

সেজুতি আর অন্তরা ক্লান্তপায়ে হাঁটছে। এতোক্ষণ খুঁজেও একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা। আজকের দিনে সকল যান চলাচল বন্ধ এটা দুজনের কেউই জানে না। আশেপাশে খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারল যে টানা দুইদিন ধরে কারফিউ চলবে। বড় বড় বাস,ট্রাকের সাথে রিকশা,ভ্যান পর্যন্ত বন্ধ। এদিকে অন্তরা আর সেজুতি রাস্তাও চিনেনা। গুগল ম্যাপ অন করার জন্য কারো ফোনেই ইন্টারনেট নেই। হাঁটতে হাঁটতে দুই বান্ধবী ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় থামল। সেজুতি রাস্তার মাঝখানেই বসে পড়েছে। অন্তরা বলল,” কিরে! কি হয়েছে তোর? বেশি খারাপ লাগছে?”

” আর হাঁটবো না দোস্ত। এবার একটু বোস।”

অন্তরা বসতে বসতে বলল,” দোস্ত আমার না খুব ভয় লাগছে।”

” আর আমার রাগ লাগছে। ওই নোরা শাকচুন্নিটারে এখন হাতের কাছে পাইলে ঘাড় মটকাইতাম।”

” আসলেই। কি একটা বিপদে ফেলে চলে গেল বলতো। শালী ফোনটাও ধরেনা।”

” ধরবে কিভাবে? সাথে ওর অনিক স্যার আছে না? আমাদের কথা কি এখন মনে থাকবে?”

” তাই বলে এতোবার কল দেওয়ার পরেও ধরবেনা? একটু তো বোঝা উচিৎ কোনো জরুরী দরকারেই ফোনটা দিচ্ছি।”

” এইটা যদি বুঝতো তাহলে তো হতোই..”

সেজুতি হঠাৎ থেমে গেল। তারপর কান খাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করতে লাগল। অন্তরা বলল,” কিরে! কি শুনিস?”

” কার যেন গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে দোস্ত। মুখ বেধে রাখলে যেমন হয়না? সেরকম।”

“ওরে বাপরে। আমার ভয় লাগছে দোস্ত চল এখান থেকে চলে যাই।”

” আরে থাম, বিষয়টা বুঝতে দে আগে।”

” কিচ্ছু বোঝার দরকার নাই। আমি সব বুঝে গেছি। নিশ্চয়ই কেউ বিপদে পড়েছে। আর এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমরাও বিপদে পড়বো। তাই চল পালাই।”

সেজুতি অন্তরার কোনো কথা শুনল না। বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে সচেতন পায়ে শব্দের উৎস বরাবর হাঁটতে লাগল। অন্তরা কয়েকবার বাঁধা দিল। কিন্তু লাভ হলনা। পরে সে নিজেও সেজুতির সঙ্গে চলতে শুরু করল। ওরা যত সামনে যাচ্ছিল আওয়াজটা তত গাঢ় হচ্ছিল এবং একসময় মনে হল এটা কারো গোঙানির আওয়াজ না বরং চিৎকারের আওয়াজ। দূর থেকে শব্দটা গোঙানির মতো শোনাচ্ছিল। কেউ চেঁচিয়ে সাহায্য চাইছে। পুরুষকণ্ঠ। ওরা আরো কয়েক ধাপ সামনে এগুতেই দেখল রাস্তা শেষ। নিচে খাদ। সেই খাদের গভীরতা অনেক। একটা ছেলে ভাঙা গাছের ডাল ধরে ঝুলে আছে। সে-ই চিৎকার করছে। কোনোভাবে হাত থেকে গাছের ডালটা ছুটে গেলেই খাদে পড়ে যেতে হবে।

সেজুতি অপরিচিত ছেলেটিকে আশ্বাস দিয়ে বলল শান্ত থাকতে। ওরা ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তারপর ওরা ওদের ওরনা একসাথে গিট বেঁধে লম্বা দড়ি বানাল। সেই দড়ি ছেলেটার দিকে ফেলল। ছেলেটা দড়ি ধরে উপরে উঠে আসতে সক্ষম হল। উপর থেকে সেজুতি আর অন্তরাও টানছিল। ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” থ্যাঙ্কস আপু, থ্যাংক্স আপনাদের।”

সেজুতি ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। হঠাৎ কি জানি হল।সেজুতি কিছু বুঝলনা। অন্তরা ভাঙা গাছের ডাল তুলে ছেলেটাকে ধাওয়া করতে শুরু করল। ছেলেটা এক দৌড় দিল, অন্তরাও দৌড়। সেজুতি কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। বিস্ময় কাটিয়ে সে-ও দৌড়ানো শুরু করল ওদের পেছনে। অন্তরা দৌড়াচ্ছে আর বলছে,” পালিয়ে যাবি কোথায়? আমি তো তোকে ধরবই। সারাজীবন খালি পালানোটাই শিখলি। মুখোমুখি দাড়ানোর সাহস আছে তোর? কাপুরুষ! ”

ছেলেটা দৌড়াচ্ছে আর হাতজোর করে ক্ষমা চাচ্ছে,” প্লিজ অন্তুপাখি মাফ করে দাও। আমি সেদিনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি চাইলে আমি এক্সপ্লেনেশন দিতে পারি।”

” তোর এক্সপ্লেনেশনের আমি গুল্লি মারি। তুই খালি আমার সামনে আয় একবার। বেটা কাপুরষ। তুই আবার আমাকে অন্তুপাখি বইলা ডাকিস? কে তোর পাখি?”

সেজুতি ছুটতে ছুটতে বলল,” তোরা থাম দোহাই লাগে তোদের। অন্তু প্লিজ থাম।”

সেজুতি অন্তরাকে টেনে দাঁড় করাল। অন্তরা থামল কিন্তু দমল না। এখনো বিষধরী নাগিনের মতোর ফোসফোস করছে। অন্তরার অবস্থা দেখে সেজুতির ভয় লাগল। এর আগে কখনো ওকে এতোটা রেগে যেতে দেখেনি সে। সামনে ছেলেটাও থেমে গেছে। ধীরপায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছে বেচারা। সেজুতি অন্তরাকে বলল,” দোস্ত তুই ঠান্ডা হয়ে বলতো কাহিনি কি?”

” কাহিনি ওই কু*ত্তা জানে। ওই কু*ত্তাকে জিজ্ঞেস কর ও কি করছে।”

এ কথা বলতে বলতে নিজের স্যান্ডেল খুলে ছেলেটার দিকে ছুড়ে মারল অন্তরা। ছেলেটা ক্যাচ ধরতে পেরেই দাঁত বের করে হেসে উঠল। অন্তরা তেতে আরেকটা স্যান্ডেল ছুড়ে মারল। ছেলেটা ওটাও ধরে ফেলল। অন্তরা রাগে নিচ থেকে পাথর নিয়ে জোরে ঢিল মারল। এবার ছেলেটার কপালে আঘাত লাগল। সেজুতি চমকে উঠে বলল,” দোস্ত তোর পায়ে ধরি ঢিলাঢিলি বন্ধ কর। আচ্ছা ভাইয়া আপনি আমাকে বলেন তো ও এমন করছে কেন? আপনাদের মাঝখানে কিসের এতো শত্রুতা?”

ছেলেটা কপাল ডলতে ডলতে বলল,” আমি আলভী। একসময় ওর আর আমার মধ্যে খুব সিরিয়াস রিলেশনশিপ ছিল।”

অন্তরা চেঁচিয়ে বলল,” সিরিয়াস রিলেশনশিপ? নাকি তামাশার রিলেশনশিপ? তোর কাছে তো সবটাই তামাশা ছিল।”

সেজুতি বলল,” আচ্ছা তুই চুপ থাক। উনাকে বলতে দে। ”

সেজুতি আলভীর দিকে তাকিয়ে বলল,” আচ্ছা তাহলে আপনিই আলভী?”

আলভী বলল,” জ্বী। আসলে আমাদের মধ্যে একটা বড় মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। তারপর থেকেই রিলেশনটা আর কনটিনিউ হয়নি।”

অন্তরা বলল,” মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং? আচ্ছা! তোকে বুঝাচ্ছি আমি মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং কাকে বলে। একবার সামনে আয়।”
আলভী অন্তরার কাছে এসে ওর দুইকাঁধে হাত রেখে বলল,
” অন্তু তুমি আমার কথাটা একবার শোনো। আমি জানি তুমি আমার উপর খুব রেগে আছো। কিন্তু সেদিন আমি কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম সেটা জানলে হয়তো তোমার আর কোনো রাগ থাকবে না।”

অন্তরা আর সামলাতে পারল না নিজেকে। মুখে ওরনা চেপে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” কি এমন বাধ্যবাধকতা ছিল যে সেদিন তুমি একটা কথাও বলতে পারলে না? তোমার ভাবী আমাকে ভিডিও কলে এইভাবে অপমান করল, কত বাজে বাজে কথা শোনাল। বলল আমি নাকি ওয়ানটাইম গার্ল। তাও তুমি কিছু বললে না? কিভাবে পারলে চুপ থাকতে আলভী? কিভাবে?”

” অন্তু ও আমার ভাবী না। ভাইয়ার সাথে ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে হয়নি। ও ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ছিল।”

অন্তরা চোখ মুছতে মুছতে বলল,” ও! ভাবীও না? মানে বাহিরের একটা মেয়ে? তোমাদের ফ্যামিলির কেউ হয়না ও তবুও আমাকে ওইভাবে অপমান করল আর তুমি কিচ্ছু বলতে পারলে না?”

” অন্তু তখন আমার সামনে আব্বু ছিল আম্মু ছিল। ওরা দুইজন আমার দুইপাশে দারোগার মতো দাড়িয়েছিল। আমি যদি তখন একটা শব্দ করতাম তাহলেই চড় খেতাম।”

” শুধুমাত্র চড়? আর তোমার ওই ফেইক ভাবী যে প্রতিটা কথায় আমার গালে অদৃশ্য চড় বসাচ্ছিল সেটা? ওর প্রত্যেকটা কথা তো চড়ের থেকেও ভয়ংকর লাগছিল আমার কাছে। এর থেকে আমাকে সামনাসামনি দশটা চড় মারলেও আমি কিচ্ছু মনে করতাম না।”

” আমি জানি অন্তু সে খুব বাজে কাজ করেছে। আর সেজন্য শাস্তিও পেয়েছে। শুধুমাত্র তোমাকে অপমান করার কারণেই আমি ওর সাথে ভাইয়ার বিয়েটা হতে দেইনি। আমি যেমন ওর জন্য আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছি, তেমনি ওকেও আমি ওর ভালোবাসা পেতে দেইনি।”

” তাই যদি হয় তাহলে সেদিনের পর থেকে কেন আমার সাথে যোগাযোগ রাখোনি? কেন আমার সামনে আসোনি? জানো কিভাবে কাটিয়েছি আমি এই দুইটি বছর? মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলাম।”

” প্রথম কয়েক মাস তো আমি কারো সাথেই যোগাযোগ রাখতে পারিনি। আমাকে ফোনই দেওয়া হতোনা। আর তোমার তো ফোন নম্বরও ছিলনা। তুমি ট্যাব ইউজ করতে। সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া তোমার সাথে যোগাযোগের আর কোনো উপায় ছিলনা। অথচ তখন আমি ইন্টারনেট থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলাম।”

” আচ্ছা তারপর? তারপর কেন যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনি?”

” তোমাকে আর খুঁজেই পাইনি। তুমি আইডি অফ করে দিয়েছিলে।”

” আসল কথা কেন বলছো না? তখন তুমি সুজিকে পেয়ে গিয়েছিলে। সুজির সাথে ফেসবুকে তোমার ছবি দেখেই তো আইডি অফ করেছিলাম আমি।”

” হ্যা আমি স্বীকার করছি আমার দোষ ছিল। তোমার সাথে রিলেশনের আগে আমার সুজি সাথে রিলেশন ছিল। তুমি চলে যাওয়ার পর সুজি আবার ব্যাক করেছে। আমি তখন ওকে ফেরাতে পারিনি।”

“তা পারবে কি করে? সুজি তো বিশ্বসুন্দরী তাইনা? মতিভ্রম হয়েছিল তোমার। তাহলে এখন আমার রাগ ভাঙাতে কেন এসেছো? তোমার সুজির কাছে যাও।”

” কিভাবে যাবো? সুজি তো এখন হালুয়া হয়ে গেছে।”

” মানে?”

” মানে সুজির বিয়ে হয়ে গেছে।”

” ও। তাহলে এইজন্য এখন আমার কাছে এসেছো?”

” সরি অন্তরা। প্লিজ মাফ করে দাও। আর একটা চান্স দিয়ে দেখো। একদম ভালো হয়ে যাবো।”

আলভী অন্তরার দুইহাত চেপে ধরল। তারপর করুণ দৃষ্টিতে অন্তরার চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চাইল। অন্তরা গলেও গেল। কিন্তু প্রকাশ করল না। সেজুতি তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” বেচারাকে দেখে মায়া লাগছে। মাফ করে দে।”

অন্তরা রাগী চোখে। সেজুতি বলল,” ঠিকাছে তোর ইচ্ছে না হলে মাফ করার দরকার নেই। চল আমরা চলে যাই।”

অন্তরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” ঠিকাছে যাও মাফ করলাম। কিন্তু আর কখনও যদি অন্যকোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছো তাহলে এখন যেমন ওরনা পেচিয়ে তোমাকে খাদ থেকে তুলেছি, তেমনি ওরনা দিয়ে ধাক্কা মেরেই খাদে ফেলে দিবো। মনে থাকে যেন।”

আলভী হেসে বলল,” যো হুকুম মহারাণী!”

অনিক আর নোরা ধাবা থেকে বেরিয়েই আবারও হাঁটতে লাগল। নোরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত প্রায়। একসময় বলল,” ও স্যার, আর কত হাঁটাবো? পেটে ব্যাথা করছে তো। এবার একটু রেস্ট করি?”

” প্রশ্নই আসেনা। সন্ধ্যা হওয়ার আগে আমাদের পৌঁছাতে হবে। নাহলে অন্ধকারে হারিয়ে যাবো। তখন না তুমি আমাকে খুঁজে পাবে আর না আমি তোমাকে।”

” সেজন্যই তো বলছি স্যার। একসাথে হাঁটি। আপনি আগে আমি পিছে এভাবে তো হচ্ছেনা।”

” তুমি তাড়াতাড়ি হাঁটো। তাহলেই হবে।”

” আমার পায়ে কি মেশিন লাগানো? আমি কিভাবে তাড়াতাড়ি হাঁটবো?”

আরেকটু সামনে এগোতেই একটা মালবাহী ট্রাক দেখল অনিক। শ্রমিকরা ট্রাকের ভেতর মাল তুলছে। অনিক পেছনে ঘুরে নোরাকে বলল, ” নোরা,একটু অ্যাকটিং করতে পারবে?”

তার এমন প্রশ্নে নোরা চ’মকে উঠল। ভ্রু কুঁচকে বলল,” অ্যাকটিং মানে?”

” অসুস্থতার অ্যাকটিং।”

” কেন?”

” বলছি, আগে পারবে কি-না বলো।”

” পারবো। জানেনই তো, অ্যাকটিং-এ আমি ফার্স্ট ক্লাস!”

অনিক হাসল। অভিনয়রত নোরাকে আগলে নিয়ে সে ট্রাক ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বলল,” ভাই, একটু সাহায্য করবেন প্লিজ? খুব বিপদে পড়েছি আমরা।”

শ্রমিকরা কাজ বাদ দিয়ে ওদের দিকে তাকাল। ট্রাক ড্রাইভার প্রশ্ন করলেন,” কি অইসে?”

” আমার ওয়াইফ খুব অসুস্থ। কারফিউয়ের জন্য তো যানবাহনও পাওয়া যাচ্ছেনা। যদি একটু আমাদের চন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছে দেন খুব হেল্প হয়।”

ড্রাইভার বিরক্তগলায় বললেন,” না না! সম্ভব না। ওতোদূর যাওয়ার আগেই আমগোরে আটকায় দিবো। পরে গাড়ির চাবি বাজেয়াপ্ত করবো, মাল বাজেয়াপ্ত করবো,অনেক ঝামেলা। মালই পৌঁছাইতে পারতাসি না।”

অনিক বলল,” ট্রাফিক পুলিশদের সাথে আমি কথা বলে নিবো। অসুস্থ রোগীর কথা শুনলে রাজি হয়ে যাবে। প্লিজ চলেন না ভাই। খুব বিপদে আছি। কালরাত থেকে ওকে নিয়ে ঘুরছি। প্লিজ একটু দেখেন না।”

অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর ট্রাক ড্রাইভারকে রাজি করানো গেল। অনিক নোরাকে জানালার পাশে বসাল। নিজে বসল মাঝখানে, ড্রাইভারের পাশে। ট্রাকে উঠার পরই নোরা চোখ খুলে একদম স্বাভাবিক হয়ে বসল। ট্রাক ড্রাইভার অবাক হয়ে বললেন,” আপায় না অসুস্থ? ”

অনিক হেসে বলল,”অসুস্থ হওয়া কি খুব জরুরী? ”

ড্রাইভার বললেন,” কাজটা কইলাম ঠিক হইতাসে না ভাই।”

অনিক ড্রাইভারের কাঁধ চাপড়ে বলল,” আরে এতো ভাববেন না ভাই। টাকা বেশি দিবো। আপনি খালি স্টেয়ারিং ঘুরান।”

নোরা হাসতে লাগল। জীবনে এই প্রথমবার ট্রাকে উঠেছে সে। তার ভীষণ মজা লাগছে। তাদের এই ট্রাক জার্নি খুব একটা সুখকর হলো না। সামনেই পড়ল টহল পুলিশ। ওখানেই ট্রাক থামানো হলো। ট্রাক ড্রাইভারকে কলার ধরে টানতে টানতে এক অফিসার নিয়ে চলে গেল। নোরা তখন ভয়ে অস্থির। অনিক আশ্বাস দিল, কিচ্ছু হবেনা। নোরাকে আবার সেই অসুস্থতার অ্যাকটিং চালিয়ে যেতে বলল। বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রাক ড্রাইভার বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসলেন। অনিক বলল,” কি হয়েছে? অনুমতি পাওয়া গেছে?”

ড্রাইভার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,” ওরা লেন-দেনের কথা বলে।”

অনিক সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালেট বের করে জানতে চাইল “কত চায়?”

ড্রাইভার বললেন,” টাকা না। ওরা অন্যকিছু দাবী করছে।”

অনিক ভ্রু কুঁচকে বলল,” অন্যকিছু কি?”

ড্রাইভার নোরার দিকে তাকালেন। অনিকের আত্মা কেঁপে উঠল। নোরা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। সরল মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”

অনিক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,”নোরা নামো।”

” নামবো কেন?”

অনিক বলল,”নামতে হবে। ভাই, আপনি আগান আমরা আসছি।”

ড্রাইভার বললেন,” কি কন ভাই?”

অনিক বলল,” আপনাকে যা বলছি তাই করুন।”

ড্রাইভার আর কোনো প্রশ্ন করলনা। সামনে আগাতে লাগল। অনিক-নোরাকে নিয়ে ট্রাক থেকে নেমেই উল্টোদিকে দৌড় লাগাল। নোরা বুঝতে পারছে না তারা কেন দৌড়াচ্ছে। কিন্তু অনিক যেহেতু দৌড়াতে বলছে তাহলে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ওদের পেছনে পুলিশ বাহিনীও আসছে। বুলেটের বিকট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অনিকের চোখেমুখে আতঙ্ক। সে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ নোরাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নোরার দুই গাল স্পর্শ করে বলল,” নোরা, একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। বলার সুযোগ আবার নাও আসতে পারে। হয়তো এখানেই সব শেষ। তাই বলছি, আই লভ ইউ। অনেক আগে থেকে। প্রায় চারবছর আগে, তোমাকে একটা জায়গায় দেখেছিলাম। তখন থেকেই ভালো লাগতো। ভালোবাসতাম। এখনও ভালোবাসি। ”

কথাগুলো বলতে বলতে অনিক নোরার কপালে চুমু দিল সে। নোরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিকের মুখে আই লভ ইউ শুনেও কোনো অনুভূতি হচ্ছেনা তার। কারণ এর আগে যে আরেকটা বাক্য ছিল। হয়তো এখানেই সব শেষ!

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০৮

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৮
লিখা: Sidratul muntaz

আজকে নোরা খুব জলদি কোচিং এ চলে এসেছে। এসেই দেখে কোচিং তালা দেওয়া। কি আর করার? হাঁটতে হাঁটতে ছাদে চলে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল অনিকস্যার দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালে হাত রেখে আনমনে আকাশ দেখছে। নোরা অবাক হয়ে অনিকের কাছে গেল। বলল,” একি স্যার আপনি?ভাঙা পা নিয়ে কোচিং এ এসেছেন কেন? আপনার পা ঠিক হয়েছে??”

নোরার অস্থিরতা দেখে অনিক মৃদু হাসল। তারপর বলল,” পা ঠিকাছে। আর ভাঙেনি, হালকা মচকে গিয়েছিল শুধু। হাঁটাচলায় তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা। তাহলে শুধু শুধু ঘরে বসে থাকবো কেন? এর থেকে ভাবলাম ক্লাস করাই। আর কিছুদিন পরই তো ঈদের ছুটি। তখন অনেক রেস্ট করা যাবে।”

” কিন্তু তবুও তখন রেস্ট করা আর এখন রেস্ট করা কি এক? আর আপনি তো এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।”

” হালকা ব্যথা এখনও আছে। তাই। ”

” ও।”

নোরার এইমাত্র মনে পড়ল মায়ের বাতের ব্যথার জন্য টোটকা হিসেবে একটা তেলের বোতল অনেকদিন ধরে তার ব্যাগে পড়ে আছে। মাকে দিবে দিবে করে দেওয়া হয়নি। চার-পাঁচদিন আগে পুরনো প্রতিবেশি এক বৃদ্ধা নানুর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। উনিই এই বোতলটা নোরাকে দিয়েছিলেন। মাকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে মাকে বলতেই ভুলে গেছে। তবে এখন তেলের বোতলটা ব্যবহার করার সুবর্ণ সুযোগ। এই ছুতোয় অনিকস্যারের পাটাও একবার ছুঁয়ে দেখা যাবে।

নোরা বলল, ” আচ্ছা স্যার, পায়ে তেল মালিশ করেন তো? নাহলে কিন্তু ব্যথা কমবে না।”

” হ্যাঁ প্রতিদিন রাতেই করা হয়। কখনও আম্মু করে কখনো আপু। কিন্তু আমার মনে হয়না এতে কোনো লাভ হয়। শুধু শুধু কষ্ট। ”

” লাভ হয়না কে বলেছে? আসলে লাভ-ক্ষতি তেলের গুণাগুণের উপর নির্ভর করে। তেলেই যদি ভেজাল থাকে তাহলে ব্যথা কমবে কিভাবে? স্যার! আমার কাছে একটা খুব ভালো আয়ুর্বেদিক তেল আছে। যেকোনো প্রকার ব্যথার জন্য তেলটা খুব উপকারী। আপনি একবার ট্রাই করে দেখবেন স্যার?”

” না না, কোনো দরকার নেই। আমার তেল মালিশ করতে ভালো লাগেনা।”

অনিক যতই না করুক, নোরা কিছুতেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। অনিকের পায়ে নিজের হাতে তেলমালিশ সে করেই ছাড়বে। নোরা বলল,” এইটা কোনো কথা বললেন স্যার? ওষুধ খেতে কি কারো ভালো লাগে? কিন্তু তবুও মানুষ খায়না? খায় তো। বাচার জন্য খায়। আপনাকেও বাচার জন্য মানে ব্যথা কমানোর জন্য তেলমালিশ করতে হবে। নাহলে কিন্তু ব্যাথা কমবে না স্যার। খুব কষ্ট পোহাতে হবে এই পা নিয়ে।”

অনিক কিছু বলতে নিলে নোরা থামিয়ে দিয়ে বলল,” আমার কথা শুনুন স্যার। আপনি চুপ করে ওই চেয়ারটার উপর বসে পড়ুন। আমি আপনার পায়ে তেলমালিশ করে দিচ্ছি। এমন মালিশ করবো না স্যার! জীবনেও ভুলতে পারবেন না। একটু পর দেখবেন আরামে ঘুম চলে আসছে।”

অনিক চোখ বড় করে বলল,” মানে? তোমাকে দিয়ে আমি পায়ে তেলমালিশ করাবো? পাগল নাকি? তুমি আমার স্টুডেন্ট!”

” তো কি হয়েছে স্যার? আমি আপনার শিষ্য। আর আপনি আমার গুরু।”

নোরা মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে অনিকের সামনে নিচু হওয়ার একটা ভঙ্গি করল। তারপর বলল,” এটুকু সেবা তো আমি আপনার করতেই পারি তাইনা?”

“ছি! অসম্ভব। দেখো এসব কাজ ভুলেও করতে আসবে না।”

” কেনো স্যার?”

” স্টুডেন্টকে দিয়ে হাত-পা মালিশ করানো আমার পছন্দ না। তার উপর তুমি মেয়ে মানুষ। আমার জঘন্য লাগে।”

” এখানে জঘন্য লাগার কি হল স্যার? আর আপনি কোথায় করাচ্ছেন আমি তো নিজেই করতে চাইছি৷ তাছাড়া আমার গুরু ব্যাথায় কষ্ট পাবে আর আমি শিষ্য হয়ে সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব? এটা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না স্যার। আপনার কোনো নিষেধ আমি শুনবো না। আমার যেটা ভালো মনে হয় সেটা আমি করবোই।”

” কথায় কথায় গুরু বলবে না প্লিজ। অদ্ভুত লাগছে শুনতে।”

“আচ্ছা বলবো না স্যার। আপনি শুধু অনুমতি দিন।”

” আচ্ছা মুশকিল তো! বললাম না লাগবে না?”

” আপনি অনুমতি না দিলেও আমি জোর করে করবো। যখন কেউ নিজের ভালো বুঝেনা তখন তাকে জোর করেই বুঝিয়ে দিতে হয়।”

” আচ্ছা তুমি তেলের বোতলটা দাও আমি নিজেই মালিশ করে নিচ্ছি।”

” আমি থাকতে আপনি কেন কষ্ট করবেন স্যার? এতে যে আমার অন্যায় হবে।পাপ হবে। আমি কিছুতেই এই পাপকাজ করতে পারবনা। আপনার পায়ে তেলমালিশ আমিই করবো। আর যদি আপনি না দেন তাহলে আমি খুব কষ্ট পাবো স্যার।”

অনিক বুঝতে পারল নোরার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই বলল,”ঠিকাছে। আমি বসছি। তুমি কি করবে দ্রুত করো।”

নোরা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল,” থ্যাঙ্কিউ স্যার! এইযে নিন ফ্লায়িং কিস। ”

অনিক কঠিনচোখে তাকাল। নোরা ভয়ে চুপসে গিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,” সরি। অন্তরাকে দিতে দিতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই ভুলে আপনাকেও দিয়ে ফেলেছি। সরি সরি সরি। আমি আমার ফ্লায়িং কিস ফিরিয়ে নিচ্ছি।”

নোরা হাত মুঠো করে ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরল। অনিকের হাসি পেলেও হাসল না। কষ্ট করে চেপে রাখল। মেয়েটা একদম পাগল! নোরা আসন পেতে ফ্লোরে বসে পড়ল। অনিকের পাটা যত্ন করে নিজের কোলের উপর রাখল। অনিকের তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। কারণ বলে লাভ নেই।

নোরা মালিশ করতে করতে বলল,” আচ্ছা স্যার আপনি কি ট্র্যাকিং এ যাচ্ছেন?”

” কিসের ট্র্যাকিং?”

” ওইযে সেদিন আল..”

নোরা নিজে থেকেই থেমে গেল। অনিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নোরা আমতাআমতা করে কথা ঘুরিয়ে ফেলল,” না মানে, ওইদিন একটা ভাইয়ার কাছে শুনলাম আপনি নাকি সীতাকুন্ড যাচ্ছেন? পাহাড় ট্র্যাকিং করতে?”

” ও হ্যাঁ। ছাব্বিশে আগস্ট রাতের বাসে যাচ্ছি।”

” ওহ। তারমানে সত্যি যাচ্ছেন? কনফার্ম? ”

” হুম।”

” খুব ভালো। ”

” ভালো কেন?”

” ভালো কারণ, পাহাড় আহরণ করা ভালো না? একটা সুন্দর এক্সপেরিয়েন্স! ”

” তুমি কখনও পাহাড় ট্র্যাকিং করেছো?”

” না। সেই সৌভাগ্য হয়নি।”

” তাহলে এক্সপেরিয়েন্সের কথা বললে যে?”

” এমনি শুনেছি। কতজনের কাছে শুনেছি। ট্র্যাকিং এর গল্প।”

” ওহ।”

” আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন। কোনো এক পাহাড় ট্রেকারের সাথে আমার বিয়ে হবে। সে আমাকে কাধে করে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাবে। আমি তো যেতে পারবোনা, তাই সে-ই হবে আমার বাহন। আর আমাকে নিয়ে এতোদূর উঠে যখন তার হাত-পা ব্যথা করবে, আমি এভাবেই ওকে তেলমালিশ করিয়ে দিবো। যেমন আপনাকে করে দিচ্ছি। আমার তেলমালিশ করা কেমন হয় স্যার?”

” ভালো। ”

” সত্যি? আপনার ভালো লেগেছে?তাহলে তো আর কোনো টেনশনই নেই। তারও ভালো লাগবে।”

” কার?”

নোরা একটু লাজুকমুখে বলল,”আমার ফিউচার হাসব্যান্ডের।”

” ও! তো আমার ভালো লাগলেই যে তারও ভালো লাগবে এটার গ্যারান্টি কি?”

“গ্যারান্টি আছে। লাইফটাইম গ্যারান্টি। কারণ সে পুরো আপনার মতো হবে। একদম আপনার জেরোক্স কপি। ”

” আমার মতো কেন?”

” কারণ আপনার মতো না হলে আমি বিয়েই করবোনা।”

অনিক সরাসরি নোরার চোখের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে অগ্নুৎপাত। যেন এখনি নোরাকে ভষ্ম করে দিবে । নোরা ভয় পেয়ে বলল,” সরি স্যার। দুষ্টুমি করেছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

এ কথা বলেই অনিকের পা টা কোল থেকে নামিয়ে নিচে রেখে দিল। তারপর তেলের বোতলটা ব্যাগে পুরে এক দৌড়ে ছাদের বাহিরে চলে গেল। নোরা চলে যাওয়ার পর অনিক হেসে ফেলল। মনে মনে বলল,” পাগলি একটা।”

এমন সময় নোরা ছাদের দরজায় উঁকি মেরে বলল,
“স্যার হাসলে আপনাকে দারুণ লাগে। পুরাই আল্টিমেট কিউট। ”

অনিক সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ শক্ত বানিয়ে কড়াচোখে তাকাল। নোরা আবার দৌড় লাগাল। সিড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় দেখা হলো আদনান স্যারের সাথে। নোরা খানিক হকচকিয়ে গেল। আদনান স্যার খুব গম্ভীরমুখে তাকিয়ে আছেন। নোরা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,” স্যার আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”

আদনান স্যার সালামের জবাব দিলেননা। শুধু মাথা নাড়লেন। তারপর উপরে উঠে গেলেন। নোরার হালকা অদ্ভুত লাগল। আদনান স্যার খুবই রসিক ধাচের মানুষ। কথায় কথায় হাসি-তামাশা করা তার স্বভাব। সবসময় মুখে হাসি নিয়েই কথা বলেন। আর নোরাকে তো উনি খুবই পছন্দ করেন।কিন্তু আজকে হঠাৎ কি হল? দেখে মনে হচ্ছিল খুব রেগে আছেন। নোরা বিষয়টাকে বেশ একটা পাত্তা দিলনা। সে আবার আগের মতোই নাচতে নাচতে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল।

আজকের ক্লাসটা জহির স্যারের। অনিকস্যারের লাঠিটা তাদের ক্লাসেই আছে। স্যার লাঠি নিতে নিশ্চয়ই আসবে। সেজুতি আর অন্তরার মাঝখানে বসে অনিকের আগমনের অপেক্ষাতেই প্রহর গুণছিল নোরা। হঠাৎ দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে ঢুকল। দরজা খোলার আওয়াজ শুনেই নোরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ওইটা অনিক। কিন্তু তার ধারণা সঠিক হলনা। আদনান স্যার এসেছেন। নোরার চোখের সামনেই একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটল। জহিরস্যার আদনানকে দেখে বললেন,” ভাই কিছু লাগবে?”

আদনান স্যার নিচুগলায় বললেন,” লাঠিটা।”

জহিরস্যার টেবিলের উপর থেকে লাঠিটা দিলেন। আদনান স্যার নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন। দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই নোরা উঁকি মেরে দেখে নিল। বাহিরে অনিকস্যার দাঁড়িয়ে আছে। আদনান অনিককে লাঠিটা দিল। অনিক নিয়ে চলে গেল। নোরা কিছুই বুঝলনা। অনিকস্যারের লাঠি আদনান স্যার কেন নিতে আসলেন? আর অনিকস্যার ভেতরে ঢুকল পর্যন্ত না। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়েই চলে গেল? ব্যাপারটা নোরার অস্বাভাবিক লাগছে। জহির স্যার নোরাকে ডাকল,” নোরা!”

“জ্বী স্যার?”

“আমি ক্লাসে লেকচার দিচ্ছি আর তুমি বাহিরে তাকিয়ে আছো কেন?”

” সরি স্যার।”

“সরি বলে তো লাভ নেই। তোমার কন্ডিশন খুবই খারাপ। লেখাপড়ায় মনোযোগ একদমই নেই তোমার। কোচিং এ কি শুধু রুপ দেখাতে আসো? ইংরেজি এক্সামের রেজাল্ট এতো খারাপ হল কেন? সবাই টুয়েন্টি প্লাস মার্কস পেয়েছে। আর তুমি কত পেয়েছো?”

নোরা আহতদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্লাসের সবাই খুব অবাক হয়ে ঘটনা দেখছে। জহিরস্যারকে এভাবে রেগে যেতে এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। আর নোরা তো উনার অন্যতম পছন্দের স্টুডেন্ট। নোরার সাথে এমন ব্যবহার? অবিশ্বাস্য।সেজুতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে বলল,” স্যার ইংরেজি খাতা কবে দেওয়া হবে?”

জহির বলল,” আজকেই ছুটির পর দিবো। সবাই থেকো। খাতা দেওয়ার পর আদনান ভাই তোমাদের সাথে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলবে। গুরুত্বপূর্ণ। ”

নোরার ভেতর খচখচ শুরু হয়ে গেল। কেন জানি খুব ভয় লাগছে তার। সে যেটার আশংকা করছিল সেটাই হল। ইংরেজিতে নোরার মার্কস খুব কম। পঞ্চাশে আঠারো। একটুর জন্য ফেইল করে বসেনি। এটাই সবচেয়ে লয়েস্ট মার্কস। এভাবে চলতে থাকলে এডমিশিন টেস্টে গিয়ে ধরা খাবে সে। জহির স্যার তাই বলেছেন। আদনান স্যারও ক্লাসে ঢুকে এই বিষয়টা নিয়ে অনেক ভাষণ শুনালেন। এক কথায় নোরাকে অপমান করেছেন। তখন আফজাল স্যার আর অনিকস্যারও উপস্থিত ছিল।

আদনান স্যার কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা খোচা দিয়ে ফেললেন” আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তোমাদের লেখাপড়া করতে ইচ্ছে না করলে বাবা-মাকে বলো যেন বিয়ে দিয়ে দেয়। তোমাদের বিয়ের বয়স হয়েছে। আঠারো বছর হয়েছে না সবার? প্রয়োজনে বিয়ে করে ফেলো। কিন্তু কোচিং এ এসে টিচারদের সাথে ইটিশ-পিটিশ করা চলবেনা। আমার নজরে অনেকদিন ধরেই বিষয়টা ঘুরছে। আমি কারো নাম মেনশন করবো না। কিন্তু যাদেরকে বলছি তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। সো সাবধান হয়ে যাও। এরকম যেন আমি আর কখনও না দেখি।”

অনিকস্যার তখন মাথা নিচু করে ছিলেন। আর আফজাল স্যার বোকার মতো হাসছিলেন। উনি হয়তো এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। নোরার নিজের জন্য খারাপ লাগলনা। কিন্তু অনিকের জন্য ভীষণ খারাপ লাগল। নোরার নিজের দোষে অনিককে অপমানিত হতে হচ্ছে। এটা কি সে মেনে নিতে পারে?

রাতে ফেসবুকে নোরা অনিককে নক দিল,” স্যার আসসালামু আলাইকুম। ”

প্রায় পাঁচমিনিট পর রিপ্লাই এলো,” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কোনো দরকার থাকলে বলো। আমি একটু ব্যস্ত আছি।”

” স্যার আমি কি কোনো ভুল করেছি?”

অনিক টাইপ করছে। আর নোরার হার্টবিট বাড়ছে। শ্বাস আটকে আসছে। অনিক লিখল,”হুম।”

তারপর আবার টাইপিং। নোরা লিখল ,” কি ভুল?”

কিন্তু মেসেজটা পাঠাতে পারলনা। তার আগেই একটা লেখা ভেসে উঠল,”The person is unavailable. ”

মানে অনিক তাকে ব্লক দিয়েছে। প্রায় দশমিনিটের জন্য নোরার মাথাটা পুরো খালি হয়ে গেল। সে কিছু অনুভব করতে পারছিলনা। শুধু চোখ দিয়ে কষ্টের স্রোতধারা বাহিত হচ্ছিল। ফোনের স্ক্রিনে এক-দুইফোঁটা করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। একটু পর অন্তরার মেসেজে নোরার ঘোর কাটল। অন্তরা কি মেসেজ দিয়েছে সেটা দেখল না নোরা। সে অন্তরাকে মেসেজ লিখল,” অন্তু, অনিকস্যার আমাকে ব্লক দিয়েছে।”

“কি? ফাইজলামি করস?”

” না সত্যি। ”

” ইহহ। আমি বিশ্বাস করিনা।”

নোরা একটা স্ক্রিনশট তুলে অন্তরাকে পাঠিয়ে দিল। তারপর ফোনটা অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কান্নায় গলাব্যথা হয়ে গেছে। শব্দ করে কাঁদতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো। নোরা শব্দ করে কাঁদল না। নিরবে শুধু বালিশ ভিজিয়ে গেল। সারাটা রাত কাঁদতে কাঁদতেই কেটে গেল নোরার।একফোঁটাও ঘুম হলনা।

সেদিন ছিল শুক্রবার। সকালে তাদের ফিজিক্স এক্সাম। নোরা এক্সাম দিতেও গেলনা। অন্তরাকে বলল সে যেন একাই চলে যায়। আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে নোরা অসুস্থ। অন্তরা সেটাই করল। নোরা মায়ের ফোন থেকে আদনান স্যারের নম্বর ব্ল্যাকলিস্ট করে দিল। এক্সাম দিতে না আসার জন্য আদনান স্যার ফোন করতে পারে। তাই নোরা আগে থেকেই ব্ল্যাকলিস্ট করে রেখেছে। কালরাতে যতবড় ধাক্কা সে পেয়েছে, এরপর স্বাভাবিক হতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় তো লাগবেই। এই এক সপ্তাহ অনিকের সামনেও যাবেনা সে। তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা। সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেলবে। এখনো কান্না আসছে।

কয়েকদিনের মধ্যেই কোচিং এ ঈদের ছুটি শুরু হয়। নোরা, সেজুতি আর অন্তরা বাসা থেকে অনুমতিপত্র পেয়ে গেছে। ছাব্বিশ তারিখ রাতের বাসে ওরা সীতাকুন্ড রওনা হয়। আকাশ ওদেরকে পৌঁছে দিয়েছে। আকাশ নোরার কাজিন। বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছে। সারারাত জার্নির পর ক্লান্ত হয়ে অন্তরা আর সেজুতি বিছানা দখল করে ঘুমাচ্ছিল। তারা মিরসরাই পৌঁছেছে ভোর চারটার দিকে।

নোরার খালামণির বাংলো বাড়িটা সবার খুব পছন্দ হয়েছে। একদম গ্রাম গ্রাম আমেজ। মাটির ঘরও আছে। সেদিকে তাকালেও শান্তিতে বুক ভরে যায়। পুরো জায়গাটাই শান্তিময়। চতুর্দিক ঘিরে শুধু ধানক্ষেত আর সরিষাক্ষেত। বাসার সামনে সোজা সমতল রাস্তা। সরুপথ। সেই সড়ক ধরেই হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আর কি লাগে?

নোরা সকাল সকাল বের হওয়ার জন্য অন্তরা আর সেজুতিকে ডাকাডাকি করছে। খালামণিদের যৌথ পরিবার। দাদা-দাদী, চাচা-চাচীদের ঘুম ভাঙার আগেই ওদের বেরিয়ে পড়তে হবে। নোরার খালামণি রাতেই বলা হয়েছিল যে তারা সকালে ঘুরতে বের হবে। তাছাড়া খালামণি খুব সুইট। তাকে কোনো কিছুর জবাবদিহি করতে হয়না। কিন্তু তার শাশুড়ী এক নম্বরের দারোগা টাইপ মহিলা। যেকোনো একটা বিষয় পেলেই হল। প্রশ্ন করতে করতে মাথাখারাপ করে দিবে। নোরা চাইছে ওই তিনি ঘুম থেকে জাগার আগেই বেরিয়ে পড়তে। নাহলে পড়ে হয়তো বেরই হতে পারবেনা।

কিন্তু অনিকস্যারের নোরাকে দেখা করতেই হবে। তিনি হঠাৎ কেন এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন? কেন নোরাকে ফেসবুকে ব্লক করলেন? নোরা এসবের জবাব চায়।

“অন্তু,সেজু, ওঠ না! পায়ে পড়ি তোদের ওঠ।”

অন্তরা ঘুম জড়ানো গলায় বলল,” ঘুমাতে দে প্লিজ। খুব ঘুম পাচ্ছে।”

“ঘুম তো আমারও পাচ্ছে। কিন্তু আমি কি ঘুমাচ্ছি? এখন ঘুমালে চলবেনা। আমাদের বের হতে হবে। অনিকস্যাররা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আমাদেরকে ওখানে তাদের আগে পৌঁছাতে হবে।”

কারো কোনো রেসপন্স নেই। দুজনই ঘুমে বিভোর। নোরার মাথায় একটা বুদ্ধি চাপল। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল,” চেলা! কত্তবড় চেলা!”

কথাটা বলতে বলতে নোরা লাফ মেরে বিছানা থেকে নেমে গেল। অন্তরা আর সেজুতিও লাফিয়ে উঠল। বিছানা থেকে নেমে নোরার সাথে দাঁড়িয়ে দুজনেই একসঙ্গে বলতে লাগল,” কোথায় চেলা?”

নোরা বলল,” এক্ষুণি তো এখানেই ছিল। কোথায় জানি চলে গেছে। তোরা এক কাজ কর হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে, ততক্ষণে চেলা চলে আসবে।”

এ কথা বলেই নোরা হাসতে শুরু করল। সেজুতি কোমরে হাত দিয়ে বলল,” ফাইজলামি করছিস?”

অন্তরা বলল,” দোস্ত, হোয়াট ইজ চেলা?”

নোরা হাসতে হাসতে বলল, ” চেলা কি সেটা না জেনেই লাফিয়ে উঠে গেলি?”

সেজুতি বলল,” চেলা হল সাপের মিনি ভার্সন।”

অন্তরা নোরার হাত খামচে ধরল,” ওরে বাপরে! আমি আর এখানে থাকব না।”

নোরা বলল,” থাকতে হবেওনা। এখন আমরা যাচ্ছি চন্দ্রনাথ পাহাড়।”

সেজুতি বলল,” চন্দ্রনাথ পাহাড় কেন?”

নোরা বলল,” ওইখানেই তো অনিকস্যাররা ট্র্যাকিং এ যাচ্ছেন।”

সেজুতি বলল,” তুই কিভাবে জানলি?”

নোরা বলল,” ফেসবুকে পোস্ট দেখে জেনেছি।”

অন্তরা বলল,” পোস্ট কিভাবে দেখলি? স্যার না তোকে ব্লক মেরেছে?”

নোরা মনখারাপ করে বলল,” শুধু মেসেঞ্জারে ব্লক করেছে। ফেসবুকে এখনও এড আছে।”

অন্তরা হাই তুলে বলল,” চল আমরা রেডি
হই। তুই হাত-মুখ ধুঁয়েছিস?”

নোরা বলল,” হ্যাঁ দোস্ত, আমি তৈরি। তোরা শুধু হাত-মুখ ধুঁয়ে ওরনা আর ব্যাগ নিয়ে চলে আয়। কোনো সাজ-গোজের দরকার নেই। সময় খুব কম।”

সেজুতি আর অন্তরা একসাথে বলল,” আচ্ছা যাচ্ছি।”

নোরা ব্যাগপ্যাক রেডি করে গলায় একটা দূরবীন ঝুলিয়ে তৈরী হয়ে আছে। সেজুতি হাত-মুখ ধুঁয়ে এসে তাকে দেখেই বলল,” গলায় আবার এটা কি?”

নোরা হাসি হাসি মুখে বলল,” দূরবীন।”

সেজুতি বলল,” তুই দূরবীন দিয়ে কি করবি?”

অন্তরা বলল,” আরে বুঝিস না? দূরবীন দিয়ে ওর অনিকস্যারকে খুঁজবে। ওর অনিকস্যার পাহাড়ের কোন খাঁজে আটকে আছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে না?”

সেজুতি হাসতে লাগল। নোরা দূরবীন দিয়ে সবকিছু দেখতে দেখতে বলল,” বেশি কথা বলিস না তো। জলদি রেডি হো। বের হতে হবে।”

নোরার খালামণি লিনা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। তিনি খুব দ্রুত ঘুম থেকে ওঠেন। সেজুতি আর অন্তরা খুব তৃপ্তি নিয়ে চালের রুটি আর দেশি মুরগির ডিম পোচ দিয়ে নাস্তা সারল। নোরা কিছুই খেল না। তার অস্থিরতায় ক্ষিদে উবে গেছে। গলা দিয়ে পানি অবধি নামছে না। সত্যি কি আজ অনিকস্যারের সাথে দেখা হবে?

লিনা জোর করে নোরাকে একটা হাঁসের ডিম সিদ্ধ খাওয়ালেন। তারপর বললেন,” তোরা কোথায় ঘুরতে যাবি?”

অন্তরা বলল,”সীতাকুন্ড।”

সাথে সাথে চোখ বড় করে তাকালেন লিনা।

” কি? এতোদূর? তোদের কি মাথাখারাপ?”

নোরা তড়িঘড়ি করে বলল,” না খালামণি, ও তো মজা করছে। আমরা তো শুধু আশেপাশে ঘুরতে বের হচ্ছি। এইদিকে একটা পাহাড় আছে না? সেখানে যাবো।”

লিনা শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,” নোরা খবরদার তোকে সাবধান করছি। দিন-কাল সুবিধার না৷ এটা তোর নানুবাড়ি না যে গেছোপনা করবি। দুপুরের আগে কিন্তু ফিরতে হবে। মনে থাকবে?”

” মনে থাকবে খালা। তুমি এতো চিন্তা কোর না।”

নোরা পেছন ফিরে অন্তরার দিকে রাগী চোখে তাকাল। অন্তরা হাসার ভাণ করে কানে হাত রেখে বলল,” স্যরি।”

আরেকটু হলেই তারা ধরা পড়তে নিচ্ছিল। ওরা বের হওয়ার সময় লীরা বললেন,” আকাশকেও নিয়ে যা ”

নোরা সঙ্গে সঙ্গে বলল,” আকাশ ভাই তো ঘুমাচ্ছে৷ কি দরকার ডিস্টার্ব করার? বাদ দাও।”

লিনা আর কিছু বললেন না। তারা তিনজনই বেরিয়ে পড়ল। যাত্রা শুরু করল আঁকাবাঁকা পথ ধরে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর সেজুতি হাঁপিয়ে উঠে বলল,” আচ্ছা নোরা! তুই সোজা-সমতল রাস্তা থাকতে এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিস কেন?”

নোরা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” আরে এদিক দিয়ে শর্টকাট।”

সেজুতি মুখ বাঁকিয়ে বলল,” ধুর! উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে কত কষ্ট হচ্ছে আমার।”

নোরা বলল,” কষ্ট করো বেবি! ”

অন্তরা ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” আচ্ছা এভাবে আর কতক্ষণ হাঁটাবি আমাদের বলতো? একটু পর পায়ে ফোশকা পড়বে। আর রাস্তাগুলো এমন জুতা খুলে হাঁটারও উপায় নেই। কখন কোথ থেকে সাপ-খোপ বেরিয়ে আসবে। আমার তো ভয়ই লাগছে।”

সেজুতি বলল,” তুই তো আমারও ভয় বাড়িয়ে দিলি।”

নোরা বলল,” উফফ তোরা ধৈর্য্য ধর তো। এখানে কোনো সাপ-খোপ নেই। আর এখানকার রাস্তা-ঘাট আমার থেকে ভালো আর কেউ চেনেনা। আমার শৈশব কেটেছে এইখানে। আমি নিশ্চয়ই বুঝবো কোন রাস্তা ভালো আর কোন রাস্তা খারাপ! তাই হাঁসের বাচ্চার মতো প্যাকপ্যাক না করে আমার সাথে সাথে চল।”

নোরা বেশ দ্রুতগতিতেই হেঁটে চলেছে। সেজুতি আর অন্তরা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। এবার দুজন কিছুক্ষণ চোখাচোখি করল। সেজুতি বলল,” চল হাঁটি। কি আর করার!”

অন্তরা আক্ষেপী সুরে বলল,” চল!”

আরো অনেকদূর হাঁটার পর নোরা বলল,”শোন আমি তোদের ট্র্যাকটা ভালোমতো বুঝিয়ে দেই। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আমাদের যখন ওদের সাথে দেখা হবে, তখন আমরা কিন্তু চমকানোর ভাণ করবো। মানে আমাদের বুঝাতে হবে দেখাটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে। তোরা বুঝতে পারছিস?”

অন্তরা আর সেজুতি ঘেমেই কাহিল। চলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওদের। তারা না বুঝেই মাথা নাড়ল।নোরা বলল,” ব্যাস। এইখান থেকেই আমরা জীপ নিবো।”

নোরার কথা শুনে অন্তরা আর সেজুতি কিছুটা স্বস্তি পেল এবার। তাড়াহুড়ো করে দুজন দুইপাশে ঘাসের উপর আরাম করে বসে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে খাওয়া শুরু করল। অনেকক্ষণ পর একটু রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। নোরা ওদের অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,”তোরা যদি এখনি এই অবস্থা করিস তাহলে পাহাড় ট্র্যাকিং এর সময় কি করবি?”

নোরার কথায় অন্তরা আর সেজুতির পিলে চ’মকে উঠল। সেজুতি পানির ঢোক গিলে নিয়েই বলল,” কি? আমরা পাহাড় ট্র্যাকিং করবো?”

নোরা বলল,” অনিকস্যাররা যদি করে তাহলে আমরাও করবো।”

অন্তরা বলল,” আমরা না বল আমি। শুধু তুই একাই করবি। আমরা এসবে নেই।”

সেজুতি বলল,”একজ্যাক্টলি।”

নোরা তাদের কথা শুনতে পেল না। সে দূরবীন দিয়ে আশপাশটা দেখছিল। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,” দোস্ত, অনিকস্যারকে দেখেছি!”

সেজুতি আর অন্তরা উঠে দাঁড়াল। বলল,” মানে?”

সেজুতি নোরার কাঁধে হাত রেখে বলল,” সত্যি দেখেছিস?”

নোরা চোখ থেকে দুরবিন নামিয়ে বলল,” হুম।”

তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। অন্তরা বলল,” এখন কি করবি? যাবি?”

নোরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। তারপর অগোছালো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,” তোরা এখানেই থাক। আমি দেখা করে আসি।”

অন্তরা বলল,” কিন্তু স্যার কোথায়? তুই ঠিক দেখেছিস তো?

নোরা দ্রুতগলায় বলল,” আরে হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ! আমি অনিকস্যারকে চিনবো না?”

অন্তরা বলল,” আচ্ছা তাহলে যা। আর আমরা কি আসবো?”

নোরা বলল,” তোদের আসতে হবে না। তোরা রেস্ট কর। ওইদিকের পথ আরো বেশি উঁচুনিচু। কষ্ট হবে তোদের। পারবি না।”

অন্তরা আর সেজুতি হাঁফ ছাড়ল। অন্তরা বলল,” ঠিকাছে আমরা বসছি তুই যা।”

নোরা নিজেকে পরিপাটি করে সামনে এগুতে লাগল। উত্তেজনায় তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। সে খুব দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছিল। কারণ পরে অনিকস্যারকে খুঁজে না পাওয়া যেতে পারে। দৌড়াতে দৌড়াতে নোরা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। ঢালু অঞ্চল বেয়ে গড়াতে গড়াতে খোলামাঠের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এসে ঠেঁকল। তার মাথা ভো ভো করছে। হাত-পায়ে অস্বাভাবিক ব্যথা। হালকা জ্বালাপোড়াও হচ্ছে। হয়তো শরীরের বিভিন্ন জায়গা ছিলেও গেছে। উঁচুনিচু রাস্তায় গড়াতে গড়াতে সে কতদূর চলে এসেছে বুঝতে পারছেনা। সামনেই একটা লেক। নোরার সারা শরীরে কাঁদামাটি লেগে আছে। তাই সে কোনোমতে উঠে লেকের সামনে গেল।

শরীরের নোংরা পরিষ্কার করছিল তখনই শুনল,” নোরা তুমি এখানে?”

নোরা সামনে তাকিয়ে দেখল অনিক। তাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়াতে নিয়ে দূরবীনটা নোরার গলা থেকে খুলে পানিতে পড়ে গেল। অনিক বলল,” ওহ শিট, আমি তুলে দিচ্ছি দাঁড়াও।”

নোরা কথা বলতে পারলনা শুধু মাথা নাড়ল। অনিককে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। সেই সৌন্দর্য্যে নোরা দিশেহারা। কমলা রঙের টি-শার্ট আর কালো জিন্স। কাঁধের ব্যাগপ্যাকটাও কালো। চোখে সানগ্লাস ছিল সেটা এখন গলায় ঝুলে আছে।লেকের পানিতে হাত ডুবানোর কারণে তার ফরসা সুন্দর হাতটি কাদায় মাখামাখি হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ ঝুঁকে যাওয়ার কারণে অনিকের চুলগুলো ঝাঁকিয়ে কপালে পড়ছে। এসব দেখে নোরার বুকে ধাক্কার মতো অনুভূতি হচ্ছে।

নোরার হঠাৎ খেয়াল আসায় বলল,” স্যার,ওটা তুলতে হবেনা। বাদ দিন। আপনি উঠুন।”

” আরেকটু, আরেকটু হয়ে যাবে।”

” স্যার প্লিজ বাদ দিন না লাগবে না। পরে আপনিও পড়ে যাবেন।”

” আমি পড়ে গেলে সমস্যা নেই। সাতার জানি। শুধু জামা-কাপড় ভিজে যাবে এটাই সমস্যা। ”

” আচ্ছা জামা-কাপড় ভেজাতে হবে না আপনি উঠুন তো। ওই জিনিস আমার লাগবে না।”

” ওইটা কি ক্যামেরা ছিল?”

” না দূরবীন।”

“ও। বাই দ্যা ওয়ে তুমি এখানে কিভাবে?”

” আমি তো আপনাকে.. মানে আপনাকে দেখতে পেয়েই এলাম।”

” আমাকে দেখতে পেয়ে?”

” হ্যা। দূরবীন দিয়ে দেখলাম আপনি এখানে ঘুরাঘুরি করছেন। তাই চলে এলাম।”

অনিক সন্দেহের দৃষ্টিতে বলল,” নোরা,বাই এ্যানি চান্স তুমি কি আমাকে ফলো করছো?”

” না তো। আমি আপনাকে কেন ফলো করতে যাবো? আমি তো আমার খালামণির বাসায় এসেছি।”

” কোথায় তোমার খালামণির বাসা?”

” এখানেই। মিরসরাইতে।”

” তাহলে মিরসরাই না গিয়ে তুমি এখানে কেন? এখান থেযে তো মিরসরাই নেশ দূর।”

নোরা অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,” এইটা মিরসরাই না?”

“না।”

” ও! আমি তো ভাবলাম এটাই মিরসরাই। ভুল হয়ে গেছে। মিস্টেক। আচ্ছা আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

অনিক সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,”যাচ্ছি না। খুঁজছি।”

” কি খুঁজছেন?”

” রাস্তা।”

” কিসের রাস্তা খুঁজছেন?”

” আমাদের ট্র্যাকিং চলছে। আলাদা আলাদাভাবে সবাই পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাইকিং করতে করতে দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী এক জায়গায় মিলিত হবে। যে আগে পৌঁছাতে পারবে সে উইনার। ”

” ওয়াও ইন্টারেস্টিং তো!উইনারের গিফট কি?”

” নগদ দশহাজার টাকা।”

” ওয়াও! ভেরি মাচ ইন্টারেস্টিং। আমিও খেলবো।”

“এসব মেয়েদের খেলা না। অনেক মাইল হাটতে হবে। তোমার দ্বারা সম্ভব না। তাও এমন সুচের মতো শরীর নিয়ে।”

” সুচের মতো শরীর মানে? আপনি এটা কি বললেন আমাকে? জানেন আপনাকে খোঁজার জন্য আমি কতদূর.. ”

নোরা নিজে থেকেই থামল, তারপর জীভ কাটল। অনিক চোখ বড় করে বলল,” তার মানে তুমি আমার খোঁজে এসেছো? জানতাম। এজন্যই সেদিন ট্র্যাকিং এ যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছিলে তাইনা? আমি বলেছি ছাব্বিশ তারিখ রাতে রওনা দিবো তাই তুমিও ছাব্বিশ তারিখ রাতেই এসেছো। কি ঠিক বললাম তো?এখন সত্যি করে বলো তোমার সাথে আর কে কে আছে?”

নোরা অসহায়ের মতো মুখ করে বলল,” কেউ নেই। বিশ্বাস করুন কেউ নেই। আমি একা। আর আমি আপনাকে ফলো করতে করতেও আসিনি ঠিকাছে? এখানে সত্যিই আমার খালামণির বাসা।”

” কিভাবে বিশ্বাস করবো?”

“অবিশ্বাসই বা কেন করবেন? আচ্ছা আপনার কি কমন সেন্স নেই? আমি একা একটা মেয়ে কিভাবে এতোদূর আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসবো? এটা আপনি ভাবলেন কি করে?”

” আমি তো বলিনি তুমি একা এসেছো। সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করলাম তোমার সাথে আর কেউ আছে নাকি।”

” কেউ নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে আকাশ ভাইয়া ছিল। আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি।”

” আকাশ কে?”

” আমার আপন ফুপাতো ভাই। কাজিন। ”

অনিক কিছু বলল না৷ ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়ার চেষ্টা করছে। নোরা বলল,” স্যার?”

“হুম?”

“আমি আপনার হাত ধরে হাঁটি?”

অনিক বাঁকাচোখে তাকাল। নোরা বলল,” মানে, যদি হারিয়ে যাই সেজন্য বলছিলাম। থাক হাত ধরতে হবে না। ব্যাগ ধরে হাটি। মানে টাচে থাকি। আচ্ছা নাহলে আরেকটা কাজ করা যায়, আপনার ব্যাগের ফিতার সাথে আমার ব্যাগের ফিতা বেধে রাখি। তাহলে আমরা কেউই হারাবো না। আইডিয়াটা ভালো না?”

অনিক এবারও জবাব দিলনা। নোরা একটু পর আবার বলল,” আচ্ছা স্যার, এরকম কচ্ছপের গতিতে হাটলে তো আপনি হেরে যাবেন।”

” আমি হেরেই গেছি। এতোক্ষণে কম্পিটিশন শেষ। ”

” কি? তাহলে আপনি এখনও কেন যাচ্ছেন না?”

” কিভাবে যাবো? রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি তো।”

” রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন? তাহলে গুগল ম্যাপ অন করে নিন। খুব সহজ।”

” এখানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই। বাই দ্যা ওয়ে তোমার ফোনে নেটওয়ার্ক আছে? কি সিম তোমার?”

“গ্রামীণ। ”

” ভেরি গুড। তাহলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। দাও তো একবার ফোনটা। আমি একজনকে ফোন করবো।”

“কিন্তু স্যার আমার ফোনে তো ব্যালেন্স নেই।” নোরা ইচ্ছে করেই মিথ্যা বলল।

” ওহ শিট।”

” আচ্ছা আপনি রাস্তা হারালেন কিভাবে স্যার?”

” রাস্তা হারানোর তো কোনো সুযোগই ছিলনা।বড় পাথর আর গাছের ডালে হোয়াইট সাইন দেওয়া ছিল। যেন আমরা সেই নির্দেশনা অনুযায়ী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। আমি সেই নিয়মেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ হোয়াইট সাইনগুলো আর খুঁজে পাচ্ছিনা। একঘণ্টা ধরে একই জায়গায় ঘুরছি। কিন্তু কোথাও কোনো হোয়াইট সাইন নেই। বুঝতে পারলাম না। বৃষ্টিও তো হয়নি। তাহলে সাইনগুলো মুছল কিভাবে?”

“তাহলে এবার কি করবেন স্যার? জীপ ভাড়া করবেন?”

” খোঁজ-খবর কি রাখো না? কারফিউ চলছে। আজকে থেকে কোনো জীপ,ট্রাক,বাস এমনকি রিকশাও পাওয়া যাবেনা।”

” ওয়াও! দারুণ। ”

” কি বললে?”

” কিছু না।”

অনিক হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল,” বাই দ্যা ওয়ে তুমি কেন আমার সাথে আসছো? আমি নিজেই পথহারা পথিক। তোমাকে নিয়ে কোথায় যাব?”

” জানিনা। কিন্তু একা যাওয়ার থেকে দুজন মিলে যাওয়া ভালো না?”

অনিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,” ঠিকাছে চলো তোমার ওই ভাইকে খুঁজি। আকাশ না কি যেন!”

” ওকে তো খুঁজে পাবেন না।”

” কেন পাবোনা কেন?”

“কারণ ও হারিয়ে গেছে।”

“তো হারিয়ে গেছে বলেই তো খুঁজবো। ওর কাছে তোমাকে দিতে পারলেই আমার ঝামেলা শেষ। আর তাছাড়া তুমি সত্যি বলছো নাকি মিথ্যা সেটাও তো জানা দরকার।”

এ কথা বলেই অনিক বাঁকা হাসল। নোরা অভিমানী গলায় বলল, “আমি সত্যিই বলছি। বিশ্বাস না হলে আমার সাথে চলুন আমার খালামণির বাসায়। তাহলেই প্রমাণ পাবেন।”

” এই না বললে তুমি হারিয়ে গেছো? তাহলে আমাকে খালামণির বাসায় কিভাবে নিয়ে যাবে?”

নোরা আবার জীভ কাটল। সে নিজের কথাতে নিজেই ধরা পড়ে গেছে।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০৭

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৭
লিখা: Sidratul muntaz

স্কুটারে বসে নোরা কাঁপছে। কিছুক্ষণ আগের সেই সুখানুভূতির কথাটি মনে পড়তেই তার শরীর শিহরীত হয়ে উঠছে। অন্তরা নোরার শরীরের কম্পন টের পেতেই বলল,” এই নোরা, কি হয়েছে তোর? কাঁপছিস কেন এভাবে?”

নোরার মুখে আনন্দের হাসি। চোখ উজ্জল। মুখে লজ্জার ছাপ। সেই লজ্জায় তার গাল দুটো গোলাপী আভায় ভরে উঠেছে। অনিককে এতো কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য এর আগে কখনো হয়নি তার। অনিক যখন তাকে কোল থেকে নামাচ্ছিল, নোরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনিকের ফরসা গালের খোচা খোচা দাড়িতে এক নেশা জাগানো সুভাষ। আর কিছুক্ষণ কোলে থাকলে নোরা হয়তো চুমু দিয়ে ফেলতো ওই গালে। ভেবেই সে একটা চিৎকার মে’রে স্কুটি থামিয়ে দিল। একটা ভ্যানের সাথে এখনি টক্কর খাচ্ছিল স্কুটিটা। একটুর জন্য এ’ক্সিডেবট হয়নি। নোরা বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাঁপাচ্ছে। আশেপাশের মানুষ বিরক্ত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভ্যানওয়ালা বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেল।

অন্তরা বলল”এই নোরা, কি হয়েছে তোর? ঠিকাছিস? এখনি তো একটা দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল।”

অন্তরা কাঁধ ধরে ঝাকাতেই হুশ ফিরল নোরার। সে বলল,” হ্যাঁ?”

“কি ভাবছিস? তোর কি হয়েছে?”

নোরার মুখে আবার সেই হাসির ঝিলিক। খুশিতে ভাসতে ভাসতে অন্তরার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” অন্তুরেএএএ, জানিস, আজ কি হয়েছে?”

” কি হয়েছে? না বললে জানবো কিভাবে?”

” আজকে অনিকস্যার আমাকে কোলে তুলেছেন।”

এ কথা বলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল নোরা। অন্তরা অবাক হয়ে নোরার মুখের কাছে এসে চিৎকার করে বলল,
” কি? তুই সত্যি বলছিস?”

” হুম।”

” কখন? কোথায়? কিভাবে?”

” ছুটির পর ছাদে গিয়েছিলাম। ওখানে অনিকস্যারও ছিলেন। সিড়ির উপর একটা কালো ট্যাংক আছেনা? উনি ওখানে বসেছিলেন। আমিও উঠেছি। কিন্তু নামার সময় আর নামতে পারছিলাম না। তখন উনি আমাকে কোলে করে নামিয়েছে।”

” সো লাকি! তোর ভাগ্যটা খুব ভালো রে নারু! কিন্তু এখনও এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ সেজুতি বলেছিল অনিকস্যারেরর গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে।”

” এক্ষুনি তওবা কর। এসব অলুক্ষুণে কথা বলতে হয়না।”

” তুই কি সিউর উনি সিঙ্গেল? যদি গার্লফ্রেন্ড থাকে তাহলে কি করবি?”

” প্রশ্নই আসেনা। উনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”

” এত্তো সুদর্শন হ্যান্ডসাম একটা লোক। অথচ কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই? তাও আবার এই যুগে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার!”

নোরা কঠিনগলায় বলল,” তুই কি বলতে চাইছিস?”

” আমি বলতে চাইছি, যদি উনার গার্লফ্রেন্ড না থাকে মানে যদি উনি সত্যিই সিঙ্গেল হয় তাহলে তো ভালোই। খুব ভালো। কিন্তু সেটার সম্ভাবনা টেন পারসেন্ট। আর গার্লফ্রেন্ড থাকার সম্ভাবনা কিন্তু প্রায় নাইনটি পারসেন্ট।”

” তুই পারসেন্টেজ কিভাবে বের করলি?”

” দৈবভাবে চিন্তা করলে পারসেন্টেজ এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।”

“তুই কি সম্ভাবনার অংক কষতে বসলি?”

” আচ্ছা আমাকে বলতো, অনিকস্যার কি তোকে নিজের মুখে কোনোদিন বলেছে যে উনার গার্লফ্রেন্ড নেই বা উনি সিঙ্গেল?”

” না সেটা বলেনি। আমি অনেক কায়দা করে জিজ্ঞেসও করেছি। কিন্তু উনি চালাকী করে বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন।”

” তারমানে গার্লফ্রেন্ড আছে। কিন্তু তোকে বলতে চায়না।”

” বলতে চাইবে না কেন?”

” কারণ উনি ব্যাক্তিগত বিষয় স্টুডেন্টদের সাথে শেয়ার করা পছন করেন না। সবাই তো আর আফজাল স্যারের মতো না। গড়গড় করে খালি গার্লফ্রেন্ডের গল্প বলবে আর চাপাবাজী করবে। ”

নোরা হেসে ফেলল। তারপর বলল,” নিশ্চিত হয়েই বলছি। উনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”

” নিশ্চিত কিভাবে হলি?”

” গার্লফ্রেন্ড থাকলে উনি আমাকে এতো লাই দিতেন না। আমি তো আকার-ইঙিতে বুঝিয়েছি যে আমি উনাকে পছন্দ করি। আর উনিও অবশ্যই সেটা বুঝেছেন। গার্লফ্রেন্ড থাকলে নিশ্চয়ই আমাকে ইগনোর করতেন।”

” উনি তোকে লাই দিচ্ছেন এটাই বা কিভাবে বুঝলি?”

” কাল আমাদের চ্যাটিং দেখালাম না তোকে? আর আজকে ছাদে যাওয়ার ঘটনাটাই ভাব।”

” সব ভেবেই বলছি। তুই আগে ভালোমতো নিশ্চিত হয়ে নে। উনার মতো ছেলেদের আমার কেন জানি বিশ্বাস হয়না। তোর আলভীর কথা মনে নেই?”

” তুই আলভীর সাথে উনার তুলনা করছিস? আলভী তো একটা ফ্রড।”

” হ্যাঁ আমি জানি অনিকস্যার আলভীর থেকে শতগুণে ভালো। কিন্তু তবুও ভয় হয়। সুন্দর ছেলে তো! ওদের প্যাশনই হচ্ছে দুই-তিনটা করে গার্লফ্রেন্ড পালা। আর আলভীর সাথে উনার চেহারার কোথায় একটা মিলও আছে। আমি চাইনা তুইও আমার মতো ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে বসে থাকিস।”

” কোনো চান্সই নেই। আর আমি তোর মতো অন্ধ না। আলভীকে দেখলেই বোঝা যেত ও যে একটা ফ্রডমার্কা। সবাই বুঝতো খালি তুই বুঝতিনা। প্রেমে অন্ধ হয়েছিলি।”

” এমন অন্ধ তুইও হয়ে যাস না।”

” হবো না ইনশাআল্লাহ। ”

নোরা ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় বারবার নিজেকে দেখছে। আর একাই একাই হেসে উঠছে। এখনো অনিকের ছোয়া ভুলতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে অনিক এখনো তাকে ছুয়ে আছে। এতো ভালোলাগা নিয়ে কিভাবে থাকবে সে?নোরা ঠিক করেছে পরনের জামাটা সে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখবে। কক্ষনো ধোঁবেনা। তাহলে অনিকের ছোয়াটা মুছে যাবে। এই ছোয়া কক্ষনো সে মুছতে দিবেনা।

রাতে অনিক অনলাইনে আসেনি। তবুও নোরা ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছিল। সেই রিপ্লাই এখনও আসেনি। নোরার ঘুম আসছে। কিন্তু সে কষ্ট করে জেগে আছে। অনিকের সাথে কথা না বলে সে ঘুমাতে যাবেনা।নোরার ইচ্ছে পূরণ হলনা। অনিক সারারাত একবারের জন্যেও অনলাইনে আসেনি।

নোরা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে আবার মেসেজ চেক করল। অনিক তখনও অনলাইনে নেই। বারো ঘণ্টা আগে একটিভ ছিল। নোরার হালকা চিন্তা হল। সারাদিন ছটফট করতে থাকল কখন কোচিং এ যাওয়ার সময় হবে। তাহলে অনন্ত একবার অনিকের সঙ্গে দেখা হবে। এর আগে সে শ্বাসও নিতে পারবেনা। অবশেষে ঘড়ির কাটা চারটায় পৌছাল। নোরা চারটার আগেই বেরিয়ে পড়েছিল।

কোচিং ঢোকার সময় ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের কথাবার্তা নোরার কানে আসল। একটা মেয়ে বলছে,” এই শুনছিস, অনিকস্যারের নাকি পা ভেঙেছে।”

আরেকজন বলল,” এজন্যই কি স্যার আজকে আসেনি? তুই কিভাবে জানলি?”

” আদনান স্যারের কাছে শুনেছি। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন।”

নোরা এসব কথা শুনে অস্থির ভাব শুরু করল। ক্লাসে ঢোকার সময় দরজার বাহিরে সেজুতি আর অন্তরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,” এই তোরা জানিস? অনিকস্যারের নাকি পা ভেঙে গেছে।”

সেজুতি বলল,” হ্যা শুনেছি। আর আমরা তো উনাকে দেখতে যাওয়ারই প্ল্যান করছিলাম।”

নোরা বলল,” আমিও যাবো।”

অন্তরা বলল,” তুই এতো জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কেন? আর ঘামছিস কেন এভাবে? রিল্যাক্স! পা ভেঙেছে। মরে তো যায়নি।”

নোরা ধমকে উঠল,” তোর সবসময় আজে-বাজে কথা তাইনা? মরবে কেন?”

সেজুতি হেসে ফেলল। নোরা কঠিনচোখে তাকিয়ে বলল,” তুই হাসছিস? এইরকম একটা পরিস্থিতিতে হাসছিস?”

“তুই যেমন করছিস হাসি পেয়ে গেল। সরি দোস্ত।”

” যাইহোক।শোন আমি অনিকস্যারের বাসায় যাচ্ছি। তোরা কে কে যাবি আয়।”

অন্তরা সেজুতি একসাথে বলল,” আমি যাব।”

নোরা বলল,” ঠিকাছে তাহলে চল।”

সেজুতি বলল,” আরে এক মিনিট। এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? তুই কি উনার বাসা চিনিস?”

“হ্যা চিনি। একবার গিয়েছিলাম।”

সেজুতি বলল,” আচ্ছা এখুনি কেন যেতে হবে? ছুটির পর যাই?”

” অসম্ভব। আমি ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবোনা। আর ক্লাসেও আমার মন বসবে না। ”

অন্তরা বলল,” কিন্তু ক্লাস ছেড়ে গেলে যদি বাসায় ফোন যায়?”

সেজুতি বলল,” একজেক্টলি। আমিও সেটাই বলছি।”

নোরা বলল,” তাহলে একটা কাজ করি, আমরা আদনান স্যারের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে নেই। উনাকে একটু কনভেন্স করতে হবে। কে পারবি?”

সেজুতি বলল,” আমি ট্রাই করবো।”

” ঠিকাছে তাহলে চল।”

আদনান স্যারের পারমিশন পাওয়া গেল। নোরা,সেজুতি আর অন্তরা স্কুটারে করে বিশমিনিটের মধ্যে অনিকের বাসায় পৌঁছাল। গিয়ে তারা দেখল তন্নী,জবা, রেশমি, সাদিয়া সবাই এখানে আছে। অনিকস্যারের মা তাদের যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন। নোরার মনখারাপ হল। সে আরেকটু আগে আসতে পারল না?

নোরাদের ড্রয়িংরুমে বসতে দেওয়া হল। তন্নীরাও সেখানেই বসেছে। নোরা শুধু আশেপাশে অনিককে খুঁজছে। তার ছটফটানিটা কেউ ধরতে পারছে না। কিন্তু একজন বুঝে ফেলল। খুব সুন্দর দেখতে একটা আপু নোরাকে বলল,” তোমার কি বসতে অসুবিধা হচ্ছে?”

নোরা হাসার চেষ্টা করে বলল,” না আমি ঠিকাছি।”

সেজুতি বলল,” আসলে ও স্যারকে নিয়ে খুব টেনশনে আছে।”

অন্তরা মুখ টিপে হাসল। নোরা কঠিনচোখে তাকাল। আপুটা হেসে বলল,” তোমাদের স্যার সুস্থ আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। এখন ঘুমাচ্ছে তো, ঘুম থেকে উঠলেই তোমাদের সাথে দেখা করবে।”

সেজুতি বলল,” আপনি কি স্যারের বোন?”

মেয়েটা বলল,” বোন না বড়আপু।”

অন্তরা বলল,” ও আচ্ছা, আপু আপনার নাম কি?”

” আনিকা।”

আনিকা ওদের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করল। গল্পের মাঝখানে অন্তরা নোরাকে কানে কানে বলল,” দোস্ত ওয়াশরুমে যাব।”

” তো যা না।”

” তুই আমার সাথে যাবি?”

” এটা কি কোচিং এর ওয়াশরুম যে আমাকে যেতে হবে? তুই যা তো।”

অন্তরা উঠে চলে গেল। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও অন্তরা আসছেনা। তাই নোরা উঠে গেল অন্তরাকে খুঁজতে। অন্তরা বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। নোরা তাই দেখে এগিয়ে গেল,” অন্তু কি হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

অন্তরা কান্নার জন্য কথাও বলতে পারছেনা। শুধু কেঁদেই চলেছে। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর অবশেষে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,” নোরা, দোস্ত আমি এখানে আলভীকে দেখেছি।”

” কি? আলভী এখানে কোথ থেকে আসবে?”

” জানিনা। আমি ওকে দেখেছি।”

” ও তোকে দেখেছে?”

” না ও দেখেনি। আমি ওকে দেখেই অন্যদিকে ঘুরে গিয়েছিলাম। তারপর ওখান থেকে চলে এসেছি। তাই দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি এবার কি করবো? আমার তো আবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”

” অন্তু তুই মনে হয় ভুল দেখেছিস। আলভী এখানে কিভাবে আসবে?”

অন্তরা শব্দ করে বলল,” আমি ঠিকই দেখেছি। ওইটা আলভীই ছিল।”

কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে উঠেছে অন্তরার। নোরা ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শুধু। অন্তরা আবার বলল,” আলভী নিশ্চয়ই অনিকস্যারের কেউ হয়। হয়তো অনিকস্যারের আপন ভাই? অনিকস্যারের কি কোনো ভাই আছে?”

” আমি তো জানিনা। শুধু শুনেছিলাম বড়বোন আছে। আর তাকে তো দেখলিই। আনিকা আপু।”

অন্তরা নোরার দুইহাত ধরে বলল,” নোরা তুই বলেছিলি না প্রতিশোধ নিবি? এখন প্রতিশোধ নেওয়ার সময়,সুযোগ দুটোই এসেছে। তুই প্রতিশোধ নে।”

” মানে? কিভাবে প্রতিশোধ নেব?”

অন্তরার চোখেমুখে হঠাৎই হিংস্রতা ভর করল। সে নিষ্ঠুরগলায় বলল,” আলভী তো অনিকস্যারের ভাই। তুই অনিকস্যারকে ফাসাবি। তারপর ছ্যাকা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিবি। আমার যেমন অবস্থা হয়েছিল উনারাও তেমন অবস্থা হবে। তাহলেই আলভী বুঝবে।”

নোরা এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। ঢোক গিলে বলল,” অন্তরা তুই পাগল হয়ে গেছিস। আমি এটা কোনোদিন করতে পারবনা। আলভী যদি উনার ভাই হয়েও থাকে তাহলে তার অপরাধের শাস্তি উনি কেন পাবেন?”

অন্তরা নোরার হাতটা নিজের মাথায় ছুয়িয়ে বলল,” আমার কসম বল। তুই প্রতিশোধ নিবি। তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড? প্রুভ ইট।”

নোরা অন্তরার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বলল,” ছি। এভাবে কসম কাটতে হয়না। গুণাহ হয়।”

” এসব বলে তুই আমাকে ভোলাতে পারবিনা। তোকে কথা দিতেই হবে। আচ্ছা নোরা, তুই কি সব ভুলে গেছিস? ছয়টা মাস কতটা কষ্টে কাটিয়েছিলাম আমি! পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম।আমার পাশে কিন্তু কেউ ছিলনা। শুধু তুই ছিলি। ছায়ার মতো আমার পাশে ছিলি। তুই না থাকলে হয়তো আমি সুইসাইডই করে ফেলতাম। আর এখন পাশে থাকবি না? দুইদিনের অনিকস্যারের জন্য আমার এতো দিনের কষ্টগুলো ভুলে যাবি? আলভীকে মাফ করে দিবি?”

” আমি তো মাফ করার কথা বলিনি। আমি শুধু বলছি, যে অপরাধ আলভীর সেটার শাস্তি অন্যকেউ কেন পাবে? অনিকস্যারকে কষ্ট দিলে সেটা হবে বিনা দোষে শাস্তি। এতোবড় অন্যায় আমি কখনোই করতে পারবোনা। আর অনিকস্যারের সাথে তো জীবনেও না।”

” তুই আমার থেকেও অনিকস্যারকে ভালোবাসিস?”

” তুই আর উনি সম্পুর্ণ আলাদা। তুই তো আমার বোনের মতো। তোর কষ্ট যেমন আমি সহ্য করতে পারিনা, তেমনি উনার কষ্টও পারবো নারে। কিন্তু আলভীর শাস্তি হবে। অবশ্যই হবে৷”

” কিভাবে শাস্তি হবে?”

” অনিকস্যারের সাথে না। ধোঁকাবাজী যদি করতে হয় তাহলে আলভীর সাথে করবো৷ ও তোর সাথে যা যা অন্যায় করেছে সব আমি ওকে ফিরিয়ে দিব দেখিস!”

“কিন্তু আলভী তো তোকে চেনে। তুই কিভাবে ওকে ফাসাবি? পারবি না তো।”

“সেজুতি তো আছে। সেজুতিকে দিয়ে করাবো।”

” সেজুতিও পারবে না। আলভী তো সুন্দরের পূজারী। সেজুতিকে দেখে ও পটবেনা। তোর উপর ইজিলি পটে যেতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও তোকে চেনে।”

” তাহলে ফেসবুকে ওকে ফাসাবো। ”

” ফেসবুকে কিভাবে?”

“ফেইক আইডি খুলে নিজের পরিচয় গোপন করবো। সিম্পল!”

” এতো সহজ না। আলভী খুব চালাক। কথায় কথায় ভিডিও কলে আসতে চাইবে, ফোন করতে চাইবে, দেখা করার কথা বলবে। আর এসব না করলে তোকে পাত্তা দিবেনা। বশেও আসবেনা। ওকে আমি ভালো করে চিনি।”

” তাহলে আর কি উপায়?”

অন্তরা আবার কাঁদো কাঁদোমুখে একই কথা বলা শুরু করল,
” নোরা আমি যেটা বলছি সেটা কর। অনিকস্যারকে ফাসা। উনি তো অলরেডি তোর উপর ফিদা। আর ছেলেরা দুই নম্বর মেয়েদের প্রেমেই বেশি পড়ে বুঝেছিস? তুই যদি মন-প্রাণ উজার করে পাগলের মতো ভালোবাসিস, জান-প্রাণ সব দিয়ে দিস, ওরা তোর ভালোবাসা বুঝবেনা। তোকে ঠকাবে, কষ্ট দিবে, ইগনোর করবে। কিন্তু তুই যদি ভালোবাসার নামে নাটক করিস তাহলে দেখবি তোর পেছনেই পড়ে থাকবে। তোর সবকথায় উঠবে আর বসবে। তোকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝবেনা। তুই লাথি মারলেও তুই-ই ভালো।”

নোরা করুণচোখে অন্তরার দিকে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো যে সে খুব কষ্ট থেকে বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অন্তরার প্রস্তাবে রাজি হওয়াও তার পক্ষে সম্ভব না। অন্তরা বলল,” কিরে! পারবি না আমার জন্য?”

” প্রতিশোধ আমি অবশ্যই নিবো অন্তু। কিন্তু অনিকস্যারের উপর না৷ তুই যদি আমাকে তোর জন্য জীবন দিতে বলিস সেটাও আমি পারবো। কিন্তু অনিকস্যারকে কষ্ট দিতে জীবনেও পারবো না। সরি।”

ওদের কথার মাঝখানেই আনিকার ডাক শোনা গেল,” নোরা, তোমরা এখানে কি করছো? তোমাদের স্যার তো ঘুম থেকে উঠে গেছে৷ দেখা করতে যাবে না?”

অন্তরা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে নিল। নোরা হাসার চেষ্টা করে বলল,”জ্বী, আসছি।”
“এসো।”

আনিকার পেছন পেছন নোরা আর অন্তরা হাঁটতে লাগল। নোরা ইশারা করে অন্তরাকে চুপ থাকতে বলল। ফিসফিস করে বলল,” এ বিষয়ে আর কোনো কথা না। আলভীকে দেখলেও স্বাভাবিক থাকবি।”

অন্তরা বলল,” আমি ওর সামনেই যাবনা।”

রুমে ঢুকতেই অনিক নোরাকে দেখে হেসে বলল,” কেমন আছো নোরা?”

নোরা অনিকের দিকে তাকাল। অনিকের মাথায়ও ব্যান্ডেজ, বামপায়েও ব্যান্ডেজ। ঘুম থেকে উঠায় চোখগুলো ফুলে আছে। দেখতে কি সুন্দর লাগছে! এলোমেলো চুলগুলো সাদা ব্যান্ডেজে আটকানো। এই মুহুর্তে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য নোরার কাছে আর কিচ্ছু হতেই পারেনা। প্যান্টের বামসাইড হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। ধবধবে সাদা পায়ে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ। তার উপর কালো লোম দেখা যাচ্ছে। নোরাকে এমন ড্যাবড্যাব করে অনিক স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেজুতি ধাক্কা দিল। নোরা নড়েচড়ে দাঁড়াল। সেজুতি মিনমিন করে বলল,” কন্ট্রোল দোস্ত কন্ট্রোল!”

নোরা লজ্জা পেয়ে সেজুতির কাঁধে একটা থাপ্পড় দিল।আনিকা এসব দেখে হেসে বলল,” তোমরা মারামারি করছ কেন?”

সেজুতি বলল,” ও-ই আমাকে মারে আপু। ডাকাতনি একটা।”

আনিকা হেসে ফেলল। নোরা আঁড়চোখে অন্তরার দিকে তাকিয়ে দেখল সে গম্ভীরমুখে দাড়িয়ে আছে। তন্নী তার এক্সট্রা কেয়ার শুরু করে দিয়েছে। টিফিনবক্সে অনিকস্যারের জন্য পায়েস আর কি কি যেন খাবার এনেছে। ওসব এখন স্যারকে খাওয়ানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। কিন্তু স্যার মিষ্টিখাবার খায়না।

রেশমি জিজ্ঞেস করল,” ডায়াবেটিস নাকি?”

অনিক বলল,” ডায়াবেটিস না, আমার মিষ্টি জিনিসটাই পছন্দ না।”

নোরার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সে সেজুতিকে বলল,
” সেজু, এই তন্নী কি বাচ্চি এতো জিনিস আনলো কেমনে? ও কি আগে থেকে স্যারের অ্যাক্সিডেন্টের খবর জানতো?”

“জানতো মনে হয়। ওর তো সব টিচারদের সাথে এড আছে। হয়তো আপডেট পেয়েছে।”

সেজুতি অন্তরার দিকে তাকিয়ে নোরাকে বলল,” ওইডার কি হইসে? ভুতে ধরছে কেন?”

নোরা বলল,” অনেক কাহিনি। পরে বলবো।”

এতোক্ষণে আলভী ভেতরে আসল। আলভীকে দেখে অন্তরার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। বুকের মধ্যে তুমুলমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হল। অবিলম্বে নোরার পেছনে গিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা শুরু করল অন্তরা। কিন্তু আড়াল হতে পারছে না। নোরা তো খুব খাটো আর অন্তরা তুলনামূলক অনেক লম্বা। তাই নোরার পেছনে দাঁড়ালেও তার মাথা দেখা যাচ্ছে। সে ওরনা দিয়ে অর্ধেক মুখ ঢেকে ফেলল।

আলভী এখনো এদিকে তাকায়নি। অন্তরার ছটফটানি দেখে নোরা বলল,” অন্তু প্লিজ, স্বাভাবিক থাক। তুই এমন করলে আলভী বুঝে ফেলবে যে তুই এখনো ওর প্রতি দুর্বল। তুই কি এটা ওকে বুঝাতে চাস?”

অন্তরা তাকিয়ে আছে আলভীর দিকে। কতদিন পর ছেলেটাকে দেখছে সে। একটুও বদলায়নি। একদম প্রথমদিনের মতোই লাগছে। আবার সেই পূরনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অন্তরার ইচ্ছে করছে ফ্লোরে বসে কেঁদে ফেলতে। এই দুই বছরেও কি একটুও বদলায়নি আলভী? আচ্ছা আলভী কি এখন ওকে দেখলে চিনতে পারবে? হয়তো পারবে। হয়তো না। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে থাকাকালীন অক্টোবর মাসের শেষদিকে আলভীর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল অন্তরার। সেটাই ছিল শেষ দেখা। মানে তাদের জীবনে একবার দেখা হয়েছে। এখন দ্বিতীয়বার দেখা। অন্তরা নিজেকে সামলাতে পারছেনা।

পেছন থেকে অন্তরার কান্নার আওয়াজ শুনে নোরা আতঙ্কিত গলায় বলল,” অন্তু প্লিজ কাঁদিস না। দোহাই লাগে তোর।”

সবাই অনিককে নিয়ে ব্যস্ত তাই এদিকে কেউ তাকাচ্ছেনা। ওদের কথাও কেউ শুনছেনা। আলভী ওদেরকে পিঠ দেখিয়ে অনিকের সামনে বসে গেল। অন্তরা এখন আর আলভীর মুখটা দেখতে পারছেনা। আলভী অনিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,” কি অবস্থা ভাই? এখন ঠিকাছো?”

অনিক বলল,” তেমন কিছু হয়নাই। মাথার একসাইডে একটু কেটে গেছে আর বামপাটা মচকে গেছে। সাতদিন বেডরেস্টে থাকতে হবে।”

আলভী বলল,” তাহলে কি সাতদিন ম্যাচ অফ? ”

” আরে না পাগল? সাতদিন কে বেডরেস্টে থাকে? আমার আরো কত কাজ আছে। আমি তিনদিনেই ঠিক হয়ে যাব।”

আনিকা বলল,” একদম না। তোকে সাতদিন বেডরেস্টে থাকতে বলা হয়েছে৷ এর আগে বিছানা ছেড়ে উঠল আমি তোর ডানপা-ও মচকে দিবো।”

এই কথায় সবাই হেসে ফেলল। হাসল না শুধু অন্তরা। সে তো আলভীকে দেখায় ব্যস্ত। কতটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে ছেলেটা।

আলভী বলল,” ভাই তুমি রান নিতে গিয়া পড়লা কেমনে?”

অনিক চিন্তিত গলায় বলল,” আমার মনে হচ্ছে আমারে কেউ ল্যাং মারছে। তবুও ব্যালেন্স ঠিক ছিল তাই আস্তে পড়ছি। নাইলে এতোক্ষণে উপর থাকতে হইতো।”

আলভী কপাল কুঁচকে বলল,” কি বলো? বিষয়টা তো খুব ডেঞ্জারাস। এভাবে চললে তো খেলা হইবো না ভাই। কয়দিন পর পর খালি অঘটন ঘটতাছে। আচ্ছা তুমি ট্র্যাকিং এ যাইবা?”

” কোনটায়?”

“সীতাকুন্ড, পাহাড় ট্র্যাকিং। ছাব্বিশ তারিখ যে যাইতাসি আমরা? ”

” দেখি, অবস্থা বুঝে নেই আগে।”

” আইচ্ছা ভাই।জানাইয়ো।”

“আচ্ছা।”

” থাকো তাইলে। আনিকা আপু খেয়াল রাইখো ভাইয়ের।”

অনিককে একবার জড়িয়ে ধরে আলভী বিদায় নিল। অন্তরার হৃৎস্পন্দন এতোক্ষণে শান্ত হল। নোরাকে ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল সে। আলভী তাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু যদি দেখতে পেতো তাহলে কি করতো? ওর রিয়েকশন কেমন হতো? জানতে খুব ইচ্ছে করছে অন্তরার।

সেজুতি আর নোরা স্কুটারের পেছনে বসে আছে। সেজুতি সবচেয়ে পেছনে, মাঝখানে নোরা। সামনে অন্তরা স্কুটার চালাচ্ছে। এতোক্ষণে সেজুতিকে সবঘটনা বলে ফেলেছে নোরা। অন্তরা চুপ করে ছিল। হঠাৎ বলল,” নোরা একটা কথা বলি?”

” কি কথা বল?”

” তুই জানিস অনিকস্যারের এই অবস্থার জন্য কে দায়ী? ”

” কোন অবস্থা?”

” খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনা। পা মচকে যাওয়া।”

” ওহ। কে দায়ী? ”

” আলভী।”

“আলভী কেন? তুই কিভাবে বুঝলি?”

” আমি বুঝেছি। আলভীই অনিকস্যারকে ল্যাং মেরে ফেলেছে। ও আমাকে সবসময় ওদের টিমের এক বড়ভাইয়ের গল্প শোনাতো। উনাকে আলভী খুব জেলাস করে।”

” জেলাস করে কেন?”

” ভালো খেলে তাই। প্রতিবার ম্যাচে হিরো হয় সবাই উনাকে কাঁধে তুলে নাচে। এসব ওর পছন্দ হতোনা। সবসময় সেই বড়ভাইয়ের নামে দুঃখ প্রকাশ করতো আমার কাছে। উনাকে কিভাবে ফাঁসানো যায় আমার কাছ থেকে আইডিয়া নিতো। আমি হেল্প করতামও।আমার সেটা অন্যায় মনে হলেও কখনো কিছু বলতাম না। প্রেমে অন্ধ ছিলাম তো তাই। ওকে খুশি করাই তখন আমার মুল লক্ষ্য। এতোকিছু ভাবতাম না। এখন আমি বুঝতে পেরেছি সেই বড়ভাই-ই হচ্ছে অনিকস্যার। সামনে ওরা ট্র্যাকিং এ যাচ্ছে না? সেখানে যেন অনিকস্যার যেতে না পারে সেজন্যই আলভী এতো কাহিনি করেছে। আমি নিশ্চিত।

“ও বাবা! আগে তো জানতাম মেয়েরাই হিংসুটে ভুতনি হয়। এখন দেখছি ছেলেরাও হয়। কিন্তু অনিকস্যার ট্র্যাকিং এ গেলে ওর কি সমস্যা? ”

” বুঝিস না? হিংসা।”

” আর তুই এই আলভীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমাকে বলছিলি অনিকস্যারের লেকফুল করতে? তাহলে তো আলভী কোনো শাস্তিই পেতো না। আরো খুশি হতো। ”

“তখন তো বুঝিনি। ভেবেছিলাম উনি আলভীর আপনভাই।”

” আচ্ছা অন্তু, কেমন হয় যদি অনিকস্যারদের মতো আমরাও ট্র্যাকিং এ যাই?”

” মানে?”

” মানে আমরা সবাই মিলে উনারা যে জায়গায় যাচ্ছে সে জায়গায় গেলাম। তাহলে তোরও আলভীর সাথে দেখা হবে আর আমারও অনিকস্যারের সাথে সময় কাটানো হবে। যদি এর আগে অনিকস্যার সুস্থ হয়ে যায় আর কি।”

“তুই পাহাড় ট্র্যাকিং এর মানে বুঝিস? জীবনে ট্র্যাকিং করেছিস তুই? এটা সোজা রাস্তায় স্কুটি চালানোর মতো না।”

” আচ্ছা গেলেই কি ট্র্যাকিং করতে হবে? আমরা ঈদের ছুটিতে ঘুরতে যাবো,ওরা ট্র্যাকিং করবে আমরা দেখবো।”

“ট্র্যাকিং না করলে গিয়ে লাভ কি? আর থাকবো কোথায়?”

” থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে হবে না। সীতাকুন্ডে আমার খালামণির বিশাল বাংলো আছে। ওখানে আমরা তিনজন আরামে থাকতে পারবো। এই সেজুতি যাবি?”

” তোরা যাচ্ছিস তোদের মতলবে। সেখানে আমি গিয়ে কি করবো?”

” তুইও তোর মতলবেই যাবি।”

” আমার কি মতলব?”

নোরা হেসে বলল,” ঘুরাঘুরি! ”

অন্তরা আর সেজুতি হেসে উঠল। নোরা বলল,” তাহলে ডান। আমরা তিনজন যাচ্ছি ওকে? আর তোদের বাসায় ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”

অন্তরা আর সেজুতি একসাথে বলল, “ওকে।”

তারপর তিনজন হাত মিলাল। নোরা শব্দ করে বলল,” মিশন সীতাকুন্ড।”

তারপর হাত উঠিয়ে তিনজন একসাথে চিৎকার করল।

চলবে