Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 125



ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০৭

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

পর্ব-০৭
শাহাজাদী মাহাপারা

সকাল সকাল মিতার ঘুম ভাঙলো পর্দা ভেদ করে আসা সূর্যের আলোয়। মাথাটা ভার হয়ে আছে। এই সময়ে সে সকালের চা পান করতো। বিগত কয়েকদিন যাবৎ সেই নিয়মের বাহিরে সে। অস্থির জীবন পার করছে। আদৌ জীবনে আছে না ছিটকে গিয়েছে বলা যাচ্ছে না। তার তো আর এক মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলো। এই সময়ে সে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে। আজ এই মুহূর্তে সে আরেকজন পুরুষের বিছানায় শুয়ে আছে। অস্বস্তিতে আবার গাঁ গুলিয়ে উঠতে চাইলো। রুস্মিতা আজহার। দাদী খুব শখ করে তাদের দুবোন এক ভাইয়ের নাম রেখেছেন। রওনক, রুদমিলা, রুস্মিতা। সেই দাদীই ওদের তিন ভাইবোনের জীবনের তেরটা বাজিয়ে এখন ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে পান চিবোয়৷ এই জন্যই রুদমিলা দাদীকে অপছন্দ করে। এতদিনে বুঝলো সে। হায়! আর কিছুদিন আগে যদি বুঝতো তাহলে কি তার জীবনটা আগের মতো হতো? হতো না। বাবা চরম মা ভক্ত মানুষ। অসম্ভব।

মিতা বহু কষ্টে নিজেকে হিঁচড়ে দাড় করালো। সে এই সুন্দর সাদা রঙের দেয়ালের ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। জলপাই রঙের পর্দা। কন্ট্রাস্ট করা বিছানার চাদর, ডিভান, আলমারি, ড্রেসিং। মিতার মনে হলো সে একটা খাঁচায় বন্দী। বাঘের সাথে তার রোজ এক পাতে খেতে হবে। আচ্ছা এই যে সবাই সংসার সংসার করে এই ঘরটা কি কখনো তার সেই সত্যিকারের সংসার হবে?
মিতার হঠাৎ সাদিকের কথা মনে পড়লো। চোখ দুটো ঝাপসা লাগছে মুহুর্তেই। আচ্ছা সাদিক এখন তাকে ছাড়া কি করবে? সে কেমন আছে? তারপর হঠাৎই সম্বিত ফিরল। এইখানেও ট্র‍্যাজেডি। শালার জীবন তার থেকে শুধু নিয়েই গেলো কিছুই দিলো না। এই যে এতো রূপসী রুস্মিতা। কেউ তার দিকে কখনো নজর ভরে তাকিয়ে দেখেছে? সাদিক ভাইয়ের মতো মানুষ। সেও নাকি শেষ পর্যন্ত আপাকেই পছন্দ করে। আপাতো আজীবনই প্রেম ভালোবাসা অগ্রাহ্য করে এসেছে। অথচ সে বিগত চার বছর ধরে সাদিককে পছন্দ করে। কই সাদিকতো একবারও তার ইঙ্গিতে সারা দেয় নি। অথচ সে ভাবতো সাদিক ভাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কথায় হেসে লুটিয়ে পড়ছে। তাকে স্নেহ করছে। ভালোবাসছে৷

মিতার বুক ফেঁটে কান্না আসছে। জীবনটা কেমন মুহুর্তেই একটা অদ্ভুত বাঁক নিলো৷ তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে না পারলে যেন মারা যাবে সে। দৌড়ে বিছানার বালিশে মুখ চেপে হাউমাউ করে উঠলো। মিতার মনে হচ্ছে এক্ষুণি দমবন্ধ হয়ে যাবে। কান্নার দমকে পুরো দেহ তার কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে এখানে আর থাকতে চায় না। এক মিনিটও না, এক মুহুর্তও না।
মুখ থেকে তার চি করে একটা মুদু গোঙানি ভেসে এলো।

খট করে দরজা খুললো। রুস্মিতাকে এমন অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেলো ফারদিন। চট করে দরজা লক করে মিতাকে জাপটে ধরলো৷
“মিতা তুমি ঠিক আছো? সরাও বালিশ। সরাও।”
মিতা বালিশ সরালো না মুখ থেকে উল্টে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। একদম পাথরের মতো। এই প্রথম ফারদিন তার নাম নিয়েছে। কথা বলেছে। কিন্তু মিতার তাকে বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছে না৷ থর থর করে কাঁপতে থাকা ছোট্ট কায়ায় ফারদিন অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে৷ ফারদিন কি তাকে ভালোবাসে? চারদিনে ভালোবাসা হয়? তার ইচ্ছে করছে না ফারদিনের সংস্পর্শে থাকতে। কিন্তু তার দেহ তার সাথে হঠাৎই প্রতারণা করছে। এইসব কি হচ্ছে মস্তিষ্ক আর দেহের যুদ্ধে তার নিজেকে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। ফারদিন মিতাকে শান্ত করতেই চুমু খাচ্ছে অথচ মিতার মনে হচ্ছে সে আবার বাঘের শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে।কিন্তু তার দেহ আরেকটু এই উষ্ণ আলিঙ্গনে থাকতে চাইছে। মিতার হঠাৎ মনে হলো বিগত চার দিনে তার বাসার কেউই তার খোঁজ নেয় নি কোনো। ফারদিনদের তরফ থেকেও বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হয় নি৷ এক মাস পর হবে। মিলা আপু। মিলা আপুও কি একবারও তার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেনি? অবশ্য করবেই বা কি করে। তার জীবনের ঝড়টাওতো কম বড় না। মিতা চোখ তুলে চাইলো ফারদিনের দিকে। ফারদিনের সিম্প্যাথি হোক আর যাই হোক এই মুহূর্তে মিতার ফারদিনকে নিজের কাছের মানুষ মনে হলো। যে তার কান্না শুনলে বিরক্ত বোধ করবে না । বিয়ের রাতেও তো কত কেঁদেছিলো কই ফারদিন তো রাগ করেনি৷ মিতা বালিশ সরিয়ে ফারদিনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো এবারে।
ফারদিন তার বিশাল বাহুর মধ্যে বন্দী করলো মিতা কে৷ মিতার মনে হলো সে ইচ্ছে করে বাঘের থাবার শিকার হচ্ছে। ফারদিনের মনে হলো ছোট্ট একটা বিড়াল ছানা তার বুকে চলে এসেছে প্রোটেকশনের উদ্দেশ্যে। একটাইতো সেই জড়িয়ে ধরা অথচ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে।

****
বাফেট খাবার বিষয়টা মিতার একদমই পছন্দ ছিলো না৷ তবুও সে প্লেটে একটু একটু করে খাবার নিয়ে কোণার দিকের একটা টেবিলে বসে খাচ্ছে। শাড়ি পরা তার কাছে মহাবিরক্তি লাগে। তবুও আজ সে একটা মেরুন কাতান শাড়ি পরে এসেছে ফারদিনের ছোট বেলার বন্ধু বান্ধবীর রিসেপশনের দাওয়াতে। ফারদিনের সব বন্ধু বান্ধবীরাই ডাক্তার। শুধু সে বাদে। এর মধ্যে দু জোড়া কাপল ও আছে। ফারদিন দূরে গ্রে টাক্সিডো পরে দাঁড়িয়ে আছে। কি যে সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে অথচ এত সুন্দর বেশভূষা আসলে একটা কুৎসিত চেহারা ঢেকে রাখার মাধ্যম যা শুধু রাতের আঁধারেই প্রকাশ পায়।

মিতা কাওকে চেনে না৷ ফারদিন নিজেও আগ্রহ করে ওর সাথে কারও পরিচয় করায় নি। মিতাকে ভিতরে আসতে বলে ফারদিন গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছিল এরপর ভিতরে এসে একবারও মিতার খোঁজ নেয় নি। মিতাও বিশেষ একটা গাঁ করলো না। সে নিজের মতো বসে বাকি সবার সাজ দেখায় ব্যস্ত হলো।

আশেপাশের সবাই কি সুন্দর ঝাঁ চকচকে। এই শাড়িটা আপার মানে মিলার। বিয়েতে মিলার জন্য যত লাগেজ দেয়া হয়েছিলো একটা বাদে বাকি সবই তার বাসা থেকে দিয়ে দেয়া হয়েছে।গহনা গুলোও সে নিয়ে এসেছে। এইগুলোতে মিলার আর কোনো অধিকার নেই। এই সব শপিংই মিতার পছন্দের ছিলো। মিলার চয়েজ ভালো না ভেবে মিতার মা মিতাকে মিলার সাথে পাঠিয়েছিলেন সব কিনতে। ভাগ্যের ফেরে ঘুরেফিরে তা মিতার গাঁয়েই চড়লো। মিতার এইসব ভাবতে ভালো লাগে না। কিন্তু একলা থাকলে এইসবই মাথায় ঘুরে৷ তার ছোট মস্তিষ্কটা আরও সংকীর্ণ হয়ে যায়। মন খারাপ হয়। তাই মিতা খাবার নিয়ে বসেছে। ধীরে ধীরে খাচ্ছে। বর বউ কে দেখা যাচ্ছে স্টেজে। পাশে বাকি সব বন্ধুরা। সবাই মিলে ছবি তুলবে তাই দাঁড়িয়ে আছে। কারো অপেক্ষা করছে সম্ভবতঃ৷ ক্ষনিক বাদেই সবাই হই হই করে উঠলো৷ স্টেজে একটা লম্বা চুলের মেয়ে উঠে যাচ্ছে। খুবই সিম্পল সেজেছে। অথচ কি অন্যরকম সুন্দর লাগছে। অবাক কান্ড সেও মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে।

সবার সাথে হাত মিলিয়ে ফারদিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তিশা। ফারদিন মুচকি হাসলো। সবাই আরেকদফা হই হই করে উঠলো। মিতার ভালো লাগছে না৷ এটা অদ্ভুত একটা অনুভূতি। সে বেজায় বিরক্তবোধ করছে। আচ্ছা তার কি উপরে যাওয়াটা ঠিক হবে? তার কি ফারদিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো উচিৎ? সবাইতো কাপলরা ছবি তুলছে। তারাও তো কাপল।যেভাবেই হোক বিয়ে হয়েছেতো। হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই মিতার চোখ পড়লো স্টেজে সব কাপলরা বসে ছবি তুলছে বর বউয়ের সাথে। ফারদিনের সাথে মেয়েটা দাঁড়ানো। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা গেলো না। মিতা উঠলো স্টেজে যাবার উদ্দেশ্যে ।

চলবে…

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-৫+৬

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব- ০৫

শাহাজাদী মাহাপারা

মিলা সেই কখন থেকে সবার কথা শুনছে। মুহিনের অপেক্ষায় অপেক্ষায় বিরক্তি হচ্ছে। এখনো আসছে না কেনো? এই বাড়ির জঞ্জাল পরিষ্কার করতে অনেক সময় লেগে যাবে। দুতিন দিন তো লাগবেই একদিনে অসম্ভব। লুবা জিজ্ঞেস করলো, ” বার বার ঘড়ি দেখো কেন নতুন বউ? বরের অপেক্ষা আর সয় না তাই না?”

” হয় হয় অমন নতুন নতুন সবার হয়।” মরজিনার কথা শুনে সবাই নিচু স্বরে হাসলো।

শিফা বললো, ” এত কথা হলো কিন্তু আসল কথাইতো হলো না রেশমি আপা। ওদের বিয়েটা নোটিশ ছাড়াই কিভাবে হলো? ”

” হ্যাঁ তাইতো!” কলি বললো।
মিলা বুঝতে পারলো আজ সব গর্ত খুড়া হবে। রেহায় নেই। এরা এতো কথা বলে কেনো? কলিং বেলের আওয়াজে মিটিং পন্ড হলো। মিলা যেন এই বেলেরই অপেক্ষায় ছিলো। উড়ে গিয়ে দরজা খুলে এতো মিষ্টি করে হাসলো যে মুহিন ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। হাতের থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে সে বললো, ” আপনি চিলে এসেছেন? এতো দেরি হলো যে?” ভিতরে গিয়ে সে সোজা রান্না ঘরে গেলো। ব্যাগে লেবু দেখে লেবুর শরবত বানিয়ে এনে মুহিনের মুখের কাছে গ্লাসটা ধরলো৷

মুহিন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেই প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে মুহূর্তেই পরিস্থিতি সামাল দিলো। সালাম দিয়ে কুষলাদি জিজ্ঞেস করলো। মিলার বসা চেয়ারে গিয়ে সেও বসলো। ভাবিরা টিটকিরি করেই বললাও,”কি বউ আনছো মুহিন? প্রথম দিনেই তোমারে দৌড়ানি দেয়াইছে বাজারে।”

টিপ্পনী কাটা যেনো আনন্দের।হেসে হেসে তারা বলেও ফেললো, ” রেশমি ভাবির বোনকে বিয়ে করলে না তুমি, ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়ে দেখাইলাম বিয়ে করলে না। অথচ এক দিনের বিনা নোটশে বউ ঘরে তুলছো। তুমি তো একটা ঘাঘু।”

মুহিন বোকা বোকা হাসলো প্রতি উত্তর করলো না। রেশমির ঋণ অনেক মুহিনের উপর৷ মুহিন রেশমি বলতে বোঝে আপন বড় বোন। সে রেশমিকে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে৷ বিপদে রেশমিকেই সবার আগে পাশে পেয়েছে সে। কিন্তু রেশমি যখন নিজের বোনের সাথে তার বিয়ের কথা বলেছিলো তখন সে রাজি হয়নি। এর পিছনেও কারণ রয়েছে যা সে রেশমিকে বলেনি।

মুহিন হেসে বললো, ” হুট করে বিয়ে করার জন্য দুঃখিত ভাবি। তবে পরিস্থিতিই অমন ছিলো যে কাওকে জানাবার সুযোগ হয়নি। ক্ষমা করে দিবেন। আপনারা সবাই আমার বিপদে আপদে পাশে ছিলেন কিন্তু আমি গতকাল অকৃতজ্ঞের মতো কাজ করেছি।”

মন গললো সবার। রেশমি বললেন,
” আরে এটা নিয়ে এতো পেরেসান হবার কি আছে? ও কি আজীবন এমন থাকবে নাকি? ওর বাচ্চাতো খুব ছোট। বিয়ে না করলেই বরং অস্বাভাবিক হতো বিষয়টা৷ তোমরা যে কেন ছেলেটার পেছনে লেগেছো?”

সবাই রেশমিকে খুশি করতেই বললো, ” ঠিক বলেছেন ভাবি। তবে আমরা মুহিনের সাথে মজা করবো বলেই বলছিলাম। ভাই মুহিন তোমার প্রতি আমাদের কিন্তু কোনো রাগ নেই। তুমি একদম ঠিক কাজ করেছো। কিন্তু কি এমন হয়েছিলো যে এইভাবে হুট করে বিয়ে করলে? পারসোনাল হলে বলো না।”

মুহিন পাশে দাঁড়ানো মিলার দিকে তাকালো। মুহিন জানে এখন কারণটা বললে মিলার অস্বস্তি হবে। তাই সে বললো, ” আমার অফিসের বসের সম্বন্ধির মেয়ে মিলা। বসের কথাতো ফেলা যায় না ভাবি। চাকরির ব্যাপার সেপার বোঝেনই তো। তাই আরকি। তাছাড়া মিলাও মাহতাবকে পছন্দ করেছে।”

লুবা বললো, ” আর তোমাকে করেনি বুঝি?”
মুহিন না চাইতেও লজ্জা পেয়েছে এমন ভাব করে মিলার দিকে তাকালো। একি! কি আশ্চর্য!
মিলা কি সত্যিই লজ্জা পেয়েছে? অমন মাথা নিচু করে হাসছে ঠিকাছে কিন্তু ওর ফর্সা গাল জোড়া লালাভ হয়ে আছে কেনো? সত্যিই কি লজ্জা পেয়েছে! নাকি গরমে এমন হচ্ছে?

সবাই চলে যেতেই মিলা ধপ করে সোফায় বসলো। ক্লান্ত লাগছে তার। সবাই বলে গিয়েছে পরে সময় করে এসে মিলার চেহারা দেখার জন্য গিফট দিয়ে যাবে। ওরাও সম্মতি দিয়েছে। মুহিন দরজা আটকে এসে সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো, “ওরা কখন এসেছিলো?”
মিলা বললো, ” এক ঘন্টা আগে। আপনি এতো দেড়ি করলেন কেনো?”
” আপনার বিয়ের শাড়িটা লন্ড্রিতে দিয়ে এসেছি এইজন্যই আরেকটু দেড়ি হয়ে গেলো।”

মিলা ফের জিজ্ঞেস করলো, ” আচ্ছা,আপনি তাদের সত্যিটা বললেন না কেনো?” মুহিন চোখ সরিয়ে নিলো।

” লেবুর শরবতের জন্য ধন্যবাদ।”
” কথা এড়াচ্ছেন কেনো?”
” কথা এড়াচ্ছি না। আমি গিয়েছিলাম আপনার ফুফার বাসায়। স্যার কয়েকদিন যাবৎ অফিস আসছেন না। কিছু ফাইল সাইন করানো দরকার ছিলো। চাইলে পিয়নের হাতে পাঠিয়ে দিতে বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি আমাকে নিজে গিয়ে তা দিয়ে আসতে বলেছেন। আমিও গিয়েছিলাম সেই উদ্দেশ্য থেকেই। অথচ গিয়ে দেখি আপনি প্রায় কনে সেজে বসে আছেন। আপনার বিয়ের শাড়িটা কিন্তু আমার কেনা না । আপনার ফুফুই কিনে রেখেছিলেন৷ মিলা আমি হয়তো আপনাকে পরিস্থিতিটা ঠিক ভাবে বুঝাতে পারছি না। ”

মিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
” থাক বাদ দিন। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। নামাজে যাবেন। আমি রান্না চড়াই৷ এমনিতেই সময়ের সাথে কুলানো যায় না তার উপর উটকো ঝামেলা।”
মুহিনের লাগলো।
” উঠকো ঝামেলা বলবেন না মিলা। বিপদের সময় এনারাই আমার পাশে ছিলো। একদিন দেখবেন আপনার পাশেও দাঁড়িয়েছে। ওইযে রেশমি ভাবিকে দেখেছেন না? সবার আগে উনিই ঝাপিয়ে পড়বে।” মুহিন আর মিলার উত্তরের অপেক্ষা করলো না। দৌড়ে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। আজ বাথরুমটা মানুষের বাথরুমের মতো লাগছে। সকালেই মিলা পরিষ্কার করেছে বাথরুম। আজ বাথরুম আর বসার ঘর পরিষ্কার করার কথা ছিলো। সমস্যা হচ্ছে মিলা সবকিছুতেই শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শর্তে শর্তে জর্জরিত জীবন। শর্ত গুলো নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন যা জরুরি তা হলো মিলাকে বোঝা। তাকে বুঝতে না পারলে সম্পর্কটা নিয়ে এগুনো সম্ভব না। মিলা রগচটা। সম্ভবতঃ সবকিছুতেই তার বিরক্তি। কিন্তু মনের দিক দিয়ে ভালো। খাঁটি মানুষ।

মিলা মাহতাব কে ঘুম থেকে উঠিয়ে খায়িয়ে দিয়েছে। সে নিজেও গোসল করে নিয়েছে মাহতাবকে ঘুমে রেখে। মিলা মাহতাবকে অপছন্দ করে না৷ প্রশ্নই আসে না। তার ভাইয়ের বাচ্চাটাও মাহতাবের মতোই মাত্র দু মাসের বড়। মিলার মন খারাপ হয় বাচ্চাটা কেমন মা ছাড়া৷ মা থাকতেও নেই৷ তার মতই কিছুটা অভাগী। তার মা তাকে বুঝতে পারেনা। এই দুঃখ তার কোনোদিনই ঘুচবে না। মুহিনের অপেক্ষা করছে সে। সবাই নামাজ পড়ে চলে এসেছে মুহিনেরই দেরি হচ্ছে। এই লোক সবকিছুতেই ঢিলা কিন্তু বিয়ের সময় একদম ঠিক টাইমে পৌঁছে গিয়েছিলো। বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে মুহিন গেইটের ভিতরে ঢুকছে। হাতে কি? স্প্রাইটের বোতল৷ মিলার হঠাৎ মনে হলো সে বিবাহিত। সত্যিই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অদ্ভুত অনুভূত হলো।

খাবার টেবিলে বসে মুহিন বললো, ” মাহাতাব খুব বিরক্ত করছে কি? আসলে আমি ছাড়া ও খুব একটা কারো সাথে মিশে নি।”
” বিরক্ত হবো বলেইতো এসেছি।”
মুহিন বুঝলো না মিলার কথাটা। সে ফের বললো,
” আসলে মাহতাব শুধু আমার আর রেশমি ভাবির কাছেই যা থেকেছে। এছাড়া তেমন কাউকে চিনে না। তাই যদি বিরক্ত করে বেশি আপনি প্লিজ একটু ধৈর্য নিয়ে হ্যান্ডেল করবেন।”

” আপনাকে মাছের মাথাটা দিবো? রুইয়ের মাথা। টমেটো আর নতুন ফুলকপি দিয়ে রেঁধেছি। একটু খেয়ে বলুনতো কেমন লাগে?”

মুহিন ভেবেছিলো মিলা এমনটাই বলবে কারণ মুহিনের প্লেটে সাদা ভাত বাড়া। মিলা চামচ নিয়ে তরকারির বাটিতে ঘাটছে।
মিলা কিছুই বললো না। নিজের প্লেটে মাছের চাকা টুকরো তুলে নিলো। মুহিন কিছুক্ষণ মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেই বেড়ে খাওয়া শুরু করলো। এই নারী বড়ই নির্লিপ্ত। এর সাথে সংসার করা খুবই কঠিন কর্ম হবে।

চলবে…

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

পর্ব-০৬
শাহাজাদী মাহাপারা

অফিস থেকে ফেরার পথে মুহিনের ফোনে কল এলো। মুহিনের বস বলবে নাকি ফুফা শ্বশুর বলবে তিনি কল করেছেন। রিসিভ করে সালাম এবং কুশল বিনিময় করে তিনি মুহিনকে জানালেন মিলার আব্বা আম্মা তাদের মিলাদের বাসায় যেতে দাওয়াত দিয়েছেন। মুহিন বুঝলো না উত্তরে কি বলা উচিত!কারণ যে পরিস্থিতি থেকে তারা এসেছিলো আর তাছাড়া মিলার বাবারই উচিৎ ছিলো তাদের কল করা৷ ফুফা শ্বশুরকে দিয়ে কল দেয়ানোটা বেক্ষাপ্পা লাগে। যদিও তিনিই সবকিছুর কর্তা৷ মুহিন বললো, সে মিলাকে জিজ্ঞেস করে জানাবে। মিলা যদি রাজি থাকে তবেই তারা দাওয়াত গ্রহণ করবে৷

মুহিন বাসায় ঢুকতেই তার চোখটা জুড়িয়ে গেলো। বিগত একবছরে এই বাসার যে পরিবর্তন হয়েছিলো তা চোখে দেখার মতো ছিলো না৷ তার মনে দু ধরণের অনুভূতি খেলছে। এক ভালো লাগার আরেক বিষাদের। মিলা কি সুন্দর করে ড্রয়িং রুমটা সাজিয়েছে। নতুন সোফা কাভার লাগিয়েছে। এই মেয়ের কি বাজে খরচের ধাত আছে? না থাকলেই ভালো। নইলে তার পকেট “আমদানি আঠান্নি খরচা রুপিয়া” প্রবাদের মতো হয়ে যাবে। গত এক বছরে বুয়ার পিছনে যাওয়া যে পয়সা সে বাঁচিয়েছে সব শেষ হবে মনে হচ্ছে।

সোফায় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো সে। কুসনের কাভার গুলো সুন্দর। রুচি আছে মিলার। মিলা রুমে ঢুকে বললো,” সোফা কাভার রেশমি ভাবিরা গিফট করেছেন। ওনারা আসলে বিকেলে বাসায় এসেছিলেন অনেক কিছু নিয়ে। বললেন বিয়ের গিফট। আমাদের উচিত সবাইকে একদিন দাওয়াত করে খাওয়ানো।”

মিলা কথা বলার সময় তার গলা দিয়ে খুশি বেয়ে পড়ছিলো৷ অথচ দুদিন আগেও এই বিয়েতে তার কি ভীষণ আপত্তি ছিলো।
” গিফট পেয়ে খুব খুশি মনে হচ্ছে। দেখেছেন বিয়ের কিন্তু লাভও আছে।”
মিলার হাসি পেলেও সে হাসলো না । উলটো টিপ্পনী কাটলো।

” হ্যাঁ। তাতো অবশ্যই। আপনার বাসার যে হালত ছিলো এক বছরে। বিনা পয়সার বুয়া পেয়েছেন সাথে নয়া নয়া জিনসপত্র উপহার পাচ্ছেন আপনার সংসার সাজানোর জন্য। লাভ তো অবশ্যই আছে।”

মুহিন ধরাশায়ী হলো। এই মহিলার সাথে মজাও করা যাবে না। মানুষকে নাস্তানাবুদ করতে সে পারদর্শী।

” কথায় কথায় খোঁচা দিয়ে অপমান করার ট্রেনিং কোথায় করায় আমাকে যদি বলতেন তাহলে আমিও ভর্তি হতাম ক্লাস করতে। ”
মিলা দমলো না।

” রুদমিলা’স পোক এন্ড ইনসাল্ট ট্রেনিং সেন্টারে। আপনার জন্য বিশেষ ছাড় থাকবে।”

মুহিন কিছুক্ষণ ভেবলার মতো তাকিয়ে থেকে ঘর কাপিয়ে হাসলো। মিলার কোলে মাহতাব ছিলো তাকে সোফায় শুয়িয়ে দিয়ে সে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিলো মুহিনের সামনে।

“আমি শুধু কুসন কাভার গুলো অর্ডার করেছিলাম সোফার কাভারের সাথে। যখন চলে যাবো তার আগে সব হিসাব চুকিয়ে দিয়ে যাবো। আমি খাতায় নোট করে রাখছি কোথায় কত খরচ করছি।”

মুহিন পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে মিলার দিকে তাকালো। বিশেষ কিছুই বললো না। ঢকঢক করে গ্লাসের পানি খালি করে মাথা ঝাকালো।

” আপনার ফুফা কল করেছিলেন।”
” কি বললেন?”
” আপনার বাবা আমাদের দাওয়াত করেছেন। ”
” ও৷ আপনার সময় হলো একদিন যাবো।”
মুহিন একটু অবাক হলো। মিলা সত্যিই সে বাড়িতে যেতে চাচ্ছে?
যেতে চাইতেই পারে। সারা জীবন কি সব ধরে রেখে বসে থাকা যায়? বাবা মায়ের সাথে বেশিদিন অভিমান করে থাকা যায় না।

******
খাবার টেবিলে বসে সবাই খাচ্ছে। হঠাৎ গমগমে কন্ঠ ভেসে এলো বা পাশ থেকে। মিতা মাথা নিচু করে আছে। ভদ্রলোক বললে,
“তুমি ফিরবে কবে?”
পাশ থেকে আরেকটা ভারী কন্ঠ বললো,
” মাস খানেক পর ফিরবো। তাছাড়া মিতার পাসপোর্ট আর ভিসা করতে দিয়ে যাবো। হয়ে এলে ওকে পাঠিয়ে দিবেন।”
মহিলা কন্ঠ বললো,
” কেনো? ওর আবার কিসের পাসপোর্ট,ভিসা? শোনো ফারদিন ওর সাথে তুমি কোনো প্রকার স্বাভাবিক বৈবাহিক সম্পর্কে যাবে না। এই মেয়েকে আমি যেভাবে নিয়ে আসছি ওইভাবেই ফেরত পাঠাবো। কতবড় বাটপার গুষ্টি এরা। দেখো কিভাবে মাথা নিচু করে দেখছে সব ভাব খানা এমন ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। উলটে দিবো তোমার মাছ?” মিতার প্লেটে তখন সত্যিই একটা ভাজা মাছ ছিলো।
” আহ! তামান্না।” ভদ্রলোকের কন্ঠে বিরক্তি।
” তুমি এক কি প্যাঁচাল শুরু করেছো অশিক্ষিত মহিলাদের মতো। আর বাটপারের গুষ্টি আবার কি? ভুলে যাও কেন ওটা আমার চাচার ছেলে। আমার ভাই হয়।”
মুখ ঝামটালেন তামান্না খানম। ফাররুখ জামান সাহেব সেদিকে পাত্তা দিলেন না।
ফারদিন চুপচাপ খাচ্ছে তার এইসবে কোনো মাথা ব্যথা নেই। মিতার গলা দিয়ে আর খাবার নামতে চাইলো না। সে তবুও প্লেটের অবশিষ্ট খাবারটুকু শেষ করলো। তামান্না এই নিয়েও একচোট কথা শুনালেন।
” দেখো দেখো কেমন গোগ্রাসে গিলছে। কি হাভাতারে মেয়ে।” মিতা না পারতেই বললো,
” খাবার অপচয় করা উচিত না। আল্লাহ পছন্দ করেন না। আমার বাটপার আব্বাও পছন্দ করেন না।”
তামান্না সহ টেবিলে থাকা ফারদিন, ফাররুখ আর তারিন কে অবাক করে দিয়ে সে উঠে হাত ধুয়ে নিজের প্লেট ধুয়ে রুমে চলে গেলো।

মিতার সবকিছুতেই বিরক্তি বোধ হচ্ছে। গহনা,কাপড়, মেকাপ সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। অথচ এইতো এক মাস আগেও তার শাড়ি,গহনার কত কত শখ ছিলো। জানালা দিয়ে মস্ত বড় একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় পুরো রুমটা রুপালি রঙ ধারণ করেছে। অথচ তার কাছে তাও যেন বিষাক্ত লাগছে। এমন রাতগুলোতে আপা আর সে এক বিছানায় জড়াজড়ি করে ঘুমাতো। গলা ছেড়ে গান গাইতো।

মিতার চোখের কোন বেয়ে নেমে আসা অশ্রুও চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। ফারদিন রুমে ঢুকেছে কখন টের পায়নি সে। পেটে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। আবার!
ভয়ে শরীর কাঁপছে তার।

এইযে কিছুক্ষণ আগে এই লোকটার মা তাকে নিষেধ করলো মিতার সাথে কোনো প্রকার শারীরিক, মানসিক সম্পর্কে যেতে। কি বিশ্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি৷ অথচ এই লোকটার আসল চেহারা সে তার মাকে দেখাতে পারেনি। আজ চার দিন চলছে মিতার বিয়ের। প্রথম রাত থেকে মিতার শরীরের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে এই লোক। রাতভর এমন শক্ত পেশির নিচে পিষ্ট হচ্ছে সে। দমবন্ধ হয়ে আসতে চায় অথচ চিৎকার করতে পারে না। মিতার ফের ভয় হলো এই লোক তাকে শুধু ভোগবস্তু হিসেবেই দেখে। সদ্য বিশে পা দেয়া মিতার নরম শরীরের আজ একটুও শক্তি নেই। আজ মিতার শাশুড়ি তাকে দিয়ে চারটা বিছানার চাদর ধুয়িয়েছে। এতো ভারি চাদর সে কখনো ধোয়নি। এমন কি তাকে কখনো শক্ত কোনো কাজও করতে হয় নি৷ সে রান্নায় নিপুণা কিন্তু ভারী কাজ করতে পারেনা। এত গুলো চাদর ধুয়ে ছাদে নেড়ে দিয়ে এসে সে একটু শুতে চেয়েছিলো। তিনি তার বান্দবীদের চা নাস্তার দাওয়াত দিয়েছিলেন। মিতাকে পটের বিবি সাজিয়ে তাদের সামনে শোপিস করে বসিয়ে রেখেছিলেন। দুপুরের খিদে আর ঘুমে মিতার ঘাড়ের রগ টনটন করছিলো ব্যথায়। বমিও চলে আসছিলো একেক জনের বিদেশি পারফিউমের ঘ্রাণে। তার শাশুড়িকে চুপিচুপি সে বলেছিলো। অথচ ভদ্রমহিলা বলেছে এমন মিথ্যা ছুতো দিয়ে সে উঠে গেলে নাকি তার মান ক্ষুন্ন হবে। জোড় করেই তাকে বসিয়ে রেখেছে।

এখন ব্যথায় তার সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসতে চাইছে। ফারদিন মিতাকে ফিরিয়ে তার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিতেই মিতা আর সহ্য করতে পারলো না। সমস্ত শক্তি দিয়ে ফারদিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। ফারদিনের সাদা টিশার্ট মিতার বমিতে মাখামাখি অবস্থা। মিতা মুখ হাত দিয়ে চেপে দৌড়ে ওয়াশরুমে গেলো। রাগে ফারদিনের চ্যখের শিরাগুলো লাল হয়ে আছে। সে বাথরুমের দরজায় তার বিশাল হাত দিয়ে কয়েকবার থাবা দিলো। মিতা বের হলো না। তার নিজেকে নাড়ানোর শক্তিটুকু নেই। ফারদিন দ্রুত গেঞ্জি খুলে বাথরুমের সামনে ছুড়ে ফেললো। নিজের আরেকজোড়া ট্রাউজার গেঞ্জি নিয়ে বাহিররের ওয়াশরুমে ঢুকলো। তার ঘৃণা লাগছে। ফারদিনের যাবার আওয়াজ শুনে মিতা বাথরুম থেকে বের হলো। ফারদিনের গেঞ্জি দিয়েই মেজের বমি মুছলো। ফের ধুয়ে এনে আরেকটা মোছা দিয়ে। তা সাবান পানিতে চুবিয়ে রাখলো। কাল বুয়াকে দিয়ে ধোঁয়াবে। আর নইলে ওটাকে ঘরে পা মুছার কাপড় বানাবে। এ ঘরে শুধু একটা পাপস। বাসার কাজের লোকেরাও স্লিপার পড়ে হাটে। শুধু তার পা খালি। তাই ময়লা বাঝে বেশি। ভালো হলো একটা পাপস পাওয়ায়। সে হাত মুখ ধুঁয়ে এসে কম্ফোর্টার টেনে শুয়ে পড়লো।

চলবে…

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০৪

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
শাহাজাদী মাহাপারা
পর্ব-০৪

অগ্রহায়ণের শেষ প্রায়৷ চারপাশে মৃদু অন্ধকার। গতকাল সারাদিনের ভ্যাপসা গরমকে ছাপিয়ে বর্ষণের তাড়াহুড়ো পুরো প্রকৃতিজুড়ে। মেঘেরা নিজেদের মাঝেই একটু পরপর গুড়ুম গুড়ুম করে কথা বলে উঠছে। মুহিনের শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। ক’টা বাজে? ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো পাঁচটা। রাতে তার ঘুমটা ঠিক হয়েও হয়নি। ছাড়া ছাড়া ঘুমের কারণ মিলা আর মাহতাব। মিলা একটু পরপরই বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে৷ মাহতাব কে দেখেছে। অথচ এই নারীর সাথে মাহতাবের সৎ নামক সম্পর্ক। মাহতাব ঘুমানোর পরই হয়তো সেও ঘুমিয়েছে। মুহিন উঠেনি ইচ্ছে করেই, আর তার শরীরটাও সায় দিচ্ছিলো না। নয়তো রোজ রাতে সে মাহতাবের জন্য জেগে থাকে। ভোরে ঘুমায় ৯ টায় অফিস যায়। বাসায় আসে রাতের ৮টায়। ততক্ষণ মাহতাব থাকে পাশের ফ্ল্যাটে৷

মুহিন আলমারি থেকে দুটো কাথা হাতে নিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়ালো। একটা ফিচলে হাসি দিয়ে ফের একটা কাথা আলমারিতে রেখে বিছানায় উঠে বসলো। মিলা শীতে কাচুমুচু হয়ে ওড়না জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে এক হাত মাহতাবের উপর। মুহিন ফ্যান কমিয়ে জানালা লাগিয়ে কাথা ওদের গায়ে দিতেই মিলা লুফে নিলো। মুহিন মাহতাবকে ঢেকে কিছু অংশ নিজে নিয়ে বিছানায় শুতেই খেয়াল করলো মিলা মাহতাবকে নিয়েই তার দিকে চেপে আসছে। মেয়েটার ঠান্ডা পা দুটো তার পা স্পর্শ করছে। মুহিন ঘাবড়ে গেলো। ধীরে নিজের পা দুটো সংযত করে মিলার দিকে ফিরেই ঘুমালো। উপরে ক্যামেরা সেট করা থাকলে অবশ্যই এটাকে একটা সুখী পরিবার বলা যেতো। সে হিসেবে মাহতাব খুবই ভালো বাচ্চা সে মোটেও কোনো প্রকার নড়াচড়া করেনি। ফ্যান কমিয়ে দেয়ায় এখন আর তেমন ঠান্ডা অনুভত না হওয়ায় মিলা কাথাটা টেনে নামালো কিছুক্ষণের মাঝেই মুহিনের চোখে তন্দ্রা লাগলো।

মিলার যখন ঘুম ভাঙলো তখন আশে পাশে কোথায় হলুদ গাঁদা ফুল গান বাজছে। সে উঠেছে বুকের স্পর্শকাতর স্থানে কারো হাতের ছোঁয়ায়। স্পর্শটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। অভ্যাস বসত ভেবেছে রুশ্মিতা। সে নিচু স্বরে বললো,
” মিতা সরে শো। আম্মু টিভির সাউন্ডটা একটু কমাও।”
কিন্তু সাউন্ড কমলো না। বিরক্তি নিয়ে মিলা আর দিন গুলোর মতোই ঘড়ির দিকে তাকালো। আরে ঘড়ি কই? লাফ দিয়ে উঠে বসে চোখ ডললো। এটা কই? তার মাথা হ্যাং হয়ে আছে। ধাতস্থ হয়ে পাশে হাত দিলো। মাহতাব খেলছে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে অ আ করে মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ করছে। তার পাশে মুহিন উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে এক হাত মিলার দিকে। মিলার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ধারা নিচে নামলো। ওটা মুহিনের হাত ছিলো! ভয় পেলেও বুঝলো ঘুমের মাঝে হয়েছে কাজটা। মুহিন তখনও মৃদু নাক ডাকছে। সে বিছানা ছাড়লো শরীরে ওড়না ঠিক করে মুহিনের দিকে তাকালো। একটা কাথায় শুয়ে ছিলো ব্যাপারটায় অস্বস্তি লাগলো মিলার।

বেশ ক্ষানিকক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজছে। মিলা বিরক্ত হলো। বাথরুম থেকে বের হয়ে লুকিং গ্লাসে নজর দিলো। কয়েকজন মহিলা দাঁড়ানো। আজ ছুটির দিন হওয়ায় মুহিন অফিস যায় নি। তবে মিলা তাকে কিছু বিশেষ কাজ দিয়েছে যা না করলেই নয়। এটাকে আসলে বাসা না পুরানো স্টোর রুম বলা চলে যা দশ বারো বছরে একবার পরিষ্কার করা হয়। মিলা দরজা খুললো।

“আসসালামু আলাইকুম।”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি মুহিন সাহেবের বউ?”
” জ্বি। উনিতো বাসায় নেই কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছেন। কিছু বলবেন?”
মহিলা গুলো মিলার কথার গুরুত্বই দিলো না। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। মিলা টাল সামলাতে না পেরে দেয়ালে বাড়ি খেলো। হুড়মুড়িয়ে ছ’ সাত জন মধ্য বয়সী নারী ঘরের ভিতর ঢুকলো। সোফার উপর ঝাড়ু দেখে একজন বললো, ” যাক এবার এই ভূতের বাড়িটা মানুষের বসবাসের যোগ্য হবে।”
সবাই একচোট হেসে নিলো।
” আমি এই বাসার বাড়িওয়ালি। তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।”
মিলা মুচকি হাসলো।

ভদ্রমহিলার নাম রেশমি। বয়স কত হবে ৩৫-৪০ এর মধ্যে। কাপড় চোপড়ে আভিজাত্য ফুটে উঠেছে। চেহারায় জৌলুস। বেশ সুখী সুখী ভাব। মিলা এখন এনাকে কি বলে সম্বোধন করবে? আন্টি? আপু? ভাবি?
তিনি মিলাকে পা থেকে মাথা অব্দি খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যাবেক্ষণ করলেন।

তারা সোফায় বসলেন৷ মিলা বুঝলো না কি করা উচিৎ তার এই মুহূর্তে। সে বাসায় দেখেছে অতিথি আসলে আপ্যায়ন করা খুবই জরুরি। কিন্তু কি দিয়ে করবে? শুধু চা খাওয়াবে এক কাপ?

মিলা একটু হেসে বলল,” আপনারা বসেন৷”
বলেই রান্না ঘরে গেলো। একটা পাতিল মেজে তাতে পানি চড়ালো। আশেপাশে চা পাতির ডিব্বাটা খুঁজলো। সকালেতো মুহিন এখানেই দেখিয়েছিলো৷ চিনি, চায়ের পাতি, দুধের বয়াম চামচ, ছাকনি সব রেডি। কিন্তু দিবে কিসে? ড্রয়িং রুম থেকে এখনো হাসির শব্দ আসছে৷ পানি ফুটতেই চা পাতা দিয়ে চুলার আঁচ একটু কমিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো। সবাই বসে আছে। সে একটা চেয়ার টেনে বসলো।
” চা বসিয়ে এসেছো?”
” জ্বি। একটু অপেক্ষা করুন।”
” শুধু চা খাওয়াবে সেমাই দিবে না?”
” আসলে আমি তো গতকালই এসেছি কোথায় কি রাখা আছে এখনো জানিনা।”
সবাই ফের হাসলো। বোকার মতো চেয়ে আছে মিলা। এতে হাসির কি হলো। একে একে সকলে নিজেদের নাম বললেন কলি, শেফা, মরজিনা, আঁখি, শিখা, লুবা আর রেশমি। এরা হচ্ছে এই বাড়ির ভাবি গ্যাং। চার তলার বাসার সব দুটো করে ফ্ল্যাটের সবাই থাকেন। মুহিনের সাথে তাদের তিন বছরের পরিচয়। মুহিন বিয়ের পর নতুন এ বাসায় শিফট হয়েছিলো এরপর থেকে এখানেই আছে। এর মাঝে জীবনের কিছু উত্থান পতন হলো৷ যার চাক্ষুষ দর্শি এনারা।

মিলা চায়ের কাপের সেট বের করলো৷ ধুয়ে চা ঢেলে এনে পরিবেশন করলো। সাথে চানাচুর। গতকাল রাতে মুহিন খাবারের সাথে চানাচুর আর বিস্কিটের প্যাকেট এনেছিলো। ভাগ্যিস এনেছিলো নইলে এখন কি দিতো? তবে এমন রসানো গল্পের সময় চানাচুর না হলে চলেই না। বহু কিছুই জানা যাবে এনাদের থেকে। জীবনে সংগ্রামের সে এখনো কিছুই দেখেনি। কিন্তু এনারা সিদ্ধহস্ত সকলেই। শিখতে লাজ নেই। তাই হাত বাড়ালেই যে শিখিয়ে দেয়ার লোক পাওয়া গিয়েছে তা ভেবেই স্বস্তি এলো মনে।

চায়ে চুমুক দিয়ে রেশমি বললেন,
” চা ভালো হয়েছে। মিষ্টিও ঠিক আছে। রান্না পারো? ”
” পারি কিছুটা।”
” মুহিন ভাই ভীষণ ভোজন রসিক। একে বাঁধতে হলে আগে নিজের হাত দুটোকে কষ্ট দিতে হবে।” এনাদের পুলক দেখে মনে হচ্ছে এরা অল্পতেই হেসে গড়িয়ে পড়ার মতো অমায়িক। কিন্তু কুটনীতি সব জায়গাতেই রয়েছে। এখানেও আছে।

” মুহিন ভাইকে আভা যাওয়ার পর কত বিয়ে দিতে চাইলাম তিনি তো বিয়ে করতেই রাজি ছিলেন না৷ অথচ দেখো সেই বিয়ে ঠিকি করলেন। ” শিখা বললেন।
ওমনি রেশমি গলাখাকারি দিলেন।

আভা! এটাই তবে মাহতাবের মায়ের নাম। কি আশ্চর্য মিলা কিছুই জানে না৷ নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে নির্বোধ প্রাণী মনে হচ্ছে।

রেশমি বললেন, ” মুহিনকে তো আমার ছোট বোনের সাথে কত বার বিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু রাজিই হলো না৷ সে নাকি আর বিয়েই করবে না। আর যদি করেও তাহলে নাকি দেখতে ভালো না, অল্পশিক্ষিত আর বাচ্চা নিবে না আর এমন মেয়ে বিয়ে করবে।”

আঁখি রেশমির সাথে তাল দিয়ে বললো,
” কই! এখন দেখছেন ঠিকি সুন্দরী বউ আরেকটা বিয়া করছে। এইটাতো আগেরটার থিকাও সুন্দর। কি সুন্দর ভাসা ভাসা চোখ! ”

মিলা বুঝতে পারছে না সে হাসবে নাকি রাগ করবে? তারা কি দারুণ ভাবে মুহিনের ভালো চায় বলে ক্রিটিসিজাম করে ফেললেন। একেই বলে, মুখে মধু চালে কদু।

মিলাকে রেশমি এতক্ষণ পর মনে পড়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলেন, ” আরে তোমার নামইতো জানা হইলো না। মুহিনতো ফট করে বিয়ে কইরা আনছে। কিছুইতো জানায় নাই।”

মিলা হেসে বললো,
” আমি রুদমিলা। ইডেন মহিলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি। ”
” আরে তুমিতো অনেক শিক্ষিত। দেখছেন ভাবি? কতবড় ছুপা রুস্তম?”
” দেখলাম। অথচ আমার বোনটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। একাউন্টিং এ বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে।”

মিলা বুঝতে পারলো রেশমির আক্ষেপ। তার সুন্দরী শিক্ষিতা বোনকে অজুহাত দেখিয়ে মুহিন নাকচ করে ঠিকি সুন্দরী শিক্ষিতা বিয়ে করেছে। অথচ তার বোন মিলার থেকেও যোগ্য। মিলা ঘড়ি দেখলো সাড়ে বারোটা বাজে।আজ আর কাজ সম্ভব না৷ মাহতাব ঘুমাচ্ছে৷ এই ছেলেটা এতো ঘুম কাতুরে৷ মুহিনের আসতে আর কতো দেরি? তরকারি কিনতে গিয়েছে না চাষ করতে বুঝতে পারছে না। এদের বিদায় করাও সম্ভব না। সুতরাং এখানেই বসে এগুলো শুনতে হবে। গসিপ শুনতে তার সমস্যা নেই কিন্তু গসিপের কেন্দ্রবিন্দু সে নিজে, তার স্বামী, প্রাক্তন আর ছোট্ট মাহতাব। তাই অস্বস্তি হচ্ছে।

চলবে…

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০৩

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
শাহাজাদী মাহাপারা

পর্ব-০৩

এই মুহূর্তে এই ছোট রুমটাকেও মিলার কাছে বিশাল মনে হচ্ছে। সিলিংফ্যানের ঘটঘট আওয়াজ আর তিনজন মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। রাত ৩টা বাজে। চোখে ঘুম থাকলেও নতুন জায়গা বা বিছানা বদল যেকোনো একটা কারণে তার তন্দ্রাটা ঠিক ঠাক ভাবে আসছে না। নাকি পাশে পুরুষ রয়েছে বলেই এমন হচ্ছে!

খুব স্বাভাবিক। ছাব্বিশ বছরের মধ্যে মাত্র পাঁচ বছর সে বাবার সাথে ঘুমিয়েছেলো। এরপর থেকে অন্য কোনো পুরুষের সাথে ঘুমায়নি। সেখানে এতো রীতিমতো স্বামী। পরপুরুষ না হোক পুরুষ তো। ধর্ম, আইন, সমাজ এমন কি নিজের শরীর সব কিছুর কাছেই সে বৈধ।আর মনের কাছে? উত্তর নেই।

মুহিন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে৷ আজ সারাদিনের দৌড় ঝাপের পর তার মাঝে রোম্যান্টিসিজম আসলেও তা ফলানো সম্ভব নয়৷ এমন কি চিন্তা করাও মহাপাপ। তাই রাতের খাবার গলা দিয়ে নামতেই সে বিছানাকেই নিজের প্রেয়সী বানিয়ে ভোস-ভোস করে নাক ডাকছে। নাক ডাকা তার ধাতে নেই তবে ক্লান্ত লাগলে এমন টা হয়। মাঝখানে মাহতাব ঘুমাচ্ছে তার পাশে ওই সুন্দর রমণী যার জন্য হঠাৎ করেই তার বরফ হয়ে যাওয়া মনটা একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে। সে অবশ্যই কোনো মহা পুরুষ না, মানসিক রোগীও না৷ তাই নারী দেহ পাশে থাকতে অভুক্ত থাকবে এটা রীতিমতো হাস্যকর। তবুও নিজের লিপ্সাকে প্রাধান্য দেয়নি সে। জানে এই বিয়ে, সংসারটা স্বাভাবিক না। এখানে বৈধতা থাকলেও ভালোবাসা নেই, প্রেম নেই। তার বিয়ে করার উদ্দেশ্য মাহতাবকে মা দেয়া। আর মিলার কি উদ্দেশ্য তা সে এখনো সঠিক জানে না। আর তার নিজের আত্মসম্মান বোধ প্রবল। তাই মিলার কাছে নিজের চরিত্রে দাগ পরতে দিতে নারাজ।
মিলা উঠে বসলো। কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

গোসল করে বের হতেই দেখলো মুহিন বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। এখনো সারাদিনের কাপড় ছাড়ে নি। মিলা বারান্দায় গিয়ে কাপড় নেড়ে টেবিলের অপর প্রান্তে এসে বসলো। মুহিন এবং সে দুজনেই এখন মুখোমুখি। মিলা খেয়াল করলো মুহিনের চোখ মুখে ক্লান্তি। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক অথচ ঘন চুলে মাথা ভর্তি। একটু যত্নের অভাব। এ বাসায় সব কিছুতেই যেন যত্নের অভাব টের পায় সে। সে যে খুব যত্নশীলা তেমনটা না। সে অলস। কিন্তু টুকটাক কাজ সে অবশ্যই করে। তবে আজ মনে হচ্ছে কাজের মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছে। পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সিগনালটা তখনই বিপ বিপ করে আওয়াজ করেলো। ঘাবড়ে গেলো মিলা। দ্রুত বেডরুমের দিকে তাকালো, আওয়াজে মাহতাব উঠে না যায়। ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে মুহিনও তাকালো। স্মিত হেসে বললো,
” দুঃখিত।” মিলা ফের মুহিনের দিকে তাকালো।
” ওভেনে খাবার গরম দিয়েছিলাম। আপনার ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চই।”
” জ্বি।” মিলার মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে ক্ষুধায়। ক্ষুধা পেটে তার ঘুমও আসে না।
মুহিন একে একে প্লেটে খাবার সাজিয়ে মিলার সামনে রাখলো।
” আসলে আজ রান্না হয় নি। আর আমার রান্না হয়তো আপনি খেতে পারবেন না৷ আমি বাসায় খাই না বাহিরে রাতের খাবার সেরে ফিরি। সামনে একটা হোটেল দেখেছেন না? সেখানেই। আর সকালের নাস্তা আর লাঞ্চ অফিসেই করি।”
এজ এক্সপেক্টেড। মিলার মনে হলো সবকিছু স্বাভাবিক করতে বেশ সময় লাগবে৷ বিয়েটা হুট করে হওয়ায় সে মুহিন সম্পর্কে কিছুই জানে না। আজকালকার যুগে এমন পাত্রী দেখতে এসে বউ নিয়ে বাড়ি ফেরা বিষয়টা তার কাছে অদ্ভুৎ আর হাস্যকর মনে হতো। অথচ কি কপাল তার ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে – ‘ যে যারে নিন্দে, সে তারে পিন্দে’। অর্থাৎ যাকে বা যে জিনিসকে অপছন্দ করবা বেশি ওটাই তোমার সাথে ঘটবে। প্রবাদটা যেনো স্বশব্দে তার গালে চড় বসিয়েছে অথচ সে চড়ের শব্দ তার কর্ণকুহর ছাড়া আর কোথাও প্রতিধ্বনিত হয় নি।
মিলা ফোস করে শ্বাস ছাড়লো। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডিম, মুরগীর তরকারি, লেবু,শসা এক গ্লাস পানি সবই সামনে আছে। মিলা মুহিনকে ভদ্রতা থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি খাবেন না?”
” খাবো। আপনি খেয়ে নিন। আমি ফ্রেশ হয়ে খাবো। বাথরুমে বাবুর কাপড় ভেজানো ধুঁয়ে দিতে হবে।”

মিলা চুপ করে রইলো। মুহিন মাথা নিচু করে বসে আছে।

” আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি বসছি।”
কথাটা মিলা বলতেই পারতো কিন্তু তার ধারে কাছ দিয়েও গেলো না। ক্ষুধার্ত মিলার মাথা ধরার বাতিক রয়েছে। সে দ্রুত প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে মুখে তুলে চিবানো শুরু করলো। মুহিন বোকার মত চেয়ে রইলো। এই মেয়ের মধ্যে সামান্য সহমর্মিতা, সৌজন্যতাবোধ নেই। সেও যে সারাদিনের না খাওয়া এইটুকু এই মেয়ে জানার চেষ্টাও করলো না। মুহিন এক গ্লাস পানি গিলে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো, “আরাম করে খান।” মিলা ওর কথা শুনলো কিনা বোধগম্য হলো না। সে কচ কচ করে শসা গুলোতে কামড় বসাতে ব্যস্ত।

মুহিন রুমে গিয়ে দেখলো মিলার বিয়ের শাড়িটা অবহেলায় মেঝেতে পড়ে আছে। চুড়িগুলো ড্রেসিং টেবিলের উপর যেনো কেউ ছুড়ে ফেলেছে। সবকিছুই কেমন এলোমেলো। মুহিন শাড়িটা মেঝে থেকে তুলে ভাজ করে রাখলো। এটা আগামীকাল লন্ড্রিতে দিতে হবে। মিলা বমি করেছে এই শাড়ি পরা অবস্থায়। যদিও বমি কাপড়ে লাগে নি তবুও। মুহিন তাওয়াল নিয়ে বাথরুমে গেলো ফ্রেশ হতে। ঢুকেই ধাক্কা খেলো বালতিতে কাপড় নেই। ভেজানো কাপড়গুলোতো এইখানেই ছিলো৷ দৌড়ে বারান্দায় গেলো। মিলা খাবার খেতে খেতেই মুহিনকে দেখছিলো। মুহিন বারান্দা থেকে এসে আবার বাথরুমে ঢুকলো। কৃতজ্ঞতাবোধ করলো। যতটা ভেবেছিলো ততটাও খারাপ না মেয়েটা৷ এই একদিনে কত উদ্ভট সব কান্ড ঘটে গেলো অথচ খুবই সাধারণ সব বিষয়াদি। গোসল করে বের হয়ে দেখলো খাবার টেবিলে সব ঢাকা। মিলা নেই। সে বারান্দায় গিয়ে নিজের কাপড় নেড়ে খাবার খেয়ে ঘরে এসে দেখলো মিলা বসে আছে।

” আপনার ফেসবুক আইডি নেই?”
চট করে তাকালো মুহিন।
” হ্যাঁ, আছে।”
” নাম বলুন।”
মুহিন ঘাবড়ালো। সে কি বিয়ের বিষয়টা পাবলিক করবে? নাম বলতে সমস্যা নেই। কিন্তু তার আইডিতে গেলে এই মেয়েটা কষ্ট পাবে। নাও পেতে পারে কারণ ওদের মধ্যে কোনো মানসিক টান এখনো তৈরি হয় নি। আইডি জুড়ে তার প্রথম প্রেমের ছাপ। যা সে এখনো মুছে ফেলতে পারেনি। আইডির ছাপতো কিছুই না এই যে বিছানায় ঘুমাচ্ছে এই বাচ্চাটা এটাতো তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্ত্রীর একটা অংশ। সে তাকেও মুছতে পারেনি নিজের জীবন থেকে। বিছানায় তাকিয়ে সে ভাবছে আইডি দিবে কি না?

মিলা বুঝতে পারলো৷
“থাক লাগবে না। ফোন নাম্বারটা দিন অন্তত।”
মুহিন ফোন নাম্বার বললে মিলা নাম্বার হাজবেন্ড লিখে সেভ করলো। তার প্রথমে অস্বস্তি হলেও এটাই ঠিক মনে হচ্ছে। এমন কি ইমার্জেন্সি ডায়ালে সে বাবা মায়ের নাম্বারের সাথে মুহিনেরটাও এটে দিলো।

মুহিন জিজ্ঞেস করলো, ” আপনার নাম্বারটা?”
” মিসড কল দিয়েছি সেভ করে রাখুন।”
মুহিন মিলার নাম্বার ওয়াইফ লিখে দুটো লাভ ইমোজি দিয়ে সেভ করলো। হাস্যকর হলেও তার মজা লাগলো।কি অদ্ভুৎ প্রহসন চলছে। সে তার প্রথম স্ত্রীর নাম্বার এইভাবে সেভ করেনি। সেটা তার নামেই সেভ করা ছিলো।
মুহিনের ফোন থেকে ওয়াইফাই স্ক্যান করে মিলা ফেসবুকে ঢুকলো।

এই বাসায় তার প্রথম স্ত্রীর কোনো ছবি নেই। যেদিন ডিভোর্স পেপারটা পেয়েছিলো সেদিনই সব ছবি সে নিজে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছিলো। সে রাতের কথা সে আর ভাবতে চায় না। জানালার কাছে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো।

মুহিন সিগারেট খাচ্ছে দেখে মিলা বললো,”আপনি বাসায় থাকলে এইসব খাবেন না প্লিজ। আমি এইগুলোর ধোঁয়া সহ্য করতে পারিনা। আর এইগুলোতে আপনার নিজের ফুসফুসতো যাচ্ছেই সাথে বাবু আর আমার ফুসফুসও যাবে।” মুহিন দুটো টান দিয়ে ফেলে দিলো। সিগারেট শুরু করে কলেজে থাকা সময়৷ এরপরও খেয়েছে। কিন্তু মাহতাব আসার খবর পেয়ে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো। ডিভোর্সের পর থেকে আবার শুরু করেছে।বেশি না রোজ একটা খায়। কোনো কোনো দিন দুটো। এমনও রাত গিয়েছে যখন সারা রাত ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ধোয়াসা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মাহতাবের কথা ভেবে কমিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে আবার বন্ধ করতে হবে।

মুহিন রুমে এসে শুয়ে পড়লো। আগামীকাল ফেসবুকের সব ছবি ডিলিট করে দিতে হবে। তার চেয়ে ভালো ডিএক্টিভ করে নতুন একাউন্ট খোলা। সে তাই করবে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে মুহিন ঘুমিয়ে গেলো। এর মধ্যে মাহাতাব পটি করলো, রাতে ক্ষুধার জন্য উঠে কান্না করলো মিলা খুব সুন্দর মাহতাবকে ভাত খাওয়ালো অল্প অল্প করে। সেই সন্ধ্যার পর ঘুমিয়েছিলো বেচারা।খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ খেলার পর সে আবার ঘুমিয়ে গেলো। মিলার পাশেই। মিলা হাসলো। মুহিনের ছেলেকে নিয়ে একটুও হুশ নেই। আজব তো! সে বুঝতে পারলো মুহিন ইচ্ছে করেই উঠেনি। সে জানে মিলা সামলে নিবে। কি করে জানলো? আচ্ছা, মাদার ইন্সটিংক্টের মতো কি ফাদার ইন্সটিংক্ট ও কাজ করে? কাল সকালে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে।

এটা সেটা চিন্তা করে মিলার আর ঘুম হলো না। সারা রাত সে এপিঠ ওপিঠ করেই কাটালো। আচ্ছা এই বিয়েটা স্বাভাবিক হলে এখন তারা কেমন অবস্থায় থাকতো? ওরা নিশ্চই বাকি দম্পতিদের মতো নফল নামাজ পড়তো। মুহিন কি প্রথমেই তার অধিকার আদায় করতো? নাকি সারা রাত একে অপরকে জানার জন্য প্রশ্নে প্রশ্নে সুখ খুঁজতো। নানাবিধ প্রশ্ন সে নিজেই নিজেকে করলো উত্তরও সে নিজেই বের করলো।

ফজরের আযানের পর তার চোখটা একটু লেগে এলো।

চলবে…

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০২

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

শাহাজাদী মাহাপারা
পর্ব-০২

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মাহতাব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সোফার উপর৷ কিছুক্ষণ আগেই সুজি খাইয়েছে মিলা। সারা বিকাল কান্না করে করে এখন মাথা চোখ বুক সব ব্যথা করছে। বিকেলে মাহতাবের কান্না থামার পরই মুহিন বাসা থেকে বের হয়েছে। যাওয়ার আগে “একটু বাহিরে যাচ্ছি” বলেই দরজা লাগিয়ে চলে যায়। মিলার মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।
এইরকম একটা অসুস্থ পরিবেশে তাকে প্রায় জোর করেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে তার।বারবার কান্না ডুকরে উঠছে বুকের ভিতর।কিন্তু আসলেই কি তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছে? ব্যাপারটা ঠিক তা না। সে এক বুক অভিমান আর আত্মসম্মানবোধ থেকেই এখানে। পরে পরে পঁচে বা শরীরে জং ধরে যাচ্ছে এইসব কথা শোনার চেয়ে এইখানে বিয়ে বসাটা তার কাছে বেশ সহজ মনে হয়েছিলো তখন। কিন্তু এখন অস্থির লাগছে। কি করে সব সামলাবে? নিজের ভেতর ভয় আর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। মিলা মাহতাবকে কোলে নিয়েই আশেপাশে দেখতে লাগলো। এই বাসায় যে মহিলা মানুষ দূরে থাক বুয়াও আসে না তা বুঝতে বাকি নেই তার। পুরো বাসায় কোণায় কোণায় ঝুল, মাকড়সার বাসা। এত ছোট বাচ্চা নিয়ে এই লোক এমন নোংরার মধ্যে থাকে, কি করে সম্ভব! আচ্ছা এই লোক যে বেতন পায় একটা বুয়াতো রাখতে পারে৷ বাচ্চাটা সারাদিন থাকে কোথায়? নিজের মনে হাজারটা প্রশ্ন কিলবিল করছে মিলার। রান্না ঘরের দিকে গেলো সে। সিংকে দুটো প্লেট, গ্লাস, বাবুর একটা ফিডার আর বাটি পরে আছে।

হেঁটে হেঁটে অবশেষে বেডরুমের দরজা খুললো। প্রথমেই যেটা তার মন ভালো করে দিলো তা হলো নির্মল বাতাস। এতো সুন্দর বাতাস রুমের জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকছে। তার সাথে বেবি পাওডারের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো মিলা। মন খারাপিটা অনেকটাই কেটে গেলো। একটা বড় একটা খাট, কিং সাইজ বেড। সুন্দর একটা চাদর বিছানো। বাচ্চাদের মশারি, বালিশ, কোলবালিশ সবই আছে। একটা বড় তিন স্টোরের আলমারি একপাশে, আরেকপাশে ড্রেসিং টেবিল, বিছানার এক পাশে বেড সাইড টেবিল, একটা ওয়াড্রোব, একটা ছোট টেবিল-চেয়ার। ময়লা কাপড় রাখার ঝুড়ি আর একটা ময়লার ঝুড়ি রাখা রুমে।

এই হলো বাসার হাল হকিকত। মিলা মাহতাবের দিকে তাকালো। প্রথমে সে ভেবেছিলো মাহতাবের বয়স দেড় বছর তবে এখন বুঝতে পারছে তার বয়স ১ বছরের বেশি না। এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে একা পালা সত্যিই মুশকিল। মাহতাব হাত দিয়ে মিলার খোপা করা চুলে একটু পর পর হাত দেয়ার চেষ্টা করছে। ছোট ছোট হাত। মিলা হাতটা সামনে এনে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। কি কপাল! নিজের বাচ্চা পালার বয়সে আরেকজনের বাচ্চা পালতে হচ্ছে। নিজেকে ন্যানি ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হলো না তার। হ্যাঁ ন্যানিই তো। আর আমেরিকান ভাষায় বেবি সিটার বলে। সে তো এই বিয়ে বসেছে বাচ্চা পালার দায়িত্ব নিতেই। সে যে অথর্ব না তা সে দেখিয়ে দিতেইতো এত বড় গুরু দায়িত্ব নিয়েছে।

মিলা রান্না ঘরে গেলো আবার এটা সেটা ধরে ধরে দেখলো।মাহতাবকে খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিলো রান্না ঘরের মেঝেতেই। তারপর হাতের কাছে সুজি দেখে একটু সুজি বানালো। রান্নাটা এখনো পুরোপুরি করায়ত্ব করতে পারেনি সে। এইভাবে আরেক জনের কিচেনে ঢোকাটা তার কাছে চরম অস্বস্তির কাজ। কিন্তু আজ সে আরেকজনের ত্যাগ করা সব কিছুই নিজের করে নিচ্ছে একটু একটু করে৷ সুজি বানানো শুরু করলো সে। ফোনের ডাটা অন করে বাচ্চাদের সুজির রেসিপি বের করে তাই বানালো। নিজের জন্যও বানালো একটু চিনি বেশি করে দিলো। চিনি দুধ সামনেই ছিলো সব। এই শাড়িতে আরও খারাপ লাগছে রান্না ঘরে আগুণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। মাহতাব টিয়া পাখিটাতে একটু পরপর চাপ প্রয়োগ করতেই সেটা আওয়াজ করছে আর মাহতাবের মুখের মৃদু হাসে দেখা যাচ্ছে।

মিলা সুজি বানিয়ে মাহতাবকে চামচ দিয়েই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়ালো। মাহতাবও বেশি নখড়া না করে খেয়ে নিলো। মিলার মনে হলো মাহতাব অভুক্ত ছিলো অনেক। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে গেলো। মিলা ওকে সোফায় শুয়িয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে দম ফেললো। সুজিটা গিলে তারও পেটের জ্বালা কমেছে। ক্ষুধা সহ্য হয় না মিলার। বাবার বাড়িতে কখনো রাগ করে না খেয়ে থাকতে হয় নি। বাবা জোর করে হলেও খাইয়েছে। মা একশো বকা দিলেও খাবারের সময় একশোবার ডেকেছেন। চোখে টলটলে অশ্রু কিন্তু আর কাঁদতে ইচ্ছে করছে না মিলার। মিলার মনে হলো মাহতাব আসলে মিশুক বাচ্চা। নাহলে এতো ছোট বাচ্চা মা ছাড়া কারো কোলে যেতে চায় না। আর তার যেহেতু শুধু বাবাই আছে সুতরাং বাবা ছাড়া কাওকে ধরতে অনুমতি দিচ্ছে এমন কি মিলাকে দেখেছে কয়েক ঘন্টা মাত্র তাতেই সে মিলার সাথে মিশে গিয়েছে। মিরাকেল টাইপ ব্যাপার স্যাপার।

মেইন ডোরের দিকে নজর যেতেই উঠেই চাবিটা লাগিয়ে দিলো ভেতর থেকে। ভদ্রলোক আসলে নিশ্চই কলিংবেল দিবে। মিলা বেডরুমে গিয়ে বিছানা ঝারার ঝাড়ু খুঁজে আগে বিছানা পরিষ্কার করে মাহতাবকে এনে শুয়িয়ে দিয়েছে। এরপর নিজের এই ক্যাটক্যাটা বিয়ের শাড়ি দেখলো আয়নায়। আসলে শাড়িটা খুব খারাপ যে তা না। শুধু ওরই বিরক্তবোধ হচ্ছে। গা চুলকাচ্ছে। এই শাড়ি পাল্টাতে হবে। কিন্তু শাড়ি পালটে কি পরবে? আবার শাড়ি পরবে? নাকি সালওয়ার স্যুট? অসহ্য লাগছে আগে শাড়ি পালটে গোসল নেয়া দরকার বমির পর থেকেই শরীর আর চলতে চাইছে না। সারা দিনের না খাওয়া তাই যা বমি হয়েছে তা শুধু সকালে সাবিনা ভাবির জোর করে খাইয়ে দেয়া একটা পাউরুটিই ছিলো। দ্রুত ব্যাগের চেইন খুলে এক সেট সালওয়ার কামিজ আর গামছা বের করলো। শাড়ির জায়গায় জায়গায় সেফটি পিনের লক। মনে হচ্ছে সেফটি পিন দিয়ে তাকেই শাড়ির সাথে আটকে ফেলা হয়েছে। এই সেফটিপিন খুলতেই খানিকটা সময় নিলো। শাড়ি খুলে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরেই হাতে কাপড় নিয়ে পিছলা বাথরুমের সামনে গেলো সে। হঠাৎ মনে পড়লো শাওয়ারের নব নেই, বালতিতে ময়লা কাপড় ভেজানো গোসল করবে কি দিয়ে? আরেকটা বালতি খুঁজতে লাগলো। এই বাড়িতে আগেও মহিলা ছিলো তার মানে বালতিও আছে এক্সট্রা। এমনকি জীবন যাপনের জন্য যা যা লাগে সবই আছে। শুধু অযত্নে আছে। বাবু ঘুমাচ্ছে ও ঘুমে থাকতেই গোসল সারতে হবে। বাচ্চার মায়েরা এভাবেই গোসল করে। কিন্তু আফসোস এটা ওর বাচ্চা না। রান্না ঘরে ঢুকবার আগে সে আরেকটা বালতি পেলো। ওটা নিয়েই বাথরুমে ঢুকতে যাবে দেখলো দরজার নব কেউ বাহির থেকে খুলছে। কি আশ্চর্য!সে তো লক করেই রেখেছিলো। ভয়ে শিটিয়ে গেলো মিলা। চোর নাকি? উপরের ছিটকিনি না লাগিয়ে বিশাল ভুল হয়েছে। হায় আল্লাহ!

দরজার নব খুলে মুহিন ভিতরে এলো। হাত ভরতি কিছু জিনিস। দরজা লাগিয়ে পেছনে তাকাতেই বেক্কল হয়ে গেলো।
মিলা মুহিনকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। হঠাৎ নিজের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতেই “আ” জাতীয় মৃদু চিৎকার করে দু হাতে মুখ চেপে ধরলো। মুহিন এখনো হাবলার মতো তাকিয়ে আছে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে। মিলা ‘পা*রভার্ট’ বলে গালি দিয়েই বালতি সহ দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলো একটুর জন্য পিছলা খেয়ে পড়ে নি। নইলে মান সম্মানের আর কিছুই থাকতো না। ও ধরণী তুমি দ্বিধা হও আমি লুকাই।
মুহিন মিলার দৌড়ে যাওয়ার স্টাইল দেখে বোকা বোকা হাসলো। এরপর চেপে না রেখে জোরেই হাসলো। বাথরুমে কল ছাড়া থাকায় মিলা টের পেলো না। মাথায় মগ দিয়ে পানি ঢালতে ঢালতে ভাবছে সবার আগে এই বাথরুমের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর বাদবাকিটা ভেবে দেখা যাবে। নতুন কাপড় গুলো পানি পেয়ে রঙ ছেড়েছে আর মিলার দেহ ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে এসে স্বস্তির শ্বাস।

চলবে…

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০১

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

শাহাজাদী মাহাপারা
সূচনাপর্ব

কাঁচা বাজেরর সামনে দিয়েই বাঁক নিলো রিকশাটা। রুদমিলা বিরক্ত চোখে চেয়ে দেখছে সব। মাছের বাজারের সামনে থেকে যাওয়ার সময় তীব্র বিশ্রী গন্ধে নাক মুখ আঁচল দিয়ে ঢাকলো যেনো তার নাড়িভুড়ি সব উল্টে আসতে চাইছে। কি বিশ্রী গন্ধ! পাশে বসা লোকটার গা থেকেও ঘামের সোদা গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসের সাথে। মিলা আর সহ্য করতে পারলো না বমি করার জন্য ওয়াক করে উঠলো। মুহিন চট করে তাকালো বাঁ পাশে। সহসা জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি ঠিক আছো?”
মুখের ভিতর তেতো ভাব নিয়ে মিলা তার দিকে তাকালো। এই লোকের সাহস তো কম বড় না তাকে তুমি করে ডাকছে? ১ ঘন্টা হয়েছে মাত্র এই লোকের সাথে তার পরিচয়। আর এখনি সে তাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে? ম্যানারলেস লোক। স্বামী হয়েছে তাই মাথা কিনে নিয়েছে? অসহ্য। মিলা কোনো উত্তর করলো না। বেগুনী রঙের শাড়িটা শক্ত করে আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখলো।
মুহিন কয়েক লহমা ওর দিকেই তাকিয়ে থেকে নজর ফিরিয়ে নিলো।

৩৪ বছর বয়েসি মুহিন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরে। বয়সের সাথে দেহেরও একটা ভারিক্কি নজরে পরে। পুরোপুরি না হলেও পেটের দিকে মেদ জমতে শুরু করেছে। লম্বায় ৫ফিট ৬ কি ৭ হবে। জীবনের নানা বাঁক দেখে অভ্যস্ত লোক হঠাৎ করে একটা নতুন বাঁকের সাথেই ধাক্কা খেয়েছে। জীবন নামক তরীটা একা একা বইবার ভার থেকে মুক্তি নিতেই আজ রুদমিলা নামের তরুণী, আচ্ছা, ওর বয়স তো ২৬ এখনো কি তরুণী বলা চলে তাকে? হ্যাঁ তরুণীই তো সে। সেই নারীকে সে বিয়ে করেছে। আড়ম্বরহীন এই বিয়েতে রুদমিলার মত কতটা আছে সে সঠিক জানে না তবে এতক্ষণে কিছুটা ঠাওড় করে নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে সে শান্ত। সময়ের সাথে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে কথাটা রুদমিলার ফুফু তাকে বলেছে। আসলেই কি ঠিক হয়ে যায় সব? হয় না। সত্যি কথা বলতে সময়ের সাথে কিছুই ঠিক হয় না। তবে সময় কাঁচা ঘায়ে মলমের প্রলেপ লাগিয়ে দেয় এতে ঘাঁ শুকিয়ে যায় ঠিক কিন্তু দাগ রয়েই যায়৷ তবে সময় আবার নতুন করে ঘায়ের সৃষ্টি করে এটা ঠিক। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মুহিন।

একটা চার তলা বাড়ির সামনে এসে থামলো রিকশা। মুহিন আগে নেমে ভাড়া দিলো। রুদমিলার কাছে গিয়ে হুড নামিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো রিকশা থেকে নামার জন্য। রুদমিলা হাতের দিকে তাকিয়েও বিরক্ত হলো। আরে কি আশ্চর্য সে কি অথর্ব নাকি? এমন হাত বাড়িয়ে দেয়ার কি আছে? সে কি জীবনে রিকশা চড়ে নাই? আজব! মিলা হাত ধরার ধারে কাছেও গেলো না। উল্টো পাশে নামলো। নিজের ব্যাগ নিজেই নামালো। এরপর চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মাথায় ঘোমটা দেয়া ছিলো সেটা সরিয়ে ফেললো। ভ্যাপসা গরমের দিনে এমন নতুন শাড়িতে শরীর চুলকাচ্ছে। একটা নরমাল সুতি শাড়িই নাহয় দিতো। বেগুনী রঙের কটকটা কাতান শাড়ি। এইগুলা কি দিছে আজাইরা। রাগে তার ইচ্ছে করছে লোকটার মাথায় একটা থাবড়া দিতে কিন্তু পারছে না। মুহিন গেইট খুলে ভিতরে গিয়ে বললো, “এসো।” মিলাও পেছন পেছন গেলো। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলার ৩-বি লেখা বাসাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মুহিন একটি অস্বস্তি বোধ করছিলো। তবুও চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে গেলো। মিলা তার পেছন পেছন ঢুকলো। অন্ধকারের জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে আরেকটু ভেতরে যেতেই পায়ে কিছু বিঁধলো। মাগো বলেই আর্তনাদ করে উঠলো সে। মুহিন দ্রুত লাইট জ্বালালো। মিলা ঘরের দিকে চট করে তাকালো আলো জ্বালায়। হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মুহিনের বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। মন খারাপও হলো। এই সুন্দর পুতুলের মতো মেয়েটাকে সে কিভাবে নিজের সাথে রাখবে? অনুশোচনা হচ্ছে এখন বিয়ে করে।

মিলা প্রায় চিৎকার করে উঠলো ,
” আল্লাহ মাবুদ এইসব কি? এই বাসায় মানুষ বসবাস করে?”
চোখ থেকে পানি আসার উপক্রম তার। ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদুক। মিলা মুহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,” ওয়াশরুম কোথায়?” মুহিন হাত দিয়ে ইশারা করতে দেরি মিলা প্রায় শাড়ি হাটুর উপর উঠিয়ে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। বেসিনে হরহর করে বমি উগড়ে দিলো। শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। বেসিনের কল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আয়নায় সাদা সাদা আস্তরণ পড়েছে, বাথরুমটাও পিছলা, শাওয়ারের নবটা নেই। বালতিতে কিছু কাপড় ভিজিয়ে রাখা আছে। কান্না উপচে পড়ছে তার চোখ থেকে। কাঁপা হাতেই চোখমুখে পানি দিলো সে। বাথরুম থেকে বের হয়ে ঘরের দিকে নজর গেলো। ছোট ছোট বাচ্চাদের খেলনা সারা ঘরময় ছড়ানো। ডাইনিং রুমে সিক্স সিটার টেবিল কাঠের। তার উপরে বাচ্চাদের দুধের কৌটা, ফিডার নিচে দুধ প্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ পানির কাচের জগ, গ্লাস, চামচের সেট এলোমেলো হয়ে আছে। পাশে কলা আর পাউরুটির প্যাকেট।

সামনে একটা বেডরুম আর এই ড্রয়িংরুম কাম বেডরুমের বাসা। ড্রয়িং রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দা তা থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। রুদমিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সামনে এগোতেই মুহিনকে দেখলো খেলনা গুলো একটা একটা করে সেন্টার টেবিলের উপর উঠাচ্ছে। মিলাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি ঠিক আছোতো মিলা?”

” আপনি আমাকে আপনি বলে ডাকুন। এটা একটা ভদ্রতা অপরিচিত কাউকে সম্বোধন করার।” মুহিনের মনে হলো তার থেকে বয়সে ৭-৮ বছরের ছোট মেয়েটা তার গালে কষে একটা চড় বসিয়েছে। আচ্ছা নিজের স্ত্রীকে কেউ আপনি বলে ডাকে? কি কুক্ষণে এমন অভদ্র মেয়েকে বিয়ের জন্য সে রাজি হয়েছিলো কে জানে! রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।

” দুঃখিত। আর ভুল হবে না মিসেস রুদমিলা আজহার।”

মিলা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো। মুহিন ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা এক বোতল পানি বের করে তা গ্লাসে ঢেলে মিলার হাতে দিলো। পানি দেখেই যেন তেষ্টা আরও জেঁকে বসেছে। ঢক ঢক করে গ্লাসের পানি গিললো সে। উফ বুক পেট ঠান্ডা হয়েছে এতক্ষণে।

মিলা বললো, ” আমি কোন ঘরে থাকবো?”
হাত দিয়ে ইশারায় রুমের দিকে দেখালো মুহিন। মিলা ফের বললো, ” এই বাসায়তো একটা বেডরুম আপনি কোথায় থাকবেন?” হতবুদ্ধি হয়ে গেলো মুহিন। আরে কি আশ্চর্য! স্বামী স্ত্রী যে এক রুমে থাকে এই মহিলা জানে না? একে এখন মেয়ে বলতে বাঁধছে তার। ২৬ এর বুড়ি অথচ কথার ঢং শোনো। হাসি পেলো মুহিনের। এবার আর সে হাসি চাপলো না।
হেসেই বললো, “স্বামী স্ত্রী এক রুমে, এক বিছানায় পাশাপাশি শোয়, এক প্লেটে খাবার খায়, এক গ্লাসে পানি খায়, এক বাথরুম উইজ করে, এক তাওয়াল ইউজ করে এমন কি এক কাথা – কম্বলের নিচে ঘুমায়।”

মিলার মুখটা একদম দেখার মতো হলো মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে সে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুহিন বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। মিলা অবাক হয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। কিছুক্ষণ পরেই আবার বাসায় ঢুকলো। হাতে একটা ছোট্ট বাচ্চা৷ দেড় বছর হবে বয়েস। তাইতো মনে হচ্ছে দেখে৷ মিলা মুহিনের হাতে বাচ্চা দেখে এবার হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। ওর কান্না দেখে এবার আর মুহিন বিরক্ত হলো না৷ ওর সত্যিই মিলার জন্য খারাপ লাগছে। পরিস্থিতি তাদের দুজনকে জুড়ে দিয়েছে নইলে মিলার মতো মেয়ে এমন জায়গায় কখনোই থাকতো না আর না মুহিনের ছেলেটার এতো কষ্ট হতো। সবই কপাল। মিলার কান্নার আওয়াজে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সেও কান্না শুরু করেছে। মিলা, মাহতাব একসাথে কাঁদছে। মুহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টিভি ক্যাবিনেটের পাশে। কার কান্না আগে থামাবে বুঝতে পারছে না। মিলাকে ধমক দিয়ে কান্না থামাতে বলার আগেই সে উঠে এসে মাহতাবকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে শান্ত করতে লাগলো। এখনো সে হেঁচকি তুলছে। কান্নার দমকে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠছে। পিঠের পিছনে সোফায় হেলান দিতেই পেঁপু শব্দ করে উঠলো একটা খেলনা টিয়া। মিলা টিয়াটা হাতে নিয়ে ছুড়ে মারলো মুহিনের পায়ের কাছে। কিছু বললো না সে।অপর পাশের সোফায় বসে একটু পর পর নিজের মাথার চুল নিজেই টানতে লাগলো।

চলবে…

প্রিয়তোষ পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ২০(শেষ)
লিখা Sidratul Muntaz

চারদিকে আহাজারি, নোরা ধর্ষণের বিচার চাই,ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। খবরের কাগজ,টিভির পর্দা, সোশ্যাল মিডিয়া,সবজায়গাতে শুধু একটাই টপিক। হ্যাশট্যাগ জাস্টিস ফোর নোরা। নোরার ভার্সিটির সিনিয়র,জুনিয়র সকল ফেমিনিস্টরা রাস্তায় নেমে গেছে। শাহবাগে আন্দোলন গড়ে তুলছে। তাদের দাবী একটাই,জাস্টিস ফোর নৌরিন জাহান। পুলিশরা জোরদার তদন্ত শুরু করেছে।

অনিকও পুরো বাংলাদেশ তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন তখন যেকোনো জায়গায় চলে যাচ্ছে। একটা ক্লু পেলেই বাসা থেকে বের হয়ে পড়ছে। যে অবস্থাতে ওদের হাতের কাছে পাবে, ওইখানে ওই অবস্থাতেই ওদের শেষ করে দিবে এটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। অনিককে সাহায্য করছে তার ঘনিষ্ঠ দুইবন্ধু সাজ্জাদ আর ইমন।

হসপিটালে বেশিরভাগ সময় নোরার কাছে থাকে অন্তরা আর সেজুতি। একদিন অন্তরা নোরাকে লাঞ্চ করাচ্ছিল। নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়ার সময় নোরার ক্ষত-বিক্ষত মুখটা দেখে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। সেজুতি অবাক হয়ে বলল,” কিরে কাঁদছিস কেন?”

অন্তরা খাবারের প্লেটটা রেখে নোরার দুইহাত ধরে বলল,” আমাকে ক্ষমা করে দে নোরা।”

” তুই কেন ক্ষমা চাইছিস?”

” সব আমার জন্য হয়েছে।”

নোরা মৃদু হেসে বলল,” এই বোকামেয়ে, তোর জন্য কিভাবে সব হলো? ”

” আমি যদি আলভীকে বিয়ে না করতাম তাহলে আলভী তোর সাথে এতো জঘন্য কাজটা কোনোদিন করতো না। আমারই দোষ। নিজের জীবনটা তো নষ্ট হয়েই ছিল। আমি এবার তোর জীবনটাও নষ্ট করে দিলাম। তুই প্লিজ পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস বোন।”

অন্তরা এসব বলে কাঁদতে লাগল। নোরা অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” নিজেকে এভাবে দোষারোপ করিস না তো। তুই তো আর জানতি না আলভী এতোবড় কালপ্রিট। ওর এই পরিকল্পনার কথা আমরা কেউই জানতাম না। ভাবতেও পারিনি। তাই এখানে তোর দোষী হওয়ার কোনো চান্স নেই। সব আসলে আমার পোড়া কপাল।

অন্তরা বলল,” তুই দেখিস, আলভীকে যখন খুঁজে পাওয়া যাবে আমি ওর এমন অবস্থা করবো, ওকে খু*ন করে ফেলবো।”

নোরা মুচকি হেসে বলল,” হয়েছে। এবার খাইয়ে দে তো। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে।”

অন্তরা চোখ আবার নোরাকে খাইয়ে দিতে শুরু করল। সেজুতি বলল,” টিভিটা একটু ছাড় তো। নিউজ দেখি।”

অন্তরা সেজুতিকে রিমোট দিয়ে বলল,” তুই ছাড়।”

সেজুতি টিভি ছাড়ল। এটিএন বাংলায় অনিকের স্টেটমেন্ট লাইভ দেখাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অনেক কথা বলছে। চোখেমুখে তার তীব্র ক্রোধ,প্রতিবাদী কণ্ঠ। সবাই মন দিয়ে অনিকের কথা শুনতে লাগল,” আজকাল রাজধানীর রাস্তাঘাটে পর্যন্ত মেয়েরা নিরাপদ না। শহরের মানুষ আর মানুষ নেই, হয়ে গেছে নিকৃষ্ট পশু। ওদের মধ্যে দয়া-মায়ার লেশমাত্র নেই। একজন কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মন-মানসিকতা নেই। এভাবে আর কতদিন? জানোয়ার থেকে এরা মানুষ কবে হবে? একটা মেয়ে একা রাস্তায় বের হলে তার পক্ষে নিরাপদে বাসায় ফেরা প্রায় অসম্ভব। এই যুগে এসেও যদি মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা না থাকে, কোনো স্বাধীনতা না থাকে তাহলে কিসের স্বাধীন দেশ? কোন দেশে বাস করছি আমরা? সব কি এই সমাজব্যবস্থার জন্য? দেশের দুর্বল আইনের জন্য? নাকি সবথেকে বড় দায় দেশের মানুষের বিকৃত মস্তিষ্ক? অবশ্যই আমি বলবো সবার আগে এই বিষয়টিই দায়ী। কেউ বিপদে পড়লে আমরা সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে চিন্তা করি কিভাবে নিজেদের মাথা বাচানো যায়। পিঠ বাচিয়ে পালানো যায়। আমি আমার আহত গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যখন মাঝরাস্তায় আর্তনাদ করছিলাম, শুধুমাত্র একটা সাহায্যের জন্য পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিলাম বিশ্বাস করুন এই শহরের একজন মানুষও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। আমি নিজের চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল এ কেমন দেশে বাস করি? এই দেশে আদৌ মানুষ আছে তো? অবশেষে একজন মানুষের দেখা সত্যিই পেয়েছিলাম। আর তার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। তার জন্যই হয়তো আজকে নোরা বেচে আছে। নাহলে ওর জীবনটাও বাচাতে পারতাম না আমি। সেই রিকশাওয়ালা চাচাকে স্যাল্যুট। উনি সেদিন আমাকে অনেকবড় বিপদের হাত থেকে বাচিয়েছিলেন…

সাংবাদিকরা ওর সামনে মাইক ধরে আছে। নিচে হেডলাইন। ধর্ষিতা নোরার প্রেমিকের বক্তব্য। নিজের নামের পাশে ধর্ষিতা লেখাটা দেখেই নোরার কান্না পেয়ে গেল আবার। জীবনে এমন দিন দেখতে হবে কখনো ভাবেনি সে। সেজুতি নোরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,” কাঁদিস না নোরা। দ্যাখ অনিক ভাইয়া তোর জন্য কতকিছু করছেন। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে তো উনার সব চেষ্টা বৃথা যাবে। মন শক্ত কর, ধৈর্য্য ধর। সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে। কোনো এক সকালে নতুন সূর্য উঠবে।”

নোরা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। অনেকদিন কেটে যাওয়ার পরেও আলভীদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে অনিক দিনের চব্বিশঘণ্টা সময়ই নোরার কাছে কাটায়, আলভীদের বিষয়ে কোনো ইনফরমেশন পেলে এখনো হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

নোরাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সারাদিন সে বাসায় বসে কাটায়।ফেসবুকে ইদানীং আর লগইন করতে ইচ্ছে করেনা। নিউজফিডটা দেখতে তার অসহ্য লাগে। তার ভাবতেও ঘৃণা লাগে কিছু কিছু মানুষ নোরার পুরনো ছবি আপ্লোড করে ক্যাপশন দেয়,” জিন্স-টপ পড়ে রাস্তায় নামবে আর ধর্ষণ করলেই দোষ?”

এসব দেখলে চোখ দিয়ে এখন আর জল বের হয় না। রক্ত বের হয়। কানে ধোঁয়া জমে। শরীর গিন গিন করতে থাকে। আসলেই কি পোশাকের জন্য তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল? রাত-বিরাতে একাকী রাস্তায় চলা-ফেরা করার জন্য ধর্ষণ করা হয়েছিল? সবাই শুধু এই বিষয়গুলোই খতিয়ে দেখছে। অথচ ভেতরের গল্প কেউ জানতে চাইছে না। নোরা এসব ভেবে ভেবে যখন কাঁদছিল তখন অনিকের ফোন এলো। নোরা ফোন ধরে বলল, ” হ্যালো।”

” নোরা, আমার মিষ্টিপরী। একটা গুড নিউজ আছে।”

গুড নিউজ শব্দটা শুনে নোরা মুচকি হাসল। বলল,” আমার জীবনে গুড নিউজ হওয়ার মতো কি আর কিছু আছে? সবথেকে বড় খারাপটা তো হয়েই গেছে। আর কি গুড নিউজ হবে শুনি?”

” তোমাকে না বলেছি এসব কথা বলবে না। আমার কিন্তু ভালো লাগে না।”

” আচ্ছা সরি। বলো কি গুড নিউজ?”

” ওই সিএনজি ওয়ালা ধরা পড়েছে।”

” সত্যি? ”

” হুম, তোমাকে একবার থানায় আসতে হবে। কনফার্ম করতে হবে এটাই উনি কিনা। যদিও উনি নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছে, তবুও তোমার স্টেটমেন্ট দরকার।”

” আচ্ছা। আমি আসবো কিভাবে? তুমি এসে আমায় নিয়ে যাও।”

” আমি তোমাদের বাসাতেই আসছি। তোমাকে নিয়ে যেতে। তুমি তৈরি থেকো।”

” আচ্ছা।”

” এবার এক এক করে সবাই ধরা পড়বে দেখো। সবার উপযুক্ত শাস্তি হবে।”

নোরা মুচকি হেসে বলল,” শাস্তি হলেও কি? আমার কপালে ধর্ষিতার তকমাটা তো আর মুছে যাবে না। তা ছাড়া ওদের দোষ কোথায় বলো? ওদের শাস্তি না হয়ে আমার শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমি উপযুক্ত পোশাক পড়িনি, এটা আমার ক্রাইম। গভীর রাতে মেয়ে হয়ে একা রাস্তায় বেরিয়েছি এটাও আমার ক্রাইম। শাস্তি তো আমার হওয়া উচিৎ। ফাসি হলেও আমারই হওয়া উচিৎ।”

” নোরা প্লিজ! সস্তা মেন্টালিটির মানুষের মতো কথা বলো না তো। আর এসব ভেবে কষ্ট পেও না। যার মন-মানসিকতা যেমন সে তেমন চিন্তাই করবে। ওরা আসলে ধর্ষকদের সাপোর্টার। এখন এ বিষয়ে কিছু বলতে গেলেও আমি হয়ে যাবো ফেমিনিস্ট। দেশের প্রধানমন্ত্রী মেয়ে হলে কি হবে? দেশটা এখনো পুরুষতান্ত্রিকই রয়ে গেল।”

অনিক ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,” যাক বাদ দাও। আমি এই পাঁচমিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি জলদি তৈরি হয়ে নাও।”

” ঠিকাছে।”

নোরা ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

তিথি ইলোরার রুমের পর্দা সরিয়ে ডাকল,” আন্টি।”

ইলোরা ঘুরে দেখলেন তিথি। মুখে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বললেন,” তিথিমা, এসো।”

তিথি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অভিমানী গলায় বলল,” আচ্ছা আন্টি, অনিকের সাথে কি ধর্ষিতা মেয়েটার বিয়ে হবে? এটাই কি আপনি চান?”

” নাউজুবিল্লাহ! আমি এটা কেন চাইবো? মা হয়ে নিজের ছেলের এতোবড় সর্বনাশ আমি চাইতে পারি নাকি?”

” তাহলে আপনি অনিককে কিছু বলছেন না কেন? দিন-রাত ওই মেয়েটার বাসায় পড়ে থাকে। সারাখন ওই মেয়েটার সাথে কাটাচ্ছে। ওই মেয়েকে নিয়ে এখন সোশ্যাল মিডয়ায় তোলপাড় চলছে। আপনার ছেলেও এসবের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। এখন তো সবাই ওকে চেনে ধর্ষিতা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড হিসেবে। এর থেকে লজ্জার কি আর কি হতে পারে? আপনিই বলুন আন্টি!”

ইলোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” কি আর বলবো? অনিক তো আমার কোনো কথা শুনে না।”

” আপনার কথা না শুনুক, ওই মেয়ের কথা তো শুনে। আপনি এক কাজ করুন, ওই মেয়েটার বাসায় যান। ওকে সাবধান করে আসুন যেন আর কক্ষনো অনিকের সাথে মেলামেশা করার চেষ্টাও না করে। নিজের জীবন তো এমনিই নষ্ট এখন কি অনিকের জীবনটাও নষ্ট করতে চায় ও?

” এইটা তুমি ভালো বুদ্ধি দিয়েছো মা। যা বলার ওই মেয়েকেই বলতে হবে। অনিক তো আমার কথা শুনবে না কিন্তু ওই মেয়ের কথা নিশ্চয়ই শুনবে।”

” ওকে ভালো করে শাসিয়ে আসবেন। যদি লজ্জা থাকে তাহলে যেন ওই কলঙ্কিত মুখ আর জীবনে অনিককে না দেখায়।”

তিথি একটু থেমে বলল,”আন্টি আপনি কালই নোরাদের বাসায় যাবেন।”

” কাল না মা। আমি আজই যাবো।”

” কিন্তু তখন যদি অনিক ওখানে থাকে?”

” অনিক থাকতে আমি যাবো না। অনিক বাসায় ফিরলে তারপর যাব।”

ইলোরা সেদিনই নোরাদের বাসায় গেলেন। দরজা খুললেন লীরা। ইলোরাকে দেখেই উনি প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন,” কে আপনি?”

ইলোরা হাসিমুখে বললেন,” আমি ইলোরা খাতুন। অনিকের মা।”

লীরার মুখে উজ্জল হাসি ফুটল। উনি সম্মানের সহিত বললেন,” ভেতরে আসুন।”

ভেতরের রুম থেকে আনিস আওয়াজ দিলেন,” কে এসেছে?”

লীরা বললেন,” বিশেষ মেহমান এসেছে গো। অনিকের মা।”

আনিস হাসিমুখে রুম থেকে বেরিয়ে ইলোরাকে সালাম দিলেন,” আসসালামু আলাইকুম আপা।”

ইলোরা জবাব দিলেন,” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”

আনিস লীরাকে বললেন,” তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও কল্পনাকে বলো চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে।”

ইলোরা সোফায় বসতে নিয়েও বসলেন না। দাঁড়িয়ে বললেন,” এক মিনিট। আমি এখানে চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য আসিনি।”

আনিস-লীরার মুখ হালকা মলিন হল। আনিস সংশয় নিয়ে বললেন,” তাহলে?”

ইলোরা বললেন,” আপনাদের সাথে আমার একটা জরুরী দরকার আছে। বিশেষ করে আপনার মেয়ের সাথে। ডাকুন আপনার মেয়েকে একবার। ওর সামনেই কথাটা বলি।”

আনিস-লীরা একবার চোখচোখি করলেন। লীরা বললেন,” আচ্ছা আমি ডেকে আনছি।”

লীরা চলে গেলেন নোরাকে ডাকতে। আনিস ইলোরাকে হাসিমুখে বললেন,” আপা আপনি কেন দাঁড়িয়ে আছেন? আপনি বসুন। ওরা আসছে।”

ইলোরা বসলেন। একটু পর লীরা আসল নোরাকে নিয়ে। নোরার ভয়ে বুক ধুকপুক করছে। মাথায় আধঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে ড্রয়িংরুমে ঢুকল নোরা। ইলোরা নোরাকে দেখে বললেন,” এইতো চলে এসেছে। বসো নোরা। তোমার সাথেই কথা বলতে এসেছি আমি।”

নোরা বসল না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,” বলুন আন্টি।”

আনিস ধমক দিয়ে বলল,” বলুন আন্টি কি? আগে সালাম দাও।”

নোরা বলল,” আসসালামু আলাইকুম। ”

ইলোরা হেসে বললেন,” থাক ভাই, যেখানে আসল শিক্ষাটাই মেয়েকে দিতে পারেন নি সেখানে এটুকু ম্যানার্স না শেখালেও চলবে।”

নোরা একথা শুনে আরো মাথা নিচু করে ফেলল। লীরা অবাকদৃষ্টিতে তাকাল। আনিস বিস্ময় নিয়ে বললেন,” সরি আপা, ঠিক বুঝলাম না।”

ইলোরা বললেন,” আমি বুঝিয়ে বলছি। আমার ছেলে অনিকের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার পছন্দের পাত্রীর সাথে। সে অনিকের যোগ্য পাত্রীও বটে। কিন্তু অনিক এই বিয়েতে রাজি হচ্ছেনা। তাও আবার আপনার মেয়ে নোরার জন্য। সে নোরার মোহে ডুবে আছে। কিন্তু আপনিই বলুন তো ভাই, একটা মেয়ে যে কিনা ধর্ষিতা তাকে কি বাড়ির বউ করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?”

আনিস-লীরা কেউই কোনো উত্তর দিলেন না। উত্তর দিতে পারলেন না। ইলোরা বললেন,” কিন্তু আমার ছেলে এই বিষয়টা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। এখন নোরার কি উচিৎ না অনিককে বুঝিয়ে বলা? কিন্তু সেটা না করে ও কি করছে? অনিককে আরো উৎসাহ দিচ্ছে। শুধু ও কেন আপনারা সবাই মিলেই তো দিচ্ছেন। আচ্ছা আপনারাও কি চান আপনাদের ধর্ষিতা মেয়েকে আমার নিরীহ ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে? যদি সেটাই চেয়ে থাকেন তাহলে আমি বলবো আপনারা দিবাস্বপ্ন দেখা ছাড়ুন। আপনাদের মেয়ে কখনোই আমার ছেলের উপযুক্ত নয়। শুধু আমার ছেলে কেন? সে তো কোনো ভালো ফ্যামিলির বউ হওয়ারই উপযুক্ত নয়। সেই যোগ্যতা সে হারিয়েছে। ভাই আপনি মেয়েকে দয়া করে এই বিষয়টা বোঝান। অন্তত আমার ছেলের জীবনটা যেন সে নষ্ট না করে। আমি হাতজোর করে মিনতি করছি আপনাদের সবার কাছে। আমার ছেলেটাকে রেহাই দিন আপনারা।”

ইলোরা উঠে দাঁড়ালেন। নোরার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,” এরপর থেকে যেন আর কক্ষনো তোমাকে আমার ছেলের ত্রিসীমানায় না দেখি।”

তারপর আনিস-লীরার দিকে তাকিয়ে বললেন,” দুঃখ দিয়ে থাকলে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু নিজের ছেলের ভালো প্রত্যেক মা-ই চায়। আপনারা দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আসি। আসসালামু আলাইকুম। ”

আনিস বললেন,” ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

লীরা কোনো কথাই বললেন না। ইলোরা চলে যাওয়ার পর নিরবে দরজাটা আটকে দিলেন। এদিকে নোরার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে। আনিস ভেজা চশমাটা খুলে পাঞ্জাবীর সাথে মুছে আবার চোখে পড়লেন। নোরার কাছে এসে বললেন,” থাক মা, কাঁদিস না।”

নোরা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। কষ্টে আনিসের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। পেছনে লীরা আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন।

অনিক ঘরে ঢুকেই চিৎকার শুরু করল। তার কণ্ঠে তীব্র ক্রোধ। চোখেমুখ রাগে লাল হয়ে আছে,” মা, মা কোথায় তুমি?”

ইলোরা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন,” কি হয়েছে?”

অনিকের আগের মতোই ক্রুদ্ধগলায় বলল,” তুমি নোরাদের বাসায় কেন গিয়েছিল? ওর বাবা-মাকে তুমি কি বলেছো? কেন এইভাবে অপমান করলে ওদের? জবাব চাই আমার জবাব দাও। কেন করলে এমন?”

” অসভ্যের মতো চিৎকার করবে না। এক চড় দিয়ে তোমার সবকয়টা দাঁত ফেলে দিবো আমি। অসভ্য কোথাকার!”

আনিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,” মা কি বলছো? তুমি ভাইকে চড় দিবে কেন?”

অনিকের শরীর এখনও রাগে কাঁপছে। ইলোরা বললেন,” আমি যেটা করেছি তোমার ভালোর কথা ভেবেই করেছি। ওই মেয়ের সাথে আর কক্ষনো মেলামেশা করবে না তুমি। আর ওই মেয়ের যদি আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছু থেকে থাকে, তাহলে সে নিজেই থেকেই তোমার সাথে সমস্ত সম্পর্ক নষ্ট করে দিবে।”

“সেটা কখনোই হবে না মা৷ বরং তুমি এই কাজটা করে আমার সাথে তোমার সম্পর্ক নষ্ট করেছো। এবার তো যেভাবেই হোক আমি নোরাকেই বিয়ে করব।”

ইলোরা সত্যি সত্যি অনিকের গালে একটা চড় দিলেন। আনিকা মুখে হাত দিয়ে আহতগলায় বলল,” মা, এটা কি করলে তুমি?”

ইলোরা আঙুল উঠিয়ে বললেন,” আর কখনও ওই মেয়েকে বিয়ে করার কথা মুখে আনলে তোর জিভ টেনে ছিড়ে দিবো আমি।”

” শুধু জিভ কেন, আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। বিয়ে তো আমি ওকেই করবো। তুমি কোনোভাবেই আটকাতে পারবে না।”

” আচ্ছা? তাই নাকি? তাহলে তুমিও শুনে রাখো। এক দরজা দিয়ে তুমি ওই মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকবে তো আরেক দরজা দিয়ে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো। ওই নষ্ট মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় আমি মরে গেলেও থাকবো না। আমাকে চিরজীবনের মতো হারাতে হবে তোমায়। এবার তুমিই ভেবে দেখো। তোমার কাকে চাই। আমাকে? নাকি ওই ধর্ষিতাকে।”

ইলোরা এই কথা বলে নিজের রুমে চলে গেলেন। অনিক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আচমকা সোফায় একটা লাথি মেরে সেও রুমে চলে গেল। আনিকা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসল। প্রতিদিন এই এক অশান্তি এবার অসহ্য লাগছে তার। এসব কবে শেষ হবে কে জানে?

অনিক সেই যে দরজা লাগিয়ে রুমে ঢুকেছে এখন পর্যন্ত বের হয়নি। ডিনারের জন্য ওকে অনেকবার ডাকা হয়েছে। ও ভেতর থেকেই বলেছে ডিনার করবে না। ইসহাক আর ইলোরা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাত ঠিক বারোটা নাগাদ আনিকা অনিকের দরজায় কড়া নাড়ল,” ভাই, দরজাটা খোল। আমি আপু, তোর সাথে কথা আছে।”

” আপু আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।”

” মিথ্যে কথা বলিস না। আমি জানি তুই না খেয়ে ঘুমাতে পারিস না।”

” কে বলেছে পারিনা?”

” বেশি কথা না বলে দরজা খোল। নাহলে কিন্তু মায়ের মতো আমিও এক চড় দিবো।”

” দরজা বন্ধ থাকলে চড় দিবি কি করে?”

” যখন খুলবি তখনি দিবো। এবার খোল।”

অনিক বাধ্য হয়ে দরজা খুলল। আনিকা চাঁদের মতো একটা হাসি দিয়ে বলল,” দ্যাখ তোর জন্য কি এনেছি। তোর ফেভরেট দম বিরিয়ানি।”

” আবার এসব কেন? আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

” তুই খাবি না তোর ঘাড় খাবে। বোস আমি খাইয়ে দেই।”

” প্লিজ আপু, ভাল্লাগছে না। এখন এসব খেলে বমি আসবে।”

” বমি আসলে বমি করবি, তবুও খেতে হবে। নে খা।”

অনিক বিরক্তি নিয়ে বলল,” না!”

” আমি এতো আদর করে তোকে খাইয়ে দিচ্ছি তবুও তুই খাবি না? খুব কষ্ট পাবো কিন্তু।”

অনিক অগত্যাই খেল। আনিকা ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, ” তোর মনে আছে, ছোটবেলায় তোকে আমি এভাবে খাইয়ে দিতাম। কত খাইয়ে দিয়েছি!”

অনিক মৃদু হেসে বলল,” ছোটবেলাটা খুব সুন্দর ছিল নারে আপু? তখন আমি কি চাই সেটা বলার আগেই মা বুঝে নিতো। আর এখন..”

” মনখারাপ করিস না ভাই। আসলে মা তিথিকে নিয়ে অনেকবছর ধরে স্বপ্ন দেখেছে তো, তাই হঠাৎ ওর জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নিতে পারছে না। তার উপর নোরার সাথে এতোবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। মা মান-সম্মানের ভয় পাচ্ছে।”

” ভয় আমিও পাচ্ছি আপু। তবে মান-সম্মানের কোনো ভয় নেই আমার। নোরাকে হারানোর ভয় আছে। নোরার জন্য আমি পাঁচবছর ধরে অপেক্ষা করছি। ওর জায়গায় অন্য কাউকে আমি মেনে নেওয়া তো দূর, জাস্ট চিন্তাও করতে পারিনা।”

” আমি তোকে বলি ভাই, তুই নোরাকে বিয়ে করে নিয়ে আয়। যা হবে দেখা যাবে। মা প্রথম প্রথম হয়তো রাগ করবে,অশান্তি করবে কিন্তু আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

” নোরা আমাকে মায়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবে না আপু। যদি করতো তাহলে কি আমি অপেক্ষা করতাম? কবেই ওকে ঘরে নিয়ে আসতাম!”

আনিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” তাহলে আর কি করার? অপেক্ষাই কর। যদি কোনো মিরাকল হয়, আর মা কোনোদিন রাজি হয়।”

অনিক সামান্য হাসল। আদৌ কি তা সম্ভব? প্রায় একমাসের মতো কেটে গেছে। নোরা অনিকের ফোন ধরছে না। ম্যাসেজের রিপ্লাই করছে না। একেবারে ইগনোর করছে তা নয়, জরুরী বিষয়ে কথা বলে শুধু। আগের মতো দিন-রাত খোশগল্পে মেতে থাকা হয়না।

নোরা দিনে একবার তার সাথে ম্যাসেজে কথা বলে। অনেকবার ফোন দিতে দিতে একবার ফোন ধরে। অনিক কারণ জিজ্ঞেস করলে ব্যস্ততার অযুহাত দেখায়। আরও নানা অযুহাত দেখায়। দিনে ওদের যেটুকু কথা হয়, অনিকের তাতে মন ভরে না। দিনশেষে তৃষ্ণার্ত মন নিয়েই ঘুমাতে যেতে হয়।

নোরাদের বাসায় যাওয়ার মতো সাহস কিংবা মুখ কোনোটাই তার নেই। মায়ের জন্য সেটুকু অধিকারও সে হারিয়েছে। নোরার সাথে কতদিন দেখা হয়না। অনিক প্রায়ই ওদের বাসার নিচে দাড়িয়ে থাকে, ওকে একনজর দেখার আশায়। নোরা যদি একবার বারান্দায় আসে। কিন্তু নোরা আজ-কাল বারান্দাতেও আসেনা। অনিকের তৃষ্ণার্ত মন তৃষ্ণার্তই রয়ে যায়। একদিন অনিক নোরাকে ম্যাসেজ করল, ” নোরা।”

” বলো।”

” আজকে একবার দেখা করবে?”

” কেন?”

” তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”

” সে তো সবসময়ই করে।”

” আজকে অনেক বেশি ইচ্ছে করছে। প্লিজ চলোনা একবার দেখা করি।”

” সম্ভব না।”

” কেন সম্ভব না? এভাবে কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছো নোরা? তুমি তো এমন ছিলে না।”

” আমার কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই। সব বদলে গেছে। আগে সমাজে আমি একজন সাধারণ মেয়ে ছিলাম। যার ন্যূনতম সম্মানটুকু ছিল৷ এখন সেটাও নেই। কারণ আমি একজন ধর্ষিতা।”

” আমি মানি না তুমি ধর্ষিতা। আমার কাছে তুমি পবিত্রা। ফুলের মতোই পবিত্রা। আমার মিষ্টিপরী তুমি। আমার জীবনের সবটুকু।”

” এসব কথা প্লিজ বলো না। শুনতে কষ্ট হয়। কি লাভ এসব করে? আমি চাইনা আমার এই কালো ছায়া তোমার জীবনে পড়ুক। তুমি ভালো থাকো, খুব সুখে থাকো। এটাই আমার চাওয়া।”

” সুখে থাকবো? তাও তোমাকে ছাড়া? আমার সুখের অপর নাম যে তুমি সেটা কি এখনো জানোনা? নাকি জেনেও না জানার ভান করছো?”

নোরার চোখ ভিজে আসল। ওয়াইফাই অফ করে ফোনটা একপাশে রেখে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করল সে। অনিক কেন এমন করে?এভাবে চললে সে নিজেকে সামলাবে কি করে? তারও যে কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু শত কষ্ট হলেও যে তার অনিককে ভুলতেই হবে। অনিককে সে নিজের করে চাইতে পারেনা। তার সেই অধিকারই নেই৷ অনিক তার থেকেও অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। এভাবেই বাড়তে থাকল ওদের দূরত্ব।

নোরা যত দূরে যেতে চাইতো অনিক যেন তত কাছে চলে আসতো। সব মিলিয়ে ওদের মধ্যে পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ হয়ে উঠছিল না। অনিক এখনো আলভীদের খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওদের কোনো হদিশই পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা কি সম্পুর্ণ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?

বিকালের শেষদিকে অনিক পুলিশ স্টেশন থেকে বাইকে করে বাসায় ফিরছিল। নোরা কোচিং থেকে বাসায় ফিরছিল। মাঝরাস্তায় দেখা হল ওদের। অনিক নোরাকে দেখেই বাইক থামিয়ে বলল, ” নোরা,কোথায় যাচ্ছো?”

নোরা মৃদু হেসে বলল,” বাসায়। তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

অনিক নিজের বাসায় যাচ্ছিল। তবু মিথ্যে বলল, ” তোমাদের ওদিকেই যাচ্ছিলাম। চলো তোমাকে নামিয়ে দেই।”

” আমাদের ওদিকে তোমার কি কাজ?”

” কাজ আছে। বাইকে উঠো তারপর বলছি।”

” আমি চলে যেতে পারবো।”

” সবসময় জেদ ভালো লাগে না নোরা, বাইকে উঠতে বলছি উঠো।”

” আমি পেছনে বসবো।”

” পড়ে গেলে?”

” পড়বো না।”

অনিক ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” আচ্ছা বসো।”

তারপর বিরবির করে বলল, ” রাজি হয়েছো এইতো অনেক।”

নোরা অনিকের পিঠ ধরে বাইকে বসল। অনিকের শরীরে শীতল শিহরণ সৃষ্টি হল। কতদিন পর আবার সেই চেনা স্পর্শ। তৃষ্ণার্ত মনটাকে বেসামাল করে তোলার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। অনিক বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল, ” ঠিক করে ধরে বসো। নাহলে পড়ে যাবে।”

” ধরেই বসেছি।”

” ভালো করে ধরো।”

নোরা ভালো করে ধরল। অনিক বাইক স্টার্ট দিতেই জোরে একটা ধাক্কা অনুভূত হল। নোরা অনিকের পিঠের উপর হেলে পড়ল। তারপর ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনিক হেসে ফেলল। নোরা রাগান্বিত গলায় বলল, ” তুমি এটা ইচ্ছে করে করেছো তাইনা?”

অনিক জবাব দিল না। ডাকাতের মতো হাসছে। নোরা তেতে উঠে বলল, ” এরকম করলে আমি এখনি নেমে যাবো।”

” নেমে দেখাও পারলে। আমি বাইকই থামাবো না। ”

” আমি চলন্ত বাইক থেকেই লাফ দিবো। তুমি জানো আমি এটা করতে পারি।”

” দ্যাখো পাগলামি করো না।”

” তুমি অসভ্যতা বন্ধ রাখো আগে।”

” আচ্ছা আর করবো না সরি।”

অনিক একটা দিঘীর পাড়ে এসে বাইক থামাল। নোরা অবাক হয়ে বলল, ” আমরা এখানে কেন আসলাম?”

” থাকো কিছুক্ষণ, ভালো লাগবে।”

” আমি বাসায় যাবো।”

” অবশ্যই যাবে। আমি কি নিষেধ করেছি?”

” আমি এখনি যেতে চাইছি।”

” যেও, তার আগে একটু বসো। সূর্যাস্তটা দেখে যাও। মুগ্ধ হবে নিশ্চিত।”

নোরা কোনো কথা না বলে অনিকের পাশে বাইকে বসল। অনিক আনমনে বলল, ” তোমার মনে আছে নোরা? আমাদের সীতাকুন্ডের ট্রিপের কথা?রাস্তা হারিয়ে ফেলা, কারফিউ,পুলিশের কত এ্যাডভেঞ্চার। আর আমাদের সিলেটে কাটানো সেই রাতগুলোর কথা মনে হলে তো..”

” তুমি যদি টপিক চেঞ্জ না করো তাহলে আমি এক্ষুনি এখান থেকে উঠে চলে যাবো।”

” আচ্ছা চেঞ্জ করলাম। তবুও যেও না। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য তো আমার সাথে থাকো।”

” আমাকে সন্ধ্যার আগে বাসায় যেতে হবে। সূর্যাস্ত দেখা হবে না।”

” আমি তোমাকে পৌঁছে দিবো তো। সন্ধ্যার পরে গেলেও সমস্যা কি?”

” আমি তোমার সাথে যেতে চাইছি না।”

” কেন?”

” এমনি।”

” নোরা, এতো কঠোর কেন হয়ে যাচ্ছো তুমি? একটু কি দয়া হয়না আমার উপর?”

নোরা কথা না বলে সামনে হাঁটতে লাগল। অনিক নির্বিকার তাকিয়ে রইল। যেতে যেতে নোরা যদি একবার ফিরে তাকায় সেই আশায় পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। নোরা ফিরে তাকাল না। সে চলে গেল। তাকাবে কিভাবে? তার চোখ দিয়ে যে তখন বৃষ্টি নামছিল। কান্নার বৃষ্টি।

তারপর একদিন আসল সেই নতুন সূর্যোদয়ের সকাল। অনিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদ ওকে ফোন করে জানাল আলভীরা পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার বর্ডার ক্রস করে এতোদিন মিয়ানমারে গা ঢাকা দিয়েছিল তিনজন। আজ সকালে ওদের মধ্যেই একজন বাংলাদেশে ফেরার পথে এলাকাবাসীর কাছে ধরা পড়ে। ধর্ষকদের ভাইরাল হওয়া ছবির সাথে চেহারা মিলে যাওয়ার পর স্থানীয় মানুষেরা ওদের আটক রেখে পুলিশের খবর দেয়।

অনিক এসব জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। অনেকদিন পর আবার সেই ঘুমন্ত টপিক জেগে উঠে। জাস্টিস ফোর নোরা। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার টানিয়ে আন্দোলন। ধর্ষকদের উপযুক্ত বিচারের জোরদার দাবী। অনিক ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেই দেখতে পায় তিনজনকে একসঙ্গে এ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জনগণরা ওদের ইট-পাটকেল,জুতা ছুড়ে মারছে৷ সাংবাদিকরা লাইভ টেলিকাস্ট করছে। এতোদিন পর আলভীকে দেখে অনিকের ভেতর পশুত্ব নতুন করে জেগে উঠল। শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করল। প্রতিশোধস্পৃহা মনের মধ্যে তীব্র তাড়না জাগিয়ে তুলতে। অনিক হারিয়ে ফেলল,বোধশক্তি, হিতাহিতজ্ঞান।

সে কোনোকিছুর পরোয়া না করে মাঝরাস্তাতেই গর্জে উঠল হুংকার দিয়ে। বাইক থেকে গরম স্টিক খুলে নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ শুরু করল আলভীদের উপর। তখন চ্যানেলে লাইভ ক্যামেরা চলছিল। নিউজ রিপোর্টাররা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘটনা রেকর্ড করার জন্য। পুলিশরা বারবার বাঁশি বাজিয়ে জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অনিকের সাথে সাথে ওরাও ধর্ষকদের গণপিটুনি দিতে এগিয়ে আসতে চাইছিল।

অনিককে থামানোর জন্য পুলিশবাহিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও সফল হতে পারলনা। শিপন আর আরিফকে ছাড়ানো গেলেও আলভী নিস্তার পায়নি। অনিক জানোয়ারের মতো পেটাতে পেটাতে একসময় আলভীকে মেরে ফেলল। এতো নৃশংসভাবে মারল যে উপস্থিত সকল জনতার আত্মা কেঁপে উঠল আলভীর নিথর দেহ দেখে। এতোটা ভয়ংকর মৃত্যু হয়তো চোখের সামনে এর আগে কেউ কখনো দেখেনি।

এই একটা ঘটনা সম্পুর্ণ অবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দিল। ধর্ষিতার প্রেমিকের হাতে ধর্ষক খুন। এই নিউজ হয়ে উঠল পরদিন সকালের গরমতাজা খাবার। আলোড়ন সৃষ্টি হল সারাদেশ জুড়ে। যেখানে এতোদিন আন্দোলন হচ্ছিল হ্যাশট্যাগ জাস্টিস ফোর নোরা। সেখানে শুরু হল জাস্টিস ফোর অনিক আবেদিন। খুনি অনিক আবেদিনের বেকসুর খালাশের দাবী তুলছে জনগণ। অনিক পুলিশ কাস্টাডিতে বন্দী।

শিপন আর আরিফের শাস্তি হয়েছে সাতবছরের কারাদণ্ড। সেখানে অনিকের শাস্তি হল ছয় বছরের। আনিকা,ইলোরা,ইসহাক জেলখানায় দেখা করতে এসেছেন অনিকের সাথে। সবার সাথে দেখা হওয়ার পর অনিক মায়ের সাথে একা কথা বলতে চাইল। ইলোরা কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে বললেন, ” বাবা তুই এরকম কেন করলি ?”

অনিক স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” এটা না করলে যে শান্তি পেতাম না মা। এখন নিজেকে খুব বীরপুরুষ মনে হচ্ছে জানো? যদি আমিও সাধারণ জনতার মতো চুপচাপ সব দেখতাম, আলভীকে ছেড়ে দিতাম, আইনিব্যবস্থার উপর নির্ভর করে হাত গুটিয়ে রাখতাম, তাহলে নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতাম না। মা তুমিই না বলেছিলে নোরা আমার যোগ্য না। এখন আমি তোমাকে বলছি মা, আমার জন্য নোরার চেয়ে বেশি যোগ্য আর কেউ না।”

অনিক খানিক হাসল। তারপর আবার বলল,” তোমার জেল ফেরত আসামী খুনি ছেলেকে কোন পাত্রী বিয়ে করবে বলোতো? আমার জন্য এখন ধর্ষিতা নোরাই উপযুক্ত তাইনা মা?”

ইলোরা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,” তুই চুপ কর। একদম চুপ। আমার ছেলে খুনি হতে পারে না। তুই তো কোনো অন্যায় করিস নি। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিস। তাহলে তোর সাথে এতোবড় অন্যায় কেন হবে?”

” নোরাও তো কোনো অন্যায় করেনি মা। বরং অন্যায় ওর সাথে করা হয়েছে। আমি সেই অপরাধীদের নিজহাতে শাস্তি দিয়েছি। ঠিক করেছি না মা বলো? শিপন আর আরিফ বেঁচে গেছে, কিন্তু আলভীকে তো শাস্তি দিতে পেরেছি। ওর এই পরিণতি সবার কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ কেমন আজব দেশে বাস করি বলোতো মা? যেখানে ধর্ষকদের শাস্তি হলো সাতবছরের।অথচ যে ধর্ষককে শাস্তি দিয়ে জেলে আসল তার শাস্তি হয়ে গেল চৌদ্দবছরের। এ কেমন বিচার ব্যবস্থা বলতে পারো মা?”

ইলোরা কাঁদতে কাঁদতে নুইয়ে পড়েছেন। অনিক চোখের কোণ মুছে বলল, ” আমি কিন্তু কষ্ট পাইনি মা। একদম কষ্ট পাইনি। মাথা উচু করে জেলে এসেছি। মাথা উচু করেই বের হবো। সবাই আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলছে, আমাকে নিয়ে আন্দোলন করছে, লড়াই করছে, এর থেকে বড় পাওয়া আমার জন্য কি হতে পারে বলো মা? তবে হ্যা, যেদিনই মুক্তি পাই, জেল ফেরত আসামী হয়ে কিন্তু আমি ধর্ষিতা নোরাকেই বিয়ে করবো। ধর্ষিতা মেয়ের খুনি স্বামী। অথবা খুনি ছেলের ধর্ষিতা বউ।”

অনিক হাসতে লাগল। সেই হাসি বিষের মতো লাগছিল ইলোরার কাছে। উনি কানচেপে ধরে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসলেন। নোরা অনিকের সাথে দেখা করতে গেল। কান্নামাখা গলায় বলল, ” কেন করলে এমন?”

অনিক নোরাকেও একই কথা শোনাল। এসব শুনে নোরার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার জন্যই অনিকের জীবন নষ্ট হয়েছে। তার গায়ে যেমন লেগেছে ধর্ষিতার কলঙ্ক, তেমন অনিকের কপালেও গেথে গেছে খুনির তকমা।

এদিকে সাধারণ জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। অনিকের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নির্বিশেষে সবাই জায়গায় জায়গায় আন্দোলন গড়ে তুলছে। অনিক আবেদিনকে বেকসুর খালাস দেওয়ার দাবী। এই শাস্তি কেউই মানতে রাজি নয়। তবে অনিক বেকসুর খালাস তো পেল না, কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় তার শাস্তি কমিয়ে আনা হল। ছয় বছরের জায়গায় দুই বছরের কারাদন্ড দেওয়া হল তাকে।

দুইবছর পর,
অনিককে জেল থেকে রিসিভ করতে সবাই এসেছে। আনিকা, ইসহাক, ইলোরা, আনিকার হাসব্যান্ড আলিও বিদেশ থেকে ফিরেছে বহুদিন আগে৷ তিনিও আজ এসেছেন। তাদের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার বয়স পাঁচবছর। অনিক এতোদিন ভাগ্নিকে জেলের ভেতর থেকে দেখেছে। আজ বাহিরে থেকে দেখছে। ভাগ্নি দৌড়ে এসে তার কোলে উঠে মিষ্টি কণ্ঠে ডাকল,” মামা!”

অনিক বাচ্চাটার কপালে চুমু দিল। মেয়েটার নাম রাখা হয়েছে অনিরা। অনিক আর নোরার সাথে মিলিয়ে অনিরা। নোরার মা-বাবাও অনিককে দেখতে এসেছে। শুধু আসেনি নোরা। দুই ফ্যামিলির মধ্যে এখন বেশ ভালো সম্পর্ক।

ইলোরা নোরার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। উনি এতোদিনে এইটা বুঝে গেছেন, নোরাকে ছাড়া উনার নিজের ছেলের সুখ সম্ভব না। এই ছয় বছরে নোরাকে উনি মাথায় তুলে রেখেছেন। পুত্রবধুর সম্মান দিয়েছেন। তিথির বিয়ে হয়েছে তিনবছর আগে। এটা হওয়ারই ছিল। যত যাই হোক, দিনশেষে খুনী ছেলে কে বিয়ে করতে চায়?

ইলোরাও এখন জানেন তিথি অনিকের কতটা অযোগ্য ছিল। অনিক লীরা-আনিসকে সালাম করল। তারপর নোরার কথা জিজ্ঞেস করতেই ওরা বলল নোরা অনিকের জন্য বাসায় ওয়েট করছে। অনিক নোরার মা-বাবার সাথে উনাদের বাসায় চলে গেল। নোরা অনিককে রিসিভ করতে আসলনা এই কৌতুহলটা অনিকের মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

নোরাদের বাসায় যাওয়ার পর অনিক নোরার রুমে ঢুকল। পুরো রুম অন্ধকার। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। ছোট ছোট প্রদীপ শিখার মতো আলো। সেই আলো দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে ইংরেজি অক্ষরে লেখা,” হ্যাপি বার্থডে অনিক। নিচে সংখ্যাক্ষরে লেখা উনত্রিশ। অনিকের মনে পড়ে গেল আজ তার বয়স উনত্রিশ পূর্ণ হচ্ছে। নিজেকে এখন কিছুটা বুড়ো মনে হচ্ছে।

কিন্তু নোরা কোথায়? অনিক আশেপাশে খুঁজতেই দেখল নোরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সাথে কেক, ছুড়ি ক্যান্ডেলস,বেলুন। অনিক নোরার দিকে এগিয়ে গেল। নোরা উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনিক ডাকল,” নোরা, আমার মিষ্টিপরী।”

নোরা লাজুকমুখে সামনে ঘুরল। অনিকের দিকে তাকাতেই হালকা অবাক হল। চুল,দাড়ি বড় হয়ে কেমন কবি কবি টাইপ অবস্থা। তবে এই অবস্থাতেও ওকে বেশ লাগছে। নোরার হালকা লজ্জাও লাগছে। এতোদিন পর সামনা-সামনি দেখা, যদিও প্রায়ই জেলখানায় দেখা হতো ওদের। কিন্তু আজকের দিনটা তো স্পেশাল। অনিক হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে নোরার সামনে বসে পড়ল। এক হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,” এই মেয়ে, তুমি কি এই জেল ফেরত আসামীর রুমমেট হবে?”

নোরা মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ” আমি এই জেল ফেরত আসামির ধর্ষিতা বউ হবো।”

অনিক চোখ-মুখ শক্ত করে উঠে দাড়াল। নোরা দুইগাল স্পর্শ করে কঠিন গলায় বলল, ” নিজেকে আর কক্ষনো ধর্ষিতা বলবে না। তুমি ধর্ষিতা নও, তুমি আমার লক্ষী বউ।”

অনিক নোরার কপালে চুমু দিল। নোরা তৃপ্তি নিয়ে অনুভব করল। তারপর অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,” আর তুমি কখনো নিজেকে আসামি বলবে না। তুমি আমার কিউট স্বামী। জেলফেরত আসামি নও।”

একথা শুনে অনিক হেসে ফেলল। নোরাও হেসে অনিকের বুকে মাথা রাখল। অনিক তার বুকে শীতল প্রশান্তি অনুভব করল। অদ্ভুত এক তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ল সারা বুকজুড়ে। অনিক নোরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ এভাবেই থাকল। একটু পর অনিক বলল,” বড় হয়ে গেছো নোরা। এখন তোমাকে সত্যি বউ বউ লাগে।”

” আগে বউ বউ লাগতো না?”

” উহুম। বাচ্চা লাগতো। মনে হতো বাচ্চা গার্লফ্রেন্ড আমার।”

নোরা হাসল। বলল,” এ বছর একুশে পা রেখেছি আমি।”

” তাহলে তো অনেকবড় হয়ে গেছো। এসো তোমাকে একটু কোলে নেই।”

” আমার ওজনও কিন্তু বেড়েছে।”

নোরা একথা বলতে বলতেই অনিক ওকে কোলে নিয়ে ফেলল। তারপর ভ্রু কুচকে বলল,” কোথায় ওজন বেড়েছে? তুমি তো আগের মতোই হালকা।”

” তাহলে মনে হয় তোমার বিরহে শুকিয়ে গেছি।”

অনিক দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,” সবটা পুষিয়ে দিব।”

নোরা অনিকের বুকে ধুম-ধারাক্কা কিল দিতে শুরু করল। অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

সমাপ্ত।

প্রিয়তোষ পর্ব-১৯

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৯
লিখা Sidratul Muntaz

নোরা অনিককে অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছে। অনিক ফোন ধরছে না। নোরার রাগ লাগছে। এতোবড় একটা ডিসিশন অনিক ওকে না জানিয়ে কি করে নিতে পারল? সে জবাব চাইবে অনিকের কাছে। আরো কয়েকবার রিং হওয়ার পর অনিক ফোন ধরে খুব বিনীত গলায় বলল” হ্যালো!”

নোরার রাগান্বিত কণ্ঠ, ” এতোক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি ফোন ধরছিলে না কেন?”

” সরি। পাশের রুমে শার্ট ইস্ত্রি করছিলাম। ফোনটা সাইলেন্ট ছিল তাই..”

” বাদ দাও। আগে বলো তুমি আমাদের ভার্সিটি থেকে রিজাইন কেন করেছো?”

” চাকরিটা আমার আর দরকার নেই তাই।”

” দরকার নেই মানে? এতো ভালো চাকরি কেন দরকার নেই? নতুন চাকরি পেয়েছো?”

” না, এখনও পাইনি।”

” তাহলে কেন ছাড়লে চাকরিটা?নাকি আমার মুখ দেখতে চাওনা?”

” ছি নোরা! এইটা কি ধরণের কথা? আমি তোমার মুখ দেখতে চাইবো না?”

” তাহলে চাকরি কেন ছাড়লে?”

” আমি চাইনা তোমার আমার মধ্যে শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কটা আর থাকুক। এজন্যই তো মা তোমাকে অপমান করার সুযোগ পেয়েছিল।”

” মানে? তুমি এই সামান্য কারণে এতো ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিলে?”

” সামান্য কারণ না নোরা। এটা আমার কাছে অনেকবড় কারণ। তোমার অপমান মানে আমার অপমান। আমি চাইনা এই বিষয়টা নিয়ে আর কখনো তোমাকে কারো কাছে অপমানিত হতে হোক। অন্তত আমি সেটা টলরেট করবো না।”

নোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” বুঝেছি। শার্ট ইস্ত্রি করছিলে কেন? কোথাও যাচ্ছো?”

” হ্যাঁ। আজ একটা চাকরির ভাইবা আছে। খুব ভালো চাকরি। ভাইবাতে পাশ করলেই কনফার্ম হয়ে যাবে। স্যালারি চল্লিশ হাজার টাকা। দোয়া করো।”

” ওয়াও! নিশ্চয়ই দোয়া করি। কখন ইন্টারভিউ? ”

” আজ সন্ধ্যায়।”

” সন্ধ্যায়? কোন জায়গায়?”

” বসুন্ধরাতে।”

” আজকে তো বসুন্ধরাতে আমারও যাওয়ার কথা।”

” তাই? কেন?”

” আজকে অর্পি আপুর মেহেন্দী। বসুন্ধরার কোনো এক রেস্টুরেন্টে আয়োজন করা হয়েছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যাবো না।”

” যাবেনা কেন? যাও, ঘুরে এসো। কাজিনদের সাথে থাকলে ভালো লাগবে।”

” হুম। এখন ভাবছি যাবো। আসার সময় তুমি আমাকে ড্রপ করে নিতে পারবেনা?”

” অবশ্যই। এটা তো আমার সৌভাগ্য।”

নোরা হেসে বলল,” অনেকরাত হবে কিন্তু।”

” কতরাত?”

” বারোটার উপরে বাজতে পারে।”

” সমস্যা নেই। আমার ইন্টারভিউ হয়তো নয়টা নাগাদ শেষ হয়ে যাবে। তারপর আমি তোমাকে ফোন করবো। তুমি এ্যাড্রেস দিও, আমি সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করবো।”

” আচ্ছা ঠিকাছে, রাখছি তাহলে।”

” আচ্ছা।”

ফোনটা রেখেই অনিক মুচকি হাসল। আজ অনেকদিন পর নোরার সাথে বাইকে চড়ার সুযোগ হচ্ছে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? সন্ধ্যায় নোরা মেহেন্দির অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য খুব সুন্দর করে সাজল। কালো রঙের একটা গর্জিয়াস সেলোয়ার কামিজ, মুখে মেকাপের প্রলেপ,খোলা লালচে চুলগুলো কার্ল করে একসাইডে আটকানো। নিজের রুপে নিজেরই মুগ্ধ হতে ইচ্ছে করছে। এই অবস্থায় অনিকের সামনে গেলে কি হবে? অনিক তো গাধার মতো তাকিয়ে থাকবে। আর সেই তাকানো দেখে নোরা লজ্জারাঙা হবে।

নোরা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেই হাসছিল। হঠাৎ অনিকের ফোন এলো। নোরা ফোন ধরে বলল,” হ্যালো!”

” বের হয়েছো?”

” না। রেডি হচ্ছি। আর এখন তোমার সাথে যেতে পারবো না। আমাকে বাবা নিয়ে দিয়ে আসবে। আসার সময় তোমার সাথে আসবো।”

” ওহ। তাহলে কি আমি চলে যাবো?”

” হুম চলে যাও।”

” আচ্ছা, সাবধানে যেও।”

” আচ্ছা।”

অনিক ইন্টারভিউরুমের সামনে অপেক্ষা করছে। জায়গাটায় প্রচন্ড ভীড়। তার পরনে আকাশী রঙের ফরমাল শার্ট আর কালো রঙের ফরমাল প্যান্ট। নেভি ব্লু রঙের টাই। শার্টের হাতা ফোল্ড করা। হাতে খয়েরী মোলাটের একটা ফাইল। বামহাতে এ্যাশ কালার ঘড়ি। হাতে সাদা টিস্যু। বারবার ঘেমে যাচ্ছে সে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম টিস্যুতে মুছছে। ভীড়ের মধ্যে বসে থাকতে তার গরম লাগছে। এতো গরমেও মানুষ বসে বসে চা খাচ্ছে। তার উপর একটু পর পর দাড়োয়ান ওর কাছে ডিশে করে চা নিয়ে আসছে। প্রায় বারবার জিজ্ঞেস করছে,” চা খাইবেন স্যার?”

অনিক কয়েকবার ভদ্রভাষায় না করেছে। কিন্তু লোকটা নাছোরবান্দা। যেন চা খাইয়েই ছাড়বে। আরো একবার জিজ্ঞেস করতে এলো,” স্যার দেই এককাপ চা?”

অনিক এবার জবাবই দিলনা। কিন্তু তার বলতে ইচ্ছে করছিল,” কাছে এসো, চা তোমার মাথায় ঢালি।”

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। অনিকের সিরিয়াল এখনো আসেনি। ঘড়িতে নয়টা বাজতে চলল। আর কত? যেখানে এক পোস্টের জন্য এতো মানুষ ডাকা হয়েছে সেখানে তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বললেই চলে। টাই লুজ করে পা মেলে বসল৷ তার সবকিছু অসহ্যবোধ হচ্ছে।

প্রায় দেড়ঘণ্টা পর যখন রাত সাড়ে দশটা বাজে তখন জানা গেল ইন্টারভিউয়ের যে মেইন অফিসার, মিঃ শফিকুল মোর্শেদ এখনো আসেন নি। অনিকের এতো মেজাজ খারাপ হল! ইচ্ছে করল সবকিছু ভেঙে ফেলতে। এমন হলে সে নোরার কাছে যাবে কখন? অনিকের মাথা ধরে আসছে।

কিছুক্ষণ পর জানা গেল, মোর্শেদ সাহেব মাত্র প্রবেশ করেছেন। চারদিকে হৈচৈ বেঁধে গেল। ইন্টারভিউয়ের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। কোর্ট পড়া ভদ্রলোক হাসিমুখে ভেতরে যেতে যেতে বললেন,” সরি, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছি। আসলে রাস্তায় এতো জ্যাম!”

অনিকের এই কথাটাও বিরক্ত লাগল। সবার প্রথমেই তার নাম ডাকা হল,” মিঃ অনিক আবেদিন।”

অনিক ইন্টারভিউ রুমে যখন ঢুকবে তখন রাত এগারোটা বাজে। আর তখনি নোরার ফোন আসল। অনিক ফোনটা কেটে দিয়ে ম্যাসেজ করল,” আধঘণ্টা অপেক্ষা করো, আমি আসছি। তুমি আমাকে এ্যাড্রেস সেন্ড করে রাখো। আর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার দরকার নেই, ভিতরেই থাকো। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।”

এদিকে নোরা অলরেডি বের হয়ে গেছে। সে খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়েই অনিককে ফোন করছিল। অনিকের ম্যাসেজ দেখে সে আবারও ফোন করতে লাগল। কিন্তু অনিক ফোন সাইলেন্ট করে পকেটে রেখে দিয়েছে।

নোরার যে কি বিরক্ত লাগছে। সম্পুর্ণ রাস্তায় সে শুধু একা। ঘোর অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। বাসে যে উঠবে তারও উপায় নেই। বাস পাওয়া যাচ্ছেনা। তার ফোনে ইন্টারনেটও নেই যে একটা উবার কল করবে। অনিকের জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব না। আবার একা একা বাড়ি ফিরে যাওয়াও সম্ভব না। ভীড় বাসে ওরা মহিলা উঠাতে চায়না।

খালি বাসে উঠতে নোরার নিজেরই ভয় লাগে। মোটামোটি ভীড় কম আর সম্পুর্ণ খালিও না এমন বাস পাওয়া যাচ্ছে না। কি একটা মুশকিল। নোরা রাস্তার একপাশ দিয়ে হাটতে লাগল৷ হঠাৎ নোরার মনে হল কেউ তাকে ফলো করছে। তার পেছনে তিনজন মুখোশধারী ছেলে। ওদের দেখে নোরার ভেতরটা শিউরে উঠল। ওরা কি নোরাকেই ফলো করছে। নোরা জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। একবার তার মনে হল ছেলেগুলো আলভী,শিপন আর আরিফ। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল না। আলভীরা তো ভালো হয়ে গিয়েছিল। ওরা এমনকাজ করবেনা।

তারপর আবার মনে হল কুকুরের লেজ কোনোদিন সোজা হয়না। নোরা বুকের মধ্যে জোরালো ধাক্কা অনুভব করল। নিজের অজান্তেই সে কখন জানি দৌড়াতে শুরু করে দিয়েছে। ছেলেগুলো এখন আর ওর পেছনে আসছে না। নোরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনিককে আবার ফোন করা শুরু করল। অনেকবার ফোন করল। কিন্তু নো রেসপন্স।

নোরা ফোনটা ব্যাগে ভরে আবার হাটতে লাগল। সামনেই একটা সিএনজি পেয়ে গেল। নোরা ভাবল সিএনজি করেই চলে যাবে। সিএনজিওয়ালার সাথে কথা হল৷ সিএনজিওয়ালা ওকে নিয়ে যেতে রাজি হল। নোরা সিএনজিতে বসে ক্রমাগত দোয়া পড়ছে। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। বাবাকে কি একটা ফোন করবে? বাবা এইসময় প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কি দরকার এই অবস্থায় বাবাকে জ্বালানোর?

মাকেও টেনশন দিতে ইচ্ছে করছে না। সে তো সবাইকে বলে এসেছিল অনিকের সাথে ফিরবে। কিন্তু সেই অনিকেরই এখন খোঁজ নেই। হঠাৎ সিএনজি ওয়াল একটা নীরব জায়গায় গাড়ি থামাল। নোরা জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”

” বুঝতাসি না। টায়ার পাংচার হইসে মনে হয়। চেঞ্জ করতে হইবো।”

” হায় হায় কি বলেন? কতক্ষণ লাগবে?”

” বেশিসময় লাগবো না। অপেক্ষা করেন।”

সিএনজিওয়ালা একথা বলে কোথায় যেন চলে গেল। নোরার এখন সন্দেহ হচ্ছে। এটা কোনো ফাদ নয়তো? ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আরো কয়েকবার অনিককে ফোন করল। বাবার নম্বরেও ডায়াল করল। মাকেও করল। কিন্তু কেউই আজ ফোন ধরছেনা।

হঠাৎ নোরা খেয়াল করল সেই মুখোশধারী তিনজন তাকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। নোরা ভয়ে শব্দ করতে যাবে তার আগেই ওর মুখ চেপে ধরা হল। নোরার হাত-পা ভয়ে শিথিল হয়ে আসছে৷ তাকে কোথায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে নিজেও জানেনা।

ইন্টারভিউ শেষ করে বাহিরে বের হল অনিক। ফোনটা হাতে নিতেই দেখল নোরার অনেকগুলো মিসডকল। অনিকের খোটকা লাগল। কোনো বিপদ হয়নি তো? জলদি কলব্যাক করল। কিন্তু এবার নোরা ফোন ধরছে না। অনিক কলব্যাক করতেই লাগল। শুধু রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে। অনিকের অস্থির লাগতে শুরু করল। ফোনটা রিসিভ হল অনেকক্ষণ পর। অনিক বিচলিতগলায় বলল,” নোরা, কোথায় তুমি?”

নোরার ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। নোরার এমন কণ্ঠ শুনে অনিকের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। অনিক বলল,” হ্যালো নোরা, কি হয়েছে তোমার? তুমি কোথায় আছো আমাকে বলো!”

নোরা অস্পষ্টভাবে বলল,” গ্রীন, গ্রীন সাইনবোর্ড,গ্রীন সাইনবোর্ড,ভ্যাসলিনের এড। তাসনিয়া ফারিনের।”

নোরা প্রত্যেকটা শব্দের শেষে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। অনিক যেটুকু বুঝল, নোরা এমন একটা জায়গায় আছে যেখানে গ্রীন সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে ভ্যাসলিনের এড দেওয়া। আর মডেল তাসনিয়া ফারিন। অনিক ফোন কাটল না। লাইনে থেকেই বাইক চালানো শুরু করল। নোরাদের বাসার দিকে যেতে লাগল। পথে নিশ্চয়ই কোথাও গ্রীন সাইনবোর্ড দেখা যাবে। অনিক বাইক চালাচ্ছে আর বলছে, ” নোরা তুমি প্লিজ কথা বলতে থাকো। ফোন কেটো না নোরা আমি আসছি। খুব জলদি আসছি।”

নোরা এখনও আর্তনাদের শব্দ করছে। প্রতিটা শব্দ অনিকের বুকের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো দপদপ করে জ্বলছে। অনিক দিশেহারার মতো বাইক চালাচ্ছে। একটা সময় থেমে গেল। দেখল বিশাল সাইনবোর্ড। জায়গাটা একদম নিরব। নোরার বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে। অনিক বাইক ছেড়ে দিল। এতো জোরে ছাড়ল যে বাইকটা কাত হয়ে পড়ে গেল। অনিকের সেই হুশ নেই।

সে উন্মাদের মতো আশেপাশে নোরাকে খুঁজছে। হঠাৎ দেখল ঝোপঝাড়ের নিচে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে এক নিথর দেহ। অবস্থা ক্ষত-বিক্ষত। অনিক স্তব্ধ হয়ে গেল। অনুভূতিশুন্য চাহনি নিয়ে ধীরপায়ে হেলতে দুলতে এগুতে লাগল। মেয়েটা যেন তার নোরা না হয়। এই কামনাই মনে মনে পুষছে সে।কাছে যেতেই বুঝতে পারল মেয়েটা নোরা!

অনিকের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। বুকের ভেতরটা নিভু নিভু করছে। নোরার গালে হাত দিয়ে কয়েকবার ডাকল,” নোরা, এই নোরা, নোরা!”

নোরার কোনো সাড়াশব্দ নেই। অজ্ঞান হয়ে গেছে হয়তো। কি হয়েছে ওর সাথে? খুব ভয়ানক কিছু? অনিকের মাথা ফেটে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে নোরাকে কোলে তুলল সে। নোরার শরীর থেকে রক্তের স্রোতধারা বাহিত হচ্ছে।

অনিক ওকে নিয়ে দৌড়াতে লাগল। একটা গাড়ি, শুধু একটা গাড়ি এখন তার খুব প্রয়োজন। কিন্তু দেশে এমন কোনো স্বহৃদয়বান নেই, যে তার ধর্ষিতা প্রেমিকাকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে হসলিটাল পর্যন্ত পৌছে দিবে। তাকে বাচতে দিবে। ধর্ষিতাদের কি আদৌ বাচার অধিকার আছে?

অনিক চিৎকার করে গাড়ি খুঁজতে লাগল৷ বাইকে নোরাকে উঠানো যাবেনা। এই অবস্থায় নোরা বাইক থেকে পড়ে যাবে। কেউ তাদের নিতে চাইছে না। যেই আসছে সেই-ই চলে যাচ্ছে। যেন পালিয়ে বাচতে চাচ্ছে। রাস্তায় একটা মানুষও নেই। কি করবে অনিক? তারপর একটা বয়োবৃদ্ধ রিকশাওয়ালার দেখা পেল। রিকশাওয়ালা নির্দ্বিধায় ওদেরকে রিকশাতে তুলে নিল। অনিক নোরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বারবার বলছে,” কিচ্ছু হবে না নোরা, এইযে আর একটু।”

রিকশাওয়াল ওদের কাছাকাছি একটা হসপিটালে নামাল। অনিকের রিকশা ভাড়া দেওয়ার কথা মাথায় ছিলনা। সে নোরাকে কোলে করে হসপিটালে ঢুকে গেল। রিকশাওয়ালাও আর ডাকলেন না। মনে মনে দোয়া করতে লাগলেন, মেয়েটাকে যেন বাঁচানো যায়।

টানা সাতদিন অবজারভেশনে রাখার পর নোরা রেসপন্স করতে শুরু করল। হিতাহিতজ্ঞান ফিরে পেল। এতোদিন অনিক শুধু পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছে আলভী,শিপন আর আরিফদের। যদিও নোরা মুখে ওদের নাম নেয়নি। কিভাবে নিবে? সে তো কথা বলার মতো অবস্থাতেই ছিলনা। তবুও অনিক নিশ্চিত এই দুর্ঘটনার পেছনে ওরাই আছে।

পুলিশ অপেক্ষা করছে নোরার জ্ঞান ফেরার। ওর সাথে সাথে কথা না বলে তেমন কোনো স্টেপ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবে অনিক একা হাতেই সব সামলাচ্ছে। সে অনেক জায়গায় খোঁজ লাগিয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে ওই তিনজন একেবারে নিখোঁজ। সেদিনের পর থেকে ওদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নোরার বাবা আনিস প্রথমদিনই স্ট্রোক করে বসেন। এখন তিনি হসপিটালে ভর্তি।

লীরার শরীরও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সারাক্ষণ খালি কান্নাকাটি করে। হসপিটালেই দিনযাপন করছেন উনি। অসুস্থ মেয়ে আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে। লীরা হসপিটালের করিডোরে হাঁটাহাটি করছিলেন। হঠাৎ খবর এলো নোরার জ্ঞান ফিরেছে।

এতোদিন অপেক্ষার পর এমন একটা সুসংবাদ পেয়ে লীরা সবার আগে অনিককে ফোন দিলেন। অনিক আধঘণ্টার মধ্যে হসপিটালে হাজির হলো। অনিক কেবিনে ঢুকতেই দেখল নোরার নিস্তব্ধ দুটি চোখ। তার ভেতরটা কেঁদে উঠতে চাইল। অচিরেই চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে উঠল। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। লীরা অনিককে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অনিকের কাছে গিয়ে বললেন,” বাবা, মেয়েটা তো কথা বলছে না। কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম। একটা শব্দ পর্যন্ত করল না। শুধু চেয়ে থাকে। কিচ্ছু বলেনা। ও কি আর কোনোদিন কথা বলবে না বাবা?”

অনিক সঙ্গে সঙ্গে বলল,” কথা বলবে আন্টি। নিশ্চয়ই কথা বলবে। ওকে কথা বলতেই হবে।”

লীরা কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেয়ের এ অবস্থা উনার সহ্য হচ্ছেনা। অনিক নোরার পাশে গিয়ে বসল। ওর হাতটা ধরে সেই হাতে একটা চুমু দিল। তার ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও শপথ করছে, নোরার এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের উপযুক্ত শাস্তি সে দিয়েই ছাড়বে। এ পর্যন্ত কয়বার যে অচেতন নোরার হাত ধরে এ শপথ করেছে সে তার হিসেব নেই। আজ আবারও করল।

নোরার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুগলায় ডাকল,” নোরা, এই নোরা। কথা বলবে না নোরা? আমার সাথেও কথা বলবে না? অবশ্য না বলাটাই তো স্বাভাবিক। তোমার এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। শুধু আমিই। সেদিন ইন্টারভিউটা যদি না দিতে যেতাম তাহলে হয়তো আজও তুমি সুস্থ থাকতে, স্বাভাবিক থাকতে। আমার উপর ভরসা করেই তো তুমি রাতেরবেলা বাসা থেকে বের হওয়ার সাহস দেখিয়েছো, অথচ সেই আমিই তোমার হাতটা ধরতে পারলাম না।

যখন তোমার আমাকে সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল। তখনি তোমার কাছে আমি পৌঁছাতে পারলাম না। পৌঁছালাম কখন? সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর। খুব ভালো হতো যদি মানুষের আগে থেকে ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা থাকতো। বিশ্বাস করো নোরা আমি যদি কোনোভাবে খালি একবার জানতে পারতাম তোমার সাথে এতোবড় একটা অন্যায় হতে যাচ্ছে তাহলে কক্ষনো তোমাকে একা ছাড়তাম না। সারাখন পাহাড়া দিয়ে রাখতাম। চুলোয় যাক আমার চাকরি, চুলোয় যাক ইন্টারভিউ। কিচ্ছু পরোয়া করতাম না। সেই চাকরিটা আমি ঠিকই পেয়েছিলাম জানো নোরা।

তিনদিনের মাথাতেই লেটার এসেছিল। যখন তুমি হসপিটালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলে আর সেজন্য দায়ী আমার ওই ইন্টারভিউ, ওই চাকরি। আমার কি মাথা ঠিক থাকার কথা? আমি লেটারটাকে কুচি কুচি করে কাটলাম। তারপর ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। কোনোদিন করবো না ওই চাকরি আমি। কোনোদিন না। যে চাকরির জন্য আমার তোমাকে হারাতে হয়, এমন চাকরি আমার দরকার নেই। আমার শুধু তোমাকে দরকার নোরা। বড্ড দরকার। তোমার আগের সেই চঞ্চলতা, সেই উচ্ছ্বাস,তোমার হাসিমাখা মুখ সবকিছু আমার দরকার। কতদিন হয়ে গেছে তোমার কণ্ঠস্বর শুনিনা। একবার কথা বলো না নোরা প্লিজ! আমি আর পারছি না। এরপর তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। প্লিজ কথা বলো না নোরা প্লিজ।”

অনিক খানিক চুপ মারল। তার গলা ভেঙে আসছে। বুকের মধ্যে তীব্র এক ব্যথা অনুভব হচ্ছে। চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর আবার বলল,” কষ্ট পেও না নোরা। সবকিছু আমি ঠিক করে দিবো। আবার আগের মতো। যারা তোমার সাথে এই অন্যায় করেছে তাদেরকে তোমার পায়ের সামনে এনে ফেলবো ওয়াদা করছি। তুমি নিজহাতে ওদের শিরচ্ছেদ করবে। ”

নোরা হঠাৎ মৃদু হাসল। অনিক নোরার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা গভীর চুমু দিয়ে বলল,” আসছি, অনেক কাজ আমার। তুমি রেস্ট নাও। বাই।”

নোরা কিছু বলল না। হাসিমাখা মুখ বজায় রাখল। অনিক দরজার বাইরে গিয়ে লীরার সাথে কি যেন কথা বলছে। নোরা সেদিকে কর্ণপাত করলনা। সাতদিন আগের ঘটনাগুলো ওর আবার মনে পড়ছে। শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। হাত-পা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সারাদিন নোরা একটাও কথা বলেনি।

সন্ধ্যায় আবার লীরা ফোন করে জানাল নোরা কথা বলছে, আর অনিকের সাথে কথা বলতে চাইছে। অনিক নিজের ঘরে শুয়ে ছিল৷ এই খবর শুনে জলদি উঠে তৈরি হতে লাগল হসপিটালে যাওয়ার জন্য। নোরা তার সাথে কথা বলতে চাইছে। এরচেয়ে ভালো সংবাদ এই মুহুর্তে আর কিচ্ছু হতে পারেনা। হঠাৎ দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। অনিক দরজা খুলে দেখল মা এসেছে। অনিক কোনো বলল না। দরজাটা খোলা রেখে শার্ট পড়তে লাগল। ইলোরা বললেন,” কোথাও বের হচ্ছিস নাকি?”

” হুম।”

” যাচ্ছিস কোথায়?”

” কাজ আছে।”

” আমি জানি তো কি কাজ।”

অনিক বিরক্তগলায় বলল,” জানলে ভালো। এতো প্রশ্ন করছো কেন?”

” তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

” পরে শুনবো।”

” এখনি শুনতে হবে।”

অনিক উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। ইলোরা জোরগলায় ডাকলেন,” অনিক!”

অনিক থামল এবং দ্বিগুণ বিরক্তিমাখা গলায় বলল,” কি?”

ইলোরা ছেলের সামনে এসে ওর কাধে হাত রেখে বললেন,” বোস এখানে।”

” মা আমার তাড়া আছে। আমাকে যেতে হবে। পরে এসে শুনবো তোমার কথা।”

” তোকে আমি বসতে বলেছি।”

ওদের চেচামেচির শব্দে আনিকা ছুটে আসল। ইলোরা আনিকাকে দেখে কিছু বললেন না। অনিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,” আজ তিথিকে আমি আংটি পরিয়ে এসেছি। এ মাসের মধ্যেই তোদের বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই।”

অনিক ভ্রু কুঁচকে বলল,” হোয়াট?”

একই সাথে আনিকাও বলল,” মানে?”

ইলোরা ছেলে-মেয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন,” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি কি আমার ছেলেকে সারাজীবন অবিবাহিত রাখবো নাকি? তার উপর বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন পরেই সাতাইশে পা রাখবে৷ এই বয়স বিয়ে করার জন্য যথার্থ।”

অনিক কিছু বলতে পারলনা। তার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে সামনে থাকা কাচের জগে একটা জোরে ঘুষি মারতে। জগটা ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। আর তার হাত হবে ক্ষত-বিক্ষত। এতেই যেন শান্তি লাগবে। আনিকা বলল,” মা তুমি এই কথা এখন কিভাবে বলছো? পরিস্থিতি কি তোমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? নোরার এই ভয়ংকর অবস্থা, ভাই কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কোনো ধারণা নেই তোমার? ছেলেটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখো মরার মতো বেঁচে আছে।”

ইলোরা বললেন,” আমি আমার ছেলেকে দেখেছি। আর সেজন্যই বলছি, ওর ভালোর জন্য বলছি। কোনো ধর্ষিতা মেয়েকে নিশ্চয়ই আমি বাড়ির বউ করবো না! তাহলে শুধু শুধু অপেক্ষা করে লাভ কি? কার জন্য অপেক্ষা? তিথির সাথে বিয়েটা হয়ে যাক!”

আনিকা কপালে হাত ঠেঁকাল। সে কাকে কি বুঝাচ্ছে? ইলোরা আবার বললেন,” অনিক ধর্ষকদের খুজে বের করতে নোরাকে সাহায্য করছে তো করুক। আমার তো সেটা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। ধর্ষকরা ধরা পড়লে উপযুক্ত শাস্তি পাবে এটাই তো অনিক চায়। কিন্তু তার জন্য বিয়েটা আটকে থাকবে কেন? আগে বিয়েটা হয়ে যাক তারপর..”

অনিক হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ইলোরা পিছু ডাকলেন, অনিক শুনল না। আনিকা মায়ের কাছে হাতজোড় করে বলল,” মাফ চাই তোমার কাছে। দয়া করে ছেলেটাকে একটু শান্তি দাও।”

তারপর সেও ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অনিক হসপিটালে গিয়ে দেখল পুলিশের সাথে নোরা কথা বলছে। এইটা দেখে সে আর ভেতরে ঢুকল না। নোরা সেদিনরাতের ঘটনা পুলিশের কাছে বর্ণনা করছে। সে এখন ভেতরে গেলে নোরা অপ্রস্তুতবোধ করবে। হয়তো সবকিছু বলতেও চাইবে না।

অনিক বাহিরে দাঁড়িয়েই সবটা শোনার চেষ্টা করল। যেটুকু শুনল তার ব্যাখ্যা এই, ওরা তিনজন ছিল। আর তিনজনই মুখোশধারী। মাঝরাস্তায় সিএনজি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ওরা নোরাকে সিএনজি থেকে তুলে নেয়। নোরার ধারণা সিএনজিওয়ালাও এর সাথে যুক্ত। পুলিশরা সিএনজির বর্ণনা চাইলেন।

নোরা অস্পষ্ট বর্ণনা দিল। ছেলেগুলো ওকে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে প্রথমেই হাত-পা বাধল। নোরা ততক্ষণে কাবু হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে তিনজনই মুখোশ খুলেছিল তবে চেহারা দেখা যায়নি। কিন্তু কণ্ঠ শুনে যতটুকু বুঝেছে, ওরা আলভী,শিপন আর আরিফই। ফোনটা নোরার হাতে ছিল। কেউ একজন ফোনটা হাত থেকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ধর্ষণের পর ওরা নোরাকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর ফোন বাজার শব্দ শুনে তিনজনই ছুটে পালায়।

নোরা ফোনের উৎস বরাবর চারদিক হাতড়াতে হাতড়াতে ফোন খুজে বের করে। তখনো অনিকের ফোন বাজছিল। নোরা রিসিভ করে অনিককে ঘটনা জানায়। এরপর আর কি হয়েছিল তার মনে নেই। নোরার জবানবন্দি শোনার পর অনিকের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। শরীরের রগ ফুলে উঠছে। আলভীদের সামনে পেলে এখন সে ঠিক কি করতো নিজেও জানেনা। সবকয়টাকে খুন করে ফেলতো। জানোয়ারের মতো বেরধক পিটিয়ে খু*ন।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১৮

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৮
লিখা Sidratul Muntaz

পরদিন সন্ধ্যায় অনিক বাইক নিয়ে চলে গেল নোরাকে বাসা থেকে আনতে। বাসার নিচে দাঁড়িয়ে নোরাকে ফোন করল সে। এর আগেই নোরা বাইকের আওয়াজ শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ফোন ধরে বলল,” তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি নামছি।”

” ওকে।”

অনিক বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। নোরা আজকে আবার ওকে তুমি করে বলছে। যতবার নোরার মুখ থেকে তুমি ডাকটা শুনে অনিক বুকের মধ্যে ধাক্কা অনুভব করে। তার আশেপাশে সবকিছু রঙিন মনে হয়। অদ্ভুত এক অনুভূতি! নোরা পাঁচমিনিটের মধ্যে নিচে নামল। ওকে দেখে অনিক কয়েক সেকেন্ডের জন্য পলক ফেলতেই ভুলে গেল। হাবার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

নোরাকে অন্যরকম লাগছে। নেভি ব্লু আর কালো রঙের সেলোয়ার কামিজ পরেছে। চোখে কাজল আর কালো আইশ্যাড, ঘন পাপড়িতে মাসকারা, ঠোঁটে ন্যুড কালার লিপস্টিক। সামনের চুলগুলো বোধহয় কার্লও করেছে। ঠিক যেন রাতপরী। এতোসুন্দর! নোরা সামনে এসে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করল,” আমাকে কেমন লাগছে?”

অনিক তখনো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। ঘোর লাগানো গলায় বলল,” রাতপরী।”

নোরা লজ্জা পেয়ে হাসল৷ অনিক বলল,” সামনে বসো।”
” মানে?”

” বাইকের সামনে বসতে বলছি।”

নোরা সামনে উঠে বসল। অনিকের সাথে এই পর্যন্ত যতবার বাইকে উঠেছে অনিক ওকে সামনেই বসিয়েছে। আর নোরার এটা ভীষণ ভালো লাগে। নোরা সামনে বসতেই অনিক ওর চুলে মুখ ডুবাল। তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিল। কি মিষ্টি গন্ধ! অনিক আসক্ত এই গন্ধে। নোরার পিঠের চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ে একটা গভীর চুমু দিল অনিক। নোরা কেঁপে উঠল। অস্থিরগলায় বলল,” কি করছো? রাস্তার মাঝখানে এসব.. কেউ দেখলে?”

” দেখবে কিভাবে? সব তো অন্ধকার।”

” তবুও। তুমি প্লিজ বাইক স্টার্ট দাও তো। নাহলে কিন্তু আমি পেছনে বসবো।”

অনিক হেসে বাইক স্টার্ট দিল। রেস্টুরেন্টে পৌঁছানোর পর অনিক নোরাকে নিয়ে লিফটে উঠল। লিফটে আরো মানুষ ছিল। নোরা জিজ্ঞেস করল,” আমরা কয় নম্বর ফ্লোরে যাচ্ছি?”

” টপ ফ্লোর।”

” মানে ছাদে?”

” হ্যাঁ।”

” কিন্তু ছাদে কেন?”

” দরকার আছে তাই।”
নোরা বুঝতে পারল কি দরকার। লাজুকমুখে বলল,” দেরি হয়ে যাবে না?”

” হোক দেরি। দেরি করে যাওয়াই ভালো, দাম বাড়ে।”

ছাদে প্রচন্ড বাতাস। নোরার চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। অনিক ওকে টান দিয়ে একটা উঁচু জায়গায় দাড় করাল। তারপর দেয়ালের সাথে চেপে ধরেল। নোরা বলল,”মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে তো।”

“মেকাপ বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট নাকি আমি?”

নোরা মিষ্টি হেসে বলল,” তুমি।”

আধঘন্টা পর ওরা নিচে নামল। ইলোরা, ইসহাক, আনিকা সবাই একটা ফ্যামিলি টেবিল বুক করে বসেছে। অনিক-নোরা পৌঁছাতেই দেখল সেখানে তিথিক উপস্থিত। তিথিকে দেখে দু’জনের হাসিই মিলিয়ে গেল। আনিকা আর ইসহাকের মুখেও অন্ধকারের ছাপ। শুধু ইলোরার মুখে মিষ্টি হাসি।

অনিক গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি এখানে আসবে জানলে নোরাকে কখনোই আনতো না সে। সবাইকে চুপ দেখে ইসহাক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে বললেন,” এইতো এসে গেছে ওরা। অনিক, তোদের এতো দেরি হলো কেন?”

অনিক চুপ। নোরাও কি বলবে বুঝতে পারছে না। আনিকা বলল,” রাস্তায় জ্যাম ছিল বোধহয়। নোরা, তুমি আমার পাশে এসে বসো। এসো।”

ইলোরা হেসে বললেন,” এসো নোরা! ”

নোরা গিয়ে আনিকার পাশে বসল। তিথি ইলোরার একপাশে বসেছে। অনিক শান্তভাবে গিয়ে নোরার পাশে বসল। কিন্তু ওর ডানপাশে পড়ে গেল ইলোরা। অনিক ফিসফিস করে মাকে বলল,” মা এসব কি? ও এখানে কেন?”

ইলোরা বললেন,” তিথি আমার মেয়ের মতো। ওকে আমি ফ্যামিলির অংশই মনে করি সবসময়। তাই ডিনারেও নিয়ে এসেছি। আশা করি এতে তোমার কোন সমস্যা হবে না?”

অনিকের ভীষণ রাগ উঠছে। ইচ্ছে করছে নোরাকে নিয়ে এখনি এখান থেকে উঠে চলে যেতে। কিন্তু এই হাসি-খুশি পরিবেশটা নষ্ট হবে বলে ও সেটা করতে পারছেনা। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ইলোরা নোরার হাত ধরে ওকে নিয়ে গেল একটা নিরিবিলি জায়গায়। হাঁটতে হাঁটতে বলল,” কেমন আছো নোরা?”

নোরা নরম সুরে বলল,” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আন্টি। আপনি ভালো আছেন?”

” হুম। এখন বলো আমাকে তোমার কেমন লেগেছে?”

” খুব ভালো। ”

” সত্যিই ভালো লেগেছে? নাকি খুশি করার জন্য বলছো?”

” আমি খুশি করার জন্য কাউকে কিছু বলিনা আন্টি। যা বলি মন থেকে বলি।”

” তাই? তাহলে মন থেকে একটা কথা বলোতো।”

” কি কথা?”

” লম্বা করে মেয়েটাকে দেখলে না আমার সাথে? ওর নাম তিথি। চেনো নিশ্চয়ই? ওর সাথে আমি অনিকের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অনিক তোমাকে বিয়ে করতে চায়। এখন তুমিই আমাকে বলো নোরা, তিথিকে দেখে তোমার কি মনে হলো? অনিকের জন্য তোমাদের দুজনের মধ্যে কে বেশি যোগ্য? তুমি না তিথি? আর সাথে ব্যাখ্যাটাও দিও। কেন বেশি যোগ্য।”

নোরা হাঁটা থামিয়ে দিল। ইলোরাও থেমে গেলেন। নোরা বিব্রতবোধ নিয়ে তাকাল। ইলোরা হাত ভাঁজ করে বললেন,” বলো।”

নোরা মাথা নিচু করে বলল,” আমার মনে হয়, উত্তরটা আপনার প্রশ্নের মধ্যেই আছে আন্টি। ”

” কিরকম?”

” আপনিই তো বললেন, অনিকস্যার আমাকে বিয়ে করতে চান। যেখানে উনি নিজেই আমাকে চান, সেখানে কি যোগ্যতা বিচারের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে?”

ইলোরা ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর হেসে বললেন,” ভালোই তো কথা জানো দেখছি। আর কি বললে? অনিকস্যার? ওহ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম। অনিক এখন তোমাদের ভার্সিটির লেকচারার তাই না? আর তুমি ওর স্টুডেন্ট। আচ্ছা স্টুডেন্ট হয়ে টিচারের সাথে এমন একটা সম্পর্কে জড়ানোর রুচি তোমার কিভাবে হলো বলোতো? ”

নোরা মাথা নিচু করে আছে। তার চোয়াল ক্রমশ কঠিন হয়ে আসছে। ইলোরা একটু ঝুঁকে বললেন,” এটা কি ঠিক? আর তোমার মা-বাবাই বা কেমন? টিচারের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে উঠে-পরে লেগেছেন? তোমার মতো এই কাজটা যদি আমার মেয়ে করতো না, তাহলে আমি ওকে এক চড় দিয়ে সোজা বানিয়ে ফেলতাম। ছেলে-মেয়েদের ভার্সিটি,কোচিং এ পাঠানো হয় লেখাপড়ার জন্য। টিচারদের সাথে ইটিশ-পিটিশ করার জন্য নয়। যেখানে তুমি একজন ছাত্রী হয়ে তোমার থেকে আট-দশবছরের বড় শিক্ষকের সাথে প্রেম করতে পারো, আর তোমার পরিবারও তাতে প্রশ্রয় দেয়, সেই পরিবারের শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।”

নোরার চোখ ছলছল করছে। সে পলক ফেলতে পারছে না, চোখের জল গড়িয়ে পড়ার ভয়ে। এখন কিছুতেই কাঁদা যাবেনা। এমন পরিস্থিতিতে যারা কাঁদে তারা দুর্বল। নোরা নিজের দুর্বলতার পরিচয় দিতে চায়না। ইলোরা নোরার এক বাহু শক্ত করে ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,” শিক্ষকরা বাবার সমতুল্য। মা-বাবার পরে শিক্ষকের স্থান। সেটা জানো? নাকি এটুকু শিক্ষাও পরিবার থেকে দেওয়া হয়নি?”

নোরা কিছু বলতে পারছে না। তার সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। ইলোরা বললেন,” অনিক তোমাকে বিয়ে করতে চায় বলে আনন্দে নাচছো। আবার আমাকেও বড়মুখ করে বলছো যোগ্যতা বিচারের প্রয়োজন নেই। বেয়াদবির চরম মাত্রা কাকে বলে সেটা তো তোমাকে দেখেই শিখতে হয় মেয়ে! তোমার বান্ধবীর অন্তরার কীর্তি তো সব শুনেছি আফিয়া আপার কাছে। প্রেগন্যান্সির নাটক করে ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে। তোমাদের মতো মেয়ের কাজই তো এগুলো।

চূড়ান্ত লজ্জাবোধ যদি থেকে থাকে তাহলে আর কখনও আমার ছেলের সামনে আসবে না তুমি। তোমার মতো বেহায়া মেয়ে আমার ছেলের যোগ্য কোনোদিন হতে পারবে না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। আর অনিক তোমাকে ভালোবাসে বলেই যে তুমি ওর যোগ্য হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই কিন্তু। আমার ছেলে ভালোমানুষ বলে তোমাকে বিয়ে করতে চাইছে। নাহলে তোমার মতো মেয়েদের সাথে শুধু… আর বললাম না।

যেটুকু সম্মান অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে ভালোয় ভালোয় বিদায় হও। সেটাই তোমার জন্য মঙ্গল। আর অনিকের জন্যও।”

ইলোরা কথা গুলো এক নিশ্বাসে বলে শেষ করলেন।তারপর গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন ভেতরে। নোরা মুখে হাত দিয়ে কাঁদছে। কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না। এর চেয়ে ওর দুইগালে দুটো চড় দিলেও ও কিচ্ছু মনে করতো না। তাই বলে এইভাবে অপমান? নোরা কাঁদতে কাঁদতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। অনিক নোরাকে খুঁজতে বাইরে এসেছিল। সে দেখল নোরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অনিক গলা উঁচিয়ে অনেকবার ডাকল। কিন্তু নোরা শোনেনি।

নোরা বাসায় ঢুকে দেখল মা-বাবা একসাথে বসে টিভি দেখছেন। ঘরের লাইট বন্ধ। টিভির আলোতে আলোকিত হয়ে আছে ঘর। কল্পনা দরজা খুলে রান্নাঘরে চলে গেল। লীরা মেয়েকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,” কিরে মা! কেমন হলো হবু শ্বশুরবাড়ির সাথে ডিনার?”

লীরার প্রশ্নে নোরার আরো কান্না পেয়ে গেল। অন্ধকার রুমে সেটা দেখা যাচ্ছেনা। আনিস হাসিমুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুজনের দৃষ্টি উজ্জল। হয়তো গল্প শোনার জন্য মুখিয়ে আছে। কিন্তু নোরা ওদের কি গল্প বলবে? অপমানের গল্প? কিভাবে হবু শ্বাশুড়ি তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে সেই গল্প বলবে?

নোরার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা-বাবাকে কত আনন্দ নিয়ে বলেছিল তার হবুশ্বাশুড়ী তাকে ডিনারে ডেকেছেন। নোরা মাথা ব্যাথার ভাণ ধরে বলল,” ভালো লাগছে না মা। আমার মাথাটা ব্যথা করছে। পরে গল্প করবো। এখন আমি রুমে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবো।”

আনিস একটু সন্দেহী গলায় বললেন,” কি হয়েছে মা? সব ঠিকাছে তো?”

” হ্যা ঠিকাছে বাবা। সব ঠিকাছে।”

লীরা বলল,” কল্পনাকে বলি তোর জন্য এক কাপ আদা দিয়ে চা বানাতে? মাথা ব্যাথাটা কমবে।”

” লাগবে না মা। আমি ঘরে যাচ্ছি।”

নোরা রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ফ্লোরে বসেই কাঁদতে লাগল। অনিকের মা তাকে এইভাবে অপমান কেন করলেন? যেখানে তার বাবা এতো মেজাজি মানুষ হয়েও তার সাথে কোনোদিন উঁচুগলায় কথা বলেনি, একটা ধমক পর্যন্ত দেয়নি। সেখানে বাহিরের এক মহিলার এতো অপমান সে কি করে মেনে নিল? অন্যকেউ হলে নোরা ফটাফট মুখের উপর জবাব দিয়ে দিতো। কিন্তু ইলোরাকে সে কিচ্ছু বলতে পারেনি। কিভাবে বলবে? সে যে অনিকের মা!

নোরার ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। নোরা ফোন ধরল না। সাইলেন্ট করে রেখেদিল৷ বিছানায় সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল নোরা। ঘুম ভাঙল ফজরের আযানের শব্দে। দু একবার হাই তুলে আশেপাশে তাকাতেই দেখল ফোনের লাইট জ্বলছে। অনিক ওকে এখনো ফোন করছে? সেই যে রাতে ফোন সাইলেন্ট করেছিল তারপর আর ফোনটা হাতে নেয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিল।

নোরা ফোনটা নিয়ে দেখল পাঁচশো চুয়াল্লিশটা মিসডকল। পঁচাশিটা ম্যাসেজ। ম্যাসেজগুলোতে বেশিরভাগই ”সরি’ লেখা। আরো অনেকভাবে এ্যাপোলোজাইস করেছে অনিক। একটা ম্যাসেজে লেখা,” নোরা প্লিজ একবারের জন্য নিচে এসো। আমি..”

বাকিটা পড়তে পারলনা। আবার ফোন এলো অনিকের। নোরা ফোন ধরে বলল,” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে অস্থির কণ্ঠে ভেসে আসল,” নোরা, নোরা, নোরা, প্লিজ ফোনটা কেটো না প্লিজ। একবার আমার কথা শোনো। মা যা করেছে সবকিছুর জন্য আমি ক্ষমা চাইছি, বিশ্বাস করো আমি জানতাম না মা তোমাকে এসব বলবে। জানলে তোমাকে অপমান করার জন্য কখনো ডেকে আনতাম না। প্লিজ মাফ করে দাও নোরা। এক্সট্রিমলি সরি। প্লিজ!”

” শান্ত হোন আপনি। আন্টির কথায় আমি কিচ্ছু মনে করিনি। শুধু একটু কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই কষ্টটাও আর হচ্ছেনা। ”

” নোরা তুমি কি একবার ছাদে আসবে প্লিজ?”

” ছাদে মানে? আপনি কি আমাদের বাসার ছাদে?”

” হ্যাঁ। অনেকক্ষণ নিচে দাড়িয়েছিলাম। তারপর দাড়োয়ান গেইট খুলে দিল। তোমাদের বাসায় ঢোকার সাহস হচ্ছিল না। তাই ছাদে চলে এসেছি।”

” একটু অপেক্ষা করুন আমি এখনি আসছি।”

নোরা ওরনাটা গলায় জড়িয়েই ছাদে দৌড় দিল। অনিক কার্নিশে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। নোরাকে দেখেই সামনে এগিয়ে আসল। নোরা দেখল অনিকের ফোলা ফোলা দুটো চোখ,এলোমেলো চুল, অগোছালো অবস্থা। এই অবস্থাতেই কত সুন্দর লাগছে দেখতে। মানুষটা কেন এতো সুন্দর? অনিক একটা টু শব্দ করলনা। হঠাৎ নোরাকে কোলে তুলে নিল।

তারপর ওকে দেয়ালের উপর বসিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। নোরা বুঝতে পারছে না অনিক কি করতে চাইছে। অনিক নোরার পা দুটো চেপে ধরল। তারপর করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” পায়ে পড়ি নোরা। প্লিজ মাফ করে দাও।”

নোরা অবাক হয়ে গেল। পা ছাড়ানোর চেষ্টাও করতে পারছে না। বেশি ছুটোছুটি করলে পেছন দিয়ে দুম করে পড়ে যাবে। অনিক যে মাঝে মাঝে কি পাগলামি করে! নোরা পা গুটিয়ে নিতে নিতে বলল,” পা ছাড়ুন প্লিজ। আপনি আমার পায়ে হাত দিলে আমার পাপ হবে।”

” আর তোমার কাছে ক্ষমা না চাইলে আমার পাপ হবে। প্লিজ ক্ষমা করে দাও আমাকে।”

” এখানে আপনার তো কোনো দোষ নেই। আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন?”

” দোষ আমারই। এমন মায়ের সন্তান হয়ে জন্ম নেওয়াই আমার দোষ।”

” প্লিজ মায়ের সম্বন্ধে এসব বলবেন না।”

” তাহলে আর কি বলবো? আমার মন ভেঙে গেছে বলে আমি কষ্ট পাচ্ছি না নোরা। তোমার অপমানের যন্ত্রণাটা আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাচ্ছে। মাকে এজন্য আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না। মা খুব অন্যায় করেছে। খুব,খুব,খুব অন্যায়।”

” বাদ দিন এসব কথা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর আন্টির কথায় আমি কিচ্ছু মনে করিনি। একটু কষ্ট পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু এখন সেই কষ্টটা একদম হজম হয়ে গেছে। বলতে পারেন হারিয়ে গেছে। আপনাকে দেখে, আপনার এসব পাগলামী দেখে, এখন কি মনে হচ্ছে জানেন? ভাগ্যিস আন্টি আমাকে অপমান করেছিল! নাহলে তো জানতেই পারতাম না আপনি আমাকে এতো ভালোবাসেন।

আমি রাগ করে ফোন সাইলেন্ট করে দিলে আপনি সারারাত ধরে ফোন দিয়ে যেতে পারেন। উতলা হয়ে বাসার সামনে ছুটে আসতে পারেন। বাচ্চাদের মতো কেদে চোখ ফোলাতে পারেন। এতো ভালো কেউ কাউকে কিভাবে বাসতে পারে? আমি কি সত্যিই এতো ভালোবাসা ডিজার্ভ করি?”

অনিক মুচকি হেসে বলল,” শুধুমাত্র তুমিই ডিজার্ভ করো।”

নোরা দেয়াল থেকে নেমে নিচে বসে পড়ল। অনিক হাটু গেড়েই সোজা হয়ে বসল৷ নোরা এতোক্ষণ অনিকের দুই হাত ধরে ছিল। এবার সেই হাত দুটো নিয়ে নিজের গালের উপর রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আই লভ ইউ।”

তারপর অনিকের গলা জড়িয়ে ধরল। অনিকের বুকে মাথা রেখে আবারও কাঁদতে লাগল। অনিক ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,” কেঁদো না নোরা।”

” আমি কি কোনোদিনও আপনাকে পাবো না?”

” কে বলেছে পাবে না? আমি তো তোমারই। শুধু তোমার।সবসময় থাকব তোমার।”

” সত্যি? ”

” একদম সত্যি। ”

” আপনাকে ছাড়া আমি একদম থাকতে পারব না।”

অনিক হেসে বলল,” বোকা মেয়ে, আমি কি পারব তোমাকে ছাড়া থাকতে?”

নোরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অনিক চোখ বন্ধ করে আছে। তার দুই চোখের কিনারা দিয়েই গড়িয়ে পড়ছে জল। কোনো শব্দ হচ্ছে না শুধু নিঃশব্দে কান্না!

তিথিদের বাসার কলিংবেল চাপছে অনিক। দরজা খুলল তিথিই। অনিককে দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেল সে। জীবনে এই প্রথমবার অনিক তাদের বাসায় এসেছে। খুশিতে খৈ হারিয়ে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না তিথি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অনিক শান্তগলায় বলল,” ভেতরে আসতে পারি?”

তিথি নর্ভাসনেস কাটিয়ে কম্পিত গলায় বলল,” অবশ্যই। অবশ্যই আসতে পারো। এসো।”

দরজার সামনে থেকে সরে অনিককে ভেতরে আসার জায়গা করে দিল তিথি। অনিক সোফায় বসতে বসতে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” বাসায় আর কেউ নেই?”

” মা বাজারে গেছে। মিথি ঘুমাচ্ছে। রান্নাঘরে ফুলী আন্টি আছে। তোমার জন্য কি আনবো? কফি খাবে?”

” আমি কিছু খেতে আসেনি। তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি।”

অনিকের কপট উত্তরে তিথির মলিন হলো। হালকা আহত গলায় বলল,” বলো?”

অনিক পাশের সোফাটার দিকে ইশারা করে বলল,”বসো।”

তিথি বসল। অনিক জিজ্ঞেস করল সাবলীল ভঙ্গিতে,” তিথি, আমাকে ভালোবাসো?”

তিথি সলজ্জে নিচুগলায় জবাব দিল,” বাসি তো।”

” আমি বাসিনা।”

অনিকের উত্তরটা আগুনের ফুলকির মতো ছিটকে পড়ল তিথির বুকে। অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব হতে লাগল মুহুর্তেই। অনিক আবার বলল,” জোর করে যে ভালোবাসা হয়না, এটুকু তো জানো? ভালোবাসতে অনুভূতির প্রয়োজন। সেই অনুভূতিই যদি মরে যায়, তাহলে ভালোবাসা আসবে কি করে?”

তিথি কোনো জবাব দিলনা। অনিক জবাবের অপেক্ষাও করলনা। বলল,” নোরাকে আমি প্রায় পাচঁবছর ধরে ভালোবাসি। সেটা তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানেনা। আমার প্রত্যেকটা বিষয়ে নজরদারি করা তো তোমার স্বভাব। কে জানে? হয়তো গুপ্তচরও লাগিয়ে রেখেছো আমার পেছনে। কিন্তু একটা কথা সত্যি করে বলো তো তিথি। এসব করে কি কোনো লাভ আছে? আমি কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না সেটা তো তুমি জানোই। বরং এসব করে তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধটাকেও নষ্ট করে দিও না প্লিজ। আই ওয়ান্ট টু রেসপেক্ট ইউ। এন্ড লেট মি ডু দ্যাট।”

তিথি অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি যেমন আমাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না, তেমনি আমিও তো পারবো না কোনোদিন তোমাকে ভুলে যেতে।”

তিথির দৃষ্টি করুণ হয়ে এলো। চোখের পানি ছলছল করছে। উফফ এই মেয়েরা এতো কাঁদে কেন? অনিকের অসহ্যবোধ হচ্ছে। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” প্লিজ তিথি, আমার জীবনটা নষ্ট করে দিও না। তুমি প্লিজ আমার জীবন থেকে সরে যাও। মিনতি করছি তোমার কাছে।”

” আমি তোমার জীবন কোথায় নষ্ট করলাম অনিক? উল্টো তুমিই তো আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছো। তোমার জন্য তিলে তিলে শেষ হচ্ছি আমি।”

অনিক উচ্চশব্দে বলল,” আমি কি তোমাকে বলেছি আমার জন্য তিলে তিলে শেষ হতে? আমাকে ভালোবাসতে বলেছি? জোর করেছি?”

অনিকের কথার আওয়াজে ফুলী রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো। ফুলী তিথিদের বাসার গৃহকর্মী। অনিক উনাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। পকেটে হাত দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,” দ্যাখো তিথি, ভালোভাবে বলছি। এখনো সময় আছে তুমি মাকে বোঝাও। মাকে বলো যে তোমার আমার মধ্যে বিয়ে সম্ভব না। মা যেন তোমার আশা ছেড়ে দেন।”

তিথি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,” বলবো না। মরে গেলেও বলবো না। আমি যদি তোমাকে না পাই তাহলে নোরাও পাবেনা। ইনফেক্ট এই পৃথিবীর কোনো মেয়েই পাবেনা। তুমি আমার অনিক, শুধু আমার।”

তিথি অনিকের হাতটা ধরে কপালে ঠেঁকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ফুলী এই অবস্থা দেখে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। অনিকের ভীষণ রাগ হচ্ছে। কাকে কি বুঝাতে এসেছে সে? এই মেয়ে জীবনেও বুঝবে না। চরম বিরক্তি নিয়ে অনিক উচ্চারণ করল,” ধ্যাত!”

তারপর ঝারি মেরে হাতটা ছাড়িয়ে হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। তিথি ফ্লোরে বসে পড়ে কাদছে। অনিকের এমন ব্যবহার দেখলে তার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মরে যেতে। এখনো তাই ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে এটাও জানে। মরে গেলেও অনিক তার কাছে আসবে না। কেন আসবে না? তিথি চিৎকার করে উচ্চারণ করল,”কেন?”

অনিক তিথিদের বাসা থেকে বেরিয়েই একটা সিগারেট ধরালো। অনেকদিন ধরে সে সিগারেট খায়না। আজ কেন খাচ্ছে নিজেও জানেনা। ইদানীং কি করতে কি করে ফেলে কোনোকিছুরই হুশ থাকেনা তার। এভাবে চলতে থাকলে একদিন পাগল হয়ে যাবে। একদিকে মা তিথি ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না, অন্যদিকে নোরা মায়ের অনুমতি ছাড়া বিয়েও করবে না। অনিকের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু কই যাবে? কিভাবে যাবে? সে যে বাধা পড়ে গেছে নোরাতে। তাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই।

অনিক হাটঁতে হাঁটতে অনেকদূর এসে গেছে। হঠাৎ দেখল সামনে নোরা দাঁড়িয়ে। নোরা ওদের এলাকায় কি করছে? অনিক সিগারেট টা ছুঁড়ে ফেলল। রোডসাইডের পানির ফোয়ারা থেকে কয়েকবার কুলি করে মুখ টিস্যু দিয়ে মুছে নিল। তারপর নোরার কাছে গেল। নোরা ওকে দেখে মুচকি হেসে বলল,” হায়।”

” কেমন আছো?”

” ভালো। তুমি কেমন আছো?”

” তুমি যেমন রেখেছো তেমনি আছি।”

নোরা মুখ গম্ভীর করে ফেলল। জবাব দিলনা। মাথা নিচু করে সামনে তাকাল। অনিক বলল,” হঠাৎ এইখানে?”

” আলভীদের বাসায় এসেছিলাম। অন্তুর সাথে দেখা করতে।”

” ওহ। দেখা হয়েছে?”

” হুম।”

” এখানে যে আসবে আমাকে জানাও নি কেন?”

” এমনি।”

অনিক আর কিছু জিজ্ঞেস করলনা। নোরা ওর থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। আজকাল ভার্সটিতেও অনিকের ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে থাকে নোরা। যে মেয়ে আগে যুদ্ধ করে হলেও সামবের বেঞ্চে বসতো শুধুমাত্র অনিককে কাছ দেখার জন্য। সেই-ই আজকাল দুরে দুরে থাকতে চাইছে। অনিক ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার পদে জয়েন করেছে একমাস হলো। শুধুমাত্র নোরার জন্যই দিন-রাত খাটা-খাটনি করে চাকরিটা নিয়েছিল সে।

অনিক বলল,” এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

” রিকশা খুঁজছি।”

নোরা এই কথা বলতে বলতেই আচমকা একটা জীপগাড়ি ওদের পাশ ঘেঁষে গেল। অনিক সরে পড়লেও নোরা সরতে পারলনা। নোংরা কাদামাটিতে তার ড্রেস ভরে গেল। অনিক চেঁচিয়ে উঠল ড্রাইভারের উপর,” ওই, কমন সেন্স নাই নাকি?”

তারপর ধাওয়া করতে চাইল গাড়িটাকে। নোরা বাঁধা দিয়ে বলল,” প্লিজ বাদ দাও। সিন ক্রিয়েট করার দরকার নেই।”

” ফালতু।”

অনিক নোরার দিকে তাকাতেই দেখল কাদায় ভরে গেছে একদম কর্দমাক্ত হয়ে আছে ও। অনিক বলল,” এবার কি করবে?এ অবস্থায় বাসায় কিভাবে যাবে?”

” চলে যেতে পারবো।”

” চলে যেতে পারবো মানে? এসো আমার বাসা থেকে চেঞ্জ করে যাও।”

” না না, দরকার নেই। আমি রিকশায় উঠে হুড নামিয়ে চলে যাবো। বাসায় গিয়ে চেঞ্জ করবো।”

” আমার বাসায় এখান থেকে হেঁটে যেতে লাগবে দশমিনিট। আর তোমার বাসায় রিকশা করে গেলেও লাগবে পয়তাল্লিশ মিনিট। কি দরকার নোরা ভেজা কাপড়ে এতোক্ষণ থাকার? চলো তো।”

” না প্লিজ, বললাম তো আমি পারবো চলে যেতে।”

” আমি জানি তুমি কেন যেতে চাইছো না। ভয়ের কিছু নেই। মা এক সপ্তাহের জন্য খালামণির বাসায়। আপুও মায়ের সাথে গেছে। ঘর খালি, লক করা। চাবি আমার কাছে দেখো।”

অনিক পকেট থেকে বের করে চাবি দেখাল। নোরা বলল,” তোমার খালি বাসায় আমি কেন যাবো?”

” বেশি কথা বললে এখন রাস্তা থেকেই উঠিয়ে নিয়ে যাবো। সেটা ভালো লাগবে?”

নোরা উত্তর দিলনা। অনিক হাত টেনে ধরে বলল,” চলো।”

নোরা বাধ্য হয়েই অনিকের সাথে গেল। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নোরা দেখল অনিক তার জন্য বিছানায় কাপড় রেখে দিয়েছে। টিয়া রঙের একটা কামিজ৷ ওরনা আর সেলোয়ারটা হলুদ রঙের। খুব সুন্দর কাপড়টা। কিন্তু এটা কার কাপড়? আনিকার? উহুম আনিকার হবে না। কারণ আনিকা শরীর স্বাস্থ্যের দিকে থেকে নোরার দ্বিগুণ। আর লম্বাও। এই কামিজ আনিকার মাপের না। বরং এটা কাটায় কাটায় নোরার মাপের। অনিক কি এটা তাহলে ওর জন্যই কিনেছে? যদি ওর জন্যই কিনে থাকে তাহলে ওকে দেয়নি কেন?

নোরা ড্রেসিংটেবিলের আয়নাতে তাকাল। ওর চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে। চুল ঠিক করে মোছা হয়নি। তোয়ালেটা গায়ে জড়ানো। গা থেকে তোয়ালে খুলতে যাবে এমন সময় দেখল দেয়ালে অনিকের একটা ছবি লাগানো। অনিকের ছোটবেলার ছবি। এই আট/নয় বছর হবে! বাচ্চা অনিকের চোখে চশমা। চশমা দিয়েই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। হাত ভাঁজ করা। এটুকু ছেলের কি ভাব! ওই চোখের দিকে তাকাতেই নোরার বুক কেপে উঠছে। কি মারাত্মক সেই চাহনী। মার্ডার করার জন্য এমন একটা লুকই যথেষ্ট। মানুষ হার্টঅ্যাটাক করবে এমন দৃষ্টি দেখে।

নোরারও যে ছোটখাটো হার্টঅ্যাটাক হয়নি তা নয়, ওর হাত-পা কাঁপছে। নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে অনিক ওই চশমার আড়াল থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওকে দেখছে। লজ্জায় নোরার চোখমুখ বন্ধ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এই ছবির সামনে কিছুতেই ড্রেস চেঞ্জ করতে পারবে না সে। মনে হবে অনিক সত্যি সত্যি ওকে দেখছে। নোরা ওরনা দিয়ে ছবিটা ভালো করে মুড়িয়ে নিল। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করল। ছবি থেকে ওরনাটা সরিয়ে নেওয়ার সময় বলল,” এভাবে কেউ তাকায়? চোখে ঘুষি মারলে তারপর বুঝবে। চোখ ফুলে আলু বের হবে তখন। দুষ্টু একটা।”

নোরা নিজে নিজেই হেসে উঠল। অনিক দরজা ধাক্কাচ্ছে,” নোরা, তোমার হয়েছে?”

নোরা মুখ আগেরমতো গম্ভীর বানিয়ে দরজা খুলল। অনিকের হাতে কফির ডিশ। ডিশে দুকাপ কফি। নোরাকে কামিজটায় খুব মানিয়েছে। প্রকৃতির মতো সুন্দর লাগছে দেখতে। ও যেন প্রকৃতির রাণী! অনিক বিভোর হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-১৭

0

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৭
লিখা Sidratul Muntaz

নোরা হসপিটালের কেবিনে শুয়ে আছে। অনিক বাইরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো আসনগুলোর একটায় বসে আছে। ভোর হতে চলল, লীরা কাঁদতে কাঁদতে নোরার কেবিনেই বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আনিস সারারাত ঘুমাননি। ঘুমায়নি অনিকও। আনিস-লীরার থেকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম আর দৌড়াদৌড়ি করেছে অনিক। তাই সে একটু বেশিই ক্লান্ত। তবে সেই ক্লান্তিভাব তার চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। সেখানে শুধুই দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা।

আনিস দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অনিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটাকে উনি অবাক হয়ে দেখছেন। দেখছেন তার এবং তার স্ত্রীর পর আরো বাড়তি একজন আছে, যে নোরার জন্য নিজের থেকেও বেশি চিন্তা করছে,ভাবছে,কষ্ট পাচ্ছে,উতলা হচ্ছে। রাস্তা থেকে হসপিটাল পর্যন্ত পুরোটা সময় অনিক পাগলের মতো ছুটোছুটি করেছে।

সারারাস্তা নোরাকে কোলে নিয়ে রেখেছে। নোরার জ্ঞান ফেরার পর বেশ কিছু সময় নোরার হাত ধরে বসে ছিল। নোরার হাতে চুমু দিচ্ছিল, আনিস সেটাও দেখেছেন। তবে আড়ালে দাঁড়িয়ে। অবশ্য উনি সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও হয়তো অনিক পরোয়া করতো না। কারণ তখন সে ঘোরের মধ্যে ছিল। হয়তো এখনও আছে। অনিকের এই সকল আচরণের একটাই অর্থ।যে অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি যে কারো আছে। আনিস হঠাৎ অনিককে জিজ্ঞেস করলেন,” তুমি বাসায় যাবে না?”

” জি?”

অনিক প্রশ্নটা শুনতে পায়নি। তাই আনিস আবার প্রশ্ন করলেন,” বাসায় কখন যাবে তাই জিজ্ঞেস করছি।”

অনিক মুখে মালিশ করে বলল,” যাব আঙ্কেল, একটু পরেই যাবো।”

” নোরার ঘুম ভাঙার পর ওর সাথে একেবারে দেখা করেই যেও।”

অনিক কিছু বলল না। তবে খুব কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে মাথা নাড়ল। আনিস বললেন,” আচ্ছা তুমি ওই সময় আমাদের বাড়ির সামনে কিভাবে এসেছিলে? মানে তোমাকে কি কেউ খবর দিয়েছিল?”

” অন্তরা ফোন করেছিল আমাকে। তখন নোরা অন্তরার সাথে ফোনকলে ছিল।”

” অন্তরা আমাকে ফোন না করে তোমার কাছে কেন ফোন করল?”

অনিক উত্তর দিতে পারলনা। কি উত্তর দিবে? বড়ই জটিল প্রশ্ন। অনিকের অস্বস্তি দেখে আনিস আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু বললেন,” আমি বাহিরে আছি, তুমি যাওয়ার আগে আমাকে জানিয়ে যেও।”

” আচ্ছা।”

আনিস সামনে যেতে নিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকিয়ে বললেন,” আমি চায়ের দোকানে যাচ্ছি। তুমি আমার সাথে যাবে?”

” না আঙ্কেল।”

” কিছু আনবো? চা কিংবা সিগারেট? ”

” না আঙ্কেল এসব কিছু লাগবে না।”

” লাগবে না? নাকি খাওই না?”

” চা খাই। তবে সিগারেট না।”

” তাহলে চা-ই খাবে চলো।”

” এখন ইচ্ছে করছে না।”

” ঠিকাছে, থাকো তাহলে।”

আনিস চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পর অনিকও বেরিয়ে গেল। হসপিটাল থেকে সোজা থানায় চলে গেল। আলভীকে যতক্ষণ না মনের ঝাঁঝ মিটিয়ে পেটাতে পারছে ততক্ষণ তার মন শান্ত হবেনা। কিন্তু থানায় আলভীকে খুঁজে পাওয়া গেলনা। জানা গেল, আলভীকে তার বাবা জামিন করে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। তবে শিপন আর আরিফ থানাতেই ছিল। ওদেরকে দেখেই অনিকের মাথা গরম হয়ে যায়। শরীরের রক্ত টগবগ করতে থাকে।

আচমকাই শিপন,আরিফকে ধরে এলোপাথাড়ি চড়,থাপ্পর,ঘুষি দিতে থাকল অনিক। পুলিশের সকল কন্সটেবলরা মিলেও অনিককে থামাতে পারছিল না। অবশেষে ইন্সপেক্টর আসায় অনিক থামল। পরে সে গেল আলভীদের বাড়ি। আলভী তার বাড়িতেও নেই। সেখানে আরো বড় ঝামেলা। অন্তরার মা-বাবা আলভীদের বাসায় এসে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছেন। অন্তরাকে কিছুতেই এ বাড়িতে রাখতে চায়না তারা। যে ছেলে বাইরের একটা মেয়েকে পিটিয়ে এমন দশা করতে পারে সেই ছেলে নিজের বউয়ের সাথে কেমন আচরণ করবে তা বোঝা হয়ে গেছে তাদের।

অন্তরার মা-বাবা বিয়েটা ভেঙে অন্তরাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু অন্তরা যেতে চায়না। এতো হট্টগোল দেখে অনিক আর সেদিকে পা বাড়াল না। চলে গেল নিজের বাসায়। সেখানেও আরেক ঝামেলা। অনিক নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়েছিল পাঁচমিনিটও হয়নি। এরই মধ্যে ইলোরা এসে রাজ্যের চেঁচামেচি শুরু করলেন৷ সারারাত অনিক কোথায় ছিল, কি করেছে, আলভীদের বাসায় কি হয়েছে,আরো নানান ধরণের প্যাচাল।

অনিক বিরক্ত হয়ে মাকে ধমক দিয়ে বসল। বলল রুম থেকে বের হয়ে যেতে। ইলোরা বুঝলেন না ছেলের রেগে যাওয়ার কারণ। তবে এটুকু বুঝলেন, মারাত্মক কিছু হয়েছে। উনি আর কথা বাড়ালেন না। চলে গেলেন ঘর থেকে। আলভীকে প্রায় সাতদিনের মতো খুঁজে পাওয়া গেল না। এর মধ্যে অনেক কিছু বদলেছে।

আনিস আর লীরা অনিক আর নোরার সম্পর্কের বিষয়ে জানতে পেরে গেছেন। হাসিমুখে মেনেও নিয়েছেন। অন্তরা তার বাপের বাড়ি চলে গেছে। অনিক-নোরার দেখা-সাক্ষাৎ আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। অনিক এখন নোরাদের বাসায় গেলে মোটামুটি জামাই আদরই পায়। তবে নিজের বাসায় এখনও নোরার বিষয়টা জানাতে পারেনি সে।

বাবা ইসহাক আর বড়বোন আনিকাকে নিয়ে অনিকের কোনো সন্দেহ নেই। ওরা চোখ বন্ধ করে নোরাকে মেনে নিবে। সমস্যা হচ্ছে শুধু মাকে নিয়ে। যে মা নিজের ছেলের থেকে বাহিরের মেয়ে তিথিকে বেশি বিশ্বাস করে সে মাকে কিভাবে কোনো বিষয় নিয়ে কনভেন্স করতে হয় অনিকের জানা নেই। মায়ের প্রতি তার একটা অভিমান সবসময় আছে, থাকবে। আর সেটা শুধুই তিথির জন্য।

সাতদিন পর হঠাৎ উদয় হলো আলভী। অনিক ঠিক করে রেখেছিল আলভীকে যখন যে অবস্থায় যেখানেই পাবে, কোনো কথা হবেনা। ডিরেক্ট মাইর। জানোয়ারের মতো মা’রবে। কিন্তু অনিক সেটা করতে পারলনা। আলভী অনিকের সামনে এসেই পায়ে পড়ে গেল। বিনীতভাবে ক্ষমা চাইল নিজের কৃতকর্মের জন্য। এমনভাবে ক্ষমা চাইল, যে অনিক মাফ করতে বাধ্য হল। হয়তো আলভী সত্যিই খুব অনুতপ্ত। আর যদি অনুতপ্ত না-ও হয়, জীবনে কোনোদিন এমন কাজ করার দুঃসাহস দেখাবেনা সে। এটুকু নিশ্চিত।

আলভী নোরার বাবা-মায়ের কাছেও মাফ চাইল। এমনকি অন্তরার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে অন্তরাকে নিজের বাসায় পর্যন্ত ফিরিয়ে আনল। মেনে নিল বউ হিসেবে। এতে আর কেউ খুশি হোক আর না হোক নোরা ভীষণ খুশি হল। এতোই খুশি হল যে আলভী তার সাথে যেই অন্যায় করেছে সেটাও এক নিমেষে ক্ষমা করে দিল। সবকিছু চলে থাকল গতানুগতিকভাবে। অন্তরাও এখন আলভীর সাথে ভীষণ সুখী। সে স্বপ্নেও ভাবেনি এমন দিন তার জীবনে আসবে।

ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। ইলোরা কিছুক্ষণ আগে টিভি বন্ধ করে বিছানায় শুয়েছেন। অনিক রান্নাঘরে কেক বানাতে ব্যস্ত। একা হাতে সব সামলাতে পারছে না। আনিকাও আসতে পারছে না ওকে হেল্প করতে। কারণ রান্নাঘরে বেশি ভীড় দেখলে ইলোরা সন্দেহ করবেন। অনিকের মাঝরাতে কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই ও এইসময় রান্নাঘরে থাকলে ইলোরা সন্দেহ করবেন না। কেকটা ওভেন থেকে নামিয়েই নিজের ঘরে চলে গেল অনিক। ক্যান্ডেলস রেডি করতে হবে।

আনিকা আর ইসহাক সোফায় বসে বেলুন ফুলাচ্ছেন। সেই আওয়াজও বেডরুমে পৌঁছাতে দেওয়া যাবেনা। কারণ ইলোরা এখনো ঘুমাননি। বারোটা বাজলেই ইলোরাকে বার্থডে উইশ করা হবে। কেক নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াবে অনিক। পেছন পেছন আসবে আনিকা আর ইসহাক। তাদের এতো আয়োজন করে সারপ্রাইজ প্ল্যান সাজানোর একটাই কারণ। ইলোরাকে খুশি করতে হবে, যেন অনিক নিঃসংকোচে উনাকে নোরার বিষয়ে রাজি করাতে পারে।

ঘড়ির কাঁটা বারোটায় পৌছাতেই দরজায় কড়া নাড়ল অনিক। ইলোরা মাথা তুলে বললেন,” দরজা খোলাই আছে। ভেতরে এসো।”

অনিক “হ্যাপি বার্থডে” গান গাইতে গাইতে ভেতরে ঢুকল। ওর হাতে কেক। কেকের উপর পয়তাল্লিশটা ক্যান্ডেলস। পেছন পেছন ইসহাক আর আনিকাও এলো। ইলোরা এসব দেখে অবাক হলেন খুব। অনিক কেকের ট্রে টা টি-টেবিলে রেখেই মায়ের হাতে আলতো করে একটা চুমু দিল। তারপর বলল,” হ্যাপি বার্থডে মা।”

ইলোরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আনিকা মাকে জড়িয়ে ধরল। ইসহাক ক্যামেরা রেডি করে বললেন,” একটা ফ্যামিলি ফটো হয়ে যাক!”

ছবি তোলা,কেক কাটা, আরো বাদবাকি ফরমালিটিজ শেষ হওয়ার পর সময় আসল অনিকের কথা বলার। মা-ছেলেকে একা রুমে ছেড়ে দিয়ে বাবা আর মেয়ে চলে গেলেন। ইলোরা বিছানায় বসেছিলেন। অনিক বিছানা থেকে নেমে মায়ের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল। মায়ের একহাত ধরে বলল,” মা, জীবনে কখনো তোমার কাছে সেভাবে কিছু চাওয়া হয়নি। তবে আজকে একটা জিনিস চাইবো। দিবে?”

ইলোরা ছেলের গালে হাত রেখে বললেন,” বার্থডে আমার। আর গিফট চাইছিস তুই? আরে আজকে তো আমার গিফট চাওয়ার দিন। আমি চাইবো আর তুই দিবি। তা না উল্টো তুই-ই আমার কাছে চাইছিস?”

অনিক হেসে বলল,” তুমি কি চাও মা?একবার শুধু আদেশ করো। এক চুটকিতে তোমার সামনে হাজির করবো।”

তারপর অনিক আবার নরম স্বরে বলল,” যদি সাধ্যের মধ্যে থাকে আর কি!”

ইলোরা খুশি হয়ে বললেন,” তুই যে কথাটা বলেছিস, এটাই অনেক। তোর সাধ্যের বাহিরে আমার কখনো তোর কাছে কিছু চাওয়ার নেই বাবা। এখন বল, তুই কি চাস? আমিও দেওয়ার চেষ্টা করবো,যদি সাধ্যের মধ্যে থাকে।”

” আচ্ছা মা তুমি আগে বলো। বার্থডে যেহেতু তোমার, তাই তোমারটাই আগে শুনি।”

” ঠিকাছে। তাহলে শোন, আমি চাই ঘরে একটা বউ আসুক।”

ইলোরার কথা শুনে অনিকের মুখে অমাবস্যা নেমে এলো। মা এখন তিথির কথাই বলবে এটা নিশ্চিত। ইলোরা ছেলের এককান ধরে বললেন,” আমার গাধাটা এবার সংসারী হবে, এটাই আমার চাওয়া।”

বলেই হাসলেন। অনিক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সেই হাসিতে তাল মিলালো। তারপর ইলোরার দুইহাত ধরে বলল,” আমার তোমাকে কিছু বলার আছে মা।”

ইলোরা হাত ছাড়িয়ে খুশিমুখে বললেন,” আরে থাম! আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আগে শেষ করতে দে!”

অনিক হ্যাঁ না কিছুই বলল না। ইলোরা বললেন,” এই প্রথম তোর কাছে বার্থডে গিফট চাইছি। তাই যা চাইছি, তোকে কিন্তু দিতে হবে। না করলে চলবে না। তুই আমাকে আমার তিথিমা এনে দে। ওকে আমি ঘরে তুলতে চাই। মেয়েটাকে ছাড়া আমার এক মুহুর্তও চলে নারে! ও আমার কাছে আমার দ্বিতীয় আনিকা। আমার দ্বিতীয় মেয়ে। দ্যাখ মেয়েটা তোকে অনেক ভালোবাসে। কতবছর ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে বলতো? সারাখন এ বাসায় এসে পড়ে থাকে। আমাকে নিজের মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আমি যখন যা বলি তাই করে। এতো লক্ষী মেয়েটা! আমার কোনো কথা কক্ষনো ফেলেনা। এই যুগে এমন মেয়ে পাওয়া কি চারটিখানিক কথা? ওর মতো পূত্রবধু পেলে জীবনে আর কি লাগে? তুই আমার এই অনুরোধটা রাখ বাবা! তিথিকে বিয়ে কর। এরপর তুই যা চাইবি, আমি তোকে তাই দিবো। পাক্কা প্রমিস।”

” আমি নোরাকে বিয়ে করার জন্য তোমার অনুমতি চাই মা।”

ইলোরা ছেলের কথায় বড়সড় একটা ধাক্কার মতো খেলেন। উনার দৃষ্টি নিমেষেই প্রসারিত হয়ে এলো। অনিক বলল,” মা আমার দৃঢ় বিশ্বাস কি জানো? নোরা তিথির থেকে কয়েকগুণ ভালো। তোমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসবে। তুমি যা বলবে তাই করবে, তোমার কোনো কথা কক্ষনও ফেলবেনা। অল্প কয়েকদিনেই তোমার মন জিতে নিবে। ওকে পেয়ে হয়তো তুমি তিথিকেও ভুলে যাবে। এই যুগে ওর মতো মেয়ে পাওয়াও চারটিখানিক কথা নয়। ওর মতো বউ পেলে জীবনে আর কিচ্ছু লাগেনা। আর ও আমাকেও অনেক ভালোবাসে। আমি হলফ করে বলতে পারি, তিথির থেকেও বেশি ভালোবাসে নোরা আমাকে ৷ মা জীবনে কোনোদিন এভাবে তোমার কাছে কিছু চাইনি। তুমি প্লিজ না করোনা। এই আমি তোমার পায়ে ধরছি, অনুমতি দিয়ে দাও মা। এরপর তুমি যা চাইবে, যেভাবে চাইবে, সবকিছু সেভাবেই হবে। শুধু আমাকে নোরাকে বিয়ে করার পারমিশনটা দাও। প্লিজ!”

অনিক মায়ের সামনে হাতজোড় করে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইলোরা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ক্ষীণ গলায় বললেন,” অনিক তুই জানিস তিথিকে ছাড়া আমি চলতে পারিনা। ওকে কিন্তু আমি ছেলের বউয়ের আসনে বসাতে চাইনি,নিজের মেয়ের আসন বসাতে চেয়েছি। তুই মায়ের থেকে মেয়েকে আলাদা করবি?”

” মা, নোরা আমার সম্বল। জীবনের এমন কোনো মুহুর্ত নেই, যেই মুহুর্তে আমি ওকে মিস করিনা। চার বছর ধরে তোমার ছেলে ওই একটা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেছে মা। আর ছয়মাস যাবৎ ওকে আমি নিজের করে পেয়েছি। কি করে হারিয়ে যেতে দিই বলো? ওকে হারাতে গেলে তো আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলবো। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও আমার নোরাকে চাই। নাহলে যে বেচে থাকাও আমার জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। আমি কিছুতেই পারবো না মা। বেচে থাকার জন্য আমার নোরাকেই দরকার। বড্ড দরকার। ওকে আমার লাগবেই। তুমি যদি তোমার ছেলেকে সুখী দেখতে চাও, তাহলে নোরাকে তোমার মেনে নিতেই হবে। আর বাকি রইল তিথি। তোমার যদি তিথিকে এতোই পছন্দ হয় তাহলে দত্তক নাও।”

” মানে?”

ভ্রু কুঁচকালেন ইলোরা। অনিক পরিষ্কার করে বলল,” মানে, সন্তান দত্তক নেওয়া যায়না? তুমিও ওকে সন্তান হিসেবে দত্তক নাও। তাহলে ও তোমার নিজের মেয়ে হবে। ওকে পুত্রবধূও বানাতে হবেনা। তোমার সব ইচ্ছা পূরণ হবে। তুমি তো ওকে মেয়ের আসনেই বসাতে চেয়েছিলে তাইনা?”

” তুই কি ফাজলামো করছিস আমার সাথে?”

” ফাজলামো কেন করবো মা? তুমি যদি বলো আমি আজকেই ব্যবস্থা করতে পারি। তিথি আমার ছোটবোনের মতো এ বাসায় থাকবে।”

ইলোরা হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইলেন। অনিক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে যেতে যেতে বলল,” আমি যেটা বলছি সেটা কিন্তু ভেবে দেখো মা! তোমার ভালোর কথা ভেবেই বলছি।”

ইলোরা রাগে গজগজ করছেন। আর যাইহোক, তিথির জায়গায় অন্যকাউকে উনি কোনোদিন মানবেন না। সেই সাতবছর আগে থেকে তিথিকে ছেলের বউ করার স্বপ্ন দেখে আসছেন উনি। সেই স্বপ্ন এতো সহজে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে? তা হবে না!

অনিক নোরাদের বাসার কলিংবেল একবার চাপতেই দরজা খুলে গেল। হয়তো দরজার সামনে কেউ আগে থেকেই দাচবড়ানো ছিল। লীরা অনিককে দেখে প্রথমেই একটা হাসি দিলেন।অনিক হাসি দিয়ে বলল,
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

” ওয়ালাইকুম, এসো বাবা ভিতরে এসো।”

অনিক ঘরে ঢুকেই আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” আঙ্কেল বাসায় আছেন?”

” না নেই। উনি তো এইসময় অফিসে থাকেন।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অনিক। এখন সরাসরি নোরার ঘরে ঢুকে পড়া যাবে। কিন্তু আনিস বাসায় থাকলে এটা করা যায় না। প্রথমে আনিসের কাছে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। তারপর আনিস প্রায় আধঘণ্টার মতো বকবক করেন। অনিকের কান হয় ঝালাপালা। তারপর নোরাকে ডাকেন। নোরা বাবার সামনে বসেই অনিকের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে। একটাসময় আনিস ওদের ড্রয়িংরুমে একা রেখে চলে যান। তখন ভালোমতো নোরার সাথে কথা বলা যায়। এই হলো নিয়ম।

কিন্তু এখন আনিস নেই। তাই অনিক আর কোনোদিকে তাকালো না, সরাসরি চলে গেল নোরার বেডরুমে। নোরা বিছানায় পিঠ ঠেঁকিয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে। অনিক ঠিক বুঝতে পারলনা, মেয়েটা পড়ছে না ঘুমাচ্ছে। যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে ভালো। ঘুমপরীকে ইচ্ছেমতো দেখবে। আর যদি না ঘুমায় তাহলেও ভালো। অনিক ওর কানের কাছে গিয়ে হালকা শব্দ করবে। নোরা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠবে আর অনিকের গলা জড়িয়ে ধরবে।

অনিক মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে নোরার দিকে এগিয়ে গেল। কোনোরকম শব্দ করলনা। খুব সাবধানে নোরার কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, নোরা পড়ছে না ঘুমাচ্ছে! হঠাৎ নোরা মুখ থেকে বই সরিয়ে বলল,” কি দেখছো এভাবে?”

অনিক হকচকিয়ে গেল। গলা খাকিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল,” তুমি বুঝলে কিভাবে?”

” কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই বুঝেছি তুমি এসেছো।”

” কলিংবেলের আওয়াজ শুনে কিভাবে বুঝলে?”

” এতো ভদ্রভাবে শুধু একজনই কলিংবেল বাজায়। সে হলেন আপনি। প্রথমে টিং তারপর টং। একটু অপেক্ষা করে আবার টিংটং। এভাবে থেমে থেমে টিংটং টিংটং হলো আপনার কলিংবেল বাজানোর স্টাইল।”

” বাহ! এতোকিছু অবজার্ভ করো?”

“এতে অবজারভেশনের কিছু নেই। আমাদের বাসায় যে কেউ আসলে টিংটং টিংটং বাজাতেই থাকে। যতক্ষণ দরজা না খোলা হয়। বাবা তো পারলে কলিংবের সুইচ টিপেই ধরে রাখেন। একমাত্র আপনিই একবার বাজিয়ে থেমে যান। তাই আপনারটা মনে থাকে।”

” ও আচ্ছা। বুঝলাম।”

” বুঝেন নি। আরেকটা কারণ আছে বোঝার।”

” কি কারণ?”

” আপনার পারফিউমের স্মেল। আপনি ঢোকার সাথে সাথে ঘরটা সুগন্ধে ভরে যায়। তাই পায়ের শব্দ না করলেও আপনি ঢোকার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পেরেছি আপনি এসেছেন।”

অনিক হাসল।নোরা বইটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল,” বলুন কি খবর?”

” ভালো। তোমার কি খবর?”

” একদমই ভালো না।”

” কেন?”

” আমার এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফার্মাসী নিয়ে চান্স পেয়েছি। অথচ তুমি আমাকে একবার কংগ্রাচুলেশনস পর্যন্ত বললে না।”

অনিক হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। নোরার রেজাল্টের খবর সে মাত্র জানতে পেরেছে। আজ যে রেজাল্ট দিবে সেটাও ভুলে গেছিল। তবে সে আগেই জানতো নোরা ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু ভালো করবে সেটা কল্পনাও করেনি! অনিক ধীরে ধীরে বলল,” নোরা, আই সুয়্যার, তোমাকে কোলে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে!”

এই বলে অনিক কাছে আসতে নিলেই নোরা আ’তঙ্ক নিয়ে বলল,” ধুর,কেউ চলে আসলে?”

” আসুক। কি আর হবে? বড়জোড় দেখবে!”

” এই না, একদম না। আমার থেকে দূরে থাকো।”

” আচ্ছা বাবা আচ্ছা,অন্তত একটা কিস তো দিতে পারি?”

” ঠিকাছে। কিন্তু গালে।”

অনিক গালে কিস দিতে লাগল। থামল না দিতেই থাকল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয় এবং সাথে সাথে কেউ চেঁচিয়ে উঠল,” খালাম্মাগো! আমি কিসু দেহিনাই,আমি কিসু দেহিনাই।”

বলতে বলতে দৌড়ে চলে গেল। অনিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটু পর বলল,” দেখেনি ভালো কথা। তাই বলে চেঁচানোর কি আছে?”

নোরা লজ্জিত হয়ে বলল,” কল্পনা, এখন গিয়ে যদি মাকে বলে দেয়? ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাবো কিন্তু। ডাকো ওকে।”

” আমি ডাকবো?”

” তো কি হয়েছে ডাকলে?”

অনিক ডাকল,” এই কল্পনা, এদিকে এসো।”

কল্পনা দরজার ফাঁক দিয়ে এসে বলল,” আমি কিসু দেহিনাই ভাইজান।”

” তোমাকে কিছু দেখতে হবে না তুমি ভেতরে আসো।”

কল্পনা দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আসতে ওর লজ্জা লাগছে। নোরা বলল,” কল্পনা, ভেতরে আয়।”

কল্পনা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,” আফা! কসম আল্লাহর। আমি উকি দিতে আয়ি নাই। ভাইজান চা খাইবো কিনা হেইডা জিগাইতে আইসিলাম৷ ”

নোরা বলল,” আচ্ছা বুঝেছি। তুই যে কিছু দেখিস নি এটা যেন মা জানতে না পারে আবার।”

কল্পনা জিভ কেটে ঝড়ের বেগে মাথা নাড়ল। মানে জানবে না। নোরা হাসতে হাসতে বলল, ” ঠিকাছে এবার যা। আর ভাইজান চা খাবেন। দুইকাপ চা নিয়ে আয়। ”

” আইচ্ছা। ”

কল্পনা বেরিয়ে গেল। অনিক বলল,” মেয়েটাকে দেখলে কেন জানি আমার অন্তরার কথা মনে পড়ে।”

” কেন?”

” ওদের দুজনের চেহারার কোথায় যেন একটা মিল আছে। সমস্যা হলো কল্পনা কালো আর অন্তরা ফরসা। নাহলে দুজনকে দুইবোনের মতো লাগতো।”

নোরা হেসে বলল,” ওহ শোনো, কালরাতে অন্তরা ফোন করেছিল। ওরা হানিমুনে যাচ্ছে।”

” তাই নাকি? কোথায়?”

” জায়গা এখনও সিলেক্ট হয়নি। বিদেশ টিদেশ যাবে মনে হয়।”

নোরা অনিকের শার্টের কলার ধরে কাছে এনে বলল,” আমার এসব দেখে কত কষ্ট হয় জানো?”

” কষ্ট হয় কেন?”

” বাঃ রে! আমার বেস্টফ্রেন্ড বিয়ে করে হানিমুনে চলে যাচ্ছে। অথচ আমি এখনো আনম্যারিড। কষ্ট হবেনা?”

অনিক বলল,” কলারটা ছাড়ো নাহলে কল্পনা এসে দেখলে আবার একটা চিৎকার দিবে।”

নোরা লজ্জা পেয়ে কলার ছেড়ে দিল। অনিক কলার ঠিক করে বলল,” আমার কষ্টের কথা তুমি কি বুঝবে? অন্তরা না হয় তোমার বেস্টফ্রেন্ড। কিন্তু আলভী আমার এলাকার ছোটভাই। আমার দুই বছরের ছোট হয়ে শালা বিয়ে করে বউ নিয়ে হানিমুনে চলে যাচ্ছে। আর আমি শুধু দেখছি। কার কষ্ট বেশি? তোমার না আমার?”

” তুমি তো নিজের দোষেই কষ্ট পাচ্ছো। আমার ফ্যামিলি থেকে তো বিয়ের জন্য কোনো প্রবলেম নেই। প্রবলেম তোমার ফ্যামিলির। তুমিই তোমার মাকে ম্যানেজ করতে পারছো না। বাই দ্যা ওয়ে, কাল না আন্টির বার্থডে ছিল? তুমি বলেছিলে উনার বার্থডের দিন আমাদের কথা উনাকে বলবে। বলেছো?”

নোরার চোখ দুটো চিকচিক করছে।অনিক চুপ হয়ে গেল। মাকে যে রাজি করানো যায় নি এটা নোরাকে কিভাবে বলবে সে?

সন্ধ্যায় অনিক বাসায় ফিরে জানতে পারল ইলোরা নোরাকে মেনে নিয়েছেন। ইসহাক আর আনিকা বিষয়টা নিয়ে অনিককে সারপ্রাইজ দিবে বলে ড্রয়িংরুমের বসেছিলেন। অনিক বাসায় ঢুকতেই দুজন হাসি হাসি মুখ করে খুশির খবর জানিয়েছেন। অনিক প্রথমে ভেবেছিল আনিকার বাচ্চা সংক্রান্ত কিছু। সে হয়তো মামা হতে যাচ্ছে। পরে আবার মনে হল, ধুর সেটা কিভাবে সম্ভব? তার দুলাভাই তো নয়মাস ধরে বিদেশে৷ অনিক জিজ্ঞেস করল,” গুড নিউজটা কি?”

আনিকা আর ইসহাক একবার চোখাচোখি করল। তারপর দুজনেই হাসল। আনিকা বলল,” গেস কর।”

অনিক নির্দ্বিধায় বলে ফেলল,” আমি মামা হতে যাচ্ছি?”

অনিকের কথায় ইসহাক হো হো করে হেসে ফেললেন। আনিকা ভাইয়ের পিঠে দুই-একটা কিল দিয়ে বলল,” সবসময় তোর ইয়ার্কি না করলে চলে না?”

অনিক হাসতে হাসতে বলল,” এইটা ছাড়া আর কিছু তো মাথায় আসছে না। আর তোর হাব-ভাবও তো খুব একটা সুবিধার না। ইদানীং একটু বেশি খাওয়া-দাওয়া করছিস। মোটা হয়ে যাচ্ছিস। আমার দোষ কোথায়?”

আনিকা অভিমানী গলায় বলল,” বাবা দেখেছো?”

ইসহাক হাসতে হাসতে বললেন,” শোন শোন, আমি বলছি..”

আনিকা থামিয়ে দিয়ে বলল,” না, না বাবা! আমি বলবো।”

অনিক বলল,” আচ্ছা বল, একজন বললেই হলো।”

আনিকা মুখে হাসি নিয়ে বলল,” মায়ের মাথা থেকে তিথি পেত্নীর ভূত এতোদিনে নেমেছে। মা নোরাকে মেনে নিয়েছে।”

অনিক গালে হাত দিয়ে রেখেছিল। এই কথা শুনে গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল, ” সত্যি? ”

আনিকা বলল,” হানন্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি। আর শুধু তাই নয়, মা কালকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ডিনারের আয়োজন করেছে। আর তোকে বলেছে নোরাকে সেখানে নিয়ে আসতে। মা ওকে আংটি পড়িয়ে দিবেন।”

অনিক ইসহাকের দিকে তাকাল। ইসহাক মাথা নেড়ে বুঝালেন ঘটনা সত্যি। অনিক আনন্দিত গলায় বলল,” এসব কিভাবে হলো?”

আনিকা হালকা লাজুক ভঙ্গিতে কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে বলল,” তুই তো জানিস, মা ওকে খুব পছন্দ করে। আজকে ওর সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় তোর বিষয়টা বলছিলাম, তখন ওই-ই বলল মাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিবে৷ তারপর আমি ফোনটা মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম৷ প্রায় আধঘন্টার মতো শাশুড়ী-জামাই কি গুজুরগুজুর করল..পরে মা হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত জানাল।”

” ও। তাহলে সম্পুর্ণটাই আলি ভাইয়ার ক্রেডিট?”

ইসহাক বলল,” সম্পুর্ণটা জামাইয়ের ক্রেডিট হতে যাবে কেন? আনুরও অর্ধেক ক্রেডিট আছে। ও যদি জামাইকে বুদ্ধি করে না বলতো তাহলে জামাই জানতো কিভাবে আর তোর মাকে কনভেন্স করতো কিভাবে?।”

আনিকা বলল,” একদম ঠিক বলেছো বাবা। লভ ইউ।”

অনিক আনিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ আপু। এই প্রথমবার একটা কাজের কাজ করলি।”

আনিকা প্রথমে খুশি হলেও পরে যখন অনিকের কথা অর্থ বুঝতে পারল, ওমনি পিঠ বরাবর একটা কিল দিয়ে বলল,” শয়তান ছেলে! ”

অনিক হাসতে হাসতে বলল,” আলিভাই একটা চীজ! আমরা যেটা ঘরে বসে হাতে-পায়ে ধরে করতে পারলাম না, আলিভাই সেটা ইতালি বসে করে দেখাল?”

আনিকা বলল,” বুঝতে হবে না হাসব্যান্ডটা কার? এখন যা মায়ের কাছে যা। আর তোর দুলাভাইকে ফোন করে একটা থ্যাঙ্কিউ বলে দিস। নাহলে মাইন্ড করবে। আদরের শালার জন্য এতোকিছু করল, অথচ শালা একটা থ্যাঙ্কিউ পর্যন্ত বলল না।”

” শুধু থ্যাঙ্কিউ? আলিভাই না আসলে তো আমি বিয়েই করবো না।”

” আহারে! দেখা যাবে।”

অনিক নোরাকে সুসংবাদটা দেওয়ার জন্য ফোন করল। নোরা তখন মা-বাবার সাথে নেটফ্লিক্স দেখায় ব্যস্ত ছিল। আর ফোন ছিল ওর বেডরুমে। তাই ধরতে পারেনি। অনিক ওকে ফোনে না পেয়ে বড়সড় একটা ম্যাসেজ পাঠাল। ম্যাসেজেই সবকিছু লিখল। নোরা রুমে আসল রাত নয়টায়। আর ম্যাসেজটা দেখে প্রথমেই কিছুক্ষণ থম মেরে বসেছিল। তারপর এক গ্লাস পানি খেল। অতিরিক্ত আনন্দে মানুষ হাসতেও ভুলে যায়। নোরার এখন সেই দশা। সে কি সত্যিই অনিককে পেতে যাচ্ছে? খুশি আর আনন্দের থেকে অস্থিরতা বেশি কাজ করছে তার মধ্যে। সাথে নর্ভাসও লাগছে ভীষন। কালকে হবু শাশুড়ীমায়ের সাথে দেখা করতে যাবে। কিভাবে সাজবে,কি পড়বে, ভাবতে গেলেই মাথা ধরে আসছে। অনিককে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হবে।

নোরা অনিককে ফোন দিল। অনিক ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ফোনটা ধরেই বলল,” কেমন লাগল সারপ্রাইজটা?”

নোরা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” দারুণ। “তার কণ্ঠে খুশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। অনিক হেসে উঠল। নোরা বলল,” কিভাবে হলো এসব? বলুন না? মা কিভাবে রাজি হলেন?”

অনিক ওকে সবকিছু বলল। নোরা বলল,” তাহলে তো আলি ভাইয়াকে স্পেশাল করে একটা থ্যাঙ্কস দিতে হয়।”

” তা তো অবশ্যই। ”

” আচ্ছা উনি দেশে কবে আসবেন?”

” আমাদের বিয়েতেই আসবেন।”

” সত্যি? তাহলে আমি উনাকে একবার পা ছুয়ে সালাম করতে চাই।”

অনিক হাহা করে হেসে বলল,” ধুর বোকা মেয়ে! ভাইয়া পা ছুয়ে সালাম করা পছন্দ করেনা।”

” পছন্দ আমিও করিনা। কিন্তু উনাকে করবোই। উনি আমার কতবড় উপকার করেছে সেটা হয়তো উনি নিজেও জানে না। এইটুকু শ্রদ্ধা তো তার প্রতি দেখাতেই পারি।”

” আচ্ছা তোমার কি মনে হয় নোরা? মা যদি রাজি না হতো তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করতাম না? অবশ্যই করতাম। মা রাজি হোক আর না হোক, আমি তোমাকেই বিয়ে করতাম।”

” আপনি করলেও আমি করতাম না। মা-ছেলের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজের সম্পর্ক গড়ার কোনো আগ্রহ নেই আমার।”

” জানতাম তুমি এটাই বলবে। আর এজন্যই ভয়টা পাচ্ছিলাম। বাট এখন তো সব প্রবলেম সোলভড।”

” আমি আজকেই দুইরাকাত নফল নামায পড়বো। আমার যে কি খুশি লাগছে আপনাকে বুঝাতে পারবো না। উফ, একসাথে এতোগুলো গুড নিউজ!”

” বুঝেছি মিষ্টিপরী। আমিও খুব খুশি।”

” আচ্ছা, কাল আমি কি পরে আসবো? শাড়ি পরবো? নাকি সেলোয়ার কামিজ?”

” তোমার ইচ্ছা।”

” আমার ইচ্ছা না। আপনি মায়ের ইচ্ছার কথা বলুন। আচ্ছা তিথিআপু সবসময় কি পরে? ”

” তুমি আবার ওই মেয়েটার কথা বলছো? ওর সাবজেক্ট ক্লিয়ার,ফিনিশ। আর কখনও ওই মেয়ের নাম মুখে আনবে না।”

” সরি। কিন্তু মা তো উনাকে খুব পছন্দ করতো তাই জানতে চাইলাম।”

” তিথি তিথির জায়গায় আর তুমি তোমার জায়গায়। তোমাকে ওর মতো হতে হবেনা। তুমি নিজের মতো থাকো। নিজস্বতাকে হারাতে দিওনা। এই তুমিটাকেই আমার সবথেকে বেশি পছন্দ। বুঝেছো?”

” বুঝেছি। জানেন, আমি না আমাদের বিয়ে নিয়ে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি আজকে।”

” বাহ! তুমি এর মধ্যে বিয়ে নিয়ে স্বপ্নও দেখা শুরু করে দিয়েছো?”

” ধুর! আমি কি ইচ্ছে করে দেখেছি নাকি? ঘুমের মধ্যে দেখেছি। ঘুমের স্বপ্নে কি কারো কন্ট্রোল থাকে?”

” আচ্ছা কি স্বপ্ন দেখেছো?”

” সেটা কাল বলবো। সামনাসামনি। এখন রাখছি।”

অনিককে কিছু বলতে না দিয়েই নোরা ফোন কেটে দিল। এদিকে অনিক মনে মনে চিন্তা করতে লাগল, কি স্বপ্ন হতে পারে?

চলবে