Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1035



এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৯+২০

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৯+২০
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার পরে ভদ্রমহিলা, কৌশিক এবং অরিন্দম কে নিয়ে একটা উবের বুক করে অর্ক বেরিয়ে পড়লো, রাস্তায় যেতে যেতে রিয়ার মা কে বললো,

শ্বশুর বাড়িতে খবর দিয়েছেন?

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

দিয়েছি স্যার, ওর বাবা কে ফোন করে দিয়েছি। আসবে না হয়তো, ওই মহিলা আসতে দেবে না ওকে, তবু সম্পর্কটা তো আর অস্বীকার করতে পারি না! তাছাড়া মেয়ে বাবা অন্তপ্রাণ, যদি পরে জানে বাবা কে খবর দিই নি , তাহলে বাড়িতে বিরাট অশান্তি বাধবে! আসা না আসা ওর ব্যাপার! আমি আমার কর্তব্য করেছি! যদিও বুঝতেই পারছি, বাবার সঙ্গেই কিছু গন্ডগোল হয়েছে আজ! তাও বলে দিলাম! সারাজীবন তো দোষের ভাগী ই হয়েছি সবার কাছে! শাশুড়ি, ননদ বলে স্বামী কে আটকে রাখতে পারিনি, মেয়ে বলে তোমার জন্যে আমাকে ঠাম্মা, পিসিকে ছেড়ে আসতে হয়েছে! হাসব্যান্ড বলে আমি নাকি বিলো স্ট্যান্ডার্ড! আজ যদি এই খবর টা না দি, শেষ পর্যন্ত আমার ওপরেই দোষ পড়বে!

রিয়ার মা নেমে যাওয়ার পরে কৌশিক কে থ্যাংকস জানালো অরিন্দম, অর্ক দুজনেই,

খুব ভালো একটা কাজ করলে কৌশিক, একটা মানুষের জীবন বাঁচানো! এর থেকে ভালো কিছু আর হতেই পারে না!

কৌশিক মাথা নাড়লো,

অতো ভেবে কিছু করিনি স্যার! সেই মুহূর্তে মাথায় যা এসেছে, তাই করেছি! তবে অনির্বাণের কাছে অ্যাড্রেস না পেলে কিছুই করতে পারতাম না! একটা থ্যাংকস ওরও প্রাপ্য!

তুমি রিয়া কে পছন্দ করো কৌশিক? সরি! একজন টিচার হয়ে হয়ত এই কথাটা তোমাকে জিজ্ঞেস করা আমার শোভা পায় না, তবু এই জন্যেই জানতে চাইলাম, কারণ একমাত্র তোমাকেই ও মেসেজটা করেছে! তার মানে তোমাকেই একমাত্র বন্ধু বলে মনে করে!

করি স্যার! কিন্তু ও বলে ওর বাবা আমাকে মেনে নেবে না!

অরিন্দম এর প্রশ্নে মাথা নামিয়ে নিয়ে বললো কৌশিক।

প্রথমে অরিন্দম তারপরে কৌশিক, দুজনকে পর পর নামিয়ে অর্ক যখন বাড়িতে ঢুকলো তখন প্রায় রাত দুটো। রিয়ার সুইসাইড করার চেষ্টার কারণ যে ও নয় ওর বাড়ির অশান্তি এটা ভেবেই মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলো ও, বেল বাজাতেই অদিতি এসে দরজা খুললো,

মেয়েটা কেমন আছে এখন?

ভালো, কালকের দিনটা রেখে ছেড়ে দেবে হয়তো!

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো অর্ক, রাত অনেক হয়েছিলো, তাই অদিতি আর কথা বাড়ালো না। অর্ক হাত মুখ ধুয়ে এসেই শুয়ে পড়লো, ঘুমোতে অনেক দেরি হওয়ায় সকালে উঠতেও দেরি হলো। অদিতি চা নিয়ে এসে অর্ক কে ঘুম থেকে ওঠালো,

ওঠো, কলেজের দেরি হয়ে যাবে!

উঠে বসেই মাথায় হাত দিলো অর্ক,

মাথাটা ধরে আছে খুব, আজ আর কলেজে যাবো না!

চা খেয়ে কৌশিক কে ফোন করে রিয়ার খবর নিয়ে, অরিন্দম কে কলেজে না যাওয়ার কথা জানিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো ও। অদিতিও ছেলে কে সমরেশের কাছে দিয়ে এলো, যাতে অর্কর অসুবিধা না হয়। বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ দরজার বেল বাজলো, অদিতি দৌড়ে এসে দরজা খুললো, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে একজন আধুনিকা অল্প বয়সী মহিলা, অদিতি কে দেখেই হাত তুললেন,

নমস্কার, মিস্টার মিত্র আছেন?

অদিতি একটু অবাক হলো, প্রতি নমস্কার জানিয়ে ভেতরে সোফার দিকে ইঙ্গিত করলো,

বসুন, ডেকে দিচ্ছি! শরীরটা একটু খারাপ ওর, ঘুমাচ্ছে!

ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়লেন,

স্বাভাবিক! যা চলছে আপনাদের! এই অবস্থায় মানুষ আর সুস্থ থাকবে কি করে!

অদিতি অবাক চোখে তাকালো,

মানে? কি চলার কথা বলছেন আপনি?

এই পিংকি মানে রিয়ার কথা বলছি! শান্তিতে থাকতে দেয় কাউকে! আমার জীবনটাও তো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করছে একদম!

রিয়া কে আপনি চিনলেন কি করে?

ভদ্রমহিলা হাসলেন,

বলতেও খারাপ লাগে, তবু সম্পর্ক তো অস্বীকার করতে পারিনা কিছুতেই! সুবোধ আমার খুব ক্লোজ, একসঙ্গেই থাকি আমরা। যতোই হোক সুবোধের মেয়ে তো! আমার মেয়ে বলেও মনে করি আমি! কিন্তু ও আমাকে মায়ের জায়গা দেয় কই আর!

দিতি তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিলো মহিলা কে,

আপনি একটু বসুন, আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি!

ঘরে গিয়ে দেখলো অর্ক খাটে এপাশ ওপাশ করছে, সম্ভবত বেলের আওয়াজ এই ঘুম ভেঙে গিয়েছে। ওকে দেখেই বললো,

কার সঙ্গে কথা বলছিলে? এই সময় কে বেল বাজালো?

শোনো না! একজন মহিলা এসেছেন! কথা শুনে মনে হলো তুমি বলেছিলে না রিয়ার বাবা একজন মহিলার সঙ্গে থাকেন! ইনিই সম্ভবত সেই মহিলা!

নিচু গলায় বললো অদিতি, অর্ক লাফ দিয়ে খাটে উঠে বসলো,

এখানে! কি করতে!

দ্রুত পাঞ্জাবি পাজামা গলিয়ে ড্রইংরুমে এসে অর্ক দেখলো, ভদ্রমহিলা বসে আছেন, ওকে দেখেই নমস্কার জানিয়ে হাসলেন। উল্টোদিকের সোফায় বসতে বসতে গম্ভীর গলায় বললো অর্ক,

আপনি আমার বাড়ি চিনলেন কি করে?

মহিলা হাসলেন,

আপনি স্টুডেন্টদের মধ্যে যথেষ্ট পপুলার স্যার, আপনার ঠিকানা পাওয়া খুব কঠিন নাকি!

বলুন কি জন্যে এসেছেন?

অর্কর গম্ভীর গলা বোধহয় মহিলার নজর এড়ালো না, মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। অর্কর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

কিছুটা আমার প্রয়োজনে, বাকিটা আপনার!

অর্কর ভ্রু কুঁচকে গেল, দিতি চা করতে যাবে কিনা মনস্থির করতে না পেরে এক গ্লাস জল টেবিলে রাখলো। ভদ্রমহিলা জলের গ্লাস তুলে চুমুক দিলেন, গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন,

শুনেছি প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারছেন না আপনারা!! কল টা রেকর্ড করে রাখেন নি তো তখন! আমাকেও ফোন করে মাঝে মধ্যেই উল্টোপাল্টা কথা বলে অপমান করে ও! আমি সব কল রেকর্ড করে রাখি, আপনি চাইলে আমার রেকর্ডগুলো দিতে পারি, আপনি ওগুলো পুলিশ কে দিয়ে বলতে পারেন যে এই জিনিস ও আরো অন্যের সঙ্গেও করেছে!

শুনেছেন! কার কাছে শুনেছেন? আর এতে আপনার লাভ?

অর্কর কথায় মহিলা মাথা নাড়লেন,

এসব খবর কি আর চাপা থাকে! বাতাসে ছড়ায়! তবে লাভের কথা বলছিলেন না? নাহ! লাভ কিছু নেই! জাস্ট খারাপ লাগা থেকে হেল্প করতে চাইছি বলতে পারেন!! আসলে এই অপমান তো আমিও সহ্য করি রোজ, তাই আপনাদের কেমন লাগছে বুঝতে পারছি!!

আপনি পুলিশে যান না কেন?

যেতে তো চাই! কিন্তু ওই যে সুবোধ! মেয়ে অন্ত প্রাণ! শুধু মেয়ে মেয়ে করেই তো এতো বছরেও ডিভোর্স দিতে পারলো না বউ কে! অথচ বউ কে দেখুন, ওকে পাত্তাই দেয় না! ওর টাকা নিতে ঘেন্না লাগে, নিজের মুখে বলে গেছে আমার ফ্ল্যাটে এসে! তারপরেও মেয়ের হাতে লুকিয়ে টাকা দিয়ে আসে! আর মেয়েও তেমনি, বাবার সঙ্গে থাকে না, কিন্তু টাকা, পয়সা নিতে ছাড়ে না! মায়ের আর কতো টাকা আছে! ওই তো একটা প্রাইভেট স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের টিচার! সব আবদার তো বাবাই পূরণ করে! মাঝে মাঝেই দেখুন না বাবার কাছে গাড়ি চেয়ে পাঠায়, এককথায় ড্রাইভার সমেত গাড়ি দেয় বাবা, কোনোদিনও না বলে না!

অর্ক মহিলা কে থামিয়ে দিলো,

আপনাদের ব্যক্তিগত কথা আলোচনায় আমার কোনো রুচি নেই!

মহিলা মুখ শক্ত করলেন,

ব্যক্তিগত নয় এগুলো! আপনি পুলিশে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন, তাই বলছিলাম! এই যে আমাকে ফোনে এতো অপমান করে, তাও ওর বাবা কিছু করে না! আমার সহ্যেরও তো সীমা আছে বলুন! কাল দুপুরে এসে বলে কিনা বাবার সঙ্গে থাকবে! মায়ের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না, তো ঠাকুমার সঙ্গে থাক, তা না! আমার প্রাইভেসি বলেও তো কিছু আছে নাকি!! নিজের একটা মেয়ে আছে আমার, আবার আর একজনের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব বলুন? সুবোধ প্রায় রাজি হয়ে যাচ্ছিলো, আমি তখন আপত্তি করেছি! যে আমাকে প্রতি নিয়ত আজেবাজে কথা বলে ফোনে অপমান করে তাকে আমি কিছুতেই আমার কাছে রাখবো না! চলে যেতে বলেছি বলে সে তার কি রাগ! সুবোধ কিছু টাকা দিয়েছিলো, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলো, ও নাকি আর কখনো বাবার টাকা ছোঁবে না!

এবার অদিতি এগিয়ে এলো,

এগুলো আপনার ব্যক্তিগত কথাই! আপনাদের সম্পর্কের জটিলতায় আমরা ঢুকতে চাই না! যার সম্পর্কে এই কথাগুলো বলছেন, সে যে কাল সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলো সেটা জানেন নিশ্চয়ই! জেনেশুনেও মেয়েটার ওপরে আপনার কোনো সিম্পথী আসছে না! এতদিন আমার রিয়ার ওপরে সত্যি খুব রাগ হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো সত্যি ওর শাস্তি চাই! কিন্তু আজ আপনাকে এখানে দেখে ওর জন্যে খারাপ লাগছে! একটা অল্পবয়সী মেয়ে, যার জীবনে এখনো অনেক কিছু করার আছে, সে কতো কষ্ট পেলে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে সেটা এখন বুঝতে পারছি!

মহিলা মাথা নাড়লেন,

আপনাদের অভিরুচি! তবে আর একটা ছোট্ট প্রস্তাব ছিলো, ফ্ল্যাট টা খুব ছোটো আপনাদের, বাবা, মাও তো সঙ্গে থাকেন দেখছি! ছেলে বড়ো হচ্ছে, এবার ওরও একটা ঘর লাগবে, এতো লোক একসঙ্গে থাকতে অসুবিধা হয় নিশ্চয়ই। আমার ভগ্নিপতির প্রমোটিং এর বিজনেস, যদি চান তাহলে একটা বড়ো ফ্ল্যাট অনেকটা সস্তায় করে দিতে পারি, বাইপাসের ওপরে বড়ো একটা কমপ্লেক্স করছে ও!

রাগে গা রি রী করে উঠলো অদিতির, মহিলা সরাসরি ঘুষ দিচ্ছে!

ফ্ল্যাট কেনার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে, এ ব্যাপারে অন্যের সাহায্যের দরকার নেই! আপনি সম্ভবত আমাদের ঘাড় ভেঙে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চাইছেন, যে কাজটা আপনি ওর বাবার জন্যে করতে পারেন নি এতদিন সেটা আজ এই সুযোগে আমাদের দিয়ে করিয়ে নিতে চাইছেন, তাই না? আর ঠিকই বলেছেন, আগের বার কল রেকর্ড করে রাখিনি বলেই কিছু প্রমাণ করতে পারিনি আমরা, কিন্তু আজ আর সে ভুল করিনি। আপনার সব কথাই ভিডিও করে রেখেছি আমি, আপনি যে আমাদের ফ্ল্যাটের লোভ দেখিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ে কে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন এটাই পুলিশে অভিযোগ জানানোর জন্যে যথেষ্ট, হাতের মোবাইল টা মহিলার দিকে তুলে ধরে বললো অদিতি।

মহিলা চুপ করে গেলেন, ভয়ে, অপমানে মুখ লাল হয়ে উঠলো, অর্ক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

আমার স্ত্রী কি বলেছেন সেটা বুঝতে পেরেছেন আশাকরি! রিয়া আমার ছাত্রী, ব্যক্তিগত ভাবে ওকে না চিনলেও একজন স্টুডেন্ট হিসেবে গত তিন বছর ধরে চিনি! যথেষ্টই হাসিখুশি মেয়ে, ওর জীবনে এতো জটিলতা আছে আগে কোনোদিনও বুঝিনি! এতো কিছু জানার পরে একজন শিক্ষক হিসেবে ওর আর কোনো ক্ষতি করতে চাই না। ভবিষ্যতে আপনি এরকম কোনো প্রস্তাব নিয়ে আর আমার বাড়িতে আসবেন না আশা রাখি, যদি আসেন তাহলে এই ভিডিও টা আমরা পুলিশের কাছে দিতে বাধ্য হবো!

ভদ্রমহিলা থমথমে মুখে বেরিয়ে গেলেন, এতক্ষনে সমরেশ আর রুমাও বেরিয়ে এসেছিলেন কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনে, অদিতি ধপ করে সোফায় বসে পড়লো,

কি সাংঘাতিক মহিলা! নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে কোথা থেকে অ্যাড্রেস নিয়ে এখানে চলে এসেছে! মেয়েটা কে ফাঁসাতে চায়! কি অদ্ভুত এই দুনিয়া, তাই না! আমার এখন রিয়ার জন্যেই খারাপ লাগছে! বেচারা মেয়েটা জানেও না ও আর একটু হলেই কতো বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছিলো! এই যাহ! মহিলার নামটাই তো জানা হলো না!

ছাড়ো তো! ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করিনি! ওই রকম নোংরা একজন মহিলার নাম জানার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই!

অর্ক পাশ থেকে বলে উঠলো, রুমা মাথা নাড়লেন,

সত্যিই নোংরা মহিলা! একটা সন্তান সম মেয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে! নাই বা হলো নিজের, তাই বলে একটা বাচ্চা মেয়ের জন্যে কোনো ফিলিংস থাকবে না! আর বাবা, মায়ের সম্পর্কের জটিলতা কিভাবে সন্তানদের ওপর প্রভাব ফেলে দ্যাখ! রিয়া একটা বাচ্চা মেয়ে, কোথায় হেসে খেলে আনন্দ করে বেড়াবে, তা নয়, উল্টোপাল্টা কাজে সময় নষ্ট করছে! কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না! কার দোষ দেবো! বাবা, মায়ের!! নাকি সন্তানের!!

সমরেশ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

দোষ কারো নয় রুমা, দোষ পরিস্থিতির! বাবা, মায়েরও হয়ত নিজেদের মতো বাঁচার অধিকার থাকে! কে ভালো, কে মন্দ এগুলো তো তর্ক সাপেক্ষ! আমরা তার বিচার করার কেউ নই! কিন্তু খারাপ লাগা একটাই যে ওরা কেউই হয়ত ভালো নেই! মেয়ের এই ডিসিশন নেওয়ার কথা জানার পরে মায়ের মতো বাবারও তো খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই! তিনিও যে মেয়ে কে যথেষ্টই স্নেহ করেন সেটা তো এই মহিলার কথা থেকেই পরিষ্কার!

অর্ক সায় দিলো,

ঠিকই বলেছো বাবা, বাঁচার অধিকার সবারই আছে হয়তো! এবং সেটা তো রিয়ারও আছে! এরকম পরিস্থিতি যে হতে পারে সেটা হয়ত ওনারা বুঝে উঠতে পারেন নি! তবে মেয়ে যে খুব উদ্ধত, কথা শোনে না, এগুলো কিন্তু কাল ওর মা নিজেই বলছিলেন আমাদের! এগুলো দেখেও তো ওনাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো তাই না! আজ ক্ষতি হয়নি মানেই যে ভবিষ্যতে এরকম আবার করার চেষ্টা করবে না তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই!

হ্যাঁ,রে, ওর একটা কাউন্সিলিং করা উচিত তাই না?

রুমার প্রশ্নে অর্ক ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, করাই তো উচিত! দেখা যাক ডক্টর কি বলেন! আর আমরা চাইলেই তো হবে না, ওর বাবা, মা কি ঠিক করেন সেটার ওপরেই সবটা নির্ভর করছে! যা সম্পর্ক দুজনের! এ ডাইনে গেলে ও বাঁয়ে যায়!

মোটেই না! ভদ্রমহিলার কথা শুনে তো আমার রিয়ার মা কে ভালোই লেগেছে! যে কোনো আত্মসম্মান সম্পন্ন মহিলা এরকমই ডিসিশন নেবে! হাজব্যান্ডের অবৈধ রিলেশন আছে জেনেও তার সঙ্গে থাকবে!

নিশ্চয়ই না! তুমি একশ শতাংশ ঠিক কথা বলেছো, আমি সেকথা বলিনি! আমি বললাম মেয়ের ব্যাপারেও ওনারা সহমত হবেন কিনা সন্দেহ আছে!

দিতি র কথার উত্তরে বললো অর্ক। বেলা হয়ে গিয়েছিলো, অর্ক উঠে পড়লো,

চলো খেয়ে নিই, বিকেলে একবার হসপিটালে যেতে হবে আমাকে!

মহিলা কে যা দেখলাম, সত্যিই রিয়ার বাবা তো কোনো দায়িত্ব নেবে না মনে হয়!

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ২০
খাওয়া দাওয়া মিটতে মিটতে বেলা হয়ে গেলো, একটু রেস্ট নিয়ে, যখন উবের নিয়ে হসপিটালের উদ্যেশ্যে বেরোলো অর্ক, তখন সাড়ে চারটে বেজে গেছে। খানিকটা এগোতেই একটা বড়ো রাজনৈতিক মিছিল, রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে রেখেছে, বারবার ঘড়ির দিকে দেখছিলো অর্ক, ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয় ছটাতে, ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবে তো ও! খানিকটা অন্তত মেট্রোতে গেলেই হতো এখন আফসোস হচ্ছিলো, শরীরটা ভালো লাগছিলো না বলেই উবের নেওয়ার ডিসিশন নিয়ে ছিলো তখন, এখন মনে হচ্ছে ভুল হলো সেটা।

রাসবিহারী মোড়ে এসে সিগনালে দাঁড়িয়ে গেলো উবেরটা, মিছিল ততোক্ষনে অন্য দিকে ঘুরে গেছে, কিন্তু সামনে লম্বা গাড়ির সারি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে, কি করবে ভাবতে ভাবতে হটাৎ মেট্রোর গেটের দিকে চোখ গেল ওর, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সকালের সেই ভদ্রমহিলা! সম্ভবত অটোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন! রিয়ার মা বলেছিলেন উনি আলিপুরে থাকেন, মনে পড়লো অর্কর, একটু অন্য মনস্ক হলো ও। ইতিমধ্যে সিগন্যাল খুলে গেছে, উবের যখন মেট্রো গেটের পাশ দিয়ে এগোচ্ছে, তখন মেট্রোর গেট দিয়ে তিয়াসা কে বেরোতে দেখলো ও, ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করলো অর্ক, তিয়াসা যেনো ওই ভদ্রমহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো! ভদ্রমহিলা তিয়াসা কে হাত নেড়ে কিছু বলছেন, দেখতে দেখতেই উবের টা এগিয়ে গেলো।

হসপিটালে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সময় শেষ হয়ে এসেছিলো, ওকে দেখেই কৌশিক দৌড়ে এলো,

স্যার, ভেতরে যাবেন নাকি? এই যে কার্ড,

দৌড়ে কার্ড হাতে লিফটে উঠে যখন বেডের সামনে এলো তখন রিয়ার মা নেমে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন, অর্ক রিয়ার দিকে তাকালো,

কেমন আছো?

রিয়া কোনো কথা না বলেই চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। ওর মা লজ্জিত হলেন, অর্কর দিকে তাকিয়ে বললেন,

ভালো আছে স্যার! কাল সকালে ছেড়ে দেবে বলেছে!

সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো, দুজনে লিফটে করে নিচে নেমে আসছিলো যখন, তখন অর্ক জিজ্ঞেস করলো,

আপনার হাজব্যান্ড এসেছিলেন?

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

আসেনি, জানতামই আসবে না!!তবে মেয়েও বাবার কথা বলছে না একবারও!

নিচে নেমে এসে দেখলো অনির্বাণ, দীপ, শ্রেয়া সবাই এসেছে ওখানে, ওকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়ালো, অর্ক ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো

তিয়াসা আসে নি?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

না স্যার, ওর বাবার শরীরটা একটু খারাপ, তাই বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না আজ,

অর্ক মনে মনে চমকে উঠলো একটু, বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না! কিন্তু ও তো রাসবিহারী তে দেখলো তিয়াসা কে!

রিয়ার মা কে নেমে আসতে দেখে বাকিরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গিয়েছিলো, এই সুযোগে অনির্বাণ কে সাইডে সরিয়ে আনলো অর্ক,

তোমাকে বলেছিলাম অনির্বাণ, কৌশিক কে রিয়ার বাড়ি যাওয়ার কথা না বলতে! কৌশিক বললো ও তোমার কাছ থেকেই অ্যাড্রেস পেয়েছে! যদিও সেটা আল্টিমেটলি ভালো হয়েছে, তবুও আমি আশা করেছিলাম তুমি কথা রাখবে।

অনির্বাণ মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,

স্যার, আমি বলতে চাই নি! তিয়াসা জোর করলো, বললো বন্ধু হিসেবে কৌশিকের সামনে রিয়ার স্বরূপ প্রকাশ পাওয়া উচিত। এতো কিছুর পরেও ও রিয়া কে ভালোবাসে স্যার!

তিয়াসা কে ফোন করো, বলো আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই!!

অনির্বাণ ফোন বার করে ডায়াল করার কিছুক্ষন পরে তিয়াসা ফোন তুললো, উল্টোদিকে হইচই এর আওয়াজ, অর্ক ওর সঙ্গে কথা বলতে চায় জানিয়ে অনির্বাণ ফোন দিলো,

রিয়া কেমন আছে স্যার? আজ কিছুতেই যেতে পারলাম না, বাবার খুব শরীর খারাপ!

শুনলাম অনির্বাণের কাছে! তুমি কোথায় থাকো? খুব হইচইয়ের আওয়াজ আসছে!

তিয়াসা হাসলো,

গড়িয়া তে স্যার, বাবার ওষুধ আনতে এসেছি বাজারে!

গড়িয়া তে ওষুধ পাওনি বুঝি, তোমাকে একটু আগে কালীঘাট মেট্রোর সামনে দেখলাম!

ঠান্ডা গলায় বললো অর্ক, অনির্বাণ চমকে তাকালো, উল্টোদিকে তিয়াসার চমক বোঝা না গেলেও কোনো কথার আওয়াজ এলো না। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পরে অর্ক আবার বললো,

যে ভদ্রমহিলার পাশে তুমি দাঁড়িয়েছিলে ওনাকে আমি চিনি! আজ সকালেই আমার বাড়ি এসেছিলেন, তুমি ওনা কে কিভাবে চেনো?

আমি কারোর পাশে দাঁড়াই নি স্যার, আমি এমনই দাঁড়িয়েছিলাম। আমার রিয়ার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে নেই স্যার, তাই অনির্বাণ কে বলেছিলাম বাবা অসুস্থ,

অর্ক হাসলো,

যাক তাও ভালো! অন্তত এটুকু তো স্বীকার করলে তুমি রাসবিহারী তে ছিলে একটু আগে! কি জন্যে এসেছিলে?

আমার কিছু পার্সোনাল কাজ ছিলো স্যার!

কাজটা সম্ভবত বুঝতে পারছি! তবে বন্ধুর ওপরে রাগের বদলা এই ভাবে নিতে নেই, হয়তো রিয়া অনেক ভুল কাজ করেছে, কিন্তু তুমি যা করলে সেটাও খুব খারাপ কাজ, এটা মনে রেখো!

ফোনটা অনির্বাণের হাতে দিয়ে ওর দিকে তাকালো অর্ক,

কোনো কোনো সময় নিজের বুদ্ধিও ব্যবহার করতে হয়! কৌশিকের ভালো চাইতে গিয়ে হয়ত রিয়ার খারাপ করে ফেলছো! বন্ধু তো সবাই, তাই না? আর এটা জানার পরেও তো কৌশিকের কোনো পরিবর্তন হলো না, ও তো সেই রিয়ার পাশেই থাকলো, ভবিষ্যতে এরকম করো না কখনো আর! আর তিয়াসা কেও বুঝিয়ে বোলো, বন্ধুর পাশে বিপদে না দাঁড়াক ক্ষতি করার চেষ্টা যেনো না করে!

স্যার, আমি অনেকবার ওকে আটকেছি স্যার, রিয়া যে স্টেশনে ম্যাম কে মিথ্যে বলেছিলো সেটা ও রিয়া কে বলতেও যাচ্ছিলো, আমিই তখন সেটা আটকে ছিলাম,

তাড়াতাড়ি বললো অনির্বাণ, অর্ক হাসলো,

যাক! আর এসব আলোচনায় কাজ নেই! তিয়াসা যখন বেশি উদ্যোগ নিয়ে এসব করছিলো তখনই বোঝা উচিত ছিলো আমার, কাকে আর বিশ্বাস করি বলো! সম্ভবত তোমার বোন রিয়াকে ফোন করতে দেখেছে, এটা তিয়াসাই তোমায় রিয়া কে বলতে বলেছিলো তাই না?

অনির্বাণের নিচু করে নেওয়া মাথা অর্কর কাছে ঘটনার সত্যতা জানান দিলো!

রিয়ার ওপর তিয়াসার রাগের কারণ টা কি অনির্বাণ?

জানি না স্যার! কখনো বলেনি কিছু! ও রাসবিহারী মোড়ে কার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলো স্যার?

উনি রিয়ার বাবার সঙ্গে থাকেন, আজ আমার বাড়িতে এসেছিলেন, আমি চাইলে রিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশে কমপ্লেইন করতে হেল্প করতে চাইছিলেন!

কি! তিয়াসা ওনার সঙ্গে কথা বলছিলো!

হ্যাঁ, আমি দেখলাম ও ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে! তবে ও তো ওনাকে চেনে বলে স্বীকার করলো না! তুমি মহিলা কে চেনো?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

না স্যার, চিনি না! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার, তিয়াসাও চেনে না ওনাকে! আমরা আজ পর্যন্ত রিয়ার বাবাকেই দেখিনি কেউ, আর ওই ভদ্রমহিলা!

ওকে বোলো ও রিয়া কে মিথ্যেবাদী বলছিলো সেদিন! আজ একই কাজ ও ও করেছে! শুধু আমার সঙ্গে নয় কিন্তু তোমার সঙ্গেও, ভবিষ্যতে মনে রেখো সেটা!

ওদের কথোপকথনের মধ্যেই কৌশিক এসে গেলো,

স্যার, আমার টিউশন আছে, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি,

তুমি কোন দিকে যাবে কৌশিক?

চেতলার দিকে স্যার,

অর্ক ওকে থামালো,

দাঁড়াও! আমি উবের নেবো, তোমাকে রাসবিহারী তে নামিয়ে দিচ্ছি,

তুমি রিয়ার বাবা যার সঙ্গে থাকেন, সেই মহিলা কে চেনো?

উবেরে বসে জিজ্ঞেস করলো অর্ক, কৌশিক ঘাড় নাড়লো,

না স্যার! কোনোদিনও জানতামই না ওর বাবা অন্য কারো সঙ্গে থাকেন! সেতো আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম! তারপরে ওর মেসেজে জানলাম আরো!

হুম! বেশ কিছু মিথ্যে বলেছে রিয়া!

স্যার, কি হয়েছে ঘটনা টা বলুন তো! আপনারা ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন কেনো?

অর্ক নিজেকে সংযত করলো, ছেলেটি রিয়ার ঘনিষ্ঠ, বেশি কিছু বলা যাবে না!

কিছু কিছু মিথ্যে কথা ও বলেছে কৌশিক, তুমি তো জানো তার মধ্যে কিছু কিছু! সমর স্যার বলেছিলেন আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে কিছু কথা কলেজে রটেছে, সেগুলো তুমিও নিশ্চয়ই জানো! এর মধ্যে এমন কিছু কথা আছে, যেগুলো রিয়া ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিলো না!

কৌশিক মাথা নিচু করলো,

স্যার, কথাগুলো রিয়া শুধু আমাকেই বলেছিলো আর কাউকে নয়! বিশ্বাস করুন স্যার আমি কাউকে বলিনি, আর ও আমি ছাড়া কারো সঙ্গে খুব বেশি কথা শেয়ার করে না! তারপরেও যে এগুলো কি করে ছড়িয়ে পড়লো আমি জানি না স্যার!

রাতে বাড়ি ফিরে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো অর্ক,

কি যে বলি! তিয়াসাটাও কম যায় না জানো! ওর কথায় অনির্বাণ কাল রিয়ার বাড়িতে ওকে ওর বোন দেখেছে বলে মিথ্যে কথা বললো। আমি তখন ভেবেছিলাম ও নিজে বলেছে এগুলো, কিন্তু আজ বুঝলাম সবটাই তিয়াসার কান্ড।

রুমা অবাক হলেন,

ওমা! মেয়েটাকে তো বেশ ভালোই লেগেছিলো আমার, সে আবার কি কান্ড করলো!

আর ভালো! এখন তো বুঝতে পারছি ওর ইন্টারেস্ট টা কোথায়! রিয়ার ওপরে কোনো কারণে রাগ আছে ওর, তাই যেচে যেচে সব সময় আমাকে হেল্প করতে আসতো!

কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে?

অর্কর কথায় অবাক গলায় প্রশ্ন করলো দিতি,

ওই যে বলে না লাক! একদম তাই, নেহাত উবের টা হসপিটালে যাওয়ার সময়ে রাসবিহারীর মুখে সিগন্যালে দাঁড়ালো তাই তো ওকে দেখতে পেলাম। কালীঘাট মেট্রো থেকে বেরিয়ে এসে যেখানে দাঁড়ালো, সেখানে ওই সকালে যিনি এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, সেই ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়েছিলেন।

উনি ওখানে তিয়াসার সঙ্গে কি করছিলেন?

বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো অদিতি, অর্ক হাসলো,

কি আর করবেন! নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ি যেমন প্ল্যান নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক সেরকমই তিয়াসার সঙ্গে হাত মিলিয়ে রিয়াকে কিছু টাইট দেবার চেষ্টা করছেন!

কি কান্ড! এই সকালে এসেই মেয়ের মতো দেখি বলছিলেন,

হতাশ গলায় বললেন রুমা,

ছাড়ো তো! মেয়ের মতো! তোমার মনে হয়! যে মহিলা আমাদের হাতে প্রমাণ তুলে দিতে চাইছিলেন, তিনি ওর ভালো চান!

পাশ থেকে বিরক্তির গলায় বললো অদিতি, অর্ক সায় দিলো,

একদমই তাই! আমি অবশ্য তিয়াসা কে ছাড়িনি, ও যদিও স্বীকার করলো না ওর সঙ্গে কেউ ছিলো, তাও কড়া করেই বলেছি ওকে! অনির্বাণ কেও বলেছি, আর মনে হয় না কেউ এখানে আসবে বা ফোন করবে আমাকে, দুজনেই বুঝেছে আমি বিরক্ত হয়েছি খুব!

অনির্বাণের সঙ্গে তিয়াসার একটা সম্পর্ক আছে মনে হয়, ও যা বলে অনির্বাণ তাই করে! এই কথাটা কৌশিকও বলছিলো সেদিন!

অদিতির কথায় সহমত হলো অর্ক,

হুম! আমারও মনে হয়েছে সেটা! রিয়াও বলছিল অনির্বাণ কে সেদিন ওর বাড়িতে, তিয়াসার কথায় ওঠাবসা বন্ধ কর!

পরের দিন রিয়া কে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলো, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলো অর্ক, কৌশিক আর রিয়ার মা। ডাক্তার বাবু ওদের আলাদা করে ডাকলেন,

ওর একটু পার্সোনাল অ্যাটেনশন প্রয়োজন! সঙ্গ দিন ওকে, একা থাকতে দেবেন না। বেশি চুপচাপ থাকলে কাউন্সিলিং করান কিছুদিন, এই প্রবণতাটা ভালো নয়।

কৌশিক, রিয়া আর ওর মায়ের সঙ্গে বাড়িতে গেলো, অর্ক কলেজের দিকে। ছুটির সময় অরিন্দমের সঙ্গে মেট্রোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো সবটাই, অরিন্দম ভাবলো একটু,

সাথী কে বললে কেমন হয়? ওদের তো ফিনান্সিয়াল কন্ডিশন সেরকম ভালো নয় মনে হয়, অন্য কোথাও চাপ হয়ে যাবে। সাথী আমার রেফারেন্সে ফিজ কমিয়ে দেবে অনেক।

অরিন্দম সব ব্যাপারেই চটপটে সাথীর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেললো সাথে সাথেই। ওখানে দাঁড়িয়েই রিয়ার মা কে ফোন করলো, ভদ্রমহিলা রাজি হলেন এক কথায়। অর্ক হসপিটাল থেকেই কলেজে গিয়েছিলো, তাই রিয়ার খবর কারোর জানা ছিলো না, বাড়ি ফিরতেই রুমা এগিয়ে এলেন,

কেমন আছে মেয়েটা? ডাক্তার কি বললেন?

অর্ক মাথা নাড়লো,

ভালো আছে মা, আজ সকালেই ছেড়ে দিলো। তবে ডাক্তার কাউন্সিলিং করতে বলেছিলেন, তাই অরিন্দম সাথীর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছে।

পরের দিন সকালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো, রিয়ারা বেরিয়ে যাওয়ার পরে সাথী অরিন্দম কে ফোন করলো, অর্ক তখন ক্লাস শেষ করে টিচার্স রুমে ঢুকে ছিলো সবে, অরিন্দম বাইরে বেরিয়ে এসে ওকে হাতের ইশারা করে ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ফোন স্পিকারে দিলো,

অর্ক বাবু, মেয়েটি কিন্তু প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে আছে, কাউন্সিলিং এ হবে না, মেডিসিন লাগবে। আমি ওর মা কেও জানিয়েছি, সায়ক্রিয়াটিস্টের কাছে রেফার করেছি ওকে।

কথা বলে কি বুঝলি?

পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো অরিন্দম,

খুব খারাপ! অনেকগুলো ব্যাপার একসঙ্গে ঘটে গিয়েছে আসলে, বাবার বাড়িতে থাকতে না দিতে চাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না একদম! ওর বাবার বান্ধবী, আর মা দুজনের ওপরেই প্রবল রাগ বোধহয় অনেকদিন থেকেই ছিলো, তার সঙ্গে বাবার ওপরেও রাগ যোগ হয়েছে এর সঙ্গে।

ফোনের কথাটা কি স্বীকার করলো?

নাহ! কিছুতেই স্বীকার করলো না! বারবার বলছে ওটা ও করেনি! তবে বাকি কাজগুলো ওই করেছে, সেটা ওর কথা থেকেই পরিষ্কার। আসলে ও সবাই কে সব সময় দেখাতে চেয়েছিলো ও অন্য স্টুডেন্টদের থেকে আপনার কাছে কিছুটা স্পেশাল। ও ফোন করলে আপনি নোটস দেন, ওর চয়েসে বউয়ের জন্যে গয়না কেনেন, এক্সকার্শনে গিয়ে ও আপনার পাশে বসে গল্প করে, বাড়িতে গিয়ে আপনাকে কে কফি করে খাওয়ায়, এমন কি সোফায় আপনার পাশে ক্লোজ হয়ে বসে ক্লাস করে। আসলে ওর লোনলিনেস থেকে ও সব সময় পার্সোনাল অ্যাটেনশন খোঁজে, আপনার ব্যবহার, যেটা হয়ত অন্য প্রফেসরদের থেকে আলাদা, স্টুডেন্টদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশা এই জিনিসটা ওকে আপনার প্রতি অ্যাট্রাক্ট করেছে! ও সব সময় চেয়েছে যে ওকে কেউ আলাদা করে কেয়ার করে এটা প্রচার করে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে, ঠিক এই কারণেই কৌশিকের প্রপোজালেও ও সরাসরি না বলে নি কখনো। আপনি হয়তো ওর কিছু আবদার মেনে নিয়েছেন কোনো কোনো সময়, তাতে এই ব্যাপার টা আরো বেশি করে ওর মনে দৃঢ় হয়েছে! ওর বক্তব্য ওর বন্ধুরাও বলে ও স্যারের স্পেশাল স্টুডেন্ট, ও চাইলেই স্যার নোটস দেন!

অর্ক মাথায় হাত দিলো, সাথী শেষ কথা বললো,

অর্ক বাবু, আর ওর বাড়িতে যাবেন না প্লিজ, সেটা ওর জন্যেই ভালো হবে। ও যতো আপনাকে চোখের সামনে দেখবে ততো আরো পার্সোনাল অ্যাটেনশন চাইবে, ওর মনে হবে আপনি সত্যিই ওকে আলাদা চোখে দেখেন, তাই কলেজের বাইরেও ওর খোঁজ খবর রাখছেন। এমনিতেও ও বলেছে আমাকে, আপনি ওর জন্যে হসপিটালেও যাতায়াত করেছেন, তাই যোগাযোগটা একদম বন্ধ করে দিন।

আমি শেষ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, এগুলো কি কৌশিক বা ওর মা জানে?

না, কৌশিক নামের ছেলেটি আসে নি, তবে ওর মা কে তো বলতেই হতো। একটা কথা, কৌশিক কে কিছু বলার দরকারও নেই, একমাত্র ওকেই কিছুটা হলেও বিশ্বাস করে রিয়া। কৌশিক ওকে প্রপোজও করেছে কয়েকবার, কৌশিক কে পাছে সরাসরি না বললে ওর কাছ দূরে থেকে সরে যায়, তাই কখনো ও কৌশিক কে না বলে নি, সব সময় বাবার দোহাই দিয়েছে। আমাকেও রিকোয়েস্ট করেছে বারবার, কৌশিকের বন্ধুত্ব ও হারাতে চায় না! আসলে ও এতটাই লোনলি যে একটু ওকে কেউ নরমভাবে কেয়ার নিয়ে ডিল করলেই ও তাকে আগলে রাখতে চায়, হয়ত বেশ কিছু সময় যা অল্প হয়েছে তাকে কিছুটা বাড়িয়ে বলে তার কাছে ও কতটা মূল্যবান এটা অন্যের সামনে তুলে ধরতে চায়। এই কথাটা আপনারাও মাথায় রাখবেন প্লিজ, কৌশিক কে কোনোদিনও জানতে দেবেন না কিছু! কৌশিক কোনো কারণে ওর পাশ থেকে সরে গেলে ওর কোনো ইনফরমেশন ও হয়ত আর কাউকে শেয়ার করবে না। তাই এর পরে কিছু ঘটলে কেউই জানতে পারবো না আমরা।

অর্কর প্রশ্নের উত্তরে কথাগুলো বলে ফোন রেখে দিলো সাথী। ফোন রেখে দিয়ে দুজনেই হতভম্ভ হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষন, তারপর অর্ক কথা বললো,

এবার থেকে ওর মা কিছু বলার জন্যে ফোন করলে তুইই যোগাযোগ রাখিস, আমি আর ফোন ধরবো না। ওর মাও এই কথাটা জেনে গেছে যখন, তখন কিছু জিজ্ঞেস করলে সত্যিটাই বলে দিস!

বাড়িতে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো অর্ক, সাথীর কথাগুলো কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না! কোনোদিনও বোঝে নি ও, স্টুডেন্ট ছাড়া কিছু ভাবে নি কোনোদিনও, শুধু যেদিন ওর গায়ে লেপ্টে এসে বসছিলো, সেই দিন কেমন কেনো একটা অস্বস্তি হয়েছিলো প্রথম। অথচ মেয়েটা ভাবতো ও ওকে আলাদা গুরুত্ব দেয়! ভাবতে ভাবতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো একটু, তন্দ্রা ভাঙলো দিতির ডাকে,

ওঠো চা নাও,

চায়ের কাপ পাশের টেবিলে রেখে খাটে বসলো অদিতি।

সাথী কিছু বললো? কাউন্সিলিং হয়েছে রিয়ার?

অর্ক ইশারা করলো,

বসো এখানে, তোমার সঙ্গে কথা আছে!

দরজা বন্ধ করে এসে কৌতূহলী চোখে তাকালো অদিতি,

কি হয়েছে?

সাথী বললো একটু ভালো ব্যবহার যার কাছ থেকেই ও পায়, তাকেই ও ক্লোজ মনে করে। ওর আসলে ধারণা আমি ওকে অন্য স্টুডেন্টদের থেকে আলাদা চোখে দেখি, মানে ওকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিই। সেসবের কিছু কিছু প্রমাণ হিসেবেই ওই কথাগুলো তোমাকে ও বলেছে। এখন আমি বুঝতে পারছি এই যে ও আমাকে ফোন করে নোটস চেয়েছিলো, বা বন্ধুদের সামনে ও ভালো কফি করে কিনা বলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, এগুলো সবই নিজেকে গুরুত্বপূর্ন করে তোলার জন্যে! তবে ফোন যে ও করেছে সেটা স্বীকার করেনি কিছুতেই! সব কিছু মেনে নিলেও এই মিথ্যেটা আমি কিছুতেই মেনে নেব না। বাকি মিথ্যেগুলো খুব সাধারণ, সত্যি হয়ত ওইটুকু মিথ্যে বলাতে আমাদের কোনো ক্ষতি হতো না, কিন্তু ফোন করে যে মিথ্যেটা ও বলেছে সেটা অলমোস্ট আমাদের সংসার ভেঙে দিচ্ছিলো। যাইহোক সাথী ওর সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ রাখতে বারণ করেছে, আমি ওর আর ওর মায়ের নম্বরটা ব্লক করে দেবো ঠিক করেছি।

অদিতি অর্কর হাতটা ধরলো,

ঠিক আছে! এতো কিছু ভেবো না এটা নিয়ে! কাউন্সিলিং হলে ভালো হয়ে যাবে নিশ্চয়ই! ওর ঐ ফোন যে আমাদের কতো টা ক্ষতি করতে পারতো সেটা সুস্থ হলে ও নিজেই বুঝবে নিশ্চয়ই!

জানিনা! বুঝলেই ভালো! সাথী বললো শুধু কাউন্সিলিংয়ে হবে না, মেডিসিন লাগবে! দেখা যাক কি হয়! আমি অরিন্দম কে বলে দিয়েছি সবটা, এবার থেকে যদি ওর মা আর কন্টাক্ট করেন তাহলে ওই যা করার করবে! আমার ওর জন্যে হসপিটালে যাওয়াটা কেও ও স্পেশাল অ্যাটেনশন দেওয়া বলে মনে করছে। অনেক হয়েছে, এবার একটু শান্তিতে কাটাতে চাই বাকি জীবনটা! গত বছরখানেক যা গেলো! সব শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিলো একদম! কোনোদিনও যে এই ফেজটা কাটিয়ে উঠতে পারবো, একসময় ভাবতেও পারছিলাম না!

অর্ক হটাৎ করেই জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে এলো অদিতি কে, গাঢ় গলায় বললো,

বিশ্বাস করো, একসময় যখন গোটা কলেজে তোমার সন্দেহবাতিক হওয়ার কথা ছড়িয়ে গেলো না, সমর দা ওই ভাবে বললেন অরিন্দমের বিয়েতে, তুমি ফোন নিয়ে অশান্তি করতে লাগলে, তখন ভীষণ মনে হতো সব ছেড়ে চলে যাই! বাড়িতে অশান্তি, বাইরে অশান্তি, আর পারছিলাম না নিতে! মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়েছি কতদিন! শুধু ছেলেটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো, মনে হতো এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবা হব আমি! এইটুকু শিশু কে একা ছেড়ে পালিয়ে যাবো! শুধু ওর জন্যেই ফিরে এসেছি বারবার!

অদিতির শরীরটা কেঁপে উঠলো ভয়ে, এতো কষ্ট অর্কও পেয়েছে তখন, অথচ কিচ্ছু বুঝতে পারে নি ও! শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ও অর্ক কে।

চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৭+১৮

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৭+১৮
ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে প্রায় মাস দেড়েক, সেদিন রাতের পর থেকে আর নতুন করে কিছু এগোয় নি, তার কারণ একটাই ওদের পরীক্ষা চলছিলো, ইচ্ছে করেই পরীক্ষা চলাকালীন অর্ক ওদের বিরক্ত করতে চায় নি। একজন শিক্ষক হিসেবে ওদের পরীক্ষাটা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ওর কাছে। গতকাল বিকেলে পরীক্ষা শেষের পর তিয়াসা ফোন করেছিলো ওকে,

স্যার, এক্সাম শেষ হয়েছে আজ, এবার বলুন কি করতে চান?

ওর এত বেশি উৎসাহের কারণ বোঝে অর্ক, ও রিয়াকে মনে মনে একটুও পছন্দ করে না আসলে। তাই এই সুযোগে কিছুটা হলেও জব্দ করতে চায়, তবে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার ভয়ে নিজে থেকে কিছু করতে চায় না, পুরোটাই অর্কর ঘাড় দিয়ে হয়ে গেলেই ওর সুবিধা!!

সেদিক থেকে কৌশিক ছেলেটি যথেষ্টই ভালো, রিয়া ওকে সব কিছু মিথ্যে বলেছে জানার পরেও ও রিয়া কে বাঁচানোর চেষ্টাই করে গেছে সব সময়।

ও আমাকে এক্সকারশনে গিয়ে একটা কথা বলেছিলো স্যার, আমি এখন বুঝতে পারছি ও কেনো এতো ডিপ্রেসড থাকে সব সময়!!

কৌশিকের কথায় একটু চমকে ছিলো অর্ক,

ডিপ্রেসড থাকে? বেশ হাসিখুশিই তো! বুঝিনি তো কখনো!

বুঝবেন না স্যার, ও কখনো কারোর সঙ্গে শেয়ার করে না এসব! ও বলেছিলো ও যাদেরকে ভালোবাসে, তাদেরকে কেউ ওর থেকে আলাদা করে দেয়! ওর মা নাকি ওকে ঠাকুমা, পিসিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে! এখন বুঝছি শুধু ঠাকুমা, পিসি নয় বাবার কাছ থেকেও ওকে আলাদা করে দিয়েছে ওর মা!! আর সত্যি বলতে ওর দোষ তো একটাই, ও কিছু কথা নিজের মতো করে বানিয়ে বলেছে হয়ত, কিন্তু তাতে কার কি ক্ষতি হয়েছে ?

কৌশিকের গলার সহানুভূতির সুর সবাইকেই অবাক করেছিলো, অর্ক মনে মনেই একটু চিন্তায় পড়েছিলো, সত্যিই তো! মেয়েটার দোষ টা ঠিক কি? হয়ত কিছু মিথ্যে কথা বলেছে ও, তার জন্যে তিয়াসা যদি মুখ খুলতে রাজিও হয়, তাহলেও ও হয়তো রিয়াকে কিছু বকাবকি করতে পারে, এর বেশি কিছু না! কিন্তু সেটা বাদে আর কি করতে পারে ও। শুধু কিছু মিথ্যে কথা বলার জন্যে তো আর পুলিশে কমপ্লেইন ও করতে পারবে না!!তিয়াসা একটু বিরক্ত গলায় বলেছিলো,

মানে? কারোর ক্ষতি হয়নি বলে যা খুশি বানিয়ে বানিয়ে নিজের মতো করে বলবে? আমার সব সময় মনে হতো ও মিথ্যে বলে স্যার, ও যতটা বলে ততোটা বড়লোক ও নয়! জানেন তো, যখনই কোথাও ওর গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা উঠতো ও কোনোভাবে সেটা কে এড়িয়ে যেতো, এই শান্তিনিকেতন যাওয়ার সময়েও এই নিয়ে আমাদের কতো মিথ্যে বলেছিলো! ও গাড়ি নিয়ে গেলে ওর বাবা নাকি জেনে যাবে! এখন তো শুনছি বাবাই নাই, তার আবার রাগ!

তাতে কি? ট্রেনে গিয়ে কিছু কম আনন্দ হয়েছিলো নাকি? সবটাই তো আমিই অ্যারেঞ্জ করেছিলাম, শুধু কন্ট্রিবিউট করা ছাড়া আর কিই বা করেছিস তুই?

কৌশিক রাগের গলায় বলছিলো, অনির্বাণ তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো,

আরে ছাড় না! কি লাভ ওসব পুরনো কথা তুলে, নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল করিস না! আর ঘোরা তো হয়ে গেছে কবেই!

কৌশিক থামে নি, রীতিমত উত্তেজিত গলায় বলেছিলো,

কথাটা লাভ, লোকসানের নয়, কথাটা অন্য জায়গায়, কি হয়েছে যদি ট্রেনেই গিয়েছি? গাড়ি তো তোরও ছিলো, তোর বাবা তো সত্যিই বড়লোক, তো তুই তোর গাড়ি নিয়ে যাসনি কেনো তখন? তিয়াসা বারণ করেছিলো, তাই তো?

এবার তিয়াসা উত্তেজিত হয়েছিলো, অর্কর উপস্থিতি সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বলেছিলো,

তুই হটাৎ করে এর সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ফেলছিস কেনো?আমি যা বলি অনির্বাণ তাই করে নাকি? আর তুই তাহলে কি করিস? রিয়াকে যাতে গাড়ি নিয়ে যেতে না বলি আমরা তাই তো তুই নিজে আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিয়ে নিলি সেদিন! কিছু বুঝি না ভাবিস নাকি! আজ পর্যন্ত তো কখনো কোনো দায়িত্ব নিতে দেখিনি তোকে!

দুজন কে তর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখে শেষ পর্যন্ত অর্ক ইন্টারফেয়ার করেছিলো, কৌশিক কে নরম গলায় বলেছিলো,

এতো উত্তেজিত হয়ে পড়ছ কেনো? এগুলো খুব সাধারণ কথা, হয়ত তুমি ঠিকই বলেছো ওর মিথ্যে কথাতে কারো কোনো ক্ষতি হয় নি। কিন্তু ভেবে দেখো, এই হ্যাবিট টা তো ভালো নয়, আজ ক্ষতি হয়নি বলেই যে কাল হবে না, এরকম কোনো কথা আছে নাকি! মিথ্যে বলার অভ্যাসটাই খারাপ, আর তুমি একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে এটা কে সাপোর্ট করছো!

না, স্যার সাপোর্ট করছি না, আসলে তিয়াসা ওই ভাবে বললো তো তাই বলে ফেলেছি। কথা হচ্ছিলো রিয়া কে নিয়ে, ও সেখানে আমাকে জড়িয়ে ফেললো। আমি যে ট্রেনের টিকিট কেটেছি রিয়ার গাড়ি নিয়ে যাওয়া আটকাতে এটা কি ও প্রমাণ করতে পারবে? অহেতুক বিতর্ক তৈরি করার কোনো প্রয়োজন আছে ওর? আর যদি তাই হতো, তাহলে অনির্বাণের গাড়ি নিয়েও তো যেতে পারতাম আমরা, ও ও তো ট্রেনে যেতেই চেয়েছিলো তখন!

একটু অভিযোগের সুরে বলেছিলো কৌশিক, এবার অনির্বাণ কথা বলেছিলো,

ভুল ভাবছিস ভাই, কেউ তোকে জড়িয়ে ফেলেনি! তুই নিজের মতো করে ভাবছিস এগুলো! আমার গাড়ি নিয়েই তো যাই আমরা বেশিরভাগ সময়, আগেও গিয়েছি, এখনো যাই, আমি কখনো কিছু বলেছি তাই নিয়ে?

তুই বলিসনি, তিয়াসাই তো তোর হয়ে বলে দিলো সবটা,

বিদ্রুপের গলায় বলেছিলো কৌশিক, অনির্বাণ হাত তুলেছিলো,

প্লিজ, সবটা না জেনে কমেন্ট করিস না, আগে বলতে দে আমাকে! যেদিন আমাদের শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথা হলো, তার মাস খানেক আগে একদিন তোরা আমার বাড়িতে এসেছিলি মনে আছে? সেদিন ওখানে আমাদের দোকান থেকে কেউ কোনো একজন ভদ্রমহিলা কে ফোন করে কিছু আজেবাজে কথা বলেছিলো। ভদ্রমহিলা পরে বাবা কে ফোন করে পুলিশে কমপ্লেইন করবেন বলেছিলেন, বাবা খুব রেগে গিয়েছিলো, বোন করেছে ভেবে ওকে বকাবকিও করেছিলো। পরে বোন বলেছিলো ও নাকি মেয়েদের সবাইকেই নিচে নামতে দেখেছিলো। এবার বল, এই ঘটনা জানার পরে আর বাবা আমাকে গাড়ি নিয়ে যেতে দিতো শান্তিনিকেতন? কোন লজ্জায় গাড়ির চাবি চাইতাম?

রাত বেশ খানিকটা হয়েছিলো, রুমা টেবিলে খাবার সাজাতে শুরু করেছিলেন দেখে অদিতি বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো তাঁকে সাহায্য করতে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখতে রাখতে ঘর থেকে আসা কথোপকথন সবটাই কানে আসছিলো ওদের, সমরেশ সোফায় বসেছিলেন, শুনতে পাচ্ছিলেন তিনিও, হটাৎ করেই অনির্বাণের কথায় চমকে উঠলো ওরা। দিতি হাতের থালা নামিয়ে রেখে প্রায় ছুটে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলো, পেছন পেছন সমরেশ আর রুমাও।

তুমি কি বলছিলে? তোমাদের দোকান থেকে কেউ কোনো মহিলা কে ফোন করেছে?

ঘরে ঢুকে আসা অদিতির গলায় অনির্বাণ উঠে দাঁড়িয়েছিলো,

হ্যাঁ, ম্যাম! কিন্তু এটা অনেকদিন আগের কথা! আজকের নয়!

কতোদিন আগের কথা অনির্বাণ?

দিতি আর কিছু বলার আগেই উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করেছিলো অর্ক, অনির্বাণ ভ্রু কুঁচকে ভেবে বলেছিলো

শান্তিনিকেতনে যাওয়ারও মাস খানেক আগের কথা স্যার! কেনো বলুন তো?

তোমাদের দোকানের নম্বরটা কি?

জানতে চেয়েছিলেন সমরেশ, অদিতি আফসোস করছিলো,

ইস! একটুও যদি বুঝতে পারতাম এরকম হবে, তাহলে নম্বরটা সেভ করতাম! কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে নি তখন!

আমি সেভ করেছিলাম, সাথী করতে বলেছিলো তখন, নম্বরটা বলো তো অনির্বাণ,

পকেট থেকে মোবাইলটা বার করতে করতে বলেছিলো অর্ক, অনির্বাণের বলা নম্বরের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলো সেভ করা নম্বর। তিয়াসা, কৌশিক আর অনির্বাণ তিনজনেই কিছু বুঝতে না পেরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, তৎক্ষণাৎ অর্ক ভেবে নিয়েছিলো কৌশিকের সামনে কিছু বলবে না ও! মেয়েটা কে কোনো খবর পেয়ে সতর্ক হতে দেবেনা কিছুতেই! কৌশিক জানলেই ও সবটাই জেনে যাবে! ভেতরের উত্তেজনা দমিয়ে রেখে বলেছিলো,

না, কিছুনা! চলো খেয়ে নেবে! পরশু থেকে পরীক্ষা, এখন আর এসব সাধারণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই সমরেশ উঠে এসেছিলেন,

সাথীর তারমানে কিছুটা হলেও সন্দেহ হয়েছিলো, তাই না? সেই জন্যেই বোধ হয় নম্বরটা সেভ করতে বলেছিলো তোমাকে,

অর্ক লজ্জিত হয়েছিলো, অদিতির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলেছিলো,

খুব খারাপ লাগছে! ভাবতেও পারিনি, মেয়েটা এরকম কোনো কাজ করতে পারে! কোনোদিনও সেই ভাবে কড়া হয়ে মেলামেশা করিনি স্টুডেন্টদের সঙ্গে, বরাবর বন্ধুর মতোই মিশতে চেয়েছি! তার প্রতিদান যে এই ভাবে পাবো,কল্পনাও করিনি!

অর্কর মুখ দেখে খারাপ লেগেছিলো অদিতির নিজেরও, সেই সঙ্গে অভিমানও হয়েছিলো খুব, ওকে তখন একটুও বিশ্বাস করে নি অর্ক! ও কতো কষ্ট পেয়েছিলো তখন! রুমা এগিয়ে এসেছিলেন, ছেলের পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন,

দোষ তোর নয়! দোষ তো তাদের, যারা তোর বন্ধুর মতো মেশা কে অন্য ভাবে নিয়ে এই সুযোগে অসভ্যতা করার চেষ্টা করছে। মন থেকে বার করে দে এসব, চল খেতে চল।

ওই জন্যেই তো নিজেদের মধ্যে স্বচ্ছতা রাখাটা জরুরি! তুমি সেটা কখনো বোঝনি। যদি তুমি নিজের দিকটা ঠিক রাখতে, এতো ক্যাজুয়াল না হতে, ফোন বন্ধ বা সাইলেন্ট করে রাখার মতো কাজগুলো দীর্ঘদিন ধরে না করতে, তাহলে কোনো বাইরের ফোন অদিতির বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারতো না। এই ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলো কে ছোটো মনে হলেও এগুলোই কোনো কোনো সময় বড়ো বড়ো ব্যাপার হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে আশা করি তুমি সচেতন হবে এসব বিষয়ে,

পাশ থেকে বলেছিলেন সমরেশ, অর্ক মাথা নিচু করেছিলো।

বুঝতে পারছি সেটা এখন! সচেতন হবার কথা বলছো তুমি! আমার তো বিশ্বাস জিনিসটাই চলে গেলো, এরপরে তো শুধু তোমরা তিনজন ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতেও পারবো না কখনো! তুমি জানোনা বাবা, আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না, আমার ঠিক কি রকম লাগছে!

অর্ক র মুখে দুঃখের ছাপ সবাইকেই কষ্ট দিয়েছিলো, সমরেশ উঠে পড়েছিলেন,

মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ! একজনের জন্যে তুমি সবাই কে অবিশ্বাস করতে পারোনা! চলো খেতে চলো!

সেদিন ওই প্রসঙ্গ চাপা পড়েছিলো এরপর, কিন্তু তিয়াসা যে যথেষ্টই বুদ্ধিমতি সেটা অর্ক বুঝেছিলো, যখন ও বাড়িতে ফিরে গিয়েই রাতে অর্ক কে ফোন করেছিলো। তখনই অর্ক বলেছিলো পরীক্ষা শেষ হলে সবটা আলোচনা করবে, সেই মতো কালকের কথার পর আজ ওদের জগু বাজারে দাঁড়াতে বলেছিলো কিন্তু কৌশিক কে না জানিয়ে!

জগু বাজারের ঠিক মুখে দাঁড়িয়ে অর্কর জন্যে অপেক্ষা করছিলো তিয়াসা আর অনির্বাণ, মেট্রো থেকে নেমে রাস্তাটা পেরিয়ে গিয়েই ওদের কে দেখতে পেলো ও আর অরিন্দম। ওদের দেখেই অনির্বাণ হাত তুললো,

স্যার, এদিকে!

গলির মধ্যে ঢুকে অরিন্দম হাত তুললো,

ওই হলুদ বাড়িটা,

কিই!

একসাথে বিস্ময় ছিটকে বেরোলো অনির্বাণ আর তিয়াসার গলায়। অর্ক কোনো কথা না বলেই বেলে হাত রাখলো, বেল বাজানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসেই চমকে গেলো রিয়া, কিন্তু সোজা চোখে কোনো প্রশ্ন না করে তাকিয়ে থাকলো ওদের দিকে। অর্ক অবাক হচ্ছিলো, মেয়েটার কি কোনো ভয় নেই!

কে এসেছে? খুলেছিস দরজা?

বলতে বলতে ততোক্ষনে বেরিয়ে এসেছেন সেদিনের ভদ্রমহিলা, অর্ক আর অরিন্দম দেখেই অবাক গলায় বললেন,

ওমা! আপনারা! কি ব্যাপার? আসুন আসুন, ভেতরে আসুন স্যার,

রিয়া তখনও দরজা আটকে দাঁড়িয়েছিলো, মহিলা বিরক্ত হলেন, চাপা গলায় বললেন,

এটা কি ধরনের অসভ্যতা! দরজা থেকে সরে যাও, ওনাদের ভেতরে আসতে দাও!

একটাও কথা না বলে দরজা থেকে রিয়া কে সরে যেতে দেখে অরিন্দম একটু নিচু গলায় বললো,

ব্যাপার কি বলতো! মেয়েটা কি সব জেনে গেছে নাকি! কিরকম নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে দ্যাখ!

ওরা ভেতরে এসে বসলো, অতো লোকের বসার জায়গা না থাকায় অনির্বাণ দাঁড়িয়ে রইলো, একটু দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো রিয়াও। ভদ্রমহিলা বিনীত গলায় বললেন,

কি হয়েছে স্যার? আমার মেয়ে কি কিছু করেছে?

অরিন্দম মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ, ম্যাডাম, খুব খারাপ লাগছে বলতে তাও সরাসরিই বলছি, আপনার মেয়ে সম্পর্কে আমাদের কিছু অভিযোগ আছে। ও আমার বন্ধুর স্ত্রী কে কিছু এমন কথা বলেছে যেগুলো ওদের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করেছে। এরকম বেশ কিছুদিন ধরেই ঘটছিলো কিন্তু এর কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে না থাকায় আমরা এটা নিয়ে এগোতে পারিনি। কিন্তু একটা ঘটনার প্রমাণ আমরা জোগাড় করতে পেরেছি বলেই আজ আপনার সামনে এসেছি। ও এই ছেলেটির দোকানের নম্বর থেকে ফোন করে আমার বন্ধুর স্ত্রী কে বেশ কিছু কথা বলেছে, যেগুলো আমরা পরে আপনাকে আলাদা করে বলবো,

অনির্বাণের দিকে আঙুল দেখিয়ে রিয়ার মা কে বললো অর্ক, ভদ্রমহিলা বিস্ফারিত চোখে তাকালেও, রিয়ার মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন এলো না। সে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে বললো,

আমি তোর বাড়ি থেকে ম্যাম কে ফোন করেছি? তুই দেখেছিস?

অনির্বাণ একটু চুপ করে থেকে বললো,

আমার বোন দেখেছে!

কি দেখেছে তোর বোন? আমি ফোন করেছি?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ,ও দেখেছে তোকে,

অর্ক মনে মনেই শঙ্কিত হচ্ছিলো, অনির্বাণ যে এটা বানিয়ে বলেছে সেটা রিয়া জানে নিশ্চয়ই! কারণ ও ফোন করার সময় যথেষ্ট সতর্ক থেকেই করেছে সবটা। মেয়েটা বেশ শক্ত মনের, একে ভাঙা মুশকিল!

আর কতো শত্রুতা করবি? তিয়াসার কথায় ওঠাবসা বন্ধ কর এবার! তোদের কোনো ক্ষতি করেছি আজ পর্যন্ত, যে অহেতুক আমাকে ফাঁসাতে চাইছিস! নিজের চরকায় তেল দে না,

অনির্বাণের দিকে সোজা তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললো রিয়া, অরিন্দম শেষ চেষ্টা করলো,

তুমি কি মিথ্যে বলো না রিয়া? কলেজে সবাই জানে তুমি তিনতলা বাড়িতে থাকো, তোমার বাড়িতে সিসিটিভি লাগানো আছে?

রিয়া মাথা নাড়লো,

না বলি না! এটা আমার বাড়ি না! এটা মায়ের বাড়ি! আমার বাড়িতে সি সি টি ভি লাগানো আছে, মা কে জিজ্ঞেস করুন না হয়!

অর্ক চমকে তাকালো, ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

আমরা এখানে ভাড়া থাকি, আমার শ্বশুরবাড়ি সত্যি তিনতলা, সি সি টি ভি ও আছে!

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৮
আমি এমনিতেই খুব অশান্তি তে থাকি স্যার, ও যদি আপনার সংসারে কোনো সমস্যা তৈরি করে থাকে তাহলে ওর হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, প্লিজ আমার মেয়েকে মাফ করে দিন,

ভদ্রমহিলা প্রায় হাতজোড় করলেন অর্কর সামনে, অর্কর খারাপ লাগছিলো। তিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো ও,

তোমরা বাইরে অপেক্ষা করো, আমরা কথা বলে আসছি একটু,

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিয়া মুখ খুললো, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

কেনো ক্ষমা চাইছো? কি করেছি আমি?

অরিন্দম অর্কর দিকে তাকালো ওর চোখে অসহায়তা ফুটে উঠলো, অর্কর মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ, মেয়েটা এতো সাংঘাতিক! ও রিয়ার দিকে তাকালো,

তুমি মনে করো তুমি কোনো অন্যায় করো নি রিয়া? তুমি কতোবার গিয়েছ আমার বাড়ি যে ম্যাম কে বলেছো তুমি অনেকবার কফি করেছো? তুমি এই কথাগুলো অস্বীকার করতে পারবে না, কারণ তিয়াসা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন। ও যদিও তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায়নি বলে আমাকে কিছু বলছিলো না প্রথমে, কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই স্বীকার করেছে। তিয়াসা কে বাঁচানোর জন্যে কথাগুলো কে একটু ঘুরিয়ে বললো ও।

আমি ওইভাবে কিছু বলিনি স্যার, আমি কফির কৌটো তাক থেকে নিচ্ছিলাম দেখে ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি কোথায় কফি থাকে কিভাবে জানলাম। আমি তার উত্তরে বলেছিলাম আমি আগে করেছি এখানে, অনেকবার করেছি বলিনি, ম্যাম ভুল বুঝেছেন!

অরিন্দম অবাক চোখে অর্কর দিকে তাকালো, মেয়েটার কথা ঘোরানোর ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলো অর্ক নিজেও। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,

কিন্তু তিয়াসা সাক্ষী আছে, তুমি এগুলো বলেছো। এমনকি তুমি বোলপুর স্টেশনেও অদিতি কে কিছু কথা বলেছিলে, সেগুলো দিতি আমাকে ট্রেনেই বলেছিলো।

রিয়া চুপ করে থাকলো এই প্রথম, সম্ভবত তিয়াসার কথা শুনেই, ভদ্রমহিলা ভয় পেলেন, মেয়ের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,

যাও, ভেতরে যাও! আর কোনো কথা শুনতে চাই না তোমার মুখ থেকে!

রিয়া ভেতরে চলে গেলো, ভদ্রমমহিলা অর্কর দিকে ফিরে বললেন,

স্যার, অনেক ভুল করেছে বুঝতে পারছি আমার মেয়ে! আসলে ও খুব উদ্ধত, কথা শোনে না একদম, আমি নিজেই ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি স্যার। আগে এরকম ছিলো না ও, যত বড়ো হচ্ছে ততো এরকম হয়ে যাচ্ছে, ইদানিং আমার সঙ্গেও খুব খারাপ ব্যবহার করছে। তবে আমার শ্বশুরবাড়ি সত্যিই বড়লোক, যদিও আমার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই! কিন্তু আমার মেয়ে সেখানে যাতায়াত করে লুকিয়ে আমি জানি।

আপনার হাজব্যান্ড এখানে থাকেন না বোধহয়?

অরিন্দম জিজ্ঞেস করলো, উত্তর দেবার আগেই ব্যাগ কাঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রিয়া, মহিলা অবাক হলেন,

কোথায় যাচ্ছিস!

তোমাকে সব কিছু বলতে হবে নাকি!!

বলেই বেরিয়ে গেলো রিয়া, ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

দেখুন! কি আর বলবো ওকে বলুন! আমার হাসব্যান্ড নিজের বাড়িতে থাকেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই! উনি অন্য মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে আছেন, আমি সেটা মেনে নিতে পারিনি তাই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। আইনত আমাদের ডিভোর্স হয়নি কখনো, আমার শাশুড়ি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলের স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিয়ে আমি ওখানেই থেকে যাই, কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমার মেয়ের ব্রেন ওনারা ওয়াশ করে ফেলেছেন, ও ওর বাড়ি ছাড়ার জন্যে, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবার জন্যে আমাকেই দায়ী করে। আমার শাশুড়ি, ননদ, স্বামী ওর সঙ্গে লুকিয়ে স্কুলে দেখা করতো, দামী দামী গিফ্ট দিতো,আর আমার বিরুদ্ধে ওর মনকে বিষিয়ে দিতো, এই করে ওর আমার সঙ্গে সম্পর্ক আর ভালো নেই।

অর্ক মনে মনে অবাক হচ্ছিলো, কতো রকমের লোক আছে পৃথিবীতে! ছেলের অবৈধ সম্পর্ক কে মেনে নেওয়ার জন্যে বউ কে চাপ দেয়! ওর খুব খারাপ লাগছিলো ভদ্রমহিলার জন্যে, আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

আপনার চলে কি করে? চাকরি করেন আপনি? হাজব্যান্ডের কাছ থেকে সাহায্য পান?

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

আমি একটা স্কুলে প্রাইমারি সেকশনে পড়াই, স্কুলের পরে দু একটা প্রাইভেট টিউশন করি। হাজব্যান্ডের কাছ থেকে নিই না কিছু তবে লুকিয়ে মেয়ের হাতে টাকা পয়সা দেয় ওর বাবা সেটা বুঝি। অনেকবার বারণ করেছি মেয়েকে, ও শোনে না, ও আমাকে ওর সবচেয়ে বড় শত্রু ভাবে। ওর মাথায় এটা ঢোকানো হয়েছে যে ইচ্ছা করেই আমি ওখান থেকে চলে এসেছি। অথচ আমার হাসব্যান্ড কিন্তু কখনো মেয়ের দায়িত্ব নিতে চায় নি।

উনি কি আবার বিয়ে করেছেন?

মহিলা ম্লান হাসলেন,

নাহ! ওর একটা ফ্ল্যাট আছে আলিপুরে সেখানে থাকে ওই মহিলা! মহিলা বিবাহিতা, একটা মেয়ে আছে। মেয়ের তো সেই জন্যেই রাগ, বাবা যখন বিয়ে করেনি তখন আমি চলে এলাম কেনো!

অর্ক উঠে দাঁড়ালো, দেখাদেখি অরিন্দমও, দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় বললো,

মেয়েকে বুঝিয়ে বলবেন একটু, মিথ্যে বলা ওর ভবিষ্যতের জন্যেও খারাপ। আসি!

বাড়িতে ঢুকতেই সবার মুখোমুখি হলো অর্ক, রিয়া কে দিয়ে স্বীকার করানো যায় নি শুনে দিতি হতাশ হয়ে পড়লো।

বিরাট ভুল হয়ে গেছে আমার! কল টা রেকর্ড করা উচিত ছিলো!

হা হুতাশ করতে লাগলো দিতি, সমরেশ হাত তুললেন,

ছেড়ে দাও! যা হয়ে গেছে তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে বা! মিছিমিছি ভেবে লাভ কি! আমার শুধু একটাই খারাপ লাগছে ভেবে যে সব কিছু জেনেও আমাদের শুধু মাত্র প্রমাণের অভাবে চুপ করে থাকতে হচ্ছে। এই রকম মানসিকতার মেয়ে কে কোনো শাস্তি ছাড়াই ছেড়ে দিতে হবে এটা ভাবলেই বিরক্ত লাগছে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া মিটে যাওয়ার পরে সমরেশ ঘরে ঢুকে গেলেন, রুমা টি ভি খুলে ড্রইং রুমের সোফায় বসে পড়লেন। এ তার প্রতিদিনের নেশা, সারা দুপুর বসে বসে টিভি দেখেন উনি। অদিতি ছেলে কে ঘুম পাড়াতে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলো, কিছুক্ষন পরে অর্কও ঢুকে এলো। ছেলে ততোক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছিল, অর্ক কে ঢুকতে দেখে অদিতি উঠে বসলো।

মনটা খুব অস্থির লাগছে দিতি! এতো ঘটনার একটাও প্রমাণ করতে পারলাম না! কি সুন্দর একটার পর একটা মিথ্যে বলে গেলো! একবারের জন্যেও ভাবিনি জীবনে এরকম কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে। খুব সাধারণ জীবনই তো কাটাই আমরা, কোনো রকম জটিলতা তো হয় নি কখনো! তাহলে আজ কেনো এতবড় একটা ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটলো বলতো!! যদি ও সত্যিই আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে দিতো তাহলে?

তুমি তখন আমার একটা কথাও বিশ্বাস করো নি! কতো বার তোমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছি!

দিতি র গলায় অভিমানের সুর, অর্কর কানেও বাজলো, দিতির হাত ধরে নরম গলায় বললো,

সরি দিতি, বিশ্বাস করো, নিজেকে ছোটো লাগছে খুব! ভুল আমারই, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। ছোটো ছোটো ভুল বোঝাবুঝি ছিলো আমাদের মধ্যে, কিন্তু সেটা এতো বড় আকার নেয় নি কখনো আগে। আজ বুঝতে পারছি ফোন সাইলেন্ট রাখা, না ধরা, না বলে কোথাও চলে যাওয়াগুলো কে নিয়ে তোমার সাথে অশান্তি হয়েছে অনেকবার আগে, আমি আসলে সেগুলো কে খুব সাধারণ ব্যাপার ভেবেছি তখন। ভেবেছি তুমি অহেতুক অশান্তি করো, এখন মনে হয় যদি আমার ওই হ্যাবিটগুলো না থাকতো তাহলে হয়ত আমি ফোন হারিয়ে ফেলেছিলাম সত্যিই, এই কথাটা তোমাকে সহজেই বিশ্বাস করাতে পারতাম সেদিন। এখন বুঝি তোমার আস্থা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজের দোষেই, কিন্তু এবার আমি প্রমিজ করছি, আমাকে আর একটা সুযোগ দিয়ে দ্যাখো, এই ভুলগুলো কোনোদিনও রিপিট হবে না আর! কিন্তু প্লিজ চলে যাবার কথা আর ভেবো না কখনো, সেদিন আমার ওইভাবে তোমাকে চলে যাওয়ার কথা বলা উচিত হয়নি, সেটা বাবা, মায়ের সামনেও বলেছি, আজও বললাম, ক্ষমা করে দাও প্লিজ।

অদিতি চুপ করে রইলো, কে জানে ওর কোনোদিনও বদল হবে কিনা! নাকি শুধুমাত্র মুখের কথা হয়েই থেকে যাবে এগুলো! কিন্তু বললো তো তবু, এই ক্ষমা চাওয়া টুকুই তো চাওয়া ছিলো ওর, অন্তত ওকে বুঝুক অর্ক, এটাই তো ও চেয়েছে মনে মনে এতদিন! কেনো যে এই ছেলেটাকেই এতো ভালোবাসে ও, শুধু মুখেই রাগ দেখায়, ছেড়ে যেতে পারে কই!

কিন্তু মেয়েটা এরকম করলো কেনো? আমি তো ওর কোনো ক্ষতি করিনি!

সেটাই তো! আমি নিজেও সারাক্ষন এটাই ভেবে যাচ্ছি, কোনো মোটিভ থাকবে না? কেউ কোনো কারণ ছাড়াই অহেতুক মিথ্যে কথা বলবে? তাও আবার তারই স্যার সম্বন্ধে! গত তিন বছরে তো এমন কোনো ইঙ্গিত আমি পাই নি যে ওর সম্বন্ধে এরকম কোনো ধারণা করবো! আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় আড়াই বছর হতে চললো, তারও প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকে ওকে আমি চিনি, তখন তো আমার বিয়েও হয় নি। এরকম কিছু করার থাকলে তো ও সেই সময়েই করতে পারতো, তখন তো কিছু করে নি। আর এখন তো কলেজ শেষ হয়ে গেলো ওদের!

দিতি বাধা দিলো,

তুমি ভুল করছো! ঘটনা টা কিন্তু এখন কার নয়, এটা প্রায় একবছর আগের ঘটনা হতে চললো, যদি আমরা ফোনের সময় থেকে হিসাব করি! আচ্ছা! ও কি তোমাকে পছন্দ করতো মনে মনে? না হলে বিয়ের পরেই এরকম করলো কেনো?

অর্ক চমকে উঠলো,

পছন্দ করতো! তাই আবার হয় নাকি! হ্যাঁ, আমি তো সবার সঙ্গেই কথা বলি, ওর সঙ্গেও বলেছি! বার কয়েক মেট্রো স্টেশনে দেখা হয়েছে, এমনকি একটা নোটস এর জন্যে ফোন নম্বরও নিয়েছিলো আমার। নোটস নিয়ে যাবার জন্যে ফোনে রিমাইন্ডার ও দিয়েছে। কিন্তু এরকম তো বুঝিনি কিছু কখনো! এমনকি নোটস নিয়ে যেতে যখন ভুলে গিয়েছিলাম তখনও কিন্তু ও কিছু বলেনি আমাকে, তিয়াসাই বলেছিলো। তবে ও আমার সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখতো জানো তো! সেটা আমি এখন বুঝতে পারছি, যেদিন ওরা এখানে নোটস নিতে এলো, সেদিন রিয়া কফি করেছিলো। আমি চা খাবে কি না জিজ্ঞেস করায় আমাকে বলেছিলো, তুমি যেহেতু নেই তাই ওই করে নিচ্ছে। আমি তখন স্টাডিতে নোটস খুঁজতে ঢুকে গিয়েছিলাম। আমার একটু অবাকই লেগেছিলো তখন, যে ও কি করে জানলো তুমি এখানে নেই!

তুমি বলেছিলে না তোমার মোবাইল ওভেনের তলায় রাখা ছিলো? ওই কফি করতে গিয়ে রেখে আসেনি তো?

জানি না! এখন তো সবই সম্ভব মনে হচ্ছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি মোবাইলটা সোফায় রেখে উঠে গিয়েছিলাম, কিন্তু কি করে যে ওখানে গেলো! এটাও তো প্রমাণ করতে পারবো না কিছুতেই! রিয়া যেমন কফি করতে গিয়েছিলো তেমনি তিয়াসা আর শ্রেয়া বলে আর একটা মেয়েও কিন্তু রান্না ঘরে ঢুকেছিলো সেদিন! খুব হতাশ লাগছে, এতগুলো ঘটনা চোখের সামনে দেখেও কিছুই করতে পারলাম না!

আর কিছু না, একটাই কথা মনে হচ্ছে যে এতো কিছু করার পরেও যদি ও পার পেয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ওর সাহস আরো বেড়ে যাবে। আজ আমাদের সঙ্গে করলো, কাল আবার অন্য কারোর সঙ্গে করবে। দেখো, তুমি তো কিছুতেই বিশ্বাস করো নি আমার কথা, আমাকে চলে যেতেও বলেছিলে একদিন। আজ যদি আমিও চলেই যেতাম, আর যদি বলছি কেনো চলেই তো যাচ্ছিলাম, যদি না বাবা, মা হটাৎ চলে আসতেন, তাহলে আমাদের সম্পর্কটাই তো শেষ হয়ে যেতো ওর জন্যে! পৃথিবীতে কতো অদ্ভুত মানুষ আছে তাই না! যারা না নিজেরা ভালো থাকতে জানে, না অন্য দের ভালো থাকতে দেয়! কি লাভ হয় বলতো এতে! ও ও কি খুব ভালো আছে, এসব করে, কে জানে!

দীর্ঘশ্বাস ফেললো অদিতি, দুজনেই মনে মনে ছটফট করছিলো, কিন্তু কিছুই করার নেই। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হয়ে আসছে দেখে অদিতি উঠে পড়লো, ওর এখন অনেক কাজ আছে। অর্ক খাটে শুয়ে পরপর ঘটনাগুলো কে ভাবতে গিয়ে নিজেই অবাক হচ্ছিলো, এতদিন যে কেনো একটুও তলিয়ে ভাবে নি ও! মেয়েটা কি ইচ্ছে করেই দিতি র মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে সব সময়! অতো জায়গা থাকতে ওর পাশে বসেই এমন ভাবে কথা বলছিলো যে মনে হবে, ও ফোনে নয় সামনে বসে অর্কর সঙ্গেই কথা বলছে!

একটু পরেই অদিতি চা নিয়ে এলো, সমরেশ ঘর থেকে উঠে এলেন, সোফায় বসে চা খেতে খেতে আলোচনা চলছিলো, বিষয়বস্তু একটাই, রিয়া! সবারই আফসোস কিছু করা গেলো না! এই করতে করতে রাত দশটা বেজে গেলো, এর মধ্যে রান্নার দিদি এসে রান্না করে দিয়ে গেছে। রুমা থাকলে এসব বিষয়ে অদিতি খুব একটা মাথা ঘামায় না, তিনিই এদিকটা দেখাশোনা করেন। সাড়ে দশটা নাগাদ ছেলে কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসে ওরা একসঙ্গে খেতে বসলো, খাওয়া যখন প্রায় মাঝপথে এমন সময় অর্কর ফোন বাজলো, ফোন ধরতেই কৌশিকের উত্তেজিত গলা শোনা গেলো,

স্যার, রিয়া হাতের শিরা কেটে ফেলেছে, ওকে হসপিটালে ভর্তি করেছি স্যার!

কথাগুলো এতটাই জোরে ছিলো যে সবাই শুনতে পাচ্ছিলো, অর্ক এঁটো হাতেই উঠে দাঁড়ালো,

কেমন আছে এখন?

স্যার, এমার্জেন্সি তে ঢুকিয়েছি, এখনো কিছু জানায় নি ভেতর থেকে, আণ্টি আপনাকে ফোন করতে বললেন, আপনি কি আসবেন স্যার?

বলতে বলতেই পাশ থেকে রিয়ার মা ফোন টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন,

স্যার, আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি, পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই! আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না!

অর্কর খুব খারাপ লাগতে লাগলো, ওর সকালে কথা গুলো বলার জন্যেই কি মেয়েটা আত্মহত্যার চেষ্টা করলো! মেয়েটার কিছু হয়ে যাক, এরকম তো চায়নি ও কখনো! তাড়াতাড়ি বললো,

আপনি চিন্তা করবেন না, আসছি আমি।

টেবিলের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সবার মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট! ও তাড়াতাড়ি অরিন্দম কে ফোন করলো,

শোন রিয়া সুইসাইডের চেষ্টা করেছিলো, কৌশিক এই মাত্র ফোন করলো আমাকে! একটু যাবি আমার সঙ্গে?

কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে উবের বুক করলো অর্ক, যাওয়ার পথে অরিন্দম কে তুলে নিয়ে যখন হসপিটালে পৌঁছলো তখন রিয়া কে বেড়ে দিয়েছে। কৌশিক জানালো ডাক্তার বলেছেন ও বিপন্মুক্ত এখন। রিয়ার মা এক পাশে শুকনো মুখে বসেছিলেন, অর্ক আর অরিন্দম ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, ওদের দেখেই মুখ তুললেন ভদ্রমহিলা,

আজ শুধু কৌশিকের জন্যে আমার মেয়েটা বেঁচে গেলো স্যার! ও না এলে আমি জানতেও পারতাম না আমার মেয়ে এরকম করেছে! আমি টিউশন পড়াতে চলে গিয়েছিলাম, ওর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, কখন ও বাড়ি থেকে ফিরেছে আমি জানিই না!

অর্ক কৌশিকের দিকে তাকালো, কৌশিক মাথা নাড়লো, হাতের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

দেখুন স্যার!

একটা হোয়াটসঅ্যাপে করা মেসেজ, ” বলেছিলাম না তোকে, আমাকে কেউ ভালোবাসে না! বাবাও আজ ফিরিয়ে দিলো! ওই মহিলা বাবা কে কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে, আর মা ওকে সেই সুযোগটা করে দিয়েছে! ওরা কেউ আমার কথা ভাবে না, একমাত্র তুই কিছুটা হলেও বুঝিস আমাকে, তাই এগুলো তোকেই জানালাম। ভালো থাকিস, আর কোনোদিনও তোর সঙ্গে দেখা হবে না!”

অর্ক স্তম্ভিত হয়ে গেলো, অরিন্দম অবাক গলায় বললো,

তুমি এই মেসেজ দেখে এলে নাকি?

কৌশিক ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, স্যার আমি সন্ধ্যে বেলায় টিউশন করি, তাই মেসেজটা দেখিনি তখন! বাড়ি ফিরে দেখেই ওকে ফোন করেছিলাম, ধরলো না দেখে কেমন সন্দেহ হলো! তাই সরাসরি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম এবার অনির্বাণের কাছ থেকে অ্যাড্রেস নিয়ে, ও বোধহয় সকালে আপনাদের সঙ্গে গিয়েছিলো ওর বাড়ি। আণ্টি ছিলেন না তখন, বেল বাজাতে কেউ খুললো না, তখন ওপরের বাড়িওলার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আন্টিকে ফোন করেছিলাম। তারপর আণ্টি আসতে দরজা খুলে দেখি এই কান্ড! খুব জোর বেঁচে গিয়েছে স্যার, ডক্টর বললেন আর দেরি হলে বিপদ হতে পারতো!

চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৫+১৬

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৫+১৬
দিতি তার জেদে অনড় রইলো, সে এর শেষ দেখতে চায়! সমরেশও দিতিকেই সমর্থন করলেন, অর্ক বললো,

আমিও শেষ দেখতেই চাই, কিন্তু আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই! আমি পুলিশে অভিযোগ জানাতেও পারবো না! ঠিক আছে অরিন্দমের সঙ্গে কথা বলি একটু, দেখি ও কি সাজেশন দেয়!

অর্ক কলেজে বেরিয়ে গেলো, আসার সময় অরিন্দম কে সঙ্গে নিয়ে আসবে বলে ঠিক করলো। গত দুদিন ধরে দুজনের মধ্যে সেভাবে কথা হচ্ছিলো না আর, তা সত্বেও বেরিয়ে যাবার সময় অদিতি সামনে এসে দাঁড়ালো। ওকে দেখে একটু হলেও মনে মনে খুশি হলো অর্ক, গুমোট পরিস্থিতিটা একটু একটু কাটছিলো।

ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার পরে রুমা এবং সমরেশ দিতির মুখোমুখি হলেন, অদিতি কে সোফায় বসিয়ে সমরেশ বললেন,

তুই তো যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, আমি জানি তুই সব বুঝিস। তোদের দুজনের মধ্যেই যদি গন্ডগোল জিইয়ে রাখিস, তাহলে বাইরের লোক তো সুযোগ নেবেই, তাই না! আমার ছেলে কে আমি খুব ভালো করে চিনি, শুধু মাত্র জীবনটা কে সিরিয়াসলি না নিয়ে কলেজ ছাত্রদের মতো কাটিয়ে দেওয়ার জন্যেই এই সব অশান্তি! ওকে যে যা বোঝায় ও তাই বোঝে! ওর এখনো সাবালকত্ব আসেনি। ও কে অরিন্দম বললো বলে ও চুপ করে গেলো, একবারও ভাবলো না যে ওর চুপ করে থাকা আসলে আমাদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছবে!

আসলে ও অতো ভেবে কোনো কাজ করে না, ছোটো থেকেই এরকমই!

রুমা কে কড়া গলায় ধমকে থামিয়ে দিলেন সমরেশ,

চুপ করো! তুমি আর তোমার অপগণ্ড ছেলেকে সাপোর্ট করো না! একটা চাকরি করা ছেলে, সে ছোটো বেলায় যা ছিলো এখনও তাই থাকবে? নিজে বাবা হয়ে গেছে সে, এখনও যদি দায়িত্ব বোধ না আসে তবে আর কবে আসবে?

রুমা চুপ করে গেলেন, দিতি র দিকে তাকিয়ে সমরেশ বললেন,

তোকেও একটা কথা বলতে চাই। নিজের ওপর কনফিডেন্স রাখ, কেউ তোকে কিছু বললেই তুই বিশ্বাস করবি কেনো? আর তোকে আমি বাবা হয়েও বলছি, যদি মনের মধ্যে একফোঁটা সন্দেহও থাকে তোর, তাহলে এইভাবে একসঙ্গে না থাকাই ভালো। সারাজীবন তুই সন্দেহ নিয়ে বাঁচতে পারবি না, বাইরের কেউ লাগবে না, তোর সন্দেহই তোদের সম্পর্ক শেষ করে দেবে।

রুমা পাশ থেকে অবাক গলায় বললেন,

কি বলছো তুমি! কোথায় মিটমাট করার চেষ্টা করবে তা না করে উল্টে একসঙ্গে না থাকার পরামর্শ দিচ্ছ!

হ্যাঁ, দিচ্ছি! কারণ আমি মনে করি সম্পর্কে বিশ্বাস না থাকলে সেই সম্পর্ক কোনোদিনও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! কাল ওদের দুজনের কথা শুনে মনে হয়েছে ওরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, দুজনেরই দুজনের সম্পর্কে অভিযোগের পাহাড় জমে আছে! আর কাল আমি অর্কর সামনে বলিনি, কিন্তু আমারও মনে হয়েছে যে দিতি র অহেতুক ছোটো খাটো ব্যাপারে বেশি রিয়েক্ট করার জন্যেই হয়ত সত্যিই ওকে মিথ্যে বলতে হয়। ও যে ফোন খুঁজে পাচ্ছিলো না, এই সাধারণ কথাটাও যদি দিতি বিশ্বাস না করে, তাহলে তো ও কিছু এক্সকিউজ খাড়া করবেই বাধ্য হয়েই! এই সমস্যার সমাধান হয়ত হবে, কিন্তু আবার কোনো নতুন কিছু আসবে, তখন কি হবে?

বিশ্বাস করো বাবা, আমি ওকে আগে কোনোদিনও সন্দেহ করিনি, এগুলো ওর ভুল ধারণা! ও ভাবে ফোন বন্ধ রাখলে, বা খুঁজে পাচ্ছে না বললে আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়! আমার আসলে প্রচণ্ড টেনশন হয়, মনে হয় ওর কোনো বিপদ হয়েছে। কিন্তু তারপর যখন ও বাড়ি এসে বলে ও ভুলে গিয়েছিলো অন করতে, বা খুঁজে পাচ্ছিলো না তখন ঐ ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ টা দেখলেই আমার টেনশনটাই রাগে চেঞ্জ হয়ে যায়,
আর আমি রিয়েক্ট করে ফেলি,

হতাশ গলায় বললো অদিতি, সমরেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন, তারপর ধীর গলায় বললেন,

যার নয়ে হয়নি, তার নব্বইয়েও হবে না এটা তোকে ধরে নিতে হবে। এই ঘটনার পরেও ওর কিছু বদল হবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। যদি হতো, তাহলে সবটা জানার পরে অশান্তির ভয়ে সেটাকে লুকিয়ে না রেখে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতো। কাল তুই চলে যেতে চেয়েছিলি, কিন্তু গিয়েও ভালো থাকবি কি? যার ফোন বন্ধ থাকলে টেনশন করিস, তার সঙ্গে সারাজীবনের মতো যোগাযোগ বন্ধ করে থাকতে পারবি তো?

অদিতি দু হাতে মুখ চাপা দিলো, কান্না ভেজা গলায় বললো,

ও ও সেটা জানে বাবা! তাই তো আমার সঙ্গে বারবার এরকম করে। ও বারবার ফোন বন্ধ রাখবে, হারিয়ে ফেলবে, আমি বাড়িতে এলে চিৎকার করবো, ও মিথ্যে কথা কিছু বানিয়ে বলবে, অশান্তি হবে, আমি চলে যাবার হুমকি দেবো, কিন্তু কোথাও যেতে পারবো না! আর তারপরেই ও চার বার করে সরি বলবে, আর আমাকে ম্যানেজ করে ফেলবে!

রুমা পিঠে হাত রাখলেন,

কাঁদিস না, এরই নাম সংসার বুঝলি তো! ছেড়ে যেতে চাইলেই কি আর যেতে পারি আমরা! হ্যাঁ, যেখানে ভালোবাসা থাকেনা, সেখানে কিছুতেই থাকা যায়না এটা ঠিক, কিন্তু তোর তো আর তা নয়! অর্ক তোকে যে ভালোবাসে খুব, এটা তুইও জানিস, তাই তো হাজার রাগ অভিমানের পরেও আবার থেকে যাস, তাই না? ওর শুধু একটাই দোষ, বড্ড ক্যাজুয়াল ও, সেটুকু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বাড়লেই আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে দেখিস!

সারা কলেজে রিয়াকেই খুঁজতে খুঁজতে ঢুকলো অর্ক, আজও আসেনি মেয়েটা! টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে মুচকি হাসলো অরিন্দম,

কি? স্পেশাল ছাত্রী কে খুঁজছিস নাকি!

অর্ক বিরক্ত হলো,

ইয়ার্কি মারিস না ভাই, তোর জন্যেই ফাঁসলাম আমি! তোর কথা শুনে ওই মেয়েটার কথা কাল চেপে যেতে গিয়েই কাল হলো, বাড়িতে পুরো একঘরে হয়ে গেছি! বিরাট চাপে আছি, দিতি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো কাল!

এবার অরিন্দম সিরিয়াস হলো,

বলিস কি! অদিতি চলে যাচ্ছিলো! না, আমি আসলে ভেবেছিলাম, আর কদিন পরেই তো ওরা চলে যাবে, তাই অহেতুক জটিলতা বাড়াতে চাই নি। এমনিতেই তো সমর দা যা ছড়িয়ে রেখেছে!

অর্ক অন্যমনস্ক হলো,

আচ্ছা, সমর দা বলেছিলেন না উনি টিউশনের স্টুডেন্টদের কাছ থেকে শুনেছেন!! কাল তিয়াসা মেয়েটা আমাকে বললো রিয়া ওদের বলেছে, দিতি খুব সন্দেহবাতিক, তাই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে!!

আচ্ছা, শান্তিনিকেতনে ওদের গ্রুপের কেউ ছিলো?

অরিন্দম একটু চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, অর্ক উত্তেজিত হলো,

কেউ ছিলো মানে! পুরো গ্রুপটাই তো ছিলো! দিতি ইনফ্যাক্ট আমাকে রিয়ার নামও বলেছিলো, আমিই ওকে তিয়াসা বলে শুধরে দিয়েছিলাম!! আমি শালা সত্যি বোকা রে, আমার একবারও এটা মাথায় আসেনি কেনো তখন! দিতি রিয়া নামটা কিভাবে জানলো এটা একটুও মনে হয়নি আমার!!

আর এক্সকার্সনে তো ছিলো নিশ্চয়ই?

আমার পাশেই তো বসে ছিলো! আমি এটা ভেবেই দেখিনি, যে দিতির সঙ্গে ফোনে আমার রাগারাগি হচ্ছে, এটা হোটেলের রুম থেকে আমাকে দেখতে পেলেও কথা শুনতে কেউ পাবে কিভাবে, যদি না সে আমার পাশেই বসে থাকে! নিজের বোকামির জন্যে নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে এখন!!

শুধু তুই? আমি আর অদিতি? আমাদেরও তো কারোর মাথায় আসেনি যে অতদূর থেকে কথা শোনা কি করে সম্ভব!!

হতাশ গলায় বললো অরিন্দম, কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো অর্ক,

নাহ! দিতি ঠিকই বলেছে, আমি না সত্যি খুব ক্যাজুয়াল! নিজের ওপরেই বিরক্ত লাগছে এখন! শুধু আমার ব্যাপারটা কে সিরিয়াসলি না নেবার জন্যেই মেয়েটা এতটা সাহস পেলো! চল, মেয়েটা কে ধরতে হবে এবার, ব্যাপারটা সত্যি আর সাধারণ নেই! আর তুই একটু বাড়িতে চল আমার সঙ্গে, বাবাও তোকে ডেকেছে, হেল্প লাগবে তোর।

দুজনে এগিয়ে গিয়ে মাঠের কোনায় বসে থাকা গ্রুপটার সামনে পৌঁছালো, আজ ওখানে কোনো মেয়ে নেই। ওদের দেখেই সবাই তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো, দু একজন হাতের সিগারেট লুকিয়ে ছুঁড়ে ফেললো, অনির্বাণ এগিয়ে এলো,

স্যার, কিছু বলবেন?

রিয়া কোথায়? আসেনি আজকে? আমার কাছ থেকে সেদিন ভুল করে একটা নোটস এর খাতা নিয়ে চলে গেছে মনে হয়, কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!

সটান মিথ্যে বলে দিলো অর্ক, অনির্বাণ ঘাড় নাড়লো,

আসেনি স্যার! মেয়েরা কেউই আসে নি আজ! নেক্সট উইকেই এক্সাম তো! ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি,

অনির্বাণ কে পকেট থেকে মোবাইল বার করতে দেখেই তাড়াতাড়ি অরিন্দম এগিয়ে এলো,

ছাড়ো, পরীক্ষার সময় আর ফোন করে ডিস্টার্ব করতে হবে না! ও থাকে কোথায়? কাছে হলে গিয়েই নিয়ে নিতাম না হয়,

সামান্য নোটস এর জন্যে রিয়ার বাড়ি যাবে স্যারেরা এটা বোধহয় ওদের কারোরই বিশ্বাস হলো না, অনির্বাণ একটু অবাক গলায় বললো,

ভবানীপুরে থাকে স্যার, কিন্তু আমি ওর বাড়ি চিনি না। কৌশিক ওর সঙ্গে মেট্রো থেকে নামে, ও চেনে স্যার,

পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কৌশিকের দিকে আঙুল দেখলো অনির্বাণ, কৌশিক এগিয়ে এলো,

জায়গাটা চিনি স্যার, জগুবাজারের কাছে, কিন্তু বাড়িতে কোনোদিনও যাই নি আমি, তাই ঠিক কোন বাড়িটা সেটা জানি না। তবে ওদের তিনতলা বাড়ি, সামনের গেটে সি সি টি ভি লাগানো আছে, এটা জানি,

অর্ক হতাশার হাসি হাসলো,

বাবার নামটা কি? সেটা জানো?

কৌশিক মাথা নাড়লো, অনির্বাণ পাশ থেকে বলে উঠলো,

স্যার, ফোন করে দেখি বরং, যদি ওর কাছে নাই থাকে, তাহলে মিছিমিছি অতো খোঁজাখুঁজি করে বাড়ি গিয়ে লাভ কি?

অর্ক আর কিছু বলার আগেই অনির্বাণ রিয়া কে ফোন করে ফেললো, কথা বলে জানালো ওর কাছে কোনো খাতা নেই!

অরিন্দম ঘাড় নাড়লো, অর্কর দিকে তাকিয়ে বললো,

আর দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে!!নিজের বাড়িতে ভালো করে খোঁজ আগে, বাড়িতেই আছে নিশ্চয়ই! চল এগোই!

ছাত্রদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা টিচার্স রুমে ফিরে এলো, এই মুহূর্তে আর কিছু করার ছিলো না, দুজনেরই ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছিলো, তাই আপাতত এই প্রসঙ্গ চাপা পড়লো। প্রায় বেলা দুটোর সময় অর্কর ক্লাস শেষ হলো, টিচার্স রুমে ঢুকে দেখলো অরিন্দম ওর জন্যেই বসে আছে। অর্ক অরিন্দম কে দেখেই বললো,

তোর ক্লাস শেষ হয়ে গেছে? চল, রিয়ার বাড়িটা ঘুরেই যাই তাহলে একবার, বেশিক্ষন লাগবে না। কৌশিকের কথা শুনে তো কাছেই মনে হলো,

অর্কর কথায় অরিন্দম একটু চিন্তিত মুখে তাকালো,

গিয়ে কিছু লাভ হবে? শুধু তিনতলা বাড়ি, আর সি সি টি ভি, এটা কোনো বাড়ির অ্যাড্রেস হলো? কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো নাকি! বাবার নামটা পর্যন্ত জানি না! কি অদ্ভুত মেয়েরে! তিন বছরে কোনো বন্ধু কে বাড়ির ঠিক মতো একটা অ্যাড্রেসও দেয় নি!

হ্যাঁ, আজ সারাদিন এটাই ভেবেছি জানিস! মেয়েটার যেনো সব কিছুই অদ্ভুত! এতো জায়গা থাকতে আমার পাশে বসেই ও এতো জোরে ফোনে কথা বলছিলো, যে দিতি বিরক্ত হয়েছিলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে ছিলাম, তখন আশেপাশে কেউ ছিলো না। মেয়েটা ওইটুকু সময়ের মধ্যেই যে কখন আমার পাশে এসে বসেছে, আমি খেয়ালই করিনি!

তোর বাড়িতে কতো বার এসেছে?

কতো বার কোথায়? আগে একবার এসেছিলো, আর এবার টানা তিনদিন, সব মিলিয়ে চার বার!! অথচ দ্যাখ, দিতি কে কিরকম গল্প দিয়ে ফেলেছে, ও নাকি আমাকে অনেকবার কফি বানিয়ে খাইয়েছে! কি ভীষণ মিথ্যেবাদী রে!

কিন্তু কেনো বলতো?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না! চল ওর বাড়িতে গিয়েই দেখা যাক! ও হ্যাঁ, যেটা বলতে গিয়ে অন্য কথায় চলে গেলাম, আমার না কিরকম একটা স্ট্রাইক করছিলো! মেয়েটা বোধহয় ইচ্ছে করেই কাউকে ঠিক অ্যাড্রেস দেয়নি, ও চায় না যে ওর বাড়িতে কেউ যাক! তাই সুভাষ দা কে রিকোয়েস্ট করে মেয়েটার অ্যাড্রেস টা বার করিয়েছি, কাউকে বলিস না যে সুভাষ দা বার করে দিয়েছে।

একটু নিচু গলায় বললো অর্ক, অরিন্দম অবাক হলো,

সুভাষ দার কাছ থেকে পেলি! যাক এই একটা কাজের কাজ করেছিস! হ্যাঁ, এটা একদমই মাথায় আসেনি আমার! কলেজের খাতায় তো অবশ্যই অ্যাড্রেস থাকবেই! চল তাহলে, বেরিয়ে পড়ি!

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মেট্রোর উদ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়লো, রাস্তায় যেতে যেতেই বাড়িতে ফোন করে দিলো দুজনেই, ফিরতে দেরি হবে জানালো। সমরেশ পাশেই বসে ছিলেন, দিতির কথা সবটাই শুনতে পাচ্ছিলেন, ফোন রাখার পর বললেন,

যাক! তাও ভালো! কিছুটা হলেও যে সিরিয়াস হয়েছে সেটা দেখেও ভালো লাগলো! দেখি কি হয় এবার!

দিতি ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, বাবা যা বলেছো!! ও যে দেরিতে হলেও কিছু উদ্যম নিয়েছে সেটাই বিরাট ব্যাপার! আর দেখলে, তোমরা ছিলে বলে মনে করে দেরি হবে জানালো, আমি একা থাকলে পরে বাড়ি ফিরে ভুলে গেছি বলে দিতো!

রুমা পাশ থেকে হাত তুললেন, হেসে বললেন,

হ্যাঁ, থাক থাক! আর দুজনে মিলে আমার ছেলেটার নিন্দে করতে বসিস না!

মেট্রো থেকে নেমে কৌশিকের কথা মতো জগু বাজারে পৌঁছে গেলো দুজনে, আশেপাশের বেশ কয়েকটা দোকানে জিজ্ঞেস করেও কোনো সুরাহা হলো না।

যতো টা সোজা মনে হয়েছিলো, ততো টা সোজা নয় রে! তিনতলা বাড়ি মানে মোটামুটি চওড়া রাস্তায় হবে বলেই তো ভেবেছিলাম!

খানিকটা হতাশ গলায় বললো অর্ক, অরিন্দমও হতাশ হয়ে পড়েছিলো,

কি করা যায় বলতো?

পি জি খুঁজছেন নাকি দাদা? লাগলে বলতে পারেন, মেট্রোর আশেপাশেই আছে,

দুজনকে প্রায় মাঝ রাস্তায় হতাশ মুখে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বোধহয় ছেলেটা এগিয়ে এলো, অর্ক তাড়াতাড়ি পার্স থেকে চিরকুট টা বার করলো,

না, ভাই, পি জি নয়, এই ঠিকানাটা খুঁজছি! একটু হেল্প করো না!

হাত বাড়িয়ে ঠিকানাটা নিয়ে চোখ বুলিয়েই ফেরত দিলো ছেলেটা,

কিনবেন নাকি? এটুকু বলতে পারি ভাড়াটে ওঠাতে পারবেন না!

অর্ক কিছু বলার আগেই অরিন্দম এগিয়ে এলো,

আরে না না! কিনবো না, বাড়িটা খুঁজছি, মালিকের সঙ্গে দরকার ছিলো একটু। তুমি তো চেনো মনে হচ্ছে বাড়িটা,

ছেলেটা ঘাড় নাড়লো, তাচ্ছিল্যের গলায় বললো,

আরে হ্যাঁ, কে না চেনে! এই বাড়ির মালিকের কাছে তো লোকে একটা কারণেই আসে! অহেতুক মিথ্যে কেনো বলছেন দাদা, গত তিন চার বছর ধরেই তো পেপারে বিজ্ঞাপন দেয়, কতো লোক এলো গেলো! আপনারাও এসেছেন, তাতে কি হয়েছে! কিনতে তো পারবেন না কিছুতেই! নিচের তলায় দুটো, দোতলায় একটা, মোট তিনটে ভাড়াটে, মালিক তিনতলায় থাকে! ওই ভাড়াটে তুলতে জান কয়লা হয়ে যাবে দেখবেন, রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া জমা দেয় সবকটা! ওই সামনে বাঁদিকের গলিতে ঢুকেই চার নম্বর বাড়ি, মালিক মোটামুটি তিনতলার বারান্দায় বসেই থাকে সব সময়, যান ঘুরে আসুন একবার না হয়!

আর কথা বাড়ালো না দুজনেই, ঠিকানা যখন পাওয়া হয়েই গেছে, তখন আর মিছিমিছি নিজেদের সত্যি প্রমাণের দরকার কি! ছেলেটা নাহয় ওদের খদ্দেরই ভাবলো। ছেলেটা চলে যাবার পরে অর্ক মুখ খুললো,

যে বাড়িতে সি সি টি ভি বসানো থাকে, তার তলায় ভাড়াটে! চল দেখি মালিকের মেয়ে কি বলেন!

অরিন্দম হাসলো,

মালিকের মেয়ে! ভালো বলেছিস! মালিক যে কতো বড়লোক সেটা মনে হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে!

না! পয়সা আছে তো নিশ্চয়ই, না হলে সি সি টি ভি থাকতো না! হয়ত এককালে ভাড়া দিয়েছিলো, এখন আর ওঠাতে পারছে না বলে বিক্রির চেষ্টা করছে!

গলির মুখটা থেকে বাঁদিকে ঘুরতেই নম্বর মিলিয়ে তিনতলা, হলুদ রঙের বাড়িটা দেখতে পেলো ওরা। বাড়িটা যথেষ্টই পুরনো, খড়খড়ি দেওয়া জানলার সবুজ রংগুলো প্রায় হালকা হয়ে এসেছে, বেশ অনেক আগে শেষ রং হয়েছিলো বলে মনে হয়। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক সত্যিই তিনতলার ঘর লাগোয়া ছাদহীন বারান্দাতে একটা লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। বাড়ির তলায় দাঁড়িয়ে অর্ক ওপরের দিকে তাকালো,

আপনি কি সুবোধ বাবু?

ভদ্রলোক নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, ঘাড় নাড়লেন,

না, আমি রমেন মিত্র, সুবোধ নামে এখানে কেউ থাকে না!

বাড়ির নম্বরটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো এতক্ষনে, অর্ক নম্বর বলে জিজ্ঞেস করলো,

এটাই বাড়ির নম্বর তো?

ভদ্রলোক সম্মতি জানালেন,

হ্যাঁ নম্বর এটাই! তবে সুবোধ নামে কেউ নেই!

এবার অরিন্দম এগিয়ে এলো,

আমরা রিয়া নামে কলেজে পড়ে এমন একটা মেয়েকে খুঁজছি, মানে ভালো নাম রিয়া, ডাক নামটা ঠিক জানি না।

আচ্ছা! বুঝলাম! নিচের বাঁদিকের বেলটা টিপে দেখুন একবার!

বাঁদিকের বেলটা বাজার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেলো, ভেতর থেকে একজন মধ্য বয়স্ক বিবাহিতা মহিলা বেরিয়ে এলেন, অর্ক হাত তুললো,

নমস্কার, আমরা রিয়া নামে একজন কে খুঁজছি,

ভদ্রমহিলা একটু অবাক চোখে তাকালেন,

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, কিন্তু ও তো বাড়িতে নেই, বেরিয়েছে, ফিরতে দেরি হবে, কিছু বলার ছিলো?

অর্ক মাথা হেলালো,

হ্যাঁ, আমি অর্ক মিত্র, ও আসলে আমাদের কলেজেরই ছাত্রী, গত পরশু আমার কাছে বাড়িতে ক্লাস করতে গিয়ে ভুল করে আমার একটা খাতা নিয়ে এসেছে। ওটা খুব জরুরি, ওদের তো আর কলেজ নেই, তাই ভাবলাম বাড়িতে এসেই একটু নিয়ে যাই!

ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন,

সরি, সরি, আমি একদম বুঝতে পারিনি! আপনার নাম আমি শুনেছি, ভেতরে আসুন না স্যার, আমি ওকে ফোন করে কোথায় খাতা আছে জেনে নিচ্ছি,

জুতো খুলে ভেতরে ঢুকে এলো দুজনে, ভদ্রমহিলা হাত দেখালেন,

বসুন স্যার, চা করি একটু,

ছোট্ট একটা ঘেরা বারান্দায়, ছোটো দুটো কাঠের সোফা, বসেই দুজনে দৃষ্টি বিনিময় করলো,

বড়লোক!

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৬
অরিন্দম কে নিয়ে অর্ক যখন বাড়ি ঢুকলো, তখন দুজনেরই মুখ থমথমে, অদিতি, সমরেশ আর রুমা তিনজনেই অধীর আগ্রহে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন, ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেখে বেল দেওয়ার আগেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন।

একটা চূড়ান্ত মিথ্যেবাদী মেয়ে মেসোমশাই, বাড়িতে না গেলে জানতেই পারতাম না!

দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই হতাশ গলায় কথাগুলো বলেই সোফায় ধপ করে বসে পড়লো অরিন্দম, পাশে অর্কও।

হ্যাঁরে, বাড়িতে কে কে আছে? দেখা হলো মেয়েটার সঙ্গে?

রুমার একের পর এক ধেয়ে আসা প্রশ্নে বিরক্ত হলেন সমরেশ,

আহ! সব কিছুতেই তাড়াহুড়ো! দাঁড়াও আগে, শান্তি মতো বসতে দাও একটু!

দিতি ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল বার করে নিয়ে এসে দুজনের সামনে গ্লাসে রাখলো, এক চুমুকে গ্লাস খালি করে টেবিলে রেখে শ্বাস ফেললো অরিন্দম,

আহ! অদিতি এটাই এই সময় দরকার ছিলো, মাথা গরম হয়ে আছে একদম!

অর্ক কে কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে থাকতে দেখে রুমা অবাক হলেন, অধৈর্য্য হয়ে বললেন,

তোর আবার কি হলো? কথাগুলো বল না একটু! আর কতো ধৈর্য্য ধরে থাকবো!

ও আর কি বলবে মাসীমা, ও তো বমকে গেছে একদম! কোথায় সিসিটিভি লাগানো তিনতলা বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলতে গেলাম, আর ফিরলাম দেড় কামরার ভাড়াটের সাথে কথা বলে!

মানে! ও কি তিনতলা বাড়িতে থাকে বলেছিলো?

রুমার কণ্ঠে বিস্ময়, দিতি একটাও কথা বলছিলো না, অর্কর মুখ দেখে মনে মনে খুশি হচ্ছিলো ও, বুঝুক ও এবার!

এতক্ষনে অর্ক মুখ খুললো,

হ্যাঁ, ওর বন্ধুরা অন্তত তাই জানে! ওদের কথামতই সিসিটিভি লাগানো তিনতলা বাড়ি খুঁজতে জগু বাজারে গিয়েছিলাম আমরা, কিন্তু গিয়ে দেখলাম ওরা ওই বাড়ির একতলায় দুটো ঘর নিয়ে ভাড়া থাকে। অবশ্য দুটোও ঠিক বলা যায় না, কারণ যেখানে আমরা বসেছিলাম সেটা ঠিক ঘর নয়, বারান্দাটা কেই ঘিরে নেওয়া বলতে পারো।

বন্ধুদের মধ্যে কেও কি আজ পর্যন্ত ওর বাড়িতে যায় নি?

জানতে চাইলেন সমরেশ, অর্ক ঘাড় নাড়লো,

না, বাবা যদ্দূর মনে হচ্ছে কেউই যায় নি!! যদিও সবার সঙ্গে তো কথা বলিনি আমরা, তবু ওদের গ্রুপের যে কজন ছিলো আজ কলেজে তারা কেউ যায় নি। তারা অবশ্য সবাই ছেলে, মেয়েরা আজ কেউ আসে নি, ওদের মধ্যে কেউ গিয়েছে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না!

এতক্ষন চুপ করে থাকার পরে অদিতি মুখ খুললো,

তিয়াসা কে জিজ্ঞেস করো না একবার, ও তো ওই গ্রুপেরই,

আজ অদিতির কথায় আপত্তি জানালো না অর্ক, সঙ্গে সঙ্গেই ফোন তুলে তিয়াসা কে ডায়াল করলো,

সরি তিয়াসা, পরীক্ষার সময় বিরক্ত করছি একটু!

উল্টো দিকে তিয়াসার গলা শোনা গেলো,

না, না, স্যার, বলুন না, বিরক্ত করার কিছু নেই,

রিয়ার বাড়িতে গিয়েছ কখনো?

না, স্যার! আমি যাই নি কখনো, আমার সঙ্গে ওর খুব বেশি বন্ধুত্ব নেই! তবে কৌশিক গেছে স্যার, ও ওর বাড়ি চেনে, একসঙ্গেই মেট্রো থেকে নামে ওরা।

কৌশিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে আগে, ও বাড়ি পর্যন্ত যায় নি কখনো,

এবার একটু অবাক হলো তিয়াসা, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

কৌশিক যায় নি! ও বললো আপনাকে একথা! আমার মনে হয় ও বলছে না সবটা, ও গেছে স্যার, আমরা সবাই জানি!

অর্ক একটু চমকে উঠলো, কৌশিক মিথ্যে কথা বলেছে! কিন্তু ওখানে তো সবাই ছিলো, কেউ তো কিছু বললো না! ওর চুপ করে থাকায় তিয়াসা কিছু ভাবলো, তারপর বললো,

স্যার আপনি এখন বাড়িতে থাকবেন তো? আমি অনির্বাণ কে নিয়ে আসছি তাহলে,

দুদিন পরে পরীক্ষা, এখন এলে তোমার অসুবিধা হবে না তো?

একটু কুণ্ঠিত গলায় বললো অর্ক, তিয়াসা তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো,

না স্যার, আমি পড়ছিলাম না, অনির্বাণের বাড়িতেই আছি, ওকে নিয়ে আসছি ঘন্টাখানেকের মধ্যে।

অরিন্দম এর দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, কলেজ থেকে সোজা এখানেই এসেছে ও, তাই অর্ক ওকে বেরিয়ে যেতে বললো,

তুই চলে যা, সোমা একা আছে। আমি তোকে আপডেট দিয়ে দেবো রাতে,

অরিন্দম বেরিয়ে যাওয়ার পরে ঘন্টাখানেকও লাগলো না, অনির্বাণ কে নিয়ে তিয়াসা পৌঁছে গেলো, দুজনেরই চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া।

স্যার, কিছু হয়েছে কি? আজ সকাল থেকেই আপনি রিয়ার বাড়ি খুঁজছেন,

সোফায় বসতে বসতে বললো অনির্বাণ, তিয়াসা চুপ করে আছে দেখে অর্ক বুঝলো ও অনির্বাণ কে কিছু জানায় নি। মনে মনে খুশি হলো অর্ক, যাক মেয়েটার কথার দাম আছে। অর্ক কে ওর দিকে তাকাতে দেখে তিয়াসা নিচু গলায় বললো,

স্যার, আমি কিছু বলিনি ওকে, শুধু বলেছি আপনি রিয়ার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না তাই ডেকেছেন আমাদের। তবে আপনি ওর সামনে নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেন, ও জানলেও কাউকে বলবে না স্যার।

অর্ক মাথা নাড়লো, অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বললো,

রিয়ার বাড়ি আমি খুঁজে পেয়েছি অনির্বাণ, কিন্তু আমি জানতে চাই তোমাদের মধ্যে কে কে ওখানে গিয়েছ?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

কেউ না স্যার! সকালে আপনারা চলে যাওয়ার পরে আমরাও এটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম আজ! আমাদের সবার ধারণা ছিলো কৌশিক গিয়েছে কিন্তু ও ও আজ বললো যে ও যায় নি কখনো!

ও বললো, আর তোরা বিশ্বাস করে নিলি? আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর ও গিয়েছে অনেকবার! স্যার, আপনার সামনে একটা কথা বলতে একটু অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু এটা না বললে আপনি সবটা ঠিক বুঝতে পারবেন না, তাই আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি। কৌশিকের সঙ্গে রিয়ার একটা রিলেশন আছে স্যার, তাই ও যদি বলে ও কখনো যায় নি, এটা মিথ্যে বলছে ও!

এবার একটু চমকেই গেলো অদিতি, কৌশিকের সঙ্গে রিলেশন আছে! তাহলে অর্কর সম্বন্ধে এইসব কথা বলছিলো কেনো! অদিতির ভাবনার মধ্যেই অনির্বাণ বলে উঠলো,

না, না, এটা বোধহয় আমাদের ভুল ধারণা ছিলো, ওই যে তুই বলিস না মাঝে মাঝে, যে এটা একতরফা, রিয়া ওকে পাত্তাই দেয় না, ওটাই ঠিক আসলে!

তোকে কে বললো? কৌশিক?

একটু অবাক হয়ে বলল তিয়াসা, অনির্বাণ ঘাড় হেলাল,

হ্যাঁ। ও নিজেই বললো আজ এগুলো, ওকে রিয়া বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায় নি কখনো!

ওকেও ডাকি স্যার? ওর কাছে অনেক বেশি খবর আছে, রিয়ার ব্যাপারে। যদি সত্যি কোনো রিলেশন নাই থাকে, তাহলে সবটা খুলেই বলবে নিশ্চয়ই!

তিয়াসার কথার উত্তরে অর্ক সম্মতি দেবার আগেই অনির্বাণ অবাক হলো,

কি খবর দেবে? কি হয়েছে বলতো আসলে? স্যার বলেছিলেন ও একটা খাতা নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার জন্যে তো এতো কিছু হবার নয়!

তিয়াসা অর্কর দিকে তাকালো, তারপর আস্তে করে বললো,

শেষ যেদিন আমরা পড়তে এলাম, সেদিন আমার সামনে ও ম্যাম কে অনেক মিথ্যে কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছিলো! আমি শুনেছিলাম সেগুলো, স্যার কেও জানিয়েছিলাম, তাই স্যার ওর সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নিচ্ছেন।

অদিতির সঙ্গে চোখাচোখি হলো অর্কর, ওর আর দিতির অশান্তির কথাটা যে তিয়াসা অনির্বাণ কে বললো না, সেটা দেখে খুশি হলো দুজনেই।

কি বলেছিলো ম্যাম কে?

কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো অনির্বাণ, তিয়াসা মাথা নাড়লো,

ওই! সেরকম কিছু না! বলছিলো ও অনেকবার এখানে এসে কফি করেছে আগে! ও তো মিথ্যে বলেই, সেতো তুইও জানিস, মনে নেই, বোলপুর স্টেশনে ম্যাম কে কিরকম মিথ্যে বলেছিলো গয়না পছন্দ করা নিয়ে?

অদিতি অবাক হলো একটু, এরাও তাহলে গয়নার কথাটা নিয়ে আলোচনা করেছে আগে! অর্ক একটু লজ্জিত দৃষ্টিতে অদিতির দিকে তাকালো, নিজের ভুলের জন্যে নিজেরই লজ্জা লাগছে এখন! অনির্বাণ হেসে ফেললো হটাৎ,

স্যার, তিয়াসা ওটা ভুলতে পারছে না কিছুতেই! আসলে ওর ক্রেডিট টা রিয়া নিয়ে নিয়েছে তো! সেদিন ট্রেনেই রিয়ার সঙ্গে মোকাবিলা করতে চাইছিলো, নেহাত আমি ঠেকিয়ে দিলাম!

তিয়াসা লজ্জায় পড়লো, অর্কর দিকে তাকিয়ে বললো,

না, না, স্যার, অনির্বানটা ওই রকমই! শুধু আমাকে ফলস পজিশনে ফেলে! স্যার, বলুন তো, আমি হাটে আপনাকে চয়েস করতে হেল্প করেছিলাম না? রিয়া তো ওই দোকানে ছিলোই না!

অর্ক অদিতির দিকে তাকালো একবার, তারপর অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে হাসলো,

হ্যাঁ, তিয়াসা সত্যি হেল্প করেছিলো, আমি দিতি কে বলেছিলাম সেকথা। ইনফ্যাক্ট, ও আমাকে রিয়ার নাম বলছিলো, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ও তিয়াসার নামটা ভুলে গিয়ে রিয়া বলে ফেলেছে!

ওদের কথাবার্তা চলাকালীন রুমা ঢুকলেন,

তোমরা খেয়ে যেও কিন্তু, আমি রান্না বসিয়েছি,

দুজনের কেউই খুব বেশি আপত্তি করলো না, তিয়াসা মা কে ফোন করে জানিয়ে দিলো, অনির্বাণ ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবে জানালো। রাতে খেয়ে যাওয়ার কথা হয়ে যাওয়ায়, হাতে অনেকটাই সময় ছিলো, অনির্বাণ কৌশিক কে এখানে আসার জন্যে ফোন করে ফেললো। প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যেই কৌশিক এলো, ঢুকেই সবার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো,

কি হয়েছে স্যার? খাতা খুঁজে পান নি?

অর্ক মাথা নাড়লো,

না, না, সেসব কিছু নয়, তোমার একটু হেল্প চাই কৌশিক! সবাই বললো রিয়ার সঙ্গে তোমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে, তাই তোমাকে ডাকলাম।

রিয়ার সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের কথাটা কৌশিক অস্বীকার করলো না, একটু নিচু গলায় বললো,

ওই একটু স্যার, ও আসলে খুব লোনলি, আর সবার সঙ্গে সব কথা শেয়ার করতে পারে না। তাই আমার কাছে কিছু কিছু শেয়ার করে, ওর বাড়িতে খুব অশান্তির মধ্যে থাকে ও!

অশান্তির মধ্যে থাকে! কি রকম?

ওর মায়ের সঙ্গে বাবার কিছু সমস্যা আছে স্যার! তাছাড়া ওর মায়ের ওপরেও রিয়ার রাগ আছে, উনি বোধহয় ওর ঠাকুমা, পিসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ঠিক পছন্দ করেন না! তাই কলেজের পর ও অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যেতে চায়!

অর্কর প্রশ্নে একটু নিচু গলায় বললো কৌশিক, তিয়াসা অবাক হলো,

বাবা! তুই এতো কিছু জানিস! অথচ ওর বাড়িতে যাসনি বলছিস!

বিশ্বাস কর! কোনোদিনও যাই নি! আসলে ওর বাবা খুব কড়া, ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না। ওদের বাড়ির গেটে সি সি টি ভি লাগানো আছে, তাই ওর বাবা সব জেনে যাবে বলে ও আজ পর্যন্ত ওদের বাড়ির কাছাকাছিও যেতে দেয়নি আমাকে! আমি ওকে জগু বাজারের সামনে ছেড়ে এসেছি সব সময়।

অর্ক হাসলো, কৌশিকের জন্যে ওর খারাপ লাগছিলো, কৌশিকের দিকে সরাসরি তাকালো ও,

কৌশিক, ওদের বাড়ির গেটে কোনো সি সি টি ভি নেই, ওটা ওদের বাড়িও নয়! ওখানে ভাড়া থাকে ওরা, আর তোমার জানলে খারাপ লাগবে, ওর বাবা ওদের সঙ্গে থাকেন না! তাই তাঁর দেখে ফেলার বা জেনে যাবার কোনো প্রশ্নই নেই!

চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৩+১৪

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৩+১৪
অর্ক কাল থেকেই একটু গম্ভীর হয়ে আছে, আজ ওই ছেলে মেয়েগুলোই আবার আসবে, অদিতির ওপর ঠিক ভরসা রাখতে পারছে না ও। একে তো কিভাবে কে জানে দিতির সন্দেহ বাতিক হওয়া নিয়ে কলেজে অনেকদিন আগে থেকেই একটা রটনা ছড়িয়েই আছে, তার মধ্যে যদি আজ আবার সবার সামনে কিছু করে বসে ও, তাহলে আর কলেজে মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না ওর। কিন্তু ওরও তো কোনো উপায় নেই, ওদের সিলেবাস টা তো শেষ করাতেই হবে ওকে। পরীক্ষার আগে ওদের কোনো ভাবেই বিপদে ফেলতে পারবে না ও।

সকাল থেকেই নিজের মনের ভেতরের ওঠা ঝড় টাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দিতি, কোনো মতেই আজ নিজেকে ওই সন্দেহর জালে জড়াতে দেবে না ও। অর্কর সম্মান ওর হাতে এখন, ওকে কোনো ভাবেই স্টুডেন্টদের সামনে ছোটো হতে দেওয়া যাবে না।

খাটে বসে ছেলে কে আদর করতে করতে অর্ক ওর দিকেই তাকিয়ে আছে লক্ষ্য করছিলো দিতি। ওর খুব খারাপ লাগছিলো, অর্ক কি ওকে একটুও বিশ্বাস করছে না! কাল ও ওরকম বলে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু ওদের ঠোঁটের মুচকি হাসিটা ও কল্পনা করেছে, এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। কিন্তু ওকে কেউ বিশ্বাস করেনা এখন, এমন কি নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করেনা ও, তাই অর্ক যখন বললো ওটা ওর কল্পনা ও সেটা মেনে নেবার চেষ্টাই করলো তর্ক করে লাভ নেই! ওর কারোর কাছে কিছু প্রমাণ করার নেই, শুধু একটাই চেষ্টা ওর সঙ্গে অর্কর যেনো আর কোনো সমস্যা তৈরি না হয়।

অর্ক তো নিজেও যে সরে যাচ্ছিলো এটা স্বীকার করলো না, কিন্তু ও তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো ওটা, কিন্তু আর জটিলতা বাড়াতে চায়না ও। কিন্তু অর্কর ওর দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকা টা ওর খুব খারাপ লাগছে, সত্যিই নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে, এই অপমানটা ও কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না, নিজের কান্না লোকাতে ওখান থেকে উঠে গেলো দিতি।

আজ ছেলে কে ঘুম পাড়াতে এসেও কিছুতেই ওর নিজের ঘুম আসছে না আর, খাটে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে দিতি। ড্রইং রুম থেকে অর্কর পড়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে, বিকেল হয়ে এসেছে, চায়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আজ আর উঠলো না দিতি। ও যদি বেরিয়েই ওই রকম কিছু দেখে আবার! তার থেকে এই ভালো, অর্ক আগে উঠে এসে ডাকুক ওকে, তখন না হয় উঠবে ও।

উঠেছ ঘুম থেকে? চা করবে নাকি?

অর্কর গলার আওয়াজে উঠে বসলো ও,

হ্যাঁ করছি, যাও তুমি, আমি চা নিয়ে আসছি,

শান্ত মুখে কোনো দিকে আর না তাকিয়েই সোজা রান্না ঘরে ঢুকে গেলো দিতি। চা করে বেরিয়ে ওদের সামনে রাখতে গিয়ে দেখলো অর্ক আবার পড়াতে শুরু করেছে, এবার একটা আলাদা চেয়ারে একা বসে আছে ও। স্টুডেন্টরা সব সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ও কারো দিকে না তাকিয়েই চায়ের ট্রেটা রেখে ঘরে ঢুকে এলো।

অর্ক কে আলাদা চেয়ারে বসে থাকতে দেখে ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর, ইস নিশ্চয়ই কাল ওর ঐ রকম কথার জন্যেই অর্ক আজ আর কারোর সঙ্গে সোফায় বসে নি। নিজের কাছে নিজেই ছোটো হয়ে যাচ্ছিলো ও, বড্ড নোংরা মন হয়ে গেছে ওর!

প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এই সময় প্রতিদিনই একটা ব্রেক দেয় অর্ক, একসঙ্গে বেশিক্ষন টানা পড়ানো স্টুডেন্টরাও নিতে পারেনা। এই সময় আরেক বার চা করতে হবে, ছেলে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে, ওকে কোলে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো দিতি। দু তিনটে ছেলে নিচে নেমে গেলো, বোধহয় একটু ঘুরে আসবে, কয়েকজন অর্কর সঙ্গে স্টাডি তে ঢুকেছে, তিনটে মেয়ে সোফায় বসে নিজেদের মোবাইল দেখতে ব্যস্ত।

ওকে ছেলে কে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকতে দেখেই ওদের মধ্যে থেকে একটা মেয়ে উঠে এলো, মেয়েটা কে ও বোলপুর স্টেশনে দেখেছিলো মনে পড়লো দিতির,

ম্যাম, ওকে আমাকে দিন,

ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো মেয়েটা, ওর সুবিধাই হলো, ছেলে কে নিয়ে চা করা একটু অসুবিধের, গরম সসপ্যানে হাত দিয়ে দেয় ও।

নাম কি তোমার?

চায়ের জল প্যানে ঢালতে ঢালতে ছেলে কে কোলে নিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে জিজ্ঞেস করলো ও।

তিয়াসা,

অদিতি একটু চমকে উঠে সামলে নিলো নিজেকে, এর কথাই না অর্ক বলেছিলো ওকে! এই তো গয়না কেনার সময় মতামত দিয়েছিলো। কিন্তু এই মেয়েটা তো সেই মেয়েটা নয়, যাকে ও নাম জিজ্ঞেস করেছিলো, সেতো অন্য মেয়ে ছিলো। কথা বলতে বলতে একটু পরেই বেশ ভালই লাগলো মেয়েটাকে, টুকটাক গল্প করছিলো ওর সঙ্গে, সেদিনের অর্কর ওপর সন্দেহের জন্যে লজ্জাই লাগছিলো একটু।

কথা বলতে বলতেই হটাৎ করে স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসে অন্য একটা মেয়ে সরাসরি রান্না ঘরে ঢুকে এলো, এই মেয়েটাই তো ওকে নিজের নাম রিয়া বলেছিলো, মনে পড়লো অদিতির।

ম্যাম, আপনি ঘরে যান, আমি করে নিচ্ছি, আমরা কফি খাবো এবার,

ও কিছু বলার আগেই তাকের ওপর থেকে কফির কৌটো আর চিনির কৌটোটা নিয়ে নিলো মেয়েটা।

তুমি কফি কোথায় আছে জানলে কি করে?

অবাক গলায় বললো অদিতি, ও নিজের বিস্ময় আর চেপে রাখতে পারছিলো না, মেয়েটা ওর বাড়িতে কোথায় কি থাকে জানে সেটা!

আমি তো এখানে এলেই মাঝে মাঝেই কফি করে খাওয়াই ওকে,

কি বললো মেয়েটা? মাঝে মাঝেই খাওয়ায়? তাও আবার ওকে বললো? স্যার না বলে!

কয়েক সেকেন্ডের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গেলো দিতি, ওদের কথা বলতে দেখে আস্তে আস্তে করে বাইরে বেরিয়ে গেছে আগের মেয়েটা লক্ষ্য করলো ও। এই তবে সে যে ওর না থাকার সময়ে বাড়িতে আসে!

সেই সময় রান্নার দিদির কথা শুনে ওর মনে হয়েছিলো যে অর্ক কারোর জন্যে কফি করেছিলো, অর্ক কফি করা কবে শিখলো এটাই তো ও ভেবে গেছে এতোদিন! কিন্তু এখন বুঝতে পারছে আসলে অর্ক নয় কফি এই মেয়েটা বানিয়েছিল, যে কাপ রান্নার দিদি দেখেছিলো। এই মেয়েটাই তো গয়না পছন্দ করেছিলো ওর জন্য! সব পুরনো ঘটনাগুলো যেনো চোখের সামনে কেউ সাজিয়ে দিলো ওর! এতদিন ধরে কি সম্পূর্ন অন্ধকারে ছিলো ও!

ঠিক আছে, তুমি কফি করো তাহলে,

যা বলার ও অর্কর সঙ্গেই কথা বলবে, এখানে একটা কথাও বলবে না ও, আর কোনো কথা না বলে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে বাইরে বেরিয়ে আসা কান্নাটাকে গিলে নিয়ে,মেয়েটা কে রান্না ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে এলো অদিতি।

কফি খাওয়া পর্ব শেষ করে স্টুডেন্টরা আবার পড়তে শুরু করেছে, ঘর থেকে শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিলো দিতি। ওর ঘরে ঢুকে আসার কিছু পরেই ছেলে কে ওর কাছে ফেরত দিয়ে গিয়েছে তিয়াসা, হাতে ওর মোবাইলটা নিয়ে বসে আছে ছেলে, ওকে কোনো জ্বালাতন করছে না, চোখটা বন্ধ করে নিলো দিতি। এতদিন পরে ও সব কিছু পরিষ্কার বুঝতে পারছে, ওর রান্না ঘরে ঢুকে কি সুন্দর ওকেই বার করে দিলো মেয়েটা!

ও তো বিশ্বাসই করে নিয়েছিলো সব কিছু, অর্ক কে একটুও সন্দেহ করছিলো না, আজ যদি এই ঘটনা টা সামনে না আসতো তবে তো ও কোনোদিনও জানতে পারতো না এই ব্যাপার টা। অর্কও এক মুহূর্তের জন্যেও ওকে বুঝতে দেয়নি কিছু! কি সুন্দর অভিনয় করে গেছে আজ প্রায় বছর দেড়েক ধরে! আর ও ও নিজেকে পাগল ভেবে গেছে শুধু! ও রান্নার দিদির কাছে কফির কাপের গল্প শোনার পরেও কেনো জিজ্ঞেস করলো না অর্ক কে কিছু, এখন খুব আফসোস হচ্ছে!

স্টুডেন্ট দের ব্রেক দিয়ে স্টাডিতে এসে পরের দিনের জন্যে নোটসগুলো গুছিয়ে রাখছিলো অর্ক, কাল আবার একটা নতুন ব্যাচ আসবে, আজ এদের শেষ হলো। ওর পেছনে পেছনে কয়েকজন ঢুকে এসেছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের মতো বই দেখছিলো তারা।

আর চা খেতে ইচ্ছে করছে না, কফি খাবো এবার, তোরা খাবি কেউ,

অর্ক ঘুরে তাকিয়ে দেখলো, রিয়া কফি আনার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে ততোক্ষনে।

কে করবে তুই? খাওয়া যাবে তো?

পেছন থেকে দীপের টিপ্পনির আওয়াজ ভেসে এলো, রিয়া কোমরে হাত দিয়ে অর্কর দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ আবদারের গলায় বললো,

স্যার, আপনি বলুন আপনাকে আমি করে খাইয়েছি না কফি, ভালো করিনি?

অর্ক হেসে ফেললো,

হ্যাঁ, রিয়া ভালো কফি করে, খেয়ে দেখতেই পারো, সেদিন অনেকেই ওর কফির প্রশংসা করেছিলো,

কিন্তু রিয়া রান্না ঘরে ঢুকলে আবার বিরক্ত হবে না তো দিতি, মুখে হ্যাঁ বললেও মনে মনে একটু চিন্তায় পড়লো অর্ক। ও তো বোধহয় এতক্ষনে চা করতে শুরু করে দিয়েছে, এখন আবার কফি! রিয়া কে এখন ও আটকাতেও তো পারছে না আর, অন্যরাও কফি খেতে চাইছে! কি করবে না করবে ভেবে ওঠার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রিয়া।

রিয়া কফি নিয়ে ফিরে আসার পর ওর দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করেছিলো অর্ক। ওকে কি খুব অপমান করেছে দিতি! কিন্তু দেখে তো সেটা মনে হচ্ছে না, বেশ তো খুশি মুখেই কফি নিয়ে ঢুকলো, একটু একটু করে টেনশন টা কাটিয়ে উঠছিলো অর্ক। দিতির কোনো রাগের গলাও শোনা যাচ্ছে না, তাহলে কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি নিশ্চয়ই। ও এতো করে বুঝিয়েছে অদিতি কে তারপরে আর নিশ্চয়ই কোনো বোকামি করবে না ও। কফি শেষ করে আবার চেয়ারে বসে পড়াতে শুরু করলো অর্ক।

আরো প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে পড়ানো শেষ হলো, এক এক করে স্টুডেন্টরা বেরিয়ে যাচ্ছে, অদিতির ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ও। শেষ পর্যন্ত যে ঠিক মতো কোনো অশান্তি ছাড়াই মিটে গেছে আজকের দিনটা এটা ভেবেই আনন্দ হচ্ছিলো ওর। দিতি চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়ে আছে, পেছন ফিরে, ওর কি শরীর খারাপ! ছেলে একমনে মোবাইল নিয়ে খেলছে ও ফিরেও দেখছে না!

ঘুমোচ্ছো নাকি?

খাটে বসে জিজ্ঞেস করলো ও, চোখ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো অদিতি।

রিয়া? তাই না? এই নামই তো মেয়েটার? ওকেই বিয়ে করতে চাও তুমি?

ঠান্ডা গলায় ওর দিকে তাকিয়ে বললো অদিতি,

রিয়া! ছি ছি, তুমি একদম পাগল হয়ে গেছো দিতি, ও আমার ছাত্রী,

চমকে উঠে বললো অর্ক, এই ভয়টাই তো এতক্ষন পাচ্ছিলো ও।

ছাত্রী বুঝি বউ বাড়িতে না থাকলেই এসে কফি বানিয়ে খাওয়ায়? স্যার কে ও বলে ডাকে?

মানে? ও বলে ডাকবে কেনো? স্যার বলেই ডাকে!

তাই! আর কফি? সেটাও বানায় না তো?

শ্লেষের গলায় বললো অদিতি,

ও একবারই এর আগে এখানে এসেছিলো দিতি, তখন বানিয়েছিল, তুমি ছিলেনা তখন, তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি আর,

তাই? বলা হয়ে ওঠেনি তাই না! নাকি বলতে চাওনি? আজ ধরা পড়লে, তাই বলতে বাধ্য হলে তাই তো? একদিন বানিয়েছিল? কিন্তু ও তো বললো অনেকবার বানিয়েছে,

ও বললো তোমাকে? এতবড় মিথ্যে কথা! কেনো ও এই মিথ্যে কথাগুলো অহেতুক বলবে তুমি বলতে পারো আমাকে? নিজের কল্পনাগুলো কে নিজের মতো করে অন্যের মুখে বসিয়ে দিও না দিতি। ওদের সামনে পরীক্ষা, আজকের পরে আর কোনোদিনও ওরা আসবে না এখানে, আমার সঙ্গে আর দেখাও হবেনা হয়ত সারাজীবনেও। এই কথাগুলো কলেজে ছড়িয়ে পড়লে আমার সমস্যা হবে, সেটা তুমি বুঝতে পারছো কি!

আর ও যে আমাকে স্যার বলেই ডাকে, এটা প্রমাণ করতে আমার এক সেকেন্ড লাগবে, কিন্তু তার জন্যে অন্য স্টুডেন্ট দের ডাকতে হবে, সেটা করলে আমার সম্মান বলে আর কিছু থাকবে না দিতি। এতো করে বোঝালাম তোমাকে, তাও তুমি একই জিনিস করেই যাচ্ছ বারবার।

আমি ছেলের কথা ভেবেই তোমার এই পাগলামি গুলোকে এতো দিন ধরে মেনে নিচ্ছিলাম কিন্তু সত্যিই আমি আর পারছি না বিশ্বাস করো। এবার তোমার যা মনে হয় করো তুমি, আর আমি আটকাবো না তোমাকে, যদি থাকতে চাও আমার সঙ্গে তাহলে থাকো, কিন্তু থাকতে না চাইলে যা ইচ্ছে তাই করো, আর কোনো রকম অভিযোগের জবাব আমি তোমাকে দেবো না,

কথাগুলো বলেই বেরিয়ে যাবার জন্যে পেছন ফিরেই চমকে গেলো অর্ক, তিয়াসা ওর সামনেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষন ধরে চলা ওর আর দিতি র সব কথাই যে ও শুনে ফেলেছে সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলো ও।

স্যার, আমার মোবাইল টা,

ওকে ওর দিকে ঘুরতে দেখেই কাঁচুমাচু মুখে বললো ও, অর্ক ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকিয়ে দেখলো ওর ছেলের হাতে ধরা তিয়াসার মোবাইল। কোনো কথা না বলেই ছেলের হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে ওর হাতে দিয়ে দিলো অর্ক, ওর পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সোফায় এসে মাথা নিচু করে বসে পড়লো ও, আর কারোর জানতে বাকি থাকবে না এবার, তিয়াসার কল্যাণে কালকের মধ্যেই এই কথাগুলো সারা কলেজে ছড়িয়ে পড়বে।

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৪
কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো মাঠের কোনায় একটা দলের সঙ্গে তিয়াসা বসে আছে, নিজের মনের মধ্যেই একটা লজ্জা লাগছে ওর, নিশ্চয়ই তিয়াসা ওদের কে সব কিছুই বলে দিয়েছে এতক্ষনে। গোটা কলেজ আজ ওর দিকেই তাকিয়ে থাকবে, ভাবতেই পা টা কেমন আড়ষ্ঠ হয়ে গেলো, আস্তে আস্তে নিজেকে শক্ত করে টিচার্স রুমের দিকে এগোতে লাগলো অর্ক।

স্যার, আপনাকে কিছু বলার ছিলো আমার,

কখন যে তিয়াসা ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করে নি অর্ক। চমকে উঠে পেছন ফিরে তিয়াসা কে দেখেই লজ্জা লাগলো ওর, নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখেই ওর দিকে তাকালো অর্ক,

বলো, কিছু ডাউট আছে এখনও? অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে?

না স্যার, সে সব নয়, আমার অন্য কিছু কথা বলার আছে আপনাকে,

অর্ক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো, ওর আবার কি বলার আছে!

স্যার, ম্যাম কাল বানিয়ে বলেন নি, সত্যি রিয়া ওগুলো বলছিলো ম্যাম কে, আমি রান্না ঘরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, নিজে কানে শুনেছি,

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একদম চমকে গেলো অর্ক!

এদিকে সরে এসো,

এবার মেয়েটা কে একটা সাইডে সরিয়ে আনলো ও,

তুমি শুনেছ নিজে?

হ্যাঁ, স্যার, বলছিলো ও মাঝে মাঝেই আপনাকে বাড়িতে এসে কফি করে খাওয়ায়, এই কথাগুলো শুধু কাল ম্যাম কে বলেনি স্যার, আমাদেরও বলেছে অনেক বার। আর জানেন স্যার, ও এটাও বলেছে সবাই কে, ম্যাম খুব সন্দেহ করেন আপনাকে, তাই আপনাদের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে,

প্রায় এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেললো তিয়াসা, অর্ক অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। একটু চুপ করে থেকে বললো,

তিয়াসা, একটা রিকোয়েস্ট করবো তোমাকে…

আমি জানি স্যার, আমি কাউকে কিছু বলবো না, আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন,

অর্ক কে থামিয়ে দিয়ে বললো তিয়াসা,

স্যার, আমিই যে এই কথাগুলো বলেছি, এটা কেউ যেনো না জানে প্লিজ। আসলে সবাই বন্ধু তো, নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল করতে পারবো না!

রিয়া কে একটু টিচার্স রুমে ডেকে দাও তো,

তিয়াসা ঘাড় নাড়লো,

ও আজ আসে নি স্যার, কিন্তু স্যার আপনি কিন্তু আমার নাম নেবেন না!

নেবো না, এমনি কথা বলবো, ওর ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে?

ফোন নম্বরটা দিয়ে মেয়েটা চলে যাবার পর, অর্ক টিচার্স রুমে এসে বসে পড়লো। মেয়েটা সত্যিই এই কথাগুলো দিতি কে বলেছে! অর্ক র এখনও যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। একদম বোকা লাগছে নিজেকে! একটু পরেই অরিন্দম এসে ঢুকলো, ওকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হলো,

কি হয়েছে? আবার অদিতির সঙ্গে ঝামেলা নাকি?

অর্ক মাথা নাড়লো,

ঝামেলা ছিলো, এখন আর নেই! আমি বুঝলি তো পুরো বোকা হয়ে গেছি!

মানে?

চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো অরিন্দম, অর্ক গত দুদিনের ঘটনা খুলে বললো।

বলিস কি! কি সাংঘাতিক মেয়েরে! কিন্তু হটাৎ এরকম কেনো করলো বলতো? ডাক মেয়েটা কে, কথা বলি ওর সঙ্গে!

আসে নি আজ, ফোন নম্বর নিয়েছি! কিন্তু কিছু প্রমাণ তো করতে পারবো না! ওই তিয়াসা নামের মেয়েটা জানে সব, কিন্তু সামনে আসতে চায় না! আগেই বলেছে ও যে বলেছে এটা কেউ যেনো জানতে না পারে! তোর মনে হয় সবার সামনে ও স্বীকার করবে? যদি না করে তাহলে উল্টে আমিই বিপদে পড়ে যাবো।

অরিন্দম চিন্তায় পড়লো,

ঠিকই বলেছিস! এমনিতেও তো দিন কয়েক পর থেকেই আর আসবে না কলেজে! মিছিমিছি জল ঘোলা করে লাভ নেই কিছু! তুই একটু সতর্ক থাক বরং, আর ফোন করারও দরকার নেই!

কোনো রকমে পর পর দুটো ক্লাস শেষ করলো অর্ক, অদিতির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব, এখন মনে হচ্ছে রাগ দেখিয়ে আজ বেরোনোর সময়ে বলেও আসেনি ওকে। অদিতি অবশ্য অভ্যাস মতোই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলো, কিন্তু বুঝতে পেরেও ও ওপরের দিকে তাকায় নি। কাল খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে ও, বাড়ি গিয়েই ক্ষমা চাইতে হবে! কিন্তু যদি সব শুনে ফোনেই চেঁচামেচি করে! তাই বাড়ি গিয়েই সবটা বুঝিয়ে বলবে ঠিক করলো ও। দুটোর পরে ওর সব ক্লাস শেষ হয়ে গেলো, অরিন্দমের এখনও একটা বাকি আছে তাই আজ একাই কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়লো অর্ক। বেল বাজাতেই দরজা খুললো মা, দেখে একদম চমকে গেলো ও,

তুমি ? কখন এসেছো? বাবা এসেছে?

পর পর অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেললো অর্ক, রুমা কোনো উত্তর দিলেন না, মনের মধ্যে চাপা টেনশন হতে লাগলো অর্কর। দিতি কি তবে বাবা, মা কে খবর দিয়ে এনেছে! মনে মনে ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকলো ও। সমরেশ সোফায় নাতি কে কোলে নিয়ে বসে আছেন, দিতি রান্না ঘরে কিছু করছে বোঝা যাচ্ছে, গোটা বাড়িতে একটা থমথমে পরিবেশ।

ছেলে ওকে দেখেই হাত বাড়ালো কোলে ওঠার জন্যে, এটা ওর প্রতিদিনের অভ্যাস, বাড়ি ফিরেই একবার কোলে নিতে হবে ওকে, অর্ক তাড়াতাড়ি হাত, মুখ ধুয়ে এসে ওকে কোলে নিলো। কয়েক মিনিট কোলে নিয়ে বারান্দায় ঘুরে আসার পরেই ছেলে শান্ত হয়ে গেলো, রুমা ওর কাছ থেকে ছেলে কে নিয়ে বললেন,

বাইরে যা, বাবা ডাকছেন তোকে,

মনের মধ্যে একটু অশান্তি নিয়েই এসে বসলো অর্ক, একটু পরেই অদিতি চায়ের কাপ রেখে গেলো, রুমাও নাতি কে কোলে নিয়ে পাশের সোফায় বসলেন। বড়ো কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝেই অর্ক মনে মনে প্রমাদ গুনলো।

নিজেদের সমস্যা নিজেরা মেটাতে পারো না? এরকম পরিস্থিতি কেনো তৈরি হয় বাড়িতে যে, আমাদের এসে ইন্টারফেয়ার করতে হয়? তুমি নাকি দিতি কে চলে যাবার কথা বলেছো?

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কড়া গলায় বললেন সমরেশ, অর্ক কিছু বলার আগেই অদিতি সমরেশের সোফার পেছনে এসে দাঁড়ালো,

বাবা, বিশ্বাস করো, আমি নিজেই আর থাকতে চাই না এখানে! তোমার ছেলে আমাকে পাগল প্রতিপন্ন করতে চাইছে, কিন্তু আমি তো নিজে জানি যে আমি পাগল নই! আগের বার ওকে অরিন্দম দার বন্ধু বোঝালো যে প্রেগন্যান্সি তে এমন হয়! আমি নাকি ডিপ্রেসন থেকে এসব বলছি, আমি মেনেও নিয়েছিলাম, গিয়েছিলাম কাউন্সিলরের কাছে! কিন্তু এখন তো আমি প্রেগন্যান্ট নই, ছেলে কে নিয়ে আমি নাকানি, চোবানি খাচ্ছি সারাদিন, কোনো ডিপ্রেসন নেই আমার, আমি জানি! তাও ও বলতে চায় যা আমি নিজে কানে শুনেছি সব ভুল!! নিজের অন্যায়গুলো কে ও আমার ঘাড়ে দিয়ে পার পেয়ে যেতে চাইছে, সেটা আমি এবার কিছুতেই মেনে নেবো না।

অর্ক কোনো উত্তর দিলো না, এই মুহূর্তে তিয়াসার কথাগুলো বলতে যাওয়া মানে যে আগুনে ঘি ঢালা সেটা বুঝেই চুপ করে রইলো। সমরেশ বিরক্ত হলেন, ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

তুমি জানো ও বাড়ি চলে যাচ্ছিলো! নেহাত আমি আর তোমার মা তোমাদের সারপ্রাইজ দেবো বলে হটাৎ এসে গেলাম তাই! বেয়াই মশাই অসুস্থ, উনি এসব জানতে পারলে কি হতো ভেবেছো তুমি?

অর্ক অবাক হয়ে গেলো, দিতি বাবার কাছে চলে যাচ্ছিলো! ওর যা রাগ! এখন যদি ও জানতে পারে ওই ঠিক, তাহলে কুরুক্ষেত্র বাধবে, ওকে কিছুতেই সকালের কথাগুলো জানতে দেওয়া যাবে না। অরিন্দম ঠিকই বলেছে, এমনিতেও তো ওরা আর কয়েকদিন পর থেকে আসবেই না, মিছিমিছি গন্ডগোল করে লাভ নেই! তার থেকে বরং ও দিতি র কাছে ক্ষমা চেয়ে ম্যানেজ করে নেবে!

আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করেছি? উত্তর দিচ্ছ না কেনো?

ছেলে কে চুপ করে থাকতে দেখে অধৈর্য্য গলায় বললেন সমরেশ, অর্ক দিতি র দিকে তাকালো,

সরি দিতি! আমার ওইভাবে কথা বলা উচিত হয় নি, ভবিষ্যতে কোনোদিনও হবে না এরকম আর,

দিতি মাথা নাড়লো,

তোমার সরি বলা না বলায় আমার কিছু যায় আসে না! তুমি যদি আজ কথা গুলো কে উইথড্র করেও নাও তাহলেও তো এটা বোঝায় না যে আমি সত্যি কথা বলেছি! তোমার ধারণা আমি বদলাতে পারবো না, তুমি আমাকে পাগল ভাবছো, ডিপ্রেশনের জন্য কাউন্সিলিং করিয়েছো, আমি সব মেনে নিয়েছি এতদিন! কিন্তু আর না! আমি কাল সামনে দাঁড়িয়ে বলা কথাগুলো কে কল্পনা করেছি, এটা ভাবতে আমি কিছুতেই রাজি নই! আমি এই অশান্তির থেকে মুক্তি চাই এবার, তুমিও ভালো থাকবে এতে! পাগলের সঙ্গে থাকা তো তোমার জন্যেও কষ্টকর তাই না? মিছিমিছি আমার জন্যে তুমি সবার কাছে ছোটো কেনো হবে বারবার?

এবার রুমা হস্তক্ষেপ করলেন,

আমরা জানি তুই পাগল নস! তোর মত বুদ্ধিমতি মেয়ে কজন আছে? আমি তোকে বিশ্বাস করি! কিন্তু ডিভোর্স কোনো সমস্যার সমাধান নয় মা, পরে বুঝবি সেটা!

বরং এটার একটা হেস্তনেস্ত করা উচিত এবার! কে ঠিক কে ভুল, সেটা জানতে হবে, সেরকম হলে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে হবে। নিজের স্ত্রী কে বিশ্বাস না করে তুমি বাইরের একটা অচেনা মেয়ে কে বিশ্বাস করছো, এটা ভাবতে আমার অবাক লাগছে,

পাশ থেকে বললেন সমরেশ, রুমা সহমত হলেন,

হ্যাঁ, তুই তাই কর! ডাক মেয়েটা কে, জিজ্ঞেস কর সব কিছু!

অর্ক টেনশনে পড়লো, এখন কি করবে ও! ও যে সব টা জানে সেটা যদি এখন প্রকাশ করে তাহলে তো সবাই ওকেই দোষারোপ করবে! জানতে চাইবে, সব কিছু জেনেও ও কেনো চুপ করে ছিলো। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে অদিতি এগিয়ে এলো,

দ্যাখো মা! ও কিন্তু জিজ্ঞেস করতে চায় না কিছু! কারণ ও জানে আমি সব সত্যি কথাই বলেছি! নিজের দোষ চাপা দেবার জন্যেই ও মেয়েটার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করাতে চায় না কখনো! তাহলে তো ধরা পড়ে যাবে সব কিছু! আমি এখন নিশ্চিত এই মেয়েটাই আমাকে ফোন করেছিলো!

এবার অর্ক চেঁচিয়ে উঠলো, বাবা, মায়ের উপস্থিতি সম্পূর্ন ইগনোর করে বললো,

এবার তুমি কালকের ঘটনার সঙ্গে এতদিন আগের ঘটনাকেও রিলেট করে ফেলছো! বাহ! খুব ভালো! এরপরে আর কোনো কথাই থাকে না! যা খুশি করো তুমি! আর ধরা পড়ে যাবে মানে কি? কি এমন অন্যায় করেছি আমি, যে ধরা পড়ার ভয় পাবো?

এবার সমরেশও ধৈর্য্য হারালেন, রাগের গলায় বললেন,

রিলেট তো করবেই! আমি হলেও তাই করতাম! তুমি কেনো মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে চাইছো না? আমাকে বুঝিয়ে বল সেটা! এটার দুটো মানে হয়, হয় দিতি যা বলছে সব ঠিক, তুমি সব জানো! জেনেশুনে সব কিছু আড়াল করতে চাইছো! আর নয়তো তুমি বিশ্বাস করো না যে দিতি সুস্থ! তুমি সত্যিই ওকে পাগল ভাবছো!!আমি কিন্তু ওকে সুস্থ মনে করি, তাই আমি জানতে চাই তুমি কি ভাবছো?

আর কোনো উপায় নেই দেখে এবার মুখ খুললো অর্ক,

দিতি কে পাগল মনে করি না আমি, সমস্যা মেয়েটার, সেটা আমি আজই জানতে পেরেছি! কিন্তু আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই! তাই মেয়েটার সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলা সম্ভব নয়! সেই জন্যেই চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার,

সোফায় বসা বাকি তিনজন বিস্ফারিত চোখে অর্কর দিকে তাকালো, রুমা বিস্মিত গলায় বললেন,

এতো বড়ো কথাটা এতক্ষন বলিস নি তুই! শুধু প্রমাণ নেই বলে এতো বড়ো ঘটনা ঘটানোর পরেও মেয়েটা কে ছেড়ে দিবি!

দিতি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো, ওর ধারণাই কি সত্যি তবে! অর্কর সঙ্গে মেয়েটার কোনো সম্পর্ক সত্যিই আছে! সেই জন্যেই ও মেয়েটাকে কিছু করতে চায় না! সমরেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন,

আমি তোমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না!! এতক্ষন ধরে তুমি চুপ করে ছিলে! আমরা তোমাকে বাধ্য করছিলাম মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে তাই আর কোনো উপায় না দেখে এই কথাটা বললে!

অর্ক মাথা নাড়লো,

আরে! সে জন্যে নয় বাবা! কোনো প্রমাণ ছাড়া এগুলো নিয়ে এগোনো যায়? তুমিই বলো! আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেই তো ও আমাকে কে বলেছে তার নাম জিজ্ঞেস করবে! কিন্তু যে বলেছে সেতো সামনে আসতে চায় না! তাহলে আমি প্রমাণ করবো কি করে! মাঝখান থেকে গোটা কলেজে ছড়াবে!

এবার দিতি মুখ খুললো,

এতদিন তো চুপ করেই ছিলে! তাতে ছড়ায় নি কিছু? সবাই তো জানে আমি সন্দেহবাতিক! সেটাও তো ছড়িয়েছে! আটকাতে পেরেছো? এবার ছড়ালে ছড়াক, তবু আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো!

তুমি আমার সম্মানের কথা ভাববে না একবারও? অরিন্দমও আমাকে ইগনোর করতে বললো এসব, আমিও ভেবে দেখলাম ওরা কদিন পরেই চলে যাবে, তাই আর এইসব নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করতে চাই না।

কলেজ থেকে চলে যাবে, তোমার জীবন থেকে যাবে কি?

অর্ক কে থামিয়ে দিয়ে বললো দিতি, অর্ক অবাক চোখে তাকালো,

আমার জীবন থেকে মানে? তুমি এখনো ভাবছো ওর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক আছে! তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না!

দিতি হাসলো,

তুমি করো আমাকে? আমার বলা কথাগুলো কোনোদিনও বিশ্বাস করেছো? আর তোমাকে বিশ্বাসের কথা বলছো? বিশ্বাস করার মতো কোন কাজটা তুমি করেছো আজ পর্যন্ত? এতো লোক আছে চারপাশে, বলতো তাদের কার ফোন প্রতিদিনই বন্ধ বা সাইলেন্ট হয়ে যায় ভুলবশত? কে কোথাও বেড়াতে গিয়েও ফোন সাইলেন্ট করে কোনো খবর না দিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা বাইরে থাকে? একই ভুল দিনের পর দিন হয় কারো?

দিতি ঠিক বলেছে, আমি বহুদিন আগেই তোমার মা কে এই কথাগুলো বলেছি!! তোমার কাজকর্মই তোমাকে সন্দেহের তালিকায় রাখে সব সময়। যেকোনো ব্যাপারে তোমার ক্যাসুয়াল অ্যাপ্রোচ এর জন্যে দায়ী। সামান্য ব্যাপারগুলো কে তুমি নিজেই অসামান্য করে তোলো সবসময়। এই যে আজকের ব্যাপারটাই ধরো, আমরা চেপে না ধরলে তুমি কোনোদিনও এটা বলতে না আমাদের! তাহলে তো প্রশ্ন জাগবেই যে কেনো তুমি মেয়েটা কে বাঁচাতে চাইছো?

বিরক্ত গলায় দিতি কে থামিয়ে দিয়ে বললেন সমরেশ,

না বাবা, আমি মেয়েটা কে বাঁচাতে চাইছি না, কোনো প্রমাণ করার উপায় নেই তাই বাধ্য হচ্ছি। আর ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ এর কথা বলছো? হয়ত দু একবার এরকম হয়েছে, কিন্তু এটার আসল কারণ জাস্ট অশান্তি অ্যাভয়েড করা! আর কিছু না! হ্যাঁ মেয়েটা এটা বলেছে সেটা মানলাম! কিন্তু দিতিও এটা বিশ্বাস করলো তো? ও আসলে আমাকে একটুও বিশ্বাস করে না, সব ব্যাপারেই তিল কে তাল করা ওর স্বভাব। ওই যদি আমাকে বিশ্বাস না করে তাহলে বাইরের লোকের আর কতক্ষন লাগবে এসব গন্ডগোল বাধাতে? শান্তিনিকেতনের কথা জানো তুমি? আমি জাস্ট একটু নিজে ক্রেডিট নেবার জন্যে বলেছিলাম যে আমি ওর গয়নাগুলো পছন্দ করেছি, ও সেটা নিয়ে কি কাণ্ডই করলো! কেনো আমি ওকে মিথ্যে কথা বলেছি, সেটা জানতে চাইলো। এটা তো মজা, এটাকেও সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো ও। তাহলে আমি কি করবো? বাধ্য হয়েই তো বলতে হয় আমাকে! আমি যখন সত্যি বলি তখনও কি দিতি আমাকে বিশ্বাস করে? করে না তো! মোবাইলটা যে আগের বার সত্যিই আমি সারারাত খুঁজে পাইনি, এর মধ্যে কিন্তু একফোঁটাও মিথ্যে ছিলো না, কিন্তু ওকে বিশ্বাস করাতে পারলাম কি? এমনকি একটা সামান্য কথা, রিয়া এখানে এসে কফি করেছিলো একবার। এটাও কি এতটাই জরুরি কোনো বিষয় যে ওকে মনে করে বলতে হবে? কিন্তু কাল এটা নিয়েই ও কতো কিছু বললো! আমি নাকি ওর কাছ থেকে ইচ্ছা করেই লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি! তাহলে? তুমি হলে কি করতে? অশান্তি এড়ানোর জন্যে মিথ্যেই বলতে তাই না?

রাগের গলায় বললো অর্ক, রুমা কপালে হাত দিলেন, হতাশ গলায় বললেন,

তোদের দুজনেরই কোনো ম্যাচুরিটি নেই! তোরা তো নিজেরাই দেখছি ছেলেমানুষ, তোরা বাচ্চা মানুষ করবি কি ভাবে!!

চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১১+১২

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১১+১২
থ্রি টায়ার কামরার প্রায় অর্ধেকটাই ওদের, ট্রেন ছাড়ার পরে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে ছাত্র ছাত্রীরা। একটা সাইড লোয়ার বার্থে মুখোমুখি বসে কৌশিক আর রিয়া গল্প করছিলো, সকালের কথার জের যে এখনও রিয়ার মন থেকে যায়নি সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলো কৌশিক।

এখনো মন খারাপ করে আছিস?

নরম গলায় বললো ও, রিয়া হাসলো একটু,

জানিস তো, আবার ওই বাড়িতে ঢুকতে হবে ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে যায়! ওখানে যে আমি কি করে থাকি সেটা আমিই জানি! মাঝে মাঝে ঠাকুমা, পিসিদের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু মায়ের জন্যে যেতে পারিনা!

অতো বড় বাড়িতে তোর দম বন্ধ হয়ে যায়! ওরে বাবা! তাহলে তো আমাদের মতো ফ্ল্যাট হলে তুই থাকতেই পারতিস না!

পরিবেশটা হালকা করার জন্যে একটু মজার গলায় বললো কৌশিক, রিয়া কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে বললো,

অতো বোকা তুই নস! আমি জানি! বাড়ি বড়ো ছোটো হওয়ার সঙ্গে যে দম বন্ধের কোনো সম্পর্ক নেই সেটা নিশ্চয়ই তোকে বুঝিয়ে বলতে হবে না!

তোর ঠাকুমা তোদের সঙ্গে থাকেন না?

নাহ! ঠাকুমা নিজের বাড়িতে থাকেন! আমরা অন্য বাড়িতে! ঠাকুমা, পিসিরা আমাকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু মা ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দেয় না! তোকে সকালে বলেছিলাম না! যারা আমাকে ভালোবাসে, ঠিক তাদের কে কেউ না কেউ আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। একসময় আমরা ওই বাড়িতেই থাকতাম, কিন্তু মায়ের জন্যেই ওখান থেকে চলে আসতে হয়েছে!

রিয়ার গলায় ক্ষোভের সুর, কৌশিক স্বান্তনার সুরে বললো,

মায়ের সম্পর্কে ওইভাবে বলিস না, কাকিমার থেকে তোকে অন্য কেউ বেশি ভালোবাসতে পারে না!

রিয়া হাসলো, খুব কষ্টের গলায় বললো,

মা আমাকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে! মা যদি চাইতো তাহলে সব ঠিক হয়ে যেতো আমাদের! কিন্তু মা নিজেই কখনো চায়নি সেটা! আমি যখন ক্লাশ ফোরে পড়ি, তখন আমরা ঠাকুমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাই! আমি জানিস তো, মা কে লুকিয়ে ঠাকুমার কাছে যাই, ফোনে কথা বলি, মা জানলে ওটাও বন্ধ হয়ে যাবে!

এইরকম মাঝে মাঝেই কোথাও বেড়াতে চলে যাবি, তাহলে দেখবি ভালো লাগবে তোর,

সেই চেষ্টাই তো করি, কিন্তু একা যেতে কি ভালো লাগে বল!

জানি লাগে না! তাই তো তুই যখন শান্তিনিকেতন যেতে চাইলি, আমি সঙ্গে সঙ্গেই নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ব্যবস্থা করলাম তো! ওদের ভরসায় বসে থাকলে কোনোদিনও হতো না আর!

রিয়ার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললো কৌশিক, আস্তে করে কৌশিকের হাতে চাপ দিলো রিয়া,

থ্যাংক ইউ রে! শান্তিনিকেতন বললি বলে একটা কথা মনে পড়লো, অর্ক স্যারের বউ না খুব সন্দেহবাতিক মহিলা। সেদিন ফেরার সময় স্টেশনে দেখা হয়ে ছিলো না! সব মেয়েদের দিকেই কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছিলেন, আমাকে তো নামও জিজ্ঞেস করলেন!

তাতে কোনো সন্দেহবাতিক বোঝায় না! নাম জিজ্ঞেস করাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার,

রিয়া মাথা নাড়লো,

তোকে ঠিক বোঝাতে পারছি না! ওনার চোখের দৃষ্টি অন্য রকম ছিলো, এটা একমাত্র মেয়েরাই বুঝতে পারে, তুই ফিল করতে পারবি না!

আজও সকালে কিছু নিয়ে গন্ডগোল হচ্ছিলো ফোনে, বললি না তুই?

হ্যাঁ, নদীর ধারে তো! সেতো স্যার তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন! ওই জন্যেই তো বললাম, মহিলা যেনো কেমন!

মাঝ রাতে ঘুমের মধ্যেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় খাটে উঠে বসলো দিতি, হে ভগবান! আর একটা দিন কেটে যেতে পারলো না! অর্কর ট্রেন কটায় ঢুকবে কে জানে! কোনো রকমে বাইরে বেরিয়ে এসে শাশুড়ির ঘরে নক করলো ও, প্রায় সাথে সাথেই রুমা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন,

কি রে কি হলো? শরীর খারাপ লাগছে?

উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন রুমা, স্ত্রীর গলা শুনে ততোক্ষনে সমরেশও এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়!

আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলো মা, আর পারছি না!

বলতে বলতে সোফায় বসে পড়লো অদিতি। সঙ্গে সঙ্গেই হসপিটালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন করলেন সমরেশ, দিতি কে নিয়ে যখন ও টি তে ঢোকানো হচ্ছে তখন রুমা অর্ক কে ফোন করতে চাইলেন। অদিতি নিজেই বাধা দিলো,

ও খুব নার্ভাস মা, ওকে এখন ফোন কোরো না! আগে হয়ে যাক সব কিছু তারপর জানিও!

রুমা একটু দোলাচলে ভুগছিলেন, চিন্তিত গলায় বললেন,

তবু, একবার কথা বলে নিলে তো তোরও ভালো লাগতো,

দিতি থামিয়ে দিলো,

কিন্তু তারপর এই মাঝরাত থেকে ও তো বসে বসে টেনশন করবে! তার থেকে একদম খবর দিও তুমি,

রুমা আর কিছু বললেন না, দিতি কে ও টি তে ঢোকানো হয়ে যাওয়ার পরে চেয়ারে এসে বসলেন দুজনে। কিছুক্ষন পরে অন্য মনস্ক গলায় বললেন রুমা,

মেয়েটা কতো রিসনেবল! অর্ক টেনশন করবে বলে খবরই দিতে দিলো না! এই মেয়েই কদিন আগে কি কান্ডটাই না করলো! আমি এখনও মেলাতে পারি না ঠিক!!

যথেষ্টই বুদ্ধিমতি মেয়ে ও, আজ পর্যন্ত তোমার সঙ্গেও তো কোনো সমস্যা হয় নি কখনও।তোমার ছেলে যে যথেষ্টই ইরেস্পনসিবল সেটা তুমি নিজেই জানো, বিয়ের আগে তো পৌঁছে ফোন করতে ভুলে যেতো প্রায়ই। তুমি কতো টেনশন করতে তখন, এখন কিন্তু ও খবর না দিলেও অদিতি নিজে ফোন করে খবর দেয় তোমাকে। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই মেয়ে এরকম একটা বোকার মতো কাজ কখনই করতে পারে না। আমি ওদের সমস্যায় কথা বলতে চাইনি কখনো তাই বলিনি, কিন্তু আমার মনে হয় যে ফোন নম্বরটা ও দিয়েছিলো, সেটায় কথা বলে অন্তত দেখতে হতো একবার, তা না করে তোমার ছেলে কোন কলিগের পরামর্শে কাউন্সিলিং করে নিয়ে এলো!

বিরক্ত গলায় বললেন সমরেশ, রুমা চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষন পরে আস্তে আস্তে বললেন,

কাউন্সিলিং করে তো উপকার হয়েছেই, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই! যাকগে যা হয়ে গেছে তা ভুলে যাওয়াই ভালো, এখন আজকে সব কিছু ঠিক মতো হয়ে গেলে দেখো, সব গন্ডগোল মিটে যাবে ওদের!

মিটে যাবে না! সাময়িক ধামা চাপা পড়বে! তোমার ছেলে কে এবার একটু সাবালক হতে বলো! ওই কলেজ স্টুডেন্টদের মতো, আজ মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে, চার্জ নেই, কাল সাইলেন্ট মোডে ছিলো ভুলে গেছি, এইসব যদি চলতে থাকে তাহলে এসব ঝামেলা চলতেই থাকবে। এখন আর ছোটো নেই ও, সব ব্যাপারে গা এড়িয়ে চলার এই ব্যাপারটা যতদিন থাকবে, ততদিন সমস্যা আবার তৈরি হবে! বউ কে নয়, তোমার ছেলেকেই আগে কাউন্সিলিং করানো উচিত ছিলো!

সেতো জানিই! কিন্তু কি করবো বলতো? অতো বড় ছেলে কে আর কিই বা বলা যায়! নিজেরই তো বোঝা উচিত সবটা! বাপ্পার বিয়েতে গিয়েই কি কান্ডটা করলো বলতো! শেষে কিনা খুঁজতে বেরোতে হলো! আমি তো ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম যে ও ফিরলে দিতি আবার কি অশান্তি শুরু করে কে জানে! কপাল ভালো অল্পের ওপর দিয়ে গেছে, নাহলে আমাদের সম্মান বলে আর কিছু থাকতো না!

এবার সমরেশ আরো বিরক্ত হলেন,

ঘুরে ফিরে এটাই বললে যে তোমার বউ অশান্তি করেনি তাই তোমার সম্মান বেঁচে গেছে! কিন্তু সম্মান আদৌ বেঁচেছে কি? নিজের ছেলের কথা ভাবো একটু, তাকে বিয়ের দিন খুঁজতে বেরোতে হলো। সেটা খুব সম্মানের বুঝি? কি ভাবলো আত্মীয়স্বজন? একটা চাকরি করা বিবাহিত ছেলে এতটাই ইরেস্পন্সিবল যে, তার মা, বউ কে তাকে রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে বেড়াতে হয়!

সমরেশের কথা শেষ হবার আগেই ও টির দরজা খুলে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন, তাঁকে দেখেই দুজনে একসাথে উদগ্রীব হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

ট্রেনে উঠেই ওপরের বার্থে উঠে শুয়ে পড়েছিলো অর্ক, দোলানি তে চোখদুটো কখন যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো নিজেও টের পায়নি। ঘুম ভাঙলো প্রায় ভোরের দিকে,

স্যার, আপনার ফোন বাজছে অনেকক্ষন থেকে, দুবার মিসড কল হয়ে গেছে,

ওরই একজন স্টুডেন্ট ওকে ধাক্কা দিচ্ছে ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারছে ও। অনেক কষ্ট করে চোখ খুলে ফোন টা কে পকেট থেকে বার করে নিয়ে কানে ধরলো অর্ক,

ছেলে হয়েছে অর্ক, দিতি কে এক্ষুনি বার করলো ও টি থেকে,

মায়ের উচ্ছসিত গলার আওয়াজে লাফ দিয়ে উঠে বসলো অর্ক, এই মুহূর্তে চোখে আর একটুও ঘুম নেই ওর। অর্ক যখন হাসপাতালে পৌঁছালো, তখন দিতি এবং ছেলে দুজনেই ঘুমোচ্ছে। রুমা অর্ক কে দেখেই এগিয়ে এলেন, ইতিমধ্যেই তিনি বেয়াই মশাইকে খবর দিয়ে দিয়েছিলেন, অর্ক পৌঁছানোর আগেই তিনিও পৌঁছে গেছেন। বাড়িতে একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হলো, গত কয়েক মাসের ঝড় ঝাপটা কাটিয়ে নতুন করে শান্তি ফিরলো।

দেখতে দেখতে দু মাস কেটে গেল, এই সময়টা কলকাতাতেই কাটালেন সমরেশ আর রুমা, তাঁদের ওদিকে ডাক্তার বদ্যির সুবিধা কম থাকায় দিতি কে নিয়ে যাবার বদলে তাঁরাই এখানে থেকে যাওয়া মনস্থির করলেন। তাছাড়া আরো একটা কারণ ছিলো, আগের বার একা থাকার সময়েই সমস্যা দেখা দিয়েছিলো, তাই রুমা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন, পাছে একাকীত্বের জন্য আবার নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়।

ইতিমধ্যে একটু হলেও অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলেন সমরেশ, নিজের খোলামেলা বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত তিনি। তাঁর পক্ষে এই দু কামরার ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না আর, তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অর্কর বেশ কিছু ছুটি পাওনা ছিলো, বাবা, মা থাকায় বেশি ছুটি নেবার প্রয়োজন হয় নি ওর এতোদিন, বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠছেন দেখে ও নিজেই একদিন মা কে ফিরে যাবার জন্যে বললো।

খুব অসুবিধা হবে না তো তোর?

একটু কুণ্ঠিত গলায় বললেন রুমা, অর্ক ঘাড় নাড়লো,

আমার ছুটি জমে আছে অনেকটাই, আমি ম্যানেজ করে নেব, তুমি চিন্তা কোরো না। বাবা যখন থাকতে চাইছেই না আর, তখন তোমরা চলেই যাও,

রুমা তাও মনে মনেই একটু লজ্জিত হচ্ছিলেন, আজ দিতির মা হলে হয়তো চলে যেতে পারতো না এই ভাবে। তিনি একটু আলাদা ভাবে স্বামী কে একা পেয়ে সেকথা বললেন,

বাচ্চাটার মাত্র দু মাস হলো, দিতি ওকে সামলাতে পারবে! ওর নিজেরই তো অপারেশনের পরে শরীর এখনও ঠিক হয় নি তেমন!

সমরেশ বিরক্ত হলেন,

তুমি থাকো তাহলে! আমার আর ভালো লাগছে না! অনেকদিন এসেছি, এবার বাড়ি ফিরবো। আমরা কি সারাজীবন এখানেই থেকে যাবো? বরং তোমার ছেলে কে ঠিক করে বোঝাও একটু, ও তো বাবা হয়েছে এখন, এবার একটু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করুক। দায়িত্ব নিতে শিখুক একটু!

সেতো ও বলছেই, ওর ছুটি আছে অনেক! কিন্তু আমাদেরও তো একটা দায়িত্ব থেকেই যায়!

সে দায়িত্ব তো পালন করেছি, আর কতো? কতোদিন হয়ে গেলো এসেছি বলতো?

স্ত্রী কে থামিয়ে দিয়ে বললেন সমরেশ, তাঁর গলা রীতিমত অর্কর বেডরুম থেকেও শোনা যাচ্ছিলো। তাঁকে খুব উত্তেজিত দেখে দিতি একসময় ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, শাশুড়ি কে উদ্যেশ্য করে বললো,

বাবার হয়ত সত্যিই আর ভালো লাগছে না এখানে মা, তোমরা বরং কিছুদিন বাড়ি থেকে ঘুরে এসো, আমরা সামলে নিতে পারবো।

এবার সমরেশ একটু লজ্জিত হলেন, দিতি কে বললেন,

রাগ করিস না মা, মাসখানেক একটু ঘুরে আসি বাড়ি থেকে, তারপর আবার এসে থাকবো না হয়। বাড়িটা প্রায় দু মাস ধরে খালি পড়ে আছে, কি জানি কি অবস্থা দেখবো গিয়ে!

অবশেষে সবকিছু গুছিয়ে হাতের কাছে রেখে, রান্নার দিদি কে পই পই করে কামাই না করতে বুঝিয়ে দিয়ে রুমা, সমরেশ বাড়ি ফিরে গেলেন। অর্ক বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিলো, দুজনে মিলে মোটামুটি চারদিক ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছিলো।

এমন সময় একদিন অরিন্দমের বিয়েতে বৌভাতের নিমন্ত্রণ হলো ওদের দুজনের, অতো ছোটো বাচ্চা নিয়ে সামলাতে পারবে না বলে শেষ পর্যন্ত দিতি বৌভাতের অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অর্ক যদিও বলেছিলো যে সে পারবে তবু দিতি একটু ভয় পেলো, বারবার বলা সত্বেও দিতি না যেতে চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত অর্ক একাই বৌভাতে উপস্থিত হলো।

অরিন্দম আর তার স্ত্রীর হাতে উপহার তুলে দিয়ে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে একটা সোফায় গিয়ে বসলো অর্ক, এদিক ওদিক তাকিয়ে চেনা মুখ খুঁজছিলো ও। বেশির ভাগই দু পক্ষের বাড়ির লোক, কলেজের কাউকেই ও দেখতে পাচ্ছিলো না, সম্ভবত এখনও কেউ এসে পৌঁছায় নি। ও একটু আগেই এসে পড়েছে, দিতি কে একা বাড়িতে রেখে বেশিক্ষন যাতে বাইরে না থাকতে হয় তাই একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছে এখানে।

কখন এলে?

বলতে বলতে ওর পাশে বসে পড়লেন সমর দা, অর্ক এই প্রথম বার জীবনে সমর দা কে দেখে খুশি হলো। একা একা বসে থাকাটা সত্যিই খুব অস্বস্তির, হেসে বললো,

এই তো এক্ষুনি! আপনি কখন এলেন? বৌদি আসেন নি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসেছে তো, ওই যে ওইদিকে সব মহিলাদের সঙ্গে মিশে গেছে! বউ ছাড়া আমি কোথাও যাইনা!

বলেই নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন সমর, অর্কও বাধ্য হয়েই হাসলো একটু। কয়েকমিনিট নীরবতার পরে হটাৎ করেই গলাটা নামিয়ে প্রায় অর্কর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন সমর,

তুমি তো একাই এসেছো দেখছি! শুনলাম সব! কি আর করা বলো!! এরকম সন্দেহবাতিক বউ কে নিয়ে কোথাও না যাওয়াই ভালো, বলা যায়না কখন আবার কি করে বসে!

অর্ক চমকে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

এসব কি বলছেন! সন্দেহবাতিক কিসের! ছোটো বাচ্চা, তাই ও আসেনি!

শাক দিয়ে আর মাছ ঢেকো না! কলেজে সবাই সব জানে! কি আর করবে, ফেলে দিতে তো আর পারবে না! এই করেই বাকি জীবন টা চলতে হবে, তবে ভাই, সন্দেহ জিনিসটা এমনই শুরু হলে আর থামানো মুশকিল! মনের মধ্যে গেঁথে যায় একেবারে!

মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিলো অর্কর, অরিন্দম কে বিশ্বাস করার এই পরিণতি! এতো নিচু মনের ও! গোটা কলেজে এইভাবে রটিয়ে দিলো সব!

কফিটা তিত লাগছে, কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্ক, এখানের খাবার মুখে তুলতেও ইচ্ছে করছে না আর। সমর দা পেছন থেকে ডাকলেন,

খেতে বসবে কখন?

পরে খাবো, আপনি বসে যান!

সমর দা কে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আস্তে আস্তে সরে এসে, অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো ও।

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১২
এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? শান্তিতে খেতেও পারো নি নাকি,

দরজা খুলে অর্ক কে দেখেই হেসে বললো অদিতি, অর্ক কোনো কথা না বলেই গম্ভীর মুখে অদিতির পাশ দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো দিতি একটু অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ওকে দেখেই চিন্তিত গলায় বললো,

কি হয়েছে তোমার?

অর্ক সোফায় বসে দিতি র দিকে তাকিয়ে বলল,

ফ্রিজে ঠান্ডা জল আছে? দাও তো একটু, মাথাটা প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে!

অদিতি তাড়াতাড়ি জলের গ্লাস এনে অর্কর দিকে এগিয়ে দিয়ে, উল্টোদিকের সোফায় বসে উদগ্রীব চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। জলটা একচুমুকে শেষ করে গ্লাসটা আওয়াজ করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে দাঁতে দাঁত পিষে অদিতির দিকে তাকালো অর্ক,

অরিন্দম যে এতো খারাপ, সেটা একটুও ভানি নি কখনো। বিপদে পড়ে একটু হেল্প চেয়েছিলাম তখন, যদি জানতাম এই তার পরিণতি হবে তাহলে কখনো ওর কাছে কিছু শেয়ার করতাম না।

কি হয়েছে! অরিন্দম দা কি করেছে?

কি করে নি সেটা বলো! আমার কলেজে আর কোনো সম্মান রইলো না! গোটা কলেজে ও বলে বেরিয়েছে যে তুমি নাকি সন্দেহবাতিক!

কে বললো তোমাকে?

কান্নায় গলা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে অদিতির, লক্ষ করলো অর্ক। নিজেকে শক্ত করে অদিতির হাতটা চেপে ধরে বললো,

তুমি কিছু ভেবো না, ওকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না! যা খুশি রটিয়ে ও কিছুতেই পার পেতে পারবে না, আমি ওর সম্মানও ধুলোয় মিশিয়ে দেবো, দেখো তুমি!!

কি হবে ওসব করে আর! যা ছড়ানোর তাতো ছড়িয়েই গেছে! ইস! আমি কি করে মুখ দেখাবো সবার সামনে এবার!

জলভরা চোখে বললো অদিতি, অর্কর মাথা আরও বেশি করে গরম হয়ে যাচ্ছিলো। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ফোন তুলে সাথীকে ডায়াল করলো ও, সাথী হ্যাল্লো বলতেই ও ফোনের ভেতরে হৈ হুল্লোড় এর আওয়াজ পেলো। সাথী তারমানে সম্ভবত বিয়ে বাড়িতেই রয়েছে এখন!

ভালোই হলো আপনি অরিন্দমের ওখানে আছেন, আসলে ওকেই এই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম।

কি হয়েছে? আপনি এতো উত্তেজিত কেনো?

বিপদে পড়েই হেল্প চেয়েছিলাম অরিন্দমের কিন্তু ও যে সেটাকে ওর মুখোরোচক গল্পের প্লট হিসেবে ইউজ করবে, সেটা একবারও ভাবিনি। সে যে আপনার প্রফেসনল এথিক্সও নষ্ট করেছে অদিতির খবর রটিয়ে দিয়ে, সেটা তাকে বুঝিয়ে বলবেন, ওর নিজেরই একটা কাউন্সিলিং দরকার এবার!!

দাঁড়ান, দাঁড়ান, কি বলছেন আপনি? অরিন্দম অদিতির কথা রটিয়ে দিয়েছে? সেতো খুব খারাপ কাজ, আমি ওর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে অবশ্যই জানাবো!

অর্ক কে থামিয়ে দিয়ে বললো সাথী, অর্ক ফোন রেখে দিল। বেশ কিছুক্ষন দুজনেই নির্বাক হয়ে সোফায় বসে থাকার পরে অর্কর ফোন বেজে উঠলো। ফোনে অরিন্দমের নাম দেখেই বুঝলো অর্ক, সাথী ওকে সব বলেছে ইতিমধ্যেই! ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই অরিন্দমের উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এলো,

ভাই কি হয়েছে? সাথী বলছে তুই নাকি ওকে ফোন করেছিস? বলেছিস আমি অদিতির কথা কলেজে সবাই কে বলে দিয়েছি?

বলিস নি বুঝি? সমর দা তাহলে মিথ্যে বললেন তাই তো?! তবে তোর কাছ থেকে সত্যিই এক্সপেক্ট করিনি এটা! কাজটা খুব খারাপ করলি কিন্তু!

ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে বললো অর্ক, অরিন্দম একদম আকাশ থেকে পড়লো,

তুই কি পাগল হলি? সমর দার কথাও বিশ্বাস করছিস আজকাল! ঠিক আছে, আমি নেক্সট উইকে জয়েন করবো, মুখোমুখি বসবো সমর দার সঙ্গে। দেখি কেমন আমার সামনে এতো বড় মিথ্যে বলার ক্ষমতা রাখে ও, বলুক আমার নাম সামনে বসে!!

অর্ক আর কোনো কথা বললো না, অরিন্দম ফোন নামিয়ে রাখার পরে অর্কর মনে পড়লো, সমর দা তো অরিন্দমের নাম বলেন নি একবারও! মুখোমুখি বসে প্রমাণ করতে পারবে তো ও!

কিন্তু নেক্সট উইক নয়, পরের দিন সকাল হতেই অর্কর বাড়িতে উপস্থিত হলো অরিন্দম, ঘরে ঢুকেই অদিতির কাছে ক্ষমা চাইলো। অর্কর দিকে তাকিয়ে বললো,

বিশ্বাস কর, সত্যি আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে! কিন্তু আমি যেটা করিনি, সেটার দায় স্বীকার, সত্যিই করতে পারবো না। কাল সারারাত আমি ভেবেছি, সমর দার এই যে অহেতুক, বিভিন্ন বানিয়ে বানিয়ে বলা কথাগুলো কে আর বাড়তে দেওয়া চলবে না। এর আগে আমার সম্বন্ধেও তোকে একবার মেট্রোতে কতো কথা বলেছিলো, সেবার আমি কিছু বলিনি! কিন্তু আর নয়! এবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে!

বলতে বলতেই সোফায় বসে অর্ক কে কোনরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সমর দা কে ডায়াল করে ফেললো অরিন্দম, সমর দা ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা স্পিকারে দিয়ে টেবিলের ওপরে রাখল ও। ওদিক থেকে সমরের গলা ভেসে এলো,

কি ভাই, ফুলশয্যার পরের দিনই দাদা কে তলব কেনো? সব খবর ভালো তো?

ভালো আর থাকতে দিচ্ছেন কই! বয়স তো কম হয়নি আপনার! এই বয়সে এইসব কথা আপনার মুখে মানায়?

অরিন্দমের কড়া গলার উত্তরে থতমত খেলেন ভদ্রলোক, খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,

কি কথা? আমি তো কিছুই বুঝলাম না!

ওই অর্কর স্ত্রীর সম্বন্ধে ওকে যা বলেছেন কাল! তার কথাই বলছি! তা আপনাকে এতো মুখরোচক খবরটা দিলো কে? আমরা কেউ জানলাম না আপনি জেনে গেলেন?

এবার একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় উত্তর দিলেন সমর,

তুমি কিছু জানো না নাকি? সবাই জানে তো! আমি তো ভাবতাম তুমিই আগে জানবে সবটা, ওর সবচেয়ে ক্লোজ তো তুমিই! বলে নি তোমাকে কিছু?

সবাই জানে! কি জানে? এই সবাই কারা?

অরিন্দম অবাক গলায় বললো, গোপন খবর বলতে পেরে একটু খুশিই হলেন ভদ্রলোক, উত্তেজিত গলায় বললেন,

আরে! সবাই, মানে সবাই! টিচার থেকে স্টুডেন্ট কেউ বাদ নেই আর! এতো বেশ পুরনো কথা, প্রায় মাস তিনেক হতে চললো! অর্ক খুব চাপে আছে, তুমি জানো না দেখেই তো আমার অবাক লাগছে!

এসব সম্পূর্ন মিথ্যে কথা! কিচ্ছু হয়নি ওদের! কারা রটাচ্ছে এসব?

সমর কে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো অরিন্দম, সমর তাড়াতাড়ি উৎসাহের গলায় উত্তর দিলেন,

তুমি কিছুই খবর রাখোনা দেখছি! এসব কি আজকের কথা নাকি! আমি তো কবেই স্টুডেন্ড দের কাছ থেকেই শুনেছি! থার্ড ইয়ারের একটা গ্রুপ এর সঙ্গে নাকি বেশ কয়েকমাস আগে শান্তিনিকেতন বেড়াতে গিয়ে দেখা হয়েছিলো অর্ক আর ওর বউয়ের! সেখানে মেয়েদের দেখে নাকি ওর বউ জেরায় জেরায় ওকে জেরবার করে দিয়েছে, মেয়েদের নামও জিজ্ঞেস করেছে ডেকে ডেকে! আর এক্সকারসনের ঘটনা জানো না? সেখানে তো পাশে বসে অন্য মেয়েকে ফোনে কথা বলতে দেখে নাকি ওর বউয়ের কি রাগ! শেষে তো ওকে উঠেই যেতে হয়েছে ওখান থেকে! আরো অনেক কিছু আছে, অতো কি আর ফোনে বলা যায়!!এসো একদিন বাড়িতে, বলবো সব!

ফোন কেটে দিয়ে সোফায় মুখোমুখি বসে তিনজনেই তিনজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষন পরে অর্ক অরিন্দমের হাত চেপে ধরলো,

সরি ভাই! বিরাট বড়ো ভুল করে ফেলেছি!

অরিন্দম ম্লান হাসলো,

আমি বোধহয় সত্যিই তোর বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি, তাহলে তুই অন্তত অন্যের মুখের কথায় বিশ্বাস করতিস না! যাকগে! বাদ দে! আসল কথা ভাব! এক্সকারশনে সত্যি কোনো মেয়ে তোর পাশে বসে কথা বলছিল? অদিতি রিয়েক্ট করেছিলো তাতে?

রিয়েক্ট করিনি, মেয়েটা আসলে খুব জোরে জোরে কারোর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলো, তাই বিরক্ত হয়েছিলাম! আমি ওর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না তাই,

অর্ক কিছু বলার আগেই অদিতি পাশ থেকে বলে উঠলো,

তোকে উঠে চলে আসতে দেখেছে কে কে?

অর্ক মাথা নাড়লো,

জানি না! হোটেলের সব রুম থেকেই নদীর ধার দেখা যায়। অসীম বাবু, ধীমান বাবু ছিলেন টিচারদের মধ্যে, আর স্টুডেন্টদের কথা কি করে বলবো! অনেকেই ছিলো, যে কেউ হতে পারে!

অন্য মনস্ক গলায় বললো অর্ক,

আর শান্তিনিকেতনে?

সেখানেও তো জনা ছয়েক ছিলো প্রায়, কার কথা বলি বলতো! তবে দিতি যে তিয়াসার নাম জানতে চেয়েছিল, এটা কিন্তু ঠিক!

অরিন্দম অদিতির দিকে তাকালো, অদিতি মাথা নাড়লো,

এটা ঠিক যে আমি একজনের নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারণ সে আমাকে বলেছিলো অর্কর হাট থেকে কেনা গয়নাগুলো সে পছন্দ করে দিয়েছিলো। কিন্তু আমি মোটেও সবার নাম জানতে চাইনি! কেউ কথা বললে তার নাম জিজ্ঞেস করা কি অশোভন? তুমিই বলো অরিন্দম দা?

একদমই নয়! খুব সাধারণ ব্যাপার! কিন্তু সেটা এরকম অসাধারণ বানিয়ে তুললো কে? এটা কিন্তু জানা খুব দরকার!

একটু চিন্তার গলায় বললো অরিন্দম, অর্ক বাধা দিলো,

আমি শিওর, সমর দাই! কেউ হয়ত বলেছে কথাগুলো এমনই, সেটা কে উনিই তিল থেকে তাল করে তুলেছেন।

অরিন্দমও সহমত হলো, একটু রাগের গলায় বললো,

একবার সুযোগ পাই! দ্যাখ ওকে কি করি! বুড়ো হয়ে মরতে চললো এখনও কুট কাচালি গেলো না! ওই বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন করে না! ওখানেই গল্প শুনে নতুন নতুন গল্প বানায়! এক কাপ কড়া করে চা করো তো অদিতি, মাথাটা ধরে গেছে একদম!

অদিতির আনা চা খেয়ে, সমর কে গালাগালি দিতে দিতে অরিন্দম বিদায় নিলো। আগামী মাসে হনিমুন সেরে ফিরেই দুজনে মিলে সমরের কিছু ব্যবস্থা করবে, যাবার আগে অদিতি কে কথা দিয়ে গেলো। সপ্তাহখানেক পরে আস্তে আস্তে ঘটনাটা সবারই মন থেকে মুছে গেলো।

দেখতে দেখতে আরো মাস তিনেক কেটে গেলো, সমরেশ এবং রুমা বিভিন্ন ঝামেলায় আটকে পড়ে আর কলকাতায় আসতে পারলেন না। অদিতির বাবার শরীর বরাবরই খারাপ, তাই তাঁর পক্ষে আসাও সম্ভব ছিলো না। শেষ পর্যন্ত রুমার ইচ্ছেই ছেলে নিয়ে অদিতি আর অর্ক দুজনে বাড়ি থেকে ঘুরে এলো। ফিরে এসে অর্ক কলেজে যেদিন জয়েন করলো তার কিছুদিন পরেই থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা। ওকে দেখেই অনির্বাণ এগিয়ে এলো,

স্যার, আপনার বাড়িতে আসতাম একদিন, কিছু জিনিস বোঝার ছিলো!

অর্ক রাজি হলো, সত্যিই ওর ছুটি নেওয়ার জন্যে কিছু কিছু জিনিস তাড়াহুড়ো করেই শেষ করেছে ও। ওগুলো আর একবার ডিসকাস করলে ভালোই হবে, বললো,

ঠিক আছে এই সপ্তাহে তো দিন তিনেক ছুটি আছে, ওইসময় এসো তাহলে। যারা যারা আসতে চায়, তাদের সবাই কে বলে দিও একটু। দু তিন দিন বসলেই সব টা কমপ্লিট হয়ে যাবে। কলেজ থেকে ফিরে অদিতি কে বললো সবটা,

তোমার অসুবিধা হবে না তো! যদি হয় তাহলে অন্য কোনো ব্যবস্থা করবো না হয়!

কিসের সমস্যা! কোনো অসুবিধা নেই, আমি ছেলে কে নিয়ে বেডরুমে থাকবো। ওকে নিয়ে বেরোলেই ও জ্বালাতন করবে,

হেসে বললো অদিতি, অর্কও হাসলো,

হ্যাঁ ওটাই ভয় আমারও, যা দুরন্ত হয়েছে, দু দুবার খাট থেকে পড়তে পড়তে বাঁচলো!

ওরাও কি আমার কথা জানে? সমর দা কি ওদেরও বলেছে! আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে,

ছাড়ো না! জানলেও বা কি এসে যায়! ভালোই তো, যদি জেনেও থাকে, তাহলে এখানে এসে তোমাকে দেখে ওদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে। সেটাই তো আমরাও চাই, তাই না?

অদিতি কে থামিয়ে দিয়ে বললো অর্ক, অদিতি একটু হাসলো,

আচ্ছা! সত্যিই কি আমি সন্দেহবাতিক? তুমি নিজেও কি তাই ভাবো?

অর্ক মাথা নাড়লো,

মোটেও না! তুমি একবারই এরকম কাজ করেছিলে বাড়িতে একা থাকার সময়ে, তবে আমি পরে ভেবেছি জানো, তোমাকে ওই সময় একা রাখা আমার উচিত হয়নি! যাইহোক ওসব আলোচনা থাক, ওদের দু একবার চা করে দিও একটু, তাহলেই হবে।

স্টুডেন্টরা আসতে শুরু করলো নির্ধারিত দিনে, আজ নিয়ে তৃতীয় দিন হলো স্টুডেন্টদের বাড়িতে ডেকে ওদের সমস্যা গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে অর্ক। অদিতি কে খুব বেশি বিরক্ত করে না ও, শুধু বার দুয়েক সবাই কে চা করে দিতে বলা ছাড়া। সেটুকু দিতি হাসি মুখেই করে, যে মেয়েগুলো এসেছে এখনও পর্যন্ত, প্রত্যেকটা মেয়েকেই বেশ ভালো লেগেছে দিতির।

চা করার সময় ওরাই ওর ছেলেটা কে নিয়ে রেখেছে, ওর খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ওদের সঙ্গে একটু আধটু গল্পও করেছে ও, ভালোই লাগছিলো ওর। অনেকদিন তো সেভাবে ওর কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি, এরা কলেজের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট, বেশ বড়ই সবাই, কথা বলে বেশ সময় কেটে যাচ্ছিলো ওর।

সংখ্যায় বেশি হয়ে যাচ্ছিলো বলে স্টাডি তে জায়গা হচ্ছিলো না, ড্রইং রুমের সোফায় ওদের নিয়ে বসছিলো অর্ক। ওখান থেকে কথা বললে বেড রুম থেকে শোনা যায়, ছেলে ঘুমাতে চায় না, এখন প্রায় ছয় মাসের হয়ে খুব দুষ্টু হয়েছে সে। তাই কদিন ধরেই পেছন দিকের ঘরে এসে দুপুরে ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো দিতি। ওই ঘর থেকে বেরোলে সামনে রান্নাঘরটা পড়ে, ডাইনিং থেকে ড্রইং এর অনেকটা দূরত্ব, তাই অতোটা আওয়াজ আসেনা এখানে।

ছেলে কে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেরই কখন চোখ বুজে এসেছিলো টের পায় নি দিতি। আজকাল ছেলের পেছনে ওকে এতো ছোটাছুটি করতে হয়, ও পেরে ওঠেনা আর। আগে যতদিন অর্ক ছুটিতে ছিলো ততদিন ও ও কিছুটা সাহায্য করতো ওকে, এখন সবটাই ওর ওপরেই এসে পড়েছে। ড্রইং রুম থেকে ভেসে আসা অর্কর গলার স্বরে ঘুম ভাঙ্গলো দিতি র। কিছু বোঝাচ্ছে ও স্টুডেন্টদের বুঝতে পারছে দিতি, তার মানে ওর ছাত্র ছাত্রীরা এসে গিয়েছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় চারটে বাজে, এইসময় একবার চা দিতে বলে অর্ক, চা করবে বলে ঘরের বাইরে এসেই থমকে গেলো দিতি। সেন্টার টেবিলের চারিদিকে ছড়ানো সোফায় গোল হয়ে বসে আছে স্টুডেন্টরা, ওর দিকে পেছন ফিরে সোফায় বসে মাথা নিচু করে টেবিলের ওপর রাখা নোটস এর দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝাচ্ছে অর্ক। ওর বাম পাশে একটা ছেলে, উল্টোদিকের সোফায় বেশ কয়েকটা ছেলে, মেয়ে আর ঠিক ডান পাশে বসে একটা মেয়ে খুব বিশ্রী ভাবে অর্কর গায়ের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে বসে আছে।

অর্ক মাঝে মাঝেই নিজেই অস্বস্তিতে একটু করে সরে যাচ্ছে বাম দিকে বসা ছেলেটার দিকে, আর ঠিক ততটাই সরে আসছে মেয়েটা। উল্টোদিকের সোফায় বসা ছেলে, মেয়েগুলোর ঠোঁটে লেগে থাকা মুচকি হাসিটা চোখে পড়ছিলো দিতির। অনেকদিন পরে আবার সেই সন্দেহ টা ফিরে আসছে বুঝতে পারছে দিতি, নিজেকেই নিজে শান্ত করার চেষ্টা চালাতে লাগলো ও।

ঘরের মধ্যে আবার ফিরে চলে এলো অদিতি, এখন বেরোলেই সব গন্ডগোল হয়ে যাবে আবার। আজ আর চা করতে বেরোবে না ও, হে ভগবান! কিছু যেনো ভুল করে না ফেলে ও। বিছানায় শুয়ে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করতে লাগলো, এই সময় টুকু তাড়াতাড়ি পার করে দাও, মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো ও।

ইস , আর তো দু একদিনের ব্যাপার ছিলো আজকের দিনে এটা চোখে না পড়লেই হতো না! কি করে ও এখন! একটুও ভুল পদক্ষেপ ওর আর অর্কর সম্পর্কটা কে সারাজীবনের মতো শেষ করে দিতে পারে জানে ও! আজ যদি ও স্টুডেন্ট দের সামনে কোনো বোকামি করে ফেলে, অর্ক ওকে কোনো দিনও ক্ষমা করবে না, ওর সংসারটাই ভেঙে যাবে একদম।

চা করবে না?

অর্কর গলার স্বরে চমকে তাকালো দিতি, ও অর্কর দিকে তাকাতেই পারছে না,

আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, আজ তুমি একটু নিজেই করে নাও প্লিজ,

কথাগুলো বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো অদিতি, হটাৎ করেই খুব কান্না পাচ্ছে ওর।

অর্ক একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো, কিছু একটা হয়েছে অদিতির বুঝতে পারছে, এই কিছু হওয়া টাকেই ভয় পায় ও। এক্ষুনি স্টুডেন্টদের সামনে কিছু করে ফেলবে না তো! রীতিমত ভয় লাগছে এবার, সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করলো ও, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্টুডেন্ট দের দিকে তাকালো ও,

আমার ছেলের শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে, আজ আর হবে না, কাল কে একটু আরেকবার সবাই এসো এই সময় প্লিজ।

স্টুডেন্টরা বেরিয়ে যেতেই অদিতির সামনে দাঁড়ালো ও,

কি হয়েছে তোমার?

ওই মেয়েটা কে? তোমার গায়ে লেপ্টে বসেছিলো তোমার পাশে,

অর্কর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো অদিতি, অর্ক প্রমাদ গুনলো, উফফ আবার!

প্লিজ দিতি, এগুলো নতুন করে আবার শুরু কোরনা, ওখানে সবাই আমার স্টুডেন্ট। এই ধরনের কথা যদি একটুও ওদের কানে যায়, তাহলে কিন্তু আরও ছড়িয়ে যাবে তোমার সন্দেহবাতিক হওয়ার কথা!

অদিতি কে শান্ত করার চেষ্টা চালাতে লাগলো অর্ক।

বিশ্বাস করো আমি একদম সত্যি বলছি। তুমি দেখেছিলে, ওই মেয়েটার কাণ্ড দেখে অন্যরা কেমন মুচকি হাসছিলো,

কেউ হাসেনি দিতি, আবার এগুলো কল্পনা করছো তুমি, সবাই আমার পড়ানো শুনছিল, এখানে কেউ হাসতে আসেনি। ওদের পরীক্ষা সামনে, ওরা পড়া বুঝতে এসেছে আমার কাছে!

অদিতির পাশে বসে বললো অর্ক, হটাৎ করেই লজ্জা লাগলো অদিতির, ইস একটু আগেই ও ভেবেছিলো এগুলো নিয়ে কিছু বলবে না অর্ক কে, তাও আবার বলে ফেললো! কি যে করে ও!

সরি অর্ক, আমার ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না দেখো তুমি,

অর্কর হাত টা ধরে ফেললো দিতি, খুব লজ্জা লাগছে এখন,

ওদের আবার কালকে আসতে বলেছি, আজ কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি, সবে শুরু করেছিলাম, তুমি কাল কিন্তু ওদের দেখে এরকম আর কিছু করবে না, প্রমিস করো আমাকে,

প্রমিস,

ঘাড় নেড়ে বললো দিতি, ওকে শুয়ে পড়তে বলে সোফায় এসে বসলো অর্ক। এই প্রথম বার অদিতির সামনে স্বীকার না করলেও নিজের মনের মধ্যেই একটা অস্বস্তি হচ্ছে। অন্যরা হাসছিলো কিনা ও লক্ষ্য করেনি সেটা, কারণ মাথা নিচু করে পড়াচ্ছিলো ও, কিন্তু রিয়া মেয়েটা যে সত্যিই বার বার ওর গায়ের সাথে লেপ্টে আসছিলো, নিজেও সেটা ফিল করেছে ও। তাই বারবারই পাশে বসা ছেলেটার দিকে নিজেকে সরানোর চেষ্টা যে ও করছিলো সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এটা দিতি কে বুঝতে দেওয়া চলবে না একটুও, তাহলেই বিরাট অশান্তি বাধাবে ও। কাল দূরে গিয়ে আলাদা একা বসতে হবে, মনে মনে ঠিক করলো ও।

চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-৯+১০

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৯+১০
স্টেশনে খুব ভিড়, প্রচুর মানুষ এখানে বেড়াতে এসেছিলো বোঝাই যাচ্ছে, দিতি ভিড় বাঁচিয়ে সাবধানে একটা ধার ঘেঁসে দাঁড়ালো। ওদের নিজেদেরও প্রচুর লোকজন, গত কালের বৌভাত শেষে একসঙ্গে সবাই ফিরছে নিজেদের বাড়িতে, সব মিলিয়ে বেশ একটা হট্টগোলের সৃষ্টি হয়েছে। ট্রেনটা লেট করছে কিন্তু বসার কোনো জায়গা নেই স্টেশনে, দিতি চারদিকে তাকিয়ে বসার জন্যে একটু জায়গা খুঁজছিলো, কয়েকদিনের ধকলে শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।

ওর ঠিক পাশেই একটা বেঞ্চ যেখানে একটা কলেজ পড়ুয়াদের গ্রুপ বসে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বসে থাকা মেয়ে তিনটের দিকে তাকিয়ে ওদের একটু বসতে দেবার অনুরোধ করা যায় কিনা ভাবতে ভাবতেই অর্ক এসে দাঁড়ালো। ও এতক্ষন বাপ্পার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সবার জিনিসপত্র একজায়গায় গুছিয়ে রাখছিলো। অর্ক কে দেখেই গ্রুপের সবাই ওর দিকে ফিরে তাকালো, একটা ছেলে বললো,

স্যার কতো নম্বর কোচ?

অর্ক উত্তর দিলো সাত,

অদিতি কথোপকথন শুনেই ওদের অর্কর স্টুডেন্ট বলে বুঝতে পারলো। নিজের মনেই ও একটু অবাক হলো, হটাৎ দেখা হওয়ার মধ্যে যে ব্যাপারটা থাকে, সেই ব্যাপারটা ওদের কথার মধ্যে নেই। এটা যেনো জানাই ছিলো যে ওদের এখানে দেখা হবে! অর্ক কে ওর পাশে দাঁড়াতে দেখেই সম্ভবত অদিতির পরিচয় ওদের কাছে স্পষ্ট হলো, বসে থাকা মেয়েগুলোর মধ্যে একজন উঠে দাঁড়ালো,

ম্যাম, বসুন না!

অদিতি আর বেশি কিছু না ভেবে বসেই পড়লো, এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। অর্ক ততোক্ষনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর সঙ্গে গল্প করতে শুরু করেছিলো, অদিতি কে জায়গা ছেড়ে দেওয়া মেয়েটিও তাদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো। বেঞ্চটা বেশ ছোটো, তারমধ্যে প্রত্যেকের কাছেই যথেষ্ট জিনিসপত্র রয়েছে, অদিতি নিজের হাত ব্যাগ টা কোলে নিয়েই বসলো। পাশে বসে থাকা মেয়েটি সম্ভবত অদিতি কে ঠিক ভাবে বসতে দেওয়ার জন্যে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে মনোনিবেশ করলো। দিতি খুব অস্বস্তিতে পড়লো, ও আসায় যে ওদের কে জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে এটা বুঝেই ও মেয়েটার দিকে তাকালো,

আরে! তুমি উঠলে কেনো! আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না!

মেয়েটি মিষ্টি হাসলো,

ঠিক আছে ম্যাম! আপনি বসুন না! আমরা অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছি, একটু দাঁড়াতে ভালোই লাগবে!

এরপরে আর কিছু বলার ছিলো না, থ্যাংক ইউ বলে, অদিতি নিজেও নিজের মোবাইলের দিকে তাকালো। গ্যালারি খুলে বিয়ের ফটো গুলো দেখছিলো, হটাৎ করেই পাশ থেকে একটা গলা খুব আস্তে করে বললো,

এই সেটটা ভালো হয়েছে না ম্যাম? আমি চয়েস করে দিয়েছিলাম।

চমকে উঠে পাশের মেয়েটার দিকে তাকালো অদিতি, মেয়েটা তখন ওর গ্যালারির দিকে ইশারা করছে। মেয়েটার ইশারা লক্ষ্য করে ফটোর দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলো দিতি, এটা তো সেই গয়নাগুলোর একটা যেটা অর্ক হাট থেকে কিনে এনেছিলো! এতো ভালো লেগেছিলো, তখনই পরে ফটো তুলেছিলো ও! কিন্তু এই মেয়েটা সেটা পছন্দ করলো কিভাবে! অর্ক কি তাহলে ওকে মিথ্যে কথা বললো!

আর কিছু ভাবার আগেই ট্রেন চলে এলো, কয়েক মিনিটের তাড়াহুড়োর মধ্যেই ও শুধু মেয়েটাকে নাম জিজ্ঞেস করতে পারলো, মেয়েটা তড়িঘড়ি জিনিসপত্র কাঁধে তুলতে তুলতে জবাব দিলো, রিয়া।

নিজেদের সিটে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো, বাপ্পা কে হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে অর্ক নিজের সিটে এসে বসতে গিয়ে লক্ষ্য করলো অদিতি গম্ভীর মুখে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে।

কি হলো তোমার?

একটু ভীত গলায় প্রশ্ন করলো অর্ক, দিতি র এই থমথমে মুখ কেই ও খুব ভয় পায়। অদিতি ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো, তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

আমার গয়নাগুলো তুমি নিজে পছন্দ করে কিনেছো?

আমি নিজে পছন্দ করেছি বলে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না! হটাৎ এ প্রশ্ন নতুন করে কেনো?

অবাক গলায় বললো অর্ক,

কারণ স্টেশনে বসে থাকা তোমার ছাত্রীদের মধ্যে একজন আমাকে বললো, সে এগুলো চয়েস করে দিয়েছে! ও কি করে পছন্দ করলো? কোথায় দেখা হলো তোমার সঙ্গে?

এবার অর্কর বিরক্ত লাগলো, একটা সাধারণ বিষয় কে নিয়ে অদিতি এতো প্রশ্ন করছে!

হাটে দেখা হয়েছিলো ওদের সঙ্গে, ওরা এখানে বেড়াতে এসেছিলো বন্ধুরা মিলে। আমি যে দোকান থেকে এগুলো কিনছিলাম, সেখানে ওরাও ছিলো। আমাকে এগুলো কিনতে দেখে তিয়াসা দু একবার মতামত দিয়েছিলো এইটুকুই, এর বেশি কিছু নয়। তার মানে এই নয় যে তিয়াসা এগুলো আমাকে পছন্দ করে দিয়েছিলো!

গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো অর্ক, অদিতি লজ্জা পেলো একটু। ও বড্ড বেশি ভেবে ফেলে! তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে লজ্জিত গলায় বললো,

সরি! আমি সেইভাবে কিছু বলতে চাই নি! আসলে তুমি বলেছিলে তুমি নিজে পছন্দ করেছো, আর রিয়া আমাকে বললো যে ও নাকি পছন্দ করে দিয়েছে! তাই জানতে চাইছিলাম!

অদিতি কে কথা শেষ না করতে দিয়েই থামিয়ে দিলো অর্ক,

তুমি ভুল করছো, ওর নাম তিয়াসা, রিয়া নয়!

অদিতি একটু অন্য মনস্ক হলো, এতো ভুল শুনলো ও! যদ্দূর মনে পড়ছে মেয়েটা নিজের নাম তো রিয়াই বলেছিলো! একটু চুপ করে থেকে বললো,

তোমার সঙ্গে যে ওদের দেখা হয়েছিলো, তুমি বলো নি তো আগে সেটা!

এটা আবার এমন কি গুরুত্বপূর্ন বিষয় যে মনে রেখে তোমায় বলতে হবে! আর তুমি তো ওদের কাউকেই চেনো না, তাই বলা না বলায় কি বা এসে যায়!

তুমি জানতে ওরা এখানে আসবে?

অর্কর গলার স্বরে বিরক্তি লক্ষ্য করেও অদিতি আবার প্রশ্ন করলো, এবার অর্ক ধৈর্য্য হারালো, একটু রুক্ষ গলায় বললো,

না, জানতাম না! ওরা আমার স্টুডেন্ট, ওদের পড়াশুনার বাইরের খবর আমি রাখি না! কাল হটাৎ করেই হাটে দেখা হয়েছিলো, তখন ওরা বলেছিলো আজ ওরাও ফিরবে! ব্যাস এইটুকুই! আর কিছু জানার আছে তোমার?

অর্কর কড়া গলা এবার অদিতি কে থামিয়ে দিলো, অদিতির এবার লজ্জা লাগছিলো, অহেতুক সাধারণ ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য তৈরি হোক সেটা আর চাইছিলো না। অর্ক মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলো, দিতি এতো সব ব্যাপারেই পুলিশি জেরা করতে শুরু করে যে, মাঝে মাঝে ওর অসহ্য লাগে। সামান্য একটা গয়নার কথা থেকে কতো কথায় চলে গেলো। তিল কে তাল করতে ওর জুড়ি মেলা ভার। তাও যে অল্পের ওপর দিয়ে গেলো সেও ভালো, নাহলে এতো সুন্দর বেড়ানোটা একদম নষ্ট হয়ে যেতো। অর্ক কে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষন পরে অদিতি নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে করে ওর হাতের ওপর চাপ দিয়ে একটু মজার গলায় বললো,

রেগে গেলে নাকি! আমার ওপর না তিয়াসার ওপর?

তিয়াসার্ ওপর! কেনো?

অর্ক গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, অদিতি মুচকি হাসলো,

ওই যে! অর্ক মিত্রর ক্রেডিট টা নিয়ে নিলো যে!

এবার অর্ক হেসে ফেললো,

ফেল করিয়ে দেবো ওকে দেখো!

অনির্বাণ সবে আরাম করে হেলান দিয়ে সিটে বসেছিলো, উল্টোদিকের সিটে বসে থাকা তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলো! তিয়াসা ওকে মোবাইলের দিকে দেখতে ইশারা করছে! মোবাইল টা খুলতেই হোয়াটসঅ্যাপে তিয়াসার মেসেজ দেখলো,

একটু বাইরে চল, কথা আছে,

কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে বাথরুমের পাশে হাতে একটা সিগারেট নিয়ে দাঁড়ালো অনির্বাণ, কয়েক মিনিট পরে তিয়াসা কে উঠে দাঁড়াতে দেখে বন্ধুদের মধ্যে একটু মুচকি হাসি ছড়িয়ে পড়লো। তিয়াসা সেটা কে ইগনোর করে বাইরে বেরিয়ে এলো, ওকে দেখেই অনির্বাণ চিন্তিত মুখে তাকালো,

কি হয়েছে? এইভাবে মেসেজ করে বাইরে ডাকলি?

রিয়াটা কি মিথ্যে কথা বলে রে! স্যারের বউ কে বেমালুম মিথ্যে বলে দিলো! ও নাকি হারটা পছন্দ করে দিয়েছে!

রীতিমত উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো তিয়াসা, অনির্বাণ একটু থতমত খেলো,

কিসের হার? কি বলছিস কিছুই তো বুঝতে পারছি না!

ধ্যাত! তোকে কিছু বলতে যাওয়াই বৃথা! কাল হাটে যখন স্যারের সঙ্গে দেখা হলো, তখন স্যার গয়নাগুলো কিনছিলেন মনে নেই?

বিরক্ত গলায় বললো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে! তুই তো দু একটা সাজেস্টও করেছিলি? তাই না?

এবার খুশি হলো তিয়াসা,

হ্যাঁ, সেটাই তো! অথচ ম্যাম কে কিরকম মিথ্যে বলে দিলো রিয়া! ও নাকি ওগুলো পছন্দ করেছে!

অনির্বাণ হেসে ফেললো,

তাহলে তোর রাগের কারণ কোনটা? রিয়ার মিথ্যে বলা নাকি তোর ক্রেডিট নিয়ে নেওয়া!

তিয়াসা গম্ভীর মুখে চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো, এবার অনির্বাণ সিরিয়াস হলো,

তুই তো রেগে গেলি! আমি জাস্ট এমনই বলেছিলাম!! আরে, রিয়া যে মিথ্যে বলে এটা কি নতুন কোনো কথা বল? লাস্ট তিন বছরে কতো মিথ্যে বলেছে বলতো! এগুলো নিয়ে এতো ভাবিস না, ও আসলে ম্যাম কে ইমপ্রেস করে স্যারের ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করছে!

তিয়াসা মাথা নাড়লো,

না রে! ম্যাম কিন্তু একটুও খুশি হন নি! কিরকম অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন!

তুই কি করে জানলি?

আমি পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম তো, ওই টুকু বেঞ্চে অতো লাগেজ নিয়ে তিনজনে বসা যায়! ম্যাম নিজের ফোনের গ্যালারিতে ছবি দেখছিলেন, রিয়া তখন একটা ফটো দেখিয়ে খুব আস্তে করে কথাটা বলছিলো, যাতে আমি শুনতে না পাই!

অনির্বাণ হাসলো,

সেতো আস্তে বলবেই! না হলে তো, তোকে ক্রেডিট দিতে হবে!

ক্রেডিট চাই না! কিন্তু অহেতুক মিথ্যে কথা শুনলে কিরকম মাথা গরম হয়ে যায় যেনো! আমি ওকে ছাড়বো না, সবার সামনে ওকে জিজ্ঞেস করবো!

রাগের গলায় বললো তিয়াসা, অনির্বাণ অবাক দৃষ্টিতে তাকালো,

তোর হলো কি! ছাড় না এসব! ওকে বলে কোনো লাভ আছে! ওটা ওর স্বভাব হয়ে গেছে! এখন কি আর তুই বদলাতে পারবি?

তিয়াসা চুপ করে গেলো, অনির্বাণ ঠিকই বলেছে! সামান্য এইটুকু কথার জন্যে সিন ক্রিয়েট করে লাভ নেই!

শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পরে প্রায় মাস দুয়েক কেটে গেলো, দিতির ডেলিভারির দিন প্রায় এসে গিয়েছিলো, এমন সময় একদিন কলেজে আসার সময় অরিন্দম গাড়ির ধাক্কায় পা ভাঙলো। সামনেই কলেজের এক্সকারসন ছিলো, অরিন্দমের সঙ্গে যাবার কথা ছিলো, এই অবস্থায় সব কিছু অন্য রকম হলো। প্রিন্সিপাল অর্ক কে ডেকে পাঠালেন,

প্লিজ তুমি একটু সঙ্গে যাও! আমার নিজেরই তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অন্য কাউকে পাচ্ছি না।

অর্ক চিন্তায় পড়লো, অদিতি কে একা ফেলে এই অবস্থায় যাওয়া ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় বলে, ও আগে থেকেই প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলো। তিনিও রাজি হয়েছিলেন তখন, কিন্তু এই পরিস্থিতি যে আসতে পারে সেটা কেউ ভাবতেই পারে নি। বাধ্য হয়েই অর্ক সম্মতি জানালো,

ঠিক আছে স্যার, আমি কিছু ব্যবস্থা করছি!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে মেট্রোতে এটাই শুধু মাথায় ঘুরতে লাগলো, এখন ও কি করে! অদিতি যা অভিমানী, এই সময় ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার কথা ও কিভাবে নেবে কে জানে! রাতে খেতে বসে এই প্রসঙ্গ তুললো অর্ক,

আজ প্রিন্সিপাল স্যার ডেকেছিলেন আমাকে, অরিন্দমের অবস্থা তো জানো! আমাকেই হয়ত যেতে হবে এক্সকারসনে, জানি তোমার খুব অসুবিধা হবে, কিন্তু কিছু করার নেই দিতি!

দিতি চুপ করে থাকলো, অর্ক মনে মনে চিন্তিত হচ্ছিলো। বিরাট কিছু অশান্তির আশঙ্কা করছিলো। কিন্তু একটু পরে নিজের থেকেই বললো দিতি,

মা, বাবা কে এখানে আসতে বলি তাহলে? আর তো অন্য কিছু মাথায় আসছে না আমার, যেতে যখন হবেই তখন এদিকটা একটু গুছিয়ে নিতে হবে তো?

অর্ক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো! দিতি যে এতো সহজে এটা মেনে নেবে ও ভাবতেও পারেনি। ও তাড়াতাড়ি মা কে ফোন করলো, রুমা সমরেশ কে নিয়ে যাবার আগের দিনই চলে আসবেন বলে কথা দিলেন। সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হলো আপাতত।

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১০
দিন চারেক আগে রাতের ট্রেনে স্টুডেন্টদের নিয়ে এক্সকারশনে এসেছে অর্ক, আরো দুজন টিচার সঙ্গে আছেন যদিও, কিন্তু তাঁরা একটু বয়স্ক, তাই ছাত্র, ছাত্রীরা ওর কাছেই বেশি আবদার করে। কদিন ধরেই রীতিমত হৈ হুল্লোড় চলেছে, আগামী কাল রাতে ফিরে যাবার পালা। তাই আজ ব্যাগ গুছিয়ে, সব কিছু ঠিক করে রেখেছে ও।

ওর যাওয়ার আগের রাতেই রুমা এবং সমরেশ এসে গিয়েছিলেন, ওনাদের দেখে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছে দুজনেই। অর্ক বারবার করে দিতি কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে, এই কদিন যেনো একটু বেশি সাবধানে চলাফেরা করে ও। দিতি র মনের মধ্যেও একটু টেনশন হচ্ছিলো, যতোই হোক এখানের কিছুই শ্বশুর, শাশুড়ি চেনেন না। তাও অর্ক কে বুঝতে দেয়নি কিছু, ও বেচারা আরো টেনশন করবে।

পিচ রাস্তা থেকে নেমে ডান দিকের পায়ে চলা পথটা একদম হোটেলের সামনে দিয়ে নদীর ধারে গিয়েছে। ভোরের সূর্যের প্রথম আলো অল্প অল্প গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওপরে পড়ছে, এই সময় টা খুব ভালো লাগে অর্কর। আশেপাশের সব ঘরের দরজা বন্ধ, ছাত্র ছাত্রীরা কেউই ঘুম থেকে ওঠেনি বোঝা যাচ্ছে, অর্ক আস্তে আস্তে নেমে এসে রাস্তায় পা রাখলো।

নদীর ধার বরাবর পর পর কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ, অন্য সময় ভর্তি থাকলেও এতো ভোরে সব গুলোই খালি। তারই একটাতে বসে পড়লো অর্ক। ঠিক ওর পেছনেই ওদের হোটেলটা, সব কটা ঘর থেকেই নদীটা দেখা যায়। দিতি এখন কি করছে কে জানে! এতো ভোরে তো ঘুম থেকে ওঠেনি নিশ্চয়ই! তবু এই পরিবেশে বসে ওর খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে দিতির সঙ্গে, একটু ভেবে ফোনটা করেই ফেললো অর্ক।

অর্ক যাওয়ার পর থেকেই রাতে ভালো করে ঘুম হচ্ছে না দিতির, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব সব সময়। শুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে ও, অর্ক না থাকাকালীন যেনো কিছু না হয়। ভোরের দিকে সবে মাত্র একটু চোখ টা বুজে এসেছিলো, এমন সময় অর্কর ফোন এলো। গলাটা শুনেই মনটা ভালো হয়ে গেলো দিতি র।

জায়গাটা খুব সুন্দর না?

খুব উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করলো দিতি,

খুব সুন্দর, কিন্তু এতো দায়িত্ব যে উপভোগ করার সময় নেই। তোমার জন্যেও খুব টেনশন হচ্ছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? সবাই যদি আসতে পারতাম তবেই এনজয় করতে পারতাম,

অর্কর কথায় খুশি হলো দিতি, ও ও তো যেতে চায়, কিন্তু উপায় কই!

আজ রাতের ট্রেনে উঠছি, তারপর আর কোনো চিন্তা নেই। আজকের রাতটা একটু সাবধানে থেকো,

দিতি জবাব দিলো থাকবে। ও যে নিজে কতটা টেনশনে আছে সেটা তো আর অর্ক জানে না!

কতক্ষন থেকে একা বসে আছি, আর কতক্ষন ওয়েট করবো?

কথা বলতে বলতে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলো দুজনেই, হটাৎ করেই ফোনের ওপাশের নারী কন্ঠ অদিতি কে চুপ করিয়ে দিলো। কেউ অর্কর ফোনে কথা শেষ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে! কে সে! অর্ক কি তাহলে ওখানে একা নেই! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একগাদা প্রশ্ন অদিতির মাথার মধ্যে ঘোরা ফেরা করতে লাগলো।অর্ক চমকে ফিরে তাকালো, ও তো কারোর সঙ্গে আসেনি! ওর জন্যে আবার কে অপেক্ষা করবে! ঘুরে তাকিয়েই অর্ক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, ওর ঠিক পাশের বেঞ্চে রিয়া বসে ফোনে কথা বলছে, বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করছে বোধ হয়!

ততোক্ষনে দিতি ধৈর্য্য হারিয়েছে, একের পর এক প্রশ্নবাণ অর্কর দিকে ধেয়ে এল সঙ্গে সঙ্গেই,

তোমার সঙ্গে কে আছে?

অর্ক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, অদিতি যা! এক্ষুনি না ভুল বুঝে ফোনের মধ্যে উল্টোপাল্টা কথা শুরু করে! নদীর ধার বরাবর হেঁটে যেতে যেতে একটু নিচু গলায় বললো,

আমার স্টুডেন্ট, ও ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে, বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করছে বোধহয়।

বাবা! একেবারে তোমার পাশে বসেই ফোনে কথা বলছে! কে সে? সামান্য সভ্যতা ভদ্রতা নেই! একজন কথা বললে একটু দূরে গিয়ে কথা বলতে হয় এটকুও জানে না!

বিরক্ত গলায় বললো অদিতি, অর্ক তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে তাকালো। কেউ শুনতে পেলো না তো! দিতি যা চিৎকার করে বলছে! অদিতি আবার জিজ্ঞেস করলো,

কে সে? বললে না তো?

চারপাশ দেখে নিয়ে গলাটা একটু নামিয়ে উত্তর দিলো অর্ক,

রিয়া।

অদিতি একদম চমকে গেলো, এই মেয়েটা কেই তো দেখেছিলো ও! যদিও অর্ক একটা অন্য নাম বলেছিলো, নামটা এখন আর মনে নেই।

ও ওখানে কখন এলো? বলোনি তো?

আমি নিজেই জানিনা কখন এসেছে! আমি তো তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম, খেয়াল করিনি। আর ও কখন এসেছে তাতে আমাদের কি এসে যায়? তুমি যা বলছো বলো না, আমি ওখান থেকে উঠে এসেছি,

বলতে বলতে হোটেলের রাস্তায় এগিয়ে গেলো অর্ক। মনে মনে নিজেও একটু বিরক্ত হলো, মেয়েটা এতো জোরে ফোনে কথা বলে যে, যে কেউ শুনলে ভাববে পাশের কারোর সঙ্গে কথা বলছে। যখন হোটেলের গেট দিয়ে ঢুকছে তখন ওর কৌশিকের সঙ্গে দেখা হলো, ও ফোনে কথা বলতে বলতেই নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছে। অর্ক বুঝলো রিয়া সম্ভবত ওর সঙ্গেই কথা বলছিলো, আর বেশি কিছু না ভেবে ও নিজের ঘরে ঢুকে গেলো।

একা একা এখানে বসে আছিস?

রিয়ার পাশে বসতে বসতে বললো কৌশিক, রিয়া ঘাড় নাড়লো,

আমার একা ভালো লাগে।

তাহলে আর আমাকে ডাকলি কেনো? একাই তো ভালো থাকিস তুই!

তা নয়! এই পরিবেশে একা বসে থাকতে ভালো লাগে, মনে হয় এখানেই থেকে যাই! বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না!

উদাস গলায় বললো রিয়া, কৌশিক হেসে ফেললো,

তুই এখানে থেকে যাবি? ভালোই তো! তোর বাবার তো পয়সার অভাব নেই! একটা জায়গা কিনে ফেলতো। বেশ আমরাও মাঝে মাঝে এসে থাকবো!

রিয়া কৌশিকের দিকে খুব করুন দৃষ্টিতে তাকালো,

মজা করছিস! আমি কিন্তু করছি না! বিশ্বাস কর আমার বাড়ি ফিরতে সত্যি ইচ্ছে করে না!

এবার কৌশিক সিরিয়াস হলো, একটু চুপ করে থেকে বললো,

তুই তো কোনোদিনও সেই ভাবে কোনো কিছু শেয়ার করিস নি আমার সঙ্গে! আজ পর্যন্ত তোর সঙ্গে মেট্রো থেকে নামা সত্বেও তোর বাড়িতে কোনোদিনও ডাকিস নি। শুধু তোর বাবার কথা শুনেছি, কাকু, কাকিমা কাউকেই দেখিনি আজ পর্যন্ত!

গিয়ে কি করবি! তোর ভালো লাগবে না! আমাদের বাড়িতে জানিস তো সব সময় অশান্তি হয় বাবা মায়ের মধ্যে। আর তাছাড়া বাবা কিরকম তোকে তো বলেইছি! ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে না!

কি নিয়ে এতো সমস্যা তোদের? প্রশ্নটা একটু পার্সোনাল হয়ে গেলো না?

কথাটা বলেই লজ্জায় পড়লো কৌশিক, রিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মৃদু গলায় বললো,

হ্যাঁ, সব কথা বলতে চাইলেও বলা যায় না রে! আমি যেগুলো তোকে বললাম, আর কাউকে বলিস না প্লিজ! তোকে অনেক কিছু তাও বলতে পারি, কিন্তু সবাই কে সেটাও পারিনা! আমি খুব বেশি ভালো নেই রে!

এভাবে কেনো ভাবছিস! অশান্তি তো সব বাড়িতেই কম বেশি হয় তাই না? তাই বলে তুই ভালো থাকবি না কেনো?

তুই জানিস না! এই যে বাবার জন্যে তোদের কে বাড়িতে ডাকতে পারিনা বা গাড়ি নিয়ে কোথাও যেতে পারি না, এটা কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই ভাবে আমি মিথ্যে কথা বলি!

রিয়ার গলায় মন খারাপের সুর শুনে কৌশিকের খারাপ লাগলো, খানিকটা আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো,

এটা ঠিক নয়! এরকম কেউ ভাবে না! তুই এগুলো নিজেই ভাবছিস! আমি জানি তুই হয়তো কোনো কোনো সময় তিয়াসার কথা শুনে এটা মনে করেছিস, তবে এটা আমাদের সবার কথা নয়। আসলে তিয়াসার রাগের কারণ অন্য, যদি আমরা অনির্বাণের গাড়ি নিয়ে যেতে চাই তাই!

জানিনা কেনো ও আমাকে পছন্দ করে না! আমি তো কোনোদিনও ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি! আমি ঠিক করেছি মনে মনে, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমি আর কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো না!

এটা কি আমার জন্যেও প্রযোজ্য? পারবি করতে এরকম?

একটু দুঃখের গলায় বললো কৌশিক, রিয়ার চোখ ছলছল করছিলো।

পারবো! জানিস তো, আজ পর্যন্ত আমি যাদের ভালো চেয়েছি, ভালো বেসেছি, তারা সবাই আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছে! তারা কেউ আমার কথা ভাবে নি! তাই আমিও এখন কারো কথা ভাবি না! কেনো ভাববো বলতো? একতরফা আমিই কেনো কষ্ট পাবো সব সময়!

সে তুই দু একজনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতেই পারিস, কিন্তু তাই বলে সবার সঙ্গেই করিস না। কেউ তোকে ভালোবাসে না, এটা ঠিক না! কাকু একটু কড়া হয়তো কিন্তু ভালো তোকে নিশ্চয়ই বাসেন!

কৌশিকের কথায় মাথা নাড়লো রিয়া, খুব থেমে থেমে বললো,

না রে বাসেনা! আগে হয়তো বাসতো, কিন্তু এখন আর ভালোবাসে না! এমনকি মাও তাই! আমি বাবা কে বেশি ভালোবাসি বলে মায়ের রাগ হয়, মায়ের সঙ্গে যেহেতু বাবার বনে না, তাই আমি যেনো বাবার সঙ্গে বেশি কথা না বলি, এটা মায়ের ইচ্ছে! যাকগে! ওসব বেশি ভাবিনা আর, কয়েকটা মাস, তারপরে বাইরে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাবো।

নদীর ওপারের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলো রিয়া, আর কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষন পরে কৌশিক আস্তে আস্তে বললো,

এতো কিছু জানতাম না রে! আগে তো কোনোদিনও বলিস নি, শুনে খারাপ লাগছে! সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না, এরকম অনেকেরই হয়।

রিয়া ঘাড় নাড়লো,

কিচ্ছু ঠিক হবে না আর। তবে এটা ঠিক যে অনেকেরই হয়। আমি যখন এখানে এলাম তখন অর্ক স্যার বউয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। জানি না কি নিয়ে রাগারাগি হলো, স্যার উঠে চলে গেলেন যাতে আমি শুনতে না পাই!

কৌশিক কৌতূহলী হলো,

তুই কি করে বুঝলি বউয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন?

রিয়া হাসলো,

কি যে বলিস! বউ না বন্ধু সেটা কথার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় না নাকি!

চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-৭+৮

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৭+৮
বেল বাজার আওয়াজে চমকে খাটে উঠে বসলো দিতি, বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেনো চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। কাল বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই অর্ক ওর সঙ্গে একটাও কথা বলে নি, রাতে অন্য ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলো! কিন্তু ওই বা কি করবে! ও তো আর পাগল নয় যে অহেতুক বানিয়ে বানিয়ে অর্ক কে তার বাবা মায়ের সামনে ছোটো করতে চাইবে! অর্ক কে ছোটো করা মানে যে নিজেকেও ছোটো করা সেটা কি ও বোঝে না!

এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই দ্বিতীয় বার বেলটা বেজে উঠলো, এবার বেশ কয়েকবার একসঙ্গে, অদিতি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। খাট থেকে মাটিতে পা দিতেই মাথাটা হালকা একটু ঘুরে গেলো, শরীরটা খুব দূর্বল লাগছে, বেডরুমের দেওয়ালটা ধরে ফেললো অদিতি। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই, এবার বেলটা একটানা বেজে যাচ্ছে, কেউ অধৈর্য্য হয়ে বারবার বেল টিপছে, কোনরকমে দেওয়াল ধরেই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললো অদিতি।

অর্ক আর ধৈর্য্য রাখতে পারছিলো না, প্রায় মিনিট পনেরো ধরে বেল বাজানোর পরেও যখন অদিতি দরজা খুললো না তখন ওর হটাৎ করেই ভীষণ ভয় লাগলো। ওর কি শরীর খারাপ হলো হটাৎ! না হলে এই ভর সন্ধ্যেবেলা একটা মানুষ এতো ঘুমোতে পারে নাকি! কি করা উচিৎ এই ভাবনার মধ্যেই অদিতি দরজা খুললো, নিজের অজান্তেই অর্কর গলা থেকে উৎকণ্ঠার আওয়াজ বেরিয়ে এলো,

দরজা খুলছিলে না কেনো? শরীর খারাপ নাকি!

দেওয়াল ধরেই ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়লো অদিতি, অর্কর একটু অস্বাভাবিক লাগলো। ও আস্তে আস্তে পেছনে পেছনে ঢুকে এলো। হাত, মুখ ধুয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসা চাইনিজ এর প্যাকেটটা দুটো প্লেটে ঢেলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো অর্ক, অদিতি একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।

নাও, খেয়ে নাও, তোমার পছন্দের জিনিস, দিদির রান্না গুলো আমি ফ্রিজে তুলে রেখেছি,

যেনো দুদিন ধরে কোনো কিছুই ঘটেনি এমন ভঙ্গিতে বললো অর্ক, একটু চুপ করে থেকে অদিতি প্লেটের দিকে হাত বাড়ালো।

তোমার শরীর কি খুব খারাপ? বাপ্পার বিয়েতে যেতে পারবে না?

খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলো অর্ক।

শরীর খারাপ তবে যেতে পারবো না এমন নয় এখনও, চেষ্টা করবো যেতে, ও অনেক বার বলেছে আমাকে,

অদিতির কথায় অর্ক একটু নিশ্চিন্ত হলো। আগামী মাসে ওর মাসতুতো ভাইয়ের বিয়ে, অনেকদিন ধরেই যাওয়ার ঠিক হয়ে আছে, এখন এই পরিস্থিতিতে অদিতি যদি না যেতে রাজি হতো তাহলে আবার মাসী কে কিছু মিথ্যে কথা বলতে হতো।

ও আসলে আমাকেও অনেক বার ফোন করেছে সেই কবে থেকে, আমি ওকে কথাও দিয়েছি আসবো বলে। কিন্তু তুমি না গেলে তোমাকে একা রেখে তো যেতে পারবো না, তাই তোমার শরীর যদি ভালো না থাকে তাহলে ওকে জানিয়ে দেবো না হয়।

অর্কর কথায় একটু খুশি হলো অদিতি, যাক! তাহলে ও ওকে নিয়েই যেতে চায়। কিন্তু এখনই কিছু বলবে না ও, এমনও হতে পারে শুধুই বিয়ের অনুষ্ঠান টা একসঙ্গে বাধ্য হয়ে কাটানোর জন্যেই ও দিতি কে ম্যানেজ করতে চাইছে।

সে তো এখন দেরি আছে, তখন যদি ভালো থাকি তাহলে যাবো,

ইচ্ছে করেই বললো অদিতি,

দেরি আর কোথায়! আমি ভেবেছিলাম আমাদের শান্তিনিকেতন তো যাওয়া হয়নি, দুদিন আগেই যেতাম তাই। শনিবার কলেজ করে চলে যেতাম, তাহলে বিয়ের আগে দুদিন ঘুরে নিতাম একটু, কিন্তু তোমার শরীর ভালো না থাকলে তো ঘুরতেও ভালো লাগবে না

এবার একটু ভাবলো অদিতি, ওর নিজেরও শান্তিনিকেতন যাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিন থেকেই, ওরা দুজনেই অনেকবার ভেবেছিলো যেহেতু মাসিরা বোলপুরে থাকেই তাই ওদের বাড়িতে গেলে ঘুরে আসবে। কিন্তু প্রায় বছর খানেক ধরে সেটা প্ল্যান হয়েই থেকে গেছে শুধু, এই সুযোগে সেটা হলে খুব খারাপ হবে না। আর অর্কর সঙ্গেও সম্পর্কটা ভালো হবে হয়ত।

যাবে তো?

অদিতি কে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো অর্ক, অদিতির ডিসিশনের ওপরে সবটাই নির্ভর করছে। ও সত্যিই ভেবেছে বেড়ানোর কথা, এর থেকে ভালো সুযোগ আর আসবে না কখনো। এখন দিতি যদি না যেতে চায়, তাহলে ওর প্ল্যানটা সম্পূর্ন পাল্টে যাবে, ও ভেবেছিলো বেড়াতে গেলে দিতি র মন টাও ভালো হয়ে যাবে, আগামী দিনগুলোতে আর কোনো ঝগড়া রাখতে চায় না ও।

একবার একটা ভুলের জন্যে তো আর সারাজীবনের মতো অশান্তি টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না! আর একই রকম কথা ও ও বলেছে সেদিন, তাই এবার এই পর্ব টা শেষ করতে চাইছিলো ও। এই যে দুজনে দু ঘরে শুয়েছিলো কাল, তাতে ও ও তো ভালো থাকে নি, ওর নিজেরই তো রাগ কমে আসার পর থেকেই উঠে চলে আসতে ইচ্ছে করেছে রাতে এঘরে, কিন্তু নিজের ইগো সরিয়ে সেটা করা সম্ভব হয়নি। আজ সাথীর কথা শোনার পর ও এগুলো ভুলে যেতে চাইছে। আর ইগো নিয়ে বসে থাকলে চলবে না, দিতির মনের কথাটাও ভাবতে হবে। এই বেড়াতে যাওয়ার সুযোগে যদি এগুলো মিটমাট হয়ে যায় ক্ষতি কি!

কি হলো বললে না কিছু! তাহলে আমি কাল সকালেই ফোন করে দিতাম বাপ্পা কে।

বলতে বলতে খাটে বালিশ টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো অর্ক। গত কাল রাতে ও আলাদা ঘরে ছিলো, অদিতি ঠিক করেই নিয়েছিলো আর নিজে থেকে এঘরে ডাকবে না অর্ক কে, আজ ওকে নিজে এসে শুতে দেখে খুশি হলো ও, তারমানে অর্ক সত্যি সবকিছু ঠিক করে নিতে চাইছে!

যাবো, ফোন করে দিও বাপ্পা কে,

লাইট নিভিয়ে দিয়ে অর্কর পাশে শুয়ে পড়লো দিতি, অর্কও খুশি হলো, ওর ধারণা ছিলো ওকে এই খাটে শুয়ে পড়তে দেখে দিতি নিশ্চয়ই কিছু বলবে। কিন্তু ওকে চুপ করে শুয়ে পড়তে দেখে বুঝলো ও ও মিটিয়ে নিতেই চাইছে গন্ডগোল, তাই মিটিয়ে নেওয়ার এই সুযোগটা ও একটুও নষ্ট করতে চাইলো না ও, পাশ ফিরেই জড়িয়ে ধরলো অদিতি কে।

পরের দিন সকালে চায়ের টেবিলে বসে অদিতি কে অনেকটাই স্বাভাবিক লাগছে দেখে একটু দোনোমনো করে প্রসঙ্গটা তুলেই ফেললো অর্ক,

তুমি কি এখনো আমার ওপরে রেগে আছো দিতি?

অদিতি মাথা নাড়লো, আস্তে আস্তে বললো,

রাগ নয় আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো, ওই ফোনটা এলো আর তার ঘন্টাখানেক পর থেকেই তুমি আর আমার ফোন রিসিভ করলেনা। এমনকি রাতের দিকে বন্ধও করে দিলে! সবটা মিলিয়েই মনে হচ্ছিলো তুমি আমাকে অ্যাভয়েড করতে চাইছো!

বিশ্বাস করো, সত্যি আমি ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তুমি দিদি কে জিজ্ঞেস করো, আমি পরের দিন ওকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। অথচ তুমি ফোন না ধরলে টেনশন করো বলেই আমি কিন্তু সত্যি এবার খুব সতর্ক ছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে ক্লাসের পরে আমি সাইলেন্ট মোডে রাখিনি আর, এমনকি বাড়িতেও ওটা সোফার ওপরেই ছিলো। তাও কি করে যে হলো! যাকগে, ছেড়ে দাও, আর কোনোদিনও হবে না! সরি!

অদিতি খুশি হলো, অর্কর হাতটা ধরে বললো,

আমারও ভুল হয়ে গেছে, বাইরের কারোর কথায় আমি কেনো যে তোমাকে ভুল বুঝলাম! কিন্তু এরকম একটা ফোন কে আমাকে করলো বলোতো? যদি রান্ডম কল করে কেউ মজা করতো, তাহলে সে তোমার নাম জানতো কি করে? এটাই না আমার খুব আশ্চর্য্য লাগছে!

অর্ক এই সুযোগের অপেক্ষাই করেছিলো, অদিতির হাতটা ধরে রেখেই বললো,

জানো তো, আজ মেট্রোতে ফেরার সময় অরিন্দমের এক বন্ধুর সঙ্গে হটাৎ দেখা হলো। ভদ্রমহিলার নাম সাথী, অরিন্দম পরিচয় করিয়ে দিলো, উনি নাকি সাইকোলজিস্ট, খুব ভালো কাউন্সিলিং করেন। তোমার প্রেগন্যান্সির কথা শুনে কথায় কথায় বললেন যে, এই সময় নাকি কারো কারো মুড সুইং, ডিপ্রেসন এসব হতে পারে। তুমি কি ওখানে একা একা খুব ডিপ্রেসড ফিল করছিলে দিতি?

দিতি একটু চুপ করে থাকলো, তারপর বললো,

এমনিতে তো কোনো অসুবিধা ছিলো না, তবে মা তো আমাকে কিছুই করতে দিতো না, তাই সারাদিন শুয়ে শুয়ে একটু বোর হচ্ছিলাম তো বটেই।

এখানেও তো সেটাই হবে তাই না? আমি কলেজে চলে যাবো, তোমার তো আবার সারাদিন একা কাটানো মুশকিল হয়ে যাবে! একা একা থাকলেই মনের মধ্যে আজেবাজে চিন্তা আসবে! সাথী বলছিলো, তোমার যদি খুব ডিপ্রেসড লাগে তাহলে তুমি ওর সাথে কথা বলতে পারো, নাহলে হয়তো পরে আরো বেড়ে যাবে!

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে সায় দিলো অদিতি,

ঠিক আছে! কথা বলো তাহলে। ওনার সঙ্গে কথা বলেই দেখি একবার!

কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, অদিতি যে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে এটা ওর ধারণা ছিলো না। তাই সোজাসুজি না বলে সাথীর কথাটা একটু বানিয়েই বলতে হলো। স্নানে যাবার জন্যে উঠতে উঠতে ঘাড় নাড়লো অর্ক,

ঠিক আছে, অরিন্দম কে দিয়ে আজই কলেজে গিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিচ্ছি।

কলেজে ঢুকেই নিজেই অরিন্দম কে খুঁজে নিলো অর্ক,

ভাই, দিতি রাজি হয়ে গিয়েছে! তুই একটা তাড়াতাড়ি অ্যাপয়েন্টমন্ট করে দে না প্লিজ!

অরিন্দম অবাক হলো,

এতো সহজে রাজি হলো! কি করে অসাধ্য সাধন করলি!

অর্ক হাসলো,

শোন না, আমি একটু মিথ্যে বলেছি! বলেছি তোর আর আমার সাথে সাথীর মেট্রোতে হটাৎ দেখা হয়েছিলো। ওকে ফোন করেছিলাম জানলে দিতি রাগ করতো, ভাবতো আমি ওকে পাগল ভাবছি। তুই সাথী কে একটু বলে রাখিস সব টা।

পরের দিন বিকেলেই সাথীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেলো অরিন্দমের চেষ্টায়, দিতি কে নিয়ে অর্ক চেম্বারে ঢুকলো। সাথী বেশ হাসিখুশি, দিতির বেশ পছন্দ হলো। সাথী দিতি র দিকে তাকিয়ে হাসলো,

বলুন, কেমন আছেন? কি সমস্যা হচ্ছে আপনার?

একটু ভেবে সবটাই বেশ গুছিয়ে বললো অদিতি, যেটুকু ভুল হচ্ছিলো, পাশে বসে অর্ক হেল্প করলো। দুজনের সঙ্গেই আলাদা করেও কথা বললো সাথী।

আপনি কি করে শিওর হচ্ছেন অর্ক বাবু, যে সত্যিই কোনো ফোন আসে নি?

অর্ক একটু ভাবলো, তারপর বললো,

কারণ আমার এমন কাউকে মনে হচ্ছে না, যে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে এই কাজটা করতে পারে। আমার সেরকম কোনো শত্রু নেই, সবার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক খুব ভালো। তাছাড়া এমনিতেই ও একটু এরকমই, মাঝে মাঝেই ফোন বন্ধ রাখা বা সাইলেন্ট রাখা নিয়ে ওর সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছে। আমার মনে হয় এবার ও ওখানে এই অবস্থায় একা ছিলো, তাই একটু বাড়াবাড়ি ভেবে ফেলেছে।

আলাদা করে দিতির সঙ্গেও কথা বললো সাথী, ঘটনা টা সত্যিও হতে পারে এটা মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এর পেছনের কোনো কারণ দিতির কাছে জানতে চাইলো সাথী। আগে কোনোদিন অর্কর ব্যবহারে ওর এরকম কিছু মনে হয়েছে কিনা, বা অর্ক সত্যি এরকম করতে পারে কিনা এর উত্তরেও নাই বললো দিতি। সাথীর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষন যুক্তি তর্ক দিয়ে বিচার করার পরে অদিতি নিজেই বিশ্বাস করলো যে এটা ওরই মনের ভুল। কেউ ওকে ফোন করেনি, ও নিজের কল্পনায় এসব ভেবে নিয়েছে।

যখন দুজনেই কথা বলে খুশি মনে বেরোচ্ছিল, তখন সাথী অর্ক কে আলাদা করে ডেকে দিতির দেওয়া ফোন নম্বরটা একটু সেভ করে রাখতে বললো, একটু অনিচ্ছা সত্বেও সেভ করলো অর্ক।

দিন দুয়েকের মধ্যেই অদিতি একদম স্বাভাবিক হয়ে গেলো, গত এক সপ্তাহের ঘটনা মন থেকে মুছে ফেললো দুজনেই। এমনকি শাশুড়ি কে ফোন করে নিজের পাগলামির জন্যে লজ্জা প্রকাশ করলো অদিতি, রুমা এবং সমরেশ দুজনেই শান্তি পেলেন। ছেলে, বউয়ের গন্ডগোলের জন্যে তাঁদের মধ্যেও অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিলো। কোনো কিছু সঠিক ভাবে না জেনেই অর্ক কে ডেকে পাঠানোর জন্যে স্ত্রীর ওপর যথেষ্টই বিরক্ত হয়েছিলেন সমরেশ।

প্রায় মাসখানেক কোনো সমস্যা ছাড়াই কেটে গেলো, অর্কও নিজে যথেষ্ট সতর্ক থাকলো, ফোন বন্ধ বা সাইলেন্ট যাতে না থাকে সে বিষয়ে মনোযোগী হলো। সাথীর সঙ্গে বার দুয়েক সিটিংয়ে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। ক্রমশ বাপ্পার বিয়ে এগিয়ে আসছিলো, অদিতি গোছগাছ শুরু করলো। মাঝে মধ্যে টুকটাক অশান্তি হলেও সেগুলো বিরাট আকার ধারণ করছিলো না।

শান্তিনিকেতন যাওয়ার দিন তিনেক আগে একদিন কলেজে ঢুকেই ছুটির দরখাস্ত লিখতে বসলো অর্ক, যাবার দিন প্রায় এসে গিয়েছে অথচ আসল কাজটাই করা হয় নি এখনো। দরখাস্ত লিখে ছুটির ব্যবস্থা করে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে কলেজ ক্যান্টিনের সামনে ও থার্ড ইয়ারের গ্রুপটার মুখোমুখি হলো। ওকে দেখেই কৌশিক এগিয়ে এলো,

স্যার, কিছু জিনিস একটু অসুবিধা হচ্ছে, দু একদিনের মধ্যে আপনি ফ্রী থাকলে বুঝতাম একটু!

অর্ক মাথা নাড়লো,

এ সপ্তাহে হবে না কিছুতেই! আমি দিন তিনেকের জন্যে একটু বাইরে যাচ্ছি, নেক্সট উইকে একটা দিন দেখো তোমরা।

কোথায় যাচ্ছেন স্যার?

অর্কর কথা শুনতে পেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়েই অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো, অর্ক একটু হাসলো,

শান্তিনিকেতন।

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৮
পরশুই যেতে চাইছিস? এতো তাড়াহুড়ো কিসের? আগে তো তোর এতো উৎসাহ ছিলো না?

তিয়াসার ধেয়ে আসা প্রশ্নবাণে র সামনে কেমন যেনো থতমত খেলো কৌশিক, একটু তড়িঘড়ি উত্তর দিলো,

আরে, না ভাই! সেই কবে থেকেই তো যাচ্ছি, যাবো হচ্ছে! কিন্তু বারবার ক্যান্সেল হয়ে যাচ্ছে তো! এবার কাউকে উঠে পড়ে লাগতে হবে বুঝলি! আর কিছুদিন পরেই এক্সাম শুরু হয়ে যাবে, তারপর কলেজ শেষ! যেতে চাইলে এখনই চল!

আমি তো সেটাই বলছি কবে থেকে, কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না আমাকে! গরীবের কথা ভাই! বাসি হলে তবেই মিষ্টি হয়!

শ্রেয়া পাশ থেকে ফোড়ন কাটল। অন্যরা কেউ কিছু বলার আগেই তিয়াসা বলে উঠলো,

যেতে হয় চল, আমার কোনো আপত্তি নেই! তবে গাড়িতে গেলে রিয়ার গাড়ি অথবা ভাড়া গাড়ি নিতে হবে!

হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেউ তোর অনির্বাণের গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে না, তোর কোনো চিন্তা নেই!

দীপের ব্যাঙ্গাত্মক গলা কিছুটা হলেও তিয়াসা কে ব্যাকফুটে ঠেলে দিলো, ও একটু গম্ভীর মুখে অনির্বাণের দিকে তাকালো।

কি দরকার এতো বিতর্কের! গাড়ির ঝামেলায় যাবার কোনো দরকার নেই! ট্রেনের টিকেট কাট,

রিয়ার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তিয়াসা আর অনির্বাণের মুখে মুচকি হাসি খেলে গেলো। কৌশিক পকেট থেকে মোবাইল বার করে টিকিটের খোঁজ শুরু করলো। অনির্বাণ উঠে দাড়ালো, তিয়াসা কে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো,

তোরা তাহলে ব্যবস্থা করে নে, কতো লাগবে আমাদের জানিয়ে দিস!

হটাৎ করে কৌশিকের কি হলো বলতো? ও তো কোনো ব্যাপারই খুব বেশি ইনভলভ হয় না কখনো! আজ একেবারে টিকিট কাটতে বসে পড়লো!

মেট্রোর দিকে দুজনে হেঁটে যেতে যেতে অনির্বাণের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তিয়াসা, অনির্বাণ মুচকি হাসলো,

কি আর! রিয়ার গাড়ি নিয়ে যাওয়া টা আটকাতে হবে না! অদ্ভুত ছেলে একটা, রিয়া কিন্তু ওকে একটুও পাত্তা দেয়না, শুধুই ইউজ করে। তবু পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায় খালি,

আমার কিন্তু একটু অন্য রকম লাগছে! ওই কিন্তু আজ প্রথম এসে যাওয়ার কথা টা নতুন করে তুললো। শ্রেয়া মাঝে মাস খানেক আগে একবার হুজুগ করেছিলো, কিন্তু তারপর আর এগোয় নি। রিয়ার গাড়ি নিয়ে যাওয়া এড়াতে গেলে তো কৌশিকের এই প্রসঙ্গ তোলাই উচিত ছিলো না, তাই না? ও এতো ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে কেনো বলতো?

তিয়াসা একটু চিন্তিত গলায় বললো, অনির্বাণ হাসলো,

এই যে মিস মার্পেল, আপনি আবার গোয়েন্দাগিরি শুরু করবেন নাকি!

তিয়াসা হেসে ফেললো, ওর এই অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের জন্যেই বন্ধুরা ওকে মিস মর্পেল বলে ডাকে। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললো,

চল, তাড়াতাড়ি পা চালা! এর পরের মেট্রো থেকে আবার ভিড় হতে থাকবে!

শনিবার যখন বোলপুর স্টেশনে নামলো অদিতি আর অর্ক, তখন বেশ রাত হয়েছে। বাপ্পা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলো, অর্ক কে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো,

কতদিন পরে এলি! বৌদি কেমন আছো?

দিতি হাসলো,

বউয়ের ছবি দেখাও!

বিয়ে বাড়ি একদম জমজমাট। দিতি ঘরে ঢুকতেই মাসি শাশুড়ি দৌড়ে এলেন, প্রণাম করতে যাওয়ার আগেই দিতি র হাত ধরে ফেললেন,

থাক! এই অবস্থায় বেশি নিচু হবার দরকার নেই!

শাশুড়ি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, দিতি র একটু লজ্জা লাগছিলো, সেই ঘটনার পরে প্রথম বার শ্বশুর, শাশুড়ির মুখোমুখি হয়েছে ও, কিন্তু রুমা এগিয়ে এসে একদম সহজ গলায় বললেন,

শরীর ঠিক আছে তো? বেশি ঘোরাঘুরি করিস না কিন্তু!

দিতি ঘাড় নাড়লো, হাত মুখ ধুয়ে এসে সবার সঙ্গে গল্প গুজব চলতে লাগলো। পরের দুদিন খুব আনন্দে কাটলো, সকালে উঠেই চা খেতে খেতে বাপ্পা বললো,

পরশু থেকে আমি ব্যস্ত হয়ে যাবো বৌদি, চলো তোমাদের ঘুরিয়ে আনি।

দিতি উৎসাহিত হলো, রুমা একটু আপত্তি জানাচ্ছিলেন, কিন্তু সমরেশ এবং মাসি সেই আপত্তি ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন,

যা তো! কিচ্ছু হবে না! গাড়িতে করেই তো ঘুরবি!

অর্ক একটু দ্বিধায় ছিলো, কিন্তু দিতি র নিজের প্রবল ইচ্ছে দেখে আর আপত্তি করলো না। শান্তিনিকেতনের দ্রষ্টব্য যা আছে সবই বাপ্পা ঘুরিয়ে দেখালো। প্রবল ঘোরাঘুরির মধ্যে দিয়ে দুদিন কেটে গেলো।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই দুদিনের ঘোরার ধকলে দিতি একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লো। গায়ে হলুদের সময় রুমা ওকে ডাকতে এসে সেটা লক্ষ্য করলেন,

তোকে আর হলুদের ওখানে যেতে হবে না! তুই রেস্ট নে একটু!

দিতি শুয়ে শুয়েই ঘাড় নাড়লো,

ঠিক আছে! একটু শুয়ে থাকি, বেলার দিকে ঠিক হয়ে যাবে!

বিকেলে বরযাত্রী যাবার সময় হয়ে গিয়েছিলো, দিতি কে তখনো শুয়ে থাকতে দেখে অর্ক একটু টেনশনে পড়লো,

তোমার শরীর এখনো ঠিক হয় নি! আমি এটাই ভয় পাচ্ছিলাম! বড্ড বেশি ঘোরাঘুরি হয়ে গেছে দিতি! তুমি কি বরযাত্রী যেতে পারবে? নাকি রেস্ট নেবে বাড়িতে?

দিতি উঠে বসলো, ও অনেকদিন ধরে বাপ্পার বিয়ের প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছে, বরযাত্রী ও যাবেই! অর্কর ইচ্ছা ছিলো না, রুমাও একটু আপত্তি জানালেন, দিতি তার জেদে অনড় রইলো। এই প্রথম বার সমরেশ নিজেও একটু চিন্তায় পড়লেন, স্ত্রী কে মাথা ঘামতে বারণ করেন যিনি, সেই তিনিও খানিকটা অনিচ্ছুক ভাবেই দিতি কে বললেন,

যেতে পারবি তো! জোর করে কিছু করিস না কিন্তু!

এর বেশি আর কিই বা বলতে পারতেন তিনি, দিতি তাও যেতে চাইলো। শেষ পর্যন্ত বরযাত্রী হয়ে মেয়ের বাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা হলো দিতি। ওখানে পৌঁছে যদিও মোটামুটি চুপচাপ বসেই থাকলো ও, খুব বেশি হৈ চৈ করলো না। ভালোয় ভালোয় বিয়ে পর্ব মিটলো, পরের দিন ভালো করে রেস্ট নেবার পরে বৌভাতের দিন সকালের মধ্যেই দিতি সুস্থ হয়ে গেলো়ে।

আজ সকাল থেকে উঠেই সবার সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলো ও, অনেক নতুন নতুন আত্মীয়স্বজন ছিলেন শাশুড়ির বাপের বাড়ির যাদের ও কোনোদিনও দেখে নি আগে। এই করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেলো, সবাই যখন ব্রেকফাস্ট করতে বসলো, তখন সবাই অর্কর কথা জানতে চাইলো। এতক্ষনে দিতি র মনে পড়লো ও আজ ঘুম থেকে উঠে থেকেই একবারের জন্যেও অর্ক কে দেখেনি। এমনকি কাল যখন ও ঘুমোতে যায় তখনও অর্ক ভাই বোনদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল, ও ও আর ডাকেনি ওকে, ভাইয়ের বিয়েতে এসে ওকে নিজের মতোই থাকতে দিতে চেয়েছিলো কদিন।

অর্ক কোথায়? ফোন কর ওকে, খেতে আসতে বল,

শাশুড়ির কথায় ও ফোন করলো অর্ক কে, যথারীতি ওর ফোন বেজে গেলো নিয়ম মতো, ও ধরলো না, একই জিনিষ প্রতিবার হয় জানা সত্বেও প্রতিবারের মতো এবারও টেনশন হচ্ছিলো দিতি র। নিজেই নিজেকে প্রতিবার সান্ত্বনা দেয় ও, এবারও তাই দিচ্ছিলো। কিন্তু নিজের খেতে ইচ্ছা করছিলো না একটুও, তাও সবার সঙ্গে বসেছে না খেয়ে উঠে যাওয়া টা খারাপ দেখায়, তাই কোনো রকমে কিছুটা খেয়েই উঠে পড়লো ও।

বেশ কিছুক্ষন পরেও যখন অর্ক ফিরলো না তখন ওর সঙ্গে ওর শাশুড়ি কেও বেশ চিন্তিত দেখলো দিতি। এতদিন ও যখন অর্কর এইসব দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজকর্মের কথা গুলো নিয়ে রাগারাগি করতো, তখন উনি সেগুলো ফিল করতে পারতেন না, কিন্তু আজ নিজেই সেই পরিস্থিতি তে পড়ে বেশ টেন্সড হয়ে গেছে দিতি বুঝলো।

একবার বাপ্পা কে দেখতে পাঠাবো? ও একটু দেখে আসুক কাছাকাছিই নিশ্চয়ই গেছে কোথাও,

বোনের কথায় আরও রেগে গেলো ওর শাশুড়ি দিতি বুঝলো, বিয়ে বাড়িতে বেড়াতে এসে এইসব উটকো চিন্তা করতে কার ভালো লাগে। এখন যার বিয়ে তাকে যদি বাড়ির অনুষ্ঠান ছেড়ে অতিথি কে খুঁজতে বেরোতে হয় তাহলে সে যে কি লজ্জার ব্যাপার সেটা কে বোঝে!

না, বাপ্পা নিজের কাজ করুক, আর একটু দেখি,

বলে বোন কে ওখান থেকে সরিয়ে দিয়েই দিতি র দিকে ফিরলেন তিনি,

চল, আমরাই একটু এগিয়ে দেখি!

শাশুড়ির সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলো ও, পাশে হাঁটতে হাঁটতে শাশুড়ি সমানে রাগ দেখিয়ে যাচ্ছেন ছেলের ওপর, এই রাগ যে আসলে রাগ নয়, প্রবল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ, সেটা ওর থেকে বেশি আর কে জানে। এই জিনিস তো বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে ও, আর ফিরে এসেই এতো কিছু বলবে ফোন না ধরার কারণ হিসাবে, তখন এটা মনে হতে বাধ্য যে বারবার একজনের সঙ্গেই এতো সমস্যা হয় কেনো!

অর্ক কে প্রায়ই বলে দিতি,

কই আমার ফোন তো কোনদিন এতো বিভিন্ন রকমের সমস্যা করেনা, তোমার ফোনই শুধু করে কেনো!

এই জিনিসগুলোই যে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তোলে সেটা ও অর্ক কে বোঝাতে পারে না। ওই ফোন টা আসার পর যদি সেদিন ও অর্ক কে যোগাযোগ করতে পারতো, তাহলে তো এতো কিছু হয়ে যেতো না তখন! মেয়েটার ফোন, অর্কর সারারাত ফোন না ধরা সব টা মিলিয়েই তো নিজেদের মধ্যে এতকিছু হয়ে গেলো ওদের। আজ বুঝুক ওর শাশুড়ি! উনি তো ভাবেন দিতি অহেতুক সন্দেহ করে ছেলে কে, ছেলে যে কি করে সেটা আজ নিজের চোখেই দেখতে পারছে মা!

প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর রাস্তা টা এক জায়গায় গিয়ে ভাগ হয়ে গেছে দুদিকে, সেখানে গিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে পড়লো। এবার কোনদিকে যাওয়া উচিত সেটা নিজেরাই মনস্থির করতে পারছিলো না।

ফিরে চলো মা, আমার শরীর খারাপ লাগছে, আমি আর হাঁটতে পারবো না,

একটু রাগের গলায় বললো দিতি, এবার ওর ভীষণ রাগ হচ্ছিলো।

কি করি বলতো? বাপ্পা কে ফোন করবি তাহলে আসার জন্যে?

শাশুড়ির উদ্বিগ্ন গলা শুনে নিজের আরও চিন্তা হচ্ছে ওর,

দেখো তুমি! তোমার ছেলে কিরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন! আমি বললে তো বিশ্বাস করোনা আমাকে, উল্টে নিজেকে শুধরে নিতে বলো, এখন বুঝতে পারছো তো কি করে ও বাড়িতে!

শাশুড়ি কোনো উত্তর দিলো না দেখে ও একটু শান্তি পেলো। এবার নিজের সময়ে উনি বুঝতে পারছেন যে অর্ক আসলে সত্যি সন্দেহ করার মতোই কাজ করে সব সময়।

কি করবে ভাবতে ভাবতেই ডান দিকের রাস্তা দিয়ে অর্ক কে আসতে দেখলো দিতি, হাতে একটা প্যাকেট ঝোলানো, নিজের মনে কি ভাবতে ভাবতে এগিয়ে আসছে। ওকে দেখেই এতক্ষনের জমানো চিন্তা টা রাগ হয়ে ফিরে এলো, ও প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলো, তার আগেই শাশুড়ির চিৎকারে নিজেকে সংযত করলো ও। আজ না হয় উনিই বলুন, অর্কও বুঝুক যে শুধু অদিতি নয় ওর কাজ কর্মে ওর মাও বিরক্ত হয় তাহলে।

ফোন কোথায় তোর? কোথায় ছিলিস এতক্ষন?

মায়ের চিৎকারে অবাক হয়ে তাকালো অর্ক। ওরা এখানে কি করছে, ওকে খুঁজতে এসেছে নাকি! মোবাইল ধরেনি ও এবারও, পকেটেই তো নিয়ে বেরিয়েছে, কি হলো তাহলে! তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মোবাইল টা বার করলো ও। এখন মনে পড়লো কাল আড্ডার সময় বার বার ফোন আসছিলো বলে সাইলেন্ট করেছিলো ওটা! দিতি র এতগুলো মিসড কল! ও খুব করুন মুখে তাকালো, মাও ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

ফোন টা সাইলেন্ট হয়ে গেছে খেয়াল করিনি,

খুব আস্তে করে একবার বলার চেষ্টা করলো ও, জানেই সেটা এই মুহূর্তে বৃথা,

তোর ফোনই সাইলেন্ট হয় শুধু? আমাদের তো হয় না! দিতি ঠিকই বলে বুঝতে পারছি, তুই চূড়ান্ত ইরেস্পনসিবল। আরেকটু হলেই বাপ্পা কে নিজের বিয়ে ছেড়ে তোকে খুঁজতে বেরোতে হতো জানিস সেটা! কতো টা লজ্জার ব্যাপার বলতো!

মায়ের অভিযোগ গুলো শুনতে শুনতেই মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো ও, দিতি গম্ভীর মুখে হেঁটে যাচ্ছে একটাও কথা না বলে, আজ ওর আর কিছু বলার দরকার পড়ছে না। মা সবটাই ওর হয়েই বলে যাচ্ছে, কোনো উত্তর দিয়ে এই মুহূর্তে আর নিজের কোনো বিপদ নতুন করে ডেকে আনতে চাইলো না ও। এমনিতেও দিতি র মোকাবিলা কিভাবে করবে পরে সেটার জন্যেও প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে লাগলো। কারণ এখন যতই চুপ করে থেকে থাক না কেনো, অতো সহজে যে ওকে ছাড়বেনা দিতি সেটা ও মনে মনেই জানে।

ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মাসি, মেসো একসঙ্গে দৌড়ে এলো, সবার একটাই প্রশ্ন, অর্ক এতক্ষন ছিলো কোথায়!

কিরে হারিয়ে গিয়েছিলি শুনলাম? ঘরে যা একবার, তারপর বৌদি তোকে কি করে দ্যাখ!

মুচকি হেসে বললো বাপ্পা, নতুন বউয়ের সামনে এই রসিকতায় অর্ক খুব লজ্জায় পড়লো। মায়ের গম্ভীর মুখ, দিতি র চুপ করে থাকা সব মিলিয়ে অর্কর বেশ অস্বস্তি হতে থাকলো, কাজটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গিয়েছে আজ!

ঘরে ঢুকেই পেছনে পেছনে এগিয়ে আসা দিতি র দিকে হাতের প্যাকেট টা এগিয়ে দিলো ও,

নাও, ধরো! এটার জন্যেই দেরি হয়ে গেলো এতো!

মুখটা কে গম্ভীর রেখেই হাত বাড়ালো দিতি, প্যাকেটটা খুলেই এতক্ষনে চেপে রাখা রাগটা একদম জল হয়ে গেলো ওর! কি সুন্দর গয়না গুলো, ওর এগুলো খুব পছন্দের।

কোথা থেকে পেলাম বলো তো?

ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো অর্ক, দিতি র খুশি ভরা মুখটা দেখেই ওর টেনশন টা অনেকটাই কেটে যাচ্ছিলো। দিতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো,

পারলে না তো? হাটে গিয়েছিলাম, তোমার শরীর খারাপ তাই নিয়ে যাইনি আর। পরে গিয়ে দেখলাম প্রচণ্ড ভিড়, ভালোই হয়েছে তোমাকে নিয়ে যাই নি!

অদিতি ততোক্ষনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, কিছুক্ষন আগের রাগ সম্পূর্ন ভুলে গিয়ে গয়নাগুলো গলায় পরে দেখতে দেখতে বললো,

দারুন হয়েছে গো! প্রত্যেকটাই খুব সুন্দর!

অর্ক একটু চুপ করে থাকলো, তারপর মুচকি হেসে বললো,

কে এনেছে দেখতে হবে না! অর্ক মিত্রর চয়েস বলে কথা!

অদিতি হেসে ফেললো,

তাই নাকি! তবে তোমার চয়েসের বেশ উন্নতি হয়েছে এটা মানতেই হবে, আগে যা জঘন্য জিনিসপত্র আনতে!

আমার চয়েস সব সময়ই ভালো, তাই না তোমাকে পছন্দ করেছিলাম!

অর্ক র দুষ্টুমি ভরা মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে, আয়নার মধ্যে দিয়েই হেসে ফেললো অদিতি,

হুমম! বুঝলাম!
চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-৫+৬

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৫+৬
গত দুদিন ধরেই ছেলের সঙ্গে দিতি র কিছু গন্ডগোল চলছে, বুঝতে পারছেন রুমা, কিন্তু নিজে থেকে না বললে এ ব্যাপারে দিতি কে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না বলেই ভেবে রেখেছেন। কাল ছেলে যখন তার মোবাইলে ফোন করে দিতি কেমন আছে, জানতে চাইলো, তখনই আরও ভালো করে বুঝলেন সেটা। রান্না ঘর থেকে রাঁধুনির বানানো চা নিয়ে, স্বামীর চা দিয়ে, নিজেদের চা নিয়ে দিতি র ঘরে ঢুকলেন। অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে মেয়েটা, ঘুমোচ্ছে নাকি এখনও!

কি রে ঘুমাচ্ছিস নাকি! ওঠ চা এনেছি!

দিতি এপাশ ফিরতেই চমকে গেলেন রুমা, কাঁদছিলো মেয়েটা!

কি হয়েছে তোর?

গলাটা নিজের অজান্তেই একটু গম্ভীর হলো, ছেলের ওপর খুব রাগ হচ্ছে এখন, এই সময়েও গন্ডগোল না করলে চলে না! শাশুড়ি কে সামনে দেখেই নিজের চোখের জল মোছার চেষ্টা করছিলো অদিতি, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। দুদিন ধরে নিজের ভেতরে এতো বড় একটা কথা চেপে রেখে, হাসিখুশি থাকা একটুও সম্ভব হচ্ছে না আর।

অর্ক কিছু বলেছে নাকি তোকে? কাল ফোন করেনি?

নরম গলায় বলা কথাগুলো যেনো আরও কষ্টটা বাড়িয়ে দিলো দিতির, শাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে দুদিনের চেপে রাখা কান্নাটা কেঁদে ফেললো ও।

মা, অর্ক অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ওর,

একদম চমকে গেলেন রুমা, অর্ক অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চায়! এতো বড় কথা! এতদিনে কিছু বোঝেন নি তিনি! হটাৎ করেই অদিতির জন্যে খুব খারাপ লাগছে তাঁর, ইস মেয়েটা কতো কষ্ট চেপে রেখেছে নিজের ভেতরে। কিন্তু যথেষ্ট পরিণত মস্তিষ্ক তাঁর, দিতির মতো অল্প বয়স নয়, তাই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ব্যাপার টা ভেবে নিলেন তিনি। ছেলে কে এক্ষুনি ডেকে পাঠাতে হবে!

মা তুমি ওকে কিছু বলবে না, আমি তোমাকে জানিয়েছি বলে!!

কাঁদতে কাঁদতেই বলছিলো অদিতি, রুমা চুপ করে শুনলেন কোনো উত্তর দিলেন না, দিতির কথা শুনলেন ঠিকই কিন্তু যা করার উনি করবেন, দিতি কে কিছু জানতে দেবেন না এখন।

তুই চা খা, আসছি আমি,

ঘর থেকে বেরিয়েই ছেলে কে ফোন করলেন,

কি করছিস? ঘুম থেকে উঠেছিস?

সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠে বসেছিলো অর্ক, মায়ের গম্ভীর গলায় একটু ঘাবড়ে গেলো,

কি হয়েছে মা? তোমার গলা টা গম্ভীর কেনো!

বাবার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে কাল থেকে, পারলে আজই বাড়ি আয় একটু, তোকে দেখতে চাইছেন,

বাবার শরীর খারাপ!! তার মানে নিশ্চয়ই খুব খারাপ, নাহলে মাত্র দুদিন আগেই এসেছে জানা সত্বেও মা আবার আসতে বলছে! আজ তো রবিবার, এমনিও যেতে অসুবিধা নেই, কাল না হয় ম্যানেজ করে নেবে কোনো ভাবে,

আচ্ছা, বেরোচ্ছি একটু পরেই,

ফোনটা নামিয়ে রেখেই চটপট রেডী হতে শুরু করলো অর্ক, দিতির জন্যেও যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো এমনিতেই।

ফোন নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই, স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন সমরেশ,

কি এমন হলো যে আমার অসুখের মিথ্যে কথা বলে তুমি ওকে ডেকে পাঠালে?

রুমা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন, এসব কথা আদৌ স্বামী কে জানানো ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই সমরেশ মাথা নাড়লেন,

এটা ঠিক করছো না রুমা, ওদের সমস্যা ওদেরই মেটাতে দাও, তুমি এর মধ্যে ঢুকতে যেও না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে!

রুমা মাথা নাড়লেন,

কোনো কোনো সময় ঢুকতেও হয় গো! ওরা দুজনেই ছেলে মানুষ, কি বলতে কি করে কে জানে! ওদের ভুল বোঝাবুঝি গুলো আমরা যদি মিটিয়ে না দি, তাহলে তো সমস্যা আরো বাড়বে বৈ কমবে না।

বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেলো, দরজার বেল দিতেই মা দরজা খুলে দাঁড়ালো গম্ভীর মুখে, একটু চমকে গেলো অর্ক, বাবা কি খুবই অসুস্থ!

দুপুরে স্নান করে খেয়ে উঠে, একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল দিতি, সকালে শাশুড়ির কাছে কেঁদে মন টা একটু হালকা লাগছে। গত দুদিন ধরেই মনের মধ্যে যে চাপা কষ্টটা ছিলো সেটাও একটু কমে এসেছে। কোনো কোনো সময় যে কারো কারো কাছে মনের কথা বলাটাও জরুরী, সেটা এখন বুঝতে পারছে।

দুদিন ধরে কতো কি ভেবেছে ও, এমনকি বাচ্চাটা রাখবে কিনা, এরকম কথাও মনে হচ্ছিলো কোনো কোনো সময়! বেলের আওয়াজ শুনে ঘুম টা ভেঙে গেলো, কে এলো এই ভর দুপুরে! ঘরে ঢুকে আসা গলাটা শুনে অবাক হয়ে গেলো দিতি, অর্ক! ও কখন এলো! ও ফোন বন্ধ করে রেখেছে বলে কি এখানে চলে এসেছে!

বাড়িতে ঢুকেই সামনেই বাবা কে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো অর্ক,

কি হয়েছে বাবা তোমার? তুমি এখানে বসে আছো? খুব শরীর খারাপ? মা ফোন করলো আমাকে!

নাহ! আমি ঠিক আছি! তোর মা ডেকেছে তোকে, ঘরে যা আগে, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে, তারপর কিছু কথা আছে তোর সঙ্গে।

কি এমন কথা, যে এইভাবে মা ডেকে পাঠালো ওকে, ওর খুব টেনশন হচ্ছিলো,

না পরে খাবো, আগে বলো কি হয়েছে, দিতি র শরীর খারাপ?

প্রশ্ন টা করতে গিয়েই গলাটা একটু কেঁপে গেলো, নিজেই বুঝলো সেটা! মা এবার ঘুরে তাকালো,

ঠিক আছে, তুমি যদি না খেয়েই শুনতে চাও, চলো তবে! ঘরে চলো, যা বলার দিতির সামনেই বলবো!

দিতি কি তবে দুদিন ধরে ফোন না করার গল্পটা বলে দিয়েছে মা কে, যা চিৎকার করছিলো কাল, শুনে ফেলা টাও কিছু বিচিত্র নয়। এই জন্যেই মা ডেকে পাঠিয়েছে ওকে! ভীষণ রাগ হচ্ছে এবার ওর, দিতি বড্ড ছেলে মানুষ মতো, সব কিছুই কি মা কে বলে দিতে হয়!

ঘরে ঢুকেই অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে ও চমকে গেলো, কি অবস্থা হয়েছে দু দিনের মধ্যে! ও তো সুস্থ করার জন্যে রেখে গিয়েছিলো এখানে, এ তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে! মনটা আবার খারাপ লাগছিলো, একটু আগের হওয়া রাগ টা কমে আসছে, নিজের ওপর রাগ হচ্ছে এখন, ওই বা যে কেনো ফোনটা যত্ন করে রাখতে পারে না! সামান্য ফোন না করার জন্যে এইরকম চোখ মুখের অবস্থা, মেয়েটা সত্যিই পাগল!

অর্কর গলা শুনে ঘুম থেকে উঠে বসেই, খারাপ লাগছিলো অদিতির। অর্ক নিজেই এসেছে, নাকি ওর মা ডেকে এনেছে ওকে! ও এতো বার করে বারণ করলো তাও মা শুনলো না! নিজের শরীর একটুও ভালো লাগছে না ওর, এখন আর কোনো তর্ক বিতর্কের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করছে না।

ঘরে ঢুকে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অর্ক, দেখেই খুব অভিমান হচ্ছিলো অদিতির, এই ছেলেটা অন্য মেয়ে কে বিয়ে করতে চায়! এতদিন ধরে ও একেই ভালোবেসে এসেছে পাগলের মতো, এতো বোকা ও! না চাইতেও চোখে জল চলে আসছে, মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো অদিতি।

তুই অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?

মায়ের সরাসরি করা প্রশ্নে একদম চমকে গেলো অর্ক,

কি বললে? আমি কাকে বিয়ে করতে চাই?

অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তোর?

কি বলছে মা এসব! অর্ক কোনো কিছুই ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারছে না।

কে বলেছে এসব কথা তোমাকে?

অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো ও, মা দিতি র দিকে তাকিয়ে আছে,

তুমি বলেছো?

দিতি র দিকে ঘুরে তাকালো অর্ক,

এখন মায়ের সামনে সাধু সেজে আছো তুমি? ভাজা মাছ উলটে খেতে জানো না তাই না?

কেঁদে ফেলে বললো অদিতি, ও অর্কর এই নাটক গুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।

আমি তোমাকে কখন বলেছি এইসব কথা?

এবার সত্যিই রেগে গেলো অর্ক, যা খুশি বলছে ও, মায়ের কাছে এইসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছে ওর নামে!

তুমি বলোনি, তোমার বান্ধবী কে দিয়ে বলিয়েছো, তুমি নিজেই তো বলতে পারতে, নাকি সেই সাহস টুকুও তোমার নেই!

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো দিতি, এখন আর শাশুড়ির সামনে ও কিছুই লুকিয়ে রাখতে চায় না। অর্ক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে, বান্ধবী! কোন বান্ধবী এই কথা বললো, ওর বান্ধবী বলেই যে কিছু আছে তাই তো মনে পড়ছে না।

তোকে অর্ক বলেনি? কে বলেছে তবে এই কথাগুলো?

এবার রুমা এগিয়ে এলেন, নিজেরও এখন একটু অস্বস্তি হচ্ছে, সব কিছু না জেনেই কি তাড়াহুড়ো করে ফেললেন! তিনি তো ভেবেছিলেন অর্কই কথাগুলো বলেছে দিতি কে!!

একটা মেয়ে ফোন করেছিলো আমাকে, এবার সব কিছুই কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেললো অদিতি। অর্ক অবাক হয়ে শুনছিল, ওর একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে এখন। মাঝে মাঝেই টুকটাক ফোন না ধরা বা বন্ধ রাখা নিয়ে ঝামেলা হয় বটে দিতির সঙ্গে, কিন্তু তাই বলে এতো সন্দেহ বাতিক ও। সব কিছুই কি বানিয়ে বলছে ও।

মায়ের দিকে তাকালো এবার অর্ক,

মা, তুমি ওর কথায় এখানে ডেকে নিয়ে এসেছো আমাকে? বাবার কিছুই হয়নি তাহলে?

চিৎকার করে উঠলো অর্ক, কিছুতেই মাথা টা ঠান্ডা রাখতে পারছে না ও। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে প্রায় পাগলের মতো দৌড়ে এসেছে ও, আর এসে কি শুনছে! ও বিয়ে করতে চায় অন্য কোনো মেয়েকে! অদিতি তো পাগল, তা বলে মাও!

তোমার মনে হচ্ছে ও একটুও সুস্থ? ওর কথা শুনে তুমি ডেকে আনলে আমাকে! তোমার একবারও মনে হলো না আমি এরকম করতে পারি কিনা! ও সব বানিয়ে বলছে মা, কেউ ফোন করেনি ওকে। কিছু অন্তত বলতে বলো ওকে, নাম, ফোন নম্বর? ও কিছুই বলতে পারবে না। সব মনগড়া ওর, শুধু অহেতুক সন্দেহ। তোমার ইচ্ছে হয় তুমি শোনো বসে বসে, আমার সময় নেই। আমি জানি ও এগুলো কেনো করছে!

রুমা অবাক হয়ে তাকালেন,

কেনো করছে মানে? ইচ্ছে করে করছে নাকি!

হ্যাঁ, ইচ্ছে করেই করছে, শুধু আমাকে সবার সামনে অপদস্থ করার জন্যে, কেনো জানো? আমার একটাই অপরাধ,আমি আমার ফোনটা কাল খুঁজে পাচ্ছিলাম না, অন্যমনস্ক ভাবে রান্না ঘরে ফেলে এসেছিলাম, তাই ওকে ফোন করতে পারিনি। শুধু সেই জন্যেই সবার সামনে ও আমাকে ছোট করতে চায়, আর সেটা করতে গিয়ে যে কি মারাত্মক অভিযোগ ও করছে সেটা ও নিজেও বোঝেনি বোধহয়। ও পাগল হয়ে গেছে, আর তুমি সেই পাগলের কথা বিশ্বাস করে ওখান থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছো! কতটা টেনশন নিয়ে আমি ছুটে এসেছি তুমি ভাবতেও পারবে না সেটা! আর এক মুহুর্ত ও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার, এসব পাগলামি তুমি সহ্য করো,

আমার কাছে নম্বর আছে,

কাঁদতে কাঁদতে বললো অদিতি,

ঠিক আছে, ফোন করো তাহলে আমার সামনে! কথা বলাও আমার সঙ্গে! দেখি কে বলেছে এ কথা!!

অদিতি চুপ করে গেলো! ওর কাছে সত্যি কোনো প্রমাণ নেই!

দেখলে তো মা!! ও চুপ করে আছে দেখো! এখন আর কিছুই বলছে না!

হিংস্র চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেই পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়েই মা কে আটকানোর সুযোগ না দিয়েই খালি পেটে আবার বেরিয়ে গেলো অর্ক।

বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, ইতিমধ্যে মায়ের অনেকগুলো মিসড কল হয়েছে, ইচ্ছে করেই ধরেনি ও। অদিতি র সঙ্গে আর থাকতে পারবে না ও, রাস্তায় আসতে আসতে ঠিক করেই নিয়েছে, ভালোই হয়েছে মা নিজের চোখেই দেখেছে সব কিছু। ওকে আর ডিভোর্স দেবার জন্যে কোনো কারণ মা কে অন্তত বলতে হবে না। ও কি ভেবে গিয়েছিলো, আর কি হলো!

এই দুদিন আগে ও অদিতি কে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারতো না, আর এই মুহূর্তে আর কোনো দিনও একসঙ্গে থাকার কথা ভাবতে পারছে না। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সম্পর্কটাই একটা প্রশ্ন চিন্হ র মুখে এসে দাঁড়িয়েছে! এতো নোংরা মানসিকতা ওর, শুধু ফোন করেনি বলে নিজের সুবিধার জন্যে মায়ের কাছে ওকে ছোটো করতে গিয়ে, অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে! এতো ছোট মন ওর, এইরকম মেয়ের সঙ্গে ও কি করে সারাজীবন কাটাবে! অদিতির এতো ভালো মানুষী ব্যাবহারের আড়ালে থাকা এতো নোংরা মন টা কে গত দেড় বছর ধরে একসঙ্গে কাটিয়েও চিনতে পারলো না ও, শুধু মুখোশ টাই দেখে গেছে এতদিন!

পেটে খাবার পড়ার পরেই মাথাটা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছে, ফোন টা হাতে তুলে মা কে ডায়াল করলো অর্ক,

পৌঁছে গেছি, সরি রাগ হয়ে গিয়েছিলো তখন,

খেয়েছিস কিছু? এরকম রাগ দেখিয়ে না খেয়ে চলে যায় কেউ?

মায়ের কথায় মন খারাপ হচ্ছিলো ওর,

হ্যাঁ, অর্ডার করে দিয়েছিলাম, খেলাম এক্ষুনি, রাখছি এখন,

ফোন টা ইচ্ছে করেই রেখে দিলো তাড়াতাড়ি, না হলে মা হয়ত এক্ষুনি দিতি র সঙ্গে কথা বলতে বলবে। ওর সঙ্গে আর কোনোদিনও কথা বলবে না একদম ঠিক করেই নিয়েছে ও। রান্নার দিদি কে ছুটি দিয়েছিলো সকালে, তখন তো আর জানতো না, আজই ফিরে আসতে হবে। রাতের ডিনার হয়ে গেছে, তাই শুয়ে পড়লো ও, আজ সারাদিন খুব ধকল গেছে!

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শরীর টা খারাপ লাগছিলো, কাল থেকে মনের ওপর তো কম চাপ পড়েনি! আজ আর কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না, খানিকটা রিলাক্স হয়েই শুয়ে রইলো খাটে। রান্নার দিদি চা দিয়ে যাবার পর খাটে উঠে বসলো ও,

কাল চলে এলে দাদা? থাকলে না বাড়িতে?

না আমার কলেজ আছে তো, থাকার উপায় নেই,
হেসে বললো ও, যদিও আজ যাবেনা বলেই ঠিক করে নিয়েছে।

বৌদি ফোন করেছিলো দুদিন আগে,

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাকালো অর্ক, দিতি ওকে ফোন করেছিলো!

ঠিক করে সব কিছু তোমার করে দিচ্ছি কিনা জানতে চাইলো আমার কাছে, আমি বলেছি তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিতে,

ওর তাকানো দেখে উৎসুক গলায় বললো দিদি, ও হাসলো একটু, যাক! তাও খোঁজ করেছিলো, সন্দেহ করা ছাড়াও আরো কিছু করে তাহলে! দিদি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পরে একটু খারাপ লাগছে এখন, দিতি র জন্যে না হোক, বাচ্চাটার কথা ভেবেও ওর একটু খবর নেওয়া উচিত বোধহয়। কিন্তু ওকে ফোন করলেই আবার ওই একই জিনিষ শুরু করবে নতুন করে, তার থেকে মায়ের কাছে খবর নিয়ে নেওয়াই ভালো, সকাল বেলা থেকেই অশান্তি ভালো লাগে না একদম!

রেডি হোসনি এখনও? বাবা এসে গেছে তো,

বলতে বলতে বেয়াই কে সঙ্গে নিয়েই ঘরে ঢুকে এলেন রুমা, দিতি অবাক হচ্ছিলো। বাবা হটাৎ এখানে!! নিশ্চয়ই শাশুড়ি কালকের ঘটনার পরে বাবা কে খবর দিয়ে এনেছে!! ইস! বাবার শরীর খারাপ এমনিতেই, এখন এসব জানলে যে কি হবে কে জানে!! কিন্তু শাশুড়ি কোথায় যাবার কথা বলছেন সেটাই তো ও বুঝে উঠতে পারছে না!!

তাড়াতাড়ি তৈরি হ, অর্ক ফোন করেছিলো, ও আবার কলেজে বেরিয়ে যাবে, ডুপ্লিকেট চাবি আছে তো তোর কাছে?

তারমানে, বাবা কে নিয়ে অর্কর কাছে শাশুড়ি ওকে পৌঁছে দিচ্ছে!! মুখটা একদম শুকিয়ে গেল দিতির, ও এখন কি করে! বাবা কি সব জেনে গেছে, কিন্তু মুখ দেখে তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না, আর ও তো কিছুতেই অর্কর সঙ্গে থাকবেনা ঠিক করেই নিয়েছে। কিন্তু বাবার সামনে এগুলো কি করেই বা বলে এখন, এসব শুনলেই তো বাবা অসুস্থ হয়ে পড়বে!

যদি বাবা কে কিছু না জানতে দিতে চাস, তাহলে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে একদম চুপ করে গাড়িতে বসে পড়,

ফিসফিস করে শাশুড়ির বলা কথাগুলোর মর্মার্থ ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলো। মা তার মানে বাবা কে সামনে রেখে ওকে অর্কর কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে। কিন্তু ওরও তো এখন কিছুই করণীয় নেই আর, বাবা কে তো কিছুই বলতে পারবে না। তাই প্রবল অনিচ্ছা সত্বেও ও ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

ভাগ্যিস আপনি ছিলেন দাদা, নাহলে তো রাতে এতটা পথ একা ফেরা একটু মুশকিল হতো আমার পক্ষে। অর্কর বাবা যেতে পারলে কোনো অসুবিধা ছিলো না, কিন্তু ও তো যেতে চাইলো না, অগত্যা আপনিই ভরসা,

দিতি কে শুনিয়েই যে শাশুড়ি কথা গুলো বললো সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছিলো, ওখানে পৌঁছেও ওকে মুখ বন্ধ রাখতে হবে, কারণ বাবা তার মানে আবার শাশুড়ির সঙ্গেই ফিরবে, ওর আর ফেরার কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু অর্কর সঙ্গে ও কি করে থাকবে ওখানে কে জানে!

লিফট থেকে বেরিয়ে ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবিটা বার করতে গিয়েই দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তার মানে অর্ক কলেজে যায়নি আজ। এই সময়ে কলেজে না গিয়ে বাড়িতে কি করছে! আজ কি ও শাশুড়ির সামনেই হাতে নাতে ধরতে পারবে অর্ক কে! কে আসে ওর বাড়িতে, দিতি না থাকলে, কার জন্যে কফি বানায় অর্ক, আজ সব কিছুই ও প্রমাণ করে দেবে। কিন্তু ও কি সত্যি প্রমাণ করতে চাইছে! তাহলে ওর হাত পা কাঁপছে কেনো? কেনো মনে হচ্ছে ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় যেনো!

শাশুড়ি কে বেলে হাত না দিতে দিয়েই চাবি টা দরজায় লাগিয়ে ফেললো ও, বেল বাজিয়ে ওকে সতর্ক হতে দেওয়া চলবে না একদম। দরজা টা খুলে ভেতরে পা দিতে দিতেই বেড রুমের দিকে চলে গেলো চোখটা, ওই তো বিছানায় শুয়ে আছে অর্ক, সঙ্গে কে আছে ওর, জানতেই হবে আজ! প্রায় দৌড়েই বেড রুমে ঢুকে পড়লো দিতি, পেছন পেছন ঢুকে আসা বাবা আর শাশুড়ির কথা ও ভুলেই গেছে এই মুহূর্তে!

অদিতি কে ঘরে ঢুকে আসতে দেখেই প্রায় ভুত দেখার মতন উঠে বসলো অর্ক, দিতি! ও কি ঠিক দেখছে! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না ও।

তুমি ! এখানে!

গত দুদিনের ঝগড়া ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো অর্ক, ও ঠিক দেখছে তো! দিতির চোখ এদিক ওদিক ঘুরছিলো তখন, নাহ! আর তো কেউ নেই! একটা অদ্ভুত শান্তি হচ্ছে মনটার মধ্যে, এটাই তো এতক্ষন ধরে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিলো ও। মিথ্যে হয় যেনো ওর ধারণা!

এখানে আসার জন্যে কান্না কাটি করছিলো, কি আর করা, ওখানে থাকতে না পারলে! এই অবস্থায় কান্নাকাটি ভালো নয় তাই না! তাই বাধ্য হয়েই দাদা কে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেলাম,

মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো অর্ক, ও সবটাই বুঝতে পারছে, কিন্তু দিতির বাবার সামনে কিছু বলার উপায় নেই। অসুস্থ মানুষ, এতদূর কষ্ট করে এসেছেন, তাই চুপ করেই থাকলো ও। রাতের খাবার বোধহয় করেই এনেছিলো মা বাড়ি থেকে, সেগুলো টেবিলের ওপর রাখলো।

একটু বসেই ওরা বেরিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি, অর্কও আর আটকাতে চাইলো না, বাবা বাড়িতে একা আছে, তাছাড়াও অনেকটা রাস্তা ফিরতে হবে, মা বেরিয়ে যাবার পরে সোফায় এসে বসলো ও। মা জোর করে দিয়ে গেলেই যে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে না, এটা কি মা বুঝতে পারেনি! যে সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই, সেই সম্পর্ক কোনো দিনও টিকে থাকে না।

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৬
সামনের মাসে শান্তিনিকেতনের প্ল্যানটা ফাইনাল করনা প্লিজ!!

কলেজের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিতে দিতে বললো শ্রেয়া, সবাই তৎক্ষণাৎ অনির্বাণের দিকে তাকালো। অনির্বাণ আজ সকাল থেকেই একটু চুপ চাপ, বন্ধুদের তাকানো দেখেই দ্রুত মাথা নাড়লো,

আমাকে জড়াস না প্লিজ!! আমি বাবার কাছে গাড়ি চাইতে পারবো না!!

তিয়াসা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, অনির্বাণটা যা, এক্ষুনি যে হ্যাঁ বলে দেয় নি তাই রক্ষ্যে। বার দুয়েক ওর গাড়িতে গেছে ওরা, গাড়িতে যাওয়া মানেই তো ওদের ড্রাইভারটা হা করে লুকিং গ্লাসের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকবে ওদের দিকে, মাঝে মাঝে এমন বিরক্তি লাগে না!! ক্ষমতা থাকলে ও চোখটাই গেলে দিতো, বেশ কয়েকবার অনির্বাণ কে বলেছেও সে কথা। অনির্বাণ ভয় পায়,

বাবার কাছে কেস খাওয়াবি নাকি!! ওই বুড়োটা বাবার রিপোর্টার জানিস না?

অনির্বাণের সরাসরি না বলে দেওয়াতে প্ল্যানটা একটু ধাক্কা খেলো, তিয়াসা তৎক্ষণাৎ রিয়ার দিকে তাকালো,

একবার তোর গাড়ি নিয়ে চল না!! প্রতিবারই তো অনির্বাণের গাড়ি নিয়েই যাওয়া হয়!!

রিয়া মাথা নাড়লো, শুকনো মুখে বললো,

বাবা কে না জানিয়ে কি করে নিয়ে যাবো বল তো? গাড়ি নিয়ে গেলেই তো বাবা সব জানতে পেরে যাবে!! তখন মাঝখান থেকে মাও বকুনি খাবে, চল না ট্রেনেই যাই।

তিয়াসা বিরক্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো, সব সময় অনির্বাণের গাড়ি নিয়েই যাওয়া হয়। রিয়ার মুখে শুধু বড়ো বড়ো কথা!! খরচা করার সময় সবচেয়ে আগে ওই পিছিয়ে যায়!! শ্রেয়া এতক্ষন চুপ করেছিলো, প্ল্যান প্রায় ভেস্তে যাচ্ছে দেখে এবার মুখ খুললো,

চল, ট্রেনেই যাই না হয়!! তবু চল তো! আর কয়েক মাস পরেই তো পরীক্ষা, তারপর কে কোথায় যাবো কে জানে!!

কথা শেষ হবার আগেই কৌশিক ঢুকলো, সবার দৃষ্টি কৌশিকের দিকে ঘুরল, রিয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

তুই যাবি তো?

কৌশিক একটু থতমত খেলো, কি প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে বুঝতে না পারলেও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। কৌশিক কে মাথা নাড়তে দেখে তিয়াসা একটু শ্লেষের গলায় বললো,

বাবা! কিছু না জেনেই হ্যাঁ বলে দিলি, হেব্বি প্রেম ভাই!!

কৌশিকের মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে সংযত গলায় বললো,

তুই এতো সব ব্যাপারেই কিছু মানে খুঁজে নিস কেনো বলতো? এটা তুই যদি বলতিস না, তাহলেও আমার উত্তর হ্যাঁ ই হতো!! অতো ভেবে চিন্তে কথা বলিনা তোর মতো!!

তিয়াসা প্রায় জ্বলে উঠলো,

আমি কি এমন ভেবে কথা বলি রে?

বলিস না ? আচ্ছা, আমারই ভুল হয়েছে তবে!! শুনতে তো পাই অনেককিছুই, কে কার সঙ্গে যাবে, কে কার গাড়িতে যাবে, কে কোথায় নামবে, সব কিছুই নাকি তুই আজকাল দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করছিস!!

অনির্বাণ দীপের দিকে তাকালো, সেদিনের মেট্রোর ওদের কথোপকথন তাহলে জায়গামতোই পৌঁছে গেছে! শ্রেয়া মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছিলো, দীপটা আবার ওর নাম নিয়ে কিছু বলে নি তো! তিয়াসার যা মুখ!! আর এগোতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো শ্রেয়া,

আমার একটু লাইব্রেরী যাওয়ার আছে, দীপ চল না প্লিজ!

দীপ এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো, কৌশিক যে এরকম হাটে হাঁড়ি ভেঙে ফেলবে, এটা ও একদম ভাবতে পারে নি, তাড়াতাড়ি শ্রেয়ার পিছু ধরলো,

হ্যাঁ, চল।

পরিস্থিতি একটু জটিল হয়ে গিয়েছিলো, দীপ আর শ্রেয়া বেরিয়ে যাওয়ার পরেই কৌশিক, রিয়া কে ডেকে নিয়ে ওদের পিছু ধরলো, ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে অনির্বাণ একটু রাগের গলায় বললো,

ঠিক করেছিস!

তুই তো বেশি আদিখ্যেতা দেখাস! কতোবার বলেছি তোকে, ওদের গাড়িতে চড়ানোর, বাড়িতে ডাকার কোনো দরকার নেই। তবু তুই ডাকবি!!

আর কোনো দিনও ডাকবো না!! যা করেছে না!! বাবা হেব্বি খোচে আছে ভাই!! সেদিন গিয়ে ওদের মধ্যে কেও একটা নিচে আমাদের দোকান থেকে নাকি কোনো এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ফোন করে ইয়ার্কি মেরেছে, যা তা কান্ড!

তুই কি করে জানলি? কে দেখেছে ফোন করতে?

একটু অবাক গলায় প্রশ্ন করলো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

আরে, কেও দেখেনি! ওটাই তো আসল সমস্যা! বাবা নাকি কিছুক্ষনের জন্যে দোকান থেকে ওপরে এসেছিলো, সেই সময় যে দুটো ছেলে থাকে দোকানে, ওরাও ছিলো না। বাবা যদিও ভদ্রমহিলা কে উল্টে থ্রেটনিং দিয়েছে, কিন্তু উনি নাকি বলেছেন যে উনি ইনকামিং নম্বর দেখেই রিং ব্যাক করেছেন। এবার বাই চান্স যদি পুলিশের কাছে সত্যি চলে যায়, তাহলে আমাদের দোকানের রেপুটেশন পুরো নষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু ওরাই যে এটা তুই কি করে সিওর হচ্ছিস? দেখে তো নি কেউ!

অনির্বাণ ঘাড় নাড়লো,

সেখানেই তো প্রবলেম, তাই তো ডাইরেক্ট কিছু বলতে পারছি না। বাবা তো আর জানতো না যে তোরাও নিচে নেমেছিলি, বাবা তাই বোন কে সাসপেক্ট করছিলো, ও ছাড়া আর তো বাড়িতে অল্পবয়সী মেয়ে কেউ নেই। আমি তো তারপর তোদের সঙ্গেই স্যারের বাড়িতে চলে গিয়েছি, জানিই না কখন এসব হয়েছে! এসেও শুনি নি আর কিছু। কাল সকালে দেখি মা বোন কে খুব বকাবকি করছে, তখন বোনই বললো, যে বাবা যে সময়ের কথা বলেছে তখন নাকি তোরাও বাড়িতে ছিলি!! ও নাকি তোদের সবাইকেই বার দুয়েক নিচের দিকে যেতে দেখেছে,

তুই আমাকেও সন্দেহ করছিস নাকি? ইস! আমার খুব খারাপ লাগছে!! বিশ্বাস কর, আমি কিন্তু এরকম কিছু করিনি, নিচে নেমেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা জাস্ট এমনই।

অনির্বাণ তাড়াতাড়ি তিয়াসার হাতটা ধরে ফেললো,

আরে ধুর! তোকে সন্দেহ করলে আর তোকে বলতাম নাকি! তুইও পারিস! আমার তো শ্রেয়া কে সন্দেহ হয়, ওই এরকম উল্টোপাল্টা ইয়ার্কি মারে সব সময়!! ফার্স্ট ইয়ারে একবার কৌশিকের ফোন থেকে কোন একটা রান্ডম নম্বরে ফোন করে একটা মেয়ের গলা শুনে কৌশিক কে ফাঁসিয়ে ছিলো, মনে আছে?

তিয়াসা মাথা নাড়লো, একটু অন্য মনস্ক গলায় বললো, রিয়াও হতে পারে। ও ও কিন্তু প্রচুর মিথ্যে কথা বলে, আমি লক্ষ্য করেছি। দীপ সেদিন ঠিকই বলেছিলো, ও যদি সত্যিই বড়লোক হতো, তাহলে মেট্রোয় যেতো না!

ছাড়! এখন চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য কোনো অপশন নেই! প্রমাণ ছাড়া কাউকে ব্লেম করা যায় না! সমস্যা একটাই, যদি ভদ্রমহিলা সত্যিই পুলিশে চলে যান, তাহলে কি হবে কে জানে! বাবার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে তখন, যেই করুক না কেনো, আফটার অল ফোনটা আমাদের দোকানের নম্বর থেকেই তো গিয়েছে!

পুলিশে যেতে পারে মহিলা? এতোটা বাড়াবাড়ি করবে! সামান্য একটু ইয়ার্কি মারার জন্যে!

শুকনো গলায় বললো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

যায় না কেউ সাধারণত, তবে ভদ্রমহিলা যেতে চাইছিলেন! জানি না কেনো! বলেছেন ওনাকে নাকি কিছু ব্যক্তিগত কথা বলেছে কেউ!

রান্ডম নম্বরে কল করলে কেউ ওনাকে কিভাবে চিনবে যে, ব্যক্তিগত কথা বলবে?

বিস্মিত গলায় বললো তিয়াসা,

সেটাই তো অবাক লাগছে! তারমানে কেউ চেনা নম্বরেই কল করে ইয়ার্কি মেরেছে! কি বলেছে সেটা জানতে পারলে ব্যাপারটা অনেকটা ক্লিয়ার হতো, কিন্তু সেটা উনি বলতে চান নি।

তাহলে এই মুহূর্তে তো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই! তুই এই অবস্থায় কাকুর কাছে গাড়ি চাইতে যাস না কিন্তু কিছুতেই, সে ওরা তোকে যতোই বার খাওয়াক!

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

পাগল! কেউ চায় নাকি আর! আমাকেই বাড়ি ছাড়া হতে হবে তাহলে!

কি হলো? ক্লাস শেষ না তোর? বাড়ি যাবি না? নাকি বউ নেই বলে আর বাড়িতে ঢুকতে চাইছিস না,

টিচার্স রুমের চেয়ার টেনে অর্কর পাশে বসতে বসতে হেসে বললো অরিন্দম, অর্ক মাথা নাড়লো,

অদিতি চলে এসেছে রে!

অরিন্দম একটু চমকে উঠলো,

চলে এসেছে! কেনো? এই তো দুদিন আগেই তুই দিয়ে এলি। বললি যে মাস খানেক থাকবে এখন! শরীর খারাপ নাকি?

ফাঁকা টিচার্স রুমের চারপাশটা দেখে নিয়ে অর্ক মাথা নামালো, নিচু গলায় বললো,

বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না! অদিতি পুরো পাগল হয়ে গেছে, কি সব উল্টোপাল্টা বলেছে মা কে! আমি নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই! ওকে নাকি কেউ ফোন করে বলেছে! লাইফটা একদম হেল হয়ে গেছে!

অরিন্দম অবাক হয়ে তাকালো,

মাসীমা বিশ্বাস করলেন এসব কথা?

কে জানে! প্রথমে তো করেছিলো, এখন বোধহয় একটু একটু বুঝতে পারছে, তাই নিজেই এসে দিয়ে গিয়েছে কাল!

অদিতি তো এরকম ছিলো না! হটাৎ এরকম করলো কেনো? কেউ ওকে সত্যিই ফোন করে কিছু বলে নি তো?

একটু চিন্তিত গলায় বললো অরিন্দম, অর্ক প্রায় জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো,

তুইও! কে এসব বলবে বলতো? কার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? ঘটনাটা অন্য! আমি ওকে একরাত ফোন করিনি তাই! দেখিস নি আগে এটা! ফোন না ধরলেই কি রকম চিৎকার চেঁচামেচি করতো!

সে ওর টেনশন হতো তাই! তাই বলে এরকম কথা বলবে? আর তুই বা করিস নি কেনো ফোন? এতো ইরেস্পন্সিবল না তুই! অহেতুক ঝামেলা তৈরি করিস!

আরে! ইচ্ছা করে করিনি নাকি! ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ভাই! তারমধ্যে কখন আবার সাইলেন্ট করে দিয়েছিলাম কে জানে!

অর্কর উত্তরে বিরক্ত হলো অরিন্দম,

তো সেটা কে কি বলে? ইরেস্পনসিবলই তো? নিজের বাড়িতে ফোন হারিয়ে ফেললি? আর এই সাইলেন্ট মোডে রাখা নিয়ে তো তোদের আগেও ঝামেলা হয়েছে, তাও রাখিস কেনো? ক্লাস শেষ হলে ঠিক করে নিতে পারিস না!

অর্ক চুপ করে থাকলো, খানিকক্ষন পরে মনমরা গলায় বললো,

বিশ্বাস কর, শুধু বাচ্চাটার জন্যে! না হলে আমার সত্যি আর অদিতির সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে না!! ভুল করেছি এটা মেনে নিয়েও বলছি, একটা ফোন না ধরার শাস্তি কখনই এতো বড়ো অপবাদ হতে পারে না! বাবা, মা সবার সামনে এমন সিন ক্রিয়েট করলো না! একদম ছোটো লাগছে নিজেকে!

শোন! ভুল তো দুজনেই করেছিস! আর এটা নিয়ে টানিস না! বাচ্চাটার কথা ভেবেও তো তোদের গন্ডগোল মিটিয়ে নেওয়া উচিত! আমার একজন খুব ক্লোজ বন্ধু আছে, খুব ভালো কাউন্সিলিং করে! একবার কথা বলে দেখতে পারিস, ফোন করি?

কাউন্সিলর! কাউন্সিলর কি করবে? অদিতি এসব ইচ্ছা করে করছে!

বিরক্ত গলায় বললো অর্ক, অরিন্দম ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটু চিন্তিত হয়ে বললো,

কিন্তু কেনো করছে সেটাও তো জানা দরকার, তাই না? এতদিন তো এরকম কিছু করে নি! একবার কথা বলে দেখতে ক্ষতি কি!

অর্ক কে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নম্বরটা ডায়াল করে ফেললো অরিন্দম। উল্টোদিকের কথা শুনতে না পেলেও অরিন্দমের বিস্তারিত বিবরণ শুনলো অর্ক, প্রায় মিনিট পনেরো কথার পরে ফোনটা নামিয়ে রেখে অর্কর দিকে তাকালো অরিন্দম,

শোন! সাথী মানে আমার বন্ধু বললো, দুটো ব্যাপার হতে পারে! হয় সত্যিই কেও ওকে ফোন করেছিলো, অথবা ওর মানসিক সমস্যা হচ্ছে, প্রেগন্যান্সি তে নাকি কারো কারো হয় এগুলো। আমি কথা বলে নিয়েছি, দু একদিনের মধ্যেই অদিতি কে নিয়ে চলে যা! যদি সত্যি মানসিক সমস্যা হয়ে থাকে প্রেগন্যান্সির জন্যে, তাহলে কিন্তু অবশ্যই কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলা উচিত। না হলে পরে আরো বাড়তে পারে!

প্রেগন্যান্সির জন্যে মানসিক সমস্যা হতে পারে! অর্কর হটাৎ করেই খুব খারাপ লাগলো অদিতির জন্যে, ও কিছু না ভেবেই সত্যি খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে! তাড়াতাড়ি চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্ক, ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে!

অরিন্দমও উঠে দাঁড়ালো, ওর ক্লাসও শেষ হয়ে গিয়েছিলো, দুজনে একসঙ্গে মেট্রোর দিকে এগোলো। মেট্রো থেকে নামার আগে অর্কর দিকে তাকিয়ে বলে গেলো অরিন্দম,

কি হলো জানাস কিন্তু, একটু বুঝিয়ে বলিস অদিতি কে। ও রাজি হলে কালই চলে যাস সাথীর কাছে।

অর্ক মাথা হেলাল,

হ্যাঁ, জানাচ্ছি তোকে!

চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-৩+৪

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৩+৪
সামান্য লজ্জা বোধ নেই অর্কর, এতো বড় ঘটনা ঘটানোর পরেও বিন্দুমাত্র লজ্জিত নয় ও, মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিলো অদিতির। কাল রাতে কতো বার ফোন করেছে ও অর্ক কে, মেয়েটার কথাগুলো শোনার পর থেকেই অর্কর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে ও, একবারের জন্যেও ফোন ধরেনি ও, নিশ্চয়ই নিজের সুবিধার জন্যেই ইচ্ছা করেই সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছিলো। আর বলে কিনা, ও ফোন খুঁজে পাচ্ছিলো না, ওই টুকু ফ্ল্যাটের মধ্যে ফোন হারিয়ে গেলো, আবার সকালেই পেয়েও গেলো সেটা!

নিজেকে বেশি চালাক ভাবে ও, অদিতি কি বোকা নাকি! যা বোঝাবে তাই বুঝবে ও! আর কিচ্ছু জানতেই চায়না ও মেয়েটার সম্বন্ধে, যা বোঝার ও সবটাই বুঝে গিয়েছে। যাতে অদিতি কাল রাতে যোগাযোগ করতে না পারে সেইজন্যেই এই প্ল্যান, অর্ক কে যতটা সহজ সরল ও ভাবতো ততটা নয় ও, এখন ও সেটা বেশ টের পাচ্ছে।

এতো চিৎকার করছিস কেনো? নিজের শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো! বাচ্চা টার কথাটাও একটু ভাব,

শাশুড়ির গলার আওয়াজে নিজেকে সামলালো দিতি, ও কি খুব জোরে চিৎকার করে ফেলেছে! উনি কি কিছু শুনতে পেলেন!

ফোন ধরেনি নাকি? দাঁড়া, আজ আমিও বলবো ওকে, খুব খারাপ অভ্যাস,

শাশুড়ির কথায় একটু হাসলো দিতি, নিজের ভেতরের চলা তোলপাড় টা কে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। মা যদি বুঝতে পারে, তাহলে এতো সহজে ছেলে কে ছেড়ে দেবে না, সেটা দিতি ভালো করেই জানে। কিন্তু এটা একান্তই ওদের দুজনের সমস্যা, কোনো প্রমাণ ছাড়া অর্কর সম্বন্ধে অভিযোগ আনা যে হাস্যকর, এটা ও ভালোই জানে, তাই এই মুহূর্তে অন্য কারোর এই ব্যাপারে ঢুকে পড়া ও চাইছে না। যা করার ও নিজেই করতে পারে, এত দুর্বল ও নয়!

ঘন্টা খানেক ফোন বন্ধ করে রাখার পর থেকেই মন টা খারাপ লাগতে শুরু করেছে। যতই হোক, অদিতির শরীর খারাপ, এই অবস্থায় হয়ত একটু বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছে, তাই বলে ওর তো নিজের মাথা টা ঠান্ডা রাখা উচিত। কিছুক্ষন ভাবার পরে রাগ টাও কমে আসছে আস্তে আস্তে, ফোন টা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে অন্ করে রাখলো অর্ক। ও নিজে থেকে কিছুতেই করবে না আর, কিন্তু দিতি করলে অন্তত ধরতে পারে যাতে।

নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে ওর, এতো ভুলো মন যে ওর কি করে হলো! রান্না ঘরে গ্যাসের ওভেনের তলায় কি করে ফোন টা রেখে এলো ও, কিছুতেই মনে করতে পারছিলো না। সোফার ওপর থেকে ওটা তো আর পায়ে হেঁটে ওখানে যায় নি, নিশ্চয়ই ওই রেখেছে, অন্যমনস্ক হয়ে কখনো। তাও তো খুঁজে পেতোনা, যদি না সকালে চা করতে গিয়ে গ্যাসের ওপর দুধ পড়তো, আর সেই দুধ মুছতে গিয়ে ওভেন সরাতে হতো!

দাদা চা, বৌদির শরীর কেমন আছে?

চায়ের ট্রে টা টেবিলে রেখে প্রশ্ন করলো রান্নার দিদি, একটু হাসলো অর্ক।

হ্যাঁ, ভালো আছে। আচ্ছা দিদি, কাল তুমি রাতে রান্না করে গ্যাস মুছে ছিলে?

অর্কর প্রশ্নে একটু অবাক হলো সরমা, এ আবার কি প্রশ্ন! দাদা এতো সংসারী কবে থেকে হলো আবার! সরমা কে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে পড়লো অর্ক, প্রশ্ন টা একটু অদ্ভুত হয়ে গেছে, নিজেই বুঝতে পারছে সেটা।

আসলে আমার মোবাইল টা কাল থেকে পাচ্ছিলাম না, আজ সকালে ওটা গ্যাসের তলায় পেলাম, তাই জানতে চাইছিলাম,

নিজের থেকেই বললো ও, সরমা একটু স্বস্তির শ্বাস ফেললো। বৌদি বোধহয় ওখান থেকেই নজর রাখছে এতক্ষন ওটাই ভাবছিলো মনে মনে, তাড়াতাড়ি বললো,

না দাদা, মুছেছিলাম তো, তখন তো তোমার মোবাইল ছিলো না ওখানে,

সরমা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। ও চলে যাবার পর থেকেই অস্বস্তি হচ্ছে, যদ্দূর মনে পড়ছে ও তো রাতে রান্না ঘরে যায়নি আর, একদম তো সকালে চা করতে গেলো। সরমা তো রাতের খাবার ডাইনিং টেবিলের ওপরে রেখে যায়, রান্না ঘরে যাবার তো প্রয়োজন পড়েনি আর। মোবাইল টা ওখানে গেলো কিভাবে, কিছুতেই মনে করতে পারছে না।

দরজা টা বন্ধ করে দাও দাদা,

সরমা র ডাকে হুঁশ ফিরলো অর্কর, দরজা বন্ধ করতে পেছন পেছন এলো ও,

আমি যাবার পরে কেউ এসেছিলো দাদা কাল? অনেকগুলো কফির কাপ দেখলাম সকালে বাসন মাজতে গিয়ে, ওই কফি করতে গিয়েই বোধ হয় মোবাইল রেখে এসেছিলে,

বলতে বলতেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো সরমা, ওর এখন দাঁড়িয়ে দাদার মোবাইল হারানোর রহস্যভেদ করার সময় নেই। আরও চারটে বাড়ির কাজ পড়ে আছে এখনো, নেহাত বৌদি নেই তাই এ বাড়িতে এখন একটু বেশি সময় দিতে হচ্ছে। নাহলে এতক্ষনে আরও দু বাড়ি সেরে ফেলতো ও!

কফি করতে গিয়ে! একটু অন্যমনস্ক হয়েই দরজা বন্ধ করে ঘরের সোফায় এসে বসলো অর্ক। কাল ওর বেশ কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী এসেছিলো, তারাই কফি করেছিলো। ও ও অবশ্য বার দুয়েক গিয়েছিলো বিভিন্ন জিনিস দেখিয়ে দিতে, তাহলে তখনই ফেলে এসেছিলো নিশ্চয়ই।

যুৎসই একটা কারণ খুঁজে বার করতে পেরে মনের অস্বস্তিটা দূর হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ, কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর বসে না থেকে উঠে পড়লো অর্ক। দিতির সঙ্গে কথা এখন আর বলবে না বলেই ঠিক করে নিলো ও। এখন ওর মাথা গরম হয়ে আছে, কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে ঠান্ডা হয়ে যাবে, সন্ধ্যেবেলায় নিশ্চিন্তে বসেই কথা বলবে একদম।

সন্ধ্যে বেলা অর্কর সঙ্গে রাগারাগি করার পর থেকেই শরীর টা সত্যিই খুব খারাপ লাগছে, বিছানায় চুপ করে শুয়ে ছিলো দিতি। নাহ! অর্কর জন্যে নিজের বাচ্চার ও ক্ষতি করতে পারবে না, জাহান্নামে যাক অর্ক, ও আর কিছুতেই মনের মধ্যে অশান্তি আনতে দেবে না।

ডাক্তার ওকে বার বার বলে দিয়েছেন চিন্তা না করতে, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো দিতি, মনের মধ্যে জমা হয়ে থাকা দুশ্চিন্তা গুলো সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। আগামী কয়েক মাস ও শুধু নিজের বাচ্চার কথাই ভাববে, অর্কর ব্যাপারে ডিসিশন নেওয়ার জন্যে সারাজীবন পড়ে রয়েছে। কিন্তু বাচ্চা র কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে ও নিজেকেই ক্ষমা করতে পারবে না।

কাল সারা সন্ধ্যে কোথায় ছিলো অর্ক, ও জানতেই পারলো না একদম। বাড়িতে ছিলো বললেই ও বিশ্বাস করবে কেনো? কোনো প্রমাণ আছে ওর কাছে? বাড়িতে থাকলেও যে একাই ছিলো এটা কি করে বুঝবে ও, না চিন্তা করতে চাইলেও শুধুই প্রশ্নগুলো ঘুরে ফিরে আসছে!

ফোন না ধরার মতো কি এমন পরিস্থিতি হয়ে ছিলো, সেটা না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই। কিন্তু অর্কর বলা কথা বিশ্বাস করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে ওর। ইসস, কেনো যে ও বিশ্রাম নেবার জন্যে এখানে আসতে গেলো, এখন নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চমক খেলে গেলো ওর মাথার মধ্যে, এতো কিছু ও ভাবছে কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর তো ও এক্ষুনি পেতেই পারে, রান্নার দিদি কে ফোন করলেই তো জানা যাবে অর্ক কাল সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ছিলো কিনা! দিদি তো রান্না করতে এসেছিলো কাল রাতে! মাথা টা ঠান্ডা করে সবটা ভেবে নিয়ে, ফোন টা হাতে তুলে নিলো ও, খুব কায়দা করে কথাটা জানতে হবে! দিদি কে ওর জিজ্ঞেস করার আসল কারণ কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না, তাহলেই এক্ষুনি পাঁচ বাড়ি গল্প করে বেড়াবে!

লাস্ট ক্লাস টা শেষ হলো চারটে নাগাদ, ক্লাস শেষ করে ও আর অরিন্দম কলেজ থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে সমর দা ডাকলেন। অর্কর সঙ্গে অরিন্দমের চোখাচোখি হলো, দুজনের কেউই বিশেষ পছন্দ করেনা সমরদা কে, কিন্তু সিনিয়র প্রফেসরের ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক ওদের থেকে অনেকটাই সিনিয়র, কিন্তু কথা বার্তা সিনিয়র সুলভ নয়। সব ব্যাপারেই আগ বাড়িয়ে কমেন্ট করা ওনার স্বভাব, কলেজে নিজের ছাত্র ছাত্রীদের সম্পর্কেও উনি যে সব মন্তব্য করেন তা একদমই শিক্ষক সুলভ আচরণ নয়।

অর্ক চুপ করে থাকলো, অরিন্দম ঘাড় ঘুরিয়ে হাত নাড়লো, মুখে জোর করে একটু হাসি টেনে এনে বললো,

আরে! দাদা যে! ক্লাস শেষ হয়ে গেলো নাকি? মেট্রো ধরবেন তো? চলুন তাহলে,

সমর দাস পা চালিয়ে এগিয়ে এলো, অর্কর দিকে তাকিয়ে ভ্রু ভঙ্গি করে বললো,

মেট্রো ছাড়া আর কোথায় যাবো বলো! কিন্তু অর্ক বাবুর তো আমার কোম্পানি পছন্দ নয় বলেই মনে হচ্ছে! তোমরা বরং এগিয়েই যাও!

অর্ক তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো,

আরে, না না! সেরকম কিছু নয়, চলুন চলুন একসাথেই যাই!

তিনজনে একসঙ্গে এসে মেট্রো স্টেশনে ঢুকলো। অরিন্দম অবিবাহিত, অর্কর বউ বাড়িতে নেই, তাই আজ কলেজ ফেরত দুজনে অরিন্দমের বাড়ি গিয়ে একটু আড্ডা মারার প্ল্যান হচ্ছিলো, কিন্তু এখন সমর দাসের উপস্থিতি তে সে প্ল্যান দুজনেই চোখের ইশারায় চেঞ্জ করে ফেললো।

ওরা যেখানে এসে দাঁড়ালো, তার পাশেই ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীরা জটলা করে দাঁড়িয়ে ছিলো, অরিন্দম ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো একটু। প্রত্যুত্তরে ওদের মুখেও হাসি ছড়িয়ে পড়লো, দু একটা টুকটাক কথাবার্তার পর সম্ভবত স্যরদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই ওরা একটু পেছন দিকে এগিয়ে গেলো। যেতে যেতেই ওদের মধ্যে একজন অর্কর দিকে তাকালো,

স্যার, কাল আপনার বাড়িতে আমার সানগ্লাসটা ফেলে এসেছি,

অর্ক একটু চিন্তা করে বললো,

তাই নাকি! খেয়াল করিনি তো! আচ্ছা, খুঁজে পেলে কাল কলেজে নিয়ে আসবো,

ছেলে মেয়ের দল টা চলে যাবার পরে সমর দা ওর দিকেই ফিরলেন,

ওর নাম অনির্বাণ না? কাল তোমার বাড়ি গিয়েছিলো কি করতে?

অর্ক সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ, ওদের কিছু প্রবলেম ছিলো, তাই!

সমর দাসের মুখটা একটু গম্ভীর হলো। তাঁর মতো সিনিয়র প্রফেসর থাকতে এই অল্পবয়সী ছেলেদুটির স্টুডেন্ট মহলে এই জনপ্রিয়তা তাঁর একটুও পছন্দ নয়। কিন্তু কিছু করার নেই, চেষ্টা যে তিনি করেন নি তাতো নয়, কিন্তু এদের কে কিছুতেই কোণঠাসা করে উঠতে পারছেন না! এর মধ্যেই মেট্রো এসে গেলো, দুটো স্টেশন পরে অরিন্দম নেমে যেতেই অর্কর দিকে তাকালো সমর দাস,

দেখলে অরিন্দম কে! কি রকম যেচে যেচে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছিলো! ছেলেটার একটা কিছু ব্যবস্থা কর ভাই, কলেজের মেয়েরা যে সব বিরক্ত হয়ে পড়ছে! এইচ ও ডি সেদিন বলছিলেন, অনেক কমপ্লেন আসছে কিন্তু!

অর্ক ভ্রু কুঁচকে তাকাল, অরিন্দম যথেষ্টই ভদ্র ছেলে, ওর নামে কমপ্লেন আসছে, এটা বিশ্বাস করা মুশকিল! এইচ ও ডি র নাম করে বলে দিলেই সব বিষয় আসলে খুব গুরুত্ব পেয়ে যায়! অর্ক খুব ভালো করেই জানে ওদের এইচ ও ডি একদম অন্য রকমের মানুষ, তাঁর কিছু বলার থাকলে সরাসরি অরিন্দম কেই বলতেন, এতো কথা ছড়াতেন না। সমর দার এইসব কথার জন্যেই সবাই ওনাকে এড়িয়ে চলে। ভদ্রলোকের যথেষ্টই বয়স হয়েছে, সব বয়সে সব কথা যে শোভা পায়না সেটা উনি বোঝেন না, অর্ক চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো।

অর্ক কে চুপ করে থাকতে দেখে বোধহয় কিছু বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক, আর এই প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন না। অর্কর স্টেশন এসে গেলো, একটা ছোট্ট আসছি বলেই মুখটা ইচ্ছাকৃতভাবেই গম্ভীর রেখে নেমে গেলো অর্ক।

স্যারদের কে দেখেই স্টুডেন্টদের দলটা মেট্রোর পেছনের দিকের একটা কামরায় উঠলো। সেটা অর্ক বা অরিন্দমের জন্যে নয়, তার একটাই কারণ সিনিয়র প্রফেসর সমর দাস।

এই সমর স্যার না! কি রকম চোখ ঘুরিয়ে দেখছিলো দেখলি!!

তিয়াসার কথা শেষ হবার আগেই অনির্বাণ খেই ধরে নিলো,

আরে ভাই! আমি বুঝবো কি করে, যে অর্ক স্যারের বাড়ি গেছি শুনেই ওর মুখটা ওই রকম হয়ে যাবে!

কৌশিক হেসে উঠলো, মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো,

হেব্বি জেলাস ভাই! ক্লাসে এসেও খালি মেয়েদের দিকেই তাকিয়ে পড়ায়! আমরাও যে বসে আছি সেটা ওকে দেখলে মনে হয় না!

এই কথাটায় মেয়েরা কেও এগ্রি করলো না, রিয়া আর তিয়াসা দুজনেই প্রতিবাদ জানালো। তর্ক জমে ওঠার আগেই রিয়ার স্টেশন এসে গেলো, ও আর কৌশিক দুজনেই নেমে পড়লো। দুজন কে একসঙ্গে নামতে দেখে অনির্বাণের ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে গেলো।

আমি জানি তুই কেনো হাসলি! কিন্তু রিয়া কে পটানো একটু চাপের আছে! কোথায় কৌশিক আর কোথায় রিয়া!

তিয়াসা অনির্বাণের প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো যাতে দীপ আর শ্রেয়া শুনতে না পায়। ওদের সঙ্গে কৌশিকের বন্ধুত্বটা একটু বেশি।

কেনো রিয়া এমন কি? কোনো রকমে তো অনার্সটা পেয়েছে!

ততোধিক নিচু গলায় অনির্বাণ উত্তর দিলো, তিয়াসা মাথা নাড়লো,

ধ্যাত! পড়াশুনার কথা কে বলছে! আমি তো ওর বাবার টাকার কথা বলছি, বড়লোক বাপের মেয়ে ভাই! ওরকম দশটা কৌশিক কে কিনতে পারে!!

শেষের কথাগুলো বোধহয় একটু জোরেই হয়ে গিয়েছিলো, দীপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, অনির্বাণ ম্যানেজ করার চেষ্টা করলো,

ওই টাকাটাই আছে শুধু! কৌশিক বরং ওর থেকে ভালো কিছু ডিজার্ভ করে!

দীপের স্টেশন এসে গিয়েছিলো, গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে আস্তে করে বললো

বাপ যদি এতোই বড়লোক, তাহলে মেট্রোয় যায় কেনো?

সে তো অনির্বাণও যায়! ওর বাবা তো বিশাল বিজনেসম্যান!

শ্রেয়া মুচকি হেসে বললো, দীপ হাত তুললো,

আরে! সেতো ভাই তিয়াসার জন্যে! আমার, তোর জন্যে নাকি! নামবি নাকি আমার সঙ্গে?

না রে, কাল অনির্বাণের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে অর্ক স্যারের বাড়ি হয়ে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিলো। আজও হলে মা ক্ষেপে যাবে!

তড়িঘড়ি জবাব দিলো শ্রেয়া, দীপের কথাটার উত্তর বাকি দুজনের কাছে ছিলো না, তিয়াসা আর অনির্বাণ শুকনো মুখে হাতটা তুললো শুধু,

বাই!

সরমা কোনো রকমে চার বাড়ি কাজ শেষ করে দৌড়ে এসে চারটে পাঁচের ক্যানিং লোকালে পা দিয়েছিলো, হটাৎ করেই ফোন বেজে উঠলো। গুছিয়ে বসে ফোন ধরে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই অদিতির গলা ভেসে এলো, সরমা একটু বিরক্ত হলো, তাও গলায় মধু ঢেলে বললো

দাদার রাতের রান্না করে এসেছি বৌদি, তুমি নিশ্চিন্তে কদিন থাকো দেখি!!

দিতি লজ্জা পাচ্ছিলো, কিভাবে আসল কথাটা জানতে চাইবে ভাবতে ভাবতে একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো,

হ্যাঁ, সে তো জানি, দাদা বলেছে আমাকে। কাল রাতে কি রান্না করেছিলে? দাদা বাড়িতে ছিলো তো তখন? জিজ্ঞেস করে নিয়ে করেছিলে তো?

এতো প্রশ্নে সরমা বোধহয় বিরক্ত হলো, তার আড্ডার দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, একটু বিরক্ত গলায় বললো,

হ্যাঁ গো জিজ্ঞেস করেই করেছি, দাদা বাড়িতেই ছিলো। এতো কফির কাপ জমেছে, সকালে বাসন মাজতে গিয়ে দেখলাম,

সরমা ফোন রেখে দিল, কথা বলে ফোন টা নামিয়ে রাখার পর থেকেই খুব মন খারাপ হয়ে গেলো অদিতির, না করলেই ভালো হতো ফোন, কেনো যে করতে গেলো! ওর কথা থেকেই পরিষ্কার কেউ কাল সন্ধ্যেবেলা, অর্কর সঙ্গে ছিলো ফ্ল্যাটে, কফিও করেছিলো তার জন্যে অর্ক। অর্ক যে কফি করতে পারে, তাই তো ও জানতো না এতদিন! আজ পর্যন্ত তো ওকে কোনোদিনও খাওয়ায় নি করে! অর্ক কে চা করতেই ও দেখেছে শুধু, কে এমন স্পেশাল গেস্ট এলো যার জন্যে কফি করলো অর্ক! তাও অনেকগুলো কাপ! সে কি অনেকক্ষণ ছিলো ওখানে! না হলে এতো কফির কাপ হয় কি করে!!

কিন্তু ও তো আর অর্কর সঙ্গে কোনোদিনও কথা বলবে না ঠিক করেই নিয়েছে, তাই এইসব প্রশ্নের উত্তর ও আর জানতে চাইবে না কখনও। কেউ যে এসেছিলো ওর ফ্ল্যাটে সেটুকুও তো ওকে জানায়নি অর্ক, ফ্ল্যাটটা তো ওরও নাকি! মাত্র দুদিন হলো ও এসেছে,এর মধ্যেই কে ফ্ল্যাটে এলো, গেলো, সেগুলো আর জানানোর প্রয়োজন ওকে মনে করছে না যখন তখন ও নিজে থেকে কিছু জানতে চাইবে না। কিন্তু এটা তো ও বুঝতেই পারছে নিশ্চয়ই কোনো মেয়েই হবে, সম্ভবত সেই মেয়েটাই, যে ওকে ফোন করেছিলো, নিজের দোষ লুকিয়ে রাখার জন্যই এখন এ বিষয়ে আর কোনো কথাই ওকে অর্ক বলতে চাইছে না।

তার মানে মেয়েটা যেই হোক না কেনো মিথ্যে কথা বলেনি একটুও। কিন্তু মেয়েটা কে এবার ও কোথায় পাবে! আর তো একবারও ফোন করলো না ওকে। কেনো যে তখন ও ফোন টা কেটে দিয়েছিলো, তাই এখন সব জেনেও ওকে চুপ করে থাকতে হচ্ছে। অর্কর মুখোশ টা ও কারোর কাছেই খুলতে পারবে না কোনো দিনও, ওর কাছে এই মুহূর্তে কোনো প্রমাণ নেই।
ক্রমশ

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৪
মেট্রোর গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতেই রিয়া কৌশিকের দিকে তাকালো,

চল, চলি এবার, টা টা!

কৌশিক চুপ করে থাকলো, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়া একদম ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,

আচ্ছা, তুই হটাৎ এখানে নেমে পড়লি কেনো বলতো? তোর টালিগঞ্জ নামলে সুবিধা হয় না?

মুহূর্তে কৌশিকের মুখ গম্ভীর হলো, ওর এখানে নেমে পড়ার কারণ রিয়ার অজানা নয়, তাও জেনেশুনেই কথাগুলো বলছে!

তুই জানিস না আমি কেনো নেমেছি?

কৌশিকের গলার স্বরে অপমানের সুর। রিয়া একটু চুপ করে থাকলো, তারপরে আস্তে আস্তে বললো,

তুই তো জানিস আমার বাবার কথা, বাবা এসব মেনে নেবে না একটুও!

এই কথাগুলো গত তিন বছর ধরে শুনছি, আর নতুন করে শোনার নেই! এই বছরটা আমাদের একসঙ্গে কাটানো শেষ বছর, এখনও তুই মনস্থির করতে পারলি না? তোর বাবার কথা ছাড়, তুই নিজের কথা বল? তুই কি ভাবছিস?

বিশ্বাস কর, আমার ভাবাভাবির কিছু নেই। আমার বাবা একটা হাই ফাই স্টাটাস মেনটেইন করে চলে, তোর মতো মধ্যবিত্ত ছেলের সঙ্গে বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবে না।

তারমানে তোর বাবার ইচ্ছেই তোরও কথা, তাই তো?

একটু ভাঙা গলায় বললো কৌশিক, রিয়া মাথা নাড়লো,

প্লিজ! আমি বন্ধু হিসেবে তোকে হারাতে চাই না!

কৌশিক চুপ করে থাকলো, তারপর বললো,

ঠিক আছে, চল তোকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি অন্তত। আজ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে যেতেও তো বলিসনি কোনোদিনও!

তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো রিয়া,

প্লিজ যাসনা! আমাদের গেটে সিসিটিভি লাগানো আছে, বাবা দেখতে পেলে রাগ করবে!

শ্রেয়া মেট্রোর গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতে দীপ কে ফোন করলো,

যা দিলি না নামার আগে! দুজনের মুখ তো শুকিয়ে গেছে একদম!!

দীপ মুচকি হাসলো ফোনের মধ্যেই,

তুই নেমে পড়েছিস?

না নেমেই ওদের পাশে দাঁড়িয়ে তোকে ফোন করছি নাকি? এইটুকু সেন্স নেই তোর?

খিঁচিয়ে উঠলো শ্রেয়া, দীপ তাড়াতাড়ি বললো,

আরে হ্যাঁ! বুঝেছি সেটা, তাও কনফার্ম হয়ে নিলাম। হটাৎ করে সব ছেড়ে কৌশিকের পেছনে পড়ে গিয়েছে তিয়াসা টা!! আর নিজের বেলায়? একদিনও তো অনির্বাণ কে গাড়ি আনতে দেয় না, আগেই বলে রাখে মেট্রোয় ফেরার জন্য।

হ্যাঁ, তো! সেই কবে থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে ওর গাড়ি নিয়ে তা আর হোলো কই? বললেই আগে তো তিয়াসাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রেনে যাওয়ার জন্যে! অনির্বাণ কে কথাই বলতে দেয় না একটাও!

আরে গাড়িতে গেলে তো লস! ড্রাইভারের সামনে তো আর প্রেম করতে পারবে না, তাহলেই গিয়ে অনির্বাণের বাবার কানে তুলে দেবে সব। সেই জন্যেই তিয়াসার ট্রেনে যাওয়ার ইচ্ছে,

শ্রেয়ার কথা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বললো দীপ।

তবে রিয়াটাও কম যায় না ভাই! এতো পয়সা, সারাক্ষন খালি বড়লোকি কথা বার্তা, এই আছে, ওই আছের গল্প! কিন্তু দ্যাখ গাড়ি নিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা বললেই ভাই বাবার গল্প শোনায়। ওর বাবা নাকি তাহলে ও বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছে সেটা জেনে যাবে!

শ্রেয়ার কথায় মাথা নাড়লো দীপ,

হ্যাঁ রে, ঠিকই বলেছিস! ওই শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথাতেও এটাই বলেছিলো। ট্রেনে গেলে তবেই যেতে পারবে ও, ওর মা নাকি বাবা কে মাসীর বাড়ি যাচ্ছে বলে ম্যানেজ করে ফেলবে!!

শ্রেয়াও নেমে যাওয়ার দুটো স্টেশন পরেই তিয়াসা আর অনির্বাণ নেমে পড়লো, ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই তিয়াসা অনির্বাণ কে বললো,

দীপটা কিরকম বললো দেখলি? রিয়ার মেট্রোয় চড়ার সঙ্গে তোর কারণটাও একসাথে করে ফেললো। আসলে কৌশিক সংক্রান্ত কোনো কিছু বললেই ওর রাগ হয়ে যায়। আর শ্রেয়া? কিরকম ইনোসেন্ট ভাবে বললো, “সে তো অনির্বাণ ও যায়”। ন্যাকা!! যেনো কিছুই জানে না!! যতো ইনোসেন্ট মুখ করে থাকে না ও, ততোটা নয় কিন্তু। অর্ক আর অরিন্দম স্যারের দিকে কি রকম তাকিয়ে ছিলো দেখলি? নেহাত আমরা পেছনে সরে এলাম, না হলে ওর কিন্তু ওদের সাথেই ওঠার ইচ্ছে ছিলো!

অনির্বাণ কথাটা কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো,

ছাড় তো!! বললে কি এসে যায়? আর মিথ্যে তো বলে নি কিছু, আমি তো সত্যিই তোর জন্যেই মেট্রোয় আসি!

তিয়াসা মুখ নিচু রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো, কোনো উত্তর না পেয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরে অনির্বাণ বললো,

কি হলো? এটা শুনেও কিছু বললি না তো?

তিয়াসা মাথা নাড়লো,

এই মুহূর্তে ভাবিনি কিছু!! সময় লাগবে, আপাতত ফাইনাল এক্সামের আগে এসব নিয়ে ভাবতে চাই না, একটু সময় দে!!

কয়েক মিনিট তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অনির্বাণ বললো,

দিলাম!

বাড়িতে ফিরে থেকেই সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভির রিমোট বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরিয়ে যাচ্ছিলো অর্ক, অদিতি কে বাড়িতে দিয়ে আসার পর থেকেই সন্ধ্যে বেলাটা কাটতেই চায়না আর। কলেজ আর বাড়ি ছাড়া তো জীবনে কিছুই করেনি ও। কাল তাও স্টুডেন্টরা এসেছিলো ওর কাছে কিছু নোটস এর জন্যে, সন্ধ্যে বেলা ঘন্টা খানেক ভালোই কেটে ছিলো। ও নিজে কোনো স্টুডেন্টকে বাড়িতে আসতে বলে না সাধারণত, কিন্তু এই মেয়েটা বেশ কিছুদিন যাবত ওর কাছে নোটস গুলো চাইছিলো। দিচ্ছি, দেবো করে দেওয়া হয়ে উঠছিলো না।

অদিতির শরীরটা ভালো ছিলো না বেশ কিছুদিন ধরে, ওকে নিয়ে বার বার ডাক্তারের কাছে ছোটা দৌড়া করতে করতে ও ভুলেই যাচ্ছিলো নোটস এর কথা। তারপর মা ফোন করে ওকে ওখানে রেখে আসতে বললো, কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে। দিতির খুব একটা আপত্তি ছিলো না, ওর সত্যি এখানে রেস্ট হচ্ছিলো না। বাড়ি থেকে ফিরে কাল কলেজে ঢুকতেই তিয়াসার মুখোমুখি হলো ও।

স্যার, নোটসগুলো? আজ পাবো কি? রিয়া বলছিলো ও আপনাকে বলে রেখেছে কদিন আগেই, আপনি আজ নিয়ে আসবেন বলেছেন!

তিয়াসার প্রশ্নে একদম লজ্জায় পড়েছিলো ও, এতো ভুল হয়ে যায় ওর!

সরি, একদম ভুলেই গেছি। কাল এনে দেবো, আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম কদিন,

লজ্জা ঢাকতে একটু বেশি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলো ও।

স্যার, সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা, কাল মানে আরও দেরি হয়ে যাবে। আমরা একটু আপনার বাড়িতে গিয়ে যদি নিয়ে আসি, প্লিজ স্যার,

তিয়াসা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে রিয়া এগিয়ে এসেছিলো। অর্ক একটু থতমত খেয়েছিলো, অদিতি বাড়িতে নেই, ওদের বাড়িতে আসতে বলা ঠিক হবে কি! ওকেই তো চা করার ঝামেলা পোহাতে হবে আবার!

স্যার, আমরা ঢুকবো না আপনার বাড়িতে, দরজা থেকেই চলে আসবো নোটস নিয়ে, প্লিজ স্যার, আমাদের খুব দেরি হয়ে যাবে কাল পেলে,

অর্ক কে চুপ করে থাকতে দেখেই বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করে বলেছিলো রিয়া, এরপরে আর কিই বা বলা যায়, অগত্যা এসো বলে দিয়েছিলো অর্ক।

সন্ধ্যেবেলায় সোফায় বসে মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই দরজায় বেলের আওয়াজ হয়েছিলো, সোফার ওপর মোবাইলটা রেখে দরজা খুলে দেখলো স্টুডেন্টরা এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ওরা নোটসটা চাইলো যখন, তখন মনে পড়লো ও যথারীতি ওটা বার করে রাখতেই ভুলে গেছে। ওদের দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ওটা খুঁজতে যাওয়া খারাপ দেখায়, তাই ওদের ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে বলেছিলো ও।

চা খাবে? উল্টোদিকের সোফায় বসতে বসতে ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলো অর্ক, বাড়িতে এসেছে যখন, তখন এটুকু সভ্যতা তো করতেই হতো।

হ্যাঁ, বলেই নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো রিয়া,

স্যার, আপনি বরং নোটস গুলো খুঁজুন ততক্ষন, আমি করছি, ম্যাডাম নেই, আপনাকে করতে হবে না।

একটু অবাকই হয়েছিলো অর্ক, দিতি নেই ওরা সেটা কিভাবে জানলো!

তোমরা জানলে কি ভাবে ম্যাডাম নেই?

স্যার, আপনি বাড়ি গিয়েছিলেন তো? ম্যাডাম কে রেখে এসেছেন, জানি সেটা। কফি করবো স্যার? এখানে আছে দেখতে পাচ্ছি কফি,

কথাগুলো বলতে বলতেই রান্না ঘরে ঢুকে গিয়েছিলো রিয়া, ও আর কথা বাড়াতে চায়নি,

করো তোমার যা ইচ্ছে, বন্ধুরা যা খেতে চায়!

বলেই নিজের স্টাডি তে ঢুকে গিয়েছিলো নোটস গুলো খোঁজার জন্যে। বেশ কিছুক্ষন লেগে ছিলো ওগুলো খুঁজতে, দিতি যে সব কোথায় গুছিয়ে রাখে! প্রয়োজনের সময় ও কিছুতেই খুঁজে পায়না, কতবার ওকে এখানে হাত দিয়ে বারণ করেছে। বেশি গোছানো থাকলে যে জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়না এই থিওরি টা অদিতি কিছুতেই বিশ্বাস করে না। কিন্তু অর্কর গোছানো জিনিস থেকে কিছু খুঁজে বার করতেই বেশি সময় লাগে সব সময়।

নোটস গুলো নিয়ে বাইরে এসে দেখলো রিয়া কফি নিয়ে এসে সোফায় বসে আছে, সামনের টেবিলে ট্রে তে কফি রাখা। সবাই ইতিমধ্যেই চুমুক দিয়ে ফেলেছে নিজের নিজের কাপে। ও ও একটা কাপ হতে তুলে নিয়ে ছিলো, খুব একটা খারাপ বানায়নি কফিটা, চুমুক দিয়েই বুঝেছিলো অর্ক।

বিস্কুট নাওনি কেন তোমরা? রান্নাঘরে ছিলো তো,

বলে সোফা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলো অর্ক, তার আগেই উঠে পড়েছিলো শ্রেয়া,

আপনি বসুন স্যার, আমি নিয়ে আসছি খুঁজে,

কফি খেয়ে আরো ঘণ্টা খানেক কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছিলো ওরা, যাবার আগে অবশ্য সবার কাপগুলো ট্রেতে করে রান্নাঘরে রেখে এসেছিলো তিয়াসা। ও ও তারপর সোজা এসে খেতে বসে গিয়েছিলো টেবিলে। অনেকক্ষণ আগে দিদি রান্না করে যায়, দিতি থাকলে ওগুলো পরে আবার গরম করে, কিন্তু ওর সেটা ইচ্ছে করে না। তাই খুব বেশি ঠান্ডা হয়ে যাবার আগেই খেয়ে নেয় অর্ক।

ধুৎ, আর টিভি দেখতে ভালো লাগছিলো না, কাঁহাতক আর একই খবর বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা যায়! টিভি টা বন্ধ করে উঠে ঘরে ঢুকে পড়লো ও, এতক্ষনে সব রাগ চলে গেছে,নিজেরই। একটু ফোন করতে ইচ্ছে করছে দিতি কে, ও থাকলে সন্ধ্যে বেলা স্টাডি তে থাকলে বিরক্ত হয়, আর এখন ওর নিজেরই কিছু পড়তে ইচ্ছে করছে না।

অন্য সময় এই নিয়েই অদিতির সঙ্গে ওর গন্ডগোল হয়, কলেজ থেকে ফিরেই স্টাডিতে ঢুকে যাওয়া ওর একটুও পছন্দ নয়। দিতি কে বাড়ি তে রেখে এসে যে বই গুলো ও নিশ্চিন্তে পড়বে বলে আলাদা করে রেখেছিলো, সেগুলো ওই ভাবেই পড়ে আছে!! খুলেও দেখতে ইচ্ছে করছে না এখন!! অথচ তখন কতো কিছু ভেবেছিলো, দিতি না থাকাকালীন কতো কিছু করার প্ল্যান ছিলো ওর। সেসব তো কিছুই হয়নি এই তিন দিনে উল্টে এ সপ্তাহেই আবার বাড়ি যাবার প্ল্যান করতে লাগলো অর্ক!!

কাল রবিবার, কলেজ নেই, সারাদিন যে কিভাবে কাটবে, ভাবতেই বিরক্ত লাগছে অর্কর। অদিতি থাকলে এই ছুটির দিনটাই একদম অন্য রকম হতো, রবিবারগুলোর জন্যে দুজনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো। দিতি নেই, এটা মনে হতেই মনে হলো সকালের পরে ওর সঙ্গে একবারও কথা বলতে পারেনি ও। সেই যে রাগ করে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো, তারপর অন করার পরেও দিতি নিজে থেকে করে নি আর।

কিন্তু ওর নিজের তো কিছু দায়িত্ব আছে, এই শরীরের অবস্থায় ও নিজে দিতি কে টেনশনে রাখতে পারেনা। অর্ক ঠিক আছে কিনা এটুকু জানতে তো অদিতি চাইবে নিশ্চয়ই, তাই মায়ের মোবাইলে ফোন করে দিয়েছিলো ও, কিন্তু দিতি র সঙ্গে কথা বলতে চায় নি।

কথা বললে ওর মোবাইলেই বলবে, মায়ের মোবাইলে ফোন করে ওকে ডাকবে না। তাই সকাল থেকে কথাই হয়নি আর। এতক্ষনে মাথা নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়ে গেছে, ফোন তুলে ডায়াল করলো অর্ক, অদিতির ফোন বন্ধ! এতো রাগ, সামান্য কারণে! পাগলামির একটা সীমা থাকে সব সময়, দিতি যেনো ভীষণ জেদি। কোনো বিষয় একবার মাথায় ঢুকে গেলে আর কিছুতেই বার করা যায় না। সাধারণ বিষয়গুলোকে অসাধারণ করে তুলতে ওর জুড়ি মেলা ভার।

এই সব টুকটাক মান অভিমান গুলো কে বাদ দিলে অদিতি মেয়ে হিসাবে খুবই ভালো। প্রথম বার কথা বলেই এতটাই ইমপ্রেস হয়েছিলো অর্ক, যে ওখানে বসেই বিয়ের ডিসিশন নিয়ে ফেলেছিলো সঙ্গে সঙ্গেই। বাবা মায়ের ও বেশ পছন্দ হয়েছিলো, মায়ের আবার ওর মা নেই শোনার পর থেকেই একটা মায়া পড়ে গিয়েছিলো, তাই দুই বাড়ি থেকেই বিয়ের দিন ঠিক করতে একটুও দেরি হয় নি।

এমনিতে যথেষ্ট সংসারী দিতি, কিন্তু সামান্য কথায় বড্ড বেশি রিয়াকশন দেখিয়ে ফেলে সব সময়। কাল যেমন ফোন না করার জন্যে ডিভোর্সের প্রসঙ্গও তুলে ফেললো, ও যে কখন, কোন সময় দিতির কাছে ডিভোর্সের কথা বলেছিলো ও সেটা একটুও মনে করতে পারছে না। ও তো চায় নি কখনো ডিভোর্স, তাহলে সেটা না দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কেনো! ও নিজে যে একটা পাগল, আর ওকেও যে খুব শীঘ্রই পাগল করে ছাড়বে সেটা এখুনি বুঝতে পারছে অর্ক।
চলবে,,

এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১+২

0

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১+২
আমি আর অর্ক দুজন দুজন কে ভালোবাসি, আমরা বিয়ে করতে চাই, প্লিজ আপনি ওর জীবন থেকে সরে যান,

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলা কথা গুলো যেনো গরম লোহা ঢেলে দিলো অদিতির কানে, ফোন ধরা হাতটা থর থর করে কাঁপছে, শরীরটা দুর্বল লাগছে, এর পরে যে আরও কিছু বলছে মেয়েটা, সেগুলো ও আর শুনতেই পাচ্ছেনা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথাটা সম্পূর্ন খালি হয়ে গেছে ওর, ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো দিতি।

কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছিলো অদিতির। এইতো মাত্র দুদিন হলো ও শ্বশুর বাড়ি এসেছে, অর্ক তো পরশুই ওকে এখানে রেখে সবে ফিরে গেলো! কি হলো একদিনের মধ্যে! সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ওর। প্রায় ঘন্টা খানেক একই ভাবে শুয়ে থাকার পরে মাথা টা একটু একটু কাজ করতে শুরু করছে এখন, এই ভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ঠিক নয় এই অবস্থায়, সবে মাত্র মাসখানেক হয়েছে, এই ভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ওর বাচ্চার জন্যে ক্ষতিকারক হতে পারে।

কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সোজা হয়ে খাটে উঠে বসলো দিতি, নিজেকে একটু শক্ত করলো। একটা অচেনা মেয়ের ফোনে ও অর্ক কে অবিশ্বাস করছে কেনো! আগে তো ওর অর্কর সঙ্গে সব কথা ক্লিয়ার করা উচিত! নাহ! অর্কর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে, জানতে হবে মেয়েটার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। এতদিন অর্কর সঙ্গে একসাথে থেকেও ও চিনতে পারলোনা ওকে!

একটু একটু করে মাথাটা ঠান্ডা হচ্ছিলো, প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে আস্তে আস্তে কিছুটা হলেও বাস্তব বুদ্ধি কাজ করতে শুরু করেছিলো অদিতির। এতক্ষনে খেয়াল হলো মেয়েটার নাম টুকুও জিজ্ঞেস করেনি ও, আরও কিছু বলছিলো মেয়েটা, সেগুলো না শুনেই ও ফোন টা কেটে দিয়েছে তখন। এবার একটু মনে মনে আফসোস হচ্ছে। কেনো যে ফোন টা কেটে দিলো তখন!

অর্কর সঙ্গে কথা বলতে গেলে এগুলো সব কিছু জানতে হবে আগে, মেয়েটার সঙ্গে ওকে আবার কথা বলতে হবে। নিজের মন কে শক্ত করলো দিতি। যদি সত্যি হয় কথাগুলো তাহলে ও কিছুতেই অর্ক কে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে কথা না বলে অর্কর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই, বুকের ভেতরের কষ্টটা কে চেপে রেখে কাঁপা কাঁপা হাতে নতুন করে ফোনটা তুলে নিয়ে মেয়েটা কে ডায়াল করতে যাচ্ছিলো সবে,

কি হলো? শরীর খারাপ নাকি? ওই ভাবে বসে আছিস কেনো?

বলতে বলতেই রুমা ঘরে ঢুকে এলেন। সদ্য প্রেগন্যান্ট ছেলের বউ কে ফ্যাকাশে মুখে বসে থাকতে দেখেই অজানা আশঙ্কায় তাঁর মুখ শুকিয়ে গেলো। শাশুড়ি ঘরে ঢুকে এসেছে দেখেই ফোনটা ডায়াল না করেই, নামিয়ে রাখলো দিতি।

হ্যাঁ মা, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, আর একটু শুয়ে থাকি, ঠিক হয়ে যাবে,

অম্লান বদনে মিথ্যে বললো দিতি, যে করেই হোক শাশুড়ি কে এঘর থেকে সরাতে হবে এখন, আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না ও। মেয়েটার কাছ থেকে সব কিছু সঠিক ভাবে না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই ওর।

আচ্ছা আচ্ছা রেস্ট নে তুই, শরীরটা একটু ঠিক লাগলে এটা খেয়ে নিস,

কেটে আনা ফলের প্লেটটা সামনে রেখে বেরিয়ে গেলেন রুমা, শাশুড়ি বেরিয়ে যাবার পর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো দিতি, ছিটকিনি তুলে দিয়ে এসে খাটে বসলো। নিজেকে শক্ত করে গুছিয়ে নিলো একটু, প্রশ্ন গুলো কে জমা করলো এক জায়গায়, একটা প্রশ্নও মিস করলে চলবে না।

এমনিতে সুস্থ, সুন্দর দাম্পত্য জীবন ওদের, কতো বন্ধুদের শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে সমস্যা থাকে, কিন্তু ওর তাও নেই। অর্কর মা ভীষণ ভালো মানুষ, দিতির মা নেই কিন্তু সেই অভাব ও বিয়ের পরে আর বুঝতে পারেনি, নিজের মেয়ের মতন ভালো বাসেন উনি ওকে। পেশায় অধ্যাপক অর্কও যথেষ্ট সভ্য ভদ্র, প্রায় বছর দেড়েক বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত কোনো রকম বেচাল ও দেখেনি। আজ সেই ছেলে কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে আছে, তাকে বিয়ে করতে চায়! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর।

মেয়েটা কে হতে পারে? স্কুল বা কলেজের কোনো বান্ধবী? ছোটো বেলার বন্ধু? অর্ক তো কাউকে বাড়িতে ডাকেনা খুব একটা। একমাত্র মাঝে মাঝে ওর স্টুডেন্টরা আসে প্রয়োজনে। তাহলে কি কলেজে? কিন্তু কলেজে এতো লোকের মধ্যে কিভাবে হলো এসব, কেউ জানলো না!

নিজের মনের মধ্যেই যুক্তি তর্কের জাল বুনে চলেছে দিতি, ভাবতে ভাবতেই ফোনটা আবার তুলে নিলো হাতে। নম্বরটা খুঁজে বের করে ডায়াল করতে গিয়ে দেখলো, একটা ল্যান্ডলাইন নম্বর। একটু অবাকই হলো দিতি, বাড়ির ফোন থেকে করেছে! ও তো তাহলে ইচ্ছা করলেই মেয়েটার ঠিকানা খুঁজে বার করে নিতে পারে! এতো বোকামি করলো মেয়েটা! আর কেউ ছিলনা তখন নাকি বাড়িতে! নাকি ও ও চায় দিতি ওর ঠিকানা সহজেই খুঁজে পায় যেনো! এতো সাহস ও কোথা থেকে পেলো!

আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ডায়াল করে ফেললো দিতি। ফোনের ওপ্রান্তে বাজতে থাকা প্রতিটা রিংয়ের শব্দ যেনো ওর বুকেও হাতুড়ি পিটতে লাগলো।বার দুয়েক বাজার পর একজন পুরুষ কণ্ঠে হ্যালো বললো কেউ, একটু অপ্রস্তুত হলো দিতি, কি বলবে ও এখন! কাকে চাইবে! ও তো নাম টাও জিজ্ঞেস করেনি তখন। ওর মনে হয়েছিলো মেয়েটাই ফোন ধরবে নিশ্চয়ই, অন্য কেউ বাড়িতে না থাকার সুযোগেই নিশ্চয়ই মেয়েটা ওকে ফোন করেছে। অন্য কেউ ধরলে কি বলবে সেটা তো ও একদম ভাবে নি!

একটু আগে এই নম্বর থেকে আমাকে একটি মেয়ে ফোন করেছিলো, আমি নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। গলা শুনে অল্পবয়সী মনে হয়েছিলো, ওনাকে একটু দেবেন প্লিজ,

একটু থতমত খেয়ে বললো দিতি, এর থেকে বেশি কিছু আর এই মুহূর্তে ওর মাথায় আসছিলো না। ওপ্রান্তে থাকা পুরুষ কণ্ঠ একটু চুপ করে থাকলো, তারপরে গম্ভীর গলা ভেসে এলো,

কি জন্যে ফোন করেছিলো আপনাকে?

একে কি বলা ঠিক হবে! মনে মনে ভাবতে ভাবতেই অধৈর্য্য গলায় ও প্রান্তের কণ্ঠ বললো,

কি হলো? বলুন?

দিতি নিজেকে সংযত করলো, একটু ঠাণ্ডা গলায় বললো,

সে আমাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলছিলো, যেগুলো আমি শুধু তার সঙ্গেই বলতে চাই!

ব্যক্তিগত কথা! কি রকম ব্যক্তিগত? এটা একটা দোকানের নম্বর ম্যাডাম, এখান থেকে কোনো মেয়ে আপনাকে কোনো ব্যক্তিগত কথা বলতে পারেনা, কারণ আমাদের দোকানে কোনো মহিলা কর্মচারী নেই!

খানিকটা বিদ্রুপের গলায় বললো লোকটা, মনে মনে একটু চমকে উঠলো দিতি। দোকানের নম্বর! কেউ ইচ্ছা করেই দোকান থেকে ফোন করেছে, যাতে দিতি বুঝতে না পারে! কার না মোবাইল আছে আজকের দিনে! মনের মধ্যে চাপা অশান্তি হতে লাগলো ওর, কি কথা বলবে এবার ও অর্কর সঙ্গে! ওর হাতে তো কোনোই প্রমাণ নেই!

দিতির এই কয়েক মুহূর্তের এলোমেলো ভাবনাগুলোর মধ্যেই ফোনটা রেখে দিলো ওপ্রান্তের পুরুষ কণ্ঠ। দিতির মনের মধ্যে অসম্ভব রাগ হতে লাগলো, বোঝাই যাচ্ছে লোকটা কিছু জানে। তাই জন্যেই দিতি কে আর বেশি কথা বলার সুযোগ দিলো না। কিন্তু ও এর শেষ দেখেই ছাড়বে! আবার ফোনটা তুলে ডায়াল করলো দিতি, উল্টোদিকের হ্যালো শুনেই একটু কড়া গলায় বললো,

কথা শেষ হবার আগেই ফোন রেখে দিলেন? আপনার দোকান কোথায়? আমি কি আপনাকে মিথ্যা কথা বলছি? কাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন? নিজেকে বেশি চালাক ভাবেন তাই না? আমি পুলিশে অভিযোগ জানাবো,

আরে! আরে! দাঁড়ান ম্যাডাম! এতো বেশি প্রশ্ন একসাথে করে ফেললেন তো! কোনটা ছেড়ে কোনটার উত্তর আগে দিই? আর পুলিশে কমপ্লেন করবেন যখন, তখন তাই করুন না। এতো প্রশ্নের উত্তর একদম পুলিশকেই দেবো তাহলে, আপনাকে দিয়ে আর সময় নষ্ট করি কেনো! যতোসব পাগলের দল! কাজের সময় বিরক্ত করে মারে!

বিরক্ত গলায় কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিল লোকটা। দিতি হতভম্ব হয়ে গেলো একদম। লোকটা উল্টে ওকেই পাগল বলে দিলো! এতো সাহস যে পুলিশে কমপ্লেন করতেও বললো! তাহলে কি লোকটা ঠিকই বলেছে, ওখানে কোনো মেয়ে নেই! নাহলে পুলিশে অভিযোগের ভয় দেখানো সত্বেও ও একটুও ভয় পেলো না কেনো! কিন্তু এতো ভুল তো হয়নি ওর! ও তো ইনকামিং নম্বরেই ডায়াল করেছে! লোকটা আদৌ সত্যি বলছে তো? এটা সত্যিই কোনো দোকানের নম্বর কিনা জানা দরকার।

দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অদিতি, দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ড্রইং রুমে। শ্বশুর, শাশুড়ি দুজনেই চা নিয়ে বসে আছেন সোফায়, সামনে খোলা টিভি তে সিরিয়াল চলছে। ওকে দেখেই রিমোট হাতে নিয়ে সাউন্ড কমিয়ে দিলেন সমরেশ, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দুজনেই তাকালেন ওর দিকে।

মা, বাড়িতে টেলিফোন ডিরেক্টরি আছে? একটু দাও না প্লিজ,

রুমা একটু অবাক হলেন,

ডিরেক্টরি! না রে বাবা, সেসব তো কিছু নেই। আগে থাকতো, এখন আর ওসব কেউ রাখে নাকি! পুরনো দিয়ে যদি হয়, তবে আমার ঘরের ওপরের তাকে একটু খুঁজে দেখতে পারিস। তবে সে কিন্তু বেশ অনেক বছর আগের! সেসব নম্বর কি আর আছে! কে জানে! কিন্তু তুই এখন ওসব দিয়ে কি করবি?

আচ্ছা! তুই তো ডাউনলোড করে নিতে পারিস ওটা! এতো খোঁজাখুঁজির দরকার কি?

পাশ থেকে বলে উঠলেন সমরেশ, দিতি লজ্জায় পড়লো। ইস! এতো সহজ সমাধানটা ওর একটুও মাথায় আসে নি আগে! কি যে হচ্ছে ওর! এই ফোনটা ওর সব বুদ্ধি গুলিয়ে দিচ্ছে, একদম পাগল করে ছাড়বে ওকে!

থ্যাংক ইউ বাবা,

বলতে বলতে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলো দিতি, পেছন থেকে রুমার স্নেহ মিশ্রিত গলা ভেসে এলো,

আরে! আস্তে! এতো ছোটা ছুটি করিস না এই অবস্থায়! পাগলি মেয়ে একটা!
ক্রমশ
#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ২
কালকের ওই ফোনটা আসার পর থেকেই অর্ক কে ফোন করতে শুরু করেছিলো অদিতি। রাত গড়িয়ে সকাল নটা বাজতে চললো একবারের জন্যেও ফোন ধরেনি ও, উল্টে অতোবার মিসড কল দেখা সত্বেও যখন রিং ব্যাক না করেই একটু বেশি রাতের দিকে ফোনটা একদম বন্ধই করে দিলো অর্ক, অদিতি মোটামুটি তখনই বুঝে গিয়েছিলো মেয়েটা একটুও ভুল বলেনি কিছু।

কিছু বুঝতে না দিয়েই যে কয়েক মাসের জন্যে ওকে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়ে অর্ক ফিরে গেছে সেটা এই মুহূর্তে খুব ভালো করে টের পাছে দিতি। দেড় বছর ধরে এক ছাদের নিচে বাস করেও ও একটুও চিনতে পারলো না অর্ক কে, এতো টা ভালো অভিনেতা ও! খুব আফসোস হচ্ছে এখন। ও যদি একটুও বুঝতে পারতো তখন, তাহলে অন্তত বাচ্চা নেওয়ার মতো মূর্খামি কিছুতেই করতো না!

কিন্তু মেয়েটা কে ধরবে কিভাবে ও! কি করে সবটা প্রমাণ করবে সবার কাছে! নিজের ছেলে কে ছেড়ে শ্বশুর, শাশুড়ি কি ওর কথা বিশ্বাস করবেন একটুও! ও তো কিছুই জেনে উঠতে পারে নি মেয়েটার সম্পর্কে, কাল ডিরেক্টরি ঘেঁটে দেখেও কিছু পায় নি। নম্বরটা সত্যিই একটা দোকানের, নাম দেখে যদিও বোঝার উপায় নেই কিসের দোকান, তাও ওটা যে দোকান সেটা বোঝাই যায়।

মাঝে মধ্যেই এরকম ফোন ধরে না অর্ক, তার জন্যে বিভিন্ন অজুহাত সব সময়ই রেডি থাকে ওর। কখনো ক্লাস নেওয়ার, তো কখনো না শুনতে পাওয়ার, মোটামুটি এই সব অজুহাতগুলোয় অদিতি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এখন। কিন্তু অন্য সময় সেগুলো কে সহজ ভাবেই নিয়েছে ও, বিশ্বাস করেছে অর্কর কথায়। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে কতো টা বোকা ও! এই দেড় বছর ধরে শুধুই অর্কর বাইরের ভালোমানুষ চেহারাটাকেই ও বিশ্বাস করেছে, ভেতরের অভিনেতা অর্ক কে বুঝে উঠতে পারেনি একটুও।

তাই আজ এতো সহজেই বোকা হয়ে গেলো দিতি! ও একটুও বুঝতে পারলো না যে অর্ক ওকে এখানে রেখে চলে গিয়েই এইরকম কিছু করতে পারে! এখান থেকে ফিরে গিয়েই বান্ধবী কে দিয়ে ওকে ফোন করিয়ে কথাটা বলে দিয়েই নিজের ফোন বন্ধ করে দিয়েছে ও। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর কি করণীয়, সেটা কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারছে না দিতি। যতই সব বুঝতে পারে না কেনো মন, তবু কেনো যেনো কোথাও দাঁড়িয়ে একটু চিন্তাও হচ্ছে অর্কর জন্যে।

একা ফ্ল্যাটে কোনো বিপদ হলো না তো! সত্যিই ও ইচ্ছে করে ধরছে না নাকি কিছু হলো ওর! নিজের ওপর নিজেরই রাগ হচ্ছিলো এবার অদিতির, ও কেনো এতো উতলা হয়ে পড়ে সব সময়! ওর এই নরম হয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারে বলেই তো অর্ক ইচ্ছাকৃত ভাবেই এগুলো করে ওর সঙ্গে! প্রতিবারই তো যখন বিভিন্ন রকমের অজুহাতে ফোন ধরে না অর্ক, প্রথমে রাগ হয়ে যায় ঠিকই, তার পরেই এই সব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় আসে ওর। আর কিছু হয়নি জানা সত্বেও অর্ক কে নিয়ে চিন্তা করে বসে ও। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তো প্রতিবার ওকে সরি বলে ম্যানেজ করে ফেলে অর্ক।

কিন্তু সেগুলো সাধারণ মান অভিমান ছিলো, কিন্তু এটা অনেক বড়ো বিষয়। ওর বিবাহিত জীবন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে এখন, মেয়েটার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে কি করবে ও! বাচ্চা টারই বা কি হবে! অর্ক র বাবা , মা, ওর বাবা সবার কাছেই তো মুখ দেখাতে পারবে না ও। অর্কর মতো ছেলে যে কোনোদিনও এমন করতে পরে ও তো স্বপ্নেও ভাবে নি কখনো! ভেতরে ভেতরে টেনশন, ভয় সব এক হয়ে গিয়ে কেমন যেনো হতাশ লাগে দিতির, এতো সহজে ওর জীবন থেকে সব কিছু হারিয়ে যাবে! ও কিছুই করতে পারবে না!

একই শহরে বাড়ি হলেও কোনোদিনই বিয়ের আগে অর্ক কে দেখেনি ও। অর্ক আর ওর পিসতুতো দাদা ছোটবেলার বন্ধু ছিলো, সম্বন্ধ টা পিসিই এনেছিলো। মা মারা যাবার পর থেকেই বাবার পরে পিসিই দিতির সব কিছু। কিছুদিন আগেই পিসেমশাই চলে গেছেন, এখন ছেলে অফিসের কাজে বাইরে গেলেই পিসি ওদের বাড়ি চলে আসেন।

প্রথম যেদিন ওদের বাড়িতে এলো অর্ক, কথা বলে বেশ ভালই লেগেছিলো ওর। ভদ্র, সভ্য হ্যান্ডসাম অর্কর প্রেমে সেদিনই পড়ে গিয়েছিলো দিতি। তাই অর্ক যখন ওর কাছে ফোন নম্বর চেয়েছিলো, ওকে নম্বর টা দিতে একবারের বেশি ভাবে নি ও। দেখতে আসার পর থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত কিন্তু দিনে দুবার করে অদিতি কে ফোন করতে বা অদিতির ফোন ধরতে কোনোদিনই ভোলেনি ও।

বিয়ের পরেই আস্তে আস্তে ফোন ধরতে আর করতে দুটোই ভুলতে লাগলো ও, এই নিয়ে মাঝে মাঝেই রাগ করতো দিতি, কিন্তু অর্কর যুক্তিও অকাট্য ছিলো, যখন ওরা একসঙ্গেই থাকে তাই আগের মতো ফোনের আর দরকার কি! যুক্তি টা যে খুব বেশি ভুল নয়, সেটা মুখে না হলেও মনে মনে তো স্বীকার করেই অদিতি, তাই এই ঝগড়া গুলোর স্থায়ীত্ব খুব বেশিক্ষন হতো না। কিন্তু এবার তো তা নয়, এবার অর্ক ওকে রেখে একাই ফিরে গিয়েছে তাই ফোন তো ওর অবশ্যই ধরা উচিত ছিলো। এখন ওর কি শাশুড়ি কে ডেকে বলা উচিত, কাল থেকে ওকে ফোন করেনি অর্ক! নাকি এটা শুনলে উনি আরও টেনশন করবেন, মনস্থির করতে পারছিলো না দিতি।

হটাৎ করেই ওর চিন্তার মধ্যেই ফোন টা বেজে উঠলো, স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অর্কর নাম টা দেখেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না দিতি। কালকের থেকে জমা হওয়া রাগ, দুশ্চিন্তা, কষ্ট, মেয়েটার বলা কথা গুলো সব মিলে মিশে একাকার হয়ে প্রবল চিৎকারে পরিণত হলো,

আমি আর কোনোদিনও তোমার মুখ দেখতে চাইনা, আমার কোনো উপায় নেই তাই তোমার সঙ্গে থাকবো, কিন্তু কোনোদিনও আর তুমি আমার সামনে আসবে না, আর জেনে রেখো কিছুতেই ডিভোর্স আমি দেবো না তোমাকে।

আরে! আমার ফোন টা কাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না…..

কথা গুলো অর্ক কে শেষ করতে না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো দিতি, হাউ হাউ করে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো, আজই যদি সম্ভব হতো ও অর্ক কে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতো! কিন্তু অসুস্থ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে শক্ত থাকতে হবে, বাবা যদি একটুও বুঝতে পারে ওর মনের অবস্থা, তাহলে আরও বেশি করে খারাপের দিকে যাবে শরীর। এখন কোনো মতেই ও বাবা কে আরো অসুস্থ করে দিতে পারবে না ওর ভালো থাকার জন্যে!

ছোটো থেকেই মা হারা অদিতির বড়ো হয়ে ওঠা বাবা কে ঘিরে, গত বছর ওর বিয়ের পর থেকেই বাবার শরীর টা খারাপ যাচ্ছিলো, ঠিক করে কিছুই বোঝা যাচ্ছিলো না। এখন তো সব সময়ই খারাপ থাকে, ছোটো খাটো একটা অ্যাটাক হয়ে যাবার পর থেকেই। ওর প্রেগন্যান্সির খবরে এখন বাবার মন বেশ ভালো, অর্কর বাবা মাও খুব খুশি, এই সময় কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চারবার ভাবা দরকার।

এই মুহূর্তে ওর একটুও আর শ্বশুর বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছে না, বাবার কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাবার কাছে যাওয়া মানে, বাবাকেই বিপদে ফেলে দেওয়া, কিন্তু ওই বা কি করে শাশুড়ির সামনে স্বাভাবিক থাকবে সব সময়!

ফোন টা রেখে দিয়ে অবাক হয়ে বসে রইলো অর্ক, অদিতির রাগের কোনো কারণ ও খুঁজে পাচ্ছে না। হ্যাঁ, ওর একটা ভুল হয়েছে, ও কাল রাত থেকে ফোন টা খুঁজে পাচ্ছিলো না, অথচ ওর স্পষ্ট মনে ছিলো ও ওটা সোফার ওপরেই রেখেছিলো। তারপর আর মনে ছিলো না, রাতে অদিতি কে ফোন করতে গিয়ে আর ফোন টা খুঁজে পায় নি ও। ও জানতো অদিতি চিন্তা করবে, ও অপেক্ষা করে থাকবে ফোনের জন্যে, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না সেটা।

বাধ্য হয়েই শুয়ে পড়লো শেষে, কান খাড়া করে রেখেছিলো যদি বাজে ফোন টা কোথাও, কিন্তু সেটাও বাজেনি। তার মানে অদিতিও ওকে ফোন করেনি একবারও, তাহলেও তো ফোনটা খুঁজে পেতো ও, কাল থেকেই মনে হচ্ছিলো বারবার। অবশেষে সকালে উঠে চা করতে গিয়ে রান্নাঘরে খুঁজে পেয়েছিলো ওটা, সাইলেন্ট মোডে করা ছিলো। বোধহয় কলেজে ক্লাস করার সময় করেছিলো আর ঠিক করা হয়নি। ফোন টা খুলতে গিয়ে দেখলো চার্জ শেষ হয়ে ওটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কখন কে জানে। চার্জ দিয়ে ফোন টা কে অন্ করার পর অদিতির অনেকগুলো মিসড কল দেখেই সঙ্গে সঙ্গেই ওকে ফোন করলো অর্ক।

কিন্তু ওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চিৎকার করতে লাগলো দিতি। ও তো জানে ওর ভুল হয়েছে, কিন্তু সেটা যে ইচ্ছাকৃত নয় এটা কোনোদিন বোঝেনা দিতি। ওর সব সময় ধারণা ইচ্ছে করেই ফোন ধরেনা অর্ক। কিন্তু সত্যি যে কাল থেকে ও ফোন টা খুঁজে পায়নি সেটা দিতি কে বোঝাবে কে! সব সময় রাগ দেখায় ওর ওপর। ওরও রাগ হচ্ছে এবার, কোনো কথাই বলতে দিলো না, জানতে চাইতেও তো পারতো কি হয়েছিলো, তা না করেই আগেই চিৎকার করতে লাগলো।

সামান্য ফোন করেনি বলে আর মুখ দেখতে চায় না, পাগল নাকি অদিতি, সন্দেহ হচ্ছে ওর এখন! কোনো সুস্থ লোক শুধু এই কারণে ডিভোর্সের কথা বলে, বিরক্ত হচ্ছিলো অর্ক। এতো জোরে চিৎকার করছিলো ও, যে মাও শুনতে পেতে পারে, এতো বোধের অভাব, যথেষ্ট বড়, বাচ্চা তো নয়, এবার নিজেরও রাগ হয়ে যাচ্ছে, রেগে গিয়ে ফোন টাই বন্ধ করে দিলো অর্ক।
ক্রমশ
চলবে,,