Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1032



চন্দ্রকুঠি পর্ব-১৩+১৪

0

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১৩)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

আরিফ সাহেব মুনের দিকে তাকালান। মুনের চোখ চোখ রেখে বললেন, ” মাধুরি আমার নিজের মেয়ে নয় এটা সত্যি। তবে মাধুরি আমার কাছে নিজের সন্তানের থেকে কম নয়”।
একটু থেমে আবার বললেন,” যাই হোক। প্রথম থেকে সবকিছু বলছি শোন,
অতীত,
বাবা-মায়ের সংসারে আমরা তিন ভাই ছিলাম। আমার বড় দুই ভাইয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে, সেই সাথে তাদের ঘর আলো করে সন্তানের আগমনও ঘটলো। তখন বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। আমার তখন বিয়ে জিনিসটার প্রতি আগ্রহ ছিলো না। ভাই ভাবীদের জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েই মেয়ে দেখতে যাই। অনিচ্ছা নিয়ে মেয়ে দেখতে গেলেও মেয়েকে দেখে আমার অনিচ্ছা, ইচ্ছেতে বদলে গেলো। চন্দ্রকে দেখার পর আমি আর বিয়েতে না করতে পারিনি। কারন চন্দ্র খুব রুপবতী ছিলো তাকে দেখার পর অপছন্দ করবে এরকম পাত্র পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।
যাই হোক বাবা-মায়ের সম্মতিতে বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। বিয়ের পর আমরা আমাদের নিজেদের বাড়িতেই থাকতাম। চন্দ্রের নিজের বাবা-মা না থাকায় সে আমার বাবা-মাকে খুব সহজেই আপন করে নিয়েছিলো। আমাদের সংসার জীবন ভালোই চলছিলো। বিয়েটা রুপের মোহে পড়ে করলেও ধীরে ধীরে আমি চন্দ্রকে খুব ভালোবেসে ফেলি। একসময় চন্দ্রও আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলে। আমাদের সম্পর্ক খুব সুন্দর ছিলো। এরপর হঠাৎ একদিন চন্দ্রর দাদুর মৃত্যুর খবর আসে। আমরা সেখানে যাই। দাদুর মৃত্যুতে চন্দ্র খুব ভেঙে পড়ে। আমি যতটা সম্ভব তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। চন্দ্রের কাকীমার কথা অনুসারে চন্দ্রর দাদুর ইচ্ছে ছিলো চন্দ্র তার পরিবার নিয়ে ‘চন্দ্রকুঠিতে’ থাকবে। চন্দ্রকুঠি যেটা চন্দ্রর নিজের বাড়ি। চন্দ্রের দাদু এই বাড়িটি ছাড়াও তার সম্পত্তির বেশিরভাগটাই চন্দ্রর নামে করে যান। এর অবশ্য কারন ছিলো। যেটা আমি পরে জানতে পারি৷ তাহলো চন্দ্রই তার সম্পত্তির প্রকৃত উত্তরাধিকার ছিলো। তার ছোট ছেলে অর্থাৎ চন্দ্রর কাকা সে তার পালিত সন্তান ছিলো। যাই হোক চন্দ্রর দাদুর ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা সবাই ‘চন্দ্রকুঠিতে’ থাকতে শুরু করি। আমাদের দিন ভালোই চলছিলো। এমন সময় চন্দ্র গর্ভবতী হয়। চন্দ্রের গর্ভাবস্থায় ওর দেখাশোনা আমার থেকে বেশি ওর বোন ময়নামতি করতো। ময়নামতি তার স্বামী এবং কন্যা আমাদের সাথেই থাকতো। চন্দ্র আর ময়নার মধ্যে খুব ভাব ছিলো। এরা একে-অপরকে খুব ভালোবাসতো।
তখন চন্দ্রর গর্ভাবস্থার তিন মাস চলছিলো। আমি একটি কাজে গ্রামের শেষ প্রান্ত গেছিলাম। সেখান থেকে ‘চন্দ্রকুঠিতে’ আসার মাঝরাস্তায় মাধুরি(ময়নার মেয়ে) সাথে দেখা। চার বছরের বাচ্চা মেয়েটি বেশ ভয় পেয়েছিলো। অনেকটা পথ দৌড়ে আসায় বেশ হাঁপিয়েও গেছিলো। আমি ওকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” কি হয়েছে মামনি? তুমি এভাবে ছুটছো কেন”?
ছোট্ট মাধুরি অস্পষ্ট সুরে বললো, ” র র ক্ত লা ল”
” কি? আচ্ছা বাড়ি চলো তারপর সব শুনবো”?
ওকে নিয়ে বাড়ির রাস্তায় যাওয়ার জন্য এগেলোই ও কান্না করতে শুরু করে দেয়। ইশারায় ওদিকে যাবে না বুঝায়। ওকে কোলে নিয়ে জোর করে হাঁটা শুরু করলে ওর কান্না আরো বেড়ে যায়, এমন সময় এক কাকার সাথে দেখা। কাকাই বললো আমাদের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছে। পুলিশের কথা শুনে বুঝলাম বাড়িতে নিশ্চিয়ই কিছু হয়েছে। যেটা মাধুরি দেখে ভয় পেয়ে ছুটে এসেছে। আমি ভাবলাম এই অবস্থায় মাধুরিকে বাড়িতে নিয়ে গেলে ও পুলিশ দেখে হয়তো আরো বিচলিত হবে। অনেককিছু ভেবে ওকে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে রেখে বাড়ি চলে এলাম। এসে দেখলাম যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সামনে ময়নামতি, তার বর এবং কাকার(ময়নার বাবা) মৃতদেহ পড়ে আছে আর চন্দ্রকে পুলিশ ঘিরে ধরেছে। আমি এক প্রকার শকড হয়ে গেলাম। পুলিশ যখন চন্দ্রকে নিয়ে গেলো তখন আমি বাঁধা দিতে গেলে আমাকে বাবা টেনে তার সাথে নিয়ে যায়।
বাবা আমাকে টেনে একটা রুমে নিয়ে যায় তারপর বলে, ” ও একটা খুনি। তুই ওর কাছে আর কখনো যাবি না”।
” না বাবা। এসব সত্যি হতে পারে না। চন্দ্র কখনোই এরকম করতে পারে না”।
” আমাদের চোখের সামনে সবকিছু হয়েছে। আমরা নিজেদের চোখে ওকে খুন করতে দেখেছি”।
” না। আমি এসব বিশ্বাস করি না”।
” তারমানে তুই বলছিস আমরা মিথ্যে বলছি”?
” আমি জানি না। আমি শুধু জানি চন্দ্র এরকম করতে পারে না”।
” চন্দ্রাবতীই এসব করেছে”।
পিছন থেকে চন্দ্রর কাকীমা বলে উঠলো।
” আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা সত্যি নয়”।
তারপর আমার ভাইয়েরা বলে উঠলো,” আমরা সবাই স্বাক্ষী চন্দ্রই এরকম করেছে”।
এদের কারো কথাই আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কারন আমি জানি চন্দ্র এরকম করতে পারে না। তখনি বড় ভাবী বলে উঠলো,” ওরা মিথ্যে বলছে। এসব ওরা করেছে। চন্দ্র কিছুই জানে না”।
কথাটি বলতে দেড়ি হলেও ভাইয়ার ভাবীর গায়ে হাত তুলতে দেরি হয়নি।
” তোকে এত বেশি বুঝতে কে বলেছে”?
তারপর বাবা বলে উঠলো,” দেখ আরিফ আমি সব স্বীকার করছি। আমরা শুধু চন্দ্রর থেকে সম্পত্তি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর কাকা সব জেনে গিয়ে বাঁধা দিতে চেয়েছিলো তাই রত্না(কাকার স্ত্রী) নিজ হাতে স্বামীকে মেরে ফেললো। কারন সম্পত্তি ওরো প্রয়োজন ছিলো”।
কাকীমা বললেন,” বাকিটা আমি বলছি। আমি আমার বরকে মারার সময় ময়না সব দেখে নেয় এবং সে সাথে সাথে চন্দ্রকে সব বলে দেয়। তখন আমার মাথায় খুন চেপে গেছিলো তাই চন্দ্রকে শেষ করতে এগিয়ে যাই। সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমার মেয়ে। চন্দ্রকে করা আঘাত আমার মেয়ে বুক পেতে নেয়। তারপর ও মারা যায়। চন্দ্রর চিৎকার চেঁচামেচিতে ময়নার বরও সেখানে আসে। তারপর আর কি তাকে তোমার বাবা মেরে ফেলে। চন্দ্রকে আমি মারতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওকে মারলে সম্পত্তি কিভাবে পাবো তাই তোমার বাবা মারতে দেয়নি”।
আমি ওখানেই বসে পড়লাম।
” সামান্য সম্পত্তির জন্য তোমরা এমন করেছো”?
আমার কথা শুনে বাবা বললো,” তোমার কাছে সামান্য হতে পারে আমাদের কাছে নয়। যাই হোক এবার তুমি শোন আমাদের সবার সাক্ষীতে চন্দ্র দোষী প্রমাণিত হয়ে যাবে। তুমি আটকাতে পারবে না। তাই যা বলছিলাম তুমি আদালতে আমাদের হয়ে সাক্ষী দেবে। তুমি আদালতে বলবে চন্দ্র আর ময়নার মধ্যে সম্পর্ক খুব খারাপ ছিলো। ওরা একে-অপরকে সহ্য করতে পারতো না। সেজন্য জেদের বসে এসব করেছে “।
আমি প্রচন্ড রেগে গেলাম। রেগে কিছু বলতে যাবো এমন সময় বড় ভাইয়া বলে উঠলো, ” তুই কিছু বলার আগে কান খুলে শুনে রাখ, তোর মেঝো ভাই কিন্তু একটি কারাগারের জেলার। থানার ওসির সাথেও ওর ভালোই সম্পর্ক আছে। জেলের মধ্যে চন্দ্রকে মেরে ফেলা আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়”।
তারপর বাবা বললো,” আমাদের কথা শুনলে তুই চন্দ্রকে হারাবি ঠিকি তবে তোর অনাগত সন্তানকে পাবি। আমাদের কথামতো চললে তোর সন্তান জন্ম নেওয়ার পর আমরা তাকে তোর হাতে তুলে দিবো”।
এরপর বাকিটা আমাকে ভাবতে বললো। কিছুক্ষণ পর আমি চন্দ্রর সাথে দেখা করতে যাই। চন্দ্রর সাথে দেখা হওয়ার পর চন্দ্র আমাকে বাবার কথামতো কাজ করতে বলে। চন্দ্রের মুখে এসব শুনে বুঝতে বাকি রইলো না থানার মধ্যে ওকে ভয় দেখানো হয়েছে।

শেষে উপায় না পেয়ে বাবার কথা মতো সাক্ষী দেই। ভাবীরা নিজেদের সন্তানদের জন্য সাক্ষী দিতে বাধ্য হয়। তারপর আদালত রায় দেয় সন্তান জন্ম নেওয়ার পর চন্দ্রর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার।

কেটে গেলো কিছু মাস। এতদিনে আমি আর মাধুরি একটা আলাদা সংসার শহরে গড়ে নিয়েছিলাম। কেউ জানতো না আমার সাথে মাধুরি আছে। তাদের স্মৃতি থেকে ময়নার মেয়ের কথায় মুছে গেছে। তারপর জন্ম হলো মুনের। চন্দ্রর কথামতো আমি তার নাম রাখলাম মুনতাহা মাহযাবিন। ছোট্ট করে মুন। চন্দ্র যে জেলে ছিলো সেখানকার জেলার ছিলো আমার ভাই। তাই তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু করা সম্ভব হয়নি। যার জন্য সেদিন মুনকে নিয়ে আসার জন্য বাবা আরো একটি শর্ত দেয়। তাহলো চন্দ্রর সব সম্পত্তি তাদের নামে করে দেওয়া। চন্দ্র তাদের কথামতো তাই করলো। এরপর আমি মুনকে নিয়ে চলে এলাম।

চন্দ্রর ফাঁসি হওয়ার পর কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। আমার দুই মেয়েকে নিয়ে আমার সংসার খুব সুন্দর ছিলো। কিন্তু আমার সেই সংসার সুখের হলো না। আমার ভাই আমাদের খুঁজছে এটা আমি জানতাম না। তাই বুঝতে পারিনি ভাই আমার সাথে মাধুরিকে দেখে তাকেই আমার সন্তান বলে ভেবে নিবে। বুঝতে পারলাম সেদিন যেদিন মাধুরি চলে গেলো। মাধুরি চলে যাওয়ার পর ওর মোবাইলটি প্রথমে আমিই খুঁজে পাই সেখানে ‘চন্দ্রকুঠি’ নামটি দেখেই বুঝে যাই, আমার মাধু কোন বিপদে পড়তে চলেছে।
হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাই ফোন করে৷ আমার মাধুর সর্বনাশ কিভাবে করেছে সেটার বর্ননা দেয়। আমি অনেক অনুরোধ করি ভাইকে। এমনকি এটাও বলি মাধুরি আমার মেয়ে নয়। আমার মেয়ে মুন। কিন্তু ভাই সেটা বিশ্বাস করে না। তারপর আমিই মুনের ব্যাগে মাধুরি মোবাইলটি রেখে দেই। কারন আমার বারবার মনে হয়েছিলো আমি মানুষ হিসাবে অকৃতজ্ঞ। যে ময়না আমাদের জন্য জীবন দিলো তার মেয়ের দায়িত্ব নিয়েও আমি তাকে ভালো রাখতে পারিনি। কেন ভালো রাখতে পারি নি! কারনটা আমার মেয়ে। তাই আমি চেয়েছিলাম হয় মুন মাধুরিকে খুঁজে নিয়ে আসুক নয়তো ও সেই অন্ধকারে হারিয়ে যাক যেখানে মাধুরিকে ওর জন্য যেতে হয়েছে। শুধুমাত্র ওর জন্য।(সংক্ষেপে অনেক ডায়লগ দিলাম, বুঝতে অসুবিধা হলে দুঃখিত)

বর্তমান,
সব শুনে মুন বাকশূন্য হয়ে গেলো। আগে ভেবেছিলো মুনের জন্য মাধুরির জীবনটা এমন হলো না তো। এখন ভাবনাটা সত্যি হয়ে গেলো। আরিফ সাহেব মুনকে জড়িয়ে ধরলেন। মুন বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। আরিফ সাহেব তো সেই শুরু থেকেই কান্না করে চলেছে। মুন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তার বলার মতো কিছু অবশিষ্ট নেই।
কিছুক্ষন পর নিজেদের সামলে বাবা, মেয়ে পাশাপাশি বসলো। রিয়াদ সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলো,” চন্দ্রকুঠিতে এসব অবৈধ কাজ কবে থেকে শুরু হয়েছে”?
” সেসব আমি জানি না। সেদিন ভাই ফোনে বললো ওখানে এসব হয়, আর মাধুরিকে সেসব করতে হবে। তার আগে আমি জানতাম না ওখানে এই ধরনের কিছু হয়”।
রিয়াদ আশাহত হলো। নিজেদের সামলে মুন তার বাবাকে মাধুরির কাছে নিয়ে গেলো। মাধুরি বাবাকে পেয়ে বেশ কিছুক্ষন কাঁদলো। মাধুরি তার বাবার কাছে মায়ের গল্প জানতে চাইলো। তখন মুন নিজের গল্প মাধুরিকে বসিয়ে দেয়। মাধুরি আরিফ সাহেবের মেয়ে নয় এটা শুনলে খুব কষ্ট পাবে। তাই ওকে সম্পূর্ণ সত্যিটা জানানো হলো না। সব শুনে মাধুরি বললো,” তাহলে মুন কে”?
বাবা বললেন,” ও আমার আর এক মেয়ে। যাকে ভাগ্য আমাকে দিয়ে গেছিলো উপহার হিসাবে”।
মাধুরি বললো,” সব ঠিক আছে কিন্তু কাকাকে মা কখন অপমান করলো? সেটা তো বললে না”?
” সেটা আমিও জানি না। হয়তো কারাগারে থাকাকালীন কিছু হয়েছিলো”।
তারপর বাবা, মেয়ে সব ভাবনাকে দূরে ফেলে নিজেদের নিয়ে মেতে উঠলো। বাবা, মেয়েকে একা ছেড়ে মুন এবং রিয়াদ বেরিয়ে গেলো।

__________
মুন এবং রাফি পার্কের একটি বেঞ্চে বসে আছে। রাফি মুনকে ফোন করে ডাকলো। মুনের মনে হলো হয়তো তাদের ভাবনা সত্যি হতে চলেছে। মুনকে ভুল প্রমান করে রাফি বলে উঠলো,” দেখো মুন তুমি আমার কাছে মাধুরির বোন ছাড়া অন্যকিছু নও। আমি তোমাকে অন্যকিছু ভাবতেও পারবো না। এখন তুমি হয়তো বলবে সারাজীবন কি আমি মাধুরির দুঃখে কাতর হয়ে কাটাবো? তাহলে আমার উত্তর হবে না। জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না। সে এগিয়ে যাবে। তবে এগিয়ে যাওয়া জীবনে আমি মাধুরির সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো কখনো ভুলবো না। মাধুরি আমার হৃদয়ে সবসময় থাকবে। আর তুমি থাকবে তার বোন হয়ে। তাই….”।
রাফির কথা শেষ হওয়ার আগেই মুন রাফির সামনে ভিডিওটা ধরলো। যেখানে রাফিকে আটকে রাখা হয়েছে। রাফি বেশ অবাক হয়ে বললো,” এটা কে? এটা তো আমি মনে হচ্ছে, কিন্তু”?
” কিন্তু কি”?
স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করলো মুন। রাফি বেশ বিষ্ময় নিয়ে বললো,” আমার সাথে এরকম কিছু কখনো ঘটেনি তো। তাহলে এই ভিডিওতে আমি কি করে থাকতে পারি”?
এবার মুন বেশ চমকালো। মুন ভেবেছিলো রাফি জেনেশুনে ওদের কাছে সত্যিটা লুকিয়েছিলো। তাই ভেবেছিলো ভিডিও দেখার পর হয়তো মুখ খুলবে। কিন্তু ভিডিও দেখার পর রাফির এই চমকানো মুখ এবং নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করার বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ডুকলো না। তারমানে রাফি নিজেই জানে না ও কখন বন্দী হলো। এটা কিভাবে সম্ভব!

চলবে,
[ ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন]

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১৪)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

” এই ভিডিওটা তুমি কোথায় পেলে”?
রাফির কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো মুন।
” কি হলো বলো”?
” আপুকে এই ভিডিওটা পাঠিয়ে, কেউ তাকে ফাঁসিয়েছে”।
” কি? মাধুরিকে ফাঁসিয়েছে মানে”?
তারপর মুন রাফিকে ‘চন্দ্রকুঠির’ ভিতরে মাধুরির সাথে যা যা হয়েছে সব বলেছে। শুধু তালুকদার বাড়ি লোকদের নামগুলো বাদে।
” মাধুরি এখন কোথায়? ও ঠিক আছে তো”?
রাফি বেশ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললো। রাফির উত্তেজনা দেখে মুন কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে মুন বললো,” কালকে আমি যেখানে বলবো সেখানে চলে এসো। আপুকে সেখানেই পাবে”।
” কাল? আজ নয় কেন? এখনি যাই না”?
” না। এখন যাওয়া যাবে না। আপু এখন বাবার সাথে আছে। এখন গিয়ে বাবা, মেয়ের মাঝে ডোকাটা ঠিক হবে না”।
” আচ্ছা। কাল একটু তাড়াতাড়ি ঠিকানাটা দিও”।
” আচ্ছা”।
রাফির সাথে কথা শেষ করে মুন চলে গেলো।
মুন সেখান থেকে সোজা রিয়াদের সাথে দেখা করলো। রিয়াদ মুনকে দেখেই প্রশ্ন করলো,” এটা কার বাড়ি? হঠাৎ এখানে আসতে বললে কেন”?
” এসব বলার সময় নেই। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি সেটা বলুন”?
” সেটা তো ভাবতে হবে”।
” তাহলে ভাবুন”।
” হুম”।
রিয়াদ কিছু বলতে নিবে তখনি মুন বলে উঠলো,” আপনি তো আপনার কথা বলেননি, সেটা কখন বলবেন”?
” আমার কথা মানে”?
” আপনার চন্দ্রকুঠিতে যাওয়ার দ্বিতীয় কারনটি কি”?
” তুমি এটা এখনো মনে রেখেছো”?
” ভুলে যাওয়াটা আসা করেছিলেন”?

” না। এরকম আসা করাটা বোকামি সেটা আমি আগেই বুঝেছি। তাই এরকম আসা রাখার ভুল করিনি”।
” এত কথা বাদ দিয়ে আসল কথা বলুন”।
” আচ্ছা বলছি। তুমি যে কারনে গিয়েছিলে আমিও সে কারনে গিয়েছিলাম”।
” মানে”?
মুন ভেবে নিলো রিয়াদ কারনটি না বলে আবার অহেতুক কথা বলবে। মুনকে ভুল প্রমাণ করে রিয়াদ বললো,” তুমি যেমন তোমার বোনকে খুঁজতে গিয়েছিলে তেমন আমিও”।
মুন বেশ অবাক হলো। মুনকে বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে রিয়াদ বললো,” আমি, আপু, বাবা, মা এই চারজনকে নিয়ে আমাদের পরিবার। আমি যখন চাকরি পেয়ে ট্রেনিং এ যাই। তখন আমাদের পরিবারে নেমে আসে এক ঝড়। যে ঝড়ের আবাস আমার বাবা-মা আমাকে দেয়নি। তাই আমি তখন কিছুই জানতে পারি না। ট্রেনিং শেষে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন জানতে পারলাম। তিন মাস আগে আমার বোন একটি চিঠি লিখে বাড়ি থেকে চলে যায়। চিঠিতে বলা ছিলো সে যে ছেলেটিকে ভালোবাসে তার বাবা-মা তাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তাই তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আপু নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে এটা জেনেও আমি আপুর খোঁজ করার চেষ্টা করি। বাবা-মা বারণ করেছিলো কিন্তু আমি শুনিনি। অনেক খোঁজ করেও আপুকে পাইনি। ভেবেছিলাম সে ভালো আছে তার নতুন সংসারে। সেখানে আমাদের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু একদিন হঠাৎ”!

এতটুকু বলে রিয়াদ থামলো। মুন কৌতুহল নিয়ে রিয়াদের দিকে তাকালো। মুনকে কৌতূহল নিয়ে তাকাতে দেখে রিয়াদ আবার বললো,” হঠাৎ একদিন আমার কাছে একটি ফোন আসে। আমার পুরনো নাম্বারে। অচেনা নাম্বার দেখে কিছুটা অবাক হই। ফোনটি রিসিভ করে কানে ধরতেই শুনতে পাই সেই চিরচেনা আপুর গলা, আপু বলছিলো আমাকে বাঁচা ভাই। আমি ভালো নেই। তারপর ফোনটি কেটে যায়। ঐ নাম্বারে আজো কল করলে বন্ধ বলে। যাই হোক সেই ফোনটি কদমতলী গ্রাম থেকে এসেছে এটুকু জানতে পারি। তারপরি সেখানে যাই। তখন ‘চন্দ্রকুঠির’ কথা মাথায় আসেনি, এছাড়া তখন তো আর জানতাম না সেখানে কি হয়! তখন জানলে হয়তো খুঁজে পেতাম”।

রিয়াদ একটু থেমে আবার বললো,” এটাই আমার কথা”।
মুন কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর বললো,” তারমানে সেদিন ঐ মহিলাগুলোকে আপনি নিজের বোনের ছবি দেখাচ্ছিলেন”?
” হ্যাঁ।

” আমাকে একটু দেখাবেন”?
রিয়াদ এবার ঘুরে মুনের দিকে তাকালো। তারপর বললো,” ওখানে নেই আপু। আমার মনে হয় আমি আর আপুকে খুঁজে পাবো না। তাই বেকার ছবি দেখে কি করবে তুমি”?
” আচ্ছা এমনিই দেখি না। চিনে রাখি যদি কখনো দেখা হয়”।
রিয়াদ কিছু না বলে মুচকি হাসলো। তারপর ফোন থেকে ছবি বের করে মুনের সামনে ধরলো। মুন ফোনের দিকে তাকালো। ফোনে রিয়াদ এবং একটি মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফুটে উঠেছে। রিয়াদ পাশে মেয়েটিকে দেখে মুন চমকে গেলো।
” এ আপনার বোন”?
” হ্যাঁ”।
” নাম কি এর”?
” রিশিতা জাহান”।
“কি”?

” তুমি এত চমকাচ্ছো কেন”?
” এই মেয়েটিকে আমি চিনি। এর নাম রিশিতা নয় রেবেকা”।
” মানে? কোথায় দেখেছো”?
তারপর মুন প্রথম থেকে সবটা বললো। সব শুনে রিয়াদ কিছুটা ভেঙে পড়লো। মুন রিয়াদকে আশ্বাস দিয়ে বললো,” চলুন। তার সাথে দেখা করবেন”।
” হ্যাঁ চলো”।

____________

মুন আর রিয়াদ চলে এলো কারাগারে। কারাগারে এসে রেবেকার সাথে দেখা করতে চাওয়ার পর যা শুনলো তার জন্য দু’জনের কেউ প্রস্তুত ছিলো না।
রহিমা ওদের দু’জনকে কারাগারে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” তোমরা এখানে কেন এসেছো”?
” রেবেকার সাথে দেখা করতে”।
তখনি সেই বৃদ্ধা মহিলা কনস্টেবল(যে মুনকে দেখে চমকে গেছিলো) এলো এবং বললো,” রেবেকা বেঁচে নেই”।
” কি”?
রিয়াদ সেখানেই বসে পড়লো। মুন রিয়াদকে ধরলো এবং বললো,” আপনি শান্ত হন প্লীজ। এভাবে ভেঙে পড়বেন না”।
” আপনি জানেন না ও আমার জন্য কি ছিলো”?
রিয়াদের চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মুন একটু শান্তভাবে বললো,” কিভাবে মারা গেলো”?
” ওর বাচ্চার মৃত্যুর খবর পেয়ে আত্নহত্যা করেছে”।
এবার মুনও একটু ভেঙে পড়লো। যে বাচ্চাটা মুনকে নিজের জন্মের স্মৃতিচারণ ঘটালো সেই বাচ্চাটিও বেঁচে নেই। ওদের দু’জনের অবস্থা দেখে রহিমা বললো,” আমিও কিছু জানতাম না। আজকে এসেই শুনলাম তিনদিন আগে এসব হয়েছে। ওর মৃতদেহ দাফন হয়ে গেছে। তাই এখন তোমাদের জন্য ওর কবরটি ছাড়া দেবার মতো কিছু নেই”।
রিয়াদকে ভেঙে পড়তে দেখে রহিমা কিছুটা আন্দাজ করে নিলো। তাই এই কথাটি বললো। রহিমার কথা শেষ হতেই অন্য মহিলাটি বললো,” আমার কাছে আরো একটি জিনিস দেওয়ার মতো আছে”।
” সেটা কি”? রিয়াদ বললো
” তবে এটা তোমাকে নয় মুনকে দিতে চাই। রেবেকা এটা মুনের জন্যই রেখে গেছে”।
এবার মুন বললো,” কি”?
মহিলাটি একটি চিঠি মুনের দিকে এগিয়ে দিলো। মুন ওনার হাত থেকে চিঠিটি নিলো। মহিলাটি বললেন,” আমি এখানে আসার আগে সেই কারাগারে কর্মরত ছিলাম যেখানে তোমার মতো…..”।
কথাটি শেষ করতে না দিয়ে মুন বললো,” আপনার চমকানোর মানেটা সেদিন না জানলেও আজকে ঠিকই জানি। তাই বলতে হবে না”।

মুন এবং রিয়াদ কারাগার থেকে বেরিয়ে এলো। দু’জনে গাড়িতে বসে আছে। চিঠিটার দিকে তাকিয়ে মুন রিয়াদকে বললো,” আপনি ঠিক আছেন। তাহলে আমরা চিঠিটা পড়তে পারি”?
রিয়াদ মুনের দিক তাকালো এবং বললো,” আমি ঠিক আছে। তুমি চিঠিটা পড়ো”।
” ঠিক আছে”।
এরপর মুন চিঠিটা পড়তে নিলো। চিঠির ভাঁজ খুলতেই প্রথমে লেখা দেখলো,

প্রিয় চন্দ্র,
তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে তখন হয়তো আমি থাকবো না। তুমি একটু অবাক হচ্ছো চিঠির উপরে চন্দ্র লেখায় তাই তো! আসলে তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তখন কিছু মূহুর্তের জন্য হলেও তোমাকে চন্দ্র ভেবেছিলাম।
আমি আমার গল্পটা সম্পূর্ণভাবে তোমাকে বলছি। তারপর তুমি নিজেই বুঝে যাবে সবকিছু।
আমি রিশিতা। বাবা-মা, ভাই নিয়ে আমার একটা সুন্দর পরিবার ছিলো। হঠাৎ একদিন সব এলোমেলো হয়ে গেলো। মায়া, মোহ বেড়াজালে প্রেম নামক এক মিথ্যে আবেগে ডুব দিয়েছিলাম আমি। ভালোবেসে যার সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম সেই মানুষটা ধোঁকা দিয়ে বিক্রি করে দিলো ‘চন্দ্রকুঠি’ নামক এক অন্ধকার নিষিদ্ধ পল্লীতে। সেখান থেকে আমার যন্ত্রণাময় জীবন শুরু। রিশিতা থেকে হয়ে উঠলাম রেবেকা। টাকার কাছে বিক্রি হওয়া জীবনটার প্রতি খুব ঘৃনা হতো। আর সবচেয়ে বেশি ঘৃনা হতো সেই মানুষটার কথা ভাবলে যার জন্য আমার এই অবস্থা। সেই মানুষটির নাম ফাহাদ।
তো যাই হোক ঘৃনিত জীবন থেকে মুক্তি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুক্তি নেওয়ার আগেই জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি। মা শব্দটি শুনে আনন্দিত হয়েছিলাম। যখন ভাবতাম এ সন্তান পাপের তখন খুব খারাপ লাগতো। তবুও এই সন্তানকে খুন করার কথা ভাবতে পারিনি। যতই হোক প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি ছিলো এটা।
গর্ভবতী অবস্থায় ওরা আমাকে ছাড়লো না। একজনকে রুমে পাঠিয়ে দিলো। সহ্য করতে না পেরে লোকটিকে মেরে দিয়েছিলাম। যে কারনে আজ আমি খুনি। সবি তো শুনলে। যেটা বাকি রইলো তাহলো চন্দ্র কে? তাকে কিভাবে চিনি?

চন্দ্রর ব্যপারে আমি চন্দ্রকুঠির একজনার কাছেই শুনেছি। যদিও সবটা জানি না। তবে শুনেছি এই বাড়িটা তার ছিলো। একদিন পুরনো আসবাপত্র রাখতে বাইরের তালাবদ্ধ ঘরটি খোলা হয়েছিলো। সেদিনই ঐ ঘরটির মাঝ থেকে আমি চন্দ্রর একটি ছবি পাই। তারপরো আমি ওর সম্পর্কে জানি।
সেদিন যখন তুমি আমার সামনে মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলে। কিছু মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো ছবি থেকে চন্দ্র বেরিয়ে এসেছে আমার সামনে।
তোমার সাথে চন্দ্র আর চন্দ্রকুঠির সম্পর্কে আছে এটা ভেবে তোমাকে সব বলতে চেয়েছিলাম। তবে তুমি যেদিন শুনতে এসেছিলে সেদিন তোমাকে সব বলা সম্ভব হয়ে উঠেনি। কারন আমি কিছু বললে আমার বাচ্চাটিকে মেরে ফেলা হতো…………।
আজ শেষ সময়ে খুব ইচ্ছে করলো তোমাকে সব বলতে। তাই তোমার জন্য আমার লেখা এই শেষ চিঠি।

ইতি
রিশিতা

চিঠিটা পড়া শেষে মুনের চোখ দিয়ে অশ্রুকোনা গড়িয়ে পড়লো। ভালোবেসে কতটা নির্মমভাবে ঠকে গেলো মেয়েটা। কতটা যন্ত্রণাময় ছিলো সেই দিনগুলি। মুনকে কাঁদতে দেখে রিয়াদ বললো,” এখন কান্না করে কোন লাভ নেই। রিশিতা, মাধুরির মতো অনেকগুলো মেয়ের যন্ত্রণার খুশি হতে হলে ওদেরকে শাস্তি দিতে হবে। তাই কান্না থামাও মুন”।
” আমরা এখন কি করবে”? কান্নারত অবস্থায় বললো মুন
” সেটা আমি ভেবে নিয়েছি, বাকিটা তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে”।
” আচ্ছা”।

মুন এবং রিয়াদ যে বাসা থেকে কারাগারের উদ্দেশ্য বেরিয়ে ছিলো সেখানেই আবার চলে এলো। বাসার সামনে গিয়ে বেশ অবাক হলো মুন এবং রিয়াদ। দরজার তালা ভাঙা। রিয়াদ এবং মুন দরজা খুলে ভিতরে ডুকে আরো অবাক হয়ে গেলো। সব জিনিস ছড়ানো, ছেটানো। ঘরটার এমন অবস্থা দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে বসে পড়লো মুন এবং রিয়াদ।

হঠাৎ চিন্তিত মুখ দূর করে দু’জনেই হেঁসে দিলো।

চলবে,

চন্দ্রকুঠি পর্ব-১১+১২

0

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১১)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

রিয়াদ অনেকক্ষণ ধরে মুনের আসার অপেক্ষা করছে। মুনকে ডাকা হয়েছে বেশ অনেকটা সময় হলো। তবুও মুন আসছে না দেখে বেশ বিরক্ত হলো রিয়াদ। বিরক্তি নিয়ে রুম থেকে বের হবে এমন সময় মুন এলো। মুনকে দেখে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললো, ” তোমার ব্যপারটা কি আমাকে একটু বোঝাবে?”
মুন রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিয়াদ সেটা দেখে বললো, ” কি দেখছো? আমার নতুন রুপ বের হয়েছে?”
” নতুন নাকি পুরনো তা জানি না তবে…”
” তবে কি?”
” আপনি, তুমি, আপনি, তুমি এই ব্যপারটা আমাদের প্লানে ছিলো না।”
রিয়াদ এবার আরো বিরক্ত হলো। মানছে আপনি থেকে হুট করে তুমিতে যাওয়া ঠিক হয়নি তার। তাই বলে এভাবে বলবে। কই রাফির সাথে তুমিতে তো কোন সমস্যা হয় না। সে বলায় এত সমস্যা। রিয়াদ বললো, ” রাফিকে বলো আমরা এখন চন্দ্রকুঠির ভিতরটা ঘুরতে চাই। ওকে বলে এখন ম্যানেজ করো।”
” কেন? আমাদের তো এখন চন্দ্রকুঠি ঘোরার কথা নয়”।
” যা বললাম তাই করো”।
” কারনটা কি? সেটা তো বলবেন”?
” দিনের আলোতে চন্দ্রকুঠি ঘুরবো। সেখানে দিনের বেলা কেমন পরিস্থিতি থাকে সেটা দেখবো। কারনটা তো জানলে এবার যাও ব্যবস্থা করো”।

মুনের কারনটা ততটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। তবুও কিছু না বলে চলে গেলো। গিয়ে রাফিকে ‘চন্দ্রকুঠি’ যাওয়ার কথা বললো। প্রথমে রাফি রাজি হলো না। তবে মুন বোঝালো তারা এখন ভিতরটা ঘুরে দেখতে চায়, যেটা মঞ্চনাট্যের সময় সম্ভব নয়। শেষে রাফি রাজি হলো।

মুন, রিয়াদ ও রাফি মিলে ‘চন্দ্রকিঠি’ ডুকলো। রাফির বন্ধু বলাতেই তারা ডুকতে দিলো৷ প্রথমে ওরা নিচতলাটা ভালোভাবে দেখলো। পরে উপর তলায় উঠলো। উপর তলায় ওঠার পর রিয়াদ বললো, ” তোমরা ওদিকটা ঘোরো আমি এদিকটা দেখি”।
মুন কৌতূহল নিয়ে বললো, ” কেন? আপনি উল্টো দিকে যাবেন কেন”?
” আপনাদের আমার সাথে একসাথে ঘুরতে ততটা আনন্দ হবে না যতটা আলাদা ঘুরলে হবে”।
রিয়াদ যে মুনকে ব্যঙ্গ করলো সেটা মুন বুঝলো। তাই চুপচাপ রাফির হাত ধরে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলো। রিয়াদও উল্টোদিকে পা বাড়ালো। রিয়াদ কিছুটা দূরে গিয়ে দু’জন মহিলার সাথে কথা বলতে শুরু করলো। মুন আঁড়চোখে রিয়াদের কান্ডকারখানা দেখছিলো। হঠাৎ দেখলো রিয়াদ মহিলা দু’জনকে ফোনে কিছু একটা দেখাচ্ছে। দূর থেকে কথা বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝলো ফোনে এমন কিছু একটা ছিলো রিয়াদ যার খোঁজ করছে। কিন্তু কি খুঁজছে রিয়াদ? তারমানে মুন প্রথমে যেটা ভাবছিলো সেটাই ঠিক রিয়াদ এখানে শুধুমাত্র মাধুরির ব্যপারটার জন্য তার সঙ্গ দেয়নি, অন্যকিছুর জন্য এসেছি। কিন্তু সেটা কি!
রিয়াদ মহিলা দু’জনের সাথে কথা বলে পিছনে ঘুরতেই মহিলাদের প্রধানকে দেখতে পেলো। সে রিয়াদকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ” এখন এখানে”?
” ঘুরতে এলাম”।
” যেখানে আপনার মতো মানুষদের এখানে রাতে আসার কথা সেখানে দিনের আলোতে ঘুরতে আসছেন বলছেন”।
মহিলাটি বেশ সন্দিহান চোখে বললো। রিয়াদ সন্দেহ কাটাতে বললো, ” পরিবারের জন্য এটুকু তো করতেই হয়”।
” মানে….”।
রিয়াদ আঙুল দিয়ে মুনের দিকে দেখিয়ে বললো, ” বউ। চন্দ্রকুঠি ঘুরতে চাইছিলো তাই নিয়ে আসা”।
” ওহ আচ্ছা”।
” তবে যাই বলেন, দিনের বেলায় এসেছি বলেই না বুঝলাম এখানে রাত আর দিন আকাশ-পাতাল ব্যবধান”।
দিনের বেলায় এখানে সবকিছু স্বাভাবিক দেখে রিয়াদ কথাটি বললো তা বুঝতে পেরে মহিলাটি বললেন, ” রাতের সুভাস আর পেলেন কই? আমাদের ব্যর্থতায় কষ্ট পেলেন”।
” সমস্যা নেই। আসা যাওয়া তো হবেই তখন না হওয়া রাতের সুভাস নিবো”।
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বলেন তো আজই আসেন”।
” দেখছি। তা কালকের মেয়েটাকে পেয়েছেন”?
” না। তবে চিন্তা করবেন না পেয়ে যাবো”।
” আচ্ছা যাই। বউ মাইন্ড করবো”।
” আচ্ছা যান”।

রিয়াদ মহিলাটিকে বিদায় দিয়ে মুনের কাছে গেলো। রিয়াদকে দেখে রাফি বললো, ” কি ভাই আলাদা ঘোরার শখ মিটলো”?
” হ্যাঁ মিটলো।”
” তা আমাদের কাছে এলেন কেন”?
কথাটি শুনে মুনের দিকে তাকালো রিয়াদ। মুচকি হেঁসে বললো,” যেখানেই যাই না কেন দিনশেষে তো নিজ ঠিকানাই ফিরতে হবে”।
” মানে….”।
” কিছু না। চলো বাড়ি ফিরে যাই”।
মুন এবং রাফির জন্য রিয়াদের বাড়ির ফেরার কথাটি গ্রাহ্য হলো না। তাই আরো কিছুক্ষন ‘চন্দ্রকুঠি’ ঘুরতে হলো৷ ঘোরা শেষে তালুকদার বাড়ি ফিরে রিয়াদ বললো, ” আমার মায়ের শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ করেছে, তাই আমাদের এখনি যেতে হবে”।
রাফির কাকা বললো, ” সেঁকি আজই চলে যাবে কিন্তু…. ”
কথাটি শেষ করতে না দিয়ে রিয়াদ বললো, ” আজ একেবারের জন্য চলে যাচ্ছি নাকি? আমরা তো আবার আসবো। আপনাদের মতো এত সুন্দর একটা পরিবারকে কি একেবারে ভোলা যায়, আমরা খুব শীঘ্রই আবার আসবো। কিন্তু আজ আমাদের যেতেই হবে”।

অবশেষে সবাই মেনে নিলো ওদের চলে যাওয়া। ওরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় রাফি বললো, ” তোমাদের সাথে আমিও যাবো। অনেকদিন ডিউটি অফ গেলো এবার নতুন করে আবার সব শুরু করতে চাচ্ছি”।
কথাটি শুনে মুন খুব খুশি খুশি ভাব নিয়ে বললো, ” আচ্ছা তাহলে চলুন একসাথেই যাওয়া যাক”।
” আদিক্ষেতা দেখলে বাঁচি না”। রিয়াদ মনেমনে

__________

শহরে ফিরে রাফি নিজ গন্তব্যে চলে গেলো। রিয়াদ মুনকে সাথে করে অন্যস্থানে নিয়ে গেলো। রিয়াদ ফ্লাটের সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজালো। সাথে সাথে রহিমা দরজা খুলে দিলো। রহিমা ওদের ভিতরে নিয়ে গেলো। মুন রহিমাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ” ও কোথায়”?
” পাশের রুমে ঘুমিয়ে আছে”।
” আচ্ছা। আমি দেখে আসছি”।
মুন পাশের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই রিয়াদ ওর হাতটি ধরে নিলো। মুন কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই রিয়াদ হাত টেনে অন্য আর একটি রুমে নিয়ে গেলো। রুমে নিয়ে গিয়ে হাত ছেড়ে দিলো। মুন জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো? এখানে কেন নিয়ে এসেছেন”?
” আগে আমাদের মধ্যে কিছু কথা পরিস্কার করে নেওয়া উচিত”।
” কি কথা”?
” তোমার বাবার সাথে কথা বলবে কখন”?
” আগে আপুর থেকে পুরো ঘটনা জানবো তারপর ভেবে দেখবো”।
” ভেবে দেখবো মানে”?
” আমি এখনো নিশ্চিত নই বাবার সাথে কথা বলবো কি বলবো না সেটা নিয়ে”।
” মানে তুমি কি বলতে চাইছো”?
” তোমার বাবার সাথে কথা না বললে তোমার মায়ের ব্যপারে জানবে কিভাবে? সেই সাথে চন্দ্রকুঠিতে এসব অনৈতিক কাজ কখন থেকে শুরু হয়েছে সেটাও তো জানতে হবে”?
” দেখুন আমার বাবা ছোটবেলা থেকে আমাদের খুব ভালোবেসে বড় করেছেন। আমি এভাবে হুট করে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করতে পারবো না”।
” পারবো না বললে তো হবে না। আমাদের সবকিছু জানতে হবে। সেইসাথে এই অনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ করতে হবে৷ এক্ষেত্রে তোমার বাবাকে প্রশ্ন করতেই হবে”।
” আমি আমার বাবাকে প্রশ্ন করতে যেতে পারি, তবে তারজন্য আমার একটা শর্ত আছে”।
” শর্ত মানে? কি শর্ত”?
” আগে আপনাকে বলতে হবে আপনার উদ্দেশ্য কি? আপনি কি শুধুমাত্র আমাদের সাহায্য করার জন্য এসব করছেন নাকি অন্যকিছু”?
” অন্যকিছু বলতে কি? আমরা আর কি উদ্দেশ্য থাকবে, আমি একজন পুলিশ অফিসার সে হিসাবে কেসের সমাধান করা আমার দায়িত্ব”।
” শুধু দায়িত্বের জন্যই আপনি আমার সাথে চন্দ্রকুঠি গেছিলেন”?
” তা নয়তো কি”?
” আপনি একটা মিথ্যাবাদী, আপনি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছেন”।
” মুন”। চিৎকার করে

রিয়াদের চিৎকারে মুন কিছুটা কেঁপে উঠলো। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,” আপনি ধোঁকাবাজ নাহলে কেন লুকাচ্ছেন সত্যিটা? আপনি শুধুমাত্র আমার আপুর জন্য ওখানে যাননি সেটা আমি খুব ভালো করে জানি”।
রিয়াদ নিরবতা ভেঙে বললো,” কোন কথা না বলা আর মিথ্যে বলা এক নয়। আমি তোমাকে কোন ধোঁকা দেইনি। হ্যাঁ আমি শুধুমাত্র এই কেসটার জন্য ওখানে যাইনি। তারমানে এটা নয় আমি এই কেসটা নিয়ে সিরিয়াস নই”।
” আর কি কারনে চন্দ্রকুঠি গিয়েছেন আপনি”?
” তোমার মতো আমার আপুকে খুঁজতে”।
” মানে….”।
” সেটা অনেক কথা”।
” সেটাই শুনতে চাই”।
” আচ্ছা বলছি”।
রিয়াদ বলা শুরু করবে এমন সময় রহিমা ডাক দিলো।

রহিমার ডাক শুনে রিয়াা এবং মুন পাশের রুমে গেলো। মুন বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো, ” কি হয়েছে”?
” বোন”।
মাধুরির ডাক শুনে মুন মাধুরির দিকে তাকালো। মাধুরির দিকে তাকিয়ে মুনের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মুন গিয়ে মাধুরিকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পর দু’বোন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মুন দু’বোনের দিকে তাকিয়ে কালকে রাতের কথা মনে করলো।

কালকে রাতে মাধুরি বলে ডাক দেওয়ার পর মাধুরি রিয়াদের দিকে তাকালো।
” আ আ আপনি”?
” আমি রিয়াদ। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। শুধু আমি নই মুনেও এসেছে”।
কথাটি শুনে মাধুরির খুশি হওয়া উচিত ছিলো কিন্তু হয়নি। রিয়াদ মাধুরির চোখে স্পষ্ট ভয় দেখতে পেলো। রিয়াদ মাধুরির ভয় কাটাতে আরো কিছু বলতে নিবে তখনি মাধুরি বলে উঠলো, ” চুপ করুন”।
মাধুরির ভয় মিশ্রিত কন্ঠ শুনে রিয়াদ বেশ চমকালো। কিছুক্ষনের জন্য মনে হলো, ” এ কি মাধুরি নয়”?

চলবে,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন। ]

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১২)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

রিয়াদ রুমে ডুকে মাধুরি বলে ডাক দেওয়ার পর মাধুরির চোখে মুখে ভয় দেখে বেশ অবাক হলো। মাধুরিকে সত্যিটা বলায় তার চোখে খুশি থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু চোখে খুশি নয় বরং ভয় রয়েছে। কেন! রিয়াদ খুব শান্তভাবে বললো,” ভয় পাচ্ছেন কেন আপনি”?
মাধুরি ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললো, ” এখানে ক্যামেরা আছে”।
” কি”?
” এই মূহুর্তে আপনি বা আমি যা বলবো সবি ক্যামেরা রেকর্ড হবে। এই রেকর্ডিং দিয়েই পরে এখানে আসা লোকদের মুখ বন্ধ করা হয়। আমি যতটা জানি তাতে ধনীদের ব্লাকমেইল করে টাকাও নেওয়া হয়”।

রিয়াদের হঠাৎ করে রাতুলের বলা কথাটি মনে পড়লো। রাতুল বলেছিলো,” তুমি হয়তো ভাবছো তুমি তো সত্যিটা সবাইকে বলে দিতে পারো। এটা জেনেও আমরা এত নিশ্চিন্ত কিভাবে? এর উত্তর চন্দ্রকুঠিতে এক রাত কাটালেই পেয়ে যাবে তুমি। তখন চাইলেও তুমি মুখ খুলতে পারবে না”।
রিয়াদ শান্তভাবে বললো, ” আপনি ভয় পাবেন না। আমাকে বলুন ক্যামেরা কোথায় আছে”?
” তা জানি না। আমি শুধু জানি এখানে সব রুমে ক্যামেরা আছে৷ সেদিন রুমে ডুকে সব পর্দা জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ধরা খেয়ে যাই। এরপরি জানতে পারি সব রুমে ক্যামেরা আছে”।
” আমরা এতক্ষন যা বললাম সব ক্যামেরা রেকর্ড হয়েছে তাই তো”?
” হ্যাঁ”।
” তাড়াতাড়ি রুমটা খুঁজুন”।
” মানে….”
” ক্যামেরা খুঁজে বের করতে হবে “।
কথাটি বলে রিয়াদ সাথে সাথে প্রত্যেকটা রুম খুঁজতে লাগলো। রিয়াদের দেখাদেখি মাধুরিও তাই করতে লাগলো। রুমের সব জিনিসপত্র খুঁজেও ক্যামেরা পেলো না। হঠাৎ রিয়াদের চোখ গেলো বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলে একটি ফুলদানি রাখা। কিছু একটা ভেবে ফুলদানিটা হাতে নিলো। কিছু মূহুর্তের মাঝে ফুলদানিটা ফেলে দিলো মেঝেতে। ফুলদানিটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো এবং ক্যামেরাটি সামনে বেরিয়ে এলো। রিয়াদ ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে আগে সেটা নষ্ট করলো, তারপর রুমের জানালা ভেঙে নিচে নেমে গেলো।
পিছন দিকে দু’জন বসে বসে ঘুমাচ্ছিলো। হয়তো তাদের এদিকটা পাহারা দিতে বলা হয়েছিলো। রিয়াদ আস্তে করে তাদের সামনে গিয়ে পকেট থেকে রুমালটি বের করে তার ভাজ খুলে দু’জনের নাকের কাছে ধরলো। লোক দু’জন অজ্ঞান হয়ে গেলো। রিয়াদ ভেবেছিলো রুমে মাধুরি নাহয়ে অন্যকেউ হলে তার উপর রুমালটি ব্যবহার করবে। যেহেতু মাধুরি ছিলো সেহেতু রুমালটি অন্য কাজে ব্যবহার করলে। পিছনের দেয়াল টপকে বাহিরে গিয়েই রহিমাকে দেখতে পেলো। রহিমা এখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো। রিয়াদ ওর হাত থেকে কাপড় গুলো নিয়ে আবার মাধুরির কাছে চলে এলো। তারপর কাপড়গুলো বেঁধে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। তারপর বললো,” এগুলো বেয়ে নিচে নামো। দেয়াল টপকে বাহিরে গেলেই একটি মেয়েকে দেখতে পাবে, তার সাথে চলে যেও। আর হ্যাঁ কাপড়টা আমি ফেলে দিবো নিচে এটাকে সাথে নিয়ে যাবে”।
মাধুরি আচ্ছা বলে খুব সাবধানে নেমে গেলো। মাধুরি রহিমার কাছে পৌঁছেছে খবরটি পেয়ে রিয়াদ নিজের মাথায় আঘাত করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।(এগারো পর্ব প্রথমবার পোস্টে যারা পড়েছেন তারা কিছু বুঝবেন না কারন তখন মাঝের অংশ মুছে গিয়ে প্রথম অংশ দু’বার রিপিট হয়েছে যার জন্য শেষটা কেউ বুঝে নাই। যারা বুঝেন নাই তারা আবার এগারো পড়ে এই পর্ব পড়ুন)

অতীত থেকে বের হয়ে আসলো রিয়াদ। মুন এবং মাধুরি গল্প করছে। মুন মাধুরিকে সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
মাধুরি স্বাভাবিক হওয়ার পর মুন খুব ধীরে জিজ্ঞেস করলো, ” তুই ওখানে গেলি কিভাবে”?
মাধুরি মুনের চোখের দিকে তাকালো তারপর বললো,” ওরা আমায় নিয়ে গেছিলো। রাফিকে আটকে রেখে ওরাই এসেছিলো আমায় নিতে”।
” ওখানে নেওয়ার পর কি হয়েছিলো”?
মাধুরি কিছুটা ভয় পেলো। মুন মাধুরিকে জড়িয়ে ধরলো।
” ভয় পাস না আপু। তোর কিছু হবে না। কেউ তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না”।
” যা ক্ষতি করার তা তো ওরা করেই নিয়েছে”।
” ক্ষতি”?
মুন কিছুটা ভয় পেলো। মাধুরির সাথে দু’মাস কি হয়েছে সেটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে। মাধুরি কিছু একটা ভেবে কান্না করে দিলো। কান্না করতে করতেই বললো, ” শুনবি কি হয়েছিলো আমার সাথে”?
” হ্যাঁ বল”।
মুন, রিয়াদ, রহিমা একটা কঠিন সত্যি শোনার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নিলো।

মাধুরি চলে গেলো অতীতে,
রাফিকে আটকে রেখে মাধুরিকে নিজ বাড়ি যেতে বলে ওর হাতে একটি ফোন ধরিয়ে দেওয়ার পর।(প্রথম দিকে এ পর্যন্ত বলা হয়েছিলো)। ফোনে একটি লোক কোথা থেকে কোথায় যেতে হবে সব বলে দিতো। কদমতলী গ্রামের ডোকার পর একজন লোক আমাকে সাথে করে ‘চন্দ্রকুঠি’ নিয়ে যায়। একটা রুমে নিয়ে বসতে বললো। তারপর বললো,” রাফিকে খুব ভালোবাসো তাই তো”?
ভয়ে ভয়ে মাধুরি বললো,” হ্যাঁ”।
” তাহলে চুপচাপ এখন যা বলছি তাই করো”।
” ক কি করবো”?
তারপর লোকটি একটি ছেলেকে নিয়ে এসে রাফির উদ্দেশ্য একটি ভিডিও বানাতে বললো। মাধুরি ভয়ে ভয়ে তাই করলো। তারপর একদিন ওখানেই রাখলো। পরেরদিন ঘরের মধ্যে একটি লোক নিয়ে ডুকলো সে। তারপর তাদের নোংরা নোংরা কথায় বুঝতে পারলাম এই সুন্দর বাড়িটা বাহির থেকে যতটা সুন্দর ভিতরে ততটাই অসুন্দর। হাজার মিনতি, অনুরোধ করেও তাদের আটকাতে পারিনি। এভাবে সাতদিন কেটে গেলো। এই সাতদিন সেই লোকটি আসেনি যে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো। সাতদিন পর সে এলো। আমি তাকে দেখেই রেগে গেলাম এবং উত্তেজিত হয়ে বললাম,” কেন করছেন আমার সাথে এরকম? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার? আপনার কি লজ্জা করে না নিজের মেয়ের মতো একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করতে”?
লোকটি আমার কথা শুনে বিশ্রিভাবে হাসলো তারপর বললো,” তোর এই পরিনতির জন্য আমি নই তোর মা দ্বায়ী। তোর নিজের মা”।
” কি”?
” অবাক হচ্ছিস। তোর এই পরিনতি তোর মায়ের জন্য। তোর মায়ের জেদ, তেজের জন্য। জেলের অন্ধকারে থেকেও তার তেজ কমেনি। আমি তাকে জেল থেকে বের করতে চেয়েছিলাম আর সে আমার মুখে থু থু মারলো। এটা তোর মায়ের অহংকারের শাস্তি। তোর মা অহংকার না করলে তুই সুস্থ আর সুন্দর জীবন কাটাতি আজ”।

তারপর দু’মাস অন্ধকারেই কেটে গেলো। পালিয়ে যাবো এরও উপায় ছিলো না। কারন সবসময় রুমেই তালাবদ্ধ থাকতাম।(অতীত শেষ)

মাধুরি নিজের অন্ধকার জীবনটা মনে করে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো। মুন এবং রহিমা অনেক বুঝিয়ে ওকে ঘুম পড়িয়ে দিলো। রিয়াদ সবকিছু শুনে কিছু একটা ভাবলো তারপর মুনকে ওপাশের রুমে ডাকলো।

মুন রিয়াদের কাছে যাওয়ার পর,
” এখন কি করা উচিত তোমার”?
” জানি না”।
” তুমি না জানলেও আমি কিন্তু জানি”।
” কি”?

” এখন তোমার নিজের বাবার কাছে গিয়ে সত্যিটা জানা উচিত”।
” আমি তো বললাম আপনার কথা না শুনে যাবো না”।
” এখন আমি আমার কথা না বললেও তুমি যেতে বাধ্য”।
” বাধ্য মানে? আমি আমার আপুকে ফিরে পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। এখানে আর কোন বাধ্যবাধকতা নাই”।
” তাই”?
” হ্যাঁ।
রিয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, ” তোমার আপুর এই পরিস্থিতি তোমার জন্য হয়েছে এটা একবারো তোমার মাাথায় আসেনি বলছো”?
কথাটি বলে রিয়াদ এক রহস্যময় হাঁসি দিলো। মুন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,” মানে”?
” তোমার মুখটা সত্যি সত্যি তো সার্জারী করা না। এটা তুমিও জানো আমিও জানি। তুমি চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না তুমি দেখতে চন্দ্রর মতো। চন্দ্রও এক সময় জেলে ছিলো। তার স্বামীর নাম আরিফ। হোক সেটা তালুকদার নয়তো হাওলাদার। আর….”
” চুপ করো”।
মুনের চিৎকার শুনে রিয়াদ থেমে গেলো। মুন কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো। রিয়াদ মুনকে কাঁদতে দেখে বিচলিত হলো। কোনকিছু না ভেবেই গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
” দেখো তুমি কেঁদো না। সবকিছুই তো শুধু মনে হওয়া। আমরা তো শিউর নই তাই না। দেখো আমি শুধু অপরাধীদের শাস্তি চাই। এজন্য তোমার বাবার থেকে সত্যিটা জানা জরুরি। আমি এজন্যই তোমাকে চাপ দিয়েছি, বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি”।
” অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আপনি এতটা…..”।
মুনকে কথাটি শেষ করতে না দিয়ে রিয়াদ বললো,” আমার এই মূহুর্তে ওদের শাস্তি দেওয়াটাই একমাত্র লক্ষ্য। আমি যা ভাবছি তা সত্যি হলে ‘চন্দ্রকুঠি’ অন্ধকারে সেও হারিয়ে গেছে। হয়তো আমি তাকে কখনো ফিরে পাবো না। কিন্তু তার অপরাধীদের শাস্তি আমি দেবোই”।
রিয়াদের চোখে মুখে রাগ ফুটে উঠলো। রিয়াদের কথা সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলেও কিছুটা বুঝলো মুন। মুন রিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়াদ মুনকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
” আগে তোমার বাবার সাথে কথা বলবো তারপর তোমাকে সব বলবো। ভেবো না আমি তোমার শত্রু নই”।
” আমি আপনাকে শত্রু কখন ভাবলাম”?
” এখন না ভাবলেও প্রথমদিকে বোধহয় ভাবতে”।
” একদমি না। শত্রু ভাবতাম না। শুধু পুরোপুরি বিশ্বাস করতাম না”।
রিয়াদ এবার মুখটা সিরিয়াস করে বললো,” তারমানে এতটা রাস্তা বিশ্বাস ছাড়া একজনের সাথে পাড়ি দিলে। তোমাকে তো বাহবা দিতেই হয়। তোমার যায়গা অন্যকেউ থাকলে এতক্ষনে….”।
কথা শেষ করতে না দিয়ে মুন বললো,” বাজে কথা রাখুন। আমাদের অনেক কাজ আছে, তাই চলুন”।
রিয়াদ চুপ করে গেলো। সত্যি এখন তাদের অনেক কাজ। মুন রহিমাকে মাধুরির দেখাশোনার জন্য থাকতে বলে রিয়াদের সাথে বেরিয়ে গেলো। মনেমনে রহিমার মতো একজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় বেশ খুশি হলো মুন৷ রহিমা বিনা স্বার্থে তার আর মাধুরির জন্য কতকিছু করছে। আজকের পৃথিবীতে এরকম কেউ করে কারো জন্য!

________
মুন এবং তার বাবা মুখোমুখি বসে আছে। আরিফ সাহেব জানতেন এরকম একটা দিন আসবে।
মুন ও আরিফ সাহেবের থেকে কিছুটা দূরে রিয়াদ এবং আরিফ সাহেবের বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই নিরব। নিরবতা ভেঙে আরিফ সাহেব বললেন,” কি জানতে চাও”?
” আমার মায়ের নাম কি”?
” সেটা তুমি জানো”।
” যেটা জানি সেটা কি আদো সত্যি”?
” সত্যি”।
” তাই? আচ্ছা তাহলে বলো তো মাধুরি কে? সে কি সত্যি আমার নিজের বোন”?
” নিজের বোনকে নিয়েও আজ এত সন্দেহ”?
” সন্দেহও নয় সত্যি। মাধুরি আপু আমার বোন নয় এটা আমি জেনে গেছি”।
” তুমি ভুল জেনেছো”।
আরিফ সাহেবের এরকম সরল স্বীকারোক্তিতে মুন কনফিউজড হয়ে পড়েছে। মুন তো নিশ্চিত নয়, শুধু মনে হওয়ার উপর নির্ভর করে এসব বলছে। মুনকে ভাবনায় দেখে রিয়াদ বললো,” মুন”।
রিয়াদের ডাকে মুন রিয়াদের দিকে তাকালো। রিয়াদ ইশারায় এসব বিশ্বাস করতে বারণ করলো, সাথে প্রশ্ন করা চালিয়ে যাওয়ার কথা বললো৷ মুন রিয়াদের ইশারা বুঝতে পেরে একবার ভেবে নিলো কি বলবে! ঠিক কি বললে আরিফ সাহেব সত্যিটা বলতে পারেন! মুন ভেবে নিলো ঠিক কি বললে বাবা সত্যি না বলে থাকতে পারবে না। মুন তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো, ” মাধুরি আপু তোমার মেয়ে নয় তাই না বাবা”?
মুনের কথা আরিফ সাহেব কিছু বলে ওঠার আগেই মুন আবার বললো,” মাধুরি তোমার মেয়ে নয় বলেই নিজের মেয়ের যায়গা ওকে অন্ধকার জীবনে পাঠালে তাই তো”?
মুনের কথায় আরিফ সাহেব চমকে উঠলেন। তার চোখে পানি স্পষ্ট দেখতে পেলো মুন৷ আরিফ সাহেব চুপ করে রইলেন। তাকে চুপ দেখে তার বন্ধু বললেন,” তুমি ভুল ভাবছো মুন। আরিফ নিজের মেয়ের জন্য পরের মেয়েকে বিপদে ফেলেনি বরং পরের বিপদে পরায় নিজের মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে”।
আরিফ সাহেব তার বন্ধুকে চুপ করতে বললেন কিন্তু তিনি চুপ করলেন না বরং বললেন,” না আরিফ সত্যিটা মুনের জানার সময় এসে গেছে। তাই বলছি চুপচাপ সব বলে দে”।
আরিফ সাহেব আবারো চুপ করে গেলেন। তার বন্ধু আবারো বললো,” তুমি হয়তো জানো না মুন তুমি ‘চন্দ্রকুঠির’ ব্যপারে জানতে পেরেছো তোমার বাবার জন্য। আরিফ নিজ হাতে মাধুরি ফোন তোমার ব্যাগে রেখেছিলো”।
কথাটা শুনে মুন এবং রিয়াদ দু’জনেই বেশ চমকালো। এবার আর আরিফ সাহেব চুপ রইলেন না তিনি বললেন,” আমিই বলছি সব”।
আরিফ সাহেব সব বলবেন এটা শুনে মুন খুশি হলো। তবে তার খুশিটা কতক্ষন থাকবে তা সে জানে না। কারন তার বাবা এখন কি বলতে চলেছেন সে সম্পর্কে ওদের কোন ধারনাই নেই।

চলবে,,

চন্দ্রকুঠি পর্ব-৯+১০

0

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৯)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

রাতের খাওয়া-দাওয়া করে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো। খাওয়ার টেবিলে রসিদ(রাফির দাদু) মুনের দিকে বেশ কয়েকবার তাকালেন। যদিও সবাই কম বেশি তাকিয়ে ছিলো। খাওয়া শেষে রাফির বাবা রাফির রুমে গেলেন। রাফি বাবাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ” কিছু বলবে বাবা?”
” হুম। তোমার বন্ধুরা যা বললো তা কি সত্যি?”
” কি বললো?”
” নিজেদের সম্পর্কে যা বললো। এই যে মুনতাহার সার্জারীর ব্যপারটা।”
রাফি বুঝতে পারলো না তার বাবার কথা। তবুও সে বললো, ” নিজেদের ব্যপারে যখন বলেছে তখন তো সত্যিই হবে। শুধু শুধু মিথ্যে কেন বলবে?”
” হুম তাও ঠিক। বলছিলাম মুনের থেকে হাসপাতালের নামটি জেনে আমাকে একটু জানাও তো।”
এরমাঝে পিছন থেকে মুন বলে উঠলো, “… (হাসপাতালের নাম) এই হাসপাতাল কাকা।”
রাফি এবং তার বাবা পিছনে ঘুরে তাকালো। দেখতে পেলো মুন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাফির বাবা বললেন, ” ডাক্তারের নাম?”
” ডাক্তার রফিকুল ইসলাম।”
” ওহ আচ্ছা। তুমি বোধহয় রাফির সাথে কথা বলতে এসেছো, তোমরা কথা বলো আমি চলে যাচ্ছি।”
রাফির বাবা চলে গেলেন। রাফির বাবা চলে যেতেই রাফি বললো, ” হাসপাতাল, সার্জারী এসবের মানে কি? তোমরা কি বলেছো বাড়িতে?”
” তেমন কিছু নয়। আমার মনে হয়না কাকা এ ব্যপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন। তাই বলছিলাম তুমিও এসব নিয়ে আর ভেবো না।”
” আচ্ছা। তুমি কি আমাকে কিছু বলতে এসেছো?”
” হ্যাঁ।”
” আচ্ছা বলো।”
” তোমার সত্যি মনে হয় আপু এমন করতে পারে?”
” ভিডিওটা তুমিও দেখেছো। এবার তুমিই ভাবো?”
” কি ভাববো? ভাববে তো তুমি। তোমার সাথে আপুর সম্পর্কটা কেমন ছিলো সেটা তো তুমি জানো। তোমার সাথে রিলেশন চলা-কালীন তোমার কখনো মনে হয়েছে আপু তোমার সাথে খুশি নয়।”
” না কখনো মনে হয়নি।”
” তাহলে একটা ভিডিওর জন্য সবকিছু মিথ্যে কেন ভাবছো তুমি?”
” কিন্তু ভিডিওটা….”
” চোখের দেখা কি সবসময় সত্যি হয় বলো?”
” তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো?”
” আমার মনে হয় আপু বিপদে আছে। আমাদের আপুকে খুঁজে বের করা উচিত।”
” কিন্তু আমরা কিভাবে খুজবো?”
” আমা…..”
মুন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো। ভালোভাবে রাফির ঘরটি আরো একবার দেখলো। ঘরটি বেশ বড়। মুন ঘরটি দেখতে দেখতে হঠাৎ করে ঘরের সুইচ বাটনে টিপ দিলো। সাথে সাথে ঘরটি অন্ধকার হয়ে গেলো। অন্ধকারের মধ্যে মুন বিছানা খুঁজে সেখানে বসে পড়লো। রাফি মুনের কর্মকান্ড নির্ভীকভাবে দেখছিলো। রাফি গিয়ে ঘরের সুইচ অন করলো তারপর বললো, ” কি করছো তুমি এসব? কিছু একটা বলতে চাইছিলে তা না বলে এসব কি করছিলে?”
মুন শান্তভাবে বললো, ” রাফি ভাইয়া তোমাকে একটা কথা বলতে চাই?”
” হ্যাঁ বলো।”
” তোমার ঘরটি খুব সুন্দর, আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
রাফি মুনের কথায় বেশ অবাক হলো। এসব কি বলছে মুন! রাফি অবাক হয়েই বললো, ” মানে? এসব কি করছো, কি বলছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
” তোমাকেও আমার খুব ভালো লাগে।”
” মানে?”
” আপুকে তুমি কতটা ভালোবাসো রাফি ভাইয়া?”
” সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় মুন। তুমি জানো না মাধুরি আমার কতটা জুড়ে আছে!”
” যে তোমাকে ঠকালো তাকে কি তুমি এখনো ভালোবাসবে?”
” তুমি ঠিক কি বোঝাতে চাইছো মুন? আমি সত্যি তোমার কাজকর্ম কিছু বুঝতে পারছি না?”
” বড় বোনের প্রেমিককে ভালোলাগা খুব বেশি অপরাধের কি?”
কথাটি বলে মুন রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো। রাফি কিছু না বুঝতে পেরে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে।(লেখিকাও জানে না এখানে কি হলো?)

____________

রাফির দাদু ডাক্তার রফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলো মুন সত্যি বলেছে। সত্যি ওর মুখে সার্জারী হয়েছিলো। যদিও ডাক্তার রফিকুল প্রথমে বলতে চাইনি। তবে জোরাজুরিতে বলতে বাধ্য হয়েছে। রসিদ সাহেবের মনে এখন আর দ্বিধা নেই। ডাক্তারের কথা সাথে আরো একটি কথা মনে করে রসিদ সাহেব দুই দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলেছেন।

অন্যদিকে রিয়াদ উঠানে পাইচারী করছিলো। এতরাতে রিয়াদকে এভাবে পাইচারী করতে দেখে রাতুল(রাফির ভাই) এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো,” এতরাতে না ঘুমিয়ে কি এখানে কি করছেন?”
রিয়াদ রাতুলের দিকে তাকিয়ে মুখে কিছুটা দুঃখ রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো, ” আসলে ঘুম আসছিলো না।”
” তা মুখে এত দুঃখ কেন?”
” না ভাই তেমন কিছু নয়।”
” আরে বলুন না।”
” বলাটা ঠিক হবে না।”
” সমস্যা নেই বলুন।”
” আচ্ছা আমরা কোথাও বসি আগে?”
” আচ্ছা চলুন। ঐদিকটায় পুকুরপাড় আছে, সেখানেই বসি চলুন।”
” আচ্ছা।”
দুজনে গিয়ে পুকুরপাড়ে বসলো৷ রাতুল বললো, ” এবার বলুন দুঃখী মুখ কেন?”
” আপনি বুঝবেন না ভাই। আপনি বিবাহিত মানুষ। বউ নিয়ে সুখেই আছেন। আমাদের দুঃখ কি বুঝবেন?”
” আরে কি হয়েছে সেটা বলুন তো?”
রিয়াদ একবার মনেমনে ভাবলো টোপটা কি দিবে নাকি একটু সময় নিবে। ভাবনা বাদ দিয়ে রিয়াদ টোপটা দিয়েই ফেললো।
” আসলে কাল মঞ্চনাট্য দেখতে গেছিলাম। চন্দ্রকুঠির এত এত সুন্দর রমনী দেখলাম যে আজ রাতের ঘুম উবে গেছে। একজন রমনীকে যদি একটু সময়ের জন্য কাছে পেতাম।”
কথাটি বলে চোখ বুঝলো রিয়াদ। উল্টোদিক থেকে কি রিয়েকশন আসবে সেটা বুঝতে পারলো না। রিয়াদের ধারনা ঠিক প্রমাণ করে রাতুল বললো, ” বেড পার্টনার হিসাবে চাইছো নাকি লাইফ পার্টনার?”
রিয়াদ চোখ খুলে ফেললো। মনেমনে খুব খুশি হলো, হয়তো তাদের ধারনা ঠিক। চন্দ্রকুঠির রহস্য তারা বুঝে গেছে, এবার শুধু ভিতরে ডোকার পালা। রিয়াদ বললো, ” না রে ভাই। লাইফ পার্টনার নামক ঝামেলাটা এত তাড়াতাড়ি নিতে চাইছি না। তাছাড়া ওসব রমনীদের বেডেই মানায় জীবনে নয়। কিন্তু বেডে তো পাইনা?”
” বেড অব্দি পেতে হলে তো কিছু ছাড়তে হবে ভাই।”
” মানে?”
” বলবো তবে একটা শর্ত আছে।”
” কি?”
” এখন আমি তোমাকে যা বলবো তা জীবনে কখনো কাউকে বলতে পারবে না।”
” আচ্ছা বলবো না।”
” তাহলে শোন চন্দ্রকুঠির ভিতরে রমনীদের বেড অব্দি তোমাকে আমি পৌঁছে দিতে পারি তার জন্য তোমাকে আগে পকেট ফাঁকা করতে হবে।”
” মানে টাকা দিতে হবে?”
” হ্যাঁ তা টাকা দেওয়ার মুরোদ আছে তোমার।”
” কত চাই?”
” এক ঘন্টা পাঁচ, দুই ঘন্টা দশ। আর সারারাত হলে পঞ্চাশ হাজার।”
” কালকের সারারাতের ব্যবস্থা করতে পারবে। চিন্তা নেই টাকা সকালে পেয়ে যাবে।”
” টাকা হলে ব্যবস্থাও হবে।”
” তারমানে বাইরে মঞ্চনাট্য ভিতরে এসব চলে চন্দ্রকুঠির।”
” হ্যাঁ।”
” আমি তো শুনেছিলাম ওটা জমিদার বাড়ি ছিলো। তোমার দাদু রসিদ তালুকদার ওখানে গরিব অসহয় মানুষদের থাকতে দেন। তারা মঞ্চনাট্য করে নিজেদের খাদ্য, বস্ত্রের যোগান দেন।”
” এটা তো সবাই জানে। কিন্তু ভিতরের কথা যারা জানে তারা সৌভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয়। এই যে দেখছো এত সুন্দর গ্রাম, গ্রামের প্রবেশদ্বার এত সুন্দর, এগুলো কি এমনি এমনি নাকি?”
” এগুলো কিসের জন্য।”
” সবি উপরে ফিটফাট নিচে সদরঘাট এর মতো। বুঝলে না তো?”
” কিছুটা বুঝেছি।”
রিয়াদ ভাবনায় পড়ে গেলো। রিয়াদকে ভাবনায় পড়তে দেখে রাতুল বললো, ” কি ভাবছো? তোমাকে এত সহজে এতকিছু কেন বললাম?”
” হ্যাঁ। আমি তো এখন সবকিছু সবাইকে জানাতেই পারি। যদি জানিয়ে দি তো?”
” কিচ্ছু করতে পারবে না। কেন পারবে না সেটা অজানা থাক? আর শোন ভিতরের এই ব্যবসাকে চালাতে হলে কাস্টমার দরকার। তাই লোকদের তো জানাতেই হতো এই ব্যবসার কথা। যদি মুখ খুললেই ধরা পড়ে যেতো তাহলে গত আঠারো বছর ধরে এই ব্যবসা চলতো না।”
” কি বলছো আঠারো বছর ধরে এসব চলছে?”
রিয়াদ অবাক হয়ে বললো। রিয়াদকে অবাক হতে দেখে রাতুল হাসলো তারপর বললো, ” রাতটা চন্দ্রকুঠির ভিতরে থাকতে চাইলে সকালে টাকাটা রেডি রেখো।”
কথাটি বলে রাতুল উঠতে লাগলো। রাতুল চলে যাবে বুঝতে পেরে রিয়াদ বললো, ” এসব কথা মুনকে বলো না। আসলে আমি ওর খুব ভালো বন্ধু, পাশাপাশি ভালো মানুষও।”
রাতুল যেতে যেতে বললো, ” আমরা অকারনে কারো কথা ফাঁস করিনা। আর হ্যাঁ লোকেরা আমাদের কথা কেন গোপন রাখে সেটা তুমি কালকের রাতের পরই বুঝতে পারবে। খুব ভালো করে বুঝতে পারবে। এখন ফাঁস করার চিন্তা মাথায় এলেও পরে এসব চিন্তা থাকবে না।” ( বেড, টেড নিয়ে বেশ বাজে কথা বা ইঙ্গিত করা হয়েছে তার জন্য দুঃখিত। সবাই ক্ষমা করবেন)

রাতুল চলে গেলো। রাতুলের শেষ কথাগুলো শুনে রিয়াদ বেশ অবাক হলো। রিয়াদ কিছুই বুঝলো না।

_______
রাফি রুমে বসে বসে ভাবছিলো মুন ঠিক কি বোঝাতে চাইছে! এভাবে উল্টাপাল্টা কথা বলে কেন চলে গেলো! বারবার কানে ভেসে উঠছে, ” বড় বোনের প্রেমিককে ভালোলাগা খুব বেশি অপরাধের?”
” মানে কি এটার! কি বলতে চাইলো! প্রথমে বললো মাধুরি বিপদে আছে, এরপর বললো…। ঠিক কি বলতে চাইলো।”
রাফি ফোনটা হাতে নিয়ে মাধুরির ছবি দেখতে লাগলো। মাধুরির ছবি দিকে কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে রইলো। রাফির ভাবনাতে আসছে না ঠিক কি হচ্ছে!

অন্যদিকে মুন রুমে বসে ভাবছে, ” কি বলতে গেলাম! আর কি বলে এলাম! আমি কি ভুল পথে হাঁটছি নাকি! আমি সব ঠিক করছি তো। এরকম অদ্ভুত ব্যবহার কেন করলাম? কিসের আশায়?”

চলবে,

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১০)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

সকালে,,
রিয়াদ টাকা নিয়ে রাতুলের রুমে গেলো। রিয়াদকে দেখে রাতুল বসতে বললো।
রিয়াদ বললো, ” ভাই টাকা….”
রিয়াদের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে রাতুল তার বউয়ের উদ্দেশ্য বললো, ” নিচে গিয়ে মাকে কাজে সাহায্য করো।”
রুপা(রাতুলের বউ) বললো, ” কিন্তু আপনি তো….”
” কথা কানে যায়নি।”
রুপা চুপচাপ চলে গেলো। রুপার চলে যাওয়ার দিকে এক পলক তাকালো রিয়াদ।
” টাকা এনেছো?”
” হ্যাঁ।”
” দেও।”
রিয়াদ রাতুলকে টাকাটা দিলো। রাতুল টাকাটা নিয়ে আলমারি থেকে একটা সবুজ কার্ড বের করে রিয়াদকে দিলো। তারপর বললো, ” খুব সাবধানে এই কার্ডটি দেখাবে। তারপর বাকি কাজ চন্দ্রকুঠির লোকেরাই করে দিবে।”
” আচ্ছা।”
” হুম।”
রিয়াদ কার্ডটি নিয়ে চলে গেলো। কার্ডটি পেয়ে গেছে এটা ভেবে মনেমনে খুব খুশি হলো। যাক অন্তত ‘চন্দ্রকুঠির’ ভিতরে কি হয় সেটা তো জানা গেলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো চন্দ্রকুঠিতে এসব কিভাবে শুরু হলো আর তালুকদার বাড়ির লোকেরা এরসাথে যুক্তই বা কিভাবে হলো? প্রশ্ন অনেক উত্তর নেই।

অন্যদিকে মুন রাফিকে নিয়ে গ্রামটি ঘুরে দেখতে বের হলো। রাফি আর মুন পাশাপাশি হাঁটছে। দু’জনেই নিরব। নিরবতা ভেঙে রাফিই বললো,” কাল মাধুরির বিপদ নিয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলে?”
মুন খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, ” যে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনে তার সম্পর্কে কি আর বলবো?”
” মানে?”
” এই যে আপু তোমার মতো একজনকে ছেড়ে অন্যকারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে। এটাই তো ওর জন্য বিপদ। আজ না বুঝলেও একদিন বুঝবে।”
” ওহ। এটাই বলতে চাইছিলে কাল?”
” হ্যাঁ।”
” যাই হোক এসব কথা বাদ দেও। এসব নিয়ে যত ভাববো ততই কষ্ট বাড়বে বই কমবে না।”
” হুম। তা চাকরিতে যোগ দিবে কবে?”
” এই তো দুই একদিনের মধ্যে।”
” ওহ৷ আচ্ছা আমি শুনেছি তোমার বাবাও নাকি জেলার ছিলো?”
” হুম। এখানকারই।”
” ওহ। তার চাকরিটাই তুমি পেয়েছো নাকি?”
রাফি কিছুটা চমকালো তারপর বললো, ” মানে? এরকম হয় নাকি।”
” হয় না বলছো। তাহলে এত ছোট বয়সেই তুমি এক ধাপে জেলার হয়ে গেলে?”
” না৷ তেমন নয়। এটা পেতে অবশ্যই আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে, যোগ্যতার প্রমান দিতে হয়েছে। তারপর না পেলাম।”
” হুম বুঝলাম।”
হঠাৎ করে এমন সময় কোথা থেকে জেনো রিয়াদ এসে পড়লো।
” আমাকে ছাড়াই ঘুরছো তোমরা?”

রাফি রিয়াদকে দেখে বললো, ” তোমাকে ছাড়া আর ঘুরতে দিলে কোথায়?”
” তাও অবশ্য ঠিক। চলে এলাম।”
” যাই হোক তোমরা এদিকটা ঘুরে দেখো আমি পাশের দোকান থেকে কিছু নিয়ে আসছি।”
” আচ্ছা।”
রাফি চলে গেলো। রিয়াদ মুনের উদ্দেশ্য বললো, ” আমরা এখানে কেন এসেছি সেটা বোধহয় তুমি ভুলে গিয়েছো?”
” তুমি?” ভ্রু কুচকে
পরক্ষনেই বললো, ” দেখুন আমি সেসব ভুলি নি। তবে ভুলতে চাই।”
” মানে?”
” আমার মনে হচ্ছে আমরা মরিচিকার পিছনে ছুটে চলেছি। আমি আর এসবের পিছনে ছুটতে চাইছি না।”
” কি? তোমার ঠিক কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছো কেন?”
” কিভাবে কথা বলছি?”
” তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কি বলছো? কালকেও তো সব ঠিকই ছিলো তাহলে হঠাৎ সুর বদলাচ্ছো কেন?”
” দেখুন কালকে ভিডিও দেখে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আপু নিজ ইচ্ছায় কারো সাথে চলে গেছে। তাই আমি আর আপুকে নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি না।”
” তো কি নিয়ে ভাবতে চাচ্ছো?”
” রাফিকে নিয়ে।”
” কি?”
রিয়াদ বেশ চমকালো। রিয়াদ এটাই বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে মুনের হলো কি! ওদের প্লান অনুযায়ী ওরা তালুকদার বাড়ি ডুকলো তারপর হঠাৎ কি হলো যে মুন এরকম করছে!
” রাফিকে নিয়ে মানে?”
” আমার রাফিকে খুব ভালো লাগে। আমি রাফির জীবনে আপু শূন্যতা পূরণ করতে চাই।”
” মানে? রাফি ভাইয়া থেকে সোজা রাফি, তারপর এসব কি বলছো?”
” যা শুনছেন তাই বলছি। রাফিকে আমার চাই।”
” রাফিকে চাইলেই বুঝি রাফি তোমাকে চাইবে?”
” জানি চাইবে না। কারন রাফি আপুকে ভালোবাসে কিন্তু সমস্যা কি আমি অপেক্ষা করবো। রাফির আপুকে ভুলে যাওয়ার অপেক্ষা।”
” আমার মনে হচ্ছে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
রিয়াদ বেশ রেগে কথাটি বললো। মুন রিয়াদের রাগকে পাত্তা না দিয়ে বললো, ” বেশ তো। তুমি বলতে অনুমতি নেন না, আপনি বলতেও না।”
রিয়াদ রেগে কিছু বলতে যাবে তখনি রাফি চলে এলো। রাফি এসে বললো, ” কি হলো তোমাদের মুখগুলো এরকম করে আছো কেন?”
” না কিছু না। আমি বাসায় যাচ্ছি তোমরা থাকো।”
কথাটি বলে রিয়াদ বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলো। পিছু পিছু মুন ও রাফিও আসছিলো। রাফি রিয়াদের ব্যপারটা বুঝতে পারলো না। ঐদিকে রিয়াদ মুনের ব্যপার বুঝতে পারছে না। এক রাতের মাঝে এতটা বদল কিভাবে সম্ভব! কি হচ্ছে এসব!

_________

সন্ধ্যার দিকে রিয়াদ ‘চন্দ্রকুঠির’ উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলো। এমন সময় লক্ষ্য করলো মুন এবং রাফি পুকুরপাড়ে বসে গল্প করছে। মুন বারবার কথার তালে তালে রাফির হাত ধরছিলো। রাফি কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছিলো। তবুও মুনকে কিছু বললো না। রিয়াদ মুনের এই অস্বাভাবিক আচরণ দেখে মুচকি হাঁসি দিয়ে ওখান থেকে চলে এলো।
চন্দ্রকুঠির ভিতরে ডুকলো রিয়াদ। রিয়াদের হাতে সবুজ কার্ড দেখে একটি লোক এসে ওকে দর্শক সারি থেকে আলাদা একটি সারিতে বসালো। সেদিনের সেই যায়গাটিতেই বসানো হয়েছে। তবে আজকে সাজসজ্জা ভিন্ন। আজকে যায়গাটি দর্শকদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্দার এপাশে মানুষ বসে আছে এটা কেউ বুঝতে পারবে না। রিয়াদ বসা অবস্থায় আশপাশ ভালোভাবে তাকালো। তার পাশে দুই তিনজন বসা। কিছুক্ষনের মাঝে দুই তিনজন থেকে সেটা দশ বারোজন হয়ে গেলো।
কিছুক্ষন বাদে একজন এসে খুব সাবধানে বললো তাদের কি করতে হবে। একজন চলে যাওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট পড় অন্যজন চলে যাবে।

রিয়াদের আগে দুজন সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। এরপর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে রিয়াদ উপরে উঠলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দুজন ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন সবুজ কার্ডটি দেখাতে বললো, অন্যজন ওর বডি চেক করছিলো। সব কিছু মেটার পর একজন তার সাথে যেতে বললো। রিয়াদ লোকটির পিছু পিছু গেলো। লোকটি একটি রুমে নিয়ে গেলো তাকে। রুমে ডুকে রিয়াদ দেখলো সেখানে বেশ কিছু মেয়ে বসা। মেয়েদের মাঝে যিনি প্রধান তিনি বললেন, ” দেখ কাকে পছন্দ?”
রিয়াদ মেয়েগুলোকে ভালোভাবে দেখলো। এদের মাঝে রিয়াদ যাকে খুঁজছে সে নেই। এদের দেখেই বোঝা যায় এরা এই কাজে বেশ চালু। এদের মাঝে কোন দ্বিধাবোধ নেই। অর্থাৎ এরা এখানে বেশ পুরনো মানুষ। নতুন হলে নিশ্চয়ই কিছুটা সংকোচ চোখে ফুটে উঠতো। রিয়াদ একটু ভয়ে ভয়ে বললো, ” ২১-২২ বছরের মধ্যে পাওয়া যাবে না?”
এখানে সবার বয়স আনুমানিক ত্রিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে। সেই অনুমানে মাধুরির বয়স আন্দাজ করে কথাটি বললো রিয়াদ। মহিলাটি একটু ভেবে বললো, ” পকেটে মাল-কড়ি আছে?”
” আছে অল্প কিছু। কিন্তু আমি তো টাকা দিয়েই এখানে আসলাম?”
” সেটাতো বেড অব্দি মেয়ে নেওয়ার জন্য৷ এবার তো দিবি ডিমান্ড অনুযায়ী মেয়ে পাওয়ার জন্য।”
” কত দিতে হবে?”
” দে দশ।”
” আচ্ছা দেখছি আছে কিনা।”
রিয়াদ পকেট থেকে দশ হাজার টাকা বের করে দিলো। আগেই ভেবেছিলো এখানে আসলে আরো টাকার প্রয়োজন হতে পারে। তাই টাকা নিয়েই আসছিলো।
” ওকে মেয়েটার রুমে দিয়ে আয়।”
মহিলাটি একজনকে নির্দেশ দিলো। তারপর রিয়াদকে তার সাথে যেতে বললো। রিয়াদ তার পিছু পিছু যাচ্ছিলো আর মনেমনে বলছিলো, ” আমার ভাবনা মতো হবে তো সবকিছু। এরা আদো মাধুরির কাছে নিয়ে যাচ্ছে তো? যদি অন্যকারো কাছে নিয়ে যায় তো? তাহলে কি হবে?”
কিছুটা ভয় নিয়েই রিয়াদ এগিয়ে যাচ্ছিলো। রিয়াদকে একটি রুমের সামনে এনে লোকটি দাঁড়িয়ে গেলো। বললো,”ভিতরে যান। যদি কোনভাবে বাঁধা দেয় তবে আমাদের ডাকবেন নয়তো থাপ্পড় মেরে বসিয়ে দিবেন। একদম ঠিক হয়ে যাবে।”
কথাটি বলে রিয়াদের ভিতরে যাওয়ার অপেক্ষা করলো লোকটি। রিয়াদ ভিতরে না গেলে এ যাবে না বুঝতে পেরে রিয়াদ ভিতরে গেলো। রিয়াদ ভিতরে গিয়ে দরজাটি বন্ধ করে বিছানার দিকে তাকালো। একটি মেয়ে বেশ জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মেয়েটির মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো না রিয়াদ। কারন মেয়েটি ঘুরে বসে ছিলো। তাই সাইড দেখা যাচ্ছিলো। সাইড দেখে রিয়াদ যতটা আন্দাজ করলে এটা মাধুরিই হতে পারে। কোনকিছু না ভেবেই রিয়াদ বললো, ” মাধুরি।”
মাধুরি ডাকটার সাথে সাথে মেয়েটি রিয়াদের দিকে তাকালো।

অন্যদিকে মুন তালুকদার বাড়িটি ভালোভাবে ঘুরে দেখছিলো। এমন সময় রুপা মুনকে ডাকলো। মুন রুপার সাথে তার রুমে গেলো। রুপা মুনকে বসতে বললো তার পাশে। মুন বসার পর রুপা বললো, ” রাফিকে ভালো লাগে তোমার?”
” হঠাৎ এ প্রশ্ন।”
” না মনে হলো আর কি?”
” ভালো লাগলে কি খুব ভুল হবে।”
” না ভুল হবে না। রাফি ভালো ছেলে। কিন্তু এই পরিবারটা কেমন জানি?”
” কেমন?”
” জানি না। অদ্ভুত।”
” কিছু মনে না করলে জানতে পারি আপনাদের বিয়ে হয়েছে ঠিক কতদিন?”
” সাত বছর।”
” এতদিনে অদ্ভুত মনে হওয়ার মতো কি ঘটেছে আপনার সাথে?”
” কিছুই না। বিয়ের দুই বছর ভালোই কাটছিলো আমাদের। তারপর ছেলে হওয়ার পর জীবনটা কেমন জানি হয়ে গেছে।”
” কেমন?”
” তোমাকে সব বলতে পারবো না। শুধু একটু বলছি রাফির পরিবার সম্পর্কে জেনেই ভালোলাগাটাকে এগিয়ো।”
” আচ্ছা।”
মুন আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তাকে বলতে না রুপা বললো, ” চলো তোমাকে বাড়ির ছাদটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
” আচ্ছা।”
এরপর মুন এবং রুপা বাড়ির ছাঁদে গেলো।
________

পরেরদিন সকালে,
রিয়াদকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেই ঘরটি ধাক্কা দিচ্ছিলো একজন লোক। বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পরও কেউ দরজা খুলছে না দেখে প্রধান মহিলাকে ডেকে আনলো। মহিলাটি দরজা ভাঙার নির্দেশ দিলেন। দরজা ভাঙার নির্দেশ পেয়ে দু’জন দরজাটি ভেঙে ফেললো। ভিতরে ডুকে সবাই অবাক। ঘরের সমস্ত জিনিস ছড়ানো ছেটানো। ফুলদানি ভেঙে কয়েকশো টুকরো হয়েছে আর বিছানার উপর রিয়াদ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। রিয়াদের মাথা রক্ত আর জানালার কাঁচ ভাঙা দেখে মহিলাটি সব বুঝে গেলো। তিনি রিয়াদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বললো এবং ঘর পরিষ্কার করতে বলে চলে গেলেন।

বেশ কিছুক্ষন পর রিয়াদের জ্ঞান ফিরলো। রিয়াদের জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে মহিলাটিকে ডাকা হলো। মহিলাটি রিয়াদকে জিজ্ঞেস করলেন,” রাতে কি হয়েছিলো?”
” জানি না। রুমে ডোকার পর মাথায় একটা আঘাত অনুভব করলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই।”
” আচ্ছা।”

কিছুক্ষন পর রাতুল এসে রিয়াদকে তালুকদার বাড়ি নিয়ে এলো। রাতুল রিয়াদের কাছে ক্ষমা চাইলো এবং বললো আজকে রাতে ওখানে কাটাতে চাইলে কাটাতে পারে। রিয়াদ বললো পরে জানাবে।

চলবে,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন ]

চন্দ্রকুঠি পর্ব-৭+৮

0

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৭)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

‘চন্দ্রকুঠির’ বাহিরে বের হয়ে দু’জনেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মুনের ততটা সমস্যা নাহলেও রিয়াদ ধরা খেতে খেতে বেঁচে গেছিলো।
তখন রিয়াদ নিজের প্লান অনুসারে কাজ করার জন্য এগোতে একটি লোক এসে বললো, ” এখানে তো তিনজন থাকার কথা চারজন কেন?”
লোকটির প্রশ্ন শুনেই রিয়াদ থ মেরে গেলো। ভেবেছিলো ধরা পড়ার আগে কেটে পড়া ভালো। বেঁচে থাকলে আবার আসা যাবে এবং জানা যাবে রহস্যের কথা। লোকটি আরো কিছু বলতে যাবে এর আগে রিয়াদ বললো, ” আসলে পিছন থেকে ভালোভাবে উপভোগ করতে পারছিলাম না তাই এখানে এসে বসলাম। এখানে তো সিট ফাঁকাই ছিলো।”
লোকটি সন্দিহান চোখে রিয়াদের দিকে তাকালো। রিয়াদ সন্দেহ দূর করতে আবার বললো, ” কেন এখানে বসলে কোন সমস্যা আছে?”
” না তেমন কিছু না। এখানে একটু সমস্যা আছে আপনি নিজ সিটে যান।”
রিয়াদ আচ্ছা বলে চলে আসলো। বেশি কথা বাড়ালেই কেস খেতে পারে তাই চুপচাপ চলে গেলো। এরমাঝে মুনও ছবিটি নিয়ে চলে এলো। কোনরকম ছবিটি ভাঁজ করে হাতে নিয়ে, তার উপর ওড়নাটা ফেলে চলে এলো। কিছুক্ষনের মাঝে মঞ্চনাট্য শেষ হয়ে গেলো, ভিরের মাঝ দিয়ে ওরাও বেরিয়ে এলো।
রিয়াদ মুনের হাতের দিকে লক্ষ্য করে বললো, ” হাতের উপর এভাবে ওড়না দিয়েছেন কেন?”
মুন উত্তর না দিয়ে হাত থেকে ছবির ভাজটি বের করলো। রিয়াদ বললো, ” এটা কি?”
ছবির ভাজ মেলে ছবিটি রিয়াদের সামনে তুলে ধরলো। রিয়াদ ছবিটির দিকে তাকিয়ে বললো, ” আপনার শাড়ী পড়া ছবি দেখে আমি কি করবো? যদি দেখাতেই চান তবে একদিন শাড়ী পড়ে সামনে আসলেই তো হয়।”
” ছবিটি ভালোভাবে দেখুন, এটা আমি নই।”
” কি? দেখতে পাচ্ছি আপনার ছবি আর আপনি বলছেন এটা আপনার ছবি নয়।”
সন্দিহান চোখে তাকালো রিয়াদ। মুন রিয়াদের তাকানো অগ্রাহ্য করে বললো, ” ছবিটিতে থাকা মুখটির পাশাপাশি আশ পাশটাও একটু লক্ষ্য করুন। ছবিটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি অনেক আগের ছবি, সেই সাথে ছবিটি যেখান থেকে তোলা হয়েছে সেই যায়গাটি লক্ষ্য করুন। আমরা যে চন্দ্রকুঠি বাড়ি থেকে মাত্র বেরিয়ে এসেছি সেই বাড়ির সামনে বসে তোলা। এবার আপনি বলুন ছবিটি আমি কখন তুললাম?”
রিয়াদ অবাক হয়ে ছবিটির দিকে তাকালো। মুনের বলা কথাগুলো সত্যি। মুন আবার বললো, ” এই ছবিটি আপাত দৃষ্টিতে আমার মনে হলেও ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, ছবিটিতে থাকা মেয়েটির ঠোঁটের নিচে একটি তিল আছে যেটা আমার নেই।”
” বুঝলাম এটা আপনি নন। কিন্তু আপনার মতো দেখতে এ কে?”
” সেটার উত্তর তারাই দিতে পারে যারা আমাকে প্রথম দেখে চমকে গিয়েছে।”
” মানে?”
” হয় রেবেকা, সেই বৃদ্ধ মহিলা কনস্টেবল নয়তো আজকের লোকটি।”
” কি বলছেন আপনি? আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”

তারপর মুন গ্রামের সেই লোকটির কথা মনে করিয়ে দিলো রিয়াদকে। রিয়াদ আর মুন এখন সেই লোকটির বাড়ি খুঁজছি। মুনের ধারনা সত্যি হলে লোকটিই বলতে পারে কে এই মেয়েটি, যাকে মুনের মতো দেখতে। প্রথম দেখায় যে কেউ মুন আর এই মেয়েটি আলাদা করতে অক্ষম হবে।

________

অন্ধকার ঘরে হাঁটু গেড়ে বসে কান্না করছে মাধুরি। এ কোন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে সে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই নাকি। মাধুরির কানে শুধু একটি শব্দই বারবার বেজে চলেছে, ” তোর এই পরিনতির জন্য দায়ী তোর মা। হ্যাঁ তোর মা। তোর মা যদি নিজের অহংকার, সততা বঝায় রাখতে সেদিন আমার মুখে থুথু না ফেলতো তাহলে আজ তুই ভালো থাকতি। তোর জীবন সুন্দর কাটতো।”
মাধুরি মনেমনে ভাবছে, ” যেই মাকে জীবনে কখনো দেখেনি সেই মায়ের জন্য এই যন্ত্রণাময় জীবন।”
পরক্ষনেই আবার বলছে,” লোকটি তো বললো আমার মা সৎ ছিলো। তাহলে নিশ্চয়ই লোকটির খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো। এখানে মায়ের দোষ দিয়ে কি করবো দোষ তো ভাগ্যের! শুধু একটাই আফসোস আমার জন্য রাফি বিপদে পড়ছে। রাফি সুস্থ আছে এই কথাটি জানতে পারলেও শান্তি পেতাম।”
মাধুরির ভাবনাজুরে নানা কথা। গত দু’মাস ধরে সে এখানে বন্দি। সে জানে না এখান থেকে কোনদিন মুক্তি পাবে কিনা! শুধু জানে সে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। এই অন্ধকার থেকে তার নিস্তার নেই।

___________
অবশেষে সেই লোকটির বাড়ি খুঁজে পেতে সফল হলো রিয়াদ এবং মুন। মুন আস্তে করে ডাক দিলো, ” কেউ আছেন বাড়িতে?”
ডাক শুনে ঘর থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এলো। মহিলাটিকে দেখে মনে হলো গৃহবধূ। হয়তো লোকটির ছেলের বউ হবে। কারন লোকটি যে তুলনা বৃদ্ধ সে তুলনা তার বউ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
” কি চাই?”
” মতিন সাহেব আছেন?”
রিয়াদ বললো। লোকটি বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এই নামটিই জানা গেলো। তাদের বর্ননা শুনে একজন মতিন নামটাই বললো। মহিলাটি বললেন, ” জ্বী ভিতরে আছেন। আপনারা কারা?”
” আমরা একটু তার সাথে দেখা করতে চাই।”
” আচ্ছা আসুন।”
মুন আর রিয়াদ ভিতরে প্রবেশ করলো। লোকটি অর্থাৎ মতিন সাহেব বিছানায় শুয়ে আছেন। কারো প্রবেশের আবাস পেয়ে উঠে বসলেন।
” কে এসেছে বৌমা?”
মতিন সাহেবের কথার জবাব দেওয়ার আগে মহিলাটি ঘরের সুইচ অন করে দিলো। মতিন সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” কারা আপনারা? কি চাই?”
মতিন সাহেবের কথার প্রতিত্তোরে মুন মাথা থেকে ওড়নাটা নামিয়ে দিলো। মুন এখনো জানে না মেয়েটি কে! আর তাকে কে কে চেনে! সেই হিসাবে মুনকে দেখে কে বা কারা চমকাবে সেটা সে জানে না, তাই ওড়নাটা ঘোমটা আকারে দিয়ে মুখটা কিছুটা অস্পষ্ট করে রাখলো। মতিন সাহেব মুনকে দেখে এবার চমকালেন না। শান্তভাবে বললো, ” কি জানতে চাও?”
মুন মতিন সাহেবের সামনে ছবিটি রাখলো। ছবিটি দেখে মতিন সাহেব কিছুটা চমকালো। মুন মতিন সাহেবের উদ্দেশ্য বললো, ” এই মেয়েটি কে? আপনি নিশ্চয়ই এর জন্য আমাকে দেখে চমকে গেছিলেন?”
” ছবিটি কোথায় পেলে?” মতিন সাহেব
” চন্দ্রকুঠি থেকে।”
” বসো তোমরা। আমি বলছি।”
কথাটি বলে মতিন সাহেব বৌমাকে চেয়ার টেনে দেওয়ার ইশারা করলেন। মহিলাটি ওদের জন্য দুটো চেয়ার এনে দিলো। মুন এবং রিয়াদ বসে পড়লো। মতিন সাহেব বললেন, ” তোমার নাম কি?”
মুনের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করা বুঝতে পেরে মুন বললো, ” মুনতাহার মাহযাবিন।”
” ওহ। ছবিটিতে যাকে দেখছো এর নাম চন্দ্রাবতী। সবাই তাকে চন্দ্র বলে ডাকতো। আমি জানতাম তুমি ঠিক আসবে। তোমার মুখটি কেন চন্দ্রর মতো দেখতে তা আমি জানি না। তবে আমার ধারণা হয়তো তুমি আমার চন্দ্রের মেয়ে তাই ওর মতো দেখতে।”
‘মেয়ে’ শুনে মুন চমকে উঠলো। মুন এই ছবির মেয়েটির মেয়ে। মুন ভাবতে পারছে না। চমকানো মুখেই বললো, ” কিন্তু আমার মায়ের নাম তো চন্দ্রাবতী নয়, আমার মায়ের নাম মেহেরজান।”
মতিন সাহেব বললেন, ” তোমার মা কি বেঁচে আছেন?”
” না। আমি আমার মাকে কখনো দেখেনি।”
” তোমার বাবার নাম কি?”
” আরিফ হাওলাদার।”
” হাওলাদার?”
কথাটি বলে মতিন সাহেব ভ্রু কুচকালেন। তার হিসাব তো মিলছে না। আরিফ নামটি মিললেও হাওলাদার এবং মেহেরজান শব্দ দুটো তার ভাবনাকে মিথ্যে করে দিলো। মতিন সাহেব কিছুক্ষন ভাবলেন। তারপর যা বোঝার বুঝে গেলেন।
রিয়াদ এতক্ষন নিরব ছিলো। এবার সে বললো, ” আচ্ছা মুনের সাথে চন্দ্রের কি সম্পর্কে সেটা নাহয় পরে জানা যাবে, আগে আপনি আমাদের চন্দ্র বলে মানুষটি সম্পর্কে জানান।”
মুনও রিয়াদের কথায় সায় দিলো। মতিন সাহেব ওদের কথা বুঝতে পেরে বললো, ” আচ্ছা বলছি।”
” হ্যাঁ বলুন।”
” তোমরা নিশ্চয়ই ‘চন্দ্রকুঠি’ বাড়িটি দেখেছো। বাড়িটি বিশাল বড়।”
” এই বাড়ির সাথে চন্দ্রাবতীর কি সম্পর্কে?”
মুন প্রশ্নটি করলো। মতিন সাহেব বললেন, ” সম্পর্ক হলো, এই বাড়িটি চন্দ্রর। চন্দ্রর দাদু ছিলেন আগেরকার সময়ের জমিদার। এই বাড়িটিই ছিলো জমিদার মহল। চন্দ্রের দশতম জন্মদিনে এই মহলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় চন্দ্রকুঠি। জন্মদিনের উপহার সরুপ চন্দ্র এই বাড়িটি পেয়েছিলো।”
” একটু পরিষ্কার করে সব বলবেন।”
” হ্যাঁ বলছি।”

” চন্দ্রাবতীর বাবা-মা কেউ ছিলো না। ছোট বেলায় দু’জনেই এক দূর্ঘটনায় মারা যান। চন্দ্রের বাবা-মা না থাকায় তার দাদু তাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। ভালোবাসা সরুপ তিনি তার সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক চন্দ্রের নামে করেন বাকি অর্ধেক তার ছোট ছেলের নামে। সম্পত্তির পাশাপাশি মহলটি চন্দ্রের নামে করে দেন। চন্দ্রের নামের সাথে মিলিয়ে মহলটির নাম রাখা হয় চন্দ্রকুঠি। আমি আর আমার স্ত্রী চন্দ্র এবং ময়নামতি(চন্দ্রাবতীর ছোট কাকার মেয়ে) দেখাশোনার দায়িত্ব ছিলাম। কারন ময়নার বাবা-মা বিভিন্ন কাজে বেশিরভাগ সময় বাহিরেই কাটাতেন। চন্দ্রকুঠি নামটি রাখারা দুই বছর পর চন্দ্রের দাদু মারা যান। তারপর চন্দ্র যখন ষোলো বছরের কিশোরি তখন তার বিয়ে হয়।”
এটুকু বলে মতিন সাহেব থামলেন। মুন বললো, ” এত অল্প বয়সে বিয়ে?”
” তখনকার সময়ে এটাই অনেক বেশি বয়স ছিলো।”
” আচ্ছা তারপর কি হলো চন্দ্রের?”
” বিয়ের পর চন্দ্র খুব সুখীই ছিলো। সে তার সুখের গল্প আমাদের সাথে করতো। জেনে রাখা ভালো বিয়ের পরও চন্দ্র চন্দ্রকুঠিতেই থাকতো। এই নিয়ে তার শশুড়বাড়িতে কোন ঝামেলা হয়নি। বরং শশুড়বাড়ির লোকেরাও এখানে এসে থাকতো। তারপর হঠাৎ একদিন সব বদলে যায়। আমি আজো বিশ্বাস করতে পারছি না এসব সত্যি।”
কথাটি বলে মতিন সাহেব কেঁদে দিলেন। মুন এবং রিয়াদ চমকালো। কি এমন ঘটেছিলো যা ভাবতেই মতিন সাহেব কেঁদে দিলেন! মতিন সাহেব আবার বলতে লাগলেন, ” তখন চন্দ্র তিন মাসের গর্ভবতী ছিলো। আমি বাজারে গেছিলাম। বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি চন্দ্রের হাতে হাত-কড়া। পুলিশ ওকে নিয়ে যাচ্ছে। চন্দ্র বারবার বলছিলো আমি কিছু করিনি। তবুও পুলিশ ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। ”
মুন বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো, ” পুলিশ? পুলিশ কেন নিয়ে গেছিলো? কি করেছিলো চন্দ্র?”
মতিন সাহেব বললেন, ” চন্দ্রর দিক থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম, ময়নামতি, ময়নামতির স্বামী, ময়নামতির বাবা মানে ছোট সাহেব সকলের লাশ পড়ে আছে। তারপর জানতে পারলাম এদের খু**ন করার জন্যই চন্দ্রকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
” কি?”
মনু এবং রিয়াদ দুজনেই বলে উঠলো।
মতিন সাহেব আবারো বললেন, ” আজো জানি না সত্যি ওখানে কি ঘটেছিলো? আদালতে চন্দ্র দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তবে মৃত্যুদন্ড বাচ্চা প্রসব করার পর কার্যকারী হবে এরকম ই শুনেছিলাম। তবে জানি না চন্দ্রের জন্ম দেওয়া সেই বাচ্চাটি কোথায় আছে? আরিফ তালুকদারই বা কোথায় গেলো?”
মুন বললো, ” আরিফ তালুকদার?”
” হ্যাঁ চন্দ্রের স্বামী। তার এবং তার পরিবারের স্বীকারোক্তিতেই চন্দ্র দোষী প্রমাণিত হয়। আমি আজও জানি না চন্দ্র কেন খু**নগুলো করেছিলো? চন্দ্রকে খুনি ভাবতেও পারছি না অন্যদিকে আরিফ মিথ্যে বলবে চন্দ্রর ব্যপারে এটাও মানতে পারছি না। কারন আর কেউ জানুক আর না জানুক আমরা(ওনার স্ত্রী আর ওনি) জানতাম আরিফ চন্দ্রকে ঠিক কতটা ভালোবাসতো।”

মুন বললো, ” খুব ভালোবাসতো কি?”
মতিন সাহেব বললেন,” ভালোবাসার সংঙ্গা অনেক ধরনের হয়। সেসব সংঙ্গাকে ছাড়িয়ে যে ভালোবাসা হয় সেটাই আরিফ আর চন্দ্রর ভালোবাসা। যার সংঙ্গা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।”

এবার রিয়াদ বললো, ” এখানকার তালুকদার বাড়ির সদস্যরাই কি তারা?”
” হ্যাঁ তারাই।”
মুন কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করলো, ” আচ্ছা চন্দ্রের কি দু’জন সন্তান? মানে সে কারাগারে যাওয়ার আগে তার আরো কোন সন্তান ছিলো?”
” না।”
মুন এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। হিসাব মিলতে গিয়েও মিললো না। মুন এবার আস্তে করে বললো,” আচ্ছা আপনি কি কিছু জানাতে ভুলে গেছেন? মানে সবকিছুই বলেছেন তার মাঝে কিছু কি মিসিং গেছে? হতে পারে ভুলে গেছেন?”
লোকটি ভেবে বললো, ” সেরকম কিছু মনে পড়ছে না রে মা।”
আসলেই কি মতিন সাহেব কিছু ভুলে যাননি নাকি ভুলে গেছেন।

চলবে,

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৮)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

মতিন সাহেবের থেকে চন্দ্রাবতীর কথা শুনে সবাই কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। মুন একধ্যানে ছবির চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রর ছবির দিকে নিক্ষেপ করা মুনের মায়াময় দৃষ্টি দেখে মতিন সাহেব কিছুটা নিশ্চিত হলেন এটা চন্দ্রর ই সন্তান। চন্দ্রর মুখ নিয়ে জন্ম যার , তার সাথে চন্দ্রর সম্পর্ক না থেকে পারে! মুন এবং রিয়াদও কিছুটা ধারণা করলো এটা মুনের ই মা। কিন্তু আরিফ হাওলাদার আর তালুকদার এর রহস্যটা ঠিক কি! ধরে নেওয়া যাক কোন কারনে আরিফ পদবী বদলে নিয়েছে কিন্তু তার মায়ের নাম। এটাও কি বদলানো হয়েছে! কিন্তু কেন! রিয়াদ নিরবতার ভেঙে মুনকে বললো, ” এবার আমাদের করনীয় কি?”
” তালুকদার বাড়ি যাওয়া।”
” কিন্তু সেখানে গিয়ে কি কোন লাভ হবে?”
” হবে। সেখানে গেলেই চন্দ্রকুঠির ভিতরে প্রবেশ করার সেই সবুজ কার্ডটি পাওয়া সম্ভব বলে আমার ধারনা।”
” কেন এরকম মনে হচ্ছে?”
তারপর মুন আস্তে করে তার মাথায় যা যা ঘুরছে সব বললো। যদিও মুনের রিয়াদকেও সন্দেহ হয়। তবুও রিয়াদ ছাড়া এখন ভরসা করার মতো কেউ নেই। কিছু একটা ভেবে রিয়াদ বললো, ” কিন্তু আপনি ওখানে যাবেন কিভাবে? আপনাকে দেখে যদি সবাই চন্দ্র ভাবে তো?”
রিয়াদের কথায় মুন কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। এরকম সময় আশার আলো হয়ে রহিমা ফোন করলো। এখানের আসার অনেক আগেই মুন রহিমার সাথে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে নিয়েছে। মুন ফোনটি রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই রহিমা বললো, ” একটা খবর জানানোর জন্য ফোন করা?
” কি খবর?”
” রাফির খোঁজ পাওয়া গেছে। রাফি তাদের বাড়িতে। রাফির বাবা মাত্র জানালো।”
” রাফি ভাইয়ার সাথে কথা হয়নি?”
” না। তার সাথে কথা হলে তো মাধুরি ব্যপারে খোঁজ নিতাম।”
” তা রাফি ভাইয়ার বাবা কি কি বললেন?”
” বললো রাফি অসুস্থ। সুস্থ হলে রাফি ফিরে যাবে।”
” ওহ আচ্ছা।”
” আরো একটা কথা?”
” হুম বলুন।”
” রাফির পরিবার কিন্তু তার নিখোঁজ হওয়ার কোন কথাই বলেননি। তাদের মতে রাফি এতদিন ছুটিতে ছিলো যেটা আজিজ স্যার জানতো।”
” ছুটিতে ছিলো?”
” হ্যাঁ তেমনি তো বললো।”
রহিমার সাথে কথা বলা শেষ করে মুন বেশ ভাবনায় পড়লো। রাফিকে বেঁধে রেখে কেউ মাধুরিকে ‘চন্দ্রকুঠি’ ডাকলো। রাফি ফিরে এসেছে, রাফি তালুকদার বাড়ির ছেলে। সবকিছু কেমন ঝট পাকিয়ে যাচ্ছে।
_______

রাফি বাড়ির পাশে এক বাগানে বসে আছে। বাগানের এই নিরিবিলিতে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। আকাশের পানে তাকিয়ে জীবনের হিসাবটা মেলানোর চেষ্টা করে চলেছে রাফি। হঠাৎ চেনা কন্ঠে ডাক শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো রাফি।
” রাফি ভাইয়া।”
ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে মুনকে দেখে কিছুটা চমকালো রাফি। রাফির চমকানো মুখটা আড়াল হলো না মুনের থেকে। রাফি নিজেকে সামলে বললো, ” মুন তুমি এখানে?”
” হুম। কেন আসতে পারি না বুঝি?”
” তা নয় কিন্তু তুমি এখানে কেন এসেছো?”
” আমার বন্ধুর সাথে ঘুরতে এসেছি। আসলে সুযোগ পেলাম তাই কাজে লাগিয়ে নিলাম।”
” মানে? কি সুযোগ?”
” এইতো মাধু আপু নেই, বাবাও তার বন্ধুর বাসায় ঘুরতে গেছে। ভাবলাম এই তো সুযোগ জীবনটাকে নিজের মতো উপভোগ করার। বন্ধু বললো কদমতলী গ্রামটি খুব সুন্দর, সেই সাথে ‘চন্দ্রকুঠির’ মঞ্চনাট্যও খুব বিখ্যাত। তো চল ঘুরে আসি।”
” বারবার বন্ধু বলছো কিন্তু বন্ধুটা ঠিক কে?”
” কেন আমাকে চোখে পড়ছে না?”
একটি গাছের পিছন থেকে রিয়াদ বেরিয়ে এলো। রিয়াদকে দেখে রাফির চেনা চেনা লাগছে তাই বললো, ” আপনি কি এখানে আগেও এসেছেন?”
” হ্যাঁ। আট মাস আগেই তো এলাম। তখন তো আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। মনে নাই আপনার?”
” ঠিক খেয়াল নেই। তবে আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।”
” যাই হোক এবার চিনে নিন। আমি রিয়াদ রায়হান, মুনের বন্ধু।”
” শুধু বন্ধু্?”
রিয়াদ কিছু বলার আগে মুন বলে উঠলো, ” সেসব কথা পরে হবে, এবার বলো আমাদের তোমার বাড়ি নেবে তো?”
” তার আগে বলো তুমি জানলে কি করে আমি এখানে আছি?”
” আসলে আমরা রাত্রী যাপনের জন্য বেশ চিন্তিত ছিলাম, এমন সময় একটি বাচ্চার সাথে দেখা। সেই তো আমার ফোনে তোমার আর আপুর ছবি দেখে তোমাকে চিনে ফেললো। তার থেকেই এই অব্দি এসেছি আমরা।”
” কিন্তু সেই বাচ্চাটি কে?”
” জানি না। তবে বললো তুমি তাকে চেনো। নাম বললেই চিনবে। তার নাম রবি।”
” রবি? মানে আমাদের রবি।”
” তোমাদের রবি বলতে?”
” আমার ভাইয়ের ছেলে।”
” ওহ। তা আমাদের যায়গা হবে তোমার বাড়ি?”
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
রিয়াদ বললো, ” তা কি পরিচয়ে নিবে?”
মুন ঝটপট বলে উঠলো, ” কি পরিচয়ে আবার? তার হবু শালিকা আমি, সেটা বলেই নিবে।”
মুন এবং রিয়াদকে অবাক করে দিয়ে রাফি হেঁসে উঠলো এবং বললো, ” সেটা আর হওয়ার নয়।”
” কেন হওয়ার নয়?” রিয়াদ বললো
” কারন মাধুরি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। মুন তুমি হয়তো ভাবছো তোমার বোন আমার সাথে এসেছে কিন্তু এটা সত্যি নয়।”
মুন বেশ চমকে বললো, ” মানে?”
এরপর রাফি যা দেখালো তা দেখে মুন এবং রিয়াদ দু’জনেই বেশ অবাক হলো। রাফির ফোনে মাধুরির একটি ভিডিও। যাতে মাধুরি এবং একটি ছেলে বেশ হাসি-খুশি মুখে রাফিকে তাদের নতুন সংসারের কথা বলছে। ভিডিওটি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মাধুরি রাফিকে নয় ঐ ছেলেটাকে ভালোবাসে এবং তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে চলেছে। মাধুরি খুব হাসি মুখেই রাফিকে তাদের বিয়ের বর্ননা দিচ্ছে।
ভিডিওটি দেখা শেষে রাফি বললো, ” আমি জানি তোমরা আমাকে খুঁজতেই এখানে এসেছো। তোমাদের মতে আমি আর মাধুরি সংসার করছি হয়তো কিন্তু এটা যে সত্যি নয় তা তো দেখতেই পেলে। আমি এক ব্যর্থ প্রেমিক। যার ভালোবাসাটা এতটাই ঠুনকো ছিলো যে প্রিয় মানুষটি অন্যকারো বুকে ভালোবাসা খুঁজে নিয়েছে।”
কথাটি বলার সাথে সাথে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাফির চোখ থেকে। অন্যদিকে মুনের হিসাব আবার তাল-গোল পাকিয়ে গেলো।
রাফি নিজেকে সামলে বললো, ” যাই হোক আমার বাসায় তোমরা বেড়াতে যেতেই পারো। আর চিন্তা করো না বাসায় বলবো তোমরা দু’জনই আমার বন্ধু।”
রিয়াদ বললো, ” গ্রামে ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক কেউ নিবে?”
” আমার পরিবার নেবে। আমাদের পরিবার তেমন নয়। তারা জানেন শহরের ছেলে-মেয়েদের বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই।”
” তাহলে যাওয়াই যায়।”
এবার মুন বললো, ” আমরা কিন্তু বেশ কিছুদিন থাকবো। গ্রামের সৌন্দর্য, মঞ্চনাট্য সব দেখে তারপর যাবো। আর আপুর সম্পর্কেও আপনাকে কিছু বলার আছে ভাইয়া।”
” আচ্ছা তাহলে চলো। আমাদের বাড়ি এখান থেকে কাছেই। মাত্র দু’ মিনিট লাগবে।”
” হুম চলুন।”
_________

আরিফ সাহেব খাবারের সামনে বসে আছেন কিন্তু খাচ্ছেন না। খেতে ইচ্ছে করছে না। গত আঠারো বছরে খুব কম দিন এমন গেছে যেদিন তিনি তার মেয়েদের ছাড়া একা খেয়েছেন। মেয়েরা তো তার হাতে খাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যেই বায়না ধরতো। কত সুন্দর ছিলো সেসব দিন। কতই না রঙীন। দিনগুলো হয়তো আর ফিরে পাওয়া হবে না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মাধুরি আর মুনের সেই হাসিমুখ, যে মুখের দিকে তাকিয়ে আরিফ সাহেব হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারেন।
আরিফ সাহেব মনেমনে হেঁসে উঠলেন মেয়েদের ছেলেবেলার কথা মনে করে। তখনি আরিফ সাহেবের বন্ধু সেখানে উপস্থিত হলেন। আরিফ সাহেবকে হাসতে দেখে তিনিও খুশি হলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন হয়তো পুরনো স্মৃতি মনে করেই আরিফ সাহেব হাঁসছেন। তবুও তিনি খুশি।
“বাস্তবে না হোক কল্পনাতে তো সুখী। মাঝেমাঝে কল্পনায় সুখী হতেও ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে।”
________
রিয়াদ এবং মুন দাঁড়িয়ে আছে তালুকদার বাড়ির প্রবেশ দরজায়। বাড়ির ভিতরে পা রাখার আগে মনেমনে একবার ভেবে নিলো কি কি বলতে হবে এবং কি কি করতে হবে! মুন এবং রিয়াদ ভিতরে ডুকতেই রাফির দাদু, বাবা, কাকা, কাকিমা এবং ভাবীকে দেখতে পেলো। তারা সবাই বসার ঘরেই বসে ছিলেন। তারা মুনকে দেখে কিছুটা যে চমকাচ্ছেন তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রাফি সবার কৌতূহল মেটাতে বললো, ” এরা আমার বন্ধু। গ্রাম দেখতে এসেছে। কিছুদিন এখানে কাটাবে।”
তাদের চমকানোটা হয়তো রাফিকে বুঝতে দিতে চাননি তাই রাফির বাবা বললেন, ” রাফি তুমি উপরে যাও, তোমার মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। তিনি তোমার খোঁজ করছিলেন।”
” হ্যাঁ বাবা। কিন্তু ওদের থাকার….”
রাফিকে কথা বলতে না দিয়ে তিনি বললেন, ” সেটা আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। যেহেতু আমাদের বাড়িতে থাকবে সেহেতু আমাদের ও চিনে রাখা উচিত। তো আমরা পরিচিত হই ততক্ষনে তুমি মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসো।”
রাফি আচ্ছা বলে উপরে চলে গেলো। রাফি সিঁড়িতে উঠতে উঠতে রাফির পরিবার তাদের পরিচয় দিলেন। তাদের সাথে রাফির সম্পর্কে কি সেটা বললেন। এবার রিয়াদ এবং মুনের বলার পালা। রিয়াদ প্রথমে শুরু করলো, ” আমি রিয়াদ এবং ও মনু। আমাদের বাসা….( ওদের বাড়ির আশপাশ থেকে যথেষ্ট দূরের ঠিকানা।)
” তোমরা একে-অপরের কি হও?”
প্রশ্নটি করলেন রাফির দাদু। রিয়াদ কোন রকম সংকোচ ছাড়াই, ” আমরা একই বিল্ডিং এ থাকি। আমাদের মায়েরা একে-অপরের খুব ভালো বন্ধু এবং আমরা একে-অপরের খুব ভালো বন্ধু।”
শুধু রাফির ভাবী ছাড়া সবাই চমকালো। রাফির কাকা মুনের উদ্দেশ্যে বললো, ” তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর।”
মুন বোধহয় এরকম একটি প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সাথে সাথে বললো,” সবি ডাক্তারের কৃপায়।”
” মানে?”
এবার রিয়াদ বললো, ” আসলে ওর মুখে সার্জারী হয়েছিলো তো তাই বললো।”
” সার্জারী হয়েছিলো মানে?”
” আসলে এটা ওর আসল মুখ না। ওর আসল মুখটিও সুন্দর ছিলো তবে এতটা নয়। সে যাই ওর মুখটি বিশ্রিভাবে পুড়ে গেছিলো তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ায় ডাক্তার এই মুখ করে দেয় সার্জারী করে।”
” মানে? এভাবে অন্যমুখ বসিয়ে দিলো? আগের মুখের ছবি ছিলো না সেটা দিয়ে তো আগের মতোই করতে পারতো?”
” আসলে ডাক্তার বিক্রি হয়ে গেছিলো। কোন এক আরিফ নামের লোক টাকা দিয়ে এই মুখটি বসাতে বলেছিলো। কিন্তু কেন তিনি এমন করেছেন সেটা আজও জানি না আমরা!”
কথাটি বলে রিয়াদ একটু দুঃখী দুঃখী মুখ করে ফেললো।
রিয়াদের কথা শুনে রাফির দাদু বললো, ” ওদের ঘর দেখিয়ে দেও।”
মুনদের নিয়ে রাফির ভাবী উপরে গেলো। উপরের শেষের দিকের দুটো রুম ওদেরকে থাকতে দেওয়া হলো। মুন জানে ওরা কথাগুলো ততটা হজম না করলেও কিছুটা যে করবে সেটা নিশ্চিত।

চলবে,,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন।]

চন্দ্রকুঠি পর্ব-৫+৬

0

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৫)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

গাড়ি এসে থামলো কদমতলী ডোকার রাস্তায়। গাড়ি থেকে নেমে রিয়াদ বললো, ” এখান থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামে ডুকতে হবে। আর হ্যা খুব সাবধানে। আমরা শুধুমাত্র গ্রামটি দেখতে এসেছি। মনে থাকবে?”
” হুম মনে থাকবে।”
” গ্রামের ভিতর ডোকার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দেন তো?”
” হ্যা বলুন।”
” আপনারা রাফির বাড়ি খোঁজ নেন নি?”
” আমরা রাফির নাম ছাড়া কিছুই জানতাম না। আর শহরে একটি ফ্লাটে থাকতো সেটা জানতাম। সেখানে গিয়েছিলাম কোন লাভ হয়নি।”
” আপনারা তার কর্মস্থল থেকে খোঁজ নেন নি?”
” কর্মস্থলে গিয়েছিলাম। তাদের মতে রাফি যে নিখোঁজ সেটা তাদের কেউ জানায় নি। যতক্ষন না তারা নিশ্চিত হবে রাফি নিখোঁজ ততক্ষনে তেমন কিছু করতে পারবে না। তবে ব্যবস্থা নিবে বললো। আমরা ঠিকানা চাওয়ায় রহিমা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু আজিজ নামে একজন দিলো না। সে বললো এভাবে যাকে তাকে জেলারের ঠিকানা দেওয়া যায় না। আমরা অনুরোধ করেছিলাম খুব কিন্তু মনে হলো আজিজ ইচ্ছে করে দিতে চাইছে না।”
” ওহ। আপনার জন্য একটি চমক খবর আছে।”
” মানে কিসের চমক?”
” রাফির বাসা কদমতলী।”
” কি?”
মুন সত্যি সত্যি অনেকটা চমকে গেলো। চমকানোর রেশ কাটিয়ে মুন বললো, ” আপনি কি করে জানলেন? কারাগারে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন নাকি?”
” না। সত্যি বলতে আমি এই গ্রামে আগেও একবার এসেছিলাম। তখন রাফির সাথে দেখা হয়েছিলো। আমি যদি ভুল না হই তবে রাফি এখানকার তালুকদার বাড়ির ছেলে।”
” আপনি আগেও এসেছিলেন? কিন্তু কেন?”
” এমনি ঘুরতে এসেছিলাম।”
রিয়াদ মুখে ঘুরতে এসেছে বললেও মুন কথাটা বিশ্বাস করলো না। মুনের কেন জানি না এখন রিয়াদকে সন্দেহ হচ্ছে। রিয়াদের সাথে একা আসাটা ঠিক হলো কিনা তাই ভাবছে। মুনকে ভাবনায় দেখে রিয়াদ বললো, ” কি হলো কি ভাবছেন?”
” কিছু না। চলুন গ্রামে যাওয়া যাক।”
” হুম চলুন।”

রিয়াদ এবং মুন গ্রামে ডোকার রাস্তায় পা রাখলো। দুজনের মাঝে নিরবতা বিরাজমান। নিরবতা ভেঙে রিয়াদ বললো,” আপনার ভয় করছে না?”
” কেন?”
” এই যে একা একটি ছেলের সাথে এতদূর এসেছেন, যদি কিছু করে ফেলি?”
” নিজেকে রক্ষা করতে জানি আমি। আমাকে ছোট ভেবে ভুল করবেন না। আর হ্যাঁ যা হওয়ার হবে। আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তিত নই।”
” তাই।”
” হ্যাঁ।”
রিয়াদ আর কিছু বললো না। দুজনেই আবার চুপ করে গেলো। গ্রামের ভিতর প্রবেশ করলো মুন এবং রিয়াদ।

গ্রামের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো মুন। মানুষের বাড়িতে যেমন সদর দরজার রুপ লাবন্য নানাভাবে সাজানো থাকে, ঠিক সেরকম কদমতলী গ্রামে পা রাখার স্থানটি সাজানো। রাস্তার দু’পাশে দুটো কদম গাছ। কদম গাছের গা বেয়ে লতার মতো পেঁচিয়ে উঠেছে আর এক ফুল গাছ। গাছটির নাম জানা নেই মুনের। তবে খুব সুন্দর ভাবে দু’পাশ একত্র করে উপর থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাছের পাতাগুলো। যেগুলোতে সাদা সাদা ছোট ছোট ফুল দেখা যাচ্ছে। গাছের মাধ্যমেই জানো কদমতলী গ্রামের প্রবেশদ্বার তৈরি করা হয়েছে। হলুদ কদম, সাথে সাদা নাম না জানা ফুলগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এতটাই সুন্দর লাগছে দেখতে যে মুনের ইচ্ছে করছে হারিয়ে যেতে। আচ্ছা গ্রামের নাম কদমতলী তাই কি প্রবেশদ্বারটি এমনভাবে গড়া নাকি প্রবেশদ্বার এমনভাবে গড়া বলে গ্রামের নাম কদমতলী।মুন মুগ্ধতায় হারিয়ে গেলো। (আমার আজাইরা মাথার কিছু কল্পনা, গুছিয়ে তুলে ধরতে পারি নি তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী, সবাই কল্পনায় নিজেদের চাহিদামতো কিছু ভেবে নিয়েন।) রিয়াদ মুনের চোখে মুগ্ধতা দেখে কিছুক্ষন পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো মুনের দিকে। তারপর নিরবতা ভেঙে বললো, ” ভিতরে চলুন মুগ্ধ হওয়ার আরো কারণ খুঁজে পাবেন।”
” মানে?”
” চলুন। গেলেই দেখতে পাবেন।”
মুন আর কথা বাড়ালো না। ভিতরে প্রবেশ করলো। রিয়াদ আর মুন পাশাপাশি হাঁটছিলো। মুন গ্রামের যত ভিতরে প্রবেশ করছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। ওরা যে রাস্তা দিয়ে হাটছিলো, তার দু’পাশেই নানা ধরনের ফুলের গাছ। তার মাঝে কয়েকটি ফলের গাছও রয়েছে। মুন আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে বলেই ফেললো, ” এত সুন্দর গ্রাম আমি আগে কখনো দেখেনি।”
” দেখার চোখ সুন্দর হলে সবকিছুই সুন্দর দেখতে লাগে।”
” তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আসলে গ্রামটি সুন্দর নয়?”
” তা নয়। হ্যাঁ সুন্দর। তারচেয়ে আপনি বেশি সুন্দর।” শেষে বিরবির করে
” কি?”
” কিছু না।”
” আচ্ছা এত সুন্দর গ্রামে আমরা কি সত্যি অস্বাভাবিক কিছু পাবো?”
” জানি না। পেতে হলে যে অনেক পরিশ্রম করতে হবে তা জানি। কেননা আগেরবার এসে খালি হাতে ফেরত গেছিলাম।”
” আগেরবার কি খুঁজতে এসেছিলেন?”
” তেমন কিছু না।”
” আচ্ছা যাই হোক, আগেরবার ‘চন্দ্রকুঠি’ গিয়েছিলেন?”
” না।”
” ওহ।”
” ভিতরে চলুন। আস্তে আস্তে সব জানা যাবে ।”
মুন আবার চুপ করে গেলো। মুগ্ধ নয়নে গ্রামের রাস্তা উপভোগ করছিলো।
_________

অন্যদিকে বারান্দায় বসে খোলা আকাশের নিচে তাকিয়ে আছে আরিফ সাহেব। তার চোখের পাতায় ভেসে উঠলো মেয়েদের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো। বিশেষ করে এই মূহুর্তে ভেসে উঠলো মাধুরির সেই কান্নাময় মুখ।
একদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছিলো মাধুরি। মাধুরির চোখে অশ্রু দেখে বুকটা ধুক করে উঠলো আরিফ সাহেবের। দৌড়ে মেয়ের কাছে গেলেন তিনি এবং বললেন, ” মামনি তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার?”
মাধুরি কাঁদতে কাঁদতেই বললো, ” জানো বাবা সবাই আমার গায়ের রং নিয়ে কথা শোনায়। সবাই বলে আমি কালো, আমাকে কেউ পছন্দ করে না।”

আরিফ সাহেব বেশ চমকে গেলেন। তারপর খুব শান্তভাবে বললেন, ” এজন্য তুমি কাঁদছো?”
” হ্যাঁ। ওর আমাকে খুব বাজে কথা বলেছে।”
” ওরা পঁচা তাই পঁচা কথা বলেছে। ওদের কাজই এটা। তুমি কেন তাদের কথায় কষ্ট পাচ্ছো? তুমি জানো না ভালো মেয়েরা কখনো পঁচা বাচ্চাদের কথায় কাদে না।”
আরিফ সাহেব পরক্ষনেই মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর একটি আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন। খুব শান্তভাবে বললেন, ” দেখো কি দেখতে পাচ্ছো?”
” আমি বাবার কোলে আছি।”
” উহু। বাবার কোলে এক সিগ্ধ মায়ার বসবাস। যার সিগ্ধতায় আয়নাটি মুগ্ধ হয়ে তার প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে তুলেছে।”
” মানে?”
” যারা তোমার গায়ের রং দেখেছে তারা মনের আয়নায় তোমাকে আঁকেনি। যদি আঁকতো তবে দেখতে পেতো শ্যাম বরণ গড়নে ফুটে ওঠা এক মায়াবী মুখের সিগ্ধ হাসির ঝলক। যার মায়াবী মুখে তাকিয়ে আমি হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারি।”
ছোট্ট মাধুরি বাবার সবকথা না বুঝলেও এটুকু বুঝেছে বাবার চোখে সে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। বাবার চোখে সুন্দরী মানে সে সুন্দরী আর কারো কথায় কিছু যায় আসে না তার। বাবা মাধুরির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আজ তুমি না বুঝলেও একদিন বুঝবে। সেদিন দেখবে কেউ না কেউ ঠিক আসবে তোমার মায়ার শহরে।”
তারপর মাধুরি আর বাবার হাসি-খুশিতে কেটে গেলো দিনটি। সেদিন পর মাধুরি তার গায়ের রং নিয়ে কখনো কিছু বলেনি। স্কুলের অনেকে বলতো সে আর মুন আসল বোন নয়। বোন হলে এদের গায়ের রং এত ভিন্নতা কেন! তখন মাধুরি শুধু একটা কথাই বলতো, ” মুন আমার বোন। পৃথিবী মিথ্যে হয়ে গেলেও এটাই সত্যি।”

কারো হাতের ছোঁয়ায় স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলেন আরিফ সাহেব। তাকিয়ে দেখলেন তার বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। বন্ধু খুব চিন্তিতসুরে বললেন, ” তুই জানতি মুন কোন পথে পা বাড়াচ্ছে তবুও তাকে ছাড়াটা কি ঠিক হলো তোর?”
” জানি না। তবে এটুকু জানি মাধুরির দুর্ভোগের কারন মুন। এখন সময় এসেছে মুনের সবকিছু জানার।”
” তুই নিজের মেয়ের এত….”
কথা শেষ করতে না দিয়ে আরিফ সাহেব বললেন, ” মুন আর মাধু দুজনেই আমার মেয়ে। যদি মাধুর জীবনের অন্ধকার মুনের জন্য আসে তবে সেই অন্ধকারে মুনকেও নামতে হবে৷ হয় মুন মাধুকে নিয়ে ফিরবে নয়তো নিজেও হারিয়ে যাবে অন্ধকারে। আমি স্বার্থপরের মতো শুধু মুনকে নিয়ে ভাবতে পারবো না। মুন আমার জীবনে যতটা যায়গা জুড়ে আছে মাধুও ঠিক ততটা যায়গা জুড়ে আছে।”
” তোর মতো করে সবাই ভাবতে পারে না আরিফ। তবে মুন কি পারবে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে?”
” পারবে। মাধু শান্তশিষ্ট, কৌতূহলহীন ওকে বোকা বানানো সহজ কিন্তু মুনকে নয়। তাছাড়া মুন জানে সে তার লক্ষে পৌঁছালে মাধুরিকে ফিরে পাবে।”
” আমি আসা রাখছি দুজনেই ফিরে আসুক।”
” হুম।”

আরিফ সাহেব বলে তো দিলেন মুন পারবে। কিন্তু সত্যি কি পারবে! দ্বিধায় তো আরিফ সাহেব ও আছেন।

_______
রাস্তা পেরিয়ে লোকালয়ে পৌছে মুন আরো অবাক হয়ে গেলো। একটু পর পর এক একটি বাড়ি। এদের মাঝে ‘চন্দ্রকুঠি’ কোনটি সেটিও তো বুঝতে পারছে না। রিয়াদ মুনের ভাব ভঙ্গি বুঝতে পেরে বললো, ” এগুলো নয়। চন্দ্রকুঠি সামনে।”
মুন কিছু বলতে যাবে এমন সময় কে জানো বলে উঠলো, ” কারা তোমরা?”
মুন এবং রিয়াদ পিছনে ঘুরে তাকালো। দেখতে পেলো একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি রিয়াদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকই ছিলো কিন্তু যেই মুনের দিকে তাকালো তখনি চমকে উঠলো। হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো লোকটির৷ মুন এবং রিয়াদ লোকটির অবস্থা দেখে বলে উঠলো, ” কি হয়েছে আপনার?”
লোকটি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো, ” চ চ চন্দ্র….”

চলবে,

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৬)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

রিয়াদ ও মুন দাঁড়িয়ে আছে দু’তলা বিশিষ্ট চন্দ্রকুঠি বাড়ির সামনে। বাড়িটি দেয়াল সম্পূর্ণ সাদা রঙে রাঙানো। সাদা পবিত্রতার প্রতিক। আচ্ছা সেই সাদা রঙের বাড়িতে কি সত্যি অস্বাভাবিক কিছু থাকতে পারে! বাড়িটি খুব সুন্দর। বাড়ির সামনে নানা ধরনের ফুলের গাছ। নানা ধরনের ফুলের মাঝে বাড়িটিকে খুবই সুন্দর লাগছে। বাড়িটির সাজ-সজ্জা দেখে মনে হচ্ছে, সবসময়ের জন্য বোধহয় বাড়িটিকে এভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। বাড়িটির সৌন্দর্য মুনকে কাড়তে পারছে না কারন মুনের চিন্তা-চেতনা জুড়ে শুধু সেই লোকটির কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চারিত হওয়া চন্দ্র শব্দিটি। লোকটি কিছু মূহুর্ত অস্বাভাবিক আচরণ করলেও পরক্ষনে নিজেকে স্বাভাবিক করে মুনের কাছ থেকে চলে গেলো। মুন বারবার পিছু ডাকলো কিন্তু লোকটি সেই ডাককে উপেক্ষা করে চলে গেলো। রিয়াদ আর মুন দুজনেই বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই দারোয়ান সামনে এসে বাঁধা দিয়ে বললো, ” মঞ্চনাট্য তো রাতে হবে আপনারা বিকেল-বেলা ভিতরে ডুকছেন কেন?”
দুজনেই আস্তে করে বলে উঠলো, ” মঞ্চনাট্য?”
” কেন আপনারা জানেন না?”
” না আসলে আমরা তো গ্রাম দেখতে এসেছিলাম, গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করার পথে একজন বললো ‘চন্দ্রকুঠি’ বাড়িটি খুব সুন্দর। তাই দেখতে এলাম। আচ্ছা এখানে কি হয়?”
এক নিঃশ্বাসে চটপট করে মিথ্যে বলতে শুনে রিয়াদ মুনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। চোখের ইশারা বেশ হয়েছে জানান দিলো। মুনও চোখের ইশারা ভাব নিলো। দারোয়ানের কথায় দু’জনের চোখে কথা বলাটা বন্ধ হলো।
” এখানে রাতের বেলা মঞ্চনাট্য হয়। ওপাশে দেখুন। দেখছেন না মানুষের ভির। সবাই মঞ্চনাট্য দেখার জন্য টিকিট সংগ্রহ করছেন। আপনারাও করুন তাহলেই এই বাড়িতে ডুকতে পারবেন।”
” আচ্ছা।”
কথাটি বলে দুজনে টিকিট সংগ্রহ করতে চলে গেলো। সেখান গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হলো। লাইনটি বেশ বড় নাহলেও ছোটও নয়। মুন মনেমনে বললো, ” আসলাম রহস্য খুঁজতে কিন্তু পেলাম মঞ্চনাট্য। ব্যাপারটি ঠিক হজম হচ্ছে না।”

মুন আর রিয়াদ টিকিট কিনে পিছনে ঘুরতেই অবাক। লাইনটি আগের তুলনায় দ্বিগুন হয়ে গেলো। দু’জনেই ভাবলো, ” এখানের মঞ্চনাট্য এত জনপ্রিয়।”
টিকিট নিয়ে দারোয়ানের কাছে গেলে জানতে পারলো সন্ধ্যার পর থেকে সবাইকে টিকিট দেখে ভিতরে ডুকানো হবে।
সন্ধ্যের পর ডুকতে পারবে শুনে মুন আর রিয়াদ গ্রামটি ঘুরে দেখতে বের হলো। সন্ধ্যে হওয়া অব্দি এই করেই সময় কাটাতে চাইছিলো আর কি! গ্রামের পথে শহরের অনেক মানুষকে আসতে দেখে কিছুটা অবাক হলো দু’জন। একে-অপরকে বলে উঠলো, ” মঞ্চনাট্য বেশ জনপ্রিয় বলতেই হবে।”
দু’জনেই কথাটি বলে একে-অপরের মুখোমুখি তাকালো। মুখের দিকে তাকিয়ে হেঁসে দিলো। তখন পাশ থেকে একজন বললো, ” হ মেলা সুনাম আমাদের মঞ্চনাট্যের। তাই তো গ্রামটি এত সুন্দরভাবে সাজানো যাতে সবাই মঞ্চনাট্যের পাশাপাশি গ্রামের সৌন্দর্যও উপভোগ করে। শহরের নামি-দামি মানুষরাও আসে মঞ্চনাট্য দেখতে।”
দু’জনে লোকটির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর আচ্ছা বলে চলে গেলো।
_______
রিয়াদ আর মুন এখন ‘চন্দ্রকুঠি’ বাড়ির ভিতরে। গত দেড় ঘন্টা যাবত বসে আছে। সেরকম অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না। কিছুক্ষন পর মঞ্চনাট্য শুরু হবে। সবাই মঞ্চনাট্যের অপেক্ষা আছে।
সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চনাট্য শুরু হলো। রিয়াদ আর মুন মঞ্চনাট্যের পাশাপাশি সবদিক নজরে রাখছে। এভাবে হলরুমে বসে মঞ্চনাট্য দেখলে তাদের চলবে না তাদের অস্বাভাবিক কিছু খুঁজতে হলে ‘চন্দ্রকুঠি’ ভালোভাবে দেখতে হবে। লোকজনের ভিড় ভালোই জমেছে, দু’জনেই ঠিক করলো সুযোগ বুঝে কেটে পড়বে।
কথা অনুযায়ী রিয়াদ কেটে পড়লো। ধীরে ধীরে সে উপরের দিকে পা বাড়ালো সবার চক্ষুর আড়ালে। একটুপর মুনও একইভাবে উপরে চলে গেলো। উপর তলাটা ভালোভাবে লক্ষ করলো মুন। বাড়ির বাহিরে থেকে ভিতর বোঝা সম্ভব নয়, সেটা আজ বুঝলো মুন। বাহির থেকে যতটা বড় মনে হচ্ছিলো, এখন মনে হচ্ছে সেটা যথেষ্ট ছোট দেখাচ্ছিলো। চোখ দিয়ে অনুমান করে যা মনে হলো তাতে মনে কম করে হলেও দশটা রুম তো হবেই। এতে যে উপর তলা শেষ এমনটা ভাববেন না, কেননা এটা উত্তরদিকের রুম। দক্ষিন দিকে আরো দশটার মতো হবে। এ বাড়িটি যে বানিয়েছে সে নিশ্চয়ই অনেক ধনী ছিলো। রিয়াদ কোনদিকে গেছে তা মুন জানে না। সে উত্তর দিকের পথে হাঁটা দিলো। একে একে প্রতি রুমই উঁকি দিচ্ছিলো। দুটো রুম পেরেবোর পরই মনে হলো পরবর্তী রুমে কেউ বা কারা আছে। কারন কথায়র আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। জানালা দিয়ে উঁকি দিতেও দেখতে পেলো তিন জন মহিলা কথা বলছে। হয়তো এরা ‘চন্দ্রকুঠির’ সদস্য। মুন এদের মাঝে মাধুরি আছে কিনা লক্ষ্য করলো। কিন্তু মাধুরিকে দেখতে পেলো না। এক পা দু পা করে সামনে এগোচ্ছিলো মুন সামনের রুমের জানালায় উঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। তবে কারো গোঙানোর আওয়াজ পাচ্ছিলো। কেউ হয়তো আছে কিন্তু রুমটি অন্ধকার তাই কিছু দেখা যাচ্ছে না ।

মুন একে একে শেষপ্রান্তে চলে এলো। সেখানে এসে রিয়াদকে দেখতে পেলো। মুন রিয়াদের সামনে গিয়ে বললো, ” আপনিও এদিকে এসেছেন? তা কিছু পেয়েছেন?”
” না। সবকিছুই তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।”
” কিভাবে স্বাভাবিক লাগলো? বেশির ভাগ রুমই আর সেসব রুম থেকে গোঙানির আওয়াজ আসছে, এটা স্বাভাবিক কিভাবে?”
” সেটা আমিও লক্ষ্য করেছি কিন্তু আমার তো তেমন অস্বাভাবিক মনে হলো না। হতে পারে ঐ রুমগুলোতে বাকিরা ঘুমাচ্ছে। এখানে তো অনেক লোক, সবাই তো একদিনে মঞ্চনাট্য করে না। শুনলেন না একেকদিন একেক দলের কাজ। কাল যারা করেছে তারা আজ ঘুমাচ্ছে।”

মুন মনেমনে ভাবলো, ” সত্যি কি সব স্বাভাবিক? তাহলে আপুর ফোনে আসা মেসেজটির মানে কি? কেন এই বাড়িতে ডাকলো আপুকে?”
রিয়াদের কথায় ভাবনা থেকে বের হলো মুন।
” চলুন দক্ষিন দিকটা দেখে আসি।”
” হুম চলুন।”

মুন আর রিয়াদ ফেরার জন্য উল্টো ঘুরতেই দেখতে পেলো একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটি বললো, ” তোমরা উপরে এলে কেন? তোমাদের উপরে আসতে দিলো কে?”
” না মানে আসলে….”
মহিলাটি আবার বললো, ” কোন সিড়ি দিয়ে এসেছো?”
মুন আর রিয়াদ একটু ভাবলো। পরক্ষনেই মনে পড়লো ওরা যেদিক থেকে এসেছে তার উল্টো দিকের সিঁড়ি দিয়ে অনেকেই উপরে আসছিলো। তাই কোন কিছু না ভেবে সেটা বললো। মহিলাটি সেসব শুনে বললো, ” তাহলে এদিকে কি করছো তোমরা? তোমাদের তো দক্ষিন দিকে থাকার কথা?”
” আসলে আমরা… ”
এবারো মহিলাটি বললো, ” ভালো ঘর খুঁজছিলে?”
” হ্যাঁ।”
কোনকিছু না ভেবে হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলালো। মহিলাটি এবার বললো, ” এখানের বেশিরভাগ রুম বুক, আপনারা দক্ষিন দিকে যান, ওখান থেকেই বেছে নিতে হবে।”
মুন আর রিয়াদ কোনমতে আচ্ছা বলে সেদিকে পা দিলো। মহিলাটির কথা কিছুই বুঝলো না দু’জনে। তবে এটুকু বুঝেছে এখানে সত্যি গন্ডগোল আছে। খালি চোখে এখানে মঞ্চনাট্য হলেও বাস্তবে অন্যকিছু হয়। মুন আর রিয়াদ ধীরে ধীরে দক্ষিন দিকে যাচ্ছিলো। একটা রুম পের হয়েই থমকে দাড়ালো। এখান থেকে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, ওপাশের সিঁড়ি দিয়ে যারা উঠছে তাদের সবার হাত থেকে দুজন লোক সবুজ রঙের কিছু একটা নিচ্ছে। সেটা ভালোভাবে দেখে তাদেরকে ডুকতে দিচ্ছে এদিকটায়। রিয়াদ আস্তে করে বললো, ” ওদিকটা যাওয়া ঠিক হবে না। ঐ মহিলাটি একা ছিলো বলে হয়তো বেশি ঘাটায় নি আমাদের নিয়ে। তবে এখানে যাওয়ার আগে আমাদের জানতে হবে সবুজ রঙের ওটা কি দেখাচ্ছে তারা?”
মুনও আস্তে করে বললো, ” হ্যাঁ। চলুন আগের স্থানে চলে যাই।”
মুন আর রিয়াদ ধীরে ধীরে আগের স্থানে ফিরে এলো। কিছুক্ষনের মধ্যে এক মহিলার কর্কশ কন্ঠ শুনতে পেলো। মহিলাটি বলছে, ” এই সিঁড়িটা বন্ধ করা হয়নি কেন? তোমরা জানো না আজ ওপাশ থেকে কাজ করা হচ্ছে?”
মহিলাটির বলার সাথে সাথে দু’জন ঐ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গেলো। একজন লোক গিয়ে জিজ্ঞেস করলো এখানে পাহারা দেওয়ার কারন কি? তখন মহিলাটি বললো, ” বুঝেন ই তো উপরে মেয়েরা আছে। আপনাদের মাঝে কেউ যদি ভুল করে উপরে চলে যান তাই এই পাহারা আর কি?”
লোকটি স্বাভাবিক ভেবেই চলে এলো। কিন্তু আমাদের নজর ওপর সিঁড়িতে, সেখান থেকে লোকজনের ওঠা-নামা লেগেই আছে। তবে সবার ভিতরে একটা জিনিসের খুব মিল, একজন যাওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট পর অন্যজন যাচ্ছে। কেউ একধ্যানে লক্ষ্য না করলে বোঝা যাবে না দর্শকের সারি থেকেই একে একে অনেকে উপরে উঠছে।
মুন আর রিয়াদ দর্শকদের দিকে তাকালো, দেখলো সবাই মঞ্চনাট্য উপভোগ করছে। অন্যকোন দিকে তাকানোর কোন চিন্তা-ভাবনা নেই তাদের। এজন্য এই ব্যপারটা কারো নজরে পড়ছে না। দু একজনের নজরে পড়লেও তারা একজন একজনার বেশি কাউকে উঠতে দেখেনি তাই বেশি মাথা ঘামাচ্ছে না।

মুন আর রিয়াদ আবার চেয়ার ছেড়ে উঠলো। এবার নিচতলার রুমগুলো লক্ষ্য করছে৷ নিচ তলায় অস্বাভাবিক কিছুই নেই, শুধু প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর একের পর একজন উপরে উঠে যাওয়া ছাড়া। মুন রিয়াদের কাছে আস্তে করে বললো, ” বাড়ির ভিতর প্রবেশ করার আগে বাড়ির পিছনের দিকে একটি রুম দেখলাম চলুন সেদিকে যাই।”
” আপনি সেদিকে যান, আমি একটু ওপাশে যাই। জানার চেষ্টা করি ওনাদের হাতে সবুজ রঙের জিনিসটি কি?”
মুন আচ্ছা বলে ধীরে ধীরে বাহিরে চলে আসে। রিয়াদ যেখান থেকে লোকগুলো উঠে যাচ্ছে সেখানের একটি ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়লো। বলে রাখা ভালো যেখান থেকে লোকগুলো উঠে যাচ্ছে সেখানের এড়িয়াটা একটু আলাদা। দর্শক সারির মধ্যে এখানে আলাদা করে দশ বারোজনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। রিয়াদ পাশে বসতেই সেই কর্কশ মহিলাটি একজন লোকের কাছে আসলো। লোকটি তাকে দেখেই বললো, ” এখানে আলাদা পর্দার ব্যবস্থা করেননি কেন? দর্শক সারি থেকে একজন লক্ষ্য করলেই তো দেখতে পাবে এখান থেকে লোক উঠে চলে যাচ্ছে?”
মহিলাটি নরম গলায় বললো, ” আসলে স্যার আজকে সবকিছুই কেমন গন্ডগোল হচ্ছে? বিকেলের দিকে পর্দা বের করতে গিয়ে দেখি রুমের ভিতর সব জ্বলে যাচ্ছে। যেগুলো ছিলো তা সব মঞ্চ সাজাতে চলে গেছে। আজকে এটা ক্যান্সেল করার কথা ছিলো কিন্তু আপনাদের বারণ করার মতো সময় ছিলো না আজ তাই….”
” থাক আর বলতে হবে না। তোমাদের সব কাজেই কোন না কোন সমস্যা লেগেই আছে।”
” স্যার এরকম ভাবে কেন বলছেন? এর আগে কখনো সমস্যা পেয়েছেন বলুন? আর চিন্তা করবেন না। দর্শকেরা সবাই মঞ্চনাট্য দেখতে ব্যস্ত, কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। আজকের দিনটাই তো, কাল থেকে আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে।”
” আচ্ছা আমি যাবো কখন?”
” আস্তে আস্তে চলে যান স্যার।”
” আচ্ছা।”
মহিলাটি চলে গেলো। যতটুকু বুঝলো রিয়াদ এরা এভাবে খোলামেলা কাউকে উপরে ওঠা-নামার কোন চান্স দেয় না। সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করেই সবার চোখের আড়ালে করে। কিন্তু আজকে ব্যপারটা অন্য! কিন্তু এখানে হচ্ছেটা কি! এখানে কি হচ্ছে এটা বুঝতে হলে কারো থেকে সেই সবুজ রঙের জিনিসটি যোগাড় করতে হবে। রিয়াদ ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো, এখানে সে ছাড়া আরো তিনজন লোক বসে আছে। তারমাঝে যে লোকটি কথা বলছিলো সে উঠে যাচ্ছে। বাকি দুজন। রিয়াদ কিছু দূরে চিকনা করে লোকটিকে এদিকে আসতে দেখে মনেমনে একবার ভেবে নিলো ঠিক কিভাবে কি করবে?

অন্যদিকে মুন সকলের চোখের আড়ালে বাড়ির পিছনের সেই রুমটিতে গেলো। কেন জানি না ওর মনে হচ্ছে এখানে কিছু পেলেও পেতে পারে। রুমটি তালা বদ্ধ। আশেপাশে ভালোভাবে দেখে বুঝে নিলে এদিকটা এখন কেউ আসবে না। তাই একটা রিস্ক নিলো মুন, পাশে থাকা একটা ইট দিয়ে রুমটি তালা ভাঙলো। প্রথমে খুব আস্তে আস্তে বাড়ি দিলেও, কিছুক্ষন পর জোরে জোরে বাড়ি দিলো। সেইসাথে তালাটিও ভেঙে গেলো। দরজা খুলে ভয়ে ভয়ে ডুকলো মুন। রুমটি সম্পূর্ণ অন্ধকার। ফোনের ফ্লাস অন করে ঘরটি দেখে মুন থ হয়ে গেলো। এটা তো পুরনো জিনিসপত্রে ভরা একটি রুম। ভাঙা ফুলদানি থেকে শুরু করে টেবিল চেয়ার সবকিছু। এটাকে ভাঙাচোরা রাখার ঘর বললে বোধহয় মানানসই হবে। মুন ভেবেছিলো এখানে কিছু পেলেও পেতে পারে। কেন জানি না মন বলছিলো। কিন্তু ঘরটি দেখে ধারনা বদলে গেলো মুনের এখানে যে কিছু পাবে না বুঝে গেছে। ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই পায়ের সাথে কিছু একটা বেজে পড়ে গেলো নিচে মুন। সাথে সাথে ভাঙাচোরা জিনিসপত্র মুনের গায়ের উপর পড়লো কিছু। বহু কষ্টে মুন নিজেকে ভাঙাচোরা থেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। ফোনটি নিচে পড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে। মুন ফোনটি খুঁজে হাতে নিলো। ফোন অন করে করতেই ফোনের আলোতে মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো। ছবিটিতে ধুলো জমে ছিলো তাই আবছা দেখাচ্ছিলো। মুন ছবিটা হাতে তুলে নিলো এবং ধুলোগুলো ছাড়াতে লাগলো। ধুলো ছাড়াতেই মুনের চোখের সামনে যা ফুটে উঠলো তা দেখে মুন নিজেই চমকে গেলো। মুখ থেকে অস্পষ্ট সুরে বের হলো, ” অসম্ভব।”

চলবে,

চন্দ্রকুঠি পর্ব-৩+৪

0

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব(৩)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুনের পরিক্ষা আজ শেষ। মুন আজকের দিনের অপেক্ষাই ছিলো এতদিন। আজ পরিক্ষা শেষ হতেই মুন বেরিয়ে পড়লো কারাগারের উদ্দেশ্যে। আজকে কারাগারে গিয়েই প্রথমে রাফির সাথে দেখালো হলো, ” আরো মুন তুমি এখানে?”
” আমি আসলে…”
” তোমার আপু পাঠিয়েছে? কিন্তু আমাদের মধ্যে তো তেমন কিছুই হয়নি তবে তোমাকে পাঠালো কেন?”
” না ভাইয়া। আমাকে আপু পাঠাইনি। আসলে আমি নিজে থেকেই এসেছি।”
” নিজে এসেছো কিন্তু কেন?”
” আসলে আমি একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
” কার সাথে?”
” ভাইয়া আগে দেখা করি তারপর বলি?”
” আচ্ছা। কিন্তু কার সাথে দেখা করবে?”
” রেবেকা।”
” ওনার সাথে তোমার কি কাজ? তুমি কি ওনাকে আগে থেকে চেনো?” চমকে উঠে
” না ভাইয়া। আসলে এমনি বাচ্চাটাকে নিয়ে কথা বলতাম।”
” বাচ্চাটাকে তো অনাথ আশ্রমে দেওয়া হয়েছে, তাকে নিয়ে কি কথা বলবে?”
” আসলে….”
রাফি কিছু একটা ভাবলো। তারপর মুনকে দেখা করতে যেতে বললো। মুন এত সহজে অনুমতি পেয়ে হাঁসি মুখে চলে গেলো। অন্যদিকে রাফি মনেমনে বললো, ” হিসাব তো মিলছে না। মুন কেন একজন অচেনা মানুষের সাথে দেখা করতে এলো।”

অন্যদিকে মুনকে সামনে দেখে রেবেকা কিছুটা মুচকি হাঁসি দিলো। তারপর খুব শান্তভাবে বললো, ” আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। এই ব্যপারটা তোমার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।”
মুনও মুচকি হেঁসে বললো, ” মুনের মাথা থেকে সহজে কোনকিছু যায় না।”
” তাই। তা কিসের জন্য এলে?”
” আপনি কি এমন অপরাধের করেছেন যার শাস্তি পাচ্ছেন?”
” শুধু এটুকুই।”
” হ্যাঁ।”
” আমি তো তোমার কেউ না, তাহলে কিসের টানে এখানে এলে।”
” কারাগারের টানে…” মুখ ফসকে কথাটি বের হয়ে গেলো
” কি?”
” না কিছু না।”
” আচ্ছা।”
” প্লীজ বলুন না কেন এখানে এলেন আপনি? কি করেছিলেন আপনি?”
” সে অনেক বড় কাহিনি। সেটা জেনে তোমার কোন লাভ নেই।”
” আপনি বলতে চাইছেন তাই তো?”
” ধরে নেও তাই।”
” তাহলে আমাকে যে আসতে বললেন?”
” এমনি।”
” আচ্ছা অপরাধ কি সেটা নাহয় না বললেন, বাচ্চাটির বাবা কোথায় তা কি বলা যাবে?”

রেবেকা কিছুটা ব্যঙ্গ হাসলো। তারপর বললো, ” আমি নিজেই জানি না।”
” মানে?” চমকে
” ও আমার এমন এক অন্ধকার জীবনের ফসল, যে জীবনের অতল গভীরে হারিয়ে গেছি আমি। তাই তো শাস্তি পাচ্ছি।”
” আমি কিছু বুঝতে পারছি না, একটু বলবেন?”
” তুমি অনেক ছোট মুন। এসব জানার জন্য তৈরি নও তুমি।”
” আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। যত খারাপ পরিস্থিতিই থাক না কেন আমি ঠিক সামলে নিতে পারবো।”
” তাই।”
” হ্যাঁ।”
” তবে শোন শুধু আমার নয় আমার মতো অনেক মেয়ের জীবনের গল্প আছে সেখানে লুকিয়ে।”
” কোথায়?”
” তা তো বলবো না। তবে জেনে রাখো তোমার মুখখানি একজনের সাথে খুব মিলে। যার জীবনের অন্ধকারও সেখানে লুকানো।”
” মানে? কি বলছেন আপনি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
” দেখো মুন সেদিন আমি হুট করে তোমাকে আসতে বলেছিলাম। বলতে পারো কিছুটা নিজের অজান্তে। তো এখন বলছি এখান থেকে চলে যাও।”
” কিন্তু…”
” কোন কিন্তু নয়। আমাদের মতো কিছু অপরাধীর কথা ভেবে জীবনের আলোময় সময়টাকে নষ্ট করো না।”
” প্লীজ আমার কথা শুনুন….”
” যাও তুমি মুন।”
” প্লীজ আমার….”
” যাও।” ধমক দিয়ে

মুন নিরুপায় হয়ে চলে গেলো। মুন একটা জিনিস ভেবে পেলো না, সেদিন বলবে বলেও আজ না বলে পাঠিয়ে দিলো তাকে। ব্যাপারটা খুব গন্ডগোলের। এসবের মাঝে মুনের মাথায় আরো একটা কথা ঘুরছে, ” আচ্ছা আমি ঠিক কি খুজছি? আমি তো জানিই না কিসের টানে এখানে বারবার আসছি! এই টানটা যে রেবেকার জন্য নয় সেটা আমি নিশ্চিত। হয়তো বাচ্চাটার জন্য। কিন্তু তাও নয়। কারণ বাচ্চাটির মায়ায় পড়লে অবশ্যই এতদিনে বাচ্চাটিকে দেখার জন্য হলেও একবার আশ্রমে খোঁজ নিতাম। তাহলে আমার টানটা ঠিক কিসের প্রতি?”
নিজের মনকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলো মুন। তখনি হঠাৎ মনে হলো সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো। সেদিন রেবেকা বাচ্চাটিকে জন্ম দেওয়া, বাচ্চাটির জন্মের পর কেঁদে ওঠা। ঠিক ঐ মূহুর্তের টানে মুন অজানা গন্তব্য ছুটে চলেছে। যেখানে জানেই না আদো এর কোন গন্তব্য আছে কিনা।
_____

পড়ালেখা, প্রেম, বাবার, বোন সবকিছু নিয়ে ভালোই চলছিলো মাধুরির। ভালো সময় মানুষের জীবনে দীর্ঘক্ষন থাকে না। তাই হয়তো বদলে গেলো মাধুরির জীবন। রাফির ফোন থেকে আশা একটা ভিডিও বদলে দিলো মাধুরির গন্তব্য। ভিডিওটি অন করে মাধুরি একদম অনুভূতি-শূন্য হয়ে পড়লো। ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একটি অন্ধকার ঘরে রাফির হাত-পা বেঁধে রেখেছে কেউ। রাফি শুধু অস্পষ্ট সুরে পানি পানি বলে চিৎকার করছে৷ ভিডিওটি দেখে মাধুরি মেঝেতে বসে পড়লো। এমন সময় ফোনে রাফির নাম্বার থেকে একটি মেসেজ এলো, ” বলেছিলাম তো চলে এসো তোমার বাড়ি৷ এলে না কেন? এখন তার মাসুল দেও। রাফিকে জীবিত চাইলে চলে এসো তোমার বাড়ি।”
মেসেজটি দেখে মাধুরির অন্তর আত্না কেঁপে উঠলো। সেদিনের মেসেজটিকে মজা ভেবে কতবড় ভুল করেছে সে, তা আজ বুঝলো। সে তো ভেবেছিলো কেউ হয়তো তার সাথে মজা করছে কিন্তু এখন ভিডিও মেসেজ দেখে তো মনে হচ্ছে না এটা মজা। মাধুরি কোনকিছু না ভেবে রাফির নাম্বারে কল করলো। প্রথমবার রিং হতেই ফোন ধরলো, ” হ্যালো কে বলছেন? রাফি কোথায়? আপনি কে? কি চান আপনি?”

” আস্তে আস্তে মামুনি। এত প্রশ্ন একসাথে করলে কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবো বলো?”
ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষালি এক কন্ঠ ভেসে আসলো। মাধুরি কিছুটা ভয় পেলো। ভয় মার্জিত কন্ঠেই বললো, ” কেন করছেন এমন?”
” তোমাকে তোমার বাড়ি অব্দি নিয়ে আসার জন্য।”
” আমার বাড়ি? কিন্তু আমি তো আমার বাড়িতেই আছি।”
” বলেছিলাম না ওটা তোমার আসল বাড়ি নয়। আসল বাড়িতে চলে এসো।”
” আসল বাড়ি? সেটা কোথায়?”
” সেটা তো তোমাকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।”
” কিন্তু আমি তো কিছু জানি না।”

লোকটি কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটি কাটার দুই মিনিট পর আরো একটি মেসেজ এলো, ” হাতের ফোনটি ভেঙে ফলো এবং চলে আসো ‘চন্দ্রকুঠি’।”
মেসেজটি পড়ে মাধুরি থ হয়ে গেলো। মনেমনে দু’বার উচ্চারণ করলো ‘চন্দ্রকুঠি’।

মাধুরি রাফিকে খুব ভালোবাসে তাই লোকটির কথা অমান্য করার সাহস হলো না। তাই ঠিক করে নিলো তাকে যেতেই হবে। রাফির জন্য যেতে হবে। কিন্তু বাবা, বোন এদের সামলে যাবে কিভাবে? কিন্তু তাকে তো যেতে হবে। বাবাকে বললে বাবা তাকে ছাড়বে না, তাই না বলেই যেতে হবে। মাধুরি ঠিক করে নিলো রাতে বাসা থেকে বের হয়ে যাবে। জানা নেই সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে কিন্তু তাকে যেতেই হবে। তবে কিছু একটা ভেবে মাধুরি ফোনটি না ভেঙে বন্ধ করে দিলো এবং ফোনটি ঐ ঘরেই লুকিয়ে রাখলো। বেঁচে না ফিরতে পারলেও কোন একদিন হয়তো বাবা বা বোন জানতে পারবে কেন সে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেলো।

অন্যদিকে,
মুন অনেক কষ্টে নিজের কৌতূহলী মনকে শান্ত করলো। মনকে বুঝালো মরিচীকার পিছনে ছুটে লাভ নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে।

একজন নিজেকে গুটিয়ে নিলো রহস্য থেকে অন্যজন রহস্যের দিকে পা বাড়াতে লাগলো। কে জানে ভাগ্য তাদের কোথায় নিয়ে যাবে।

রাত ২.৩০,
চোখ মেলে পাশে ঘুমানো মুনের দিকে তাকালো মাধুরি। খুব সাবধানে বোনের কপালে চুমু কাটলো সে। দুই মিনিট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে একমনে বলে উঠলো, ” খুব ভালোবাসি বোন। তুই আর বাবা ছাড়া আমার অস্তিত্ব মূল্যহীন। তাই বলে রাফির অস্তিত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না। রাফির জন্য আমার তোদেরকে একটু কষ্ট দিতে হচ্ছে। আমি চেষ্টা করবো সব বাঁধা পেরিয়ে তোদের কাছে ফিরে আসার।”

খুব সাবধানে রুম থেকে বের হলো মাধুরি। পা টিপে টিপে বাবার রুমে ডুকলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিলো। মনেমনে তাকে সালাম জানিয়ে বললো, ” বাবা তুমি আমার সব। ছোটবেলা থেকে কখনো মায়ের মুখটা অব্দি দেখেনি। আমরা জানি না আমাদের মা দেখতে কেমন। যেদিন মায়ের কথা জিজ্ঞেস করায় তোমার চোখে অশ্রু দেখেছিলাম সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, মায়ের হারিয়ে যাওয়ার যে কারনই হোক না কেন তোমাকে কখনো সে সম্পর্কে প্রশ্ন করবো না। কিন্তু আজ আমি নিরুপায় বাবা। আজ তোমাকে আমার জন্য একটু কাঁদতে হবে। কিন্তু তুমি ভেবো না বাবা, আমি ঠিক ফিরে আসবো।”
মুখে ফিরে আসবো বললেও হৃদয়ের গভীরে প্রশ্নটা থেকেই যায়, মাধুরি কি আর ফিরে আসতে পারবে?

ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো মাধুরি। মেইন রাস্তায় পা রাখতেই কোথা থেকে কালো চাদর মুড়ানো একজন ছুটে এসে মাধুরির হাতে একটি ফোন গুঁজে দিয়ে চলে গেলো। মাধুরি লোকটিকে পিছন থেকে ডাকলো কিন্তু লোকটি এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেলো। তখনি মাধুরির হাতের ফোনটি রিং হলো। ফোনে রাফির নাম্বার দেখে যা বোঝার তা বুঝে গেলো মাধুরি। ফোনটি ধরে, ‘হ্যালো’ বলতেই লোকটি এরপর কোথায় যেতে হবে সেটা বলে দিলো। মাধুরি এগিয়ে যাচ্ছিলো এক অজানা রাস্তায়, যার নাম ‘চন্দ্রকুঠি’।

চলবে,
~~

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৪)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

কেটে গেলো দুই মাস। সেদিন মাধুরি ঘর থেকে বের হওয়ার পর কোথায় গেছে, কার কাছে গেছে, কেউ জানে না। পুলিশও খোঁজ দিতে পারে না। সকলের ধারনা হয়তো কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। মুনের বাবাও তাই মেনে নিয়েছেন। যতদূর জানতো মাধুরির সাথে রাফির সম্পর্ক ছিলো, রাফি যেহেতু নিখোঁজ তাই ভেবে নেওয়া হয়েছে ওরা দুজন পালিয়ে গেছে। কিন্তু মুনের মন মানে না। যেখানে তারা ওদের সম্পর্কের কথা জানে, এটাও জানে মাধুরির পড়ালেখা শেষ হলেই ওদের বিয়ে হবে, সেখানে পালানোর কি প্রয়োজন ছিলো। অন্যদিকে মুনের বাবা ভাবছেন, ” আমাকে বললেই তো হতো, আমি কি মেনে নিতাম না! এখন ফিরে আসলে আমি মেনে নিবো।” তাই তো বারবার মেয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন। মাধুরির চিন্তায় আরিফ সাহেব ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এখন আর আগের মতো মুনের সাথে কথা বলে না। শুধু তাই নয় প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকেই বের হন না৷ বাবার এই কষ্ট মুনের সহ্য হচ্ছে না। মুন বুঝতে পেরেছে বাবার কষ্ট থেকে তাকে মুক্ত করার একটাই উপায় তাহলো মাধুরিকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু মুন মাধুরিকে কোথায় খুঁজবে! মুনেরা রাফির নাম ছাড়া তার বাড়ি, পরিবার সম্পর্কে কিছু জানে না। মাধুরি শুধু বলেছিলো সময় হলে সব জানাবে।

বাবার এই অবস্থা, আপুর নিখোঁজ সবকিছু মুনকে পাগল করে দিয়েছে। মুন কি করে কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। অবশেষে ভাবলো মাধুরি আর ওর রুমটা আরো একবার খুঁজে দেখা উচিত, যদি কিছু পাওয়া যায়। গত দুই মাসে প্রায় অনেকবার খুঁজেছে কিন্তু কিছুই পায়নি, তবুও বারবার বৃথা চেষ্টা করে চলেছে। মুন আরো একবার খোঁজা শুরু করলো কিন্তু এবারো কিছু পেলো না। কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে ভাবছিলো কি করবে তখনি মনে পড়লো, ” আমরা সবসময় আপুর জিনিস-পত্র খুঁজে চলেছি। আচ্ছা এরকম কি কোনভাবে হতে পারে না, আপা হয়তো আমার জিনিস-পত্রে কিছু রেখেছে।”
যেই ভাবা সেই কাজ। মুন এবার মাধুরির জিনিস রেখে নিজের জিনিস খুঁজতে লাগলো। কিছুক্ষন খোঁজা-খুঁজির পরই মুন নিজের ব্যাগে মাধুরির ফোন পেলো। মুন অবাক হয়ে গেলো, সেই সাথে নিজের বোকামির জন্য কষ্টও পেলে। আগে যদি নিজের জিনিস-পত্রও খুঁজতো তবে ফোনটা আগেই পেয়ে যেতো। ফোনটি হাতে নিয়ে দেখে সেটা বন্ধ। পুলিশ আগেই বলেছিলো ফোনের লাস্ট লোকেশন বাড়িতেই ছিলো।

মুন কিছুক্ষন ভেবে-চিন্তে তারপর ফোনটি অন করলো। ফোন করে সবকিছু ঘাটছিলো ঠিক তখনি রাফির কাছ থেকে আসা সেই ভিডিওটি চোখে পড়লো। ভিডিও মেসেজ সবগুলো চেক করে মুন থ হয়ে গেলো। মনেমনে দু’বার উচ্চারণ করলো ‘চন্দ্রকুঠি’।
এবার মুনের কাছে সব পরিষ্কার। মাধুরি বিপদে পড়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে। যে করেই হোক মাধুরিকে খুঁজে বের করতেই হবে। মুন মনেমনে ভাবছিলো, ” আচ্ছা দুই মাস কেটে গেছে, আপুর সাথে কিছু হয়নি তো। না না একদমি না। আমার আপু ঠিক আছে।”
মুন ভেবে নিলো এসব কথা বাবাকে জানানো যাবে না। বাবা জানলে আরো কষ্ট পাবে। এবার মুনকে নিজেকেই কিছু করতে হবে।

__________
থানায় বসে আছে মুন। এতদিন যে অফিসার মুনদের কেসটা দেখছিলো সে নাকি অন্য থানায় বদলি নিয়েছে। এখন নতুন অফিসারের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি দুই মিনিটে চলে আসবে বলে, দুই ঘন্টা ধরে বসিয়ে রেখেছে। অবশেষে সেই মহান অফিসারের আসার সময় হলো। অফিসার আসতেই মুনের কথা বললো একজন। তাই অফিসার সরাসরি মুনের কাছে এলো। পিছন থেকে ডাক দিলো, ” হ্যালো আন্টি।”
মুন চমকে পিছনে তাকালো। মুনকে দেখে অফিসার নিজেই লজ্জা পেলো। মুন যেভাবে বসে ছিলো তাতে পিছন দেখে বোঝার উপায় ছিলো না এ মেয়ে নাকি মহিলা। তাছাড়া লোকটিকে বলা হয়েছিলো ভিক্টিম এর মা এসেছে। মুন কিছু বলতে যাবে তার আগে লোকটি বললো, ” আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না আপনার একটা মেয়েও থাকতে পারে।”
” মানে?”
” মানে আপনার মেয়ে আত্নহত্যা করলো কেন? জানেন কিছু?”
” কিসব বাজে কথা বলছেন।”
অফিসার কিছু বলতে যাবে, তার আগেই একজন এসে বললো, ” সরি স্যার একসাথে দুটো কেস ফাইল ছিলো তাই কি বলতে কি বলে ফেলেছি সব গুলিয়ে গেছে।”
” মানে?” অফিসার
” এই মেয়েটি তার বোনের মিসিং কেসের জন্য এসেছে। আর আত্নহত্যার কেসটি যে নিয়ে এসেছিলো সে… ওখানে বসা আছে৷ ভুলে আমি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছি।”
অফিসার দুই মিনিট মুনের দিকে তাকিয়ে তারপর বললো, ” আচ্ছা ঠিক আছে। ঐ কেসটি শিরিনকে দেখতে বলুন, আমি এটা দেখছি।”
” ওকে স্যার।”
কথাটি বলে লোকটি চলে গেলো। অফিসার মুনের দিকে তাকিয়ে বললো, ” সরি আপনাকে আন্টি বলে সম্মোধন করার জন্য।”
” ঠিক আছে। সমস্যা নেই।”
” আচ্ছা বলুন আপনার কেসটি কি? সম্পূর্ণ ডিটেইলস এ বলুন।”
” হ্যাঁ।”
তারপর মুন একে একে সবকিছু বললো। অফিসার এতক্ষন এক ধ্যানে মুনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মুনের কথা বলা শেষে বললো, ” মোবাইল ফোনটি আমাকে দিন। আর যে ভিডিও এবং মেসেজের কথা বলছে সেগুলো দেখান।”
” জ্বী।”

মুন অফিসারকে দেখালো। অফিসারটি সব দেখে বললো, ” ওকে আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি ‘চন্দ্রকুঠি’ কোথায়।”
” একটা কথা বলতে চাই।”
” হ্যা বলুন।”
” চন্দ্রকুঠির লোকেশন পেয়ে গেলে আমাকে জানবেন এবং আমিও চন্দ্রকুঠি যেতে চাই।”
” এরকম তো কোন নিয়ম নেই?”
” প্লীজ। দেখুন আমার যতটা মনে হচ্ছে তাতে চন্দ্রকুঠি ততটা সহজ যায়গা হবে না আমাদের জন্য। আমার ধারণা এখানে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে।”
” এরকম মনে হওয়ার কারন?”
” আপনি মেসেজটি পড়লে হয়তো দেখবেন ওখানে আপুকে এটা বলা হয়নি রাফিকে বাঁচাতে এই বাড়ি আসো। বরং বারবার বলা হয়েছে তোমার বাড়িতে আসো। কিন্তু আমার প্রশ্ন আমরা তো আমাদের বাড়িতেই ছিলাম তাহলে আপুকে ঐ বাড়িটি তার বলার কারন কি?”
” বুঝলাম। আপনি খুব কৌতূহল প্রবণ মানুষ।”
” আপনি যদি তাই ভাবেন তাহলে তাই। আর যদি ভাবেন আমি আমার আপুকে নিজে বাঁচাতে চাই তবে তাই।”
” নিজে বাঁচাতে চাইলে তবে এখানে আসলেন কেন?”
” একা একা তো আমি সব পারবো না তাই আপনাদের সাহায্য নেওয়া।”
” আচ্ছা। তা আপনার নামটি জানতে পারি মিস?”
” জ্বী মুনতাহা মাহযাবিন।”
” ছোট করে মুন। মানে চাঁদ। সত্যি চাদের মতো সুন্দর তুমি।”
শেষের বাক্যটি আস্তে বললো যা মুন শুনতে পেলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো,” কি?”
” কিছু না। আমি রিয়াদ রায়হান।”
” হুম।”
এরপর মুন রিয়াদের ফোন নাম্বার নিয়ে চলে এলো, সাথে নিজের ফোন নাম্বার ও তাকে দিলো।

একদিন পর,
মুন বাসা থেকে দূরে বাজারে এলো, বাজার করার জন্য। আজকাল বাবা এসব কাজ করেন না। তিনি রুমে বসে একাকি সময় কাটান। বাজার করে বাসার পথে হাঁটা ধরবে এমন সময় রহিমার সাথে দেখা। মুনকে দেখেই রহিমা বললো, ” কি খবর মুন? তোমার আপা বা রাফি স্যারের কোন খোঁজ পেয়েছো?”
” না এখনি পায়নি।”
রহিমা কিছু বলতে যাবে এমন সময় মুনের ফোনে রিয়াদের ফোন এলো। ফোনটি রিসিভ করলো মুন। ওপাশ থেকে কি বললো তা রহিমা শুনতে না পেলেও মুনের কথাটি শুনলো। যা ছিলো, ” চন্দ্রকুঠির লোকেশন পেয়ে গেছেন। আচ্ছা ধন্যবাদ। আমরা তাহলে কবে যাবো?”
রিয়াদের সাথে কথা বলা শেষ হতেই রহিমা বললো, ” তুমি চন্দ্রকুঠি কেন যাবে?”
” আপুর খোঁজ হয়তো ওখানে গেলে পেতে পারি তাই।”
” আচ্ছা মুন আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলবে?”
” কি?”
” রেবেকার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?”
” তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
” তাহলে তুমি চন্দ্রকুঠি কেন যেতে চাইছো?”
” মানে? রেবেকার সাথে চন্দ্রকুঠির কিসের সম্পর্ক?”
” তুমি এই কথাটি জানো না যে রেবেকা চন্দ্রকুঠি থেকেই গ্রেফতার হয়েছিলো। এমনকি ওর আবাসস্থল ঐ চন্দ্রকুঠি।”
” কি?”
মুন অনেকটা চমকে গেলো। মুনের ভাবনায় শুধু একটা কথা তাহলো, ” আমার সেরকমভাবে কখনো রেবেকার জন্য আলাদা কোন আগ্রহ জন্মায় নি। আমার আগ্রহ টান সবকিছু ঘিরে শুধু রেবেকার ঐ অন্ধকার কারাগারে সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টি ছিলো। কিন্তু তাহলে রেবেকার সাথে আমার গন্তব্য কেন মিলে যাচ্ছে? কি আছে রেবেকার অতীতে? আচ্ছা রেবেকার অতীত কি চন্দ্রকুঠির রহস্য সম্পর্কে আমাকে জানাতে পারবে?”
মুনের মাথায় এখন নানাবিধ চিন্তা ঘুরছে। মুন কোনমতে রহিমাকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো।

______
কাজ হবে না জেনেও মুন আরো একবার রেবেকার কাছে গেলো। রেবেকা একইভাবে বারবার ওকে চলে যেতে বলছে। কিন্তু আজ মুন ফিরে যাওয়ার জন্য আসেনি। তাই হাত জোর করে অনুরোধ করে বললো, ” প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন। আমার আপু বিপদে আছি। জানি না এই দুই মাস ওর সাথে কি হচ্ছে। প্লীজ বলুন না চন্দ্রকুঠিতে কি আছে? আপনার সাথে চন্দ্রকুঠিতে কি হয়েছে?”
মুনের করুন মুখ দেখে রেবেকা একটু নরম হলো। খুব শান্তভাবে বললো, ” তোমায় বলার মতো কিছু নেই। আমি নিরুপায়। আমি কিছু বললে আমার সন্তানের ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে এটুকু শুনে রেখো চন্দ্রকুঠি এক অন্ধকার যায়গা, যার অন্ধকারে ডুকে কেউ আলোতে ফিরে আসতে পারে না।”
” মানে? একটু খুলে বলুন না?”
” তুমি চন্দ্রকুঠি যাও, নিজেই বুঝতে পারবে সব। আমার তোমার জন্য দোয়া রইলো। আশা রাখবো সুস্থ জীবন নিয়ে ফিরে আসবে তুমি।”
রেবেকা আর কিছু বললো না। মুনকে বাধ্য করলো ওখান থেকে চলে যেতে। রেবেকার কথা শুনে মুন বুঝে গেছে ওর ধারনাই ঠিক। ‘ চন্দ্রকুঠি’ একটা নাম নয় শুধু, ওটা একটা রহস্য। মুন রিয়াদের সাথে কথা বলে কালকেই ‘চন্দ্রকুঠির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়বে।

মুন ‘চন্দ্রকুঠি’ যাওয়ার আগে তার বাবার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে মুন তার বাবাকে তার বন্ধুর বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করলো। আরিফ সাহেব যেতে চাইনি তবুও মুন এক প্রকার জোর করে পাঠালো। নতুন যায়গা গেলে ভালো লাগবে, বন্ধুর সাথে সময় কাটালে বাবা ভালো থাকবে। নানাভাবে তাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলো। মুনকে ছেড়ে যদিও যেতে চায় নি আরিফ সাহেব। তবে তিনি মুনের উদ্দেশ্য কিছুটা বুঝতে পেরে রাজি হয়ে গেলেন। আরিফ সাহেব যাওয়ার সময় মুনের কপালে চুমু এঁকে চলে গেলেন।

বাবাকে বিদায় দিয়ে মুনও বেরিয়ে পড়লো। রিয়াদের বলা যায়গায় চলে এসেছে মুন। সেখানে গিয়ে দেখলো রিয়াদ আগেই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। রিয়াদ মুনকে দেখে এগিয়ে এলো, ” চলুন।”
” হুম। আপনি আর আমি একা যাবো?”
” যেহেতু আমরা জানি না ওখানে গিয়ে কাকে ধরতে হবে বা কি করতে হবে সেহেতু টিম নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে বলুন।”
” তাও অবশ্য ঠিক।”
” হ্যাঁ।”
” আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো, আপনি আমার সাথে আপুকে খুঁজতে যাচ্ছেন তাতে…..”
মুনকে কথাটি শেষ করতে না দিয়েই রিয়াদ বললো, ” এটা আমার দায়িত্ব মিস।”
পরক্ষনেই রিয়াদ মনেমনে বললো, ” আমাকে যে চন্দ্রকুঠি যেতেই হতো৷ অনেক কষ্টে চন্দ্রকুঠি অব্দি এসেছি। নিজের সমস্যার সাথে যদি আরো একজনের সমস্যার সমাধান হয় তাতে ক্ষতি কি?”

রিয়াদ আর মুন গাড়িতে গিয়ে বসলো। রিয়াদ গাড়ি স্টার্ট দিলো। মুন হঠাৎ বলে উঠলো, ” আচ্ছা আমাকে তো এটাই বললেন না ‘চন্দ্রকুঠি’ কোথায়? ওটা কি একটা স্থানের নাম?”
” না। ‘চন্দ্রকুঠি’ একটি বাড়ির নাম।”
” বাড়ির নাম?” ভ্রু কুচকে
” হ্যাঁ। এখান থেকে বহু দূরে কদমতলী নামে এক গ্রাম আছে। গ্রামটি আয়তনে অন্যসব গ্রামের থেকে কিছুটা বড়। সেই গ্রামের একটি বাড়ির নাম ‘চন্দ্রকুঠি’। আপাতত এর থেকে বেশি কিছু জানি না। বাকিটা গিয়ে জানতে হবে।”
” আমার মাথায় এই কথাটি আসছে না, একটি গ্রামের একটি বাড়িতে কি এমন রহস্য থাকতে পারে?”
রিয়াদ মনেমনে বললো, ” সেটা তো আমিও জানি না। তবে ওখানে যে রহস্য আছে তা আমি নিশ্চিত।”
মুখে বললো, ” তা তো গিয়ে দেখতে হবে।”
” হুম।”

মুন ছুটে চলেছে নতুন গন্তব্য। সে জানে না তার এই নতুন গন্তব্যে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। তবে যাত্রাপথে রিয়াদ নামের এই সঙ্গীকে পেয়ে কিছুটা আশ্বাস পেলো। তবে অচেনা মানুষ বলে বেশিটা গুরুত্ব দিতে চাইছে না রিয়াদকে।
অন্যদিকে রিয়াদ সেও কিছুর আশায় এই গন্তব্যে ছুটে চলেছে।

চলবে,

চন্দ্রকুঠি পর্ব-০২

0

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব দুই
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

পরেরদিন সকালে,
পুলিশ স্টেশনে যাবো এই আশা তৈরি হচ্ছিলাম। এমন সময় বাবা দরজায় কড়া নাড়লো, ” আসবো মা?”
” হ্যাঁ বাবা এসো।”
বাবা ভিতরে আসতেই আমি প্রশ্ন করলাম,” কিছু বলবে?”
” কারাগারে যেও না। পুলিশ স্টেশন বা থানা নামে যে ভুল শব্দটি প্রয়োগ করি আমরা সেখানে।”
” ভুল শব্দ?”
” হ্যাঁ। ভুল শব্দ। তুমি নিশ্চয়ই থানা এবং কারাগারের মাঝে পার্থক্য জানো।”
” জানি। আসলে আপু পুলিশ স্টেশন বলে কারাগারে নিয়ে যাবে এটা বুঝতে পারি নি।”
কথাটি বলে মুন মনেমনে বললো, ” কে জানতো পুলিশ অফিসার বলে এক জেলের জেলারের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে ও?”
” যাই হোক। আমরা মাঝেমাঝে কারাগার এবং থানার মাঝে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলি তাই তো সবসময় ভুল শব্দ প্রয়োগ করি।”
” হ্যাঁ বাবা।”
” তো যাই হোক তুমি কারাগারে যেও না প্লীজ।”
” আমি তো কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম বাবা। কারাগারে কেন যাবো?” মিছে হাসি দিয়ে
” আমি জানি তুমি কলেজের নামে কারাগারে যাবে।”
” না বাবা আসলে…”
” আমি তোমাদের বাবা মুন। তোমাদের ভাবনা চিন্তা সবকিছু সম্পর্কে আমি খুব ভালোভাবে জানি।”
” বাবা আমি আসলে…”
” গন্তব্যহীন রাস্তায় মিছে ছুটে চলা উচিত নয় মা।”
” যদি গন্তব্যহীনই হবে তাহলে তুমি কাল রাতে ছাদে…”
বাবা আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে লাগলেন, ” আমি জানি কাল রাতে তুমি আমাকে সিগারেট খেতে দেখেছো। সেই সাথে কিছু কথাও শুনেছো।”
” তুমি তো আমাকে দেখোনি তবে জানলে কিভাবে?”
” আমি তোমার বাবা। আমি তোমাদের উপস্থিতি অনুভব করতে পারি।”
” বাবা তাহলে আমাকে বলো কেন তুমি কালরাতে এমন আচরণ করলে?”
” কাল অফিস থেকে মুড খারাপ করে এসেছিলাম আমি। তাই ওমন ব্যবহার করেছি। এর সাথে কারাগারের কোন কানেকশন নেই। তুমি অহেতুক ভাবছো।”
” সত্যি আমি অহেতুক ভাবছি।”
” হ্যাঁ। আচ্ছা আমাকে বলো এখন তুমি কারাগারে গিয়ে কি খুঁজবে?”
” তা তো জানি না। তবে জানো বাবা ঐ কারাগার আমাকে খুব করে টানে। মনে হয় ওখানে আমার কিছু একটা আছে বা ছিলো।”
” এসব তোমার ভ্রান্ত ধারণা মুন। যেখানে কেউ যেতে চায় না সেই কারাগার তোমাকে টানছে। এসব নিছকই তোমার ভ্রম।”
” তাই হবে হয়তো। কিন্তু আমি সেখানে গেলে কি সমস্যা?”
” কোন সমস্যা নেই। আমি চাই পরিক্ষার আগে তুমি এসব নিয়ে ভাবা বন্ধ করো। পরিক্ষা সামনে এখন পড়ালেখা মন দেও। তারপর সব হবে।”
” পরিক্ষা পর তোমার কোন বাঁধা থাকবে না? শুধুমাত্র পড়ালেখার জন্যও যেতে বারণ করছো?”
” না থাকবে না। হ্যাঁ শুধু পড়ালেখার জন্য।”
” আচ্ছা তাহলে পরিক্ষার আগে এসব নিয়ে ভাববো না। তবে তারপর তুমি কিন্তু বাঁধা দিতে পারবে না।”
” আচ্ছা দেবো না।”
আরিফ সাহেব মুখে এই কথা বললেও মনেমনে ঠিক উল্টো ভাবনা ভেবে নিলেন, ” ততদিনে তোমার এই ভাবনাটা দূর হয়ে যাবে এই আশা রাখছি।”
_________

মাধুরি কলেজে গেটে পা রাখতে যাবে তখনি রাফি বাইক নিয়ে সামনে এলো৷ রাফিকে দেখে কালকের চাপা রাগটা আবার জেগে উঠলো। বেশ রাগ নিয়ে বললো, ” কি চাই?”
” তোমাকে?” বেশ আনন্দিত হয়ে
” আমাকে দিয়ে তোমার কি কাজ?”
” কেন জানো না বুঝি?”
” না তো৷ আমি তো জানতাম তোমার সব সময় নিজের ঐ চাকরির জন্যই রাখা।”
” কালকের জন্য সরি। প্লীজ ক্ষমা করে দেও। দেখো তুমি তো জানো আমাদের পেশায় রাত দিন নেই। যখনি ফোন আসবে কাজে নেবে পড়তে হবে।”
” কি এমন রাজকাজ্য করো তুমি তা তো ভালোই জানি। ঘুষ দিয়ে জেলের জেলার হয়েছো। তোমাদের আবার কাজ কি শুধু চেয়ারে বসে আরাম করা।”
” আমার যায়গায় থাকলে বুঝতে কি কাজ করি?”
” তো সেখানেই যাও না বারণ করছে কে?”
” সরি।” কান হালকা ধরে
” একটা শর্তে মাফ করতে পারি।”
” বলো কি শর্ত? আমি তোমার সব শর্তে রাজি।”
” আমার শর্তটা হলো, আজকে আমার ক্লাস শেষ না হওয়া অব্দি তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। বলো রাজি?”
” হ্যাঁ রাজি। তোমার ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমরা ঘুরতে যাবো।”
” দেখা যাবে।”
কথাটি বলে মাধুরি চলে গেলো। মুখে তার দুষ্টু হাসি। সে জানে রাফি সত্যি তার জন্য অপেক্ষা করবে এখানে। রাফি চাইলে ক্লাস শেষের আগে এসে কাজটি করতে পারে কিন্তু তাও সে করবে না। কারণ তার প্রিয় মানুষটির দেড়ি করে আশা, কথা না রাখার শাস্তিগুলো পালণ করতে তার ভালোই লাগে। আর প্রিয় মানুষটি মাধুরির কথায় সারাদিন কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে এটা ভাবতে মাধুরির খুব ভালো লাগে। এতে প্রমাণ হয় প্রিয় মানুষটি তাকে কতটা ভালোবাসে, যে তার এক কথায় সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে থাকবে। এতে অবশ্য রাফির আরো একটা লাভ হয় তাহলো ক্লান্ত বিকেলে কোন এক নির্জন যায়গায় বসে, সে তার প্রেয়সীর নরম হাতের ছোয়া দিয়ে গা থেকে ওড়নার কোনাটি নিয়ে ঘামগুলো মুছে দেওয়ার আনন্দ উপভোগ করে । ভালোবাসা এই ছোট ছোট আনন্দগুলো খুব মধুর হয়। এগুলো সত্যি ভালো লাগার।

অন্যদিকে,
মুন তার বাবাকে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা দিয়ে থাকলেও কিছুতেই ভাবনা থেকে বেড়োতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে কোন একটা রহস্য তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। শেষমেশ থাকতে না পেরে চলে গেলো কারাগারে। সেখানে গিয়ে রহিমার সাথে দেখা। রহিমা নিজ থেকেই তার সাথে কথা বললো, ” তুমি সেই ডাক্তার মেয়েটির বোন না?”
” হ্যাঁ। তবে আপু এখনো পুরোপুরি ডাক্তার নয়।”
” সে যাই হোক একদিন তো হবে।”
” হ্যাঁ।”
” তা এখানে কিসের জন্য আসা?”
” কালকের সেই বাচ্চাটি আর তার মায়ের সাথে দেখা করা যাবে?”
” তুমি তাদের সাথে দেখা করতে চাইছো কেন?”
” এমনি। কাল অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় বাচ্চাটিকে দেখতে পায়নি তো তাই।”
” ওহ। এখন এসে ভালোই করেছো বিকেলের পর আসলে আর বাচ্চাটিকে দেখতে পেতে না।”
” কেন?”
” বিকেলে তাকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেওয়া হবে।”
” অনাথ আশ্রমে কেন?”
” রেবেকার পরিবারে কেউ নেই, তাই বাচ্চাটিকে তুলে দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি।”
” ওহ। তাহলে আমি কি দেখা করতে পারি?”
” হুম।”
রহিমা মুনকে রেবেকার কাছে নিয়ে গেলো। দ্রুত কথাবার্তা শেষ করতে বলে রহিমা চলে গেলো। মুন রেবেকার দিকে নজর দিলো। রেবেকা তার বাচ্চার সাথে খেলছে, তার সাথে নানা ধরনের কথা বলছিলো। বাচ্চাটি তার কাছ থেকে চলে গিয়ে যাতে কষ্ট না পায় তাই বোঝাচ্ছিলো। মুন কিছুক্ষন রেবোকার কান্ড দেখে তারপর খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো, ” নাম কি রেখেছেন বাবুর?”
রেবেকা মুনের দিকে তাকালো। মুনের দিকে তাকিয়ে রেবেকা চমকে উঠলো। রেবেকার চমকানো মুখ দেখে মুন জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো আপনি এত অবাক হচ্ছেন কেন?”
” কি চাই তোর এখানে?”
” কিছু না। বাবুকে দেখতে এসেছি একটু।”
” নাম কি তোর?”
” মুনতাহা মাহযাবিন। আপনার?”
” মুন মানে চাঁদ মানে চন্দ্র।” এক নাগারে বললো
” হ্যাঁ মুন মানে তো চাঁদই।”
” তোর বাবা মা কে?”
” এসেছিলাম আপনার জীবন সম্পর্কে জানতে আর আপনি আমার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন। বেশ ভালো তো।”
” যা জিজ্ঞেস করছি তাই বলো। কিসে পড়ো?”
” এইতো সামনে এইচএসসি দিবো।”
” ওহ পরিক্ষা সামনেই তাই তো?”
” হ্যাঁ। এবার আপনি আপনার সম্পর্কেও কিছু বলুন?”
” বললে কি হবে? কি করবি তুই?”
” না মানে….”
” পরিক্ষার পর এখানে এসো। তারপর সব বললো সাথে তোমাকে দেখে চমকানোর কারণটাও বলবো।”
” পরিক্ষার পর বলবেন কেন? এখন বলতে কি সমস্যা?”
” কোন সমস্যা নেই। এখন বললে তুমি পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারবে না। যেহেতু পরিক্ষা সামনে সেহেতু পরিক্ষাটা দিয়েই নাহয় এসো।”
” আমি কি জানতে চাই আপনি সেটাই তো জানলেন না?”
” উহু জানতে হবে না। এখন যাও তো।”
” আচ্ছা। তাহলে আমি পরিক্ষার পর আসবো কিন্তু?”
” এসো।”
মুন চলে যাচ্ছিলো এমন সময় রেবেকা বলে উঠলো, ” তোমার চোখগুলো খুব সুন্দর মুন।”
মুন রেবেকার দিকে ঘুরে মুচকি হেঁসে বললো, ” ধন্যবাদ।”
” তোমার হাসিটাও খুব সুন্দর।”
মুন মুচকি হেঁসে চলে গেলো। এদিকে রেবেকা ভেবে চলেছে, ” একে আসতে বলে ভুল করলাম না তো। একে বললে কিছু কি হবে! মেয়েটি তো যথেষ্ট ছোট। একে আসতে বলাটা ঠিক হলো না বোধহয়।”

অন্যদিকে মুন কারাগার থেকে বের হবে এমন সময় কারো সাথে ধাক্কা খেলো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো একজন বেশ বয়স্ক মহিলা কর্মী। মহিলাটি মুনের দিকে তাকানোর সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে উঠলো। মহিলাটির মুখেও চমকানোর রেখা দেখতে পেয়ে মুন ভাবতে লাগলো, ” আজকে কি মুখটা ভালো দেখাচ্ছে না। নয়তো সবাই মুখের দিকে তাকিয়ে এত চমকাচ্ছে কেন!”
মুন ভাবনা থেকে বেরিয়ে মহিলাটিকে সরি বলতে যাবে। কিন্তু কই! মহিলাটি কই! মহিলাটি চমকানো নিয়েই মুনের সামনে থেকে চলে গেলো। মহিলাটির এই অভূত ব্যবহারের কোন মানে খুঁজে পেলো না মুন।

__________
সন্ধ্যাবেলা,
সব ভাবনাকে আপাতত পরিক্ষা অব্দি ছুটি দিয়ে মাধুরির সাথে পড়তে বসলো মুন। মাধুরির মুখ দেখে আজকে খুব খুশি খুশি লাগছে। রাফির সাথে যে ঝামেলা মিটে গেছে সেটা বুঝে গেলো মুন। হঠাৎ মাধুরির ফোনে একটি আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এলো, ” অন্ধকার। তোমার চারদিকে ঘোর অন্ধকার। অন্ধকার থেকে বের হতে হলে খুঁজে বের করে তোমার বাড়ি। তাড়াতাড়ি যাও সেখানে।”

চলবে,

চন্দ্রকুঠি পর্ব-০১

0

#চন্দ্রকুঠি
সূচনা পর্ব
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

” স্যার আট নাম্বার সেলের আসামীর লেভার পেইন উঠেছে।”
হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটি বললো রহিমা। রহিমার কথাটি শুনে রাফি এবং আপু দুজনেই থেমে গেলো। রাফি চিন্তিতসুরে বললো, ” ওনাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।”
” সেটাই তো সম্ভব হচ্ছে না স্যার।”
” মানে? কেন সমস্যা কোথায়?”
” মহিলাটি কিছুতেই জেল থেকে বেড়োতে চাইছে না, পেইন নিয়েই সে আমাদের হুমকি দিচ্ছে তাকে ওখান থেকে বের করলে সে কিছু একটা করে বসবে।”
রহিমার মুখের এই ধরনের কথা শুনে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো রাফি। সে এই ধরনের কিছু একটাই আন্দাজ করেছিলো৷ কারাগারে অনেক অপরাধী আছে কিন্তু এই অপরাধীটি বেশ অভূত। রাফিকে চিন্তিত অবস্থায় দেখে আপু বললো, ” আচ্ছা ব্যপারটা আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলবে?”
” মাধুরি আসলে হয়েছি কি, এই মহিলাটি বেশ অভূত। ইনি কারো কথা শুনার মতো নন। শুনলেই তো লেভার পেইন ওঠার পরো কি বলছে….”
রাফি পুরো কথাটি শেষ করার আগেই লেভার পেইন ওঠা মেয়েটির গগনবিদারী চিৎকার শোনা যাচ্ছিলো। চিৎকার শুনে আপু আর এক মূহুর্তে না দাঁড়িয়ে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো যেদিক থেকে চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। আপুর পিছু পিছু রাফি এবং আমিও ছুটে গেলাম। ব্যাথায় ছটফট করছিলো মহিলাটি তাও একই কথা বলে চলেছে, ” আমি এখান থেকে যাবো না। কোথাও যাবো না। আমাকে কেউ ছুবে না।”

আপু ধীরে তার কাছে গেলো এবং খুব শান্তকন্ঠে বললো, ” মা ডাক শুনতে চান না আপনি?”
মহিলাটি মুখের উচ্চারিত কথাগুলো থামিয়ে আপুর দিকে তাকালো। এক পলক তাকিয়ে বললো, ” চাই তো।”
” তাহলে তো আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে..”
” না না আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না। আমার বাচ্চা এখানেই জন্ম নিবে……”
মহিলাটি এবার আরো অশান্ত হয়ে গেলো। কিছুতেই এখান থেকে বেড়োতে চাচ্ছে না। অতঃপর কোন উপায় না পেয়ে আপু দুজন মহিলা কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে এখানেই বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ব্যবস্থা করছিলো। আপু একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট, তাই তার জন্য এই কাজটা খুব একটা কঠিন হবে না। মাধুরিকে দায়িত্ব নিতে দেখে রাফি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক আশা করা যায় বাচ্চাটি সুস্থভাবেই জন্মাবে। রাফি ভাইয়া ওখান থেকে কিছুটা আড়ালে গেলো। বাচ্চাটি পৃথিবীতে আশার অপেক্ষার পাশাপাশি চলুন কিছু কথা জেনে নেই, যাতে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হয় এখানে কি হচ্ছিলো।

রাফি ভাইয়া এবং মাধুরি( আমার আপু) রিলেশনশীপে আছে। তো আজ আমার সাথে রাফি ভাইয়ার দেখা করাবে বলে আপু আমাকে নিয়ে একটা পার্কে এসেছিলো। কিন্তু রাফি ভাইয়া কাজে পড়ে যাওয়ায় ব্যপারটা মাথা থেকে বেড়িয়ে যায়। যাতে আমার আপুর মাথাটা গরম হয়ে যায় এবং তিনি নাচতে নাচতে ঝগড়া করতে রাফি ভাইয়ার কাজের স্থানে অর্থাৎ এই পুলিশ স্টেশনে চলে আসে। শুধু একা এসেছে তা নয় সাথে আমাকেও নিয়ে এসেছে। যাই হোক তাদের দুজনের ঝগড়ার মাঝে হঠাৎ এই মহিলার লেভার পেইন উঠে তারপর বাকিটা….।

অনেকক্ষন পর একটা বাচ্চার কান্নার শব্দে ধ্যান ভাঙে আমার। এতক্ষন সবকিছুই স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু এই বাচ্চার কান্না আমাকে অস্বাভাবিক করে তুললো। আমার বুকের ভিতর ঝড় বয়তে শুরু করলো। কিছু মূহুর্তের জন্য মনে হলো বাচ্চাটির স্থানে আমি কান্না করছি। কেন এমন মনে হলো জানি না! তবে এই কারাগার, এই গর্ভবতী মহিলা, এই বাচ্চা সবকিছুর মাঝে নিজেকে অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করলো, মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো তার আগেই রাফি ভাইয়া আমাকে ধরে ফেললো।

চার ঘন্টা পর,,,
চোখ খুলে নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করে খুব গাবড়ে গেলাম। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলাম, কি হয়েছে আমার সাথে!
” আমি তো মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম তখন…..”
অসমাপ্ত কথাটি আপু শেষ করলো, ” তখন রাফি তোকে ধরে ফেলে, তারপর আমি তোকে বাড়ি নিয়ে আসি।”
মুখ তুলে একবার আপুর দিকে তাকালাম৷ তারপর খুব শান্তভাবে বললাম, ” ঐ মহিলা আর বাচ্চাটি কেমন আছে?”
” খুব ভালো। তারা দুজনেই সুস্থ আছে। কিন্তু তোর কি হয়েছিলো?”
” আমার?”
” হ্যাঁ। তখন ওভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলি কিভাবে?”
” জানি না।”
” যতদূর আমার মনে হচ্ছে তোর মাথা অধিক চাপ পড়ার জন্য এমনটা হয়েছিলো। কিন্তু তুই তো স্বাভাবিক ছিলে তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যেটা নিয়ে তুই চিন্তিত হয়ে পড়লি?”
” জানি না। হঠাৎ…”
চুপ করে গেলাম। ভেবে পাচ্ছি না কি বলবো! যদি বলি বাচ্চাটার স্থানে নিজেকে অনুভব করছিলাম, তবে আপু কি ভাববে আমার ব্যপারে।
” কি হলো থেমে গেলি কেন? হঠাৎ কি হয়েছে?”
” কিছু না। খাওয়া হয়নি ঠিকমতো তাই বোধহয় এমন হয়েছে।”
” আমি কে জানিস তুই?”
” তুই মাধু আপু। এই তুই এমন উদ্ভাট প্রশ্ন করলি কেন? আচ্ছা তুই সত্যি মাধু আপু তো নাকি তার রুপ ধরে থাকা কোন ভুত?”
কথাটি বলে হেঁসে দিলাম। কিন্তু মাধুরি আপু হাসলো না। সে খুব কঠিন গলায় বললো, ” আমি এখন মজা করার মুডে নেই মুন। আমি তোর আপু। আমি তোকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি মুন, তাই চুপচাপ বল কি নিয়ে ভাবছিলে তুই?”
” তেমন কিছু না৷”
” যেমনি হোক সেটাই বল।”

তারপর আর কি আপুকে সব বলে দিলাম৷ এমনিতেও আপুর থেকে কিছু লুকিয়ে বাঁচতে পারবো না জানি। তাই বৃথা চেষ্টা না করে বলে দিলাম।
” তুই সত্যি বলছিস?”
” হ্যাঁ আপু সত্যি।”
” এজন্য অজ্ঞান হয়ে যেতে হয়। ধুর পাগলি। আসলে তুই খুব আবেগী তো তাই রেবেকার কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারিস নি। তুই ভাবছিলি ঐ বাচ্চাটির স্থানে তুই থাকলে তোর কেমন অনুভূতি হতো। এটা নিয়ে আর ভাবিস না। যার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”
” তাই হবে হয়তো।”
” এটাই হয়েছে পাগলি বোন আমার।”
” হ্যাঁ। তা তোর আর রাফি ভাইয়ার ঝগড়া মিটলো?”
” তোর জন্য ঝগড়া করতে পারলাম কখন? ভেবেছিলাম আজ ইচ্ছেমতো ঝগড়া করবো কিন্তু তুই অজ্ঞান হয়ে সব মাটি করে দিলি।” অভিমানী কন্ঠে
” তারমানে এখনো রাগ আছে?”
” আমি ওর সাথে আর কথাই বলবো না।”
” এটা কিন্তু ঠিক না আপু। রাফি ভাইয়া যে পেশায় আছে সেখানে দাঁড়িয়ে সে একটু ব্যস্ত থাকবেই। তার ব্যস্ততার কথা জেনেই তো তুই তার সাথে সম্পর্কটা এগিয়েছিলি।”
” যতই ব্যস্ততা থাক, প্রিয় মানুষ হলে তার জন্য ঠিক সময় বের করে নেওয়া যায়। তবে প্রিয় মানুষটা শুধু মুখে নয় মনেও প্রিয় হতে হবে।”
আমি সাথে সাথে কপালে হাত দিলাম। আমার হাত দেওয়া দেখে আপু জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমিও অবুঝের মতো বলে উঠলাম, ” তোদের মতো আমি কবে প্রেমে পড়বো আর কবেই বা এত মান অভিমানের ডায়লগ বলবো। আমার কপালে কি এমন দিন আসবে কখনো, এটা ভেবেই তো আমি আবার অজ্ঞান হয়ে যাবো। ”
আমার বলার ভঙ্গিমা দেখে আপু হেঁসে দিলো। আপু এসে আমাকে আলিঙ্গন করলো। তারপর মিষ্টি করে বললো,” আসবে আসবে খুব শীঘ্রই কেউ আসবে। আমার এই ছোট্ট বোনটার মন দখল করতে।”
আমিও মিষ্টি হেঁসে আপুকে আলিঙ্গন করলাম।

__________
রাত দশটা বাবা অফিস থেকে চলে এসেছে। কলিংবেলের শব্দ পেয়েই আমি আর আপু ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। আমাদের মাঝে এটা একটা প্রতিযোগিতা, প্রতিদিন কে আগে দরজা খুলতে পারে। আমাদের মাঝে যে আগে দরজা খুলবে বাবা তাকে আলিঙ্গন করে দুটো চকলেট দিবে। আর যে শেষে খুলবে তাকে একটা। পরে অবশ্য লুকিয়ে গিয়ে তাকে আরো একটা চকলেট দিবে। এগুলো আমরা দুজনেই জানি, তবুও ছোটবেলা থেকে এই কাজটা করে চলেছিলি। যাই হোক আজকে প্রথমে দরজার কাছে এসেছি আমি। দরজা খুলে বাবাকে আলিঙ্গন করলাম। বাবা মিষ্টি হেঁসে পকেট থেকে দুটো চকলেট বের করে আমাকে দিলো। আমি চকলেট হাতে আপুকে ভেঙিয়ে বললাম, ” আজ আমি দুটো চকলেট খাবো, কেউ জানো নজর না দেয়।”

আপু আমাকে উল্টো ভেঙিয়ে বললো, ” একজন দুটো চকলেট খাক সমস্যা নেই। আবার দেখা যাবে চকলেট না পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো তখন তো আমাকেই সেবা করতে হবে।”
কথাটি বলা আমি আপুর দিকে রাগী চোখে তাকালাম। অজ্ঞান শব্দটি শুনে বাবা বললেন, ” কে অজ্ঞান হয়ে যাবে আর কেন?”
দ্বিগুন ভাব নিয়ে আপু আবার বললো, ” কে আবার তোমার ছোট মেয়ে মুনতাহা। তার তো আজকাল যেখানে সেখানে অজ্ঞান হওয়ার রোগ হয়েছে।”
” মানে? কি হয়েছে? মুন অজ্ঞান হলো কখন?”
” সে এক ইন্টারেস্টিং গল্প বাবা। শুনলে তুমি হাসি আটকাতে পারবে না। তোমার মেয়ে আজকাল বাচ্চাদের যায়গায় নিজেকে খুঁজে পায়।”
কথাটি বলতে বলতে আপু হেঁসে দিলো। এ যে সে হাসি নয়। একে বলে ব্যঙ্গত্নক হাঁসি। ঠিক এই কারনেই আমি আপুকে বলতে চাচ্ছিলাম না৷ বাবা আপুকে পুরো ঘটনা জিজ্ঞেস করলো। আপুও হাসতে হাসতে গড়গড়িয়ে সব বলে দিলো। আশ্চর্য-জনক বিষয় হলো বাবা এই কথাটি শুনে হাঁসা তো দূর, উল্টো ঘরে ডোকার সময় মুখে লেগে থাকা মুচকি হাসিটাও উবে গেলো। বাবাকে দেখে মনে হলো বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বাবার কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আপু থেমে গেলো এবং বললো, ” কি হলো বাবা চুপ হয়ে গেলে কেন?”
” মুন তুমি আর কখনো পুলিশ স্টেশন যাবে না।” কিছুটা উচ্চশব্দে
” আরে বাবা আপু একটু বেশি বানিয়ে বলছে, তেমন কিছু না। আমি তো জাস্ট…..”
আমাকে কথাটি সমাপ্ত করতে না দিয়ে বাবা বেশ ধমক দিয়ে বললো, ” যাই হোক তুমি আর কখনো পুলিশ স্টেশন যাবে না।”
এবার আমি কিছুটা ভয় পেলাম। বাবা এতটা রেগে আমাদের সাথে কখনো কথা বলেনি। আপুকে দেখে মনে হলো সেও একটু ভয় পেয়েছে। বাবা এবার কিছুটা আদেশের সুরে বললেন, ” হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেতে এসো।”
কথাটি বলে বাবা চলে গেলেন। আমি আর আপু একে-অপরের মুখের দিকে তাকালাম। আমি বেশ ভাবনার সুরে বললাম, ” বাবা এতটা রেগে গেলো কেন?”
” হয়তো তুই অসুস্থ হয়ে পড়েছিস শুনে কষ্ট পেয়েছে। আমাদের বাবা খুব ভালোবাসে তো তাই আমাদের নিয়ে চিন্তিত।”
আপু আশ্বাস দিয়ে বললো। আমিও ভাবলাম হয়তো তাই। তবে জোরালো ভাবে মনে সেই ভাবনাটা আসছে না। মনের কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠিক একটি প্রশ্ন থেকেই যায়।

____
রাত তখন ২.৩০,
চোখে ঘুম নেই। চোখ বন্ধ করলেই শুধু কারাগার, জেল, বাচ্চার কান্নার শব্দ শুধু চোখে ভেসে ওঠে। মস্তিষ্ক থেকে যতই বের করতে চাচ্ছি ততই ঐ বাচ্চার কান্নার শব্দ আমাকে অতিষ্ট করে তুলছে। ঘুমের মাঝে এরকম বাচ্চার কান্নার শব্দ আগেও শুনেছি আমি, তবে তখন নিজেকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু আজ চেয়েও সামলাতে পারছি না। বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলাম। পাশে ঘুমন্ত আপুর মুখটা দেখে ভালোই লাগলো। আপু জেগে না যায় তাই চুপিচুপি পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। ভাবলাম ছাদে গিয়ে একটু ঘুরে আসি। ছাঁদের দরজা খুলতে যাবো এমন সময় মনে হলো দরজাটা আগে থেকেই খোলা। আস্তে করে দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। দরজা খোলার পর যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এতগুলো বছরে প্রথমবার বাবার হাতে সিগারেট দেখলাম। বাবা সিগারেট খাচ্ছে। হ্যাঁ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। হঠাৎ কানে ভেসে এলো বাবার বলা কিছু বাক্য, ” চাঁদ, চন্দ্র, মুন সব এক। সবাই বিলীন হয়ে যায় দিনের আলোয়। না না। আমি মুনকে বিলীন হতে দেবো, না মাধুরিকে। ওরা দুজনেই সারাজীবন আমার কাছে থাকবে। আমি ওদের কোথায় যেতে দেবো না।”

কথাগুলো বলছিলো আর কান্না করছিলো বাবা। বাবার কান্না আমাকে আরো ভাবিয়ে তুললো। আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আর বাবার পুলিশ স্টেশন না যেতে বলা এখন আর আমার স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঘটনাটা স্বাভাবিক হলেও এরমাঝে অস্বাভাবিক কিছু আছে। হ্যাঁ অস্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক কি লুকিয়ে আছে? সেটাই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। তার জন্য আমাকে পুলিশ স্টেশন যেতে হবে।

মুন কি পারবে রহস্য অব্দি পৌছাতে নাকি পৌছানোর আগেই বিলীন হয়ে যাবে।

চলবে।
-~

তুই শুধু আমার পর্ব-৪০(শেষ পর্ব)

0

#তুই শুধু আমার
#Writer_মারিয়া
#Part : 40 ( শেষ পর্ব )

জেরিন বার বার সাইফ কে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাবেই সাইফের সাথে কনটাক্ট করতে পারছে। সাইফের ফোন অফ দেখাচ্ছে। আমান জেরিনের রুমে এসে দেখে জেরিন কাউকে বার বার ফোন দিচ্ছে। আমান বলে ওঠে,
–” জেরিন!”

কারো আওয়াজে জেরিন পেছনে তাকিয়ে দেখে আমান দাড়িয়ে আছে। আমানকে দেখে জেরিন বলে ওঠে,
–” আরে আমান! তুমি অফিস যাও নি?”

–” নাহ! আজ যাবো নাহ। তাহ তোমার কোনো প্রব্লেম হচ্ছে নাহ তোহ থাকতে।”

–” নাহ। প্রব্লেম কেনো হবে?”

–” হুম! আচ্ছা এর পরে কি করবে? মানে, তোমার হাসবেন্ডের কাছে ফিরে যাবে কি?”

–” আমান! আমি জানি, আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছিলাম। তোমার ভালোবাসার সাথে অন্যায় করেছিলাম। তাই হয়তো আজ আমার সাথে এমন হলো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমান, আমি এখনো তোমাকে নিয়ে ভাবি।”

–” তাই?”

–” হুম! সত্যি, আমি তোমার অভাব এখন বুঝতে পারি। আমান, আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।”

–” তাহ, শুধু কি আমান কে বলবে নাকি আমাদেরও বলবে?”
কারো আওয়াজ পেয়ে জেরিন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আরসাল মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আবার আমানের দিকে তাকিয়ে দেখে আমানের মুখে কেমন ভয় লাগানো হাসি লেগে আছে। জেরিনের কেমন জানি ভয় লেগে উঠে। তাও নিজেকে সামলিয়ে আরসালের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আরসাল তুমি?”

–” হুম! তোমার হাসবেন্ড নাকি তোমার উপর অত্যাচার করছে?”

–” হুম!”

–” এই কারনে পুলিশ এসছে। তোমাকে হেল্প করতে। ইন্সপেক্টর ভেতরে আসুন।”
রুমের ভেতর পুলিশ আসতেই জেরিন মারাত্মক ভয় পেয়ে যায়। আর ভয়ে ভয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” পুলিশ কেনো?”

আরসাল মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
–” তোমার হাসবেন্ড কে ঠিক করার জন্য।”

–” মানে?”

–” মানে টাহ আমি বলি?”
কথাটাহ বলতে বলতে আশা ভেতরে আসে। আশা এগিয়ে এসে জেরিনের সামনে দাড়িয়ে বলে ওঠে,
–” জেরিন! তুমি তোহ একটা মেয়ে, একজনের স্ত্রী, নিজের অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে মিথ্যা, একটা মেয়ের ঘর ভাঙতে আসা, কিভাবে পারো?”

–” তুমি এইসব কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি নাহ।”
আরসাল জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” তোমাকে এক কথায় বুঝিয়ে দেয়। তেমার বস, সাইফ এখন জেলে।”

আরসালের কথাটাহ শুনতেই জেরিন চমকে আরসালের দিকে তাকাতেই আরসাল বলে ওঠে,
–” সাইফ আমাকে মারতে চেয়েছে এন্ড তোমাকে এই বাসায় পাঠিয়েছে আমান এবং আশার সংসার ভাঙার জন্য। এর আগেও একবার আশাকে রেপ করতে চেয়েছিলো। মোটামুটি বেশ কিছু কেসে এখন জেলে। পুলিশের কয়েক ঘা বাড়ি পড়তেই সব স্বীকার করে নেয়। তোমার মনে হতে পারে, তোমাকে আর সাইফ কে কেনো সন্দেহ করলাম? আসলে তুমি তোমার হাসবেন্ডের অত্যাচারের কথা বলে আমানের কাছে সাহায্য চেয়েছো, আমান তোমাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু ব্যাপার টাহ আমাকে জানানোর পর তোমার ব্যাপারে একটু অনুসন্ধান চালাই, আর তাতে জানতে পারি তোমার হাসবেন্ড হসপিটালে এডমিট গত ৯ মাস ধরে।”

আরসালের কথা শুনতেই জেরিনের ভয়ে হাত পা কাঁপাকাপি শুরু করে দেয়। আরসাল আবার বলে ওঠে,
–” তখনই আমার তোমার উপর সন্দেহ হয়। তোমার কল লিস্ট চেক করি দেখি, সাইফের সাথে গত কয়েকদিন ধরে তোমার কন্টাক্ট আছে। ব্যাস, অল ক্লিয়ার। যাই হোক, সাইফ জেলে তোমার সাথে বাকি প্লান করার জন্য ওয়েট করছে।”

জেরিন কান্না করে দিয়ে বলে ওঠে,
–” আমার কোনো দোষ নেই বিশ্বাস করো। আমার অনেক টাকার দরকার। আমার প্রচুর টাকার দরকার। আমার স্বামীর ট্রিটমেন্টের জন্য অনেক টাকা লাগবে। ওনি আমাকে বলেছিলো আমার স্বামী যতদিন নাহ সুস্থ হবে ততদিন ওনি ট্রিটমেন্টের টাকা দিবেন৷ যদি আমি এই কাজ টাহ করে দেয় তাহলে। আমার আর কোনো উপায় ছিলো নাহ। আশা বোন আমার, বিশ্বাস করো, আমি নিজ ইচ্ছায় তোমার সংসার ভাঙতে আসি নি। একটা সময় নিজের লোভে আমানের কাছে এসেছিলাম। কিন্তু আজ লোভে পড়ে নয়, নিজের স্বামীকে সুস্থ করার জন্য কাজ টাহ করতে বাধ্য হয়েছি। আমাকে এখন জেলে দিলে, আমার স্বামীকে কে দেখবে বলো। তোমরা আমার উপর নজর রেখো, আমার স্বামী সুস্থ হলে আমি তোমাদের দেওয়া শাস্তি মেনে নিবো। দয়া করো প্লিজ।”

আশা আমানের আর আরসালের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” পুলিশদের চলে যেতে বলো। ও তোহ আমাদের এখনো ক্ষতি করে নি। ও কোনোরকম ক্ষতি করার আগেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আর ও যাহ করতে এসেছিলো, একজন স্ত্রী হয়ে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য। যদিও কাজ টাহ অন্যায় ছিলো। যাই হোক, ওকে কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়া উচিত নাহ। আর ওর স্বামীর চিকিৎসার সমস্ত খরচ আমরাই বহন করবো।”

জেরিন আশাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। আশাও জেরিন কে জড়িয়ে ধরে।

★★★
আমানদের বাসায় আজ একটা অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে। ডক্টর শায়লা ২ দিন পরে রিপোর্ট বানিয়ে জানিয়েছেন, আশা মা হতে চলেছে। এই কথা শুনে আশা আর আমানের খুশির সীমা নাই। তাই আমানদের বাড়িতে আমান আর আরসালরা মিলে পারিবারিক হাসি খুশির আয়োজন করেছে। সবাই অনেক খুশি, আশার মা হওয়ার কথা শুনে।
রাতে চৌধুরী বাড়ির সবাই ফিরে আসে নিজেদের বাড়িতে। আরসাল বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। সেহের রুমে এসে আরসাল কে নাহ পেয়ে বারান্দায় উকি দিতেই দেখে আরসাল দাড়িয়ে আছে। সেহের রুমের লাইট অফ করে দিয়ে, ব্লু সেডের ড্রিম লাইট অন করে দিয়ে, বারান্দায় গিয়ে আরসালকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আরসাল, সেহের জড়িয়ে ধরাতে মুচকি হেসে পিছন ফিরে সেহেরকে জড়িয়ে ধরে। সেহের আরসালকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় বলে ওঠে,
–” আরসাল আমার একটা বাবু চাই।”

আরসাল যেনো অবাক হয়ে যায়, সেহেরের মুখে আরসাল ডাক শুনে। আরসাল তাড়াতাড়ি সেহেরকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে, সেহেরের মুখ ধরে বলে ওঠে,
–” তুই আমাকে আরসাল বলে ডাকলি?”

–” তাহলে কি ভাইয়া বলে ডাকবো?”

–” একদমই নাহ আরসাল ইজ বেস্ট। যাই হোক কি বললি, বাবু লাগবে?”
সেহের লজ্জা পেয়ে আরসালকে জড়িয়ে ধরে আরসালের বুকে মুখ লুকায়। আরসাল সেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,
–” সেহের আজ কি আমি আমার অধিকার টাহ পেতে পারি?”

সেহের কিছু নাহ বলে আরসালের বুকে একটা চুমু দিতেই আরসাল তার উত্তর পেয়ে যায়। আরসাল সেহেরকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে সেহেরের উপর আধশোয়া হয়ে সেহেরের কপালে একটা চুমু দেয়। সেহের জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। আরসাল সেহেরের চোখের উপর চুমু দিয়ে, সেহেরের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। আরসাল যেনো আজ পাগল হয়ে যাচ্ছে সেহেরকে ভালোবাসার জন্য। এতোদিন তোহ মন টাহ দিয়েই আগলে রেখেছে। আজ সেহেরের শরীর টাও নিজের নামে করে নিতে চায় আরসাল। সেহেরের ঠোঁট থেকে সরে এসে সেহেরের গলায় মুখ ডুবায় আরসাল। সেহেরের শরীর থেকে শাড়ী ফেলে দেয় আরসাল। সরে যেতে থাকে দুইজনের মধ্যকার আবরন। একে অপরের সাথে মিলিয়ে নিতে চায় দুইজনে, আরসাল সেহেরকে নিয়ে নিজের ভালোবাসার নতুন স্বপ্ন বুনতে চায়। যেখানে শুধু সেহের আর আরসাল।

৬ বছর পর…………….

–” মাম্মাম! মাম্মাম!”

–” এই তোহ সোনা। তোমাকে খুজছিলাম তোহ আমি। কোথায় ছিলা তুমি?”

–” দিদার কাছে।”

–” আচ্ছা রুমে চলো।”

–” নাহ রুমে পাপা আছে। আমি পাপার কাছে যাবো নাহ।”

–” ওমা কেনো?”

–” আজ আমার বার্থডে। পাপা বলেছিলো আমার বার্থডে তে কোথাও যাবে নাহ। কিন্তু পাপা সকালেই কোথায় যেনো গিয়েছিলো। আমি খুজেই পাই নি।”

–” সেই জন্য আমার মা টাহ কি আমার উপর রাগ করেছে।”
আরসালের কথা শুনে ছোট্ট বাচ্চা টাহ মুখ ফুলিয়ে নেয়। এই হলো আরসাল আর সেহেরের এক মাত্র আদরের কন্যা অরশি। আরসালের জান অরশি। আজ অরশির চার বছর পূর্ণ হলো। দেখতে পুরো কিউটের ডিব্বা। আরসালকে সবসময় কাছে পেতে চায় অরশি। কিন্তু বিকালের বার্থডে পার্টির জন্য আরসাল একটু বাহিরে গিয়েছিলো কাজে, তাই অরশি রেগে আছে। আরসাল সেহেরের কোলের থেকে অরশিকে নিজের কোলে নিয়ে বলে ওঠে,
–” সরি মা! আর কখনো আমি এমন করবো নাহ। আর আজ আমি তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো নাহ।”

–” প্রমিস?”

–” প্রমিস!”
আরসাল অরশির গালে একটা চুমু দিতেই অরশিও আরসালের গালে চুমু দেয়।
সন্ধ্যায় চারিদিকে আলোয় ঝলমলে হয়ে আছে। সবাই সবার মতো হাসাহাসি মজা করছে। হঠাৎ লাইট অফ হয়ে গিয়ে একটা লাইটের আলো পড়ে সিড়ির দিকে। সবাই সিড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সেহের, আরসাল আর আরসালের কোলে অরশি। তিনজনেই সাদা ড্রেস পরা। যে কারোর মন খুশিতে ভরে যাবে এরোকম দৃশ্য দেখে। ওরা নিচে নেমে আসতেই সব লাইট জ্বলে উঠে। আর কেউ একজন বলে ওঠে,
–” Happy birthday my Princess.”

সবাই দরজার দিকে তাকাতেই দেখে রাহুল দাড়িয়ে আছে। অরশি “চাচ্চু” বলে দৌড়ে গিয়ে রাহুলের কোলে উঠে যায়। রাহুল অরশির প্রত্যেক জন্মদিনে দেশে আসে। অরশিও রাহুলকে খুব পছন্দ করে। প্রত্যেক জন্মদিনে অপেক্ষায় থাকে এইসময়ের। রাহুল অরশি কে কোলে করে নিয়ে কেকের সামনে দাড়ায়। অরশি, আরসাল আর রাহুলের মাঝে দাঁড়িয়ে কেক কেটে সবাইকে খাইয়ে দেয়। এর মাঝেই আমান আর আশার ছেলে আরিয়ান এসে বলে ওঠে,
–” অরশি তুই সবাইকে কেক খাওয়ালি, আমাকে কেনো খাওয়ালি নাহ?”

–” তোমাকে আমি খাওয়াবো নাহ।”

–” কি বললি তুই? দাড়া।”
আরিয়ান একটা কেকের পিস তুলে অরশির হাত ধরিয়ে দিয়ে জোর করে নিজের মুখে তুলে নেয়। আর অরশির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” তুই শুধু আমাকে খাওয়াবি। কারন #তুই_শুধু_আমার।”

কথাটাহ বলেই আরিয়ান বাইরে চলে যায়। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সবাই আরিয়ান কে আরসালের সাথে তুলনা করে। কারন আরিয়ান অনেকটাহ আরসালের মতো হয়েছে। রাহুল আরসালের পাশে দাড়িয়ে বলে ওঠে,
–” তোমার মেয়ে জামাই, আরসাল।”

–” হুম! কোনো সন্দেহ নাই।”
বলেই আরসাল আর রাহুল হেসে উঠে। রাহুল বিয়ে করে নি। একবার চেষ্টা করতে চেয়েছিলো, কিন্তু পারে নি সেহেরের জায়গা অন্য কাউকে দিতে। ইয়াশ বিদেশেই একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। আরসাল, সেহের, ইয়াশ অনেক বুঝিয়েছে রাহুলকে, কিন্তু রাহুল কোনো ভাবেই বিয়ে করতে রাজি হয় নি। আশফি আর নেহার একটা মেয়ে আছে, নাম নিশি। এইবার ২ বছর হবে।

রাতে সেহের অরশি কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজে পাশে শুয়ে আছে। আরসাল অফিসের কিছু কাজ কমপ্লিট করে বিছানার দিকে এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” আমার মা টাহ ঘুমিয়ে গেছে?”

–” হুম! আজ সারাদিন যাহ ছোটাছুটি করেছে, অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে।”

–” তাহ ঠিক! নাহলে তোহ ঘুমাতেই চাই নাহ।”

–” আর তাছাড়া আরিয়ানের নামে তোহ তার হাজার নালিশ।”
সেহেরের কথা শুনে আরসাল হেসে দিয়ে বলে ওঠে,
–” আমাদের আর মেয়ে জামাই খুজতে হবে নাহ।”

–” তাহ ঠিক।”
অরশি কে মাঝে রেখে আরসাল আর একপাশে শুয়ে অশরির কপালে একটা চুমু দিয়ে, সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” Thanks Seher. এরকম একটা মিষ্টি উপহার আমাকে দেওয়ার জন্য। আমার মেয়ে টাহ যে আমার জান।”

–” হুম! শুধু মেয়েটাই সব আর আমি কিছু নাহ তাই নাহ?”

–” আরে তুই তোহ আমার হার্ট, আর আমার মেয়েটাহ তোহ আমার হার্টবিট। হার্ট ছাড়া কি কখনো হার্টবিট হয়?”

–” আচ্ছা?”

–” হুম! সেহের একটা কথা বলি?”

–” হুম!”

–” #তুই_শুধু_আমার।”
সেহের একটা মুচকি হাসি দিয়ে আরসালের কপালে একটা চুমু একে দেয়। আরসালও সেহেরের কপালে একটা চুমু একে দেয়। অরশিকে মাঝে রেখে আরসাল আর সেহের অরশির উপরে আস্তে করে হাত রেখে ঘুমিয়ে যায়।

🌹★★সমাপ্ত★★🌹

তুই শুধু আমার পর্ব-৩৪+৩৯

0

#তুই শুধু আমার
#Writer_মারিয়া
#Part : 38+39

সাইফ একটা কফি শপে বসে আছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কারো জন্য। চারিদিকে নিরিবিলি পরিবেশ। হঠাৎ একটা মেয়ে সামনে এসে দাড়াতেই সাইফ উঠে দাড়িয়ে বলে ওঠে,
–” জেরিন?”

–” হুম!”
হ্যা, সাইফ এতো সময় জেরিনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। জেরিনের দিকে তাকিয়ে সাইফ বলে ওঠে,
–” বসো।”

–” হুম!”
জেরিন বসতেই সাইফ আবার বলে ওঠে,
–” কি অর্ডার দিবো, বলো?”

–” কিছুই নাহ। আসলে আপনি আমাকে গতকাল ফোন দিয়ে একটা কাজের কথা বলেছিলেন। বিগ এমাউন্টের।”

–” হ্যা! শুনলাম তোমার হাসবেন্ড নাকি হসপিটালে এ্যাডমিট এন্ড তোমার হাসবেন্ড এর ট্রিটমেন্টের জন্য প্রতিদিন অনেক টাকা দরকার হয়।”

–” হুম! গত বছর একটা এক্সিডেন্টের পর থেকে এই অবস্থা।”

–” তোহ ডক্টর কি বললো?”

–” বললো ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যেতে। তার জন্য তোহ অনেক টাকা লাগতেছে। যাহ যাহ ছিলো বিক্রি দিয়ে এই পর্যন্ত ট্রিটমেন্ট করছি। এখন আমার অনেক টাকা লাগবে। তাই আপনি যখন বললেন কাজ আছে। তাই আমি এলাম।”

–” হুম! তোমার স্বামীর ট্রিটমেন্টের সব টাকা আমি দিবো। যদি তুমি আমার কাজ করে দাও।”

–” কি কাজ?”
সাইফ একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
–” আমান কে চেনো?”

আমানের কথা শুনতেই জেরিন চমকে সাইফের দিকে তাকায়। আর কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” আপনি আমানকে কি করে চিনেন?”

–” সেইটা তোমার জানার বিষয় নাহ। তোমাকে জাস্ট যেইটা বলবো তুমি সেইটায় করবা। আন্ডারস্টান্ড।”

–” হুম! কিন্তু কাজ টাহ কি?”
সাইফ জেরিন কে সব বুঝিয়ে বলে দেয়, যে কি করতে হবে। কথা গুলো শুনতেই জেরিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।

★★★
রাহুল বারান্দায় ডিভানে বসে সকালের আবহাওয়া উপভোগ করছে। ইয়াশ এসে রাহুলের পাশে বসে বলে ওঠে,
–” রাহুল!”

–” হুম বল!”

–” এখানে বসে বসে কি ভাবছিস?”

–” সেহেরের কথা। আচ্ছা যাই হোক, একটা কথা বলতো, তুই সেহেরকে কিভাবে চিনিস? আগে তোহ বলিস নি আমাকে? আর সেহেরই বাহ তোকে কিভাবে চিনে? তুই সেহেরের কি ক্ষতি করতে গিয়েছিলি?”

–” সে অনেক কথা।”

–” শুনবো। বল।”
ইয়াশ রাহুলকে সব কথা বলে দেয়। রাহুল পুরো হতভম্ব হয়ে যায় ইয়াশের কথা শুনে। রাহুল অবাক হয়ে ইয়াশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” তুই সেহেরকে রেপ করতে চেয়েছিলি?”

–” জিদের বসে ছিলাম। তাই এমনটাহ করতে গিয়েছিলাম।”

–” তোকে বড্ড অচেনা লাগছে ইয়াশ।”

–” I am sorry dost! আমি আর কখনো এইসব করবো নাহ। বিশ্বাস কর। আমি একদম ভালো হয়ে যাবো।”

–” তোকে একটা কথা বলার আছে?”

–” কি কথা?”

–” আমরা কাল রাতে লন্ডন চলে যাবো। অলটাইমের জন্য লন্ডন সেটেল হয়ে যাবো। আর তুইও যাবি আমার সাথে। আর এই বিডি তে আসবো নাহ। বিষাক্ত হয়ে গেছে বিডি আমার জন্য। শোন কাল রাত ১১ টায় ফ্লাইট। সব কিছু গুছিয়ে নে। বিদেশটায় আমার জন্য বেস্ট। বুঝলি?”

–” হুম!”
রাহুল বারান্দা থেকে ভেতরে চলে যায় আর ইয়াশ মনে মনে ভাবতে থাকে,
–” আমাকে কালকের আগে সেহেরের সাথে একবার দেখা করে সব ভুল ভাঙিয়ে দিতে হবে। নাহলে রাহুল বিদেশে গিয়েও শান্তি পাবে নাহ। আমাকে সেহেরকে বলতে হবে সবটাহ। যে করেই হোক সবটাহ বলতে হবে।”

★★★
আরসাল একটা কাজে বাইরে যাওয়ার জন্য আয়নার সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছিল। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ পেয়ে সেহের এসেছে ভেবে তাকাতেই দেখে নেহা দাড়িয়ে আছে। নেহাকে এখন এইসময় এখানে দেখে আরসালের মুখ বিরক্তিতে ভরে যায়। আরসাল নেহার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” নেহা? তুমি এখন এইসময় এখানে?”

–” হুম! আসলে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই।”

–” সাট আপ নেহা। ঠিক করে কথা বলো। কারন ভুলে যেও নাহ, তুমি যে অধিকারে এই বাসায় এসেছো, সেই অধিকারে আমি তোমার ভাসুর হই। So, mind your language.”
কথাটাহ বলেই আরসাল চলে যেতে নিলেই, নেহা বলে ওঠে,
–” আরসাল তুমি খুব ভালো করেই জানো, আশফি কে বিয়ে করার কারন কি?”

নেহার কথা শুনে আরসাল নেহার দিকে তাকাতেই, নেহা আবার বলে ওঠে,
–” কিহ, তুমি কি জানো নাহ? তোমার ভাইকে আমি কেনো বিয়ে করেছি?”

আরসাল কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে,
–” শুধু আরসাল ভাইয়া একা কেনো, আমিও জানি।”

আরসাল আর নেহা তাকিয়ে দেখে সেহের মুচকি হাসি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আরসালেরও মুখে হাসি ফুটে উঠে সেহেরকে দেখে। সেহের একবার আরসালের দিকে তাকিয়ে আবার নেহার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” নেহা! সময় এবং সুযোগ কিন্তু বার বার আসে নাহ। তাই যাকে বিয়ে করেছো সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে শেখো। নাহলে নিজের হাত কামড়ানোর মতো দশা হবে।”

আরসাল সেহেরর দিকে এগিয়ে এসে সেহেরের মুখ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি আসি জান!”

সেহের মুচকি হাসি দিতেই, আরসাল সেহেরের কপালে একটা চুমু একে দেয়। যাহ দেখে নেহা রেগে নিজের রুমে চলে যায়। আরসাল আর সেহের নেহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে দেয়।

★★★
আশা বিছানা গুছিয়ে রাখছিলো। হঠাৎ আশার মাথা ঘুরিয়ে বমি আসলে, তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে যায় আশা। কয়েকদিন ধরে আশার শরীর টাহ একদম ভালো যাচ্ছে নাহ। প্রায় মাথা ঘোরায়, বমি আসে। একবার আমান কে বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু পরে আর বলা হয় নি। পরে আবার ভেবেছে নিজে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবে কিন্তু আর যাওয়াও হয় নি। আজকাল ব্যাপার টাহ বেড়েছে, এইবার ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে চলে যায়। নিচে মিসেস. আখিকে বলে ডাক্তারের কাছে চলে যায় আশা।
ডাক্তার শায়লার সামনে বসে আছে আশা। ইনি আশাদের সবার সাথে অনেক দিনের পরিচিত। বাড়ির সবার চিকিৎসা ডক্টর শায়লা করে থাকেন। কিছু সময় পর ডাক্টর শায়লা বলে ওঠে,
–” আশা!”

–” জি আন্টি।”

–” আমি কাল কিছু কাজে একটু বাহিরে যাচ্ছি। আমি নিজে তোমার টেস্ট রিপোর্ট বানাতে চাই। তাই আমি পরশু এসে তোমার রিপোর্ট বানিয়ে তোমাকে কল দিবো। ওকে!”

–” ওকে আন্টি! বাট সিরিয়াস কিছু হয়ছে কি?”

–” নাহ আবার হ্যা ও বলা যায়।”

–” মানে?”

–” মানে টাহ আমি এখনও বলবো নাহ। আগে আমি রিপোর্ট বানাই, সিওর হই, তারপর বলবো। ওকে। বাট টেনশনের কোনো কারন নাই। ওকে?”

–” ওকে আন্টি। আমি আসি তাহলে?”

–” হুম!”

★★★
সেহের কিছু কাজে বিকালের দিকে লাইব্রেরীতে এসেছিলো। এখন বাইরে দাড়িয়ে আছে। ড্রাইভার কে ফোন দিয়েছে, ড্রাইভার আসছে বললো। হঠাৎ সেহেরের সামনে এসে একটা গাড়ি থামতেই সেহের একটু সরে পাশে দাড়ায়। গাড়ি থেকে ইয়াশকে নেমে আসতে দেখতেই সেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইয়াশের দিকে। ইয়াশ সেহেরের সামনপ আসতেই সেহের একটু পিছিয়ে যেতেই ইয়াশ বলে ওঠে,
–” আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসি নি সেহের। কিছু কথা বলতে এসেছি। খুব ইম্পর্টেন্ট।”

–” আমার আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছা নাই।”

–” সেহের কাল রাত ১১ টায় ফ্লাইট। আমি আর রাহুল সারাজীবনের জন্য এই বিডি ছেড়ে বিদেশে চলে যাচ্ছি।”
কথাটাহ শুনতেই সেহের অবাক হয়ে ইয়াশের দিকে তাকাতেই ইয়াশ বলে ওঠে,
–” প্লিজ সেহের। কিছু সময় কথা বলবো। প্লিজ! লাস্টবারের মতো একবার বিশ্বাস করো। প্লিজ।”

সেহের আর ইয়াশ একটা কফিশপে বসে আছে। সেহের ইয়াশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” বলো কি বলবে?”

–” সেহের ফাস্টেই তোমাকে সরি বলি! সেইদিনের জন্য। সেইদিনের ইয়াশ আর আজকের ইয়াশের মাঝে অনেক পার্থক্য। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দেও।”

–” It’s ok! তুমি যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এইটায় বেশি।”

–” Thanks! সেহের, তোমাকে একটা সত্যি কথা বলার আছে।”

–” কি কথা বলো।”

–” সেহের সেইদিনের রিসোর্টে যে আগুন লেগেছিলো সেইটা রাহুল নাহ আমি লাগিয়েছিলাম।”
ইয়াশের কথা শুনে সেহের চমকে ইয়াশের দিকে তাকাতেই ইয়াশ আস্তে আস্তে সেহেরকে সব বলে দেয়। রাহুল সেহেরকে কতটা ভালোবাসে, বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর রাহুলের অবস্থা, রাহুলের এই অবস্থা সইতে নাহ পেরে ইয়াশের নিজের রাগের বশে রিসোর্টে আগুন লাগানো, রিসোর্টে আগুন লাগার কথা শুনে রাহুলের অবস্থা, সেহের রাহুলকে ভুল বুঝে চলে যাওয়ার পর রাহুলের অবস্থা, আর আজ সকালে রাহুলের বিদেশে চলে যাওয়ার কথা, সব বলে দেয় ইয়াশ সেহেরকে। সেহের যেনো থমকে গেছে ইয়াশের কথা শুনে। ইয়াশ মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
–” Rahul is best person in my life. জানো সেহের, রাহুলের আম্মু মানে আমার ফুপ্পি রাহুল হওয়ার সময় মারা যায়। রাহুল কখনো ওর মায়ের ভালোবাসা পায় নি। মায়ের ভালোবাসা কি তাই বুঝে নি। তাও কখনো বখে যায় নি। আমি ছোটবেলা থেকেই রাহুলের সাথে থাকতে খুব পছন্দ করতাম। আমাকে অনেক ভালোভাবে গাইড করতে পারে। সমবয়সী হলে ও একটু ম্যাচিওর ছেলে ছিলো অলটাইম। আমাকে অনেক সুন্দর করে ম্যানেজ করতে পারতো। ছোট বেলা থেকেই ওকে খুব ভালোবাসি। ওর কোনো কথা যেনো ফেলতে পারি নাহ। ওকে আমি দেখেছি, ও কোনো মেয়ের দিকে তাকাতোই নাহ। সেখানে আমি তোহ একটা প্লেবয়। বাট ও একদম আলাদা। কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলতে চাইতো নাহ। সেই রাহুল কি নাহ একটা মেয়েকে এতো ভালোবাসে। ভাবতেও পারি নাহ বিষয় টাহ। যাই হোক, তুমি প্লিজ রাহুলের উপর রাগ করে থেকো নাহ। ও, তোমাকে অনেক ভালোবাসে সেহের। ও, চাই তুমি সুখী হও। আরসালের সাথে সুখী হও।”
সেহের কিছু নাহ বলে কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসে। ইয়াশ সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসে কফিশপ থেকে।

★★★
আশা সোফায় বসে বসে টিভি দেখছিলো। কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলে দেখে আমান। আমানকে দেখে আশা একটা মুচকি হাসি দেয়। আমান ভেতরেই ঢুকতেই আমানের পেছন পেছন একটা মেয়ে আসতেই আশা অবাক হয়ে আমানের দিকে তাকায়। আশা আমানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমান ওনি কে?”

–” ওর নাম জেরিন।”
জেরিন নাম শুনতেই আশা চমকে তাকায় আমানের দিকে। মিসেস. আখি এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” আরে আমান এই মেয়েটা কে?”

–” আম্মু ও জেরিন। আজ থেকে এই বাসায় কয়েকদিন থাকবে।”

–” ওহ আচ্ছা!”
আশা যেনো এখনো চমকে আছে। আমান ওর প্রাক্তন প্রেমিকাকে বাসায় নিয়ে এসেছে আবার বলছে বাসায় থাকবেও। আশা যেনো ব্যাপার টাহ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে নাহ। আশা একবার আমানের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। আমান আশার যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে, একজন সার্ভেন্ট কে জেরিন কে গেস্ট রুম দেখিয়ে দিতে বলে নিজের রুমে চলে আসে।
আশা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। আমান আশার পিছনে দাড়াতেই আশা টের পায় আমান পিছে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু আশা কিছু বলে নাহ। আমান বলে ওঠে,
–” আশা আমার কথাটা শোন।”

আশা পিছন ফিরে নাহ৷ সেইভাবেই দাড়িয়ে থাকে। আমান আবার বলে ওঠে,
–” আশা প্লিজ। আমার কথাট শোন। জেরিন অনেক বিপদে আছে। তাই আমি নিয়ে আসছি। অন্য কোনো কারন নাই।”

আমান আশাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে দেখে আশার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। আমান আশার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” এই পাগলী তুই কাদছিস কেনো?”

–” তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে নাহ তোহ? আমি তোমাকে ছাড়া কিন্তু বাঁচতে পারবো নাহ।”

–” কি বলছিস তুই এইসব? আশা, জেরিন চমার অতীত। কিন্তু তুই তোহ আমার বর্তমান ও ভবিষ্যত। আমার জীবনে এখন শুধু তুই।”
আশা আমানকে জড়িয়ে ধরলে আমানও আশাকে জড়িয়ে ধরে। আর ওদের এইসব দেখে জেরিন শয়তানি হাসি দিয়ে মনে মনে বলতে থাকে,
–” আহারে, বেচারী আশা। আফসোস হচ্ছে তোনার জন্য। তোমার এই সুখের সংসার বেশি দিনের নাহ। সাইফ তোমাকে পেতে চাই নাহ, শুধু তোমার সংসার ভাংতে চাই আর আরসালের ক্ষতি চায়। আর আমি এসেছি তোমার সংসার ভাংতে।”

★★★
নেহা নিজের রুমে বসে বসে ফোন চালাচ্ছে। আশফি মাত্র অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হলো। আশফি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করছে, হঠাৎ একজোড়া হাত আশফিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই আশফির বুঝতে দেরি হয় নাহ, মানুষটাহ তার ভালোবাসার মানুষ নেহা। আশফি পেছনে ঘুরে নেহার টিশার্টের নিচে হাত দিয়ে চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। নেহার আশফির মুখ ধরে আশফির কপালে একটা চুমু দিতেই আশফি মুচকি হাসি দেয়। আশফিও নেহার কপালে একটা চুমু একে দেয়। নেহা আশফির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আশফি, তুমি বিশ্বাস করো তো আমি তোমাকে ভালোবাসি?”

–” কি বলছো তুমি এইসব?”

–” আশফি, বলো বিশ্বাস করো তোহ?”

–” চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি তোমাকে।”

–” I love you Ashfi.”

–” I love you too my jan.”
নেহা আশফিকে জড়িয়ে ধরলে আশফিও নেহাকে জড়িয়ে ধরে। নেহা শয়তানি হাসি দিয়ে মনে মনে বলতে থাকে,
–” কাল তোমাকে প্রথম ডোজ দিবো আশফি। Arsal! Wait and watch for your surprise.”

আশফি অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। নেহা আশফির পেছনে এসে বলে ওঠে,
–” আশফি!”

–” হুম।”

–” বলছি যে, তোমাদের অফিসের এম ডি কে?”

–” বড় আব্বু, বাট আরসাল ভাইয়া কে দায়িত্ব দেওয়া হবে।”

–” ওহ! তাহলে তোমার কাজ কি?”

–” মানে?”

–” মানে, তোমার কি হবে এই অফিসে কাজ করে? ভবিষ্যত কি তোমার?”

–” নেহা তুমি কি বলতে চাচ্ছো আমি বুঝতে পারছি নাহ। ক্লিয়ারলি বলো।”

–” দেখো, আশফি! কি পেয়েছো তুমি? আরসাল বিদেশ থেকে হায়ার স্টাডি করে আসছে। আর তুমি? বিডি তে স্টাডি করেছো। আরসাল এতোদিন বিদেশে ছিলো অথচ দেশে এসেই এখন কম্পানির এম ডি হয়ে যাচ্ছে। আর তুৃমি কি পেলে? এতোদিন অফিসে কাজ করে এখন আরসালের গোলামি খাটবে?”
নেহার কথা শুনে আশফি মুচকি হেসে বলে ওঠে,
–” অবশেষে নেহা কে আমি চিনলাম।”

–” মানে?”

–” তোমাকে যেইদিন বিয়ে করে আমি এই বাড়িতে এনেছিলাম। পরের দিন আমার গুরুর উক্তি ছিলো, আমি নাকি নিজের অজান্তেই আগুনে ঝাপ দিয়েছি।’

–” গুরু? কে তোমার গুরু?”

–” পারবে তোহ নামটা সহ্য করতে?”

–” মানে?”

–” মানে হলো আমার গুরুর নাম আরসাল চৌধুরী।”
নেহা আশফির দিকে অবাক হয়ে তাকালে আশফি মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
–” নেহা, তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। আমি কি পেয়েছি তাই নাহ? আমি আরসাল চৌধুরীর কাছের থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আরসাল ভাইয়া নিজের ইচ্ছেতে বিদেশে যায় নি। জোর করে পাঠানো হয়েছিলো। চাইলে আমিও যেতে পারতাম। কিন্তু আমি কখনো যেতে চাই নি। আমাদের বিজনেসের এমডি আমাকেই বানাতে চেয়েছিলো ভাইয়া, কিন্তু আমি হতে চাই নি। কারন, তুমি বুঝবে নাহ। বাট আমি আমার লাইফে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। যেটা আরসাল ভাইয়া নিজেও পাই নি।”

নেহা আশফির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আশফি নেহার দিকে তাকিয়ে আবার বলে ওঠে,
–” জানো নেহা, আমি লাইফে আরসাল ভাইয়া কে নাহ জানিয়ে যতবার নিজে একা একা কাজ করেছি ততবার বিপদে পড়েছি বাহ কাজটাহ আমার ভুল হয়েছে। আর সেইটার আবারও প্রমান পেলাম, তোমাকে বিয়ে করে।”

আশফির কথা শুনে নেহা চমকে উঠে। আশফির দিকে তাকিয়ে আছে নেহা। আশফি মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
–” তুমি যদি ভেবে থাকো আমি কিছুই জানি নাহ, তাহলে তুমি ভুল ভাবছো। তুমি আমাকে, আমার ভালোবাসাকে দাবার গুটি হিসাবে সাজিয়েছো। নেহা তোমার একবারও কেনো মনে হলো নাহ যে, আমি কেনো তোমাকে স্পর্শ করি নাহ? কারন এই মুহূর্তে তোমাকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছো। আমার ভালোবাসাকে ঘোড়া বানিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাচ্ছো। কি হবে নেহা এইসব করে? আমার ভাইয়াকে ভালোবাসাে, কিন্তু আমার ভাইয়া তোহ তার সবটুকু দিয়ে সেহেরকে ভালোবাসে। কি হবে সেহেরের ক্ষতি করে, পাবে তোহ আরসাল চৌধুরীকে? কিন্তু একটা কথা নেহা, তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী, তোমার খেয়াল আমি রাখবো ততোদিন, যতদিন তুমি আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করবে নাহ। বাট আমার পরিবারের কারো উপর এতোটুকু আচ আসলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো নাহ। তোমার আর আমার সম্পর্ক এখন শুধু বিয়ের, আশফির ভালোবাসা তুমি হারিয়েছো।”

কথাগুলো বলেই আশফি চলে যায়। নেহা বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়ে। আশফির কথাগুলো যেনো ঠিক মেনে নিতে পারছে নাহ নেহা। আশফি ওকে যে ভালোবাসার কথা বলছিলো সব শুধু নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। আজ নেহা আরসালকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু এখন নিজেই সারপ্রাইজ পেয়ে গেলো। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে নেহার, আশফি কে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে নেহার।

★★★
আরসাল নিজের অফিসে কাজ করছিলো। হঠাৎ ফোনে কারোর কলের আওয়াজে তাকিয়ে দেখে আমানের ফোন। আরসাল ফোন রিসিভ করে বলে ওঠে,
–” হ্যা! আমান বল।”

–” দোস্ত তোকে একটা কথা বলার ছিলো।”

–” হুম বল!”

–” জেরিন কে আমি আমাদের বাসায় নিয়ে আসছি।”

–” মানে? কিন্তু কেনো? আর কবে?”

–” গতকাল। ও বলছিলো ও অনেক বিপদে আছে। ওর হাসবেন্ড নাকি ওর উপর অত্যাচার করে। তাই কয়েকদিনের জন্য আশ্রয় চাচ্ছিলো। তাই আমি নিয়ে আসছি।”

–” তোরা নাহ এমন এক একটা কাজ করিস, যে আমি কি করবো বুঝতে পারি নাহ। আচ্ছা ওয়েট! আমি তোর সাথে পরে এই ব্যাপারে কথা বলছি।”

–” ওকে!”
আরসাল ফোন কেটে দিয়ে কিছু সময় চুপ করে বসে থেকে কাউকে ফোন দিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি একটা ফটো পাঠাচ্ছি। আর ফটো টার মেয়েটার নাম জেরিন। ওর সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই।”

বলেই আরসাল ফোন কেটে দিয়ে আশফির কেবিনে গিয়ে দেখে আশফি চুপচাপ বসে বসে কিছু একটা ভাবছে। আরসাল আশফির অপোজিট চেয়ারে বসে বলে ওঠে,
–” কি ভাবছিস এতো?”

কারোর আওয়াজে আশফির ধ্যান ভাঙলে সামনে তাকিয়ে দেখে আরসাল। আশফি আরসালের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” ভাবছি, আমার লাইফ টাই ভুলের উপর দিয়ে গেলো। আজ পর্যন্ত একা একা নিজের জন্য একটা বেস্ট ডিসিশন নিতে পারলাম নাহ। এমন কি লাইফের সবচেয়ে বড় ডিসিশন টাহও নাহ।”

–” নেহার কথা ভাবছিস?”

–” তাছাড়া আর কি? এরকম একটা মেয়েকে এতো ভালোবাসলাম। নাহ পারছি, ওকে লাইফ থেকে বের করতে, আর নাহ পারছি ওর কাছে যেতে।”

–” আশফি, তোদের বিয়ে হয়েছে ৪ ৫ দিন হলো। আমি ভেবেছিলাম বিষয়গুলো তোকে বলবো নাহ। তুই নিজেই বুঝে যাবি। বাট পরে আবার ভাবলাম, তোকে আগে থেকে বলে দেওয়া উচিত। কারন নেহা অনেক রকম চাল চালতে পারে, তাতেহ আমাদের পরিবারেই ভাঙন লেগে যেতে পারে। তাই তোকে আগে থেকেই বলে দেওয়াটায় বেটার।”

–” তুই ঠিক করেছিস। আজ ও এরকম একটা কাজ করতে গিয়েছিল। তারপর আর সহ্য করতে নাহ পেরে ওকে সব বলে দেয়, যে আমি সব জানি। ও আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, দাবার গুটি বানাতে চেয়েছে। সব বলে দিয়েছি।”

–” ভালো করেছিস। চিন্তা করিস নাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আরসালের কথা শুনে আশফি আরসালের দিকে তাকালে আরসাল একটা মুচকি হাসি দিতেই আশফি যেনো এক অজানা শান্তি অনুভব করে।

★★★
রাহুল আর ইয়াশ এয়ারপোর্টে চলে এসেছে। রাহুল আর ইয়াশের সব চেকিং কমপ্লিট। ওরা ভিতরে চলে যাবে, কিন্তু তার আগেই কেউ “রাহুল ভাইয়া” বলে ডেকে উঠে। গলার আওয়াজ পেতেই পেছনে তাকিয়ে দেখে আরসাল আর সেহের দাড়িয়ে আছে। রাহুল যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে নাহ। সেহের এগিয়ে এসে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমাকে নাহ বলেই চলে যাচ্ছো।”

–” সেহের তুমি?”

–” তুমি তোহ আমাকে জানালে নাহ। আমার সাথে একবার দেখা করতেও গেলে নাহ। তাই আমি এলাম তোমার সাথে দেখা করতে।”

–” তুমিই তোহ বলেছিলে, আমার মুখ দেখতে চাও নাহ।”

–” তুমি কেনো আমার ভুলটাহ ভাঙিয়ে দিলে নাহ?”

–” সরি!”

–” তুমি কেনো সরি বলছো? সরি তোহ আমার বলা উচিত। কারন অন্যায় টাহ তোহ আমি করেছি।”

–” আমি চাই নাহ তুমি সরি বলো। কারন সরি আমরা তখনই বলি যখন কেউ কারো কাছে অন্যায় করে। কিন্তু তুমি তোহ কোনো অন্যায় করো নি। আর রইলো কথা সেইদিনের ব্যাপার টাহ? ভাগ্যিস তুৃমি ঐদিন ওরকম করেছিলে, তাই আমি আরও খাঁটি হয়ে গেছি।”

–” আচ্ছা, সে কথা যাক। তুমি কি সত্যিই আর দেশে আসবে নাহ? একেবারে চলে যাচ্ছো আমাদের ছেড়ে।”

–” ভেবেছিলাম একেবারেই চলে যাবো। বাট এখন বলছি, আমি আবারও আসবো, বাট সেইদিন আসবো, যেইদিন আমি এসে চাচ্চু ডাকটা শুনতে পাবো।”
রাহুলের কথা শুনে সেহের লজ্জা পেয়ে যায়। সেহেরকে লজ্জা পেতে দেখে আরসাল, রাহুল আর ইয়াশ হেসে দেয়। রাহুল আরসালের সামনে দাড়িয়ে বলে ওঠে,
–” আসি, ওর দিকে খেয়াল রেখো। ও অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। আর সত্যি সত্যি মন থেকে দোয়া করছি, বিশ্বাস করো, একদম মন থেকে দোয়া করছি, তোমরা খুব সুখী হও।”

আরসাল, রাহুলকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,
–” তাড়াতাড়ি বিডি তে ব্যাক করো।”

–” তাহলে তাড়াতাড়ি আমাকে চাচ্চু বানাও। আমি তাহলে তাড়াতাড়ি ব্যাক করবো।”
রাহুলের কথা শুনে আরসাল হেসে দেয়। এনাউন্সমেন্ট দিতে থাকে সবাইকে প্লেনে উঠার জন্য। রাহুল আর ইয়াশ হাত নাড়িয়ে ওদের বিদায় দিয়ে ভিতরে যেতে থাকে। আরসাল আর সেহেরও ওদের বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আসে। সেইদিন ইয়াশের কাছে সবাটাহ শুনে বাসায় এসে সেহের আরসালের কাছে অনেক কান্না করলে আরসাল সেহেরকে এয়ারপোর্টে এসে রাহুলকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা বলে। তাই ওরা আজ এয়ারপোর্টে এসেছিলো।
বাসায় আসতে আসতে প্রায় রাত ১১ঃ৩০ বেজে যায়। আরসাল আর সেহের রুমে আসতেই নেহা তাড়াতাড়ি ওদের রুমে এসে বলে ওঠে,
–” আরসাল আশফি এখনো বাসায় আসে নি।”

–” তাতে তোমার কি?”

–” আরসাল প্লিজ! আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। প্লিজ আরসাল বলো নাহ, আশফি কোথায়?”

–” আমি জানি নাহ।”

–” আমি হাত জোর করছি আরসাল। আমি আশফির সাথে থাকতে চাই। ভালোবাসতে চাই ওকে। ও অনেক কষ্ট পেয়েছে। প্লিজ আরসাল। আমি ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে।”

–” আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে কি হবে? যার সাথে অন্যায় করেছো। যার ভালোবাসাকে অপমান করেছো তার কাছে ক্ষমা চাও।”

–” আশফি আমার ফোন টায় তুলছে নাহ।”

–” এইবার তুলবে। যাও ফোন দেও।”
আরসালের কথা শুনতেই নেহা দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। আরসাল সেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে সেহের মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরসাল দুই হাত বাড়িয়ে সেহেরকে কাছে আসতে ইশারা করতেই সেহের এগিয়ে এসে আরসালকে জড়িয়ে ধরে। আরসালও সেহেরকে জড়িয়ে ধরে টাইট করে।

★★★
নেহা নিজের রুমে এসে আশফিকে ফোন দিতেই আশফি কল রিসিভ করলে নেহা কান্না করে দিয়ে বলে ওঠে,
–” আশফি কোথায় তুমি? এতো রাগ আমার উপর। I sorry Ashfi. আমি এখন শুধু তোমাকে চাই। তোমাকে নিয়ে সংসার বাঁধতে চাই। ভালোবাসতে চাই তোমাকে। বলতে চাই, #তুমি_শুধু_আমার। প্লিজ আশফি চুপ করে থেকো নাহ, কিছু তোহ বলো?”

–” আমাকে তোমার কি দরকার? তুমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলে ঐ বাসায় থাকার জন্য, পেয়ে গেছো। চেয়েছো তোহ আরসাল ভাইয়া কে, তাকে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাও। দেখো পারো কি নাহ? যদি চেষ্টা করার পর আরসাল ভাইয়াকে নাহ পাও, আমাকে জানিয়ো, তখন আমি তোমার কাছে আসবো। কারন তুমি আমার ভালোবাসাকে দাবার গুটি সাজালেও, আমি যে তোমাকে ভালোবাসি।”

–” আশফি প্লিজ। আমার আর কাউকে চাই নাহ। আমার শুধু তুমি হলেই চলবে। সকালে যে নেহাকে দেখে তুমি বাসা থেকে বের হয়েছো, সেই নেহা তোমার সকালের বলা কথায় খাটি সোনা হয়ে গেছে। আমার আর কাউকে লাগবে নাহ। আমার তোমাকে চাই। প্লিজ বাসায় আসো। হ্যালো! হ্যালো! আশফি?”
ফোন কেটে দিয়েছে আশফি নেহা জোরে জোরে কান্না করতে থাকে। কিছু সময় পর রুমে কারো আওয়াজ পেয়ে নেহা সামনে তাকিয়ে দেখে আশফি দাঁড়িয়ে আছে। নেহা দৌড়ে আশফিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। কিন্তু আশফি ধরে নাহ নেহাকে। নেহা কান্না করতে করতে বলে ওঠে,
–” I am sorry. প্লিজ, আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আর কখনো আমি এমন করবো নাহ। প্লিজ, আশফি আমাকে ক্ষমা করে দেও।”

আশফি আস্তে আস্তে নেহার মাথায় হাত রেখে বলে ওঠে,
–” ঠিক আছে, আর কান্না করতে হবে নাহ। তুমি হয়তো জানো নাহ, তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারি নাহ। So, don’t cry.”

নেহা আশফির থেকে সরে এসে আশফির দিকে তাকিয়ে থাকে। আশফি নেহার চোখ মুছে দিয়ে বলে ওঠে,
–” স্মাইল করো।”

–” তুমি এখনো আমাকে স্মাইল করতে বলছো?”

–” হুম! কারন ভালোবাসি যে।”
নেহা আবার আশফিকে জড়িয়ে ধরলে, আশফিও নেহাকে জড়িয়ে ধরে।

★★★
সকালবেলা আরসালের ফোনে একটা কল আসলে আরসাল ফোন টাহ রিসিভ করে যাহ শোনে, তাতে আরসালের ঠোঁটে বাকা হাসি ফুটে উঠে। এইবার আরসালের বাকি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আরসাল আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে, বেরিয়ে যায় রুম থেকে।

চলবে…………….🌹