জীবন সীমান্তে

0
961

লেখাঃ ফাহমিদা আঁখি

ঘড়িতে রাত পৌনে এগারোটা বাজে। আমার বুকে মাথা রেখে, আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সুহা বলল, মা, বাবার কথা মনে পড়েনা তোমার?

ওর কথায় চমকে উঠলাম আমি। কতগুলো বছর কেটে গেছে সময়ের অগোচরে। প্রতিটি স্মৃতি যেন স্মৃতির পাতায় জর্জরিত। কাউকে মনে রাখার অবকাশ পেয়েছি কি আমি? হয়তো পেয়েছি। কিন্তু সেটা সুহার বাবা নয়। আজ হঠাৎ এ কথা জানতে চাইছিস কেন রে?

জানিনা মা। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমি তো কোনোদিন বাবাকে দেখিনি। ছোটবেলায় আমার বয়সী ছেলেমেয়ে যখন বাবা, বাবা বলে অস্থির। আমি তখন বোবা হয়ে থাকতাম। বুঝতে কষ্ট হতো বাবা কাকে বলে? সে কি মায়ের মতো? তারপর যেদিন প্রথম তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম মা, আমার বাবা কোথায়? তোমার হাস্যজ্জ্বল মুখটা সেদিন কেমন মলিন হয়ে গিয়েছিল। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেছিলে, আমিই তোর মা আর আমিই তোর বাবা। সেই ছোট্ট বয়সে আমি এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, আর কখনো বাবার কথা জানতে চাইবোনা। কারণ আমার মায়ের মুখটা আমি কখনো মলিন দেখতে পারবোনা। কিন্তু মা, আজ এতোগুলো বছর পর আমার মনে হয়, তুমি খুব একা। আমি জানি, রোজ রাতে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদো। বিড়বিড় করে কিসব বলো। আমার তখন খুব ইচ্ছে করে। তোমার কাছে যাই। তোমাকে জড়িয়ে ধরি। তোমার সকল ব্যথা ভুলিয়ে দিই। বলোনা মা, কেন তুমি রোজ কাঁদো? এই কান্না কি আমার বাবার জন্য?

অনেকদিন পর পুরানো ব্যথারা সব জেগে উঠলো। কত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা আমার। এখন আর সেসব কথা লুকানোর উপায় নেই। আর লুকিয়েই বা লাভ কি? আমার জীবনের গল্পটা না হয় এবার কেউ জানুক। সুহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, একটা গল্প শুনবি?
কিসের গল্প মা?
এক পরাজিত মেয়ের গল্প। কিংবা বলতে পারিস, অপরাজিত……।

কিছুটা অবাক হয়ে সুহা বলল, হুম, শুনবো।

আমি তখন সবে মাধ্যমিক দিয়েছি। পড়াশোনা নেই। হাতে অফুরন্ত সময়। সারাদিন এদিকওদিক ছুটে বেড়ানোই ছিলো আমার কাজ। খুব দুরন্ত ছিলাম কিনা। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে তখন ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক তৈরি হচ্ছিল। হচ্ছিল বলতে হয়ে গিয়েছিল। শুধু উদ্বোধন বাকি ছিলো। গাড়ি চলাচল শুরু না হওয়ায় আমরা সেই মহাসড়কে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন শখের বসে একটা লাল রঙের শাড়ি পরে সেই মহাসড়কে মহারাণীর মতো বিচরণ করেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি, সেদিন শুধু মহাসড়কে নয়, কারো মনেও বিচরণ করেছিলাম। তার ঠিক দুদিন পর, বাড়িতে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র নাকি আমাকে সেই মহাসড়কে দেখেই পছন্দ করেছিল। সেই মুহূর্তে আমার অনুভূতি কেমন ছিলো বলতে পারবোনা। শুধু এইটুকু জানতাম, আমি মুক্তি চাইছিলাম। আমার মা, একা সংসার সামলাতেন। আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করে আলাদা থাকতেন। শুধু মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসতেন মাত্র। মা, বাবাকে কিছুই বলতো না। কারণ বাবার প্রতি মায়ের ছিলো অগাধ ভালোবাসা। সংসারের এমন টানাপোড়নের মধ্যে বড় ভাই বিয়ে করে ঘরে বউ আনে। কিন্তু সে কোনো রোজগার করতোনা। ফলে সংসারের খরচ চালানো মায়ের জন্য খুব কষ্টকর ছিলো। মা, তার ভাইদের চেষ্টায় আমার বড় বোনের বিয়ে দিয়েছিলো। বাকি ছিলাম আমি। সংসারে আমার অবস্থানটা কোথায় আমি কখনো বুঝতে পারিনি। আমি ছিলাম উড়নচণ্ডী। সামান্য ভুলে মা, ভাইয়ের মারমুখী আচরণ সহ্য করেছি। সেই অবস্থায় বিয়ের প্রস্তাবে একবাক্যে রাজি হয়ে যাই। কেউ তাতে অবাক হয়নি। শুধু মা একবার বলেছিল, তনু তুইতো এখনো অনেক ছোট। বিয়ে দিলে সংসার সামলাতে পারবি? আমি বিজ্ঞজনের মতো গলা টেনে বলেছিলাম। হ্যা, পারবো। তুমি বিয়ে দিয়েই দেখোনা। আমার কথায় সেদিন বাড়ির সকলে হেসেছিল।

দিনক্ষণ দেখে বেশ ধুমধাম করে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে, বাসর এসব নিয়ে প্রতিটি মেয়েরই একটা অদ্ভুত অনুভূতি লুকিয়ে থাকে। আমারও ছিলো বোধহয়। কিন্তু বাসরঘরে আমি ভয়, চিন্তা, অস্থিরতায় ঘেমে নেয়ে উঠছিলাম। আমার তখন পিরিয়ড চলছিল। একথা মুখ ফুটে আমার স্বামীকে বলার মতো সাহস আমার ছিলোনা। মাত্র ষোলো বছরের কিশোরী তখন আমি। আমার স্বামী আমার খুব কাছে এসে, আমার কানে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, তনয়া, তোমাকে একদম স্বর্গের অপ্সরার মতো লাগছে। আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ লোকালাম। সেই রাত আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ এর কথা কল্পনা করে কাটিয়েছিলাম। আমার ভাবি আমার স্বামীকে বলেছিল, আমার সাময়িক অসুস্থতার কথা। আমি সেদিন সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম আমার স্বামীর প্রতি। এরপর কেটে যায় কতশত রজনী। আমরা একে অপরের কাছে মেলে ধরি আমাদের আপন সত্ত্বা। আমার ছোটছোট ইচ্ছেগুলো নিমিষেই পূর্ণ হয়ে যেতো। যা বিয়ের আগে কখনো হয়নি। আমরা রোজ বিকেলে নদীর ধারে ঘুরতে যেতাম। গাঙচিলের উড়ে বেড়ানো দেখতাম। দুজনে পাশাপাশি বসে সন্ধ্যার ছায়া নামতে দেখতাম। আমি খুব ভালো গান গাইতে পারতাম। একদিন একটা টেপরেকর্ডার হাতে নিয়ে এসে বললেন, কই দেখি, রবীন্দ্রনাথের একটা গান শোনাও তো। আমি গান গাইলাম। আর উনি তা রেকর্ড করলেন। মাঝেমাঝে বেলি ফুলের মালা এনে বলতেন, একটু কাছে আসো তো। মালাটা খোঁপায় বেধে দিই। উনার এমন আহ্লাদে আমার নারীত্ব গগনচুম্বী হতো। উনার এই ছোটছোট পাগলামো দেখে আমি সুখ পেতাম। নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হতো।

বিয়ের একবছরের মাথায় আমার মা মারা গেল। মারা যাওয়ার পর টের পেয়েছিলাম মায়ের ভালোবাসা কাকে বলে। একমাত্র মায়ই আমাকে নিয়ে চিন্তা করতো। বলতো, পাগলিটা ঠিকঠাক সংসার করছে তো? আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম, আমার স্বামীর ভালোবাসায়।

কিন্তু বিয়ের দুবছর পরেও যখন আমি গর্ভধারণ করতে পারলামনা, তখন সব ভালোবাসা যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। সন্তান ধারণের জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই সক্রিয় হতে হয়। আমার স্বামী ছিলো নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ সে কখনো বাবা হতে পারবেনা। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। শুরু হলো আমার পাগলামো। রোজ অশান্তি করতে লাগলাম। আমার স্বামী আমার কাছে আসলে, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতাম। চিৎকার করে বলতাম, শুধুমাত্র শারীরিক সুখ নিয়ে তোমার সাথে সংসার করতে পারবোনা আমি। আমার একটা সন্তান চাই। আমার স্বামী আমাকে শান্ত হয়ে বোঝাতে চাইতো। বলতো, দেখো তুমি এমন করোনা। আমরা একটা সন্তান দত্তক নিতে পারি। দেখবে আমরা অনেক সুখী হবো। তাতে আমি আরও রেগে যেতাম। কেন আমি অন্যের সন্তান দত্তক নেবো? কেন আমার সন্তান হবেনা? রাগে, দুঃখে কান্নায় ভেঙে পড়তাম।

নিত্যদিনের এই অশান্তির মাঝে আমার পরিচয় হয় নতুন এক ব্যক্তির সাথে। যে আমাদের পাশের বাসায় থাকতো। সে ছিলো বিরাট ব্যবসায়ী। তার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বে পরিণত হয়। আমার সবকথা তার সাথে শেয়ার করতাম। আমার দুঃখগুলো সে বুঝতো। আমি যে কোনোদিন মা হতে পারবোনা, এজন্য সেও দুঃখ করতো। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। একদিন সে আমার হাত দুটো ধরে বলল, তনয়া আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। ওর কথায় আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মাথায় একটা চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি মা হতে চাই। আমার স্বামী ছোট বাচ্চাকাচ্চা দেখলেই কোলে তুলে নিয়ে আদর করতো। যেন তার নিজের সন্তান। আমাদের এক প্রতিবেশীর মেয়ে ছিলো তারমধ্যে বিশেষ কেউ। আমার স্বামী মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো দেখতো। যা আমি সহ্য করতে পারতাম না। মেয়েটা আমাকে ছোটমা আর আমার স্বামীকে ছোটবাবা ডাকতো। একদিন কি কারণে মেয়েটার ওপর রেগে গিয়েছিলাম খুব। আমার স্বামী সেদিন প্রথম আমার গায়ে হাত তুলেছিল। যা আমার ভেতরের হিংস্রতাকে আরও জাগ্রত করেছিল। সেদিনই আমি তাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। যা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। যেদিন আমাদের ডিভোর্স হয়, সেদিন তার চোখের কোণে জল দেখেছিলাম। মিনতির সুরে আমাকে বলেছিল, তনয়া, আমাকে ছেড়ে যেওনা। প্লিজ! যেওনা। তার কোনো কথায় সেদিন আমাকে দূর্বল করতে পারেনি। আমি ঠিকই তাকে ডিভোর্স দিই এবং দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই আমার সেই বন্ধু সজীব চৌধুরীর সঙ্গে।

সুহা, একথায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। সজীব চৌধুরী তো আমার বাবার নাম। তারমানে আমি তোমার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। সুহাকে খুব আহত মনে হলো।

আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। তারপর আবার বলতে শুরু করলাম।

তোর বাবার সঙ্গে আমি সুখী ছিলাম কিনা জানিনা। তবে সবসময় নিজের ভেতরে এক শূন্যতা অনুভব করতাম। তারপর তুই এলি আমার কোল আলো করে। তাতে তোর বাবাকে খুব একটা খুশি মনে হয়নি। কারণ আমি শুধু চেয়েছিলাম একটা সন্তান। সে চেয়েছিল পুত্র সন্তান। এই নিয়ে শুরু হলো আমার জীবনে নতুন অশান্তি। কিছুদিন পর তোর বাবা বিদেশ পাড়ি দিলো। আমি একা খেয়ে না খেয়ে তোকে নিয়ে দিন পার করতে লাগলাম। বছর তিনেক পর তোর বাবা ফিরে এলো। আর লোকের কথায় কান দিয়ে আমার ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালাতে লাগলো। সে বিদেশ থাকাকালীন আমি পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলাম এই দোষে সে তোকে সহ আমাকে ঘর ছাড়া করলো। আমি দুচোখে ঝাপসা দেখছিলাম। আমার তখন মনে হচ্ছিল, এ আমার পাপের ফল। আহসানকে ছেড়ে আসার শাস্তি।

তারপর নানা চড়াই উৎরাই সহ্য করে আমি তোকে বড় করে তুলি। নতুন করে পড়াশোনা করি। আর প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা নিযুক্ত হই। একদিক থেকে তোর মা পরাজিত। যে ভালোবাসার মতো মূল্যবান সম্পদ জয় করে ধরে রাখতে পারেনি। আর একদিক থেকে অপরাজিত। যে বাস্তবতার কাছে হেরে গিয়েও মাথা তুলে দাঁড়াতে পিছপা হয়নি।

সুহার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমার মেয়েটা একসাথে এতোকিছু সহ্য করতে পারবে তো?

অনেকদিন পর মা, মেয়ে মিলে সেই নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। সবকিছু আর আগের মতো নেই। বেশ বদলে গেছে। হঠাৎ কাউকে দেখে থমকে গেলাম আমি। চোখাচোখি হতেই অস্ফুট স্বরে ডাকলাম, আহসান! আহসান বলে উঠল, তনয়া! তুমি এখানে? আমি ভারসাম্য হারাতে যাবো, এমন সময় সুহা এবং আহসান আমাকে ধরে পাশেই কাঠের বেঞ্চিতে বসালো। সুহা চিন্তিত কণ্ঠে বলল, মা তুমি ঠিক আছ? চোখের ভাষায় ওকে আশ্বস্ত করলাম, আমি ঠিক আছি। আহসান বলে উঠল,
-এই বুঝি তোমার মেয়ে?
-আমি স্মিত হাসলাম মাত্র।
-বেশ মিষ্টি দেখতে।

মেয়েটা আমাদের একা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে দূরে গিয়ে বসলো। আমি চোখ মেলে আহসানকে দেখলাম। বয়সের ভাড়ে ওকে বৃদ্ধ লাগছে ঠিকই। কিন্তু ওর চেহারার জ্যোতি আমার দুচোখ ঝাপসা করে দিচ্ছে। ওর সামনে নিজেকে খুব নগণ্য মনে হচ্ছে। পাপ করেছি আমি। পাপিষ্ঠা আমি। আমার মনের ভাব আহসান হয়তো বুঝতে পেরেছিল। তাই সে হঠাৎ বলল, গান শুনবে? আমি আমার কোঁচকানো ভ্রু যুগল আরও একটু কুঁচকিয়ে ওর দিকে তাকালাম। ও সেই টেপরেকর্ডার টা বের করলো। আর তাতে আমার গাওয়া সেই গানটা ছাড়লো।

“জীবন মরণ সীমানা ছাড়িয়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছে দাঁড়িয়ে।”

জীবনের শেষ সীমান্তে এসে, কিছু অতীত ফিরে পাওয়া কতটা সুখের তা হয়তো কখনো বলে বোঝানো যাবেনা……

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে