কৃষ্ণকলি পর্ব:- ০১

0
3981

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ছয় বছর পর বাঁধনের সাথে দেখা। ভাবতেই পারিনি, ওর সঙ্গে এভাবে দেখা হবে।
এই ছয় বছরে অনেক বদলে গেছে বাঁধন। সেই চঞ্চল বাঁধন আর এখনকার শান্ত, সভ্য বাঁধনের মধ্যে অনেক তফাত।
আমি এই বিরতিতে বাঁধনকে প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন পড়ন্ত বেলায় ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর জীবনের হিসাব কেমন যেন পাল্টে গেল।
মাথা নিচু করে রাস্তায় হাটছিলাম। হঠাৎ উপরের দিকে তাকাতেই বাঁধনকে দেখলাম।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম! কোনো দ্বিধা না করে বলে ফেললাম, কেমন আছেন?
ভালো। ছোট করে বলেই থেমে গেল বাঁধন। আমার মুখে তখন আর কোনো ভাষা ছিল না। কিছু সময় নিরবতা, তারপর আচমকা বাঁধনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসল, আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারিনি!!
স্মিতহাস্যে বললাম, কৃষ্ণকলি। “কৃষ্ণকলি”
আমার নাম।

অতীতে ফিরে গেলাম আমি। ২০১০সালে বাঁধনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার। পরিচয়টা ফেসবুকে’ই। তারপর ঘনিষ্ঠতা, ঘনিষ্ঠতা থেকে আন্তরিকতা। মনের অজান্তে’ই ওকে নিয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে ফেলেছিলাম। খুব বেশী ভালোবেসেছিলাম ওকে। এতটাই ভালো যা লিখে বুঝানোর মত নয়। সেও যে আমাকে ভালোবাসে নি, তাও কিন্তু নয়। বাঁধনও আমায় ভালোবাসত, কিন্তু কখনো বুঝতে দিত না। বুঝতে না দিলেও আমি ওর মনের না বলা কথাগুলো ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম। রিলেশনের দু’বছরের মাথায় বাঁধন আমার কাছে একটা জিনিস চাই। আমার ছবি চাই। আমার কাছে বাঁধনের প্রথম আবদার, পূরণ করা’ই যেত। কিন্তু করিনি। বাঁধনকে ছবি দিতে অস্বীকার করলাম। প্রচন্ড অভিমানে বাঁধন আমার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। তারপর অতিবাহিত হয়ে যায় দীর্ঘ একটা বছর।
সেদিন হসপিটালের বিছানায় আধাশোয়া অবস্থায় তন্ময় হয়ে মান্না দের গান শুনছিলাম। বাঁধনকে হারিয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম আমি। অসুস্থ হয়ে পুরো একবছর মনোরোগ বিভাগে থাকতে হয়েছিল আমাকে। কয়েকদিন ধরে শরীরের অবস্থাও বেশী ভালো যাচ্ছিল না। বান্ধবীর জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হয়ে’ই তাই দু’দিন ধরে হসপিটালে আছি। গান শুনার ফাকে একসময় পাশের কেবিনের এক রোগীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ’ই ফোন’টা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতে’ই মনে হলো চোখে কিরকম সরষে ফুল দেখছি। ফোন’টা চোখের কাছ থেকে আরো কাছে নিয়ে আসলাম।
চমকে উঠলাম। এ যে বাঁধন!
এতবছর পর কি মনে করে? কানে নিয়ে কথাটা বলতে’ই ও জবাব দেয়, তোমাকে দেখব। দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। তোমাদের এলাকার পরিত্যক্ত সেই জমিদারী আমলের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানকার কথা তুমি প্রায়’ই বলতে। ৩০ মিনিটের ভেতর তুমি এখানে আসো, আমি তোমায় সামনাসামনি দেখতে চাই।

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফেললাম। বান্ধবী ডাঃ নুসরাতকে বলেই ছুটে চললাম এলাকার দিকে। মিনিট দশেকের ভেতর পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত স্থানে। সি.এন.জি থেকে নামতেই দেখলাম একটা অচেনা যুবক গিটার হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। বাঁধনকে চিনে নিতে আমার ভুল হয়নি, বুঝতে অসুবিধে হয়নি এই আমার বাঁধন! এক’পা দু’পা করে এগিয়েও পিছু হটলাম।
সেদিন বাঁধনের সামনে যেতে পারিনি। বাঁধন ছিল আমার কল্পরাজ্যের রাজকুমারের চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর। এত সুন্দর-সুদর্শন যুবকের পাশে আমি যে বড্ড বেমানান। কারণ- আমি কালো। শুধু কালো নয়, অনেক বেশী’ই কালো। মনে ভয় ছিল এমন কালো চেহেরা নিয়ে ওর সামনে গেলে যদি ও ফিরিয়ে দেয়? যদি হারিয়ে যায় ভালোবাসার এই তীব্রতা’টুকু? তার চেয়ে ভালো ওর কাছে অপ্রকাশিত’ই থাকা। বাঁধন ফিরে গিয়েছিল সেদিন। এরপর হাজার চেষ্টা করেও ওর সাথে কথা বলতে পারিনি। পারিনি কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে। আর করব’ই বা কিভাবে?
ও যে যোগাযোগের সব মাধ্যম’ই ছিন্ন করে দিয়েছিল। বন্ধ করে দিয়েছিল ফোন নাম্বার। ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছিল। অন্য আইডি খুলে নক করেছিলাম। যার কারনে আইডি’টাই ডিএক্টিবেট করে দেয়। এভাবেই আমার সব স্বপ্নের ইতি ঘটল। সাজানো স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় আবারো ছটফট করে উঠলাম।
~ কি হলো? বললেন না যে কে আপনি?
বাঁধনের কথায় ভাবনাচ্ছেদ হলো। ফিরে এলাম সুদূর অতীত থেকে আজকের এই নির্মম বর্তমানে। বাঁধনের দিকে তাকি বললাম, কৃষ্ণকলি।
বাঁধন বিরক্তিভাব নিয়ে বলল, কৃষ্ণকলি!
সে’তো গল্প-উপন্যাসে’ই মানায়। আপনি তো কোনো গল্প নন, তাই না? আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি কোনো গল্প বা উপন্যাসের কথা বলছি না। আর এটাও বলছি না আমি গল্পের নায়িকা।
আমার কথা শুনে বাঁধন বলল,
তবে আমি নিশ্চিত আপনি রবীন্দ্রনাথের সেই কৃষ্ণকলি….
বাঁধনের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ ছিলাম।
বাঁধন নিরবতা ভেঙে বলল_
“তবে যায় হোক।
আমি মনে হয় ভুল কিছু বলিনি। আপনি’ই সেই কৃষ্ণকলি, যার রূপের বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ ওনার কবিতায় চমৎকার ও সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।”
বাঁধনের কথার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ওর তুড়ির আওয়াজে দিশা হয়। সামনের দিকে তাকালাম।
– এ এলাকায় নতুন?
বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বললাম, জি!
আজ’ই এসেছি এখানে।
– ওহ! কোথায় উঠেছেন?
জবাব দিলাম, আপাতত বান্ধবীর বাসায় আছি। বাসা খুঁজে পেলে’ই ওখান থেকে চলে যাব। আপনি?
আপনিও এখানকার…..(……)…..???
আমার কথা শুনে মৃদ্যু হেসে বাঁধন বলল, নাহ! আমি ভাড়াটে নয়। এ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আমি। ঐ যে সামনে যে বাসাটি দেখছেন সেটাই আমাদের বাসা। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করব সাহায্য করার। এখন আসি।
আল্লাহ হাফেজ।

বাঁধন চলে যাচ্ছে।
একটু একটু করে দুরে চলে যাচ্ছে।
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে ওর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি….

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে