#মধুবালা [১৪]
#ফারজানা_আক্তার
শুভ্র রেগে যাওয়ার আগেই নাজমা বেগম বলে উঠেন আবার “আমার ছেলের বউকে আমি নিজ হাতে বউ সাজাবো আজ। ছোঁয়া আয়তো মা আমার সাথে। বউ না সাজলে কি বিয়ের অনুভূতি আসে? বিয়ে যখন হবে তবে আমার বিয়ের শাড়ি দিয়েই আমার ছেলের বউ বধু সাঁজবে।”
এটা বলেই ছোঁয়াকে নিজের সাথে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন নাজমা বেগম। বেলাল মির্জা বাঁধা দিলেও উনি আজ কারো কথা শোনেননি। আনজুমা খাতুন তো রাগে দুঃখে নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বড়দের কথা যদি কেউ না শোনে তবে বড়দের আর সেখানে থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই তা আনজুমা খাতুন মনে করেন। বেলাল মির্জা গিয়ে কয়েকবার দরজায় শব্দ করতেই আনজুমা খাতুন দরজা খুলে দেন। নাজমা বেগমের সব রাগ তিনি এখন বেলাল মির্জার উপরই বের করবেন। বেলাল মির্জাও এবার বুঝেছে ছেলের কথা আজ না শুনলে চিরদিনের জন্য ছেলেকে হারাতে হবে তাই তিনি আনজুমা খাতুনকে বুঝাতে এসেছে। অনেক বুঝিয়ে বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুনকে হলরুমে নিয়ে আসে।
লিলিও মায়ের সাথে ছোঁয়াকে তৈরি করতেছে। সোহা বাড়ির অন্য ছোট সদস্যদের সাথে বসে আছে। মান্নান মির্জা জীবন মির্জা সোফায় বসে আছেন কাজি সাহেবের সাথে। জায়েদা বেগম নিজের গলার গহনা এনেছেন ছোঁয়াকে পরানোর জন্য।
ছোঁয়া বারবার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছে সবাইকে কিন্তু কেউই ওর কথা শুনছেনা। ছোঁয়ার মনে ওর মায়ের কথাগুলো ঘুরছে। ওর মা যে বলেছে ওই বালাগুলো না ছোঁয়ার জন্য আর কিন্তু আজ বিয়ে হলে তো ওকে এগুলো পরতে হবে তাই সে কাচুমাচু করতেছে।
অবশেষে ছোঁয়াকে আনা হলো। শুভ্রর পাশে বসানো হলো ছোঁয়াকে। ছোঁয়া মাথা নিচু করে রেখেছে। কাজিকে বিয়ে পড়ানো শুরু করতে বলা হয়েছে তার মাঝেই ছোঁয়া বলে উঠলো ও শুভ্রর সাথে কিছু কথা বলতে চাই। সবাই অনুমতি দিলেন। কিন্তু বেলাল মির্জার একটাই কথা সবার সামনেই বলতে হবে যা বলার। শুভ্র কিছু বলতে চাইলেও ছোঁয়া দিলোনা ওকে ঝামেলা করতে আর। ছোঁয়া কয়েকটা ঢুক গিলে বলে “আম্মু আমাকে প্রমিজ করিয়েছে আমি যেনো ওই বালাজোড়া কখনোই স্পর্শ না করি তবে এটা লিলিকে বলার পর লিলি বলছে আম্মুর সাথে নাকি তোমার কথা হয়েছে। কি বলেছে আম্মু তোমায় বলবে প্লিজ?”
“তুই ছোট মেয়ে এতোকিছু জেনে কি করবি তুই?”
“ছোট হলে বিয়ে করছো কেনো?”
“বাচ্চাদের মতো কথা বলিসনা ছোঁয়া। আমার পরিশ্রমে পানি ঢালিস না।”
“আগে আম্মু কি বলছে শুনবো তারপর বিয়ে।”
“সবার সমানে না হলে বুঝিয়ে দিতাম এই শুভ্রর সাথে তর্ক করার ফল কি ও কত প্রকার। ”
একটু মিনমিনিয়ে বলে শুভ্র কথাটি। ছোঁয়া মুখ ভেং’চি কে’টে বলে “সিরিয়াসলি বলছি আমি আমার মাকে করা ওয়াদা ভা’ঙ’তে কিছুতেই পারবোনা। বিয়ে ক্যানচেল।”
এটা বলেই ছোঁয়া ওটে যেতে নিলে শুভ্র বলে আচ্ছা শোন।
ছোঁয়া বসে আবার। এবার শুভ্র কথা বলা শুরু করার আগেই লিলি বলে উঠে “হুম ভাইয়া তুমি তো নাকি সব জেনেছো। মেজু আম্মু নাকি তোমাকে সব বলেছে। বলো সবাইকে সব সত্যি, বলো সবাইকে ছোঁয়ার জন্ম পরিচয়। সত্যি টা না জানলে সবাই ছোঁয়াকে কথা শুনিয়ে যাবে সারাজীবন।”
এবার ছোঁয়াও বলে আবার জায়েদা বেগমও বলেন শুভ্রকে সব বলার জন্য। কারণ উনি কিছু জানেননা। উনার বিয়ে হয়েছে ছোঁয়া জন্মের তিনবছর পর। ছোঁয়ার সেজু চাচা চাচি সব জানেন কিন্তু উনারা এসবে কোনো কথা বলেননা যা হয় তা দেখেন শুধু চুপচাপ।
সবার রিকুয়েষ্টে শুভ্র সবটা বলার সিদ্ধান্তঃ নিলো। কারণ ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে সবটা জানার।
“আসলে আমি ওইদিন রাতে টিয়া আর ওর মা বাবার কথা শোনে জানতে পেরেছি ছোঁয়ার জন্ম পরিচয়ে রহস্য আছে। বাড়ির বড় রা কিছু লুকিয়েছে আমাদের থেকে। তারপর আমি মেজু আম্মুর কাছে যায়। মেজু আম্মুর কাছে গিয়ে জানতে পারি যে শুধু আমরা ছোট রা না বরং ছোট চাচিও অজানা এই রহস্য থেকে। আমি জানতে পারি যে ছোঁয়া এই বংশেরই মেয়ে কিন্তু আমার আব্বু আর দাদি এই কথা কখনোই বিশ্বাস করেনি।”
কথাগুলো শুনেই ছোঁয়ার চোখ জলে টলমল করে উঠলো, মুহুর্তেই গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে নোনাজল। ছোঁয়া মনে করতো সবসময়ই ওর জন্ম পরিচয়ে হয়তো রহস্য আছে কোনো কিন্তু এটা যে সত্যি হয়ে যাবে তা কখনোই ভাবেনি ছোঁয়া। ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করলো শুভ্র।
এবার জায়েদা বেগম খুব উত্তেজনার সাথে শুভ্র কে বললো “বলো শুভ্র সব বলো। আমি আর পারছিনা অপেক্ষা করতে। ছোঁয়ার জন্ম পরিচয়ে কি এমন সত্যি যে সবাই আমার থেকেও লুকিয়েছে?”
“ছোট চাচিম্মু সত্যি টা জানলে হয়তো তুমিও আমার মধুবালাকে আর আদর করবেনা। মায়ের স্নেহে বুকে টেনে নিবেনা।”
ছোঁয়ার হেঁচকি উঠে গেলো এবার কাঁদতে কাঁদতে। এতটুকুও তো সে পারছেনা সহ্য করতে তবে সবটা কীভাবে করবে সহ্য? খুব যে কষ্ট হচ্ছে ছোঁয়ার এসব শোনে। বুকটা যেনো ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে। কেউ যেনো বুকের ভেতর চু’ড়ি দিয়ে আঘাত করছে অনবরত। পারছেনা কারো দিকে তাকানোর সাহস। অ’প’মা’ন লাগছে খুব।
সব নিরবতা ঠেলে শুভ্র উচ্চারণ করলো “ছোঁয়া ছোট চাচ্চুর মেয়ে। মেজু আম্মুর ছোট বোনের সাথে ছোট চাচ্চুর প্রেম ছিলো, দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। কিন্তু দাদি এক ঘরে দুই বোনকে কিছুতেই মেনে নিবেনা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এর মাঝেই ছোট চাচ্চু জানতে পারে ছোঁয়ার মা এই বালা জোড়ার জন্যই উনার সাথে সম্পর্ক করেছে তাই চাচ্চুও উনাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। আর এসব চলাকালের মধ্যেই ছোঁয়া ওই ভদ্রমহিলার গর্ভে আসেন। ছোট চাচ্চুকে উনি সাথে সাথেই বলেন এটা কিন্তু ছোট চাচ্চু রাগের মাথায় অস্বীকার করেন সবটা। তবে ওই ভদ্রমহিলার বালা জোড়ার প্রতি লোভ থাকলেও ছোট চাচ্চুকে তিনি একটু বেশিই ভালোবাসতেন।
পরে ছোঁয়ার জন্ম হওয়ার সময় অনেক কষ্ট পেয়ে ভদ্র মহিলা মা’রা যান। মেজু আম্মু সদ্য জন্ম নেয়া ছোঁয়াকে এই বাসায় এনে সবাইকে বলে দেন সব সত্যি। ছোট চাচ্চুও তখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং ছোঁয়াকে চান কিন্তু মেজু আম্মু উনার কাছে ছোঁয়াকে দেননি কারণ ছোট চাচ্চু সত্যিই অপরাধী। উনার কারণেই ছোঁয়ার মাকে সমাজের অপবাদ পেয়ে ম’র’তে হয়েছে।
এর মাঝে একটা সত্যি ছোট চাচ্চু কখনোই প্রকাশ করেননি যেটা মেজু আব্বু আর মেজু আম্মু ছাড়া আর কেউই জানতোনা।
পুরো পরিবার জানে ছোঁয়া ছোট চাচ্চু আর ওই ভদ্রমহিলার অবৈধ সন্তান কিন্তু এটা সত্যি নয়। ছোট আব্বু ছোঁয়ার আম্মুকে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। দাদির ভয়ে ছোট আব্বু এটা বলতে পারেনি কাউকে এবং মেজু আম্মুকেও কসম দিয়েছিলেন যেনো এই সত্যি কাউকে না বলে।
শুনে রাখো সবাই আমার মধুবালা পবিত্র বন্ধনে জন্ম নিয়েছে। কেউ যদি আর ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছো তো ছা’ড়’বো’না কাউকে আমি।”
শুভ্রর কথা শেষ হতে না হতেই ছোঁয়া এক ছুটে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
এ কোন সত্যি জানলো সে? কেনো এমন করলেন জীবন মির্জা ওর মায়ের সাথে? কেনো জন্মের সাথে সাথে নিজের মাকে হারাতে হলো ওর? কেনো সেলিনা পারভীন এতবছর কিছু বলেনি ওকে? কেনো কেনো কেনো হলো ওর সাথে এমন?
কোন পাপের শাস্তি ওকে দিলেন খোদা?
হাজার প্রশ্ন ছোঁয়ার মনজুড়ে। শুভ্র সহ সবাই দরজায় শব্দ করছে কিন্তু ছোঁয়া দরজা খুলছেনা। ভয় পেয়ে যাচ্ছে সবাই যত সময় যাচ্ছে। শুভ্র অনেকক্ষণ ধরে নক করতে করতে বিরক্ত হয়ে যায়। ভয় বাসা বাঁধে প্রাণ জুড়ে।
প্রায়ই ৩০মিনিট পর শুভ্র ছোঁয়ার রুমের বেলকনি দিয়ে প্রবেশ করে ওর রুমে।
শুভ্র আরেক ধা’ক্কা খাই ছোঁয়ার রুমে প্রবেশ করে। পুরো রুম অগোছালো ছোঁয়ার। রুমের কোথাও ছোঁয়া নেই। শুভ্র ওর রুমের ওয়াশরুমও চেক করে, সেখানেও ছোঁয়া নেই। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পরে এবার শুভ্র।
ছোঁয়া চলে গেছে, কিন্তু কোথায়?”
এরমাঝে সবাই ভুলে গেলেন জায়েদা বেগমের কথা। জায়েদা বেগম এখনো পর্যন্ত সেখানেই বসে আছেন আনমনা হয়ে। এমন সত্যির জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেননা।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
#মধুবালা [১৫]
#ফারজানা_আক্তার
শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে ছোঁয়া। শুভ্র বাঁধা দিচ্ছেনা। কাঁদুক, কাঁদলে যদি বুকটা হালকা হয় তবে কাঁদুক। শুভ্র ছোঁয়াকে খোঁজে পেয়েছে এটাই অনেক এই মুহুর্তে ওর জন্য। শুভ্র নিজেও কাঁদতেছে। বুকটা যে শূন্য হয়ে গিয়েছিলো ছোঁয়াকে হারিয়ে।
রাত প্রায়ই ১২টা ছুঁই ছুঁই। পাগলের মতো খুঁজেছে শুভ্র ছোঁয়াকে বিকাল থেকে। ছোঁয়া যে যে জায়গা গুলোই যেতে পারে সব জায়গায় খুঁজেছে শুভ্র ওকে কিন্তু কোথাও খোঁজে পায়নি। একটু আগেই শুভ্র ট্রেন স্টেশনে এসেছিলো ছোঁয়াকে খোঁজার ছলে তবে শুভ্রর একটুও ভাবনা ছিলোনা যে এখানেই সে তার ছোঁয়ার দেখা পাবে। ছোঁয়া কাপড় চোপড় গুছিয়ে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু গন্তব্য জানা ছিলোনা তাই এতসময় ধরে এই স্টেশনেই বসে বসে অ’শ্রু বি’স’র্জ’ন দিচ্ছিলো। মুহুর্তে যেনো পৃথিবীটা ধোঁয়াসা হয়ে গেলো ছোঁয়ার এমন মনে হচ্ছে। শুভ্র ছোঁয়ার পাশে এসে বসতেই প্রথমে ছোঁয়া পালিয়ে যেতে চাইছিলো কিন্তু শুভ্র তা হতে দেয়নি। খপ করে ছোঁয়ার হাত শক্ত করে ধরে ওর পাশে বসিয়ে বকাও দিয়েছে হালকা। আর সাথে সাথেই ছোঁয়া ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
রাত এখন ২টা ছুঁই ছুঁই। এখনো ছোঁয়া শুভ্রর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। তবে কান্নার বেগ কমেছে অনেকটা। থেকে থেকে হেঁচকি তুলছে শুধু। শুভ্র বাক প্রতিবন্ধীর মতো বসে আছে। শুভ্রর যে জানা নেই ছোঁয়াকে এই মুহুর্তে কোন ভাষায় সে সান্তনা দিবে। মেয়েটা যে ভেতর থেকে ভে’ঙে গেছে পুরোটা। শুভ্রর সহ্য হচ্ছেনা ছোঁয়ার কষ্ট। এর মাঝেই শুভ্র মিনমিন করে কয়েকবার বলেছে ছোঁয়াকে বাসায় যাওয়ার কথা কিন্তু ছোঁয়ার কোনো সাড়াশব্দ সে পায়নি। ছোঁয়া বাসায় যাওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত না। ভীষণ লজ্জা করছে ওর।
************
কেনো এতোগুলা বছর আমাকে বলেননি আপনি কিছু? কেনো? আপনি যদি আমাকে আগে বলতেন স্বাভাবিক ভাবে তবে আজ অস্বাভাবিকভাবে জানতে হতোনা আমাকে। কেনো এতো বড় মিথ্যা? কেনো এতো বড় ধোঁ’কা করলেন আপনি আমার সাথে?
আজ বুঝতে পারছি আপনি এই কারণেই ছোঁয়ার প্রতি দূর্বল অথচ আমি ভাবতাম..…..
আপনি কি ভাবতে পারছেন এতো বড় সত্যি টা জানার পর মেয়েটার অবস্থা কি হয়েছে? কোথায় আছে মেয়েটা? একটু কী চিন্তা হচ্ছে না মেয়ের জন্য বাবা হয়ে?
আপনি কী জানেন আজকের পর থেকে ছোঁয়া আপনাকে কতটা ঘৃণার নজরে দেখবে? আপনার জন্য মেয়েটার মনে পাহাড়সমান ঘৃণা জন্মেছে।
কিভাবে পারলেন বিয়ে করে স্ত্রী সন্তানকে অস্বীকার করতে আপনি? শুধু মাত্র আপনার পাপের ফলে আজ আমি মাতৃশুন্য। আপনার পাপের শাস্তি খোদা আমাকে দিচ্ছে। আমি বিয়ের এতোগুলো বছর হয়ে গেলেও মা ডাক শুনতে পারিনি শুধুমাত্র আপনার করা পাপের ফলের জন্য। আপনি খারাপ, খুব খারাপ, শুনছেন?”
কথাগুলো বলতে বলতেই খুব ক্লান্ত হয়ে বসে পরেন জায়েদা বেগম। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন জীবন মির্জা। তখনই রুমে প্রবেশ করেন মান্নান মির্জা আর জীবন মির্জার উদ্দেশ্যে বলেন “আমি চাইনি কখনো তোর এই রহস্য সবার সামনে আসুক তবুও ওই যে বলেনা সত্য কখনো গোপন থাকেনা। ঠিক তা-ই হলো। এতোগুলা বছর পর তোকে দাঁড়াতে হলো কাঠগড়ায়।
যাইহোক আমি বলতে এসেছিলাম আমার ছোঁয়া আমার মেয়েই থাকবে। হোক সব জানাজানি এতে আমার কোনো কিছু যায় আসেনা। আমার মেয়ের প্রতি কখনোই তুই অধিকার দেখাতে আসবিনা। আমি চাইনা বিষয়টি ঘরের বাহিরে যাক।
আর হ্যাঁ শুভ্র আরো দুই ঘন্টা আগেই ছোঁয়াকে পেয়েছে। শুভ্র কোনোমতে বুঝিয়ে ওকে বাসায় নিয়ে আসবে। চিন্তা করা লাগবেনা কাউকে আর আমার মেয়ের জন্য। ”
জীবন মির্জার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। মান্নান মির্জা কথাগুলো বলেই চলে গেলেন।
জায়েদা বেগমের চোখের জল যেনো আজ অবাধ্য।
**********
অনেক রাত হয়েছে বাসায় চল।”
“কিছুতেই যাবোনা।”
“দেখ ছোঁয়া এবার কিন্তু থা’প্প’ড় খাবি।”
“দাও।”
কান্নাজড়িতো নরম কন্ঠে বলে ছোঁয়া। শুভ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিজের ঠোঁট জোড়া ছোঁয়ার কপালে বসিয়ে দিলো। ভালোবাসারর প্রথম স্পর্শ। ছোঁয়া হালকা কেঁপে উঠে।
“দিলাম এবার চল।”
“বললাম তো যাবোনা ওই বাসায় আমি আর। বড় আব্বু আর দাদি এখন থেকে আরো বেশি করে কথা শুনাবে আমাকে। ”
“কেউ তোকে কোনো কথা শুনাবেনা আর, বিশ্বাস রাখ আমার উপর।
আচ্ছা তুই শুধু নিজের কথায়-ই ভাবছিস, একবারো কী চিন্তা এসেছে তোর মাথায় ছোট আম্মুর? ছোট আম্মুও তো তোর মতো আজ জানতে পেরেছে সবটা। তুই উনার স্বামীর আগের স্ত্রীর সন্তান এটা জানার পর তার অবস্থার কথা একবারও এসেছে কী তোর মাথায়?
উনিও ভালো নেই। চল বাসায় চল। উনি এতোকিছু জানার পর বাসায় থাকতে পারলে তুই কেনো পারবিনা?
আর কোনো কথা শুনতে চাইনা, বাসায় চল নয়তো কিন্তু সত্যিই মা’র’তে মা’র’তে নিয়ে যাবো।”
ছোঁয়া আর কোনো কথা বলেনি কারণ সে জানে শুভ্র ওকে বাসায় না নিয়ে এক পা-ও নাড়াবে না এখান থেকে। শুভ্রর জেদ সম্পর্কে যে ছোঁয়ার থেকে বেশি ধারণা আর কারো নেই। ছোঁয়া বাধ্য মেয়ের মতোই গাড়িতে এসে বসলো।
শেষ রাতের দিকে দুজন বাসায় ফিরলো। বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুন সবাই-ই আজ জেগে ছোঁয়ার জন্য। হলরুমে বসে আছে সবাই। আনজুমা খাতুন আজ ছোঁয়াকে মন থেকে মেনে নিয়েছে ছোঁয়ার জন্ম বৈধ জেনে কিন্তু উনি এটা ছোঁয়াকে জানানোর সাহস পাচ্ছেননা, ভীষণ লজ্জা লাগছে উনার। শুভ্র হাত ধরে ছোঁয়াকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। ছোঁয়ার ব্যাগ শুভ্রর কাঁধে। ছোঁয়া সবাইকে এড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। শুভ্র সবাইকে বলে ছোঁয়াকে এখন বিরক্ত না করার জন্য আর একা থাকতে দেওয়ার জন্য। সবাইকে ঘুমাতে যেতে বলে শুভ্র এগিয়ে গেলো ছোঁয়ার রুমের দিকে। রুমে গিয়ে দেখে ছোঁয়া রুমে নেই, ওয়াশরুম থেকে ঝুম ঝুম শব্দ ভেসে আসছে পানির। ছোঁয়ার ব্যাগ বিছানার উপর রেখে শুভ্র চলে যায় নিজের রুমে।
ছোঁয়া ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসতেই ফজরের আজানের সুর ভাসছে প্রকৃতি জুড়ে। সকাল হয়ে গেছে। আজান শেষ হতেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ছোঁয়া নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মনের সাথে শরীরের সম্পর্ক ওতপ্রোত ভাবে জড়িতো। মন ভালো না থাকলে শরীরটাও নেতিয়ে পরে।
***********।
লিলি প্রায়ই সকাল ১০টাই জেগেছে তাও আলিফ কল করে জাগিয়েছে ওকে। আজ আলিফের কল পেয়ে খুশির চেয়ে কষ্ট হচ্ছে বেশি লিলির। লিলি আজ আলিফকে এমন একটা সত্যি বলবে যা বলার পর তাদের সম্পর্ক হয়তো আর থাকবেনা স্বাভাবিক। বুকটা ছিঁ’ড়ে যেনো প্রাণপাখি উড়ে যাচ্ছে লিলির। একটুখানি কথা বলে লিলি কল রেখে দেয় আজ। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিংয়ে যায়। পুরো ঘরে আজ পিনপতন নীরবতা। টেবিলের উপর কলা পাউরুটি আর কিছু ফল রাখা আছে। একটা কলা আর পাউরুটি নিয়ে ছাঁদের দিকে এগিয়ে গেলো লিলি। ছাঁদে গিয়ে ছোঁয়ার ফুলগাছের ফুলগুলো ছুঁয়ে একটা শুকনো হাসি দিলো। মনটা ভীষণ আনচান করছে আজ লিলির।
এই সকালেই রোদের তাপ ভীষণ প্রখর। লিলির মনে হচ্ছে ওর শরীর যেনো রোদের তাপে ঝ’ল’ছে যাচ্ছে।
লিলি আর থাকতে পারলোনা ছাঁদে। দ্রুত পায়ে নেমে গেলো সিড়ি দিয়ে।
নিজের রুমে প্রবেশ করে লিলি ফোন হাতে মেসেজ অপশনে গিয়ে লিখলো “কখনোও যদি মা’রা’ত্ম’ক কোনো সত্যি জানতে পারেন আমার ব্যাপারে তবে ছেড়ে চলে যাবে আমায় নাকি বুকে টেনে নিবেন স্যার?”
এতটুকু লিখেই আলিফের নাম্বারে সেন্ড করলো লিলি।
আলিফ মেসেজটা পেয়ে তেমন কোনো রিয়াকশন না করে রিপ্লাই দেয় “অবশ্যই যাবোনা ছেড়ে কভু। আমি তোমাকে ভালোবাসি, প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছি। প্রথম দেখা শুধু ভালো লাগা ছিলো তবে কথা বলতে বলতে এতোটাই কাছের হয়ে গিয়েছো যে ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হয়ে বুকের গভীরে মিশে গেছো।
আজ বিকালে দেখা করিও।”
*
বিকালে আলিফ বসে আছে লেকের পাড়ে। একা একা বসে থাকতে কেমন জানি বিরক্তি লাগছে আলিফের।
একটু পরেই লিলি আসলে সব বিরক্তি মিশে যায় প্রকৃতির সাথে আলিফের।
লিলির মন খারাপ আজ। পাশাপাশি বসে আছে দুজন। কেউ কোনো কথা বলছেনা।
নীরবতা কা’টি’য়ে আলিফ বলে “বলো এবার সেই মা’রা’ত্ম’ক সত্যটি। শুনতে ইচ্ছুক আমি।”
মুহুর্তেই লিলির বুকের ধুকপুক প্রচন্ড রকম বেড়ে গেলো। শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে লিলির।
আলিফ এরমাঝেই আরো কয়েকবার বললো বলতে। লিলি ঘামছে প্রচুর। লিলির অবস্থা দেখে আলিফ ভয় পেয়ে যায়।
কি এমন সত্যি যার জন্য লিলির অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে?
ভাবছে আলিফ।
আলিফ গিয়ে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কিনে এনে লিলিকে খাইয়ে দিলো।
প্রায়ই অনেকক্ষণ পর লিলি ধীর কন্ঠে বলা শুরু করলো “আমি লিলি স্যার। বিশ্বাস করুন আমি মোটেও জানতাম না যে আপনি ছোঁয়া ভেবে আমায় মেসেজ দিয়েছিলেন যদি জানতাম তবে কখনোই আপনার সাথে এতোটা গভীরে যেতাম না। আমি যখন জানতে পারি তখন অনেক দেরি হয়ে যায় আর আমাদের বাসায় পারিবারিক ঝামেলা চলছিলো কয়েকদিন ধরে তারমাঝে ছোঁয়ার মা মা’রা গেলেন, এতোকিছুর মাঝে সত্যি টা বলতে যেয়েও পিছিয়ে গিয়েছিলাম আমি বারংবার। প্লিজ স্যার ক্ষমা করে দিন, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে আমার।
কিভাবে বলবো স্যার লজ্জার কথা, প্রথম দেখায় আপনার প্রতি একটু দূর্বল হয়ে পরেছিলাম তাই আপনার মেসেজ পেয়ে কিছু না ভেবেই কথা বলা শুরু করেছি। কিন্তু ধীরে ধীরে আপনার কথার ভাঁজে বুঝতে পারি আপনি আমাকে নয় বরং ছোঁয়াকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি স্যার, বড্ড বেশিই ভালোবাসি।
আপনাকে হারানোর ভয় আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে স্যার।”
সব বলে দিয়েছি এবার সিদ্ধান্ত আপনার হাতে, এই সম্পর্ক অধরা থাকবে নাকি পূর্ণতা পাবে তা আপনার উপরই ছেড়ে দিলাম।”
সব শুনে আলিফ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কিছু বলার মতো খুঁজে পাছেনা সে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে লিলি। আলিফ চোখ ঘুরিয়ে তাকায় লিলির দিকে, লিলি ঢুক গিলে।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।