বিষণ্ণ_শহর পর্ব_৮ ও অন্তিম_পর্ব

0
1120

বিষণ্ণ_শহর ?
#পর্ব_৮_ও_ অন্তিম_পর্ব
____________________
____________________
মার খেয়ে সেদিন কালু প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে যায়। শহর এসে ডাক্তার দেখিয়ে কালুকে ঔষধ কিনে দিয়ে গিয়েছিলো । কালুর চিকিৎসার জন্য অবশ্য মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলো ই. বশির। কিন্তু সেটা রয়ে গেছে টং দোকানের মালিকের পকেটেই ।
কালুকে কিছু ঔষধ নিয়ম করে খেতে বলে যায় শহর। একটা পুরো ট্যাবলেট খাওয়ার পরে আরেকটা ট্যাবলেটের অর্ধেক পরিমান ভেংগে খেতে হবে।
ট্যাবলেট ভাংতে গিয়েই বাঁধে বিপর্যয়। সমান দু ভাগে ভাগ না হয়ে এক ভাগ ছোট ও একভাগ বড় হয়ে যায়। এটা নিয়ে মারাত্মক টেনশনে পড়ে যায় কালু!
কালুর থেকেও খুব বেশি টেনশনে আছে হুরায়রা। শহরের দেয়ার ধাঁধাঁর একটা উত্তর সে বের করেছে।
সেটা হলো- আয়না। কারণ আয়না উল্টো করেই সব কিছু দ্বিগুন করে দেয়।
আয়না দিয়ে তাহলে কি বুঝানো হয়েছে!
হুরায়রা মাথায় আয়নার কথা চিন্তা করতে করতে, বাসা থেকে নেমে পড়ে। শাহীনের কাছের মানুষগুলোর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। ব্যাপারটি অবশ্য বেশ উপভোগ করছে হুরায়রা। রহস্যের সন্ধানে ডুবে থাকার মজাই অন্য রকম।
শহর আবার হুরায়রাকে একটা শর্ত বেঁধে দিয়েছে। পুরো ইনভেস্টিগেশনে সে শাহীনের কোনো প্রকার ছবি দেখতে পারবেনা কারো কাছ থেকে। এটা পুরো বিষয়টিকে আরো বেশি জটিলতর করে তুলেছে।
.
.
.

প্রথমেই হুরায়রা শাহীনের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করে। গেটের দারোয়ানকে একটু অনুনয় করে বলাতেই সে হুরায়রাকে শাহীনের মা পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু শাহীনের নাম শোনা মাত্রই তার মা কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বিদেয় হতে বলে হুরায়রাকে। হুরায়রা এখানে খুব সুক্ষ্ম একটা ট্রিকস খাটায়, সে বলে শাহীনের খুনীকে খোঁজার জন্য ইনভেস্টিগেটশন হচ্ছে।
সন্দেহের তালিকায় আপনিও রয়েছেন।
– মা হয়ে কেন আমি ছেলেকে খুন করতে যাব?
পাল্টা জিজ্ঞেস করে শাহীনের মা।
– শাহীন মারা যাওয়ার আগে এখানে একাই থাকত। আপনি থাকতেন আপনার স্বামীর সাথে অন্যত্র। ও মারা যাওয়ার পরে, বাড়ির একমাত্র মালিক আপনি ই হবেন। লোভের বশবর্তী হয়ে এমন বাবা মা ছেলে খুন হওয়ার ঘটনা আজকাল নতুন নয়।

হুরায়রার জেরা করার ভঙ্গিতে প্রশাসনিক ফরমেশন থাকায় একটু ঘাবড়ে যায় শাহীনের মা।
সে জানায়, শাহীন মারা যাওয়ার আগে তাদের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ রাখে নি। এদিকে শাহীনের সৎ বাবার আর্থিক অবস্থাও তেমন একটা ভালো ছিল না। এজন্য ই এখানে চলে আসা। শাহীন মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সে কেমন ছিল সেটাও জানেন না তিনি।
সকালে যখন প্রশাসন থেকে তাকে খবর দেয়া হয় তখন ই কেবল জানতে পারেন শাহীনের মৃত্যুর কথা।
তাদের দুজনের কথাবার্তার মাঝে রুমে প্রবেশ করেন একজন লোক। যার এক চোখ ছোট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ও মাথায় টাক। তার চাহনীর ভিতর কেমন যেন একটা কুটিলতা খেলা করছে।
হুরায়রা জানতে পারে এটা শাহীনের আম্মুর দ্বিতীয় হাজবেন্ড।
লোকটি রুমে এসেই সরাসরি হুরায়রাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
বহুত বেয়াদপ আছিলো পোলাডায়। আমি ওর বয়সে বড়, সম্পর্কে ওর বাবা। এই ছেলে আমার গায়ে হাত তুলছে! ওর মতো বেয়াদব ছেলাপান এমন অল্প বয়সে মারা যাইবে, ঠিক ই তো আছে।
তবে ম্যাডাম,
আমি কিন্তু এই বাসায় আসতে চাইনাই৷ নিয়া আসছে এই মহিলা। জোর করে।
আমার কথা হইলো, আমি টিনের চালার কুড়েঘরে থাকলে তুইও বেটি আমার সাথে থাকবি। যদি থাকতেই না পারস, বিয়ে করছিলি কেন! আমাকে জোর করে এমন একজনের বাসায় এনে উঠাইছে, যে আমার ছেলে হয়েও আমার গায়ে হাত তুলছে।
বলেন আপা, আমার কি এখানে থাকতে অপমান লাগবে না?
হুরায়রা উত্তর দেয়- লাগবে।
দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে শাহীনের মা। হুরায়রা বুঝতে পারে তাদের সাথে কথা পেঁচিয়ে লাভ নেই।
সে হেঁটে বের হয়ে আসে বাসা থেকে।
পুরো এলাকায় একটা চক্কর দেয়। টোটাল তিনটা চা- সিগারেটের টং দোকান রয়েছে এখানে। এগুলোর ভিতর একটা শাহীনের বাসার সাথে লাগোয়া। অন্যটি মাঝামাঝি একটা নিরিবিলি ডাম্পইয়ার্ডের পাশে।অন্যটি বেশ দূরে।
স্মোকারদের চা সিগারেটের দোকানের সাথে অন্যরকম একটা সম্পর্ক থাকে। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস সাধারণত সবার শুরু হয় টিনেজে। আর তখন বাসার মানুষজনের জেনে যাওয়ার ভয় থাকে দেখেই কেউ বাসার পাশের দোকান থেকে সিগারেট কেনে না। আবার তৃতীয় দোকানটাও অনেক দূরে। লজিক বলে দ্বিতীয় দোকানে গেলে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে শাহীনের সম্পর্কে।
হুরায়রা সেটাই করে। শাহীনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে চলে যায় দ্বিতীয় টং দোকানটায়।
কোনো দোকানে এক কাপ চা খাওয়ার পরে আবার সাথে সাথেই যদি আরেককাপ চায়ের অর্ডার করা হয়, এবং দোকানদার কে বলা যায় যে আপনার চা অনেক সুন্দর। এমন চা কোথাও খাইনি। তবে দোকানদার কেনো! দোকানদারের ফোরটিন জেনারেশন ও গলে যাবে। হুরায়রা চায়ে চুমুক দিতে দিতেই শাহীনের কথা তুলে। এমন একটা ভাব করে, যেন শাহীন তার কোন বন্ধু ছিল।
হুরায়রা বলে,
চাচা আপনার দোকানের কথা শাহীনের মুখে অনেক শুনেছি। আজ সত্যি ই এখানের চা খেয়ে বুঝলাম ওর কথা ভুল ছিল না।
শাহীন নাম শুনতেই দোকানদার সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় হুরায়রার দিকে।
গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,
কোন শাহীন? যে ছেলেটা মারা গেলো কিছুদিন আগে ঐটা?
– হুরায়রা মনে দুঃখ ভাব এনে বলে, হুম।
– আপনি ওর বন্ধু?
– বন্ধু না ঠিক, ক্লাসমেট।
– ও তো কোথাও পড়ালেখা করতো না। ঐ জানোয়ারটার কি হন আপনি? যে-ই হন না কেনো! আপনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যান এখন। চায়ের দাম দেয়া লাগবে না।
– এরকম বিব্রতকর সিচুয়েশনে পড়তে হবে বুঝতে পারেনি হুরায়রা। দোকানদারের আক্রমনাত্মক আচরণে সে কোন কথা বলারই সুযোগ পায়না।
সাথে সাথে উঠে পড়তে হয় দোকান থেকে। তবে যেহেতু দোকানদার এরকম আচরণ করেছে তার মানে শাহীন সম্পর্কে তার কাছে অনেক তথ্য আছে।
সেদিন সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল প্রায়।
বাসায় চলে আসে হুরায়রা। কোন কূল কিনারা করতে পারেনা রহস্যের। দোকানদারকে বন্ধু পরিচয় দিয়ে ভুল করে না ফেললে হয়ত কিছু একটা হত।
.
.
.
সুপ্তিদের নিচতলার কাজ হয়ে এসেছে প্রায়। অর্থ লগ্নি দিচ্ছে ই. বশির। সময়ে অসময়ে সে এসে ঘুরে যায়। দেখে যায়। আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্যেও সুপ্তিকে ভালো লাগার কথা সে জানাতে পারছেনা, কেমন যেন একটা সংকোচ কাজ করছে তার ভেতরে। এদিকে সুপ্তির মাথায় ঘুরছে শুধু রাজনের চিন্তা। সে কেন পত্রিকায় আলতাফ সাহেবের নাম না লিখে লতিফের নাম লিখলো! কি রহস্য লুকিয়ে আছে এটার মাঝে!
সুপ্তি ঠিক করে শহর আহমেদের সাথে আরো একবার দেখা করবে। কারণ রাজনের খবর একমাত্র শহর ই দিতে পারবে সুপ্তিকে।
সুপ্তির পক্ষে শহরকেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে পুনমকে পাওয়া সম্ভব। আর পুনমকে পেলেই সে শহর এবং রাজন দুজনকেই খুঁজে পাবে।
যেরকম ভাবা সেরকম কাজ, সুপ্তি চলে যায় পুনমের কাছে। গিয়ে শুনে শহর পুনমের বাসায় আসবে আরো দু দিন পরে। হুরায়রার সাথে পরিচিত হয় সুপ্তিও। সুপ্তি হুরায়রাকে খুলে বলে শহরের দেয়া রহস্য সমাধানের কথা।
তখন সুপ্তি জানায়, এই ছেলেটির মৃত্যুর দায়ভার এসে পড়েছিল তার বৃদ্ধ বাবার উপরে।
টুকটাক আরো কিছু কথা বলে শাহীন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। কিন্তু তেমন কোন ক্লু খুঁজে পায়না সে। সুপ্তি হুরায়রাকে জানায় রাজনের কথা। বিশিষ্ট এই রিপোর্টারের কাছে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু তথ্য তো পাওয়া যাবেই। রাজন কে প্রশ্ন করার পর সুপ্তি রাজনের পরিচয় যতটুকু জানে তুলে ধরে। হুরায়রাও সবকিছু শুনে রাজনের শরনাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু রাজনকে এখন কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে! এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় দুজনেই। পুনম সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
তুমি একটা বাসার নিচ থেকে কেকের প্যাকেট নিয়ে কেক খেয়েছিলে মনে আছে?
সুপ্তি উত্তর দেয় – হ্যাঁ
ঐ বাসায় একটা মেয়ে থাকে, খোপায় সব সময় কাঠগোলাপ দিয়ে রাখে, ওর কাছে গেলে খবর পাবে শহর এখন কোথায়।সুপ্তি এবং হুরায়রা দুজনেই মেয়েটির বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে। বাসার রাস্তার সামনে যেতেই দেখতে পায় বারান্দায় এলো কেশে বসে আছে মেয়েটি। যেন তাদের দিকে একগাল মিষ্টি হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওদের বাসার দরজায় নক করতেই একজন বৃদ্ধা দরজা খুলে। মেয়েটির মা।
ওদের দুজনকে নিয়ে বারান্দায় চলে যান তিনি। চেয়ার টেনে বসিয়ে দিয়ে চা আনতে বাইরে যান।
মেয়েটি তখনো বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকানো।
সুপ্তি ই প্রথমে কথা বলা শুরু করে।
আপু আপনার সাথে জরুরি বিষয়ে কথা ছিল।
মেয়েটি মিষ্টি কন্ঠে উত্তর দেয়-
বলুন।
– শহর আহমেদ কোথায় জানার জন্য আপনার কাছে পাঠিয়েছিল পুনম আপু।
– মেয়েটি বাতাসে ঘ্রাণ নেয়ার মত করে একটা বড় নিশ্বাস নেয়। পরে উত্তর দেয় সে এখন এ শহরের শেষ মাথায় থাকা পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরির পেছনে বসে আছে। ঘন্টা দুয়েক সেখানেই থাকবে।
তিন কাপ চা এবং এক বাটি মুড়ি নিয়ে রুমে প্রবেশ করে মেয়েটির মা।
তিনি সবার হাতে হাতে চায়ের কাপ তুলে দেন এবং বলেন, শহর ও পুনম বাদে ওকে তেমন কেউ দেখতে আসেনা। তোমরা হঠাৎ কেন এলে?
– শহর আহমেদের ব্যপারেই একটু কথা ছিল। জবাব দেয় সুপ্তি।
– শহর আর পুনম বাদে কেউ দেখতে আসে না মানে! ওর কোন বন্ধু বান্ধব নেই?
– না। ও ছোট থেকেই জন্মান্ধ।
মেয়েটির মায়ের এমন প্রশ্নের উত্তর শুনে মর্মাহত হয় হুরায়রা এবং সুপ্তি দুজনেই। হুরায়রা দাঁড়িয়ে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সুপ্তিকে নিয়ে চলে আসে।
.
.
.
এ শহরের শেষ মাথাটা একদম গ্রাম্য এলাকার মত তবে তেমন লোকজন নেই। মনে হয় মৃত্যুপুরী।
বড় ও প্রকান্ড গাছপালা গুলো সারি সারি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে জমা হয়েছে শুকনো পাতার মোটা আস্তরণ। হাঁটলে খস খস শব্দ হয়। মেয়েটির ভাষ্যমতে শহর আহমেদকে এরকম ই কোন এক গাছতলায় বসে থাকতে দেখা যাবে। খানিক বাদে
সুপ্তি এবং হুরায়রা সত্যি ই শহর আহমেদ কে একটা প্রকান্ড গাছের শিকড়ের উপরে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। ওরা হেঁটে আরো কাছে যেতেই পাতার মরমর শব্দে ঘুম ভেংগে যায় শহরের।
সুপ্তিকে ও হুরায়রাকে একসাথে দেখে শহর জিজ্ঞেস করে, কি ব্যপার তোমরা একসাথে মিলে আমাকে খুঁজছো?
– রাজনকে একটু দরকার ছিলো। ও কোথায় বলতে পারবেন?
– হ্যাঁ। ও ওর নিজ বাসাতেই আছে।
হুরায়রা জিজ্ঞেস করে তার বাসা কোথায়?
শহর আহমেদ উত্তর দেয়, খুঁজে নাও।
কথা বাড়ায় না সুপ্তি এবং হুরায়রা। রাজনের বাসা খুঁজে বের করা সুপ্তির জন্য কঠিন নয়। তারা চলে আসে।
রাজনের বাড়ির আঙ্গিনা দেখে কিছুতেই রাজন চরিত্রের মানুষটার সাথে মেলানো যায়না। চারদিকে ঝোপঝাড়, বুনো গোলাপ সহ আরো অনেক ফুলের সমাহার। বাড়িতে ঢোকার সময়ই চোখে পড়ে একটা বাঁশের বেড়া দেয়া কবর। কবরের চারপাশে তরতাজা বুনোগোলাপ, শেফালী ফুল দেখতে পায় দুজনেই। যেন একটু আগেই কেউ ফুলগুলো তুলে রেখে গেছে এখানে।
পুরানো খসে যাওয়া বিল্ডিং এর সুবিশাল বাড়ি। ফাঁটল দেখা যায়। দেয়ালের গায়ের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে পাকুড় গাছ।
চারদিকে ছায়া ঘেরা নিরিবিলি পরিবেশ। পুরো বাড়িটার একটামাত্র রুম ব্যবহার করে রাজন। তামাকপোড়ার গন্ধ ধরে এগিয়ে যায় সুপ্তি এবং হুরায়রা। একটা নির্দিষ্ট কামরার সামনে গিয়ে দেখতে পায় রাজন হা করে ফ্লোরে পরে ঘুমাচ্ছে। মাথার নিচে কয়েক গাদা কাগজ মুচড়ে বানিয়েছে বালিশ। চারদিকে অসংখ্যক অগোছালো খবরের কাগজ। একটা মানুষ যতটা অগোছালো হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটা অগোছালো হয়ে পরে আছে। রুমের দরজাটা পর্যন্ত আটকে নেয়নি। তবে পুরো নোংরা অগোছালো রুমের ভিতর একটা ছোট্ট পড়ার টেবিল, চকচক ফকফক করছে। অত্যন্ত সুন্দর করে গুছানো।
একটা ধূলোর কণাও নেই টেবিলে। টেবিলে রাখা একটা কাঁচের ফুলদানি। সেখানে সাদা ও গোলাপি জংলী গোলাপ। বইগুলো দেখলে মনে হয় নতুন। এইমাত্র কিনে আনা দোকান থেকে। আছে পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স, স্কেল সহ খুব সুন্দর মলাটের খাতা। হুরায়রা টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় পায়ে কয়েকশ পুরানো ছেড়া খবরের কাগজ মারিয়ে। টেবিলের উপরে রাখা নবম – দশম শ্রেণীর নতুন বই। বইয়ের মলাট উল্টাতেই গোটা গোটা হাতের লেখার অক্ষরে সুন্দর করে একটা নাম লেখাঃ
রিমঝিম মাহমুদ।
রোল নং – ১
হুরায়রা বুঝতে পারে, ঢোকার সময় যে কবরটা দেখেছে, সেটা এই রিমঝিম মাহমুদেরই হবে।
বইয়ের পাতা আবার ও উল্টায় সে।
সাল দেখে বেশ অবাক হয়,
পাঁচ বছর আগের বই।
এত বছর ধরে এখনো এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও নতুন রয়েছে কিভাবে!!
আসলে প্রতিটা মানুষের ভিতরেই একটা পরিপাটি ও গোছালো সত্তা থাকে, হয়ত ছোট্ট করে লুকিয়ে থাকে কোন প্রিয় মানুষের জন্য, রাজনকে দেখে সেটা উপলব্ধি করা যায়। সুপ্তি রাজনকে নাম ধরে ডাক দেয়।
চোখ মেলে তাকায় রাজন। লাফ দিয়ে উঠে বসে সে। হুরায়রাকে টেবিলের পাশে দেখে চিৎকার করে বলে, ‘টেবিলের কোন কিছুতে হাত দিবেন না প্লিজ।’
হুরায়রা সরে আসে টেবিলের পাশ থেকে।
সুপ্তি রাজনকে বিরক্তভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি আলতাফের জায়গায় লতিফ লিখলে কেন?’
প্রশ্ন শুনে অপরাধী ভঙ্গিতে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে রাজন। হুরায়রা সুপ্তিকে চোখের ইশারায় থামতে বলে রাজনের পাশে গিয়ে বসে তাকে বলে, “রাজন, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমার সাথে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, তাই তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছি।”
রাজন তার রুম থেকে বের হয়ে বাইরে আসে। পেছন পেছন আসে হুরায়রা এবং সুপ্তি। মূল দরজার সামনে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা বসার স্থানে রাজন বসে। রাজনের মুখোমুখি হয়ে বসে অপর পাশের বসার জায়গায় বসে হুরায়রা। সুপ্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাজন বাড়ির পাশে থাকা পেয়ারা গাছ থেকে দুটো পেয়ারা ছিঁড়ে আনতে বলে ।
কোমর সমান গাছ, কিন্তু একগাঁদা বড় বড় পেয়ারা পেঁকে হলুদ হয়ে ঝুলে আছে। সুপ্তি আধাপাকা তিনটা পেয়ারা ছিঁড়ে আনে।
একটা একটা নিজে ও অন্যদুটো হুরায়রা এবং রাজনকে দেয়। হুরায়রা প্রথমেই রাজনকে যে কথাটা বলে তা ছিলো,
” রিমঝিম মেয়েটার জন্য আমার প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে আছে। সামনের কবরটা নিশ্চয়ই ওর? ”
রাজন লাল চোখ নিয়ে তাকায় হুরায়রার দিকে।
ক্রমশ সেই চোখ অশ্রুশিক্ত হয়ে ওঠে৷
” ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়ে নাইনে উঠেছিল মাত্র।
তারপরই স্কুলে যাওয়া আসার পথে লতিফের লালসার শিকার হয় আমার বোন রিমঝিম।
দুটো দিন ওকে খুঁজে পাইনি। তৃতীয়দিন ওর রক্তমাখা তাজা লাশ খুঁজে পেয়েছিলাম। লতিফের উপরে সেই থেকেই একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করে। এজন্যই ওকে আমি যতটুকু পারছি হেনস্তা করছি। ওহ! আরেকটা নাম ভুলে গেলে চলবে না, ইন্সপেক্টর বশির। সেও লতিফকে সাহায্য করেছিলো। ওরা সবাই মিলে আমার বোনকে ধর্ষণ করে। প্রশাসনের লোক হওয়ায় বিচার পাইনি। ”
” শাহীন নামের কাউকে চেনো? ” প্রশ্ন করে হুরায়রা।
– চিনবো না কেনো!ও আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলো।
– ওর মৃত্যুর ব্যপারে কিছু জানো?
– সঠিক জানিনা। তবে আমার মনে হয়, ওকে খুন করেছে ইন্সপেক্টর বশির।
খারাপ লোকদের সাথে চলাফেরা করত শাহীন। ড্রাগস, মেয়ে নিয়ে রাত কাটানো, মারামারি..এসবের ভিতরে ডুবে থাকতো সে। তার এসব অপরাধ ধামা-চাপা দেয়ার জন্য আইনের লোকদের হাতের মুঠোয় রাখা ওর জন্য জরুরি ছিল। শাহীন প্রচুর টাকা খাওয়াতো ইন্সপেক্টর বশিরকে। রাতভর দুজনে একই মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করেছে, মদ খেয়েছে এমন রেকর্ডও আছে।
– তাহলে বশির ওকে খুন করবে কেন?
– বশিরের ধারণা শাহীন কোন এক কারণে তাকে খুন করতে চেয়েছিল। তাকে মেরে লাশ মাটিতে পুতে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। তাই সেই উল্টো শাহীনকে খুন করে ফেলে।
রাজনের সাথে আরো কিছুক্ষন কথা বললো হুরায়রা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোন তথ্যই আর পেলো না ।
তবে যা পেয়েছে তা মোটেও ফেলার মত নয়।
তারা দুজনে নিজ নিজ বাসায় ফিরে আসে। সুপ্তি সারা রাত ঘুমাতে পারেনা। তার মাথায় রাজনের জন্য চিন্তা হতে থাকে। রাজনের দুঃখ কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে সুপ্তির মন। এদিকে ইন্সপেক্টর বশির তার বাবাকে বলে ফেলেছে, সুপ্তিকে সে বিয়ে করতে চায়। বৃদ্ধ জাফর সাহেবের খুশি আর দেখে কে! সে খুব আনন্দের সাথে কয়েকশ রাকাত নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দোঁয়া করতে শুরু করে।
সুপ্তি বাসায় ফেরার পর পর ই তাকে জানানো হয়, খুব শীঘ্রই ইন্সপেক্টর বশিরের সাথে তার বিয়ে হতে চলেছে।
.
.
.
আজ চরম এক সত্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে শহর আহমেদকে। দুদিন পর শহর যখন পুনমের বাসায় ফিরেছে তখন পুনম বাজার করার জন্য বাসায় ছিল না। হুরায়রা একা ছিল সেখানে। পুনম খুব সকালেই বের হয়ে যায় বাসা থেকে। পুনম বের হওয়ার সাথে সাথেই নিচের রুমটিতে চলে যায় হুরায়রা।
শহর আহমেদের অনুমতি ছাড়া সেখানে একেবারেই যাওয়া নিষেধ সত্ত্বেও হুরায়রা সেখানে প্রবেশ করে। মোটা লোহার দরজা ঠেলে সরাতেই কয়েকটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়৷ সুইচ টিপে লাইট জ্বালায় সে। নিচতলাটা পুরো দুই রুমে বিভক্ত। একরুমে কোন লাইট নেই। ফ্লোর মাটির অন্য রুমটির ফ্লোরে শুধুমাত্র ইট বেছানো। একটা লোহার বড় খাঁচা দিয়ে বাঁধা রয়েছে কিছু কুকুর। অদ্ভুত ভাবে কুকুরগুলোর সব ক’টার ই কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কোনটির চোখ উঠে গেছে। কোনটির পা দুটো নেই, কোনটি আবার প্যারালাইজড অবস্থায় পরে আছে। দাঁড়াতেও পারছে না। এমন গোটা বিশেক কুকুর ওখানেই বসবাস করে। ওদের মলমূত্রাদি বিশেষ এক পদ্ধতিতে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা হয়েছে। পুরো রুমটা খুব সুন্দর পরিপাটি। কোন গন্ধ নেই। খাবার দেয়ার জন্য আছে নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট বড় পেয়ালা।
দু পা ফেলে অন্ধকার রুমের দিকে এগোতেই হালকা পঁচা একটা গন্ধ নাকে লাগে হুরায়রার।
উঁকি দিতেই বেশ অবাক হতে হয় তাকে।সেখানে মানুষের মাথার খুলি , হাত পায়ের হাড় সহ বিভিন্ন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুঁজে পায় সেখানটায়।
অবশ্য উপর থেকে তেমন কিছুই বোঝা যায়নি৷ কিন্তু একটা আঙ্গুলের হাড় পরে থাকতে দেখে এবং পাশেই ধারালো মাংস কাটার চা-পাটি রাখা দেখে হুরায়রার মনে সন্দেহ জাগে। এরপর মাটির নিচে খুঁড়তেই বের হয়ে আসে একের পর এক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কংকাল।
.
.
.
শহরের সামনা সামনি বসে আছে হুরায়রা। হুরায়রার একগাদা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে আছে শহর। কিন্তু তাকে মোটেই বিচলিত দেখাচ্ছে না। শহর আহমেদকে বরং একটু খুশি খুশি লাগছে। হুরায়রা এবার সত্যিই অবাক হয়।
শহর হুরায়রাকে জিজ্ঞেস করে, কে খুনী সেটা খুঁজে পেলো কিনা!
হুরায়রা উত্তর দেয়, খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি৷ শহর জানায়, খুব কাছাকাছি গিয়েছিলে তুমি।
প্রথমত, চায়ের দোকানদারের কাছে খোঁজ নিয়ে শাহীন সম্পর্কে জানতে পেরেছো, সে খুব খারাপ একজন লোক ছিলো।
– হুম।
– তোমার উচিত ছিল এ শহরের দ্বিতীয় খারাপ লোকটি খুঁজে বের করা। একই ক্যাটাগরির লোক একজন আরেকজন সম্পর্কে অনেক তথ্য জানে।
– হুম।
– রাজনের কাছে শুনেছ, ইন্সপেক্টর বশির শাহীনকে খুন করার সম্ভাবনা আছে। শুনোনি?
– হ্যাঁ।
– কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
– না।
– এটা শুধু তুমি জানো এবং আমি জানি।
– হুম।
– আচ্ছা একবার ইন্সপেক্টর বশিরের চেম্বারে গেলে কেমন হয়?
– ভালো।
– তবে চলো।
.
.
.
ইন্সপেক্টর বশির শহরকে দেখে কখনোই খুশি হতে পারে না।
কিন্তু সুপ্তির সাথে তার বিয়ের দিন তারিখ একদম ঠিক করে ফেলেছে সুপ্তির বাবা। সে চাইলেও মন খারাপ করে বসে থাকতে পারছে না। ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি একটা হাসি লেগেই রয়েছে তার।
হুরায়রা এবং শহর আহমেদ ই. বশিরের কামরায় ঢোকার পর বাকি সবাইকে কিছুক্ষনের জন্য বের হয়ে যেতে বলা হয়।
উপস্থিত থাকে শুধু তিনজন।
ই. বশির সিগারেট ধরায়।
হুরায়রার দিকে তাকিয়ে শহর জিজ্ঞেস করে, ‘কি দেখলে?’
– হুরায়রা উত্তর দেয়, উনি সিগারেট ধরালো দেখলাম।
– বেশ৷
ই. বশিরের শহরের আচরণ একদমই পছন্দ হচ্ছে না।
সে জিজ্ঞেস করে, ‘জরুরি কি কথা বলবে বলো।’
শহর উত্তর দেয়, ‘আমি জরুরি কিছু বলতে আসিনি। আপনাকে দেখতে এসেছি।’
বশির সাহেব অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে তাকায় শহরের দিকে।
শহর বশিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি মন্ড ব্রান্ডের সিগারেট খান কবে থেকে বশির সাহেব?
– মাস দুয়েক হবে।
– আমি ভিন্ন একটা উত্তর জানি।
– কি?
– শাহীন মারা যাওয়ার ঠিক ১৯ দিন আগ থেকে। আগে আপনি ব্যানসন খেতেন। ঠিক কিনা বলুন।
– ঠিক।
– শাহীন মারা যাওয়ার ২১ দিন আগে আপনি ওর বাসায় গিয়েছিলেন। তারপর নিঁখোজ ছিলেন দু’ দিন। ঐ দু দিন অফিসে আসেন নি। আপনি কোথায় ছিলেন?
– জরুরি কাজে বাইরে ছিলাম। তাছাড়া আপনি এখন আসুন আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।
– আমি আপনার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আসিনি৷ আমার পাশে যে পরীর মত মেয়েটি বসা ওকে একটা বিষয় ক্লিয়ার করাতে এখানে নিয়ে এসেছি।
তারপর বলুন,
লতিফকে খুন করলেন কেন?
এই প্রশ্নটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা ই. বশির সে চেয়ারে হেলান দেয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে।
শহর আহমেদ হেসে বলে,
থাক, উত্তর আমি জানি। আপনাকে দিতে হবেনা।
অনেক কাঁচা কাজ করেন আপনি।সেদিন রাতে লতিফকে আপনি পুনমের বাসায় পাঠিয়েছিলেন , আমাকে মেরে ফেলার জন্য৷ কিন্তু আমি তো পুনমের বাসায় থাকিনা।
লতিফের সব অপকর্মের প্রমাণ আপনার কাছে থাকায় লতিফ আপনার কথা শুনতে বাধ্য ছিল।
তাই সে বোকার মত একটা কাজ করতে গেল।
হুরায়রা, তোমাকে একটা ধাঁধাঁ দিয়েছিলাম। ধাঁধাঁর উত্তর কি ছিল?
– আয়না।
– এবার বুঝেছ তুমি কিছু?
– হ্যাঁ।
– কি বুঝলে?
– বশির সাহেব লেফট হ্যান্ডেড ছিলেন না। রাইট হ্যান্ডেড ছিলেন। উনি বাম হাত দিয়ে কাজ করছে। সিগারেট ও বাম হাত দিয়েই ধরিয়েছে। সুতরাং সে বশির সাহেব নয়। তার আয়না মানুষ।
– গুড। উনি যে বশির সাহেব নন, এ খবর শুধু দুজন জানতো। এক হলো আমি আরেকজন লতিফ। তাই আমাদের দুজনকেই সরিয়ে দেয়া ছিল ওনার মূল লক্ষ্য।
– উনি বশির সাহেব না, সেটাতো এখন আমিও জানি।
– হুম। বশির সাহেব যখন লতিফের সাথে মিলে রাজনের বোনকে রেপের পরে হত্যা করে, রাজন তখন ই সিদ্ধান্ত নেয়, সে বশির ও লতিফকে খুন করবে। ই. বশির শাহীনের সাথে বেশি ক্লজ ছিল। তাই শাহীনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাজন। প্রথমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে শাহীনের সাথে। এরপর খুব সুন্দর উপায়ে ই. বশিরকে খুন করে রাজন। শাহীন এবং ই. বশিরের সেদিন একটা মেয়েকে নিয়ে রাত কাটানোর কথা ছিল।
কিন্তু রাজন শাহীনকে ইচ্ছে করে সেদিন প্রচুর মদ পান করানোয় শাহীন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে। ই. বশির সেদিন ভাড়া করে আনা মেয়েটিকে তার রুমে নিয়ে যায়।
লোভাতুর জিহবা দিয়ে লেহন করে মেয়েটির স্পর্শকাতর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। রাজন আগে থেকেই প্লান করে মেয়েটির শরীরের প্রতিটি কোণায় কোণায় বিষাক্ত স্যারিন বিষের তরল দ্রবণ মেখে দিয়েছিল। ই. বশিরের জিহবা থেকে স্যারিন প্রবাহিত হয়ে যায় তার পুরো শরীরে। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। বশির যেহেতু লুকিয়ে লুকিয়ে আসতো শাহীনের বাসায়, তাই শাহীনের বাসায় আসার কথা কেউ জানতো না। প্রমাণ ও ছিলনা। নিঁখোজ হওয়ার দুদিন পরেও কেউ খুঁজে পায়নি ই. বশিরকে।
লতিফ জানতো ই. বশির কোথা থেকে গায়েব হয়েছে এবং কে এর জন্য দায়ী। সে ভেবেছিল শাহীন ই. বশিরকে খুন করেছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অপকর্মে লিপ্ত থাকত লতিফ এবং বশির।
লতিফ বশিরের বাড়ির সবার সম্পর্কে প্রায় সব কিছুই জানতো। তাই সে শরণাপন্ন হয় রবিনের। রবিন হলো ই. বশিরের আপন জমজ ভাই। লতিফ সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলে। রবিনকে বসিয়ে দেয় বশিরের জায়গায়। রবিনও তার ভাইয়ের খুনীকে হত্যার জন্য প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ই. বশিরের লাশ রাজন আমার কাছে পৌঁছে দেয়ার পর আমি নিজ হাতে কেটে টুকরো টুকরো করেছিলাম। তাই বুঝতে পারলাম ঘটনাটা কি ঘটেছে।
শাহীন যেদিন রাতে মারা গেল সেদিন আমার কাছে খবর আসে শাহীনকে মেরে ফেলার জন্য প্লান করা হয়েছে। এ শহরের বাতাসও আমার কানে কোথায় কি হচ্ছে তা বলে যায়।
কথা বলা শেষ করে শহর দাঁড়িয়ে যায়।
– আজ উঠি মিস্টার রবিন। আপনি যা করেছেন তাতে আমার এ বিষণ্ণ শহরের কোন ক্ষতি হয়নি। নিশ্চিন্তে নিজের কাজ করে যান।
নিজের চেয়ারে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে রবিন খান। তার বলার আর কিছুই নেই।
.
.

.
হুরায়রা এবং শহর পাশাপাশি হাঁটছে। হুরায়রা জিজ্ঞেস করছে, রবিন লতিফকে মারলো কেন?
শহর জবাব দেয়,
“রবিন, ই. বশিরের মত দূর্নীতিবাজ নয়। কিন্তু সে হুট করে বদলে গেলে তার উপর সন্দেহ আসতে পারে। এজন্য আস্তে আস্তে ই. বশির হিসবে ভালো হয়ে উঠছে। খবর নিয়ে দেখেছি ঘুষ নেয়া টাকা দান করে দিচ্ছে গরিব দুঃখীদের ভেতরে।”
-তোমার ওখানে আরো অনেকের মৃতদেহ পেয়েছি।
– হুম। ওরা সবাই আমার কুকুরদের খাবার হয়েছে। অপরাধের শাস্তি নিজ হাতে দিয়ে যদি ভালো কিছু হয় তবে খুনই ভালো।
হুরায়রা কিছু না বলে শহরের পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটতে থাকে।
কিছুক্ষন পর হুরায়রা জিজ্ঞেস করে তোমার ব্যপারে তো অনেক কিছু জানলাম আমার ব্যপারে কিছু জানতে চাইলে না?
.

জানতে চাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমার অন্ধ বন্ধুটির চোখ ভালো হওয়ার কারণ। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে এসেছ পর থেকে ও চোখে দেখতে পাচ্ছে।
পুনমের বাসার নিচতলায় ঢুকতে হলে মোটা লোহার গেট সরাতে হয়। আমি কপিকল ব্যবহার করি। তুমি হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়েছ। এবং আমি শাহীনের ছবি তোমাকে দেখতে নিষেধ করেছিলাম কেনো জানো?
– কেনো?
– শাহীন যেদিন মারা গেল সেদিন ও আনন্দ নগর থেকে ফিরছিল। রাস্তায় তোমাকে একা পেয়ে তোমার শরীরে বাজেভাবে টাচ করে।
এরপর থেকে ওর গলা দিয়ে অনবরত মেয়েদের চুল বের হতে শুরু করেছিলো।
এতকিছুর পরেও যদি আমি বুঝতে না পারি তুমি কে, সেটা আমার নিজের কাছেই হাস্যকর।
হুরায়রা মনে মনে বলে, ওহ আচ্ছা এই শাহীন তাহলে সেই বেয়াদব ছেলেটাই। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পুনমের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে দুজনেই।
শহরকে হুরায়রা জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় যাবে?”
শহর উত্তর দেয়, “আমি একটু ছুটি চাই। তোমার আনন্দ নগর থেকে ঘুরে আসব।”
– এখন তুমি আনন্দ নগর যাবে?
– তুমিও যাবে আমার সাথে। শেষ ট্রেনের এখনো আধাঘন্টা বাকি।
– কিন্তু আমি তো রেডি হইনি।
– জীবনের সবথেকে বড় যাত্রা মৃত্যুর পথে। আমরা কি সব সময় রেডি থাকি? এসব ছোটখাটো যাত্রায় রেডি হওয়ার কিছু নেই।
– জামাকাপড় গুলো তো আনতে দিবে!
– ওগুলো পুনমের কাছেই থাকুক। পরের বার যখন মন চাইবে হুট করে চলে আসতে পারবে আমার শহরে। তখন ব্যাগ টানার ঝামেলা করতে হবে না।
আস্তে আস্তে শহর এবং হুরায়রা হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যায় সন্ধ্যের অন্ধকারে। হালকা বাতাস তাদের দিয়ে যাচ্ছে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।
…………
…………….
………………..
পুনশ্চঃ
মধ্যরাতে অদ্ভুত সব আওয়াজে ঘুম ভেংগে যায় রাজনের। চোখ মেলে তাকায় সে।
বেশ কয়েকটা কুপি জ্বলছে তার রুমে। সন্ধ্যে বেলা ঘুমানোর সময়েও এতগুলো কুপি দেখেনি রাজন।
কুপির আলোয় ঝাটা দিয়ে রাজনের রুম পরিষ্কার করার কাজ করে চলেছে সুপ্তি। সুপ্তি বড় একটা ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছে রাজনের কাছে।
মনে হচ্ছে সে আজ থেকে থেকে এখানেই থাকবে। রাজন আসলে বুঝতে পারছে না সুপ্তি কি সত্যিই এসেছে নাকি গাঁজার নেশায় তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।
সে যা-ই হোক তবে কুপির লাল আলোয় বেশ সুপ্তিকে দেখতে বড্ড সুন্দর লাগে।
———–×————
সমাপ্ত।
লেখক_ হাসিবুল ইসলাম ফাহা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে