নতুন জীবন শেষ পার্ট

0
2801

নতুন জীবন
________________
লেখিকা:বাবুনি
______________________
(শেষ পার্ট:১২)
তানছিয়া ৩টার দিকে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। যাতে চোখ থেকে ঘুম ঘুম ভাব টা সরে যায়। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল ওর দিনে রাইফের দেয়া গিফটের কথা।সে বসা থেকে উঠে গেলো, এগিয়ে গেলো সোফার দিকে। ঐখানে ই ফেলে রেখেছিল সে প্যাকেট টা।ঐটা হাতে নিয়ে খুললো সে , ভেতরে খুব সুন্দর একটা কালো বোরখা হিজাব নেকাব সহ। সত্যি অসাধারণ হয়েছে,রাইফের পছন্দ আছে বলতে হয়। আনমনে হেসে বলে উঠলো, এটাই পড়ে যাবো আজ তাহলে। একটু ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে আজান হয়ে গেল।তানছিয়া অযু করে এসে দেখলো,রাইফ এখনো ঘুমাচ্ছে। আজ সে আর ডাকলো না নামাজ পড়তে রাইফকে।নিজে নামাজ পড়ে নিলো, তারপর বোরখা হিজাব নেকাব পড়ে রেডি হয়ে নিলো। অতঃপর সাইড ব্যাগ টা হাতে নিলো। কিছু একটা ভেবে থেমে গেল,রাইফের পাশে এসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর একটুকরো কাগজ ও কলম নিয়ে কিছু একটা লিখলো।
কাগজ টা ভাঁজ করে রাইফের বালিশের পাশে রেখে, বেড়িয়ে পরলো সে।

‘ এদিকে সুমাইয়ার ডাকে ঘুম ভাঙ্গল রাইফের।সে তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে দেখলো পাশে তানছিয়া নেই। বালিশের পাশে হঠাৎ চোখ পড়লো, সেখানে একটা চিরকুট রাখা। সে চিরকুট টা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে লাগলো।


‘ আমি আপনার এবং আপনার ফ্যামিলির কাছে আর থাকতে পারলাম না। আমার ভালোবাসার মানুষ টি চলে এসেছে আমি তার কাছে চললাম। আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে নতুন জীবন শুরু করতে পারি। আর আপনি ও যাতে নতুন জীবন শুরু করতে পারেন এই দোয়া করি। আমার জন্য কোনো কারণে কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিবেন।
‌‌ আল্লাহ হাফেজ। ‘

রাইফ পড়া শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-তুমি চিনতে পারো নি এই আমাকে। আসলেই তুমি অনেক বোকা মেয়ে,যে তোমাকে নতুন জীবনের দিকে অগ্রসর করলো। তাঁকেই নতুন জীবন শুরু করতে বলে চলে গেলে। তাঁকে ফেলে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছো। আশ্চর্য মেয়ে তুমি, সত্যি তোমার মন বুঝতে পারলাম না আজ ও।

ইতিমধ্যে শিরীনা বেগম রুমে প্রবেশ করলেন।
ছেলের চোখের কোণে জল দেখে। এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-” চলে গেছে ও তাই কান্না করছিস_!”
রাইফ তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল,
-” কই না তো।”
-” মায়ের কাছে আড়াল করছিস। আমি জানি তো তুই তানছিয়া কে অনেক ভালোবাসিস।আর আমার পুরো বিশ্বাস আছে, আজকের পর থেকে তানছিয়া ও তকে অনেক ভালোবাসবে।”
রাইফ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” তাই যেনো হয় আম্মু।”
শিরীনা বেগম ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন।
ইতিমধ্যে সুমাইয়া ও রুমে আসলো।
-” ভাইয়া তুমি এখনো যাওনি _! ভাবিকে নিয়ে আসো যদি আবার ভাবি ওনার বাসায় চলে যায়।”
রাইফ ফোন টা হাতে নিয়ে টাইম দেখে বলল,
-” যাচ্ছি নামাজ টা পড়ে নেয়।”
নামাজ পড়ে সে মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
-” আমি গেলাম আম্মু।”
শিরীনা বেগম বললেন,
-” হুমমম যা বাবা বউমাকে সাথে নিয়ে ই ফিরিস।”
-” ঠিক আছে আম্মু”

রাইফ বাইক টা নিয়ে বেড়িয়ে পরলো। বটতলা থেকে কিছুটা দূরে বাইক থামিয়ে।বাইক টা রেখে পায়ে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে সে।

‘ এইদিকে তানছিয়া, প্রায় ২ ঘন্টা যাবত ওয়েট করেও যখন তামিনের দেখা পেল না। তখন ঐ নাম্বারে একটা টেক্সট পাঠালো।

‘কোথায় তুমি _! তোমার তো আমার আগে এখানে উপস্থিত থাকার কথা। তাহলে এখন দু ঘন্টা যাবত ওয়েট করছি, তোমার কোনো খুঁজ নেই কেন_!’

সাথে সাথে ওপাশ থেকে মেসেজ আসলো।
‘ দু ঘন্টা কেন_! সারাদিন সারাজীবন ওয়েট করলেও তুমি আমার দেখা পাবে না। হা হা সেদিন বলেছিলাম না তুমি কখনো সুখী হতে পারবে না।আজ দেখো তুমি কতটা অসহায়।এই আমাকে বিশ্বাস করে তুমি তোমার স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে এলে। আবারও তুমি ভুল করেছো তানছিয়া। তুমি কি করে ভাবলে তোমার মতো একটা বিবাহিতা মেয়েকে আমি বিয়ে করবো_! তাছাড়া তুমি এখনো রাইফের স্ত্রী ওকে তো তুমি ডিভোর্স দেও নি।আর না তো ও দিয়েছে। এখন তুমি কি করবে_! তোমার তো স্বামীর বাড়ি ও জায়গা হবে না।আর না তো তোমার বাবার বাড়ি।
গুড বাই মিসেস তানছিয়া।
তোমার ব্যাড বয়ফ্রেন্ড তামিন।’

তানছিয়ার যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায়। সে কি করে এই খারাপ ছেলেকে আবার বিশ্বাস করে ,এতো ভালো স্বামী এবং তার পরিবার কে ছেড়ে চলে আসলো।
কি করবে এখন সে,তামিন যে আবার তাঁকে ধোঁকা দিলো। এখন সে কার কাছে যাবে_!
না তো ওর স্বামী ওকে গ্রহণ করবে।না তো ওর পরিবার,তানছিয়ার চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসলো। চোখ দুটো জলে ভরে ঝাপসা হয়ে আসছে।সে এইখানে ই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আর বলতে লাগলো,
– কি করলাম আমি_! কি করে এতো বড় ভুল করে ফেললাম আমি_! আমি এখন কোথায় যাবো_! কে আমাকে আশ্রয় দেবে_!

ঠিক তখনই কারো স্পর্শ পেলো ওর কাঁধে।
চোখ তুলে উপরের দিকে তাকিয়ে ঝাপসা চোখে দেখলো সে রাইফকে।
-” আপনি _!”
রাইফ ওর চোখ দুটো মুছে দিয়ে ওকে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
-” হ্যাঁ আমি। যাকে তুমি নতুন জীবন শুরু করতে বলে ছেড়ে চলে এসেছো।”
তানছিয়া আচমকা রাইফ কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
-” রাইফ প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার সেই স্ত্রী হতে চাই যাকে তুমি নিজের হাতে খাইয়ে দিতে পারো‌। আমি তোমার সেই স্ত্রী হতে চাই যাকে নিয়ে তুমি নতুন জীবন শুরু করতে পারো। আমি তোমার সেই স্ত্রী হতে চাই যাকে নিয়ে তুমি গর্ব করতে পারো। বলো না দিবে না আমাকে এই সুযোগটা_! আমি কখনো আর ভুল পথে পা বাড়াবো না। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
রাইফ তাঁকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলল,
-” তুমি যে আর এসব করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে_!”
-” আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো রাইফ। যাকে তুমি নতুন জীবন দান করেছো।যাকে তুমি নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছো। সেই আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। জানি আমার ভুল ক্ষমার অযোগ্য। তবুও মানুষ ভুল করে সেই ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে। তাকে ক্ষমা করে দিয়ে আরেকটা সুযোগ দেয়া কি উচিত নয় ভালো হবার জন্য।”
রাইফ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
তানছিয়া ওর পা ধরে বসে কান্না করতে করতে বলল,
-” শুনেছি স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত। আমাকে তুমি অনেক ভালোবাসো রাইফ আমি জানি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমাকে বেহেস্ত এর মতো চির শান্তির স্থান থেকে বঞ্চিত করো না। আমি বাকি টা জীবন তোমার সেবা করে কাটিয়ে দিতে চাই প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
এবার রাইফের চোখে জল চলে আসলো।
তানছিয়াকে উঠিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
-” তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। তাছাড়া আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষকে কি করে দূরে ঠেলে দেই বলো_! তাছাড়া সবথেকে বড় কথা তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী। তবে তুমি আমাকে কথা দাও আজ থেকে তুমি আর কোনো ভুল পথে পা বাড়াবে না। আমার কথা মতো চলবে। ”
-” ঠিক আছে আজ থেকে তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি তোমার সব কথা শুনবো কখনো তোমার অবাধ্য হবো না।”
-” তাহলে চলো বাসায় যাওয়া যাক। বাইক টা তুমি ই চালিয়ে নিয়ে যাবে আজ। আমি পিছনের সিটে বসবো।”
তানছিয়া একটু অবাক হয়ে বলল,
-” আমি চালাবো_!”
-” হ্যাঁ ম্যাডাম আপনি চালাবেন। বাইক চালিয়ে ট্রফি নিয়ে আসতে পারেন।আজ স্বামীকে নিয়ে যেতে পারবেন না _!”
তানছিয়া মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,
-” কেনো নয়, পিছনে বসেন মিস্টার।”
রাইফ ও মুখে হাসির রেখা টেনে পিছনে বসলো। তানছিয়া বাইক স্টার্ট দিল।

‘ প্রায় ৭ মাস পর রাইফ তানছিয়ার কোলে আলতো করে মাথা রেখে শুয়ে আছে।আর তানছিয়া কোরআন তেলাওয়াত করছে।
এই ৭মাসে সে পুরোপুরি ভাবে ইসলামীক জীবন যাপন করছে । কোরআন তেলাওয়াত শিখে গেছে, ঠিক মতো ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও পড়ে।
তানছিয়ার কোরআন তেলাওয়াত শেষ হলে।রাইফ ওর পেটে কান লাগিয়ে বলল,
-” মেয়ে হবে না কি ছেলে গো_!”
তানছিয়া দুহাতে মুখ ঢেকে বলল,
-” যাহ দুষ্ট আল্লাহ যা দেয় তাই হবে।”
রাইফ ওকে কাছে টেনে নিয়ে ওর কপালে চুমু খেলো।

আরো ২ মাস পর রাইফ হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারী করছে।আর আল্লাহ কে ডাকছে। হঠাৎ একজন মহিলা ডাক্তার বেড় হয়ে এসে বলল,
-” রাইফ সাহেব, আপনার মেয়ে হয়েছে। মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন।”
-” আলহামদুলিল্লাহ, অবশ্যই মিষ্টি খাওয়াবো। আমার স্ত্রী কেমন আছে_!”
-” আপনার স্ত্রী এবং সন্তান দুজন ই সুস্থ আছেন।”
-” আমি কি দেখা করতে পারি_!”
-” জ্বি অবশ্যই।”

রাইফ তানছিয়ার পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে,ওর কপালে চুমু খেলো। তারপর ওর মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে এত্তগুলা পাপ্পি দিলো। তারপর ওকে তানছিয়ার পাশে রেখে।ওর দিকে সেই ট্রফি টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-” থ্যাংকস ম্যাডাম আমার ঘরে প্রথম কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে। জান্নাত উপহার দেয়ার জন্য।”
তানছিয়া অবাক হয়ে বলল,
-” এই ট্রফি তো আমি ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। ভালো হলো কিভাবে।”
-” আমি ঠিক করে ফেলেছি।”
দুজনের মুখে ই তৃপ্তির হাসি।
তাদের সুখের সংসার শুরু হলো, শুরু হলো ওদের মেয়েকে নিয়ে ওদের নতুন জীবন।
রাইফ ও নিজস্ব একটা অফিস খুলেছে।বেশ সুখেই দিন কাটছে ওদের।

( একটা মিথ্যা নাটক যদি কাউকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। তাহলে দোষ কি সেই নাটক করতে। সেদিন তামিনের ফোন রাইফের বন্ধু সাগর ওকে দিয়েছিল।আর ওর প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করেই ,তানছিয়াকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে রাইফ। যদিও পরে সত্যি টা তানছিয়াকে জানিয়েছে সে।তামিন আজ ও তার ভুলের শাস্তি পাচ্ছে। জেলখানার অন্ধকারে চারদেয়ালে বন্দি হয়ে। )

# আশা ভালোবাসা স্বপ্ন নিয়ে তৈরি হয় একটা সংসার। সেখানে দুজন মানুষের মধ্যে একজন যদি ভুল থাকে। তাহলে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কিন্তু অপরজনের।

পুরো গল্প টা কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন এই দোয়া করি। _আল্লাহ হাফেজ_

_ সমাপ্ত _

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে