একটুখানি সুখ পর্ব-২৫+২৬

0
1164

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫

“মোহ আপু, স্বচ্ছ ভাইয়েরা তো এখনো এলো না। আসবে না নাকি? বিয়ে করবে তো?”
মোহের মাথায় লাল রঙের পাতলা কাপড় জড়িয়ে দিতে দিতে কিছুটা ভার কন্ঠে বলে উঠল কথাটা তৃণা। সঙ্গে সঙ্গে কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়ল মোহের। ঘরে থাকা বড় ঘড়িটার দিকে তাকালো সে। ঘড়ির কাটা ২ টা ৩০ মিনিট পার করে যাচ্ছে। নামাজ শেষ করেই রওনা দেওয়ার কথা ছিল পাত্রপক্ষের। বেশ অনেকক্ষণ আগেই নামাজ শেষ হওয়ার কথা! আর মোহের ও স্বচ্ছের বাড়ির দূরত্ব অনেক দূরেও না। বেশ কয়েকটা বড় শ্বাস ফেলে মোহ বলল,
“আমি কি করে জানব? এসে যাবে হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যে।”

“সত্যি আসবে তো?”

“আসবে না কেন? কি বলতে চাইছো তুমি?”
তৃণাকে কটাক্ষ করে প্রশ্নটা করল মোহ। তৃণা কিছুটা বিদ্রুপ করেই বলল,
“আমি কিন্তু জানি সকাল বেলা তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে স্বচ্ছ ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করে এসেছো। আমি দেখেছি।”

বিস্ময়ের সঙ্গে তাকালো মোহ।
“তুমি এতো ভোরে…”

“আসলে কি বলো তো! আমার ঘুমই কেঁড়ে নিয়েছো তুমি। স্বচ্ছ ভাইয়াকে আমার থেকে কেঁড়ে নিয়ে আমার ভালো থাকাটাও কেঁড়ে নিয়েছো। খুব নিষ্ঠুর তুমি। জানি না দেখা করতে গিয়ে আর কি কি হয়েছে তোমাদের মাঝে। আজকাল ছেলেরা তো…”

তৃণাকে কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে দেয় না মোহ। ধমকে ওঠে সে।
“চুপ করো তৃণা। তুমি এতো ছোট হয়ে কি করে এতো নিচু কথাবার্তা ভাবছো বলো তো? মাথা ঠিক আছে তোমার? তুমি না জেনে এসব কি আজেবাজে কথা বলছো? তুমি আমার ছোট বোনের মতো। তোমার সঙ্গে আমি মিসবিহেব করতে চাই না। সো প্লিজ বিহেব ইউরসেল্ফ! মিমি তো এসব জানে না তোমার ব্যাপারে। আমি চাই না জানুক। তাই আমায় বাধ্য করো না এসব করতে।”

বেশ রেগেমেগে তাকায় তৃণা মোহের দিকে। এতো দিন মোহের সঙ্গে কথাও বলেনি সে। মোহ কথা বলতে এলে বার বার এড়িয়ে করে চলে গেছে। আজকেই নিজ থেকে কথা বলল তাও আবার বিদ্রুপ করে। ছোট বয়সে নিজের পছন্দের মানুষকে অন্য কারো হয়ে দেখা যেন তার সহ্যই হচ্ছে না। মোহও কিছু করতে পারছে না। কারণটা তার বাধ্যবাধকতা।

নিজেকে ভালো করে একবার দেখে নিল মোহ। ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসা সে। আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে তার পরনের লাল রঙের জাঁকজমকপূর্ণ কাজ করা লেহেঙ্গা। এটা পড়ে সে হাঁটতে পারবে তো? তার ওপর পেন্সিল হিল! মনে মনে সে পরিকল্পনা করে নিল হাতে জুতো নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামবে। ভেবেই তার হাসি বের হলো। হাসতে গিয়েও হাসল না সে। আচমকা তার কানের কাছে বাজতে থাকল,
“এতোটা সুন্দরী কে হতে বলেছে তোমায়? আমায় গ্রাস করে ফেলবে নাকি? এবার তো আমার ভয় লাগছে!”

চমকে পেছন তাকালো মোহ। আশেপাশে কেউ নেই। সে ঘরে একা। অথচ সে শুনতে পেয়েছিল স্বচ্ছ কানের কাছে ফিসফিস করে কথাটা বলছিল। কিন্তু কোথায় সে? তার কি ভ্রম হয়েছে। ভেবে আবারও আয়নার দিকে তাকালো সে। এরূপ ভ্রমের কথা ভেবে তার মুখশ্রী লাল হয়ে এলো। আজকাল কি সব ভাবনা স্বচ্ছকেই ঘিরে হতে হবে? কেন, কেন, কেন? অনুভূতিরা কি পাল্টাচ্ছে? ভাবনারা কি পাল্টাচ্ছে। মনে দোলা লাগা কীসের সংকেত?

স্বচ্ছ আর তার পরিবার এখনো এসে পৌঁছায়নি। এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন মিসেস. নিরা। বার বার কল করে চলেছেন ওই বাড়িতে। কিন্তু কারোর ফোন থেকে কল ধরছে না। ড্রয়িংরুমে বেশ কয়েকটা অতিথিতে ভর্তি! উনারা এবার কানাকানি শুরু করে দিয়েছেন। অবশেষে মোহের এক দূর সম্পর্কের চাচি জিজ্ঞেস করেই বসলেন,
“কি গো নিরা? কোথায় পাত্রপক্ষ? পাত্রপক্ষ তো নিজেদের লোকই। এতো দেরি হয় কেন? সব ঠিকঠাক আছে তো?”

“হ্যাঁ। ঠিকই আছে ভাবি। এইতো আর কিছু্ক্ষণ।”
মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন মিসেস. নিরা। একজন বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,
“মনে তো হয় কিছু ঠিকঠাক আছে। থাকলে এতো দেরি হতো? কয়েকদিন আগেই না ওদের কুকীর্তি ফাঁস হলো? তারপরই তো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে! এখন ছেলে মানা করে দিল নাকি কে জানে!”

কথাগুলো বিড়বিড় করে বললেও মিসেস. নিরার কানে ঠিকই এসে পৌঁছালো। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বিষণ্ণ মুখ ভেবে চলেছেন ওদের আবার কিছু হলো না তো? নাকি স্বচ্ছ নিজের মত পাল্টে দিল? স্বচ্ছ এমন একটা ছেলে সে যদি ‘না’ বলে তাকে দিয়ে কখনো হ্যাঁ করানো সম্ভব নয়। এবার বেশ আতঙ্কে পড়ে গেলেন মিসেস. নিরা। বেশ জোরে জোরে তিহানকে ডাকতে শুরু করলেন উনি।
“তিহান? তিহান? কোথায় এদিকে আয় না রে।”

ডেকোরেশন কিছুটা বাকি থাকায় সেসবেই হাত লাগিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল তিহান সকলকে। মায়ের ডাক পেয়ে কিছুটা ছুটে এসে বলে,
“হ্যাঁ মা?”

“শোন না রে! সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে। খাবার জায়গাতে যতটুকু অতিথি এসেছিল সবাইকে বসিয়ে রেখেছে বাড়ির সার্ভেন্টরা। ওখানেই তো স্টেজও আছে। না জানি এতক্ষণে কে কি বলা শুরু করে দিয়েছে। স্বচ্ছকে ফোন কর। ছেলেটা মত পাল্টে দিল না তো? ভয় হচ্ছে আমার। আবার যদি ওর পরিবারও মত পাল্টে দেয়? তাহলে তো স্বচ্ছও রাজি হবে না।”

তিহান কিছু বলতে উদ্যত হলেই বেশ জোরে কারো কন্ঠে শোনা যায়।
“হোয়াট ছোট ফুপি? তোমার স্বচ্ছ যদি একবার হ্যাঁ করে তাকে ফ্যামিলি কেন সে নিজেই নিজেকে না করাতে পারবে না। সরি লেট হয়ে গেল!”

চেনা কন্ঠস্বরে হকচকিয়ে তাকান মিসেস. নিরা। স্বচ্ছকে দেখে বেশ উৎফুল্লতা প্রকাশ করলেন উনি। উঠে দাঁড়ান। সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“আরে এইতো এসেছে স্বচ্ছ!”
সামান্য লোকজন হলে কি হবে? হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায় স্বচ্ছকে নিয়ে।

গোমড়া মুখে মোহের বাড়িতে প্রবেশ করলেন মিসেস. রেবা ও নেহাল সাহেব। স্বচ্ছ হাঁটছিল নেহাল সাহেবের পাশাপাশি। সে হাঁটতে হাঁটতে তার বাবার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“মনে আছে তো আমার শর্তের কথা? বিয়ে হবে! বউ বাড়িতে যাবে। তারপরেই ভাই কোথায় আছে সেটা জেনে যাবে। কিন্তু বিয়েটা ঠিকঠাক হতে হবে বাবা। সো স্মাইল প্লিজ!”

জোর করে হাসলেন নেহাল সাহেব। এবার এই ছেলেটাও অচেনা হয়ে উঠেছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে এক রমনীকে পাবার জন্য! এক নারী যখন কোনো পুরুষের মাথায় ঝেঁকে বসে এবং যখন সেই পুরুষের মনের সাথে মিশে যায় তখনই এতোদিনের নিয়মের পরিবর্তন ঘটিয়ে সে মরিয়া হয়ে ওঠে সেই নারীকে পাবার জন্য। ভালোবাসা বড়ই বিষাক্ত!

ঘরে দম বন্ধ লাগছিল মোহের। বাহিরে চেঁচামেচি শুনে এবার ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। এতো ভারি কাজ করা কাপড়ে যেন সে ঠিকঠাক হাঁটতেও পারবে না। লেহেঙ্গার নিচের অংশের দুদিকে ধরতেই ভ্রু কুঁচকে আসে তার। কোনোমতে ধীর পায়ে দরজা ঠেলে বাহিরে করিডোরে বেরিয়ে আসে সে। দুদিক দিয়েই সিঁড়ি মোহের বাড়িতে। সিঁড়ির ঠিক মাঝখানে দাঁড়ায় সে। মাঝখান থেকে স্টেজ ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। তার দুচোখ খুঁজছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে। এতো ভীড়ে কোথায় সে? অবশেষে মোহের চোখ আঁটকায় খয়েরী রঙের শেরওয়ানি পরিহিত এক সুদর্শন পুরুষের দিকে। মুক্তভাবে হাসিতে চমৎকার লাগছে তাকে। এভাবে কেউ হাসে? হঠাৎ তাকালে তো যে কেউ হার্টবিট মিস করে ফেলতে পারে। মাথায় পাগড়ি দেওয়াতেও স্বচ্ছের অগোছালো চুল ঢাকতে পারেনি। সেটা দেখে বেশ হাসি পাচ্ছে মোহের। আরেকটু গভীর মনোযোগ দিয়ে যদি ধূসর বর্ণের মাদকতা চোখজোড়া দেখা যেত কতই না ভালো হতো! এই ভাবতেই হুট করে স্বচ্ছ মাথা উঠিয়ে করিডোরে থাকা মোহের দিকে তাকায়। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে মোহ। রেলিং ছেড়ে চলে আসে মৃদু হাসি দিয়ে। আজ তার ধরা দিতে মন চাইছে না স্বচ্ছের চোখে।

এলো কাঙ্ক্ষিত সময়। লজ্জায় একেবারে তটস্থ হয়ে গিয়েছে মোহ। মুখে রাজ্যের লজ্জা ভর করেছে তার। মুখ নিচু করে থাকতে থাকতে যেন একেবারে পড়েই যাবে। স্বচ্ছ নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন কিছুই হয়নি। সকলে অধীর আগ্রহে বসে আছে কখন মোহ ‘কবুল’ শব্দটি উচ্চারণ করবে। অথচ স্বচ্ছকে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে দম ফেলে এক নিশ্বাসে তিনবার কবুল বলে একধ্যানে মোহের দিকে তাকিয়ে আছে। সকলে হেঁসে ফেলেছিল স্বচ্ছের কান্ডে। কেউ কেউ তো বলছে, ‘ছেলের বিয়ের দেখি খুব তাড়া’। তারপরেই এসেছে মোহের পালা! সকলে উদগ্রীব।

“আপনি একটু অন্যদিকে তাকাবেন প্লিজ!”
ফিসফিস করে স্বচ্ছের উদ্দেশ্যে বলল মোহ। স্বচ্ছ আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে বলছো?”

“জি। আপনাকেই বলছি। এমনিতে সকলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি তাকিয়ে থাকায় অস্বস্তি আরো বেশি হচ্ছে।”

“আমার এতটুকু দৃষ্টিতে তুমি তো একেবারে নিচে হেলে পড়তে পড়তে কুঁজো হয়ে যাচ্ছো সুন্দরী! বিয়ের পর আমাদের সো কলস স্পেশাল নাইটে যেভাবে তাকাবো তুমি ঠিক থাকতে পারবে তো?”

লজ্জায় চমকে তাকায় মোহ। তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে আশেপাশে তাকায় সে। কাজি সাহেব আবারও বলে ওঠেন,
“মা কবুল বলো!”

“হ্যাঁ মা কবুল বলো। ফাস্ট!”
আবারও স্বচ্ছের এমন কথা শুনে রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় মোহ। বাকি সকলেও থতমত খেয়ে চেয়ে রয় স্বচ্ছের পানে। সবার এমন রিয়েকশন দেখে স্বচ্ছ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“আরে সবাই এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে? আমি জাস্ট ওর সাহস একটু বাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম।”

সকলে আবারও উচ্চস্বরে হেঁসে ওঠে। লজ্জা ও রাগে একাকার হয়ে ওঠে মোহ। তড়তড় করে ঘামতে থাকে স্বচ্ছের এমন কান্ডে। এই লোকটার সাথে একসাথে নাকি থাকতেও হবে। কি করে থাকবে সে? কখন কি বলে তার ঠিক নেই! দাঁতে দাঁত চেপে পাশে বসে থাকা স্বচ্ছের হাতে জোরে চিমটি কাটতে হালকা চোখমুখ জড়িয়ে মোহের দিকে তাকায় সে। কি হয়েছে সেটা চোখ দিয়ে ইশারা করে জানতে চায় স্বচ্ছ। মোহ এগিয়ে এসে স্বচ্ছের কানের কাছে বলে,
“আপনি জানেন? আপনার কথাবার্তা শুনে এখনই বিয়ে থেকে উঠে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি করে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘এমন অসভ্য লোকের সঙ্গে আমায় বিয়ে দিও না কেউ!’ একটু তো মুখ কন্ট্রোল করুন।”

বাঁকা হাসে স্বচ্ছ। হালকা ফুঁ দিয়ে বলে,
“ইউ নো হোয়াট? এখন যদি তুমি বিয়ে নাও করতে চাও তাহলে তোমায় জোর করে বিয়ে করব। কারণ তুমি আমার জন্য আজ তৈরি হয়েছো। সেটা বৃথা যেতে দিচ্ছি না আমি। আর আমি ঠিক করে নিয়েছি সেই হরিণী চোখ যা লজ্জায় পরিপূর্ণ থাকে! সেই লজ্জা সবসময় আমি দিতে চাই।”

স্বচ্ছের চোখের দিকে তাকালো মোহ। স্বচ্ছের চোখজোড়ায় মোহের বড্ড পছন্দের। পুরুষ মানুষেরও যে এতোটা সুন্দর চোখ হয় জানা নেই মোহের। সুন্দর করে আবৃত চোখের পাপড়ি আরো মোহনীয় করে তুলেছে। এবার মিসেস. নিরা এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন,
“মোহ! তুই কবুল বলবি না? সবাই কিন্তু অন্যরকম কথা বলবে।”

ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে ঢক গিলে নেয় মোহ। চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। কথায় আছে অতীত পিছু ছাড়ে না। মোহের অতীতটাও ছাড়ছে না। সে অতীতটাকে আর পছন্দ করে না। চায় না আয়মান নামক বিষাক্ত মানুষটাকে। যে অসময়ে তাকে ছেড়ে গিয়েছে। স্বচ্ছের সাথে কাটানো মূহুর্ত মনে হতেই অনুভূতিরা যেন সুন্দর হয়ে এলো। তিরতির করে কাঁপছে মোহের ঠোঁট। নিশ্বাস নিয়ে তিনবার কবুল বলেই দিল সে। কেউ আলহামদুলিল্লাহ বলবে তার আগেই স্বচ্ছই উচ্চস্বরে আলহামদুলিল্লাহ বলে ফেলল। আবারও বসে গেল হাসির রোল। মোহও মুচকি হেঁসে বন্ধ নামিয়ে ফেলল চোখ। তার কানে ভেসে এলো স্বচ্ছের শীতলতায় ভরা কন্ঠ!

“সো মিসেস. আহিয়ান হয়েই গেলে এট লাস্ট। নির্ঘুম কাটিয়ে দিতে হবে আমায় সারা রাত। কারণ সুন্দরী তো আমাকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে কাটাবে আজ থেকে সারাজীবন। শেষ নিঃশ্বাস অবধি। কি কাটাবে তো?”

চলবে…

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬

স্বচ্ছ নিজের হাতটা মোহের দিকে বাড়িয়ে তার দিকে আশাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোহ বসে বসে হাত কচলে আশেপাশে তাকিয়ে যাচ্ছে। আবার একবার স্বচ্ছের দিকে তাকাচ্ছে। আয়মানের সঙ্গে তার বিচ্ছেদের পর তার ভয় করছে অন্যকারোর সাথে স্বপ্ন দেখার কথা ভাবতে। যদি স্বচ্ছও তার মতো হয়? আর মোহ ভুলে যায়নি স্বচ্ছের সঙ্গে অনেক মেয়ের সম্পর্ক! এসব ভেবে মনে আগমন হয় বিষণ্নতার। মোহ স্বচ্ছের হাতে হাত রাখে না। একটা মেয়ের কাছে সব থেকে বেশি যন্ত্রণার প্রিয়মানুষের অন্য মেয়ের সঙ্গে। এটা যেন মৃত্যু সমান যন্ত্রণার। মুখ ঘুরিয়ে মোহ ধীর কন্ঠে বলল,
“আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন? আমাদের বিয়ে একটা বাধ্যবাধকতার সূত্রে গাঁথা? হয়ত ভুলে যাচ্ছেন। আমি মনে করিয়ে দিই। নাকি এটা ভুলে যাচ্ছেন আপনার অন্য একটা লাইফ আছে। সেখানে অসংখ্য মেয়ের আনাগোনা।”

“আমার জীবনে, আমার শয়নেস্বপনে, আমার প্রতিটা নিশ্বাসে, আমার শিরা-উপশিরাতে শুধু একজন রমনীর আনাগোনা। যাকে আমি বিয়ে করেছি। শুধু তারই আনাগোনা। আমার কোনোকালে কোনো মেয়ে মনে ধরেনি। ধরবেও না।”

কান থেকে শুরু করে হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল কথাগুলো। অবাধ্য মোহের মন ও তার চোখজোড়া আবারও স্বচ্ছের দিকেই দৃষ্টি রাখল। স্বচ্ছের হেলদোল নেই কোনো। সে এখনো নির্বিকার ভঙ্গিতে তার বাড়িয়ে আছে এউ আশায় যে মোহ হাত বাড়িয়ে তার হাতে হাত রাখবে। মোহ অস্ফুটস্বরে বলে,
“তাহলে আপনার নয় নম্বর গার্লফ্রেন্ড বলেছিলেন? তবে এতোদিন…”

চোখ দিয়ে ইশারা করে মোহকে থামিয়ে স্বচ্ছ নিজ থেকে বলে,
“একটা কথা বলো! আমি যে তোমার ভার্সিটিতে গেছিলাম আর তোমায় বলেছিলাম যে আমি আমার আট নম্বর গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি। সেদিন পাঁচ মিনিটের মাঝে কি করে ওর সাথে দেখা করে আবার তোমাকে বাইকে উঠিয়ে পুলিশের কাছে গেছিলাম। গার্লফ্রেন্ড ম্যানেজ করা পাঁচ মিনিটের ব্যাপার স্যাপার নয়। তাই না?”

কিছুটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মোহের মস্তিষ্কে চাপ দিতেই মনে হলো সত্যিই তো! কিভাবে এতো দ্রুত সব কিছু ঘটল? স্বচ্ছ কেনই বা তার গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে দিয়ে এসে তাকে বাইকে তুলে নিবে? আদোও তার কোনো গার্লফ্রেন্ড নামক কিছু ছিলই না? মূহুর্তেই চোখ বড় বড় করে তাকায় মোহ। লোকটা কি মিথ্যুক! তাকে এতোদিন বোকা বানিয়ে গেছে? স্বচ্ছ মোহের রিয়েকশন দেখে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসে। তারপরেই হাসিটা মিলিয়ে যায় তার। এখনো হাতে হাত রাখেনি মোহ। আদেও কিন্তু মোহের মনে এক টুকরো অনুভূতিও জায়গা করে নিতে পারেনি স্বচ্ছ? ভাবতেই চোখমুখের রঙ পাল্টে যায় তার। গলা খাঁকারি দিয়ে হাত নামিয়ে রাখতেই খপ করে তার হাতটা চেপে ধরে মোহ। আর কিছুটা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,

“হাত নামিয়ে নিতে বলেছি আপনাকে? কেন হাত নামিয়ে নিচ্ছেন? আপনি তো দেখছি ভারি বজ্জাত লোক! বিয়েটা তো আমার সিদ্ধান্তেই হয়েছে। তাহলে কেন রাজি হবো না আপনাকে জড়িয়ে থাকতে? আপনি চাইলেও আর ছাড়ছি না আপনার হাত। বিয়ে নামক সম্পর্ককে সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিতে জানে মিসেস. আহিয়ান স্বচ্ছ। আমি প্রথমে এই অগোছালো, উগ্র মি. আহিয়ান স্বচ্ছকে গোছালো করে তুলব। মি. আহিয়ান স্বচ্ছ বড্ড অগোছালো! এই অগোছালো মানুষটাকে গুছিয়ে নিতে হবে তো।”

স্বচ্ছ হেঁসে মোহের হাত কোমলভাবে জড়িয়ে ধরে আচমকা চুমু খেয়ে ফেলে তার হাতে পিঠে। কিছুটা চমকে উঠে আশেপাশে তাকায় মোহ। চোখেমুখে লাজুকতার সীমানা নেই। সেই মূহুর্তটাই বন্দি হলো তিহানের ক্যামেরাতে।

সবেমাত্র গাড়ি এসে থামল স্বচ্ছের বাড়ির সামনে। ভার মুখে মাথা উঠিয়ে গাড়ি থেকে সামনের বাড়িটা দেখে নেয় মোহ। এমনটা নয় যে এই প্রথমবার সে বাড়িতে প্রবেশ করছে। এর আগে বহুবার এই বাড়িতে এসেছে সে। আজকের ব্যাপারটা পুরোপুরি ভিন্ন। আগে মামার বাড়ি হিসেবে বহুবার স্বাচ্ছন্দ্যে আসাযাওয়া করেছে সে। কিন্তু আজকে কেমন যেন অস্বস্তি ভর করেছে তার মনে। কারণ এটা তার একমাত্র গন্তব্য। আজ থেকে এটা তার একমাত্র ঠিকানা। নিজের বাড়ি, নিজের স্মৃতিভরা সেই বাড়ি যেখানে মা-বাবার সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য আনন্দময় স্মৃতি সেই বাড়িটা থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে সে। সারা রাস্তা নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গিয়েছে তার চোখমুখ। ফর্সা নাকের ডগা লাল চেরিফলের ন্যায় হয়ে উঠেছে। চোখের পাতায় এখনো পানি স্পষ্ট। স্বচ্ছ আজকে শুধু তার কান্না দেখেছে। এসব ব্যাপারে কি শান্তনা দিয়ে কান্না থামানো যায় জানা নেই স্বচ্ছের। কারণ নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্য একজনের বাড়িকে নিজের বাড়ি বানিয়ে নেওয়ার কঠিন পরিস্থিতিতে সে পড়েনি। কারণ সে জানে কাজটা বেশ কঠিন। যা মেয়েরা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় সারাজীবন পার করে দেয়।

সকলে নেমে গেল গাড়ি থেকে বেশ দ্রুত। ঢক গিলে বসে রইল মোহ। পাশে রয়েছে স্বচ্ছ। স্বচ্ছের এক দূর সম্পর্কের কাজিন সোহা গাড়ি থেকে নেমেই মোহের পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“ভাবি নামবে না?”

“হু!”
ছোট্ট করে শব্দ করে স্বচ্ছের দিকে তাকায় মোহ। তার সত্যিই অদ্ভুত লাগছে বাড়িতে প্রবেশ করতে। এই অস্বস্তির চোটে জ্ঞান হারাবে না তো? মোহের ঠাঁই বসে থাকা দেখে স্বচ্ছ এগিয়ে এসে বলে,
“বিলিভ মি! এক কয়েক সেকেন্ড এখানে বসে থাকলে আমি চেরীফল ভেবে তোমার নাকের ডগায় কামড় দিয়ে ফেলব।”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় মোহ। অন্যদিকে সোহা খিলখিল করে হাসছে স্বচ্ছের কথায়। লোকটার মুখে লাগাম নেই? মোহ তেতে উঠে বলে,
“আপনি কি ড্রিংকস করে বিয়ের আসরে গেছিলেন? সেখানেও অদ্ভুত কথাবার্তা আবার এখানেও?”

“তো কি করব আমি? খিদে পেয়েছে? কাছে কাছে এমন সুন্দর নাকের ডগায় চেরীফলের মতো থাকলে কি লোভ সামলানো যায় নাকি অদ্ভুত!”

“খিদে পেয়েছে? ওই বাড়িতে আসার আগে পাহাড়ের সমান প্লেটে আপনাকে খাবার দেওয়া হলো আর আপনি এই পর্যন্ত আসতেই খিদে পেয়ে গেল?”

“বাই এনি চান্স, তুমি কি আমায় খাবারের খোঁটা দিচ্ছো? এখন কি শ্বশুড়বাড়ি খাবারের জন্যও কথা শুনতে হবে?”
ভ্রু উঁচিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে স্বচ্ছ। ওমনি লজ্জা ও অস্বস্তি জানালা দিয়ে পালিয়ে রাগ ভর করে তার মনে। স্বচ্ছের হাতেই এক চাপড় মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আপনি… আপনি একটা…অসহ্যকর!”

বলেই গাড়ি থেকে নেমে যায় মোহ। সোহা এসব কর্মকান্ড দেখে হেঁসেই চলেছে। পেটে খিল ধরে যাচ্ছে তার। হাসতে হাসতেই বলল,
“আ…আমি কি ভাবিকে ধরব? ভাইয়া যে কান্ড শুরু করেছে আমি হাসতে হাসতে এখানেই পড়ে যাব।”

“ভালো করে খাওয়াদাওয়া না করলে এটাই হয়। দিন দিন এমন শুঁটকি মাছের মতো হয়ে যাচ্ছিস কয়েকদিন পর তোকে তোর ভাবির মতো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হবে। তুইও খা আর তোর ভাবিকেও খাওয়া যে কয়দিন আছিস। আদারওয়াইজ আমার পাশে তোর ভাবিকে দেখতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!”

আবারও চোখ রাঙিয়ে তাকায় মোহ। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু আত্মীয়রা মোহকে দেখবার জন্য। মোহ বেরিয়েও যেতে পারছে না। ধীর গতিতে পায়ের ধাপ ফেলছে সে। পেছন দেখে তা লক্ষ্য করে স্বচ্ছে বলে ওঠে,
“বলছিলাম না সোহা? দেখ, খেতে পারে না সেকারণে হাঁটতেও পারছে না। ছোট ফুপি খেতে দেয় না তাই না?”

“কারণটা অন্য। অযথা নিজের মতো করে একটা কারণ বের করবেন না তো।”
চোখ রাঙিয়ে কড়া কন্ঠে কথাটা স্বচ্ছের দিকে ছুঁড়ে দেয় মোহ। প্রায় সদর দরজার কাছাকাছি চলে এসেছে সে। পাশেই হাঁটছে স্বচ্ছ। সামনে সোহা। এসব শুনে স্বচ্ছের দূর সম্পর্কের চাঁচি বলে ওঠেন,
“স্বচ্ছ, এতোই যখন তাড়া তুই তখন ওকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে আয় না! নতুন বউ তো তাই ঘরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে।”

মোহ শুকনো ঢক গিলে স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে মানা করে এসব করতে। স্বচ্ছ তা পাত্তা না দিয়ে চাচির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বলে,
“বলছেন কোলে নিতে?

চাচি মাথা নাড়াতেই আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না স্বচ্ছ। তুলে নেয় মোহকে দুহাত দিয়ে কোলে। ধড়ফড়িয়ে উঠে স্বচ্ছকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে মোহ। আকুতির সুরে বলে,
” সবার সামনে কি শুরু করেছেন?”

স্বচ্ছ কর্ণপাত না করে মোহকে নিয়েই প্রবেশ করে বাড়িতে। সকলে বিষয়টা নিয়ে হৈচৈ আর হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। মোহ তো পারছে না উড়ে যেতে বা মাটির নিচে ঢুকে যেতে। এবার স্বচ্ছ নিচুসুরে বলে ওঠে,
“তাহলে কি বলছো? সবার আড়ালে এসব করতে?”
“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার!”
মিনমিন করে কথাটুকু বলেই নিজের মুখ ঢেকে ফেলল মোহ।

এতোক্ষণ এসব থেকে বেশ বিরক্ত আর ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন মিসেস. রেবা। মোহকে স্বচ্ছ সোফায় বসিয়ে দিতেই দ্রুত স্বচ্ছের কাছে এগিয়ে গিয়ে সকলের আড়ালে বললেন,
“আমার ঘরে আয় এক্ষুনি।”

সকলে মেতে উঠল নতুন বউকে নিয়ে। এই ফাঁকে মুখটা গম্ভীর করে মিসেস. রেবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় স্বচ্ছ। তার মায়ের রুমটা ছিল খোলা। তাই কিছু না বলেই ঘরে ঢুকে পড়ে সে। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস. রেবা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন,
“পেয়েছিস শান্তি? পেয়েছিস মোহকে? এখন বল সৌমিত্র কোথায়? কি করেছিস ওর সাথে?”

“রিল্যাক্স মা। ও আমারও ভাই। এমন কিছু করিনি ওর সাথে যার কারণে তোমায় হাইপার হতে হবে।”

“এখনো বলছিস কিছু করিসনি। আজ তুই যা কান্ড করলি! সেটা যদি একবার সৌমিত্রের কানে যায় ও কতটা অসুস্থ হয়ে পড়বে জানিস তুই? জানিস তো! তুইই তো ছোটকাল থেকে ওকে সামলে এসেছিস। এখন দুইদিনের এক মেয়ে তোর কাছে বড় হয়ে গেল? তুই আমার ছেলে। তোর কাছ থেকে আমি এটা আশাও করিনি।”

স্বচ্ছ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে। অতঃপর বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে,
“ওর সব অন্যায় আমি মেনেছি মা। আর সায় দিতে ইচ্ছে করে না। আমি চাই না পাপের বোঝা বাড়াতে। আজ মোহকে ভালো লেগেছে ওর। কিন্তু কাল যখন মোহ ওর কাছে পুরোনো হয়ে যাবে তখন অন্যসব মেয়ের মতো মোহেরও কি একই অবস্থা হবে? ও তোমার এক ছেলের মোহ হলেও তোমার অন্য ছেলের ভালোবাসা হয়ে উঠেছে। তাকে ছাড়া সবটা অপূর্ণতায় ভরে ওঠে আমার। তুমিও আমার সঙ্গে গেম খেলেছো। তাহলে কেন বাদ যাব? তোমার সঙ্গে আমি কোনো তর্কে জড়াতে চাই না।”

“সৌমিত্র কোথায়?”

“ও যেখানে থাকে সেখানেই আছে। অনেক আগে ওকে ওর জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। খোঁজ নিয়ে দেখো। সে এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।”
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে বসে স্বচ্ছ। মিসেস. রেবা রাগে চোখমুখ জড়িয়ে ফেলেন। ড্রেসিংটেবিলে থাকা সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দেন উনি। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসছে উনার। কোনদিকে যাবেন উনি? তার দুই ছেলে তো দুই মেরুর হয়ে উঠছে!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে